#ফাবিয়াহ্_মমো
বাইরে রিমঝিম বৃষ্টি। গাড়ির একটা জানালা খোলা, ড্রাইভিং সিটের জানালা পুরোপুরি বন্ধ। পূর্ব পূর্ণতার গলায় মুখ লুকিয়ে জাপটে ধরে স্টিয়ারিংয়ের সাথেই ওকে ঠেসে ধরে আছে। পূর্বের পিঠে হাত বুলিয়ে জানালার বাইরে বৃষ্টির পানির হেলদেল দেখছে পূর্ণতা। চারপাশ সুনশান হয়ে আছে, মাঝে মাঝে ভয়ে গা ছমছম করে উঠছে ওর। আকাশ ফুলে ফেঁপে দিনের আলোর মতো উজ্জ্বলিত হয়ে আবার তিমির আধারে মিলিয়ে যাচ্ছে ক্ষনে ক্ষনে। পূর্ণতা চোখ গলিয়ে অশ্রু ছেড়ে পূর্বের মাথায় শক্ত করে চুমু বসিয়ে বলে উঠে,
– বাড়ি যাবেনা? এভাবেই ধরে থাকবে?
পূর্বের ভারী নিশ্বাস ফেলার শব্দ আসলো। ও কি এখনো কাদঁছে? কিছু বুঝে উঠার আগেই হাত আলগা করে পূর্ণতাকে স্টিয়ারিং থেকে উঠিয়ে সোজা করে কোলে বসিয়ে নিলো। গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে চোখদুটো বন্ধ করে নিলো পূর্ব। পূর্ণতা মুগ্ধ হয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে পূর্বের দিকে। নাকের শেষ মাথাটা গোল হয়ে লাল হয়ে আছে। বাচ্চারা ফুপিয়ে কাঁদার পর নাক যেভাবে লাল টুকটুক করে ফেলে পূর্বের নাকের অবস্থা তারচেয়েও বেশি লাল হয়েছে। শেরওয়ানির দুটো বোতাম খোলার জন্য বুকের উন্মুক্ত দিকটাও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এখন।আচ্ছা পূর্ণতা কি শেরওয়ানি টেনে বুকের বামপাশটা উন্মুক্ত করে চুমু দিবে? পূর্ব কেমন করে উঠবে? চমকে উঠবে? বুকে চেপে ধরবে? না দূরে সরিয়ে দিবে? বৃষ্টির পানিতে ভেজার পর জলীয়বাষ্পের প্রবণতায় মুখটা শুকিয়ে গিয়ে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে পূর্বের। পূর্ণতা ঢোক গিলে চট করে পূর্বের শেরওয়ানি টেনে সেদিনের মতো ঠোঁট বসিয়ে দিলো। পূর্ব ভ্রুঁ কুচঁকে আচমকা উষ্ণ ছোঁয়া অনুভব করতেই ঝট করে চোখ খুলে মাথা নুইয়ে দেখে পূর্ণতা বুকে চুমু দিচ্ছে। পূর্ব বামহাতে পূর্ণতার মাথায় এক খাবলা চুল আকড়ে বুকে থেকে ওর মুখ তুলে বলে উঠলো,
– তুমি এই জায়গাটায় কষ্ট দিয়েছো পূর্ণ!এখন চুমু দিচ্ছো কেন? লাগবেনা তোমার ঠোঁটের স্পর্শ ! আজ কোনোকিছুইতেই শান্ত হবেনা। তুমি এ কি করলে আজ আমার সাথে? আমি তোমাকে মেরে ফেলবো এমন চিন্তা…
গলা নিচু হয়ে কথা আটকে গেলো পূর্বের। আনিশার মতো পূর্ণতাও তো একই কাজ করলো!কেউই বুঝতে পারলো না দিনশেষে। আনিশা তো রূপের বাহাদুরী করতো এজন্য সহ্য হতো না ওকে কিন্তু পূর্ণতা কেন ভুল বুঝলো পূর্বের ব্যাপারে কোনোকিছু না জেনেই? পূর্ণতার কান্না পেয়ে গেলো পূর্বের ইঙ্গিতবাহী কথাতে। কিছুতেই বুঝতে পারছেনা পূর্বের ব্যাপারে উগ্রবাদী চিন্তা কিভাবে পোষণ করলো মনে! পূর্ব যদি খুন করেও থাকে পূর্ণতার উচিৎ ছিলো ঠান্ডা মাথায় পূর্বের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা। পূর্বকে আজেবাজে কথা বলে ওকে উস্কে দেওয়ার কোনো মানেই ছিলো না। অথচ সে বোকার মতো পরিস্থিতি না বুঝে পূর্বের উপর রেগে বসেছে, হাবিজাবি কতো কি বলেছে তার কোনো হিসাব নেই। পূর্ণতা আহত গলায় বিড়বিড় করে বললো,
– আমি আর এমন করবো না।
পূর্ব কিছুটা তপ্ত গলায় বলে উঠলো,
– বিশ্বাস নেই তো! তুমি আজ এরকম করলে কাল এর চেয়েও জঘন্য ব্যবহার করবে!
– এ কথা বলো না। তুমি লোকটার বুকে ছুড়ি চালিয়েছো আমি এ দৃশ্য মানতে পারিনি।
– তো? আমার সাথে যে বাজে আচরণ করলে সেগুলো কি?
– ওই দৃশ্যের প্রভাবে এমনটা করেছি। বিশ্বাস করো আমার কলিজা শুকিয়ে গিয়েছিলো তোমার ওই রূপ দেখে। তুমি তো এমন নিষ্ঠুর না। মানি..তুমি চুপ থাকো, খুব রাগ দেখাও কিন্তু মানুষ তো মারতে পারো না।
– আমার রাস্তায় হাত ঢুকাতে আসলে আমি কি ওকে ছেড়ে দিবো?ওই কুত্তারবাচ্চা তোমাকে মেরে ফেলতো আমি বসে বসে সিনারি দেখবো? দর্শক পেয়েছো আমাকে?
বলতে বলতেই পূর্ণতার চুল আরো কঠোরভাবে চেপে ধরে পূর্ব। পূর্ণতা চুলের ব্যথায় খিচুনি দিয়ে চোখ বন্ধ করলে পূর্ব মুঠো আলগা করে দেয় তৎক্ষণাৎ। পূর্ণতা চটপট চোখ খুলতেই দেখে পূর্ব আবার চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে আছে। পূর্ব রাগের মাথায় চুল খাবলে ধরা ছাড়া আর কোনো আঘাত দেয়নি পূর্ণতাকে। শুধু রাগ উঠলেই সোজা চুলে হামলা করে পাচঁ আঙ্গুলে খামচে ধরবে।
– কিছু জিজ্ঞেস করবো, সত্যি বলবে?
– প্রশ্ন করো। সত্য বলার দায়িত্ব আমার।
– লোকটাকে মারলে কেন?
পূর্ব চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই জোরে নিশ্বাস ফেলে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
– উদ্যোগ সংগঠনের লোক। আমার পেছনে দীর্ঘদিন ধরে লোক লাগিয়ে রেখেছে। উদ্দেশ্য একটাই আমার দূর্বল জিনিসে আঘাত করা।
– এমনটা কেন করবে? তুমি ওদের কি ক্ষতি করেছো?
– ওদের সাথে হাত না মিলিয়ে ভয়াবহ অপরাধ করেছি। যার শাস্তি হচ্ছে আমার উইক পয়েন্টে হামলা করা। ওরা তাই করছে।
– আমি কি তোমার সেই দূর্বল জিনিস? আমার তো মনে হয়না।
পূর্ণতার নিষ্পাপ চাহনির অবুঝ প্রশ্নে পূর্ব ঠোঁট প্রসার করে হেসে দেয়। ইশশ..এই ঠান্ডা হাসিটা দেখার সৌভাগ্য হলো তাহলে? পূর্বের গম্ভীর চেহারার নিচে ভয়ংকর রাগের অতল গহ্বরে এই হাসিটা লুকায়িত ছিলো কেন? কেন ছিলো? এই হাসিটা যে চক্ষুদৃষ্টির চেয়েও ভয়ানক! মারাত্মক রূপে ভয়ানক হাসি! পূর্ব মুখে হাসির ঝিলিক ফুটিয়ে পূর্ণতার হাত টেনে গালে ঘষে বলে উঠলো,
– সেটা না বললেও তোমার বোঝা উচিত। তুমি আমার জন্য কি জিনিস সেটা তুমি নিজেও জানো না।
পূর্ণতা অটলাবস্থায় কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হঠাৎ পূর্বের দুইগাল ধরে কপালে, চোখের পাতায়, নাকে অসংখ্য ঠোঁট ছুয়িয়ে দেয়। হাপাতে হাপাতে বলে উঠে,
– ওরা আমার জন্য তোমার ক্ষতি না করুক পূর্ব। তোমার কিছু হলেই আমি শেষ! আমি সত্যিই শেষ!
পূর্ণতা এভাবেও পাগলামি করতে পারে সেটা জানা ছিলো না। আগে হ্যালুসিনেশনের ঘোরে অদ্ভুত আচরণ করতো কিন্তু আজকের আচরণের সাথে তার কোনো মিল নেই। হ্যালুসিনেশনের ঘটনা কি করে জানি? আসলে ওর উপর ২৪ঘন্টাই আমার নজর থাকতো। কিন্তু আমি কাছে আসার ষাহস পেতাম না তখন। আজ যে দফায় দফায় ডিরেক্ট চুমুতে এ্যাকশন করছে বিষয়টা অদ্ভুত! কপালের ডানপাশটা কি কঠিন ভাবে ফুলে আছে! দরকার কি ছিলো ওভাবে জানালায় নিজের মাথা বারি দেওয়ার? যদি কিছু হতো? এটা ভাবলেই আমার বক্ষস্থল শুকিয়ে চিনচিন ব্যথা করতে থাকে। পূর্ণতা আমার গাল ধরে ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ছে। এই পাগল মেয়েটা আমার এতো কাছে, এতো নিকটে, এতো পাশাপাশি থাকা সত্ত্বেও আমায় নিয়ে ভাবছেনা। কেন ভাবছেনা? আমি ওই লোকটাকে মেরেছি বলে? লোকটাকে খুন করা প্রয়োজন ছিলো। প্রয়োজন না হলে আমি কখনো হাত নষ্ট করিনা। ইচ্ছে করে মানুষ ভালোবাসে না, আমি ইচ্ছে করে মন দেইনি, কিন্তু আমার মন আমার কাছে নেই। কার কাছে? সেটা বুঝতে পারলাম পূর্ণতার কাছে। ভয়ে না অস্থিরতায় তা জানিনা কিন্তু এখন ওর সমস্ত শরীর কাপঁছে। আমি ওর মুখটা টেনে বুকে চেপে ধরলাম। বুকের মধ্যখানে ও বাঁ গাল লাগিয়ে আমার পিঠে আকড়ে ধরলো। তবে শরীর কিন্তু এখনো মৃদ্যুতালে কাপঁছে। আমি একহাতে আগলে ধরে আরেকহাত দিয়ে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলাম। বৃষ্টির পানিতে রাস্তায় পানি জমে কর্দমাক্ত হাল হয়ে আছে খুবই সাবধানে গাড়ি চালাতে হচ্ছে আমার। একবার পূর্ণতার দিকে তাকালাম ও চুপ করে বুকে মুখ লুকিয়ে আছে। আমাদের মধ্যকার নিরবতা কতক্ষণ ছিলো অনুমান নেই বৃষ্টির মধ্যেই ওকে নিয়ে বাড়ি পৌছলাম। গাড়ি থেকে নেমেই আমার মাথায় রক্ত উঠলো! জুতা ছাড়া বাইরে বেরিয়েছে কতো বড় সাহস! কিছুই বললাম না। কোল তুলে কলপাড় থেকে পা ধুইয়ে সোজা রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলাম। ভেজা শরীরে আমি দিনের পর দিন থাকতে পারলেও এই মহারানী রোগ বাধাতে এক্সপার্ট! ভেজা কাপড় আরো কিছুক্ষণ থাকলে আমার জলপট্টি নিয়ে বসা লাগবে। কাজেই আলমারি খুলে টিশার্ট, ট্রাউজার বের করতেই বলে উঠলাম,
– লাগেজ কোথায়? যাও কাপড় নিয়ে এসো। চেন্জ করো। ওইযে বাথরুম।
বাথরুমটা আঙ্গুলে ইশারা করে দেখিয়ে দিলাম ঠিকই কিন্তু আমার কথা এককানে নিলো অপর কান দিয়ে বের করে দিলো। মেজাজটা আবার তুঙ্গে উঠলো! এখনো ভেজা শাড়িতে জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে আছে…চাপার মধ্যে দিবো নাকি? আমি রাগ ঝেড়েই বললাম,
– থাপড়াবো এখন! কি বলেছি শুনো নি? কাপড় চেন্জ করতে বলেছি না?
আমার হুঙ্কারে চোখে চোখ রাখতেও ভয় পাচ্ছে পূর্ণতা। ঠিকই আছে…ভয় পাওয়া উচিত। ভয়ে তটস্থ থাকলেই আমি খুশি! আরেকবার ধমক দিলাম ও কেঁপে উঠলো…তোতলানো সুরে বললো,
– লালাগেজ তো দিদিয়ে যাযায়নি। ওওটা আআপুর রুরুমে…সে ভেভেবেছিলো আমি তাতার..
পূর্বিকা আপি তোমার সকাল হোক দেখো তোমায় আমি কি করি! ধ্যাতত.. আজকের দিনটাই জঘণ্য! একটার পর একটা আপদ লেগেই আছে, পিছু আর ছাড়ছেনা। আমি টিশার্ট ট্রাউজার হাতে নিয়ে আলমারি যেই লাগাবো হঠাৎ পূর্ণতা আবদারী সুরে বলে উঠলো,
– তোমার একটা টিশার্ট দাও না?
– কিহ্? কার টিশার্ট?
– তোমার টিশার্ট।
– মাথা নষ্ট? তোমার সাইজ দেখেছো? আমার টিশার্ট পরলে ওইটার ভেতর আমিও অনায়াসে ঢুকে যাবো বুঝলে?
– আমি কি আপুকে জাগাবো? আচ্ছা যাই। আপুকে ডেকে লাগেজটা নিয়ে আসি।
ওহ্ শিট! ইটস এ্যা অনারেব্যাল মোমেন্ট! পূর্ণতাকে আটকাতে হবে! আমার মাথায় বুদ্ধি চাপতেই আমি হন্তদন্ত বলে উঠলাম,
– এই কোথায় যাচ্ছো! দাড়াও। এখন রাতের বেলা যেয়ে আর লজ্জার কারন হওয়ার দরকার নেই। তুমি আমার টিশার্ট পরে ফেলো। আপির একটা ঢিলেঢালা টাইপ পায়জামা আছে ওটাও নাও।
পূর্ণতা কেমন কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বুঝলাম না। আমি আবার প্রশ্ন করলাম,
– কোনো সমস্যা?
– না আসলে…আপুর পায়জামা তোমার কাছে যে..
– ওর পায়জামা দিয়ে রুমের ধূলো ময়লা মুছবো তাই চুরি করেছি। এখন কে জানতো তোমার কপালে চুরির মাল জুটবে?
– তুমি চুরি করেছো??কেন?
– তোমার কাছে এখনি কৈফিয়ত দেওয়ার লাগবে? পরে দিলে চলেনা? সামনে থেকে সরে ড্রেস পাল্টাও যাও!
পূর্ণতা বাধ্য বালিকার মতো পূর্বের দেওয়া নেভি ব্লু টিশার্ট ও পূর্বিকার কালো পায়জামা নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। কাপড় চেন্জ করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে পূর্ব শেরওয়ানির গেটআপ পাল্টে ধূসর টিশার্ট ও কালো এডিডাসের ট্রাউজার পরে আয়নার সামনে চুল ব্রাশ করছে। রাতেরবেলা কোথায় যাবে? এ সময় চুল ব্রাশ করার মানে আছে? পূর্ণতা ভেজা চুল পিঠের উপর ছড়িয়ে দিয়ে শাড়ি এনে টেবিলের উপর মেলে দিচ্ছে। পূর্ব আয়নার ভেতর দিয়ে পূর্ণতার সব কার্যক্রম লক্ষ করছে। হঠাৎ পূর্ব বারান্দার দিকে যেতে যেতে বলে উঠলো,
– বারান্দায় আসো কথা আছে।
পূর্ণতা শাড়ি ওভাবেই রেখে গুটিগুটি পায়ে বারান্দায় উপস্থিত হলে দেখে পূর্ব বারান্দায় ফ্লোর-বিছানা করছে। বিছানার চারদিকে স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ঢেকে পলিথিনের চারকোণা রশি দিয়ে বেধে ছোট্ট খেলাঘরের মতো বানিয়েছে। পলিথিনের ওপাশে মাথার কাছে কিছুটা দূরেই একটা মোমবাতি জ্বলছে। মোমবাতিকে ঢেকে একটা কাঁচের বাটির মতো বস্তু রাখা হয়েছে যেনো বাতাসের ঝাপটায় মোমবাতি না নিভে। মাথার দিকটায় পলিথিনের উপর বৃষ্টির ছাট এসে বিন্দু বিন্দু পানি জমা হচ্ছে। কি মনোরম দৃশ্য! পূর্বের মাথায় এসব সুন্দর চিন্তা ভাবনা আসে কি করে? পূর্ব পলিথিনের ভেতর থেকে বেরিয়ে বললো,
– ভেতরে যাও। দেখবে ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে।
– তুমি এটা কি করেছো?
– চোখে দেখতেই পাচ্ছো কি করেছি। এখন তুমি যাবে নাকি পাজকোলে নিয়ে ঢুকবো?
– আমি যাচ্ছি।
পূর্ণতা পূর্বের আবিস্কার করা পলিথিনের ঘরে ঢুকতেই ওর সত্যি সত্যি ঠান্ডা হাওয়ার মতো সিক্ত অনুভূতি হলো। পলিথিনের আচ্ছাদনে শিশিরকণা জমে অস্বচ্ছ হয়ে আছে। বাতাসের দুমকা হাওয়ার ঝাপটানিতে মাঝেমাঝে বৃষ্টির পানি এসে মাথার উপর পলিথিনে পরছে….কি দারুন দৃশ্য! বালিশের ওখানে মাথার কাছে সুদূরে রাখা মোমবাতিটা কেমন রহস্যময় পরিবেশ করে দিয়েছে!! পূর্ণতার কাছে এসব কিছুই স্বপ্নের মতো অনুভূত হচ্ছে! এতো শান্তি কেন পরিবেশটায়? গ্রাম্য পরিবেশের এক পশলা বৃষ্টির দিনে মিষ্টি মনোরম ফুলেল সুভাষে মোহিত হচ্ছে পূর্ণতা। স্নিগ্ধ আবেশে পূর্ণতা শিশির জমা পলিথিনে হাত রাখতেই শরীরে কাটা দিয়ে শিরশির করে উঠলো। পূর্ণতা অজান্তেই খিলখিল করে স্ফুটিত কিশোরীর মতো হেসে দেয়। পূর্ব অত্যাশ্চর্য দৃষ্টিতে পূর্ণতাকে দেখছে। পূর্ণতা সত্যি আমার ছেলেমানুষি কর্মকান্ডে খুশি? আমিতো বাদলা দিনে বৃষ্টিমুখর প্রকৃতির নিচে ওকে নিয়ে রাত্রিবিলাস করতে চেয়েছিলাম সেজন্য এসব আয়োজন। আমি কি তাহলে স্বার্থক?
পূর্ব ছোট্ট ঘরের ভেতরে ঢুকে পেছন থেকে পূর্ণতার চুলে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে দেয়। পূর্ণতা জড়তা ভেঙ্গে চমকে উঠে মাথা ঘুরিয়ে পূর্বের দিকে তাকাতেই দেখে পূর্ব ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বসে আছে। হঠাৎ বাহু দুদিকে প্রসার করে পূর্ব হাসিহাসি চেহারায় বলে উঠলো,
– আমার টিশার্টের ভেতর ঢুকে পরো তো! চট করে আমায় জড়িয়ে ধরো। আসো!
পূর্ব বলতে দেরি পূর্ণতা জমকালো খুশিতে টিশার্টের ভেতর ঢুকে পূর্বকে জড়িয়ে ধরে। পূর্ব চোখ বন্ধ করে পূর্ণতার কানের পিনায় ঠোঁট ছুয়িয়ে বলে উঠে,
– চলো এবার ভুবনভুলানো বৃষ্টিতে ভিজি। কি ভিজবে না?
.
ফুয়াদ, জাওয়াদ, সায়মা, মিথুন একত্র হয়ে ফুয়াদের রুমের দরজা আটকে গোলবৈঠকে বসেছে। মূল বিষয়বস্তু হলো, পূর্বের ক্ষতি। পূর্বের প্রতি ঈর্ষান্বিত আচরণে আজ সব ভাইগুলো খারাপের রাস্তায় গা বিলিয়ে বসেছে। সায়মা রীতিমতো পূর্ব বলতে পাগল।তবে পূর্ব সায়মাকে ছোট থেকেই আপন বোনের মতো দেখলেও কখন কিভাবে কবে সায়মার মনে সুক্ষ্ম অনুভূতির পাখা মেলেছিলো তা আদৌ পূর্ব জানে কিনা সায়মা সেটা জানেনা। কিন্তু পূর্ব সায়মাকে ওরকমভাবে পাত্তা কখনোই দেয়না। আপন ভাইবোনদের মধ্যে আবার কিসের ফালতু সম্পর্ক? পূর্বের এই মতবাদের কারনে সায়মা কখনো মনের কথা বলার জন্য সাহস পায়নি। ফুয়াদ সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে নাকমুখ দিয়ে ভোঁ ভোঁ করে ধোয়া ছেড়ে বলে উঠলো,
– কালকে কিছু করতে দেসনি! আজকে যদি কিছু করতে না দেস সবগুলারে খুন করবো!
বোকা ভোলা মিথুন বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো,
– পূর্ব যে কুত্তার মতো মারে ভুলে যাস কেন? খবরদার কোনো হাবিজাবি প্ল্যান করবিনা। তুই ফাসবি সাথে আমাদেরও ফাসাবি!
ফুয়াদ ঠাস করে মিথুনের ডানগালে চড় মেরে বলে,
– তোর মতো বোকাচো* যদি আশেপাশে দু একটা থাকে তাহলে তো ফাসার চান্স আছেই! চুপ কর শালা! কথা বলবি জায়গা মতো সিগারেট লাগিয়ে দিবো!
জাওয়াদ অতি দ্রুত তীক্ষ্ণ গলায় তেতে বলে,
– ওই ব্যাটা! যখন তখন মিথুনের গায়ে হাত তুলোস কে? মগের মুল্লুক পাইছোস?
–
– শালা এই হাদার বাচ্চা কয় কি দেখোস না? আমি বলে হাবিজাবি প্ল্যান বানাই? চড়ায়া শালার কিডনি ব্লক করা উচিত!
সায়মা ওদের মধ্যে পীড়াপীড়ি দেখে চটজলদি ঠান্ডা গলায় বলে উঠে,
– ঝগড়া করে নিজেদের মধ্যে প্রবলেম ক্রিয়েট করা উচিত না। ওই দুজনকে কিভাবে ঠেলার উপর রাখার লাগে সে চিন্তা কর। আচ্ছা? ফুয়াদ একটা কথা বলি?
ফুয়াদ সিগারেটে টান দিয়ে বললো,
– বল।
সায়মা একটু ঝুকে এসে গলা খাদে নামিয়ে বললো,
– আমরা যদি পূর্বের শত্রুদলের সাথে যোগাযোগ করি কেমন হয়?
সায়মার কথা শুনে মিথুন ইয়া বড় চোখ করে চেচিয়ে উঠলো,
– কি বলিস তুই! অসম্ভব!ছিঃ!
ফুয়াদ আরেকদফায় বিরক্ত হয়ে ধুম করে মিথুনের পিঠে কিল বসিয়ে বললো,
– তোর অসম্ভবের মায়রে বাপ শালা! মুখে আঙ্গুল দিতে পারোস না! আরেকটা শব্দ বাইর করবি ডিরেক্ট তোর কলিজায় ছুড়ি হানবো! চুপচাপ বস। ওই সায়মা? বলা শুরু কর।
মিথুন মিইয়ে যাওয়া মুড়ির মতো চুপসে গেলে সায়মা বক্তৃতা দেওয়ার মতো পাট নিয়ে বলে উঠলো,
– উদ্যোগ সংগঠনের সাথে ওর রেষারেষি আছে এ ব্যাপারে তো সবাই জানো। ঠিক না?
জাওয়াদ সায় দিয়ে বলে উঠলো,
– হু। ওই দলের চেয়ারম্যান পূর্বকে নিজের দলে শামিল করতে চায় কিন্তু পূর্ব রাজি হয়না। এই ঘটনা তো ক্যাম্পাসের বাচ্চাকাচ্চাও বলতে পারবো।
– কারেক্ট। উদ্যোগ সংগঠন কতটা পাওয়ারফুল সেটা তো সবার জানা আছে ঠিক না?একটা সাংবাদিক ওদের ব্যাপারে গোপনে রিপোর্ট করছিলো দেখে কিভাবে খুন করে ফেললো মনে আছে?
ফুয়াদ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে অবশিষ্ট অংশ জানালা দিয়ে ফেলে বললো,
– মোদ্দাকথায় আয় বা*। পেচানি বন্ধ কর।
– আহা বলছি তো। আমার প্ল্যান হচ্ছে যদি আমরা ওদের সাথে কন্টাক্ট করে পূর্বের বিয়ের ব্যাপারটা জানিয়ে দেই সাথে পূর্ণতার একটা ছবিও সেন্ড করে দেই তাহলে ব্যাপারটা জমবে না? বল বল? ওরা অবশ্যই পূর্বের বউ আছে শুনলে পূর্ণতার উপর এ্যাটাক করবে! ঠিকনা?
– আচ্ছা তুই তো এখানে পূর্ণতাকে রাস্তা থেকে সরানোর বন্দোবস্ত করলি মাঝখান দিয়ে পূর্ব কই টপকাইবো?
– শরৎচন্দ্রের দেবদাসের মতো বিরহে মরবে, বুঝলি?
– ধুত্তেরি! হাফ প্ল্যান বানাস কেন? আমার মাথায় আইডিয়া আসছে শোন! উদ্যোগের চেয়ারম্যানরে আমি পার্সনালি দেখা করে….
– আরে, তুমি পার্সনালি দেখা করলে পূর্বের গুপ্তচর যদি তোমাকে দেখে ফেলে তখন কি প্রলয় হবে জানো না?
– যেটা মন চায় ওইটা হোক ! আমি তো উদ্যোগ সংগঠনের চেয়ারম্যানরে বলবোই!
সায়মা আর বাক্য খরচ করার প্রয়োজন মনে করেনা। ফুয়াদের মাথায় একবার যা বসে যায় তা জোঁকের মতো আটকে যায়! এমতাবস্থায় কোনো লাভ নেই বুদ্ধি দেওয়ার। পরবর্তীকালে কি করে কাহিনি করে কে জানে?
.
গতরাতের বৃষ্টিতে ধূলোমাখা প্রকৃতি পরিস্কার হয়ে মিষ্টি রৌদ্রের দিন পরেছে আজ। গাছের সবুজ পাতার ফাকফোকর দিয়ে তেজহীন সূর্যের স্বর্ণালি বর্ণ এসে পূর্ণতার মুখে পরতেই ঘুম ভেঙ্গে যায় তার। পূর্ণতা ঘুমুঘুমু চোখে আড়মোড়া ঠেলে হাই তুলতেই পাশ ফিরে তাকায়। পূর্ব ঘুমিয়ে আছে নিষ্পাপ ভঙ্গিতে। কপালজোরে এলোমেলো চুলের বাহারে ঢেকে আছে তার। পূর্ণতা হাত ছুয়িয়ে চুল পেছনে সরিয়ে দেয়। আবারো অবাধ্য ভঙ্গিতে চুল কপালে এসে পরে। পূর্ণতা গালের কাছে কানের পাশে হাত রেখে পূর্বের স্নিগ্ধ মুখের কাছে এগিয়ে কপালে ঠোঁট ছুয়িয়ে উঠে যায়। পরনের পোশাক ঠিক করে সেখান থেকে বেরিয়ে চুলে হাতখোপা করতেই ফোনের সন্ধানে চোখ ঘুরায়। ওইতো ড্রেসিংটেবিলের উপর! পূর্ণতা চটপট ফোন নিয়ে কন্টাক্ট লিস্টে যেয়ে কল করতেই বলে উঠে,
– হ্যালো, হ্যাঁ পূর্বিকা আপু…আমি পূর্ণতা। তুমি ঘুম থেকে উঠোনি এখনো? আপু আমার লাগেজটা তোমার রুমে। একটু কি দিয়ে যেতে পারবে? না না রাতে সমস্যা হয়নি। তুমি কি পারবে? আচ্ছা আচ্ছা আমি দরজা খুলে দিচ্ছি। তুমি আসো। না..পূর্ব উঠেনি। এখনো ঘুমিয়ে আছে। আচ্ছা ঠিকআছে। আচ্ছা।
পূর্ণতা কল কেটে পূর্বিকার জন্য দরজা খুলতেই কপাল কুচঁকে হতভম্ব দৃষ্টিতে বলে উঠে,
– তুমি! তুমি এখানে! এখানে কি করছো!
‘চলবে’
#FABIYAH_MOMO
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক