#লেখিকাঃ_আরভি_আহিয়াদ_তিহু
#পর্বঃ37
রাত 3:30
হসপিটালের কড়িডোরের বেঞ্চে বসে প্রায় দুই ঘন্টা যাবৎ অনবরত কেদে যাচ্ছে মোনা খান আর মিরা রহমান।ওনাদের সামনেই দাড়িয়ে আছে অভি।অভির সাড়া গায়ে রক্ত মাখা।চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে আছে।মাথার চুলগুলো এলোমেলো।রাগে ওর কপালের রগ ফুলে উঠেছে।বারবার হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে সময় দেখছে আর সি.সি.ইউর দরজার দিকে তাকাচ্ছে।হঠাৎ ওর ফোনে একটা কল আসতেই,পকেট থেকে ফোনটা বের করে কানের কাছে ধরে বললো
“কি খবর ওই দিকের?”
ওইপাশ থেকে একজন পুরুশালী কন্ঠে বললো
“স্যার সবাইকে গোডাউনে আটকে রেখেছি।এখন কি করবো”
অভি শক্ত কন্ঠে বললো
“আপাততো একটু খাতির যত্ন কর।বাকিটা পরে দেখে নিচ্ছি।”
“ওকে স্যার।”
বলেই ছেলেটা ফোন কেটে দিলো।অভি ফোনটা পকেটে রেখে পিছনে ঘুরতেই দেখলো আহির, মিহির,হিয়ান দাড়িয়ে আছে।তিন জনের শার্টেই হালকা হালকা রক্ত লেগে আছে।ওদের চুলগুলো এলোমেলো,চেহারায় চিন্তার ছাপ।অভি ওদের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে কিছু ইশারা করতেই হিয়ান মাথাটা নিচু করে না সূচক ঘাড় নাড়লো।অভি গিয়ে ধপ করে বেঞ্চের উপরে বসে হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরলো।
মোনা খান ওদেরকে দেখে বসা থেকে দাড়িয়ে তড়িঘড়ি করে ওদের সামনে গিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন
“আমার আহান কোথায়?তোমরা ওকে খুজে পেয়েছো?”
মোনা খানের প্রশ্ন শুনে আহির,মিহির,হিয়ান অসহায় চোখে মোনা খানের দিকে তাকালো।ওনি কাতর চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছেন প্রশ্নের উওর শোনার জন্য।কিন্তু ওরা কোনো উওর না দিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে।ওদের এভাবে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকতে দেখে মোনা খান একটু ধমকের কন্ঠে বললেন
“কি হলো,তোমরা এভাবে চুপচাপ দাড়িয়ে আছো কেনো?বলো আমার ছেলে কোথায়?”
মিহির একটা শুকনো ঢোক গিলে কাপাকাপা স্বরে বললো
“ব-ব্রোকে এ-এখনো খুজে পাওয়া যায়নি মামনি।তবে,,,”
কিছু একটা বলতে গিয়ে মিহির থেমে গেলো।মোনা খান কাপা কাপা কন্ঠে বললেন
“ত-তবে!থেমে গেলি কেনো বল?”
মিহির আটকে আসা গলায় কাপাকাপা কন্ঠে বললো
“গাড়ির ম-মধ্যে এ-একটা পোড়া লাশ পাওয়া গেছে।লাশটার সাড়া শরীর একদম পুড়ে ঝলসে গেছে।কঙ্কাল ছাড়া আর কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই।”
কথাটা মোনা খানের কানে আসতেই ওনি কয়েক সৈকেন্ডের জন্য থমকে গেলেন।কথা বলার বাক শক্তি হাড়িয়ে ফেললেন।কিছুক্ষন স্থির দৃষ্টিতে মিহিরের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ দূটো বন্ধ করে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লেন।মিহির,আহির,অভি,হিয়ান, দৌড়ে এসে ওনাকে ধরলো।
এদিকে মিরা রহমানও খবরটা শুনে আর স্থির থাকতে পারলেন না।সেন্সলেস হয়ে বেঞ্চ থেকে ঠাস করে নিচে পড়ে গেলেন।হিয়ান আর অভি মোনা খানের পাশ থেকে উঠে এসে দ্রুত মিরা রহমান কে ধরলো।
_________________________
ফ্লাসব্যাক
তখন আহির, মিহির,হিয়ান সেই খাদের কাছে এসেই দেখতে পায় সেই গ্যাংয়ের লোক গুলো গাড়ি নিয়ে সবাই চলে যাচ্ছে।ওরা আর কোনো কিছু না ভেবেই সেই লোকগুলোর গাড়ির পিছু নেয়।কিছু দূর যেতেই সেই গাড়ি গুলোকে ওরা ওভারটেক করে চারপাশ থেকে আটকে দেয়।এক পর্যায়ে হিয়ান,আহির, মিহিরের সাথে সেই লোক গুলোর গোলাগুলি শুরু হয়।ওরা দলে অনেক জন হলেও আহীরদের সাথে পেরে উঠেনি।কেউ কেউ কোন রকম প্রান নিয়ে পালিয়েছে, আর যাদের ধরতে পেরেছে তারা কেউই আর এখন সম্পূর্ন সুস্থ নেই সবাই গুলি খেয়ে আহত হয়ে রয়েছে।আহীররা গার্ড দিয়ে সেই লোক গুলোকে গোডাউনে পাঠিয়ে দিয়ে আবার ফোনের দিকে তাকিয়ে আহানের ফোনের লোকেশন ট্রাক করার চেষ্টা করে।ওরা দেখতে পায় ফোনের সিগনেল আশে পাশেই দেখাচ্ছে। ওরা দ্রুত আবার গাড়িতে উঠে সেই সিগনেল অনুযায়ী গিয়ে গাড়ি থামিয়ে নামতেই বেশ অবাক হয়। কারন অভি তড়িঘড়ি করে মেঘকে কোলে করে নিয়ে গিয়ে নিজের গাড়িতে তুলছে।
হিয়ান দৌড়ে অভির কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো
“অভি তুই এখানে কি করছিস?”
ওদের কথায় অভি অনেকটা হকচকিয়ে উঠলো।ওর মুখ দেখেই মনে হচ্ছে এই মূহুর্তে হিয়ানদের ও এখানে একদমই আশা করেনি।তারপরেও নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে উল্টে ধমকের স্বরে বললো
“কি করছি মানে কি?আহান আমাকেও ভয়েজ মেসেজ দিয়েছিলো তাই এসেছি।কিন্তু তোরা এতোক্ষন কোথায় ছিলি?”
আহির দাতে দাত চেপে চেপে বললো
“ওই স্কাউনন্ডেলের বাচ্চা গুলোকে ধরতে গিয়ে ছিলাম।ওদের এতো বড় সাহস ওরা আমার ভাইয়ের উপরে এ্যাট্যাক করে।সব গুলোকে আজকে বুঝিয়ে দিবো, না জেনে শুনে কারো সাথে লাগতে আসলে তাদের কি অবস্থা হয়।”
কথাটা বলতে বলতে আহীরের চোখ যায় অভির গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে শুইয়ে রাখা মেঘের।মেঘের দিকে চোখ পড়তেই আহীর হতবম্ভ হয়ে দু-কদম পিছিয়ে যায়।কথার মাঝেই হঠাৎ ওর এমন রিয়্যাকশন দেখে মিহির আর হিয়ানও ওর দৃষ্টি অনুসরন করে সামনের দিকে তাকায়।তাকিয়েই ওদের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়।
গাড়ির মধ্যের আলোতে মেঘের চেহারাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।ওর সাড়া শরীরে,মাথায় কাচ গেথে রয়েছে।সারা গায়ে রক্ত আর ধুলাবালি, আর্বজনায় মাখামাখি হয়ে আছে।মেঘের এমন অবস্থা দেখে মিহির আর আহীরের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।ওদের পা দুটো অবশ হয়ে গেছে।যে মেয়েটার গায়ে ওরা একটা ফুলের টোকাও লাগতে দেয় না।আজকে সেই মেয়েটা এমন ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় ওদের সামনে পড়ে আছে।মেঘকে এই অবস্থায় দেখে ওদের শ্বাস গলায় আটকে গেছে।দৌড়ে গিয়ে যে মেঘকে একটু জড়িয়ে ধরবে সেই শক্তিটুকুও পাচ্ছে না।
হিয়ান মেঘের এমন অবস্থা দেখে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না।দৌড়ে গিয়ে মেঘকে বুকের সাথে চেপে ধরে কেদে দিলো।মেঘকে ধরার সাথে সাথে হিয়ানের হাতটা রক্তে ভিজে গেলো।ও এক হাত মেঘের গালে রেখে বললো
“বনু এই বনু চোখটা খোল প্লিজ!দেখ ভাইয়া এসে গেছে তোর কিচ্ছু হতে দিবে না।প্লিজ সোনা চোখটা খোল।”
মেঘকে নড়াচড়া করতে না দেখে হিয়ান অভির দিকে তাকিয়ে বললো
“অভি দেখ ও আমার সাথে কথা বলছে না,নড়ছেও না।ওকে আমার সাথে কথা বলতে বল প্লিজ।”
অভি কিছু বলছে না।ঠোট কামরে নিজের কান্না আটকে রাখার চেষ্টা করছে।হিয়ান অভির উওরের অপেক্ষা না করে আবারও মেঘের দিকে তাকিয়ে বললো
“বনু ওঠ প্লিজ!আমার সাথে একটু খানি কথা বল।চোখ খুলে আমার দিকে তাকা,দেখ তোর আর কোনো ভয় নেই আমরা সবাই এসে গেছি।তোর কিচ্ছু হতে দিবো না।আমার সাথে একটু কথা বল সোনা প্লিজ।”
হিয়ানের কথা শুনে অভি চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো।সাথে সাথে ওর চোখ দিয়ে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।ও চেয়েও নিজেকে সামলে রাখতে পারছে না।অভি অন্য দিকে ঘুড়ে খুব সাবধানে চোখের পানিটা মুছে ফেললো।
হিয়ান ওর হাতটা মেঘের মাথায় রেখে বললো
“ওরা আমার বোনটার কি অবস্থা করেছে।কতোটা কেটে গেছে,,রক্ত পড়ছে।শ্বাস টা পযর্ন্ত নিচ্ছে না।চোখ দুটো বন্ধ করে রেখেছে।নিশ্চয়ই ওর খুব কষ্ট হচ্ছে”
বলেই হিয়ান অভির দীকে তাকিয়ে বললো
“অভি জানিস,ওর একটু খানি কেটে গেলেও চিল্লিয়ে সাড়া বাড়ি মাথায় তুলে।সামান্য ইনজেকশন দেখলেও ভয়ে কান্না করে দেয়।সেখানে ওর এতোটা কেটে গেছে। আজকে নিশ্চয়ই ও অনেক কেদেছে তাইনা?ভীষন ভয়ও পেয়েছিলো নিশ্চয়ই, কিন্তু আমরা ঠিক সময় এসে ওকে সেইভ করতে পারিনি।”
আহির আর মিহিরের কোনো নড়চর নেই।ওরা শুধু এক দৃষ্টিতে মেঘের রক্তাক্ত চেহারার দিকেই তাকিয়ে আছে।অভি নিজেকে কোনো মতে সামলে নিয়ে হিয়ানের কাছে এসে ওর কাধে একহাত রেখে বললো
“কি করছিস হিয়ান,ছাড় ওকে।এভাবে জড়িয়ে ধরলে চাপ লেগে কাচ গুলো আরো ওর শরীরের মধ্যে ঢূকে যাবে।”
হিয়ান অভির কথায় পাওা দিলো না।ও মেঘকে ওভাবেই জড়িয়ে ধরে ওর মুখের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো।হিয়ানের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে মেঘের মুখের উপর পড়ছে।
হিয়ান মেঘকে ছাড়ছে না দেখে,অভি ওর কন্ঠটা আরেকটু নরম করে বোঝানোর স্বরে হিয়ানকে উদ্দ্যেশ্য করে বললো
“হিয়ান প্লিজ ওকে ছাড়।আমাদের অলরেডি অনেক দেরি হয়ে গেছে।মেঘের অবস্থা তেমন একটা ভালো না।ওকে এক্ষুনি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।নাহলে হয়তো আমরা আর ওকে বাচাতে পারবো না।আর তাছাড়া আহানকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
শেষের কথাটা শুনতেই হিয়ানের হাতটা আলগা হয়ে গেলো।ও মেঘকে সিটের সাথে হেলান দিয়ে শুইয়ে অভির দিকে ঘুরে অবাক কন্ঠে বললো
“খুজে পাওয়া যাচ্ছে না মানে?”
অভি আটকে আশা স্বরে বললো
“আহানের গাড়িটা খাদে পড়ে ব্লাষ্ট করেছে।সম্ভবতো আহানও গাড়িটার মধ্যেই ছিলো।”
অভির কথা শুনে আহির মিহিরের হুশ ফিরে আসলো।ওরা ধপ করে হাটু গেরে মাটিতে বসে পড়লো।হিয়ান হতবিহল চোখে অভির দিকে তাকিয়ে রইলো।ওর মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো।অভি ওদের তিন জনের এমন অবস্থা দেখে রেগে ধমক দিয়ে বললো
“সবাই এই রকম কার্টুনের মতো বসে না থেকে আহানকে খোজার ব্যাবস্থা কর।কষ্ট কিন্তু আমারও হচ্ছে,আহান যে আমার জন্য কি,,সেটা নিশ্চয়ই তোদের অজানা নয়।আমি ওকে আমার নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসি।আর মেঘ যেমন তোদের কলিজার টুকরো,তেমনি ও আমারও আদরের।আজ অবদি কক্ষনো আমি ওকে আর আলিশাকে আলাদা চোখে দেখিনি।ওরা দুজনই আমার জন্য সমান।মেঘকে এমন অবস্থায় দেখে আমারও খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু তাই বলে কি এখানে কার্টুনের মতো বসে থেকে চোখের সামনে ওদের মরতে দেখবো?”
অভির কথা শেষ হতেই কয়েকটা গাড়ি এসে ওদের সামনে থামলো।এদের মধ্যে দুটো পুলিশের গাড়ি একটা ফায়ার সার্বিসের গাড়ি।আর বাকি গুলোতে মেঘের মা-বাবা,আহানের মা-বাবা,আর হিয়ানের বাবা আর ছোট চাচ্চু।
মিরা রহমান আর মোনা খান ওখানে এসেই কান্নাকাটি শুরূ করে দিলেন।হিয়ান,আহির,মিহির কোনো রকম নিজেকে সামলে নিলো।কারন ওরা এখন এইভাবে ভেঙে পড়লে বাকিদের সামলাবে কে!আহির আর মিহির কোনো ভাবে মিরা রহমান আর মোনা খান কে বুঝিয়ে বললো যে ওরা আহানকে নিয়ে পরে চলে আসবে আপাততো ওনারা যাতে অভির সাথে মেঘকে নিয়ে হসপিটালে চলে যায়।সবাই অনেক বোঝানোর পর ওনারা যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেলেন।অভি,,মেঘ আর ওনাদের নিয়ে দ্রুত গাড়ি ড্রাইব করে হসপিটালের উদ্দ্যেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে।
আর বাকিরা সবাই এখানে থেকে যায় আহানকে খোজার জন্য।
________________________
দুই দিন পর,,,,,,,
সেই রাতের পর কেটে গেছে আরো দুটো বিষাক্ত দিন।বদলে গেছে অনেক কিছু।কোনো কিছুই এখন আর আগের মতো নেই।যেই মানুষ গুলো আগে সব সময় হাসি খুশী থাকতো,সেই মানুষ গুলো এখন জিবন্ত লাশ হয়ে গেছে।তারা সবাই যেনো হাসতে ভূলে গেছে।
আজ দুইদিন হতে চললো মেঘের কোনো হুস নেই।ডাক্তার ৭২ ঘন্টা সময় দিয়েছেন এর মধ্যে যদি মেঘের জ্ঞান ফিরে না আসে তাহলে ওনাদের আর কিছুই করার থাকবে না।ওকে কোনো রকম বাচানো গেলেও ও এখনো বিপদ মুক্ত না।আদৌ বাচবে কিনা সেটাও বলা যাচ্ছে না।চার বছর আগে মেঘের যেমনটা হয়েছিলো এখন তার থেকেও খারাপ অবস্থা।চোখের সামনে এরকম একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটতে দেখে ওর একটা ছোট খাটো ব্রেইন ষ্ট্রোকের মতো হয়েছে।ও মানুষিক ভাবে এতোটাই ভেঙে পড়েছে যে বাচার ইচ্ছেটাই হারিয়ে ফেলেছে।
এই দুই দিন আহানকে খাদ থেকে শুরু করে সারা শহরের হসপিটালে, মর্গে তন্নতন্ন করে খোজা হয়েছে কিন্তু কোথাও পাওয়া যায়নি।সবার ধারনা গাড়ি থেকে যে লাশটা পাওয়া গেছে সেটা আহানের লাশ।সেই লাশটাকে আহাদ খানের ব্লাড স্যাম্পলের সাথে ল্যাবে ডি.এন.এ টেষ্টের জন্যে পাঠানো হয়েছে।তবে এখনো টেষ্টের রেজাল্ট আসেনি।
মিহির,আহির,হিয়ান,অভি এখন ওদের পুরো পাগল পাগল অবস্থা,কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না।একদিকে তো আহানের কোনো খোজ পাচ্ছে না,,তার উপরে মেঘেকেও বাচানো যাবে কিনা ডাক্তারেরা সিওর বলতে পারছে না। মিরা রহমান,মোনা খানও ভিষন অসুস্থ,, ওনারা খাওয়া,ঘুম সব ছেড়ে দিয়েছেন।সারাক্ষন শুধু কান্নাকাটি করেন,,মানুষিক ভাবে একদম দূর্বল হয়ে পড়েছেন।আহির মিহিরকে ওনাদেরও সামলাতে হয়।ওরা গিয়ে কোনো রকম বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওনাদের খাবার খাইয়ে আবার হসপিটালে মেঘের কাছে চলে আসে।এই দুটো দিন ওরা স্থির হয়ে একটা সেকেন্ডের জন্যও বসেনি,, কখনো হসপিটাল,কখনো বাড়ি, আবার কখনো আহানকে খুজতে বেড়িয়েছে।
________________
সকাল 7:30
আহির আর মিহির মাএই ওদের মামার বাড়ি থেকে হসপিটালে এসেছে।সকাল সাড়ে পাচটার দিকে হিয়ানের মা ফোন করে জানায় মিড়া রহমান আর মোনা খান আবার কান্নাকাটি,পাগলামি শুরু করেছেন। কথাটা শোনা মাএই ওরা আর এক মুহুর্তও দেড়ি না করে সোজা হিয়ানদের বাড়িতে চলে গিয়েছিলো।গিয়ে কোনো রকম ওনাদের বুঝিয়ে শান্ত করে,কিছু খাইয়ে তারপর আবার এখন এখানে এসেছে।
চার তলায় এসে লিফট থামতেই আহির আর মিহির লিফট থেকে নেমে একটু সামনে এগিয়ে আসতেই দেখতে পায় সাড়িকা,সাঈফা,দিশা,রিজা, আলিশা ওরা সবাই ওয়েটিং রুমের সিটে বসে বসে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে।সবার ঘাড় কাৎ হয়ে হাতলের উপর পড়ে আছে যেকোনো সময় একটা মোড় দিতেই ওরা ধরাম করে ফ্লোরে পড়ে যাবে।আহির আর মিহির ওদের কাছে এগিয়ে গিয়ে সবাইকে আস্তে আস্তে ঘুম থেকে তুলে বাড়িতে যেতে বললো।কিন্তু ওরা কেউ ওখান থেকে যাবেনা বলে সাফ জানিয়ে দিলো। আহির মিহির অনেক বোঝানোর পর ওরা আপাততো বাসায় যেতে রাজি হলো। তবে ওরা বাসায় গিয়ে ফ্রেস হয়ে খেয়ে আবার এক্ষুনি আসবে।হিয়ান আর অভিও প্রথমে যেতে চাইলো না,তবে ওদের অনেক বোঝানোর পর যেতে রাজি হলো।
সবাই চলে যেতেই আহির আর মিহির গিয়ে আস্তে করে মেঘের কেবিনের দরজায় নক করে ভিতরে ঢুকে।দেখে একজন নার্স মেঘের বেডের পাশে টুল দিয়ে বসে চুপচাপ ফোন টিপছে।দরজা খোলার শব্দে মেয়েটা ফোনের দিক থেকে চোখ সড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আহির আর মিহিরকে দেখে একটা সৌজন্য মূলক হাসি দিয়ে ওদের কাছে গিয়ে গুড মনিং উইশ করলো।বিনিময়ে ওরাও গুড মনিং উইশ করে ভিতরে ঢুকে মেঘের বেডের পাশে টুল দিয়ে দুইপাশে দুজন বসে পড়লো।
এখন যদিও ভিজিটিং আওয়াস না,,তাও নার্স মেয়েটা কিচ্ছু বললো না।কারন ডাক্তার ওদের দুজনকে যখন তখন ভিতরে আসার পারমিশন দিয়েছেন।তবে এটা আহাদ খানের হসপিটাল সেই জন্য নয়।যেদিন মেঘকে এনে এখানে ভর্তি করা হয়েছিলো সেদিন এই দুই ভাইয়ের পাগলামি সবাই দেখেছিলো।ওরা হসপিটালের ফ্লোরে হাটু ভেঙে বসে চিৎকার দিয়ে কেদেছিলো।ডাক্তারের পা অবদি জড়িয়ে ধরে বোনের প্রান ভিক্ষা চেয়েছে।ওদের অবস্থা দেখে ডাক্তার নার্স সবাই কেদে দিয়েছিলো।বোনকে যে মানুষ কতোটা ভালোবাসতে পারে সেটা ওদের না দেখলে হয়তো ওনারা জানতেই পারতেন না।
নার্স মেয়েটা দরজাটা আস্তে করে চাপিয়ে দিয়ে আরেকটা চেয়ার নিয়ে ওদের থেকে অনেকটা দুরত্ব বজায় নিয়ে বসে পড়লো।আহির একধানে শুধু মেঘের সাদা গজ দিয়ে মোড়ানো চেহারাটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে।ওর চোখ দুটো ছলছল করছে যেকোনো সময় টুপ করে গড়িয়ে চোখ থেকে পানি ঝড়ে পড়তে পারে।মেঘের মুখে অক্সিজেন মাক্স লাগানো।হাতে ক্যানোলা লাগিয়ে স্যালাইন আর ব্লাড দুটোই দেওয়া হচ্ছে।বেডের পাশে থাকা হার্ট রেট মনিটরের টুড টুড শব্দ জানান দিচ্ছে মেঘের হার্ট এখনো বিট করছে।আহিরের ইচ্ছে করছে এক্ষুনি এসব খুলে ছুড়ে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে মেঘকে আগের মতো সুস্থ করে দিতে।তবে এটা যে ওর পক্ষে অসম্ভব,,ও চেষ্টা করলেও কিছুতেই মেঘকে ঠিক করতে পারবে না।
মিহির মেঘের দিকে তাকিয়ে একটা ম্লানো হাসি দিয়ে মেঘের ক্যানোলা পড়ানো হাতটা ওর দুই হাতের মধ্যে নিলো তারপর হাতের উপরে একটা চুমু দিয়ে ভাঙা গলায় বললো
“বনু তোর খুব কষ্ট হচ্ছে তাইনা?আমাদের উপরেও নিশ্চয়ই খুব রেগে আছিস?আমরা ঠিক সময়ে যদি আসতে পারতাম তাহলে হয়তো আজকে তোদের এমন অবস্থা হতো না।আমাদের মাফ করে দে প্লিজ।আর কখনো এমন হবে না।একবার তুই সুস্থ হয়ে যাহ সব সময় তোর খেয়াল রাখবো প্রমিজ।”
মিহির বসা থেকে দাড়িয়ে মেঘের দিকে একটু ঝুকে ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো
“আজকে দুইদিন ধরে তোর চেহারাটা একটুর জন্যও দেখিনি,,,জানিস তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে,তোর মূখ থেকে একবার ভাইয়া ডাকটা শুনতে ইচ্ছে করছে,ইচ্ছে করছে তোকে একবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলি তোকে ছাড়া আমরা কতোটা অসহায়।তোকে এই অবস্থায় দেখে একেকটা মুহূর্ত আমাদের শ্বাস আটকে আসে।বুকের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রনা হয়।প্লিজ তারাতাড়ি সুস্থ হয়ে যাহ।নিজের জন্য না হোক তোর ভাইদের জন্য।প্লিজ প্লিজ প্লিজ আবার আমাদের কাছে আগের মেঘ হয়ে ফিরে আয়।”
_________________________
20 দিন পর,,,,,,
মেঘের কেবিনের দরজার সামনে চার/পাচ জন নার্স ভয়ে জড়সড় হয়ে দাড়িয়ে আছে।কেবিনের ভিতর থেকে খুব জোড়ে ভাংচুরের শব্দ আসছে।ওনারা জানেন শব্দটা কিসের আর কেই বা এমন শব্দ করছে!তারপরেও কেউই ভিতরে ঢোকার সাহস পাচ্ছে না।শুধু বারবার হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কারো আসার অপেক্ষা করছে।হঠাৎ ওনাদের মধ্যের একজন নার্স বলে উঠলো
“থ্যাংক গড,,ওনারা এসে গেছেন।এইবার ওনারা সবকিছু সামলে নিবেন।”
নার্সটার কথা শুনে বাকি নার্সগুলো সবাই পাশে তাকালো।দেখলো মিহির আর আহির সিড়ি দিয়ে দ্রুত উপরে উঠে এক দৌড়ে কেবিনের মধ্যে চলে গেলো।ওদের ভিতরে ঢুকতে দেখে সবাই একটা সস্তির নিশ্বাস ফেললো।
।
আহির আর মিহির কেবিনের মধ্যে ঢুকেই দেখলো পুরো রুমটা একদম তছনছ হয়ে আছে স্কাপেল,সিজার, ইনজেকশন থেকে শুরু করে চেয়ার,টুল,বেডের চাদর বালিশ,হার্ট রেট মনিটর সব ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে।আহির আর মিহির এসব দেখে একটুও আশ্চর্য হলো না।কারন গত পনেরো দিন ধরে এই এক কাহিনি বার বার হয়ে যাচ্ছে।ওদের এখন এটা অনেকটা অভ্যাসে পরিনত হয়েছে।
আহির আর মিহির একবার ফ্লোরে থাকা জিনিস গুলোর দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকালো।দেখলো মেঘ অগ্নি চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।আহির আর মিহির কিছু বলার জন্য একটু সামনে এগিয়ে যেতেই মেঘ চিল্লিয়ে বললো
“আমি আহানের কাছে যাবো আমাকে আহানের কাছে নিয়ে চল।”
মিহির বললো
“হুম নিয়ে যাবো আগে তুই শান্ত হ।”
মেঘ আবারও চেচিয়ে বললো
“নাহ শান্ত হবো না।আমি সব কিছু শেষ করে দেবো।সবকিছু একদম ভেঙে গুড়িয়ে ফেলবো।আমার কাছে আমার আহানকে এনে দে।নাহলে আমি কিছুতেই শান্ত থাকবো না।”
আহির অসহায় কন্ঠে বললো
“বনু বলছি তো নিয়ে যাবো।তুই এই রকম করলে তোকে কিভাবে ভাইয়ার কাছে নিয়ে যাবো বলতো।”
মেঘ ফ্লোর থেকে মনিটরের একটা ভাঙা অংশ উঠিয়ে আহিরের মুখ বরাবর মারলো।কিন্তু আহীর সরে যাওয়ায় ওটা ওর গায়ে লাগলো না।মেঘ আবারও চেচিয়ে বললো
“এতোগুলো দিন থেকে শুধু বলেছিস আহানের কাছে নিয়ে যাবি,নিয়ে যাবি।কিন্তু এখনো ওর কাছে নিয়ে গেলি না।তোরা সবাই মিথ্যাবাদী তোদের কাউকে আমি ছাড়বো না।তোরা আমাকে আটকে রেখেছিস।আমাকে আমার আহানের কাছে যেতে দিচ্ছিস না।একবার আমি ওর কাছে যেতে পারি তারপর তোদের সবার নামে আমি ওর কাছে বিচার দিবো।তোরা আমাকে কষ্ট দিচ্ছিস তাইনা দেখিস ও তোদের কতোটা ভয়ংকর শাস্তি দেয়।”
মেঘের কথার উওরে মিহির আহির কিছু না বলে শুধু অসহায় চোখে একে অপরের দিকে রইলো।যেই মানুষটা আর বেচেই নেই,তার কাছে ওরা কিভাবে মেঘকে নিয়ে যাবে।
পনেরো দিন আগে ল্যাব থেকে ডি.এন.এ. রিপোর্ট এসেছে।সেই রিপোর্ট স্পষ্ট বলে দিয়েছে ওই ডেড বডিটা আহানের ছিলো।এই খবরটা যেনো কেউ বিশ্বাসই করতে চায়নি।তবুও রিপোর্ট যখন বলছে তখন তো মেনে নিতেই হবে।পরিবারের সবাই খুব ভেঙে পড়েছে।সবার অবস্থাই খুব খারাপ,আহানের মৃত্যুটা কেউই মেনে নিতে পারছে না।একমাএ আহির আর মিহিরই নিজেকে শক্ত রেখেছে।তবে সেটা উপর থেকে নিজেদের শক্ত রাখার চেষ্টা করছে।একদিকে পরীবারের সবাইকে সামলাতে হচ্ছে আরেকদিকে মেঘের প্রত্যেক দিনের এমন পাগলামো সহ্য করতে হচ্ছে।মেঘকে এখনো কেউ আহানের মৃত্যুর খবরটা জানানোর সাহস পায়নি।কারন আহানকে দেখতে না পেয়েই মেঘের এই অবস্থা যদি ও শোনে আহান আর বেচে নেই তাহলে হয়তো ওর এর থেকেও খারাপ অবস্থা হবে।
আহির আর মিহিরের ভাবনার মধ্যেই দুজন ডাক্তার আর দুজন নার্স দৌড়ে এসে কেবিনের মধ্যে ঢোকে।তারপর ওনারা জোড় করে মেঘকে চেপে ধরে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দেয়।মেঘ ওনাদের হাত থেকে ছটফট আর চিল্লাচিল্লি করতে করতে একটা সময় ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়।এতোক্ষনের ছটফট করা শরীরটা একদম নিস্তেজ হয়ে যায়।
আহীর মিহির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের কোনে জমে থাকা পানিটা মুছে নিয়ে বাইরে যাওয়ার উদ্দ্যেশে পা বাড়ায়।আপাততো ওদের এসব দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।এইসব কিছু একমাএ আহানই ঠিক করতে পারতো।একমাএ আহান ফিরে আসলেই মেঘ আবার আগের মতো হয়ে যেতো।ওরাও মনে প্রানে সব সময় এটাই চায় ওই রিপোর্ট গুলো যেনো ভুল প্রমানিত হয়,,আহান যেনো আবার ওদের কাছে ফিরে আসে।
কিন্তু সেটা কি আদৌ কোনোদিন সম্ভব?আহান কি আদৌ কোনো দিন আর তার মেঘ পড়ির কাছে ফিরে আসতে পারবে?কোনোদিন কি জানতে পারবে তার পিচ্চি পরিটাও তাকে খুব ভালোবেশে ফেলেছে!তার কাছে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকটা সেকেন্ড পাগলামি করেছে!মেঘ কি কোনো দিন নিজের মুখে বলতে ও আহানকে খুব ভালোবাসে?কোনো দিন কি আহানের মুখ থেকে সেই আগের মতো আদুরে কন্ঠে মেঘ পড়ি ডাকটা শুনতে পারবে?নাকি সব কিছু এখানেই শেষ হয়ে যাবে।আরেকটা ভালোবাসার কাহিনীর এখানেই অপূর্নতা নিয়ে সমাপ্তি ঘটবে!
হয়তো শেষ হয়ে যাবে, অথবা আবার হয়তো এখান থেকেই সবকিছু নতুন করে শুরু হবে।এখন শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা।সময়ই বলে দিবে এই দুটো মানুষের ভালোবাসা পূর্নতা পাবে নাকি অপূর্নতা পেয়ে শুধু স্মৃতির পাতায়ই রয়ে যাবে।
চলবে,,,,,,,,,,,