অপেক্ষা পর্ব ১০
__হুমায়ূন আহমেদ
ফাতেমার মেজাজ আজ খুব চড়ে গেছে। মেজাজ চড়ার মত তেমন কোন বড় ঘটনা ঘটে নি। মাঝে মাঝে অতি তুচ্ছ ব্যাপারে তাঁর মাথায় রক্ত উঠে যায়। তখন তিনি কি বলেন বা কি করেন নিজেই জানেন না। এখন তার চোখ রক্ত বর্ণ, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি সুপ্রভার দিকে তর্জনী উচিয়ে বলছেন, তোর মাকে বল এক্ষুণি বাড়ি থেকে বের হতে। এক্ষুণি। অনেক দিন ফকির খাওয়ানো হয়েছে আর না। হোটেলের ফ্রি খাওয়া, ফ্রি থাকা যথেষ্ট হয়েছে। এখন পথে নামতে বল। গতির খাটিয়ে খেয়ে দেখুক কেমন লাগে।
এইখানে থেমে গেলে হত, তিনি এখানে থামলেন না। পথে নেমে কি ভাবে জীবন যাপন করলে খেয়ে পরে বাচা যায় তা বলতে শুরু করলেন। ইঙ্গিত টিঙ্গিতের ধার ধারলেন না। ভয়াবহ কথা বলতে শুরু করলেন।
মা-মেয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে চন্দ্ৰিমা উদ্যানে হাঁটবি, কাস্টমার চলে আসবে। কোলে করে নিয়ে যাবে। কোলে কোলে থাকিবি। সুখে ভাড়া খাটবি। এইখানেতো কোলে করে কেউ রাখে না-পথে নামলেই কোল পাবি।
সুপ্ৰভা ভয়ে এবং লজ্জায় থারথার করে কাঁপছে। মনে মনে বলছে, আল্লা তুমি মামীকে থামাও। তুমি দয়া করে মামীকে থামাও। মামীর কথা শুনে সে যতটা ভয় পাচ্ছে, তারচে বেশী ভয় পাচ্ছে— মা এখন কি করবে। এই ভেবে। ফাতেমার প্রতিটি শব্দ সুরাইয়ার কানে যাচ্ছে। সুরাইয়া খুব সহজ পাত্র না। চুপচাপ সব হজম করবে। এই প্রশ্নই আসে না।
সুপ্রভার ধারণা কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মা বলবেন, সুপ্ৰভা ইমনকে বল একটা বেবীটেক্সি ডাকতে। আমরা চলে যাব। সুপ্ৰভা যদি বলে, মা কোথায় যাব? তিনি অবশ্যই বলবেন, চন্দ্ৰিমা উদ্যানে। ভাড়া খাটিব। এখন বাজে রাত দশটা। বড় মামাও বাসায় নেই। উপায়টা কি হবে? মিতু আপা আছেন। মার চিৎকার কথাবার্তা তিনি সব শুনছেন। কিন্তু কিছুই বলছেন না।
সুপ্ৰভা দেখল, মিতু আপা মগভর্তি চা নিয়ে ছাদে উঠে যাচ্ছে। এখন মা যদি সত্যি সত্যি বেবীটেক্সি আনায় তাহলে কেউ থাকবে না মাকে বুঝিয়ে দুটা কথা বলার। সুপ্রভার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কাঁদছে না। ভয়ে। কাঁদলে বড় মামী আরো রেগে যেতে পারেন।
যে ঘটনা থেকে এই আগ্নোৎপাতৃ সেই ঘটনা খুবই সামান্য। ফাতেমার পায়ে পানি এসে পা ফুলে গেছে। কাজের মেয়েকে বলেছেন এক গামলা গরম পানি এনে দিতে। গরম পানিতে পা ড়ুবিয়ে বসে থাকবেন। সে পানি আনতে অনেক দেরী করল। কারণ সে সুরাইয়াকে দোতলায় ভাত দিতে গিয়েছিল। ফাতেমা বললেন, ভাত ঘরে দিয়ে আসতে হবে কেন নিচে নেমে খেতে পারে না? কাজের মেয়ে বলল, আম্মা আমি ছোটমুখে অত বড় কথা বলি ক্যামনে? ভাত চায় ভাত দিয়া আসি, চা চায় চা দিয়া আসি, ফিরিজের ঠাণ্ডা পানি চায়, পানি দিয়া আসি। আমার কাম হইছে সিঁড়ি বাওয়া। আম্মা, আমারে ক্ষ্যামা দেন। চাকরি অনেক করছি, আর না।
ফাতেমার বারুদের বস্তায় আগুন লেগে গেল। প্রথমে গরম পানির গামলা লাথি মেরে উল্টে দিলেন। শুরু করলেন চিৎকার। দুর্ভাগ্যক্রমে সুপ্ৰভা তখন তার সামনে। সে সরে পরতে চেয়েছিল, ফাতেমা কঠিন গলায় বললেন, খবৰ্দার মেয়ে নড়বি না। খবর্দার বললাম।
ফাতেমার চিৎকার থামার পর সুপ্ৰভা খুব সাবধানে দোতলায় উঠল। মার ঘরে উঁকি দিল। মা রাতের খাওয়া শেষ করেছেন। দেয়ালে হেলান দিয়ে খাটে বসে আছেন। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, চিৎকার চেচামেচি সবই কানে গেছে। তার চোখ মুখ অস্বাভাবিক শান্ত। এই অস্বাভাবিক শান্ত ভাবটা মারাত্মক। আজ খুবই ভয়ংকর কিছু ঘটবে। সুরাইয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বললেন, সুপ্ৰভা রাতের খাওয়া খেয়েছিস?
সুপ্ৰভা ভয়ে ভয়ে বলল, হুঁ।
ইমন! ইমান খেয়েছে?
হুঁ।
আমাকে একটু পান সুপারি। এনে–দেতো, পান খেতে ইচ্ছে করছে। চুন আলাদা করে আনবি।
আচ্ছা।
সুপ্ৰভা পান আনতে নিচে গেল। মার ব্যাপারটা এখনো কিছু বোঝা যাচ্ছে না। অতি স্বাভাবিক আচরণ করছেন সেটাই অস্বাভাবিক। সুপ্রভার ভয় লাগছে। মিতু আপাকে ছাদ থেকে ডেকে নিয়ে আসতে ইচ্ছে করছে। মিতু আপা আশেপাশে থাকলেও একটা ভরসা।
পিরিচে করে দুটা বানানো পান সুপ্ৰভা মার জন্যে এনেছে। এক পাশে চুন, আরেক পাশে মৌরী, দুটা এলাচ। যেন পিরিচের দিকে তাকালেই মার মনটা ভাল হয়।
সুপ্ৰভা!
জ্বি মা।
ইমন কি করছে?
পড়ছে।
ওকে একটু ডাকতো। ওর সঙ্গে কথা আছে।
আচ্ছা।
তোর বড় মামা কি বাসায় আছে?
জ্বি না।
ভাইজান কখন ফিরেন?
এগারোটার মধ্যে সব সময় ফিরেন।
এখন কটা বাজে।
দশটা দশ।
তুই ইমনকে খবর দে।
সুপ্ৰভা ভাইকে ডাকতে গেল। তাকে বলে দিতে হবে যে তার সম্পর্কে মাকে সে একটা মিথ্যা কথা বলেছে। সে বলেছে ভাইয়া ভাত খেয়েছে। আসলে তারা দুজনের কেউই ভাত খায়নি।
ইমন পর্দা সরিয়ে মার ঘরে ঢুকল। শান্ত গলায় বলল, মা ডেকেছ?
দেখলেন, ইমনের বসার ভঙ্গি অবিকল তার বাবার মত। শুধু যে বসার ভঙ্গি তাই না, তাকানোর ভঙ্গিও সে রকম। ঐতো ভুরু কুঁচকে আছে। কপালের চামড়ায় সূক্ষ্ম ভাজ পড়েছে। এই বয়সেই কেমন গম্ভীর গভীর ভাব। গলার স্বরটাও কি তার বাবার মত? কখনো সে ভাবে লক্ষ্য করা হয় নি। একদিন ইমনকে বলতে হবে টেলিফোনে তার সঙ্গে কথা বলতে। টেলিফোনের কথা শুনে বলতে পারবেন। ইমনের গলার স্বর তার বাবার মত কি-না!
ইমন!
জ্বি।
তোর মামী যে সব কথাবার্তা বলছিল শুনছিলি।
হুঁ।
ভুরু কুচকে আছিস কেন? ভুরু সোজা করে কথা বল। তোর মামীর কথা শুনেছিস?
শুনেছি।
এরপরেও কি আমাদের এ বাড়ীতে থাকা উচিত?
হ্যাঁ উচিত।
সুরাইয়া বিস্মিত হয়ে বললেন, উচিত কেন?
উচিত কারণ আমাদের যাবার কোন জায়গা নেই।
সুরাইয়া তীক্ষ্ম গলায় বললেন, যাবার জায়গা থাকতেই হবে –রাস্তায় থাকব। রাস্তায় মানুষ বাস করে না?
পাগলের মত কথা বললেতো মা হবে না।
পাগলের মত কথা? কোন কথাটা পাগলের মত বললাম?
বেশীর ভাগ কথাই তুমি পাগলের মত বল।
তোর ধারণা আমি পাগল?
ইমন কিছু বলল না। চুপ করে রইল। সুরাইয়া চোখ মুখ লাল করে বললেন–খবৰ্দার চুপ করে থাকবি না। তোর ধারণা আমি পাগল? বল, আমি পাগল?
কিছুটা পাগলামী তোমার মধ্যে আছে।
এত বড় কথা তুই বলতে পারলি? পাগল যদি হয়েই থাকি কেন পাগল হয়েছি তুই জানিস না? কথার জবাব দে। চুপ করে থাকবি না।
কথার জবাব দেবার কিছু নেই। কথার জবাব দেয়া মানে— কথার পিঠে কথা বলা। আমি একটা কথা বলব, তুমি তার উত্তরে পাঁচটা কথা বলবে। আবার আমি বলবি. লাভ কি?
লাভ কি মানে, তুই কি সব সময় লাভ-লােকসান দেখে চলিস? তুই কি লাভ-লোকসানের দোকান খুলেছিস? একজন আমাকে আর আমার মেয়েকে বেশ্যা বলবে তারপরেও তার বাড়িতে আমি থাকিব? কোন যুক্তিতে থাকিব?
যুক্তি একটাই আমাদের যাবার জায়গা নেই। তা ছাড়া মামী রেগে গিয়ে কি বলেছেন সেটা বড় কথা না। রেগে গেলে আমরা সবাই কুৎসিত সব কথা বলি। মামী যেমন বলেন, তুমিও বল।
আমি বলি? কখন বলেছি? কি বলেছি?
কখন বলেছ, কি বলেছ সে সবাতো মা আমি লিখে রাখি নি। তবে অনেকবারই অনেক কুৎসিত কথা বলেছ। যখন বলেছি তখন লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করেছে।
ইচ্ছে করেছে। যখন তখন মরে গেলেই পারতিস। ছাদে উঠে ছাদ থেকে ঝাঁপ দিলেই পারতি। সেটা দিতে সাহস হয় না? মেনী বিড়াল হয়ে থাকতে ভাল লাগে।
তুমি কুৎসিত কথা বলা শুরু করেছ মা।
কথায় কথায় মা ডাকবি না। তোর মত ছেলের মুখ থেকে মা ডাক শুনতে চাই না। তোর জ্ঞান বেশী হয়ে গেছে। তুই মহাজ্ঞানী হয়ে যাচ্ছিস। মহাজ্ঞানী পুত্রের আমার দরকার নেই। শোন মহাজ্ঞানী, আমি এই বাড়িতে থাকিব না।
কোথায় যাবে?
কোথায় যাব সেটাও জানার দরকার নেই। সুপ্ৰভাকে নিয়ে আমি এখন, এই মুহুর্তে বিদেয় হব। তোর মামী যদি আমার পায়ে এসেও পড়ে থাকে তারপরেও থাকব না।
ঠিক আছে।
অবশ্যই ঠিক আছে। তুই এখন আমার সামনে থেকে যা। দয়া করে একটা বেবীটেক্সি এনে দে।
আচ্ছা।
ইমন মার ঘর থেকে বের হল। সুরাইয়া কাঁদতে শুরু করলেন। তিনি শব্দ করে কাঁদছেন, তার হাত পা কাঁপছে। দরজার আড়াল থেকে সুপ্ৰভা দেখছে। কিন্তু মাকে শান্ত করার জন্যে এগিয়ে আসছে না। তার শুধু মনে হচ্ছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। সুরাইয়া তীক্ষ্ণ গলায় ডাকলেন, সুপ্ৰভা সুপ্রভা। সুপ্ৰভা জবাব দিল না। সুরাইয়া বিছানা থেকে নামলেন। চটি পায়ে দিলেন। গায়ে একটা চাদর দিলেন, আর তখনি ইমন ঘরে ঢুকে বলল, মা তোমার বেবীটেক্সি এনেছি। তুমি যদি যেতে চাও যাও। আর যদি যেতে না চাও আমি বেবীটেক্সি বিদায় করে দেব। মা একটা কথা, তুমি কিন্তু একা যাবে। তোমার সঙ্গে সুপ্ৰভা যাবে না।
সুরাইয়া অবাক হয়ে দেখলেন, ইমন কঠিন গলায় কথা বলছে। ঐতো সেদিন এতটুক বাচ্চা ছিল— বিছানা ভিজিয়ে সেই ভেজা বিছানায় শুয়ে থাকত। একটু কাঁদতো না। ঠান্ডা লেগে জ্বর বাধাতো। একবার একটা উড়ন্ত মাছি হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরে মুখে পুরে দিল। কিছুতেই আর মুখ খুলে না। অনেক সাধ্য সাধনা করে মুখ খুলানো হল— কি কান্ড! মুখ খুলতেই মাছি উড়ে বাইরে চলে গেল। আর মাছির শোকে ইমনের সে কি কান্না।
সুরাইয়া একাই বেবীটেক্সিতে উঠলেন। সুপ্ৰভা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, মা একটা কথা শুনবে? সুরাইয়া তীব্র গলায় বললেন, খবৰ্দার কোন কথা না। খবৰ্দার। তিনি বেবীটেক্সিওয়ালাকে বেবীটেক্সি চালাতে বললেন। বেবিটেক্সিওয়ালা বলল, কই যাইবেন?
তাইতে তিনি কোথায় যাবেন? অনেক চেষ্টা করেও তিনি কোন ঠিকানা মনে করতে পারলেন না। এমন কেউ কি আছে যার কাছে আজ রাতটা কাটানো যায়? থাকার তো কথা। তার দূর সম্পর্কের এক খালা—মিলি খালা থাকেন। যাত্ৰাবাড়িতে। মিলি খালার সঙ্গে এক সময় ভাল যোগাযোগ ছিল। যাত্রাবাড়িতে তাঁর বাসায় সুরাইয়া কয়েকবার গিয়েছে। কিন্তু এখন খুঁজে ঠিকানা বের করতে পারবে না। কলেজ জীবনের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল। তারা এখন কে কোথায় আছে কিছু জানেন না। আগে যে বাড়িতে থাকতেন সেই বাড়িতে গেলে কেমন হয়? বাড়িওয়ালার স্ত্রীকে যদি বলেন, আজ রাতটা আমি আপনার বাড়িতে থাকব, তিনি নিশ্চয় তাকে বের করে দেবেন না। আগের বাড়ির ঠিকানা তিনি জানেন।
বেবীটেক্সিওয়ালা আবারো বলল, কই যাইবেন?
তিনি বললেন, মালিবাগ।
তিরিশ টাকা ভাড়া পরব।
তিরিশ টাকাই দেব।
তাঁর সঙ্গে টাকা আছে। খুব বেশী না। তবে আছে। সাতশ টাকার মত আছে। কিছু ভাংতিও থাকার কথা। আগের বাড়িওয়ালার বাড়িতে না গিয়ে কোন একটা হোটেলে কি উঠা যায় না? মাঝারি মানের কোন হোটেল। খুবই কি অস্বাভাবিক হবে। একা মেয়ে দেখে হোটেলওয়ালা কি তাকে ঘর দেবে না? আচ্ছা বেবিটেক্সিওয়ালাকে যদি বলেন, ভাই শুনুন, আজকের রাতটা আমি আপনার ফ্যামিলির সঙ্গে কাটিয়ে দিতে চাই। সকালবেলা আমি জায়গা খুঁজে নেব। তখন কি হবে?
খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার দীর্ঘদিন তিনি যে বাড়িতে ছিলেন— সেই বাড়ি খুঁজে পেলেন না। গলিতে ঢোকার মুখে মদিনা কাবাব হাউস বলে একটা দোকান ছিল। সেটা নেই। গলিটাও অন্য রকম লাগছে।
বেবিটেক্সিওয়ালা বলল, খালাম্মা বাড়ির নম্বর কত? তিনি বাড়ির নম্বর বলতে পারলেন না। বাড়িওয়ালার নামও মনে নেই।
আকাশের অবস্থা ভাল না। মেঘ ডাকছে। বোঝাই যাচ্ছে বৃষ্টি হবে। শ্রাবণ মাসের শুরু। রোজই বৃষ্টি হবার কথা। কয়েকদিন খরা গেল। আজ মনে হয় আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি নামার আগে আগে কোন একটা আশ্রয়ে চলে যাওয়া উচিত। সেই আশ্রয়টা কি? বেবিটেক্সিওয়ালা বিরক্ত মুখে বলল— খালাম্মা আর কত ঘুরমু।
সুরাইয়া বললেন, কমলাপুর রেল স্টেশনে চল।
ঐদিকে বেবি যাইব না।
পথের মাঝখানে আমি কোথায় নামব?
বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে। সুরাইয়ার মনে হল তাঁর জ্বর আসছে। জ্বর না এলে অল্প হাওয়াতেই এমন কেঁপে কেঁপে উঠতেন না।
খালাম্মা আমি কমলাপুর যামু না। ভাড়া মিটাইয়া দেন।
সুরাইয়ার মনে হল তিনি বিপদে পড়েছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে বিপদে পড়লেও তিনি অস্থির বোধ করছেন না। বরং ভাল লাগছে। খুব খারাপ সময়ের পরপরই খুব ভাল সময় আসে। এটা জগতের নিয়ম। বেবিটেক্সিওয়ালা রাস্তার মাঝখানে তাকে নামিয়ে দেবে। তিনি বৃষ্টিতে ভিজতে থাকবেন। পথে পানি জমে যাবে। পানি ভেঙ্গে তিনি এগুতে থাকবেন। কোন খোলা ম্যানহোলে ইচাট খেয়ে তিনি নোংরা পানিতে পড়ে যাবেন। তার হাত থেকে ছিটকে হ্যান্ডব্যাগটা পড়ে যাবে। তিনি আর সেই ব্যাগ খুঁজে পাবেন না। নোংরা কাদা পানিতে তাঁর শরীর মাখামাখি হয়ে যাবে। তখন দেখবেন-গুল্ড টাইপের কিছু মানুষ দূর থেকে তাঁকে দেখছে। তাদের মধ্যে একজন পানিতে ছপছপ শব্দ তুলে এগিয়ে আসছে। এরচে। খারাপ অবস্থাতো কিছু হতে পারে না। এ রকম খারাপ অবস্থার পরই ভাল অবস্থা আসে। সেই ভাল অবস্থাটা কি?
বৃষ্টি জোরেসোরে নেমেছে। বেবিটেক্সিওয়ালা তাকে নামিয়ে দেয়নি। বরং বেবিটেক্সি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মনে হয় কমলাপুর রেলস্টেশনের দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। তিনি কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। নিয়ে যাক, যেখানে খুশি নিয়ে যাক। বেবিটেক্সি থেকে বৃষ্টি দেখতে তাঁর ভাল লাগছে। শীত ভাবটা যদিও আরো প্রবল হয়েছে। আচ্ছা, আজ রাতে তাঁর জীবনের বিস্ময়কর কোন ঘটনা ঘটবে নাতো? কমলাপুর রেল স্টেশনে নেমেই যদি দেখেন ইমনের বাবা ট্রেন থেকে নেমেছে। রিকশা খুঁজছে। ঝড় বৃষ্টির রাত বলে রিকশা পাচ্ছে না। তাদের বেবিটেক্সি থামতে দেখেই মানুষটা এগিয়ে এল। তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বেবিটেক্সিওয়ালার সঙ্গে কথা বলছে, ভাড়া যাবে।
কোথায় যাবেন?
মালিবাগ যাব।
মালিবাগের কোন খানে?
রোলক্রসিং পার হয়ে গলিতে ঢুকতে হবে। গলির মোড়ে একটা কাবাবের দোকান আছে— মদিনা কাবাব হাউস নাম। কাবাব হাউস পার হয়ে অল্প একটু গেলেই হবে।
তখন পেছনের সীট থেকে সুরাইয়া বলবে— তোমার কি বাড়ির নাম্বার মনে আছে? বাড়ির নাম্বার কিংবা বাড়িওয়ালার নাম? মনে না থাকলে বাড়ি খুঁজে পাবে না।
তখন মানুষটা দারুণ অবাক হয়ে বলবে, আরে সুরাইয়া তুমি! তুমি কোথেকে?
সুরাইয়া ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলবেন, জানি না কোথেকে।
মানুষটা বলবে, তুমি এরকম কেঁপে কেঁপে উঠছি কেন? জ্বর না-কি?
বলেই হাত বাড়িয়ে কপাল ছুঁয়ে আঁৎকে উঠে বলবে–তোমারতো গায়ে অনেক জ্বর। শাড়িও ভিজিয়ে ফেলেছি।
সুরাইয়া বলবে, এই শাড়িটা দেখে তুমি কি কিছু বলতে পারবে? কোন স্মৃতি কি তোমার মনে পড়ে?
কিছু মনে পড়ছে নাতো।
মনে করার চেষ্টা কর। আচ্ছা, আমি তোমাকে সাহায্য করি তারিখটা হচ্ছে ১৫ই আগস্ট। তোমার জন্যদিন।
কিছুই মনে পড়ছে না।
আরো একটু চিন্তা কর। তোমার জন্মদিনে আমি তোমাকে একটা উপহার দিলাম। তুমি প্যাকেট খুলে দেখলে এই শাড়িটা। তুমি বিস্মিত হয়ে বললে— এটা আমার উপহার? শাড়ি? আমি বললাম, হুঁ। তুমি অবাক হয়ে তাকালে। তখন আমি বললাম, শাড়িটা তোমাকে দিলেও পরব। আমি। এবং এই শাড়ি পরে সুন্দর হয়ে তোমার সামনে উপস্থিত হব। কাজেই উপহারটা তোমার জন্যই হল, তাই না? তুমি চেয়ে বললে, হ্যাঁ। অবশ্যই আমার জন্যে।
এই শাড়ি আমি বৎসরে শুধু একবারই পরিা। তোমার জন্মদিনে। পনেরোই আগস্ট। আজ পনেরোই আগস্ট। মজার ব্যাপার কি জান, আজ যে তোমার জন্মদিন–তোমার ছেলেমেয়েরা তা জানে না। আজকের মত দিনে তাদের কারণে আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছি। এসে অবশ্যি ভালই হয়েছে। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
সুপ্ৰভা কাঁদছে। ইমন গম্ভীর মুখে বসে আছে। বোনকে সান্তুনা দিয়ে কোন কথা বলছে না। কিছুক্ষণ আগে মিতু এসেছিল। সে কিছুক্ষণ বসে উঠে চলে গেছে। সুপ্ৰভা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ভাইয়া, মা এখন কোথায়?
ইমন বলল, আমি কি করে বলব কোথায়?
তোমার দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে না?
হচ্ছে।
খুঁজতে যাবে না।
কোথায় খুজব?
সুপ্ৰভা চোখ মুছছে। ইমান বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ মুখ কঠিন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব রেগে আছে।
ভাইয়া বাইরে খুব ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে।
বর্ষাকালে ঝড়-বৃষ্টিতো হবেই।
তোমার একটুও দুঃশ্চিন্তা লাগছে না?
সুপ্ৰভা শোন, মায়ের পাগলামী যত দিন যাচ্ছে তত বাড়ছে। কেউ মাকে কিছু বলছে না। মাকে বলা উচিত না? সেই বলাটাই বলেছি। মা আজ একটা ধাক্কার মত খাবে। এতে তার লাভ হবে।
ক্ষতিওতো হতে পারে।
হ্যাঁ, ক্ষতিও হতে পারে। এই রিস্ক আমাদের নিতেই হবে। মা বাস করছে কল্পনার জগতে। মার জগতের সঙ্গে বাস্তবের জগতের কোন মিল নেই। বাস্তব পৃথিবীটা কেমন তাঁর দেখা উচিত।
তুমি টিচারদের মত করে কথা বলবে নাতো ভাইয়া। আমার ভাল লাগছে না। তুমি এ রকম শান্ত ভঙ্গিতে কি ভাবে বসে আছ আমি সেটাই বুঝতে পারছি না। তুমি সত্যি মাকে খুঁজতে যাবে না?
না।
আমি বড় মামাকে নিয়ে মার খোজে যাব।
বড় মামা সকালবেলা চিটাগাং গিয়েছে। আজ রাতে ফিরবেন না।
সুপ্ৰভা শোন, তুই আমার সামনে বসে কাঁদবি না দেখতে খারাপ লাগছে।
সুপ্ৰভা উঠে চলে গেল। যে ভঙ্গিতে গেল তাতে মনে হল এক্ষুণি সে একাই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে। সে গেল দোতলার বারান্দায়। রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। তার চোখে মুখে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির পানিতে এবং চোখের জলে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
অনেকক্ষণ ধরে টেলিফোন বাজছে। মিতু উঠে গিয়ে রিসিভার হাতে নিয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে টেলিফোন রেখে দিল। কিছুক্ষণ পর আবার টেলিফোন। মিতু রিসিভার হাতে নিয়েই বলল, কে নবনী?
ওপাশে কিছুক্ষণের জন্যে নীরবতা। তারপরই নবনীর বিস্মিত গলা—আপনি মিতু আপা তাই না? কি করে বুঝলেন আমি টেলিফোন করেছি?
আমার ই এস পি পাওয়ার আছে। আমি আগে ভাগে অনেক কিছু বুঝতে পারি।
যান। আপনি ঠাট্টা করছেন।
মোটেই ঠাট্টা করছি না। মাঝে মাঝে আমি পারি—প্রমাণ দেব?
দিনতো।
এই মুহুর্তে তুমি একটা সাদা ড্রেস পরে আছ—শাড়ি পরেছ, না সালোয়ার কামিজ পরেছ তা বলতে পারছি না—তবে পোশাকের রঙ শাদা।
হয়েছে?
হয়নি।
ও আচ্ছা। আমি সব সময় বলতে পারি না। মাঝে মাঝে পারি।
বলুনতো আমি কানে কি রঙের পাথরের দুল পরেছি।
বলতে পারছি না।
সবুজ পাথরের দুল। পান্নার ইমিটেশন। আমার বড় চাচা অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। ইমিগ্রন্ট। উনি দেশে বেড়াতে এসেছেন। কারো জন্যে কিছু আনেন নি। শুধু আমার জন্যে সবুজ পাথরের দুল। এনেছেন। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম রিয়েল, পরে জানলাম ইমিটেশন।
তোমার একটু মন খারাপ হল?
জ্বি। তবে মন খারাপ ভাব বেশীক্ষণ থাকে নি। দুল জোড়া যে কি সুন্দর। দেখলেই আপনার মাথা ঘুরে যাবে।
আচ্ছা একদিন দেখব।
আপা শুনুন— আপনি কি করে বললেন যে আমি শাদা কাপড় পরে আছি।
আমিতো বলতে পারিনি।
না, পেরেছেন। আমি আসলে মিথ্যা করে বলেছি পারেন নি। আমি শাদা সালোয়ার কামিজ পরেছি। এই সেটটা আমার মা আমাকে কিনে দিয়েছেন। গতবার আমরা দিল্লী গেলাম।— দিল্লী থেকে কেনা। দিল্লীতে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড মার্কেট আছে। পালিকা বাজার। মা পছন্দ করে কিনেছেন— আমার দুচক্ষের বিষ। শাদা রঙ হচ্ছে বিধবার রঙ, তাই না। আপা। আমার ফেভারিট কালার কি জানেন— আমার ফেভারিট কালার হচ্ছে রেড। আমি একটা বই এ পড়েছি লাল রঙ যাদের প্রিয় তারা মানুষ হিসেবে খুব ভাল হয়। আপা শুনুন, আমার এখন টেলিফোন রেখে দিতে হবে। আপনি কি আমার জন্যে ছোট্ট একটা কাজ করে দিতে পারবেন?
হ্যাঁ পারব। ইমনকে কিছু বলতে হবে?
জ্বি। আগামী পরশু উনার আমাকে পড়াতে আসার কথা—ঐদিন আমার ছোট খালার ছেলের বার্থডে। আমাকে বার্থডেতে যেতে হবে।
ইমনকে বলব সে যেন তোমাকে পড়াতে না যায়?
না না, আমি পড়া মিস দিতে চাই না। এমিতেই আমি খুব খারাপ ছাত্রী। আপনি শুধু বলবেন উনি যেন একটু দেরী করে আসেন।
একটু দেরী মানে কতক্ষণ দেরী? এক ঘণ্টা?
আচ্ছ একঘণ্টা। আপা আসলে আমি জন্মদিনে যেতেই চাচ্ছিলাম না— কিন্তু আমার ঐ কাজিন আমাকে খুব পছন্দ করে। খুব পছন্দ করে শুনে আপনি আবার অন্য কিছু ভেবে বসবেন না, ওর বয়স হল সাত বছর।
ও আচ্ছা।
তাহলে আপা আমি এখন রাখি? আপনার সঙ্গে কথা বলতে আমার এত ভাল লাগে। মনে হয়। কতদিনের যে চেনা। আচ্ছা। আপা আপনাদের ওদিকে কি বৃষ্টি হচ্ছে?
হচ্ছে।
আমাদের এদিকেও হচ্ছে। বর্ষাকাল আমার কাছে জঘন্য লাগে— বৃষ্টি, বৃষ্টি, বৃষ্টি। তবে সবচে জঘন্য লাগে শীতকাল। শীতকালে চামড়া ফেটে যায় এই জন্যে। আমার আবার খুব ড্রাই স্কিনা। আপা আপনার স্কিন কি রকম Oily না ড্রাই?
ঠিক জানি না। আমার মনে হয় মাঝারি ধরণের।
আপনার গায়ের রঙ তাহলে শ্যামলা। শ্যামলা মেয়েদের স্কিন হয় নরম্যাল। আর যারা খুব ফর্সা তাদের স্কিন হয় খুব ড্রাই হবে নয়ত খুব ওয়েলি হবে। এই জন্যে মাঝে মাঝে আমার কাছে মনে হয়—শ্যামলা হয়ে কেন জন্মালাম না। লোকে আমাকে কালো বলতো। লোকের বলায় কি যায় আসে। তাই না আপা?
হ্যাঁ তাই।
আচ্ছা এখন রাখি। খোদা হাফেজ। সরি সরি। আল্লাহ হাফেজ। আমার এক হুজুর আছেন উনি আমাকে বলেছেন কখনো যেন খোদা হাফেজ না বলি। সব সময় যেন আল্লাহ হাফেজ বলি।
দুটাতো একই।
না, এক না। কি যেন একটা ডিফারেন্স আছে। আচ্ছা আমি হুজুরকে জিজ্ঞেস করে আপনাকে জানাব।
টেলিফোন রেখে মিতু ঢুকল ইমনের ঘরে। সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, ইমন তুই উঠে কাপড় পড়তো। এক জায়গায় যাব?
কোথায়?
কমলাপুর রেল স্টেশনে। আমার সিক্সথসেন্স বলছে ফুপু কমলাপুর রেলস্টেশনে বসে আছেন।
ইমন বিরক্ত গলায় বলল, তুই তোর সিক্সথসেন্সের ফাজলামী আমার সঙ্গে করবি না। তোর ধারণা হয়েছে মা কমলাপুর রেল স্টেশনে— তুই সেই ধারণার কথা বলবি?
রেগে যাচ্ছিস কেন?
রাগছি না।
অবশ্যই রাগছিস। যত রাগছিস ততই কুজো হচ্ছিস। ঘাড় সোজা করে বসতে পারিস না। হ্যাঞ্চব্যাক অব ঢাকা।
বেবিটেক্সিতে উঠেই মিতু হাসি হাসি মুখে বলল, আচ্ছা শোন তোকে একটা জটিল প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি। তুইতো আবার ঠান্ডা মাথার ছেলে— ভেবে চিন্তে জবাব দে। মনে কর একটা ছেলে এবং একটা মেয়ে ছোটবেলা থেকে এক সঙ্গে বড় হয়েছে। তাদের মাঝে তুই তুই সম্পর্ক। বড় হয়ে তারা বিয়ে করল। বিয়ের পরে যদি মেয়েটা স্বামীকে তুই তুই করে বলে তাহলে স্বামী বেচারা কি রাগ করবে?
ইমন জবাব দিচ্ছে না। বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। মিতু হালকা গলায় বলল, তোকে আরো কিছু হিন্টস দিয়ে দি। ধরে নে ছেলে এবং মেয়ে ফাস্ট কাজিন। একি, এরকম রাগি চোখে তাকিয়ে আছিস কেন? ঠাট্টা করছি। আমি ঠাট্টাও করতে পারব না?
ইমন বলল, এ ধরনের ঠাট্টা আমার পছন্দ না।
মিতু হাই তুলতে তুলতে বলল, ঠাট্টা পছন্দ না? তাহলে ঠাট্টা না। সত্যি কথাই বলছি। এখন বল বিয়ের পর তোকে যদি আমি তুই তুই করে বলি তুই কি রাগ করবি? আচ্ছা বাবা যাক জবাব দিতে হবে না। বিয়ের পর তুমি করেই বলব। বিয়ের পর কেন— এখন থেকেই বলব।
ইমন তাকিয়ে আছে। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মিতু বলল, এই তুমিতো ভিজে যােচ্ছ আরেকটু সরে এসে বোস।
বলেই মিতু হাসতে শুরু করল। তার হাসি আর থামেই না। ইমন খুব চেষ্টা করছে মিতুর উপর রাগ করতে। রাগ করতে পারছে না। বরং অন্য রকম মায়ায় সে অভিভূত হয়ে পড়ছে। তার কাছে মনে হচ্ছে সে তার একটা জীবন এই বিচিত্র মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিতে পারবে।
চলবে…
অপেক্ষা গল্পের লিংক (all part)