কলমে #রেহানা_পুতুল চলবে…১
আপা তোকে নিয়ে নাকি বিকেলে সালিশ বসবে? অবশ্য ঠিক সালিশ নয়, এটাকে ঘরোয়া বৈঠক বলা চলে। তুই এমন মহাপাপ কাজটা কেন করতে গেলি আপা?
চোখের পাতা ঝাপটিয়ে জিজ্ঞেস করলো নদীর চাচাতো বোন আরু। নদী নিস্তরঙ্গ নদীর মতই শান্ত হয়ে আছে। মুখে রা টুকু নেই। কেবল ঠোঁট বাঁকিয়ে স্বভাবসুলভ মৃদু হাসিটা ছড়িয়ে দিলো।
সত্যি সত্যিই সেদিন বিকেলে দেওয়ান পরিবারে নদীকে নিয়ে বৈঠক বসল। পরিবারের সবাই উপস্থিত সেখানে।
আরুর মা নাহার বেগম গলায় তেজের ঝাঁপি ঢেলে শাশুড়ীর উদ্দেশ্যে বলল,
এখন কি হইবো আম্মা? জমিদারের বেটিরেতো কিচ্ছুটি বলা যায় না। ডাইরেক্ট একশানে চইলা যায়। সাফ সাফ বলে দিচ্ছি আমি। এত ঝামেলা পোহানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আস্তে কইতে পারনা মাইজ্জা বউ? তোমার গলা না এটা মাইক? ছেমরি মাত্র হপ্তাহ হইলো আইছে নিজের ভিটায়। আইতে না আইতেই এমন অধৈর্য হইলে চইলবো?”
রাখেন আপনের হপ্তাহ। অল্পের লাইগা বাঁইচা গেছি। কি কামডা করতে গেছিলো হে। আর ক্যান? আপনিওতো কন নদী এত বেসুরত ক্যামনে হইলো? পুরা দেওয়ান বাড়ির সক্কল মাইয়াগুলার কি চেহারাসুরত। ডাংগর না হইতেই পরে টান দিয়া নিয়া যায় চিলের লাহান ছোঁ মাইরা। মা বাপের গায়েও বাজেনা। কোনো পণও দিতে হয়না। সবগুলার চান কপাল। বলেন না? না আমি বানায়া বানায়া বলছি এসব?
হাফসা বিবি নিরুত্তর। এক গাল পান ঠেসে মুখে কুলুপ এঁটে রইলো। পাশে বসা পরিবারের বড় বউ মোরশেদা বেগম। সে ধীর গলায় বলল,
আহ! থাম তো মেজো। যেহেতু তুই নদীকে উটকো ঝামেলা মনে করতাছিস। তাইলে এখন থেকে নদীর ভরনপোষণের দায়িত্ব আমাদের দুই পরিবারের।
এটাই উচিত। নদী এই পরিবারের মাইয়া। এই বংশের মাইয়া। সুতরাং নদীর সমস্ত দায়দায়িত্ব আমগো সকলেরই নেয়া উচিত।
বলল নদীর বড় ফুফু রাফিয়া।
নদীর মেজো চাচী নাহার বেগম বলল,
আলগা পিরিত সবাই দেখাইতে পারে। থাইকবতো আমার কান্ধের উপরে। তার সব আকাম কুকাম সহ্য করা লাগবেতো আমার। তার জন্য আমার মাইয়ার বিয়ার ব্যাঘাত ঘইটলে সমইস্যা হইবে কয়ে দিলাম।
রাফিয়ার ছেলে রজত সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো ,
আচ্ছা,এটা করলেইতো ঝামেলা চুকে যায়। নদী দুই বাড়িতেই থাকবে। বড় মামার নতুন বাড়িতে ছয়মাস আর এই বাড়িতে ছয়মাস। মাঝে ক্লাস বন্ধ থাকলে দুই ফুফুর বাড়িতে গিয়ে বেড়াবে।
নাহার বেগম প্রসন্ন চোখে রজতের দিকে চাইলেন। বললেন,
এইজন্যই আমার রজত ভাইগনাটারে মনে ধরে। হেই সবদিক বিচার বিবেচনা কইরা কথা কইতে পারে। হ্যারে আমি জামাই বানামুই। রজত না শোনার ভান করে উঠে চলে যায় অন্যদিকে।
নদীর দাদী বলল,
তোমরা যেইটা ভালা মনে করো হেইটাই করো। তয় নদী পরিক্ষা শ্যাষ অহন অবধি এইখানেই থাহুক। হের বাদে যাইবো ওই রফিকের বাড়ি। কথা এটাই ফাইনাল।
আরু এসে বলল,
নদী আপার মতামত নেওয়ার প্রয়োজন নেই কারো ? নদী আপা আমার সাথেই থাকবে সবসময়।
নাহার বেগম মুখ ঝামটি মেরে মেয়েকে বললেন,
আইছে আরেক নবাবজাদী। মন চায় গুঁড়া করে ফালাই। মাসান্তে একজনের মাথাপিছু খরচ কতো জানা আছে? ভাগ আমার চোক্ষের সামনে থেইকা।
আরু মুখ গোঁজ করে চলে যায় মায়ের উপর বিরক্ত হয়ে।
রুমের ভিতরে পড়ার টেবিলে বসে থেকে সবার কথাগুলো শুনতে পেলো নদী। নিস্তেজ হেসে ভাবলো নিরবে ,
” জন্মই যার আজন্ম পাপ। অনাদর যার নিত্যসঙ্গী। লাঞ্চনা যার প্রাপ্য। বেদনা যার পরম বন্ধু। তাকে অন্যদের এসব নির্দয় বাক্য কাবু করতে পারবেনা। “
আপা তোর কি গণ্ডারের চামড়া? সব হজম করিস হাসিমুখে?
পরেরদিন সকালে রুমে প্রবেশ করে চনচন গলায় জিজ্ঞেস করলো আরু।
নদী চোখ ঘুরিয়ে চাইলো তার দিকে। বলল
এছাড়া উপায় কি আরু? তুই বল?
আচ্ছা আপা। তোর কি মনে হয় তুই সত্যিই আমাদের দেওয়ান বাড়ির সব মেয়ের থেকে কম সুন্দর?
তোর কি মনে হয় আরু? আমি কম সুন্দর না অসুন্দর?
উমমম! কম সুন্দর!
কম সুন্দর কিরে। বল অসুন্দর।
নিজের উপর তোর স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে আপা। বুঝলাম।
দেখলিতো আরু। তুইও জানিস আমি অসুন্দর। কম সুন্দর বললি মাত্র সংকোচে।
তুই এত বুঝিস কিভাবে আপা ?
আমার জায়গায় থাকলে তুইও এমন সব বুঝে যেতি। পরিস্থিতি, পরিবেশ মানুষকে অনেককিছু বুঝিয়ে দেয়। শিখিয়ে দেয়।
হয়তো। স্কুলে যাবিনা আপা?
হুম যাবো। বাড়িতে থাকলে বেশি খারাপ লাগে আমার। মাথা ভনভন করে খালি।
নদী ও আরু স্কুলে গেলো। নদীর সামনে এসএসসি পরিক্ষা। আরু ক্লাস নাইনে পড়ে।
আজ নদীর টেস্ট পরিক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। সে অলসাবজেক্টে পাশ করাসহ ভালো রেজাল্ট করেছে। তার পড়াশোনার তদারকির ভার পড়েছে ফুফাতো ভাই রজতের উপরে। রজত নদীকে স্কুলের মাঠের একপাশে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
কার হাতে মার খেয়েছিস?
কইনাতো? কে মারবে আবার আমাকে?
রজত তার চার আঙ্গুল দিয়ে নদীর চিবুক উঁচিয়ে ধরে বলল,
এই রজত ছাড়া তোকে মারার লোকের অভাব আছে নাকি পৃথিবীতে? তোর ফর্সা গালের লাল চিহ্নটাই কিছু জানান দিচ্ছে।
কিশোরী নদী লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। দৃষ্টি মাটির বুকে জিইয়ে থাকা সবুজ দূর্বাঘাসের দিকে। লবন ছিঁটে খাওয়া জোঁকের মতো কুঁচকে যেতে যেতে অভিমানী নিরীহ সুরে বলল,
দাদীর হাতে।
রজত অবাক হলো। অসহিষ্ণু কন্ঠে বলল,
আজকাল বুড়িও তোর গায়ে হাত তোলা শুরু করছে? বুড়িকে বারণ করে দিবো যেনো তোর গায়ে আর হাত না তোলে।
দাদীর কোনো দোষ নেই। ছোট চাচী তরকারি জ্বাল দিতে বলল আমাকে। পুড়ে গিয়েছে তরকারি। তাই চাচী গরম খুন্তি দিয়ে ছ্যাঁকা দিতে আসছিলো আমাকে। দাদী বুঝতে পেরে নিজেই আগ বাড়িয়ে আমাকে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে কয়েক ঘা মারলো।
বুঝলাম। নানী তোকে বড় আঘাত হতে রক্ষা করলো ছোট আঘাত করেই।
নদী পালাতে চায় রজতের সামনে থেকে।
আমি যাই রজত ভাই?
এখানে দাঁড়া বলছি। দুই মিনিট।
রজত লম্বা লম্বা পা ফেলে মাঠ পার হলো। রাস্তার ধারে দুটি দোকানে ঢুকলো। স্বল্পসময় পরে ফিরে এলো।
নে ধর। শরিরের আঘাতপ্রাপ্ত স্থানগুলোতে এই মলম লাগিয়ে নিবি সবসময়। আর এগুলো কুকিজ বিস্কেট ও তোর প্রিয় ঝাল চানাচুর। কাউকে দিবিনা। লুকিয়ে লুকিয়ে খাবি। শেষ হয়ে গেলে জানাবি।
আমি এগুলো নিতে পারবোনা রজত ভাই।
মুখ গোঁজ করে বলল নদী।
এমন ভাব নিচ্ছিস মনে হয় আমার কেনা কিছু তুই আর খাসনাই। নেসনাই।
সেটাতো আমার নানাদের বাড়ি থাকতে।
এজন্যই তো বলছি লুকিয়ে খাবি। গ্রামে তোর বয়েসী মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে। সংসার করছে। আর তুই কিনা..
রজতের মুখের বাক্য অসমাপ্ত রেখেই নদী আরুর ক্লাসের সামনে চলে দ্রুতপায়ে। রজত চলে গেলো তার গন্তব্যে। নদী মনে মনে বলল,
রজত ভাই, আম্মা,দাদী আর আপনি ছাড়া এ পৃথিবীতে কাউকেই আমার আপন মনে হয়না। কাউকেই না।
নদী ও আরু বাড়ি চলে গেলো। নদী রাতে দাদীর পাশে শুয়ে শুয়ে চানাচুর খাচ্ছে। রাতের নিরবতায় চানাচুরের মুড়মুড় শব্দ টের পেলো হাফসা বিবি। কান পেতে রইলো এবং জিজ্ঞেস করলো,
ওই নদী, ইঁন্দুরের মতন রাইতের কালে কুটকুট কইরা কি খাস ওদিক ফিরা? ক কইছি?
নদী সত্যিটা বলে দাদীকে। দাদী তাকে সাবধান বাণী শোনায় আগাম আশংকা করে। এবং বলে এই রজত নাতিটা আমার ম্যালা ভালা। আল্লাহ হ্যারে সহী সালামতে রাখুক। একটা পরীর মতন বউ জুটায়া দেউক কপালে। নদী পানি খেয়ে তন্দ্রাঘোরে ডুব দেয়।
দাদী,চাচী, আরু সবাই কই?
সকাল না ফুরাতেই ঘরের ভিতর পুরুষালী ভরাট চেনা কন্ঠের ডাক শোনা গেলো। নদী লজ্জায়,সংকোচে রুম থেকে লুকানোর প্রস্তুতি নিতে লাগলো।
ক্রমশ ১
সম্পূর্ণ গল্প পেতে
চুপিসারে গল্পের লিংক (এই নিল লেখায় ক্লিক করুন)