জমিদার বাড়ির শেষ প্রান্তে থাকা ছনের ঘরটি থেকে ক্রমাগত ভেসে আসছে যিকিরের ধ্বনি। ভুরভুর করে বের হচ্ছে আতরের গন্ধ। ঘরের চৌকাঠে বসে যারা জিকিরের তালে কাঁদছে তারা গ্রামের সাধারণ মানুষ।
মাথা থেকে পা পর্যন্ত লেবাস এবং ওঠাবসা সুন্নত মোতাবেক হওয়া গ্রামের মানুষ বেলালকে পথপ্রদর্শক হিসেবে মানে। মুর্শিদ বলে সম্বোধন করে, তার মুরিদ হতে চায়।
বেলাল তাদের বুঝানোর চেষ্টা করেন, ‘আমি তুচ্ছ মানব, আমি পাপী বান্দা, আমি দূর্বল। একজন মুর্শিদ একটা ইঞ্জিনের মতো, আর মুরিদরা হচ্ছে বগি। ইঞ্জিন নিজেই যদি দুর্বল হয়, তাহলে এতগুলো বগি নিয়ে রেলগাড়ি কিভাবে এগোবে?’
গ্রামের সরল মানুষেরা এ কথায় বুঝ মানে না। তারা ভাবে, জীবনের অন্ধকার বিদীর্ণ করার জন্য আল্লাহ বেলালকে পাঠিয়েছেন। তারা বেলালকে নিজেদের করা পাপের কথা, অনুতাপের কথা বলতে আসে। বাঁচার কৌশল জানতে চায়, পুণ্যের পথের খোঁজ করে। কাঞ্জিপুরের খেটে খাওয়া অধিকাংশ মানুষের পাপের গল্প বেলালের বুকের সিন্দুকে জমা।
বেলাল মাঝেমধ্যে তাদের কথা শুনেন। বেশিরভাগ সময়ই লাঠি নিয়ে তাড়িয়ে দেন। চৌকাঠে প্রবেশ করতে দেন না। তবুও মানুষেরা তার কাছে আসে। বাহিরে বসে থাকে, জিকির শুনে। বেলাল ঘর থেকে বের হচ্ছে টের পেলেই, ভীতুরা উঠে পালায়, সাহসীরা থেকে যায়।
উচ্চ বর্গীয় মানুষেরা আবার বেলালকে পাগল ভাবে। তার মধ্যে জমিদার বাড়ির সদস্যরা প্রধান।
জমিদারি ভিটার নিরানব্বই ভাগ অংশে জমিদার বাড়ির দাপট, বাকি এক ভাগে বেলালের ছনের ঘর।
দুই ভাগের মধ্যখানে কাঁটাতারের বেড়া।
সুফিয়ানের দিকনির্দেশনায় মনির বাগানের কাজ করছে। তার পুরো নাম মনিরুজ্জামান। কখন কীভাবে এই বাড়িতে এলো? কে বাবা? কে মা? সে জানে না। বুঝতে শেখার পর থেকেই নিজেকে এই বাড়িতে আবিষ্কার করে। জমিদার বাড়ির প্রতিটি সদস্যের খেদমত করাই তার জীবনের শ্বাশত সত্য।
সুফিয়ান লাঠি দিয়ে উত্তরে ইশারা করে বলেন, ‘ওদিকের চারাগুলো শুকিয়ে গেছে, পানি দে।’
‘সকালে না মেঘ হইলো কাকা।’
‘ওইটুকু বৃষ্টির পানিতে কিছু হয় না। আরো দে।’
‘পানি তো শেষ।’
‘শেষ তো কী? ড্রাম থেকে নিয়ে আয়।’
মনির সেচনী নিয়ে পানি আনতে চলে যায়।
সুফিয়ান চেয়ারে বসে বেলালের ঘরটির দিকে তাকান। জমিদার বাড়ি থেকে বেলালের ঘরটিকে খেলনা বাড়ির মতো দেখায়। উঠোনে একটা ছোট কুয়া। কোনো এক কারণে ইট-পাথরের এই রাজকীয় বাড়ি থেকে বেলালের ঘরটিকে তার সুখের মনে হয়।
এমন সময় দেখা গেল শব্দরকে পশ্চিম দিক দিয়ে খাসমহলে ঢুকছে। সুফিয়ানের চোখ পড়তেই ডাকলেন, ‘শব্দর।’
ভাইকে দেখে শব্দর ছুটে এসে কোলাকুলি করল, ‘কেমন আছেন ভাইজান? ভোরে বাড়ি ফিরে আপনাকে খুঁজেছি। কোথায় ছিলেন?’
‘এইতো আগের মতোই। সকালে একটু হাঁটতে বের হয়েছিলাম। তোমার কী অবস্থা?’
‘কাজকর্ম নিয়ে একটু চাপে আছি। তবে শরীর-স্বাস্থ্য ভালো আছে।’
‘ শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকারই কথা। নতুন বিয়ে করেছো।’
শব্দর হাসল। অপরাধী সুরে বলল, ‘ক্ষমা করবেন ভাইজান। আপনার উপস্থিতি ছাড়াই… ‘
‘তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু লুকিয়ে-চুরিয়ে বিয়ের কী প্রয়োজন ছিল? আমাদের বাড়িতে কি কখনো এমন বিয়ে হয়েছে? ‘
শব্দর প্রতিত্ত্যুরে চুপ রইল। সুফিয়ান বললেন, ‘ যা হবার হয়েছে। মেয়ের বাপের বাড়ি কোথায়? বংশ কী?’
‘কালিগঞ্জে। বাবা দিনমজুর, মা নেই।’ শব্দরের কণ্ঠে সংকোচ।
সুফিয়ান লাঠি দিয়ে মাটিতে দুইবার মৃদু আঘাত করলেন। তার চোখমুখের অভিব্যক্তি দেখে মেজাজ বোঝা যাচ্ছে না। তিনি নিজমনে কিছু ভাবলেন।
গম্ভীর সুরে বললেন, ‘গরীব ঘরের সুন্দরী মেয়ে! ভালো, ভালো।’
‘ভাইজান, আপনি আমার প্রতি রাগ রাখবেন না। হুট করেই সব হয়ে গেল, ভাবিকেও জানাতে পারিনি।’
‘রাগের কিছু নেই। সুন্দর জীবন কাটাতে যে জীবনসঙ্গী প্রয়োজন দেরিতে হলেও বুঝেছো তাতেই আমি খুশি।’
সুফিয়ান থেমে তারপরে বললেন, ‘গতকাল কোথায় ছিলে? নতুন বউ রেখে রাতে বাইরে থাকা কী শোভনীয়?’
‘রাজধানীতে চাল পাঠানোর জন্য কালিগঞ্জে গিয়েছিলাম। তাছাড়া একজনকে নিমন্ত্রণ করতে যেতে হতো।’
সুফিয়ান উৎসুক হয়ে তাকালেন,
‘কে সে?’
শব্দর বলল, ‘আশিকুর জামান। শুক্রবার ছেলেকে নিয়ে আসবেন।’
‘আশিকুরের ছেলে বিলেতে থাকে না?’
‘উনার একটা দত্তক ছেলেও আছে।”
সুফিয়ান শব্দরের পিঠ চাপড়ে বলেন, ‘ভালো করেছো। ব্যবসায় লাভবান হতে গেলে আশিকুর জামানের মতো ধনকুব ব্যবসায়ীদের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত।’
‘আপনি আমাকে বিশ্বাস করে ব্যবসার দায়িত্ব দিয়েছেন। উন্নতির জন্য জীবন দিয়ে দেব ভাইজান।’
সুফিয়ান খুশি হয়ে বললেন, ‘চলো হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।’
‘চলুন।’
দুই ভাই হাঁটতে হাঁটতে তাদের পারিবারিক কবরস্থানের কাছে পৌঁছে যায়। জুলফা জানালা দিয়ে তাদের দেখছে। তার চোখমুখ ফ্যাকাসে। সারাটা দিন কেটে গেল গভীর আলস্য ও রাগ নিয়ে। একটা দানাও নেই পেটে। ক্ষুধায় পেটের ভেতর গুড়গুড় শব্দ হচ্ছে৷
খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকে রেণু। জুলফাকে বাইরে তাকিয়ে থাকতে দেখে খাবার রেখে চলেই যাচ্ছিল জুলফা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে ধমকে উঠল, ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে? আমি যে খাইনি খেয়াল ছিল না?’
রেণু ড্যাবড্যাব করে তাকায়। জুলফা বিরক্তিতে আওড়ায়, ‘তুমি তো আবার বোবা। কী জ্বালা! তোমার কর্তী কি এতক্ষণে বলেছে খাবার দিয়ে যেতে? মাথা নাড়িয়েই বোঝাও।’
রেণু মাথা ঝাঁকায়। জুলফা খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে বিছানার উপর দুই পা ভাঁজ করে বসে বলল, ‘তুমি শুধু ওই রগচটা মহিলারই গোলামি করো কেন? বেশি খেতে দেয় নাকি বাড়তি টাকাপয়সা দেয়?’
রূপা ডানেবামে মাথা নাড়ায়, এসব কিছুই না। রেণু অসম্ভব সুন্দর। তবে তার দিকে তাকালেই সর্বপ্রথম চোখে পড়ে কপাল থেকে নাক বরাবর গাঢ়, কালো কাটা দাগটির উপর। জুলফা খাবার চিবোতে চিবোতে বলল, ‘নাকের দাগটা কীসের? কেউ মেরেছে?’
রূপা কোনো ইঙ্গিত দিল না। জুলফার কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘কোনো দূর্ঘটনা ঘটেছিল?’
এবার সে সাড়া দিল। উপরে-নিচে মাথা নাড়িয়ে জানাল, দূর্ঘটনা ঘটেছিল৷ জুলফা আর ঘাঁটল না। অন্য মানুষের জীবন নিয়ে তার কোনো আগ্রহ নেই।
সে জমিদার বধূর মতো হাত নাড়িয়ে বলল, ‘ঠিক আছে, যাও।’
সন্ধ্যার মৃদু অন্ধকার কখন মিলিয়ে গিয়েছে, অন্ধকারটা গাঢ় থেকে গাঢ় হতে হতে কখন জ্যোৎস্নায় পরিণত হয়েছে — কান্নারত জুলফা তা মোটেই খেয়াল করেনি।
সন্ধ্যা থেকে বিছানার ছোট্ট বালিশটিকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে শব্দহীন কান্নায় সময় কাটিয়ে দিয়েছে।
কতটা কষ্ট বুকের মাঝে ধারণ করলে একটা মানুষ এভাবে নিঃশব্দে কান্না করতে পারে তা শুধু যে মানুষটি শব্দহীন দুই চোখের অশ্রু ঝরিয়েছে সেই বুঝতে পারে। দুঃখ-যন্ত্রণার অগ্নিকুণ্ডের লেলিহান শিখায় প্রতিনিয়ত শেষ হয়ে যাচ্ছে বুকের খাঁচার অচিন পাখি। জুলফা চাদর খামচে ফুঁপিয়ে উঠে।
হঠাৎ পিঠে ঠান্ডা স্পর্শ পেয়ে থমকে গেল, চুপসে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে আবছা অন্ধকারে শব্দরকে দেখে দ্রুত উঠে জানালার কার্নিশে গিয়ে দাঁড়াল।
শব্দর এক হাতে হারিকেন নিয়ে জুলফার মুখোমুখি দাঁড়ায়, অন্য হাত বাড়ায় চোখের জল মুছে দিতে, জুলফা রাগে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নারী কান্না দিয়ে বড় বড় দাম্পত্য কলহের সহজ সমাধান করে দিতে পারে। ঝগড়া জিততে পারে, মান-অভিমান ভাঙাতে পারে, এমনকী রাগে ফুঁসতে থাকা স্বামীকেও নিমেষে মানিয়ে নিতে পারে। শব্দরও তেমনই একজন নিরীহ স্বামী। ভেবেছিল ফিরে আরো কতগুলো কথা শোনাবে কিন্তু ঘরে ঢুকেই যখন দেখল জুলফা কাঁদছে মুহূর্তে রাগ গলে পানি হয়ে গেল। কী এমন আছে নারীর চোখের অশ্রুতে? কেন এতো আকর্ষণ? আক্রমণাত্মক মনোভাব ছেড়ে রাগী, জেদি শব্দরও অনুভব করছে সে এই মুহূর্তে একজন শান্ত, শিষ্ট পত্নী নিষ্ঠ ভদ্রলোক।
সে জুলফার চোখের জল মুছে দিয়ে নরম কণ্ঠে বলল, ‘ক্ষমা চাই, আমি অনুতপ্ত।’
জুলফা নিশ্চুপ। শব্দর পরম সোহাগে শুধাল, ‘এত পছন্দ করে বিয়ে করে নিয়ে এসেছি কি খারাপ আচরণ করতে? তুমি অতিরিক্ত কথা…’
জুলফার চাহনি দেখে শব্দর থেমে গেল৷ ক্ষমা চাওয়ার মুহূর্তে পত্নীর দোষ নিয়ে কথা না বলাই সমীচীন হবে।
সে হারিকেন রেখে জুলফাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে খুব পছন্দ করে বিয়ে করেছি। তুমি এখন জমিদার বাড়ির বউ। আমার…’
জুলফা তীব্র গতিতে জানাল, ‘আমিতো আপনাকে পছন্দ করি না। জমিদার বউও হতে চাইনি।
‘কেন করো না? কিসের অভাব আমার?’
শব্দরের উৎকণ্ঠা। সে জুলফার কাঁধ শক্ত করে চেপে ধরল, ‘কী চাই তোমার? সোনাগয়না, বাড়িঘর সব তোমার। তোমাকে কিছু করতে হবে না৷ সামনে-পেছনে দাসীদের লাইন লাগিয়ে রাখব। বলো কী চাও?’
জুলফা ভর্ৎসনা করে হাসল। হারিকেনের নিভু নিভু হলুদ আলোয় তার চোখের জল চিকচিক করছে৷ সে লণ্ঠন হাতে নিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল , ‘এই আগুন আমার শাড়ির আঁচলে লাগিয়ে দিন অথবা ফিরিয়ে দিয়ে আসুন।’
শব্দর অসহায়বোধ করে। এই মেয়েকে কিছুতেই বশ করা যাচ্ছে না। তার ঔদ্ধত্য কিছুতেই কমে না।
সে কাঠকাঠ গলায় বলল, ‘এখন তোমার সাথে আমাদের সম্মান, ঐতিহ্য, খ্যাতি জড়িয়ে গেছে। তুমি আমার সঙ্গে, এই পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে নাও। এটাই তোমার ভবিতব্য। তোমার জন্য কোনো রকম বিশৃঙ্খলায় যেন না পড়ি। এই পরিবারের কোনো অসম্মান যেন না হয়।’
জুলফার দৃষ্টি কঠোর হলো, ‘অসম্মান হলে কী করবেন?’
‘গলা টিপে মেরে ফেলব।’
শব্দর কিছু বুঝে উঠার পূর্বে জুলফা তার হাত নিজের গলায় চেপে ধরে বলল, ‘মেরে ফেলুন।’
জুলফার চোখের তারায় জ্বলছে হারিকেনের আগুনের প্রতিচ্ছবি, মুখখানা কী অপরূপ দেখাচ্ছে!
শব্দর মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
প্রেমে পড়ার অন্তিম বয়সে এসে যখন সে ভেবেছিল আর কখনো প্রেমে পড়া হবে না তখন জুলফার তেজস্বী দুটি সুন্দর চোখের সাক্ষাৎ ঘটল। সঙ্গে সঙ্গে ধূলোয় পরিণত হয়ে গেল অবিবাহিত থাকার পণ।
শব্দরের চোখের শীতলতা টের পেয়ে সরে যেতে গেলে গভীর আলিঙ্গনে আটকা পড়ে জুলফা।
শব্দর গলার স্বর নামিয়ে বলে, ‘একবার আমাকে মন থেকে কবুল করে নাও। সবসময় প্রতিদ্বন্দ্বী, অপছন্দের মানুষ ভেবো না। নিশ্চয়ই আমার মধ্যে ভালো কিছু আছে। সেগুলো ভাবো। একদিন তুমিও ভালোবাসবে।’
ভালোবাসার কথা শুনতেই জুলফার চোখের পর্দায় ভেসে উঠে নাম না জানা এক পুরুষের হাস্যোজ্জ্বল মুখ৷ যার প্রেমের আগুনে দগ্ধ হয়ে গেছে জুলফার মতো সুন্দরী পতঙ্গ।
সে শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে শব্দরকে ঠেলে সরাতেই যাবে তখন বনের দিকে দৃষ্টি পড়ল। একটা সংকেত, একটা আলো এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে।
মাঝরাত। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে হুতুম পেঁচা’র ডাক আর শেয়ালের আর্তনাদ। জুলফা সন্তর্পণে স্বামীর নগ্ন বুক থেকে সরে যায়। একবার তাকিয়ে নিশ্চিত হয় শব্দর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সে আর বিলম্ব করল না। একটা ব্যাগে নিজের কয়টা শাড়ি ঢুকিয়ে জুতা খুঁজে না পেয়ে খালি পায়ে বেরিয়ে পড়ে। ভক্ষিত তৃণের উপর দিয়ে প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে বনের দিকে।
®ইলমা বেহরোজ
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/noboralink/
[পরবর্তী পর্ব মঙ্গলবার]