প্রিয় সোহেল,
আগেকার চিঠি গুলো তোমার কাছে পৌঁছতে পারুক আর নাই পারুক, আজকের চিঠিটা যেন অতি অবশ্যই তোমার হাতে পৌঁছায় সে ব্যবস্থা আমি করেছি। তোমার বন্ধু শফিকের হাতেই চিঠিটা দিলাম। কাজেই ধরেই নিচ্ছি চিঠিটা তুমি পড়ছো।
সোহেল তোমাকে আসলে কি বলব বা কি বলা উচিত আমি জানি না। আর বললেও তুমি আমার মত করে সেটা বুঝতে পারবে কিনা সেটাও জানি না। তবুও বলছি, আজকাল আমার কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়। মাঝে মাঝেই খুব ইচ্ছে হয়, কারও বুকের একদম কাছে গুটিসুটি হয়ে ঘুমিয়ে থাকি, তার শরীরের গন্ধ নিই। মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেলে হাত বাড়ালেই যেন তার নিঃশ্বাস আমায় স্পর্শ করে। এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া আমাকে কেউ গভীর মমতায় জড়িয়ে ধরুক, আমার চুলে মুখ ডুবিয়ে রাখুক। আমার উদাস হয়ে যাওয়া বিকেলের উষ্ণতা ভাগাভাগি করুক। সকালের মিষ্টি হুটোপুটি করা রোদে আমার সঙ্গী হোক। কেউ একজন করুক, কেউ একজন। আচ্ছা সোহেল, একটা কথা বলতো, তুমি কি আমার সেই “কেউ” হবে? আশাকরি তুমি বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাচ্ছি। এরচেয়ে সরাসরি করে আর বলতে পারছি না।
আর তোমার উত্তর যেটাই হোক, শুক্রবার বিকেলে কলাভবনের সামনে আমি অপেক্ষা করব। আশা করছি তুমি আসবে।
ইতি
কে সেটা তো জানোই।
বি. দ্র. টাইপ করা চিঠি দেখেও কিভাবে বুঝলে এটা আমি! আশ্চর্য! এটাকেই কি মনের টান বলে! কি জানি!
চিঠি পাঠানোর পর থেকেই অসম্ভব অস্হির লাগা শুরু হল। যদি সোহেল না আসে! অথবা ইচ্ছে করে আরও এড়িয়ে চলে, তখন!
তবু এই অস্হিরতা ঢেকে শুক্রবারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।
: কি রে, কয়েকদিন ধরে দেখছি কিছু একটা নিয়ে খুব অস্থির হয়ে আছিস? কি ব্যাপার বলতো..
: কিছু না বাবা, মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা না সামনে, এজন্যই একটু…
: পরীক্ষা নিয়ে তুই! উহু, তুই তো ভয়াবহ ছাত্রী, চোখ বন্ধ করে পরীক্ষা দিলেও ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে যাবি আমার ধারনা, আর তুই এসব নিয়ে চিন্তিত! আমার মনে হয়না। তবে একটা ব্যাপার জানিস, মাঝে মাঝে আমার খুব মনে হয়, আমার মতো গাধার মেয়ে কিভাবে তোর মত ব্রিলিয়ান্ট হয় এই বিষয়ে একটা বড় সর গবেষণা হওয়া দরকার। তাতে জেনেটিক্সের ধারনাই হয়তো বদলে যাবে , হা হা হা ..
: বাবা… কি যে বলনা তুমি ..
: আচ্ছা ঠিক আছে শোন, যেটা নিয়েই চিন্তিত হোস না কেন, আমি জানি তুই ঠিক সামলে নিবি। আর যদি প্রয়োজন মনে করিস, আমাকে জানাস, আমি তো আছিই।
: থ্যাংক ইউ বাবা।
আমি জানি আমার প্রাণপ্রিয় বাবাকে বলা মাত্র সব কিছু হাজির হয়ে যাবে। হয়তো সোহেল কে মেনে নিতে বাবার অভিজাত মন বাধা দেবে, কিন্তু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক সব মেনে নেবেন। তবুও বাবাকে এসব কথা বলা যাবে না। অন্তত এইক্ষেত্রে আমি বাবার সাহায্য নিতে চাই না। জয় করলে সোহেলকে আমি নিজে নিজেই জিততে চাই।
দুরুদুরু মনে শুক্রবার কলাভবনের সামনে গিয়ে হাজির হলাম। আমার পরনে গোলাপী রঙের সুতির একটা শাড়ি। আমি জানি, গোলাপি রঙের শাড়িতে আমাকে অপূর্ব দেখায়।
: এসেছো তাহলে!
: হুম।
এরপর দুজনে কেউ কোন কথা খুঁজে পেলাম না। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। এরপর সোহেল নিজেই নিরবতা ভঙ্গ করল।
: একটা সিগারেট খেতে পারি?
: পারমিশন চাইছো যে…
: এখন থেকে তো সব কিছুই তোমার পারমিশন নিয়ে করতে হবে, তাই আগে থেকেই প্র্যাকটিস করছি।
: মানে!
আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম। সোহেল সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল।
: মানে তুমি যা ভাবছো তাই। তবে রুপু, তোমার আমার ব্যাপারটা পুরোপুরি সিনেমার মতো হচ্ছে, সেটা ভেবে দেখেছো? একদিকে কোটিপতির আদরের কন্যা আর অন্য দিকে আমার মতো খেটে খাওয়া দিনমজুর টাইপ একটা ছেলে।
: তুমি দিনমজুর হতে যাবে কেন! এসব কি কথা!
সোহেল হা হা করে হেসে উত্তর দিল, আর আমি মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকালাম। কি প্রাণখোলা হাসিই না হাসতে পারে ছেলেটা! অথচ এর আগে কখনও তেমন হাসতেই দেখিনি ওকে!
: আসলেই দিনমজুর রুপু, আমাদের অফিসে বেতন হয় দিন হিসাব করে। কেউ অফিস মিস দিলে তার সেই দিনের বেতন কাটা যায়।
: সত্যি নাকি!
: হুম।
: এরকম অফিসও হয়! আগে শুনিনি কখনও!
: আমার সাথে থাকলে এরকম অনেক কিছুই দেখবে, শুনবে যেগুলো তুমি আগে জানতে না। হতদরিদ্র দের জীবনের গল্পই আলাদা।
: তুমি এতো মন খারাপ করা কথা বলনা তো, অফিসিয়ালি আজ থেকে আমরা প্রেমিক প্রেমিকা। কাজেই আজকের দিনে কোন মন খারাপ কথা বলা চলবে না।
: মন খারাপের এই শহরে কোন প্রেম নেই, তবু আমরা জুটি..
মন খারাপ তোমায় আজ থেকে দিলাম ছুটি
: কার কবিতা, তোমার?
: আরে দুর দুর, কবিতা লেখা আমার কম্ম না। দারিদ্র্যতা আর সাহিত্য একসাথে হয়না বুঝলে, শিল্প চর্চা করবেন সুখী মানুষেরা ..
: কে বলেছে তোমাকে? নজরুল, সুকান্ত সবাই কিন্তু দরিদ্র ছিল, দারিদ্রতা তাদের লেখাকে আরও ধার এনে দিয়েছিল।
: তাই নাকি! জানতাম নাতো, তোমার কথা শুনে তোমাকে সাহিত্যের ছাত্রী বলে মনে হচ্ছে, কে বলবে যে তুমি এপ্লাইড ফিজিক্সের মত রসকষহীন এক বিষয়ে পড়াশোনা কর। ভালো কথা, তোমার পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন রুপু?
: ভালোই।
: পরীক্ষার পর কি করবে?
: আগে ভাবতাম দেশের বাইরে যাব পিএইচডি করতে, তবে এখন আপাতত সে প্ল্যান নেই।
: কি বল সে প্ল্যান নেই! ইউ শুড হ্যাভ। তুমি পিএইচডি টাও একবারে করে ফেল, পড়াশোনার ঝামেলা একবারে চুকে যাক।
: দেখি।
: দেখাদেখির কিছু নেই রুপু, তোমাকে করতেই হবে। আমি তো পারলাম না, তোমাকে দিয়ে যদি….
বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সোহেল। বুঝতাম, সোহেলের অনেক ইচ্ছে ছিল ভালো কিছু করার। কিন্তু সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে সব ইচ্ছা কেই বিসর্জন দিতে হয়েছিল বেচারার।
আর কথা বাড়ালাম না। আমি সোহেলের জন্য একটা পাঞ্জাবী এনেছিলাম। সেটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে পরে আসতে বললাম।সারাদিন রিক্সায় ঘুরে যখন বাসায় ফিরলাম, তখন আমার মনে হল পৃথিবীর সব সুখ যেন আমার দুয়ারে হামলে পড়েছে। আমার চেয়ে সুখী কোন মেয়ে জন্মেনি আর ভবিষ্যতেও কখনও জন্মাবে না।
এরপরের বার যখন দেখা হল সেদিনও সোহেলের জন্য উপহার নিলাম। বেশ কিছু কবিতার বই আর গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ। খেয়ে না খেয়ে বেচারা এমন অবস্থা বানিয়েছে যে অল্পতেই তার বুক জ্বালা পোড়া করে। কাজেই সময় মতো যেন ঔষধ খেতে পারে এজন্য অনেকগুলো কিনে ওর অফিসের ব্যাগে ভরে দিলাম। যাতে চাইলেই খুঁজে পায়।
এর কিছুদিন পর সোহেলের অফিসেও একদিন গেলাম। টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার নিয়ে দেখা করতে। মাথায় ঘোমটা ছিল বলে পিয়ন তো বলেই বসল,
“সোহেল স্যার বিয়া করছেন, আমরারে একবার কইলেনও না অথচ আফনেরে কত ভালা পাই”
সোহেল হাসি মুখে উত্তর না দিয়ে টিফিন ক্যারিয়ারের খাবার শেষ করল। খাওয়া শেষে হাসিমুখে পানও চাইল। যেন সত্যি সত্যি আমি ওর বৌ। যদিও আমার কাছে পান ছিলনা। খাবার পরে পান খাবার বিষয়টাই আসলে জানতাম না। জানলে ঠিক নিয়ে আসতাম।
এমনি করে আমাদের দিন গুলো ভালোই যাচ্ছিল। পরীক্ষা শেষ করে থিসিস জমা দিলাম। নানান বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার জন্য এপ্লাইও করলাম। কিন্তু এতো দ্রুত যে সেটা পেয়ে যাব ভাবতেই পারিনি।
: চা দিতে বলব?
: হুম, বল।
: এতো গম্ভীর হয়ে আছো কেন রুপু? কিছু হয়েছে?
: হুম।
: কি?
: পিএইচডি’র জন্য এপ্লাই করেছিলাম না, সেখান থেকে চিঠি এসেছে। সামনের মাসেই যেতে বলছে।
: বাহ, এতো চমৎকার একটা খবর আর তুমি কিনা মুখ শুকনো করে দিচ্ছ! চল আজ তুমি খাওয়াবে, চল, কোন বাহানা চলবে না।
সোহেল কখনও এভাবে করে বলেনা। মনটা খচখচ করছিল তবুও সুযোগটা লুফে নিয়ে বেশ ভালো একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম। অর্ডারও করলাম সোহেলের পছন্দ মত যাতে সে আরাম করে খেতে পারে।
: আমরা এখন কি করব সোহেল?
: কি করতে চাও?
: না মানে সামনের মাসে যদি জাপান চলে যাই মিনিমাম চারবছর তো ওখানেই থাকতে হবে।
: ছুটি তো পাবে, প্রতিবছর একবার করে দেশে আসবে।
আমি চুপ করে গেলাম। জানতাম সোহেল এমনটাই বলবে। সে কখনও আমাকে পড়াশোনা থেকে পিছিয়ে যেতে বলবে না। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, আমার নিজেরই যেতে ইচ্ছে করছে না।
: তুমি থাকতে পারবে আমাকে ছাড়া?
: পারব না কেন, মাত্র চার বছর রুপু। আর মাঝে তো দেখা হবেই।
আমি আবারও চুপ করে গেলাম। অনেকক্ষণ পর ইতস্তত করে বললাম,
: আমাদের বিয়ে?
সোহেল যেন বেশ অবাক হল। তার বিস্মিত ভাব অল্প সময়ের মধ্যেই বিষন্নতায় রূপ নিলো।
: আমাকে তুমি বিয়ে করার স্বপ্ন দেখ রুপু, আমি তো বিয়ের ম্যাটেরিয়াল না। এটলিস্ট তোমার জন্য তো একেবারেই বেমানান।
: এসব কি বল! বিয়ে করব না তো প্রেম করছি কেন! তুমি কি ভেবেছো এটা বড়লোকের একটা মেয়ের খেয়াল খুশি?
: অনেকটা তাই।
: শুনুন মিস্টার সোহেল, আপনি আমাকে কি ভেবেছেন আমি জানিনা, আমার সম্পর্কে আপনার ধারনা বা আমার প্রতি আপনার ভালোবাসা কতটুকু তাও জানিনা, শুধু এটুকু জানি, আমি আপনাকে চাই, মনে প্রানে চাই। আমি ছাড়া অন্য কাউকে আপনার কাছেও ঘেঁষতে দেবনা।
: ঘেঁষলে কি করবে?
: দরকার হলে খুন করব আর একদম হাসবে না, আমি সিরিয়াস। আর চল, তুমি আমাকে একটা শাড়ি কিনে দেবে, সেই শাড়ি পরে আজকেই আমরা বিয়ে করব।
: কি বলছো! আজকেই! তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে রুপু, বাসায় যাও।
: না, কিছুতেই না।
আমি গোয়ার্তুমি করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ওর সিদ্ধান্ত আদায় না করে এক পাও নড়ব না। সোহেল অনেকক্ষণ পর হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করল।
: আমাকে কয়েকটা দিন সময় দাও, একটু চিন্তা করি আর কালকে আমাকে একটু গ্রামের বাড়ি যেতে হবে, বাবার শরীরটা আবার খারাপ হয়ে গেছে, একটু বোঝার চেষ্টা কর, ফিরে এসে তোমার সাথে আলোচনা করি, কেমন..
: কবে ফিরবে?
: দুইদিন পরেই।
: আচ্ছা, ঠিক দুদিন পরে, মনে থাকে যেন।
সেই যে দুই দিনের কথা বলে সোহেল গ্রামে গেল, এরপরের দশদিন তার আর কোন খোঁজই পাওয়া গেলনা। এগারো দিনের মাথায় যখন সে এলো, সে অনেকখানিই বদলে গেছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখের নিচে কালি, চোয়াল টাও ভাঙ্গা।
: বাবার জন্য দেরি হল রুপু, লোকটা ঢাকা থেকে বাকরখানি খেতে চেয়েছিল কিন্তু আমি নিয়ে পৌঁছতেই পারলাম না। তার আগেই…
বলতে বলতে হু হু করে কেঁদে উঠল সোহেল। এই প্রথম আমি ভেঙ্গে পড়া সোহেলকে দেখলাম। ক্লান্ত, বিদ্ধস্ত। সেদিন দেখা শেষে যখন সোহেল চলে যাচ্ছিল, পেছন থেকে ওকে দেখে আমার চোখ জলে ভরে উঠল। কেমন কুঁজো হয়ে হাঁটছে ছেলেটা, জীবনযুদ্ধে বিপর্যস্ত এক যোদ্ধা।
সেদিন বিয়ের কোন কথাই আমি আর বলতে পারলাম না।
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক