ইলমা বেহেরোজ
গিয়ে গা ধুয়ে পরনের শার্ট প্যান্ট জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিল। যেখানে ফেলেছে জায়গাটা শুকতারার অভ্যন্তরের অংশ। কোমরে গামছা পেঁচিয়ে বেরিয়ে আসে। দৌড়ে রুমে যায় লাশটা সরাতে। ততক্ষণে গান থেমে গেছে। আমির লাশ সরানোর জন্য যখনই উবু হবে তখনই পদশব্দ শোনা গেল। 10:26 পদ্মজা রুমে এসে দেখে আমির কোমরে গামছা বেঁধে খালি গায়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মজার চুল বেণি করা ছিল, এখন খোলা। শাঁড়ির আঁচল চিকন করে কাঁধে রাখা। হারিকেনের হলুদ আলোয় আমিরের শক্ত, আকর্ষণীয় কাঠামোর শরীর দেখে তার বুকে ঝড় উঠো কিছুক্ষণ আগে, স্বামীর মনোরঞ্জনের জন্য নিজে থেকে এগিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কিন্তু এই মুহূর্তে এসে সে নিজের মধ্যে তীব্র আকাঙ্খা টের পাচ্ছে। আমির মাঝেমধ্যেই শোবার আগে গোসল করে। তাই ব্যাপারটা অন্যভাবে নিল না। নিম্ন কণ্ঠে বলল, ‘ঠান্ডার দিন রাতে গোসল করার কী দরকার ছিল?’ আমির খালি হাতে চুলের পানি ঝেড়ে পদ্মজার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘সতেজ লাগলে যদি কারো নজর পড়ে, সেই আশায় অধমের রাত্রি স্নান।’ সে পদ্মজার কোমর চেপে ধরে নিজের কাছে টেনে আনল। আমির ভেবেছিল, পদ্মজা ঠান্ডা লেগে যাবে বলে চেঁচাবে, চুল মুছে দিবে, দ্রুত ঘুমাতে বলবে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে পদ্মজা আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল। আমিরের গলা জড়িয়ে ধরে তার ঠোঁটে চুমু খেল তারপর কণ্ঠমণিতে। অতল শিহরণে শিরশির করে উঠে আমির, পদ্মজার চোখের দিকে তাকায়। ওর দুটি চোখের তারায় স্পষ্ট, কাঙ্খিত মিলন। পদ্মজা পুনরায় চুমু খেল। আমির লাশ সরানোর অভিলাষকে একপাশে রেখে পদ্মজাকে পাজাকোলে নিতেই কনুই লেগে হারিকেন মেঝেতে পড়ে ভেঙে যায় কাচ। তাতে দুজনের কেউই ভ্রুক্ষেপ করলপ্রাণের স্পন্দন, দেহের স্পন্দনকে সঙ্গী করে শয্যায় গমন করে দম্পতি। উত্তাল দুটি দেহ মিত্রতা করে তীব্র ভালোবাসার আলিঙ্গনে। তাদের অভিসাস দেখে বোঝার জো নেই, বধর দেহে মগ্ন থাকা পরুষ মানুষটিকিছুক্ষণ আগে একটি হত্যা করেছে এবং লাশটি তাদের শয্যার খাটের নিচেই নিথর হয়ে পড়ে আছে। পর্ব চৌদ্দ ‘আরেকবার ভেবে দেখ, ঝুঁকি নেয়াটা কি ঠিক হবে?” আমির জবাব না দিয়ে সামনে চলে গেল। পেছন থেকে রবিন বলল, ‘ভাইয়ের পরিকল্পনাডা কী? আলমগীর আনমনা হয়ে বলল, ‘জানি না।’ গতকাল রাতে যা ঘটেছে এরপর আর ঘরে বসে থাকার মানুষ নয় আমির। সে কোনো পরিকল্পনা নিশ্চয়ই করেছে কিন্তু কাউকে বলছে না। আমিরকে এভাবে চুপ হয়ে যেতে দেখলে আলমগীরের দুশ্চিন্তা হয়। এমপি কুতুবউদ্দিনের বারিধারা বাড়িতে নেতারা একত্রিভ হয়েছে গোপন রাজনৈতিক মিটিং করার জন্য। কুতুবউদ্দিন তাড়াহুড়ো করে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। গলার স্বর বাড়িয়ে কাউকে বললেন, ‘আমার জুতা জোড়া কোথায়? এখানে রাখা হয়নি কেন?” বাড়ির কাজের মেয়ে বকুল অন্তদন্ত হয়ে জুতা নিয়ে আসল। জুতার উপরিভাগে যালু দেখতে পেয়ে
বকুল ভয়ে বিচলিত হয়ে বের হতে গেলে রফিকের সাথে ধাক্কা খায়। রফিক রেগেমেগে একটা গালি দেয়। বকুলের চোখে অশ্রু জমে। আবেগ লুকোতে দৌড়ে অন্যদিকে চলে যায়। এই বাড়ির সবকটা মানুষ বদমেজাজি আর নিষ্ঠুর। তার ভালো লাগে না এখানে। রফিক রুমে প্রবেশ করে তাড়া দিল, ‘সবাই অপেক্ষা করছে। আমাদের এখুনি যেতে হবে।’ কুতুবউদ্দিন একটা কাচের ছোট বোতল এগিয়ে দিয়ে বললেন, আণটা কেমন?’ দুবাই থেকে আসা সুগন্ধির ঘ্রাণ এঁকে রফিক জানাল, ‘চমৎকার। চারপাশ মৌ মৌ করছে।’ কুতুবউদ্দিন খুশিতে গদগদ হয়ে গেলেন। সুগন্ধি সংগ্রহ এবং ব্যবহার করা দুটোই তার প্রধান শখ। বিভিন্ন দেশের, বর্যান্ডের সুগন্ধি তার সংগ্রহে রয়েছে। পোশাকে সুগন্ধি মেখে নিচ তলায় যাবার পথে বারান্দা থেকে দেখতে পেলেন, আমির বাড়ির গেইটের ভেতর ঢুকছে। তার হাতে মদের বোতল, চলতে চলতে এগিয়ে আসছে। কুতুবউদ্দিন আঁতকে উঠলেন, ‘ও এখানে কী করে?’ রফিক বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। গতকাল রাতের ঘটনার পর আমিরের এখানে এভাবে আসার কথা না। কেন এসেছে? তাও ভরদুপুরে নেশাগ্রস্ত অবস্থায়। কুতুবউদ্দিন চোয়াল শক্ত করে বললেন, ‘ও যেন বৈঠকখানায় যেতে না পারে। কেউ যেন না দেখে।’ রফিক দ্রুত অন্য দরজা দিয়ে বের হয় আমিরকে আটকাতে, ততক্ষণে আমির বাড়ির চৌকাঠ মাড়িয়ে ঢুকে পড়েছে বৈঠকখানায়। উপস্থিত নেতা ও কর্মীরা আমিরকে দেখে অবাক হয়। কেউ কিছু বলার আগেই আমির হাতের কাচের বোতলটি মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে ভেঙে চুরমার করে দিল। ইতিমধ্যে কুতুবউদ্দিন নিচে নেমে এসেছে। রফিক এসে 10:26 দাঁড়িয়েছে ওর পিছনে। আমির চিৎকার করে কুতুবউদ্দিনকে বলল, ‘চামচা দিয়ে হুমকি না পাঠিয়ে আমার মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস করুন।’ কথা শেষ হবার আগেই হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল আমির। সে বিপর্যস্ত, নেশায় বুঁদ। কুতুবউদ্দিন অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। উপস্থিত জনতার
চেহারায় ফুটে উঠেছে বিস্ময়। কয়েকজন
কুতুবউদ্দিন ভীষণ বকাঝকা করলেন তাকে।আমিরকে সাধারণ ব্যবসায়ী হিসেবে জানলেও বাকিরা আমিরের নারী ব্যবসা সম্পর্কে অবগত। তবে কুতুবউদ্দিন কি নিয়ে হুমকি দিল সেটা তারা জানে না। প্রত্যেকে প্রশ্নবোধক চাহনি নিয়ে কুতুবউদ্দিনের দিকে তাকাল।
প্রত্যেকে প্রশ্নবোধক চাহনি নিয়ে কুতুবউদ্দিনের দিকে তাকাল। কুতুবউদ্দিন দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দিতে বললেন, ‘আমি শুধু বলেছি, আমার টাকা ফেরত দিতো নয়তো আমি পুলিশের কাছে যাব। এখানে হুমকির কিছু নেই। আমি শুধু আমার ন্যায্য চেয়েছি।’
আমির মেঝেতে ঢলে পড়েছে, কিছু একটা বিড়বিড় করছে। সকলে নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করল। গুঞ্জন শুরু হলো চারপাশে। কী হচ্ছে এসব?
রফিক দুই জনকে নিয়ে আমিরকে ধরে দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যায়। কুতুবউদ্দিন পরিবেশ ঠান্ডা করার জন্য প্রথমে খাবার পরিবেশনের সিদ্ধান্ত নিলেন। চিন্তায় আলমগীরের কপালের রগ দপদপ করছে। আমির আর কুতুবউদ্দিনের দা-কুমড়ার সম্পর্ক। বিগত বছরগুলোতে কেউ কারো মুখ স্বেচ্ছায় দেখেনি। এতগুলো বছর পর আজ আমির একা ঢুকে গেল ওই বাড়িতে। ওরা যদি আমিরের কিছু করে!
রবিন অধৈর্য্য হয়ে বলল, ‘ভাই কইলেই কিন্তু রফিক আর কুতুবরে এক মুহূর্তে উড়ায়া দিতে পারতাম। এতো ঝামেলার দরকার আছিল না।’
‘একজন নেতাকে খুন করা এতো সহজ নয়।’ আলমগীর ভেতরে যতটা না আতঙ্কিত, বাইরে ততটাই শান্ত।
রবিন বলল, ‘ক্ষুধা লাগছে, কিছু খাইয়া আসি আমি।’
অনেক চেষ্টা করেও আমিরকে স্বাভাবিক করা গেল না।
পদ্মমির পর্ব ২৩
#ইলমা_বেহেরোজ
পার্ট:২৩ এর ২য় খন্ড
অনেক চেষ্টা করেও আমিরকে স্বাভাবিক করা গেল না। তাকে পাহারা দিচ্ছে রফিক। সে সূক্ষ চোখে আমিরকে পরখ করে ভাবছে, ‘আমির নিশ্চয়ই কোনো ফন্দি এঁটেছে। ওর মতো ধূর্ত লোেক মাতলামোর জন্য এখানে আসতে পারে না।’
দরজায় কড়া নাড়ছে কেউ। রফিক বলল, ‘ভেতরে আসো।’ পারভেজ উকি দিয়ে বলল, ‘কয়েচ আইছে।
রফিক ভ্রুকুঞ্চন করল। কয়েচ তার চতুর্থ নম্বর রক্ষিতা ময়নার বাড়ির দারোয়ান। তার আগমনের কারণ কী?
রফিক ইশারা করলে কয়ো। ভেতরে আসে। আমির মেঝেতে ভিখারির মতো ঘুমাচ্ছে রফিক বলল, ‘কেন এসেছ?”
কয়েচ নম্র কন্ঠে বলল, ‘ময়না আপা আপনেরে যাইতে কইছে। আরো কইছে, অনেকদিন ধইরা যাইবেন যাইবেন কইরাও যান নাই তার বাড়িতে। আইজ যদি না যান সে পুলিশের কাছে যাইবে।’
রফিক দাঁতে দাঁত খিচে মনে মনে ময়নাকে গালি দিয়ে বলল, ‘শালি মাতারি, আর কয়টা দিন যেতে দে, তোর হাল কী করি দেখবি। শকুনও তাকাবে না।’
মুখে বলল, ‘ব্যস্ততার জন্য যেতে পারি না। আমি তার জন্য অনুতপ্ত। তুমি ময়নাকে বলো, আগামীকাল সকালে আমি যেভাবে হোক পৌঁছাবো।
মিটিং শেষ করে কুতুবউদ্দিন উপরে আসে। আমির তখন দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে
ছিল। মাথায় চুল থেকে জল পড়ছে। নেশা তাড়াতে বালতির পর বালতি পানি ঢালা হয়েছে আমিরের মাথায়। তার হাতে সিগারেট, রফিকের থেকে চেয়ে নিয়েছে।
কুতুবউদ্দিন রুমে ঢুকেই গর্জে উঠলেন, ‘তোর সাহস কত বড়া’ আমিরের গলার শার্ট খামচে ধরে। টেনে তুললেন, ‘এখন এখানে গেঁড়ে ফেললে কে বাঁচাবে?”
আমির দাঁত বের করে হাসল। ধীরে ধীরে ওর হাসি প্রশস্ত লাভ করল। যেন উম্মাদ হয়ে গেছে। রফিক কুতুবউদ্দিনকে
বাধা দিয়ে বলল, ‘আমির সই করতে এসেছে।’ পদ্মামর
কুতুবউদ্দিন কলার ছেড়ে অবাক চোখে রফিকের দিকে
তাকালেন। রফিক মাথা ঝাঁকাল। আমির তাকে এটাই বলেছে।
কুতুবউদ্দিন নিশ্চিত হতে বললেন, ‘ইয়াকিশাফির সঙ্গে কাজের চুক্তি বাতিল করার জন্য সই করতে এসেছে?’
আমির ঠান্ডা সুরে বলল, ‘আমি আমার বউকে নিয়ে ভালো থাকতে চাই। তার জন্য যা দেতে হয় দেব।’
কুতুবউদ্দিন আমিরের দিকে তাকায়। আমির কী সত্যি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে? ভয় পেয়ে গেছে
না, যতক্ষণ সই না করছে বিশ্বাস করা যাবে না। রফিক দলিল আনতে যায়। ঘন্টা খানেকের মতো সময় লাগে দলিল আনতো৷ খানেকের মতো সময় লাগে দলিল আনতো কুতুবউদ্দিন বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে আমিরের দিকে। এতো বড় চুক্তি বাতিল করবে শুধুমাত্র বউয়ের জন্য?
তাদেরকে বিস্মিত করে দিয়ে আমির সই করে দিল।
বলল, ‘বাকি যা যা চেয়েছেন, পেয়ে যাবেন। দুই তিন দিন সময় লাগবে। এই দুই-তিন দিনে কেউ আমার বাড়ির আশেপাশে যেন না যায়।’
শীতল কিন্তু ধারালো কণ্ঠ। তার চোখেমুখে কী যেন ছুটে বেড়াচ্ছে, কুতুবউদ্দিন নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতেও সেটা ধরতে পারছেন না। আমির কী চাইছে? খালি চোখে যা সেটাই কী সত্য? নাকি অন্য। কিছু আছে। দেখছে
কুতুবউদ্দিন কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘ভালো সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছো তুমি।
আমার সঙ্গে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছ এটা দিয়ে তার শোধ তুলে নিলাম।’
আমির চুপচাপ বেরিয়ে পড়ল। অর্ডারটা শেষমেশ হাত ফসকে বেরিয়ে গেল। ও প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়।
কখনো কখনো পিছিয়ে যেতে হয়, চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য।
গাড়িতে উঠেই সে ঘোষণা করল, ‘কুতুবউদ্দিনের বাড়ির দারোয়ান উল্লাহ মিয়ার বাড়িতে খোঁজ নিতে হবে, বকুল নামে তার কোনো মেয়ে আছে কি না।’
কলম নিয়ে নোটপ্যাডে একটা ঠিকানা লিখল, ‘যদি থাকে, উল্লাহকে তুলে নিয়ে এই ঠিকানায় যাবে।’ আমির একটা কাগজ ধরিয়ে দিল আলমগীরের হাতে।মিয়ার বাড়িতে খোেজ নিতে হবে, নামে তার কোনো মেয়ে আছে কি না।’
কলম নিয়ে নোটপ্যাডে একটা ঠিকানা লিখল, ‘যদি থাকে, উল্লাহকে তুলে নিয়ে এই ঠিকানায় যাবে।’ আমির একটা কাগজ ধরিয়ে দিল আলমগীরের হাতে।
গোধুলি লগ্ন। আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে সিঁদুর রাঙা মেঘ। সারাদিন বৃষ্টি হয়নি, রাতে হতে পারে। পদ্মজা জানালা দিয়ে আকাশ দেখছে। হাতে বিভূতি-ভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা চাঁদের পাহাড় বইটি। আজ কিছুতেই বইয়ে মন মজছে না। সকাল থেকে ভুবনকে কোথাও দেখতে না পেয়ে পদ্মজা চিন্তিত। এমনকি তার কাপড়চোপড়ও নেই বাড়িতে। এতিম ছেলেটা কোথায় গেল? আমির না আসা অবধি কিছু জানতেও পারবে না। আজ এতো দেরি করছে!
চলবে।
সম্পূর্ণ গল্প