#লেখিকাঃLamia_Tanha
#পর্বঃ২৮
[অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, চাইলে শেয়ার দিয়ে পাশে থাকতে পারেন]
– ফ্লোরেনসিয়া, আমার শহরে তোমাকে স্বাগতম।
থমথমে ভরাট কন্ঠের লোমহর্ষক কথন। সিয়ার স্মৃতিশক্তি ছিলো সর্বদা প্রখর। ওর চিনে নিতে একটুও সময় লাগেনা ওটা এদুয়ার্দোর কন্ঠস্বর।
সিয়া সতর্ক দৃষ্টিতে একবার চারপাশে নজর বুলিয়ে নিলো। একটা সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায়, এক কিনারায় দাঁড়িয়ে ছিলো ও। দূর থেকে বহুদুর পর্যন্ত সবকিছু প্রগাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত। হিমশীতল বাতাস বইছিলো। এইতো কিছুক্ষণ আগে ও’ দাদু ফ্রাঙ্কলিনের বাড়ির পশ্চাদ্ভাগের উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিলো। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে এই সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় কখন আর কিভাবে এসে পৌঁছালো?
দুর্ভাগ্যক্রমে সময় জানা নেই সিয়ার। যদি ঘড়িতে সময় দেখে কামরার বাইরে বেরিয়ে আসতো এবং এই মুহূর্তে সময় দেখতো। তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারতো কতক্ষণ সময় লাগিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে ও। ইউনিকর্নটা অদৃশ হওয়ার পর থেকে পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানোর সময়টুকু মনে নেই সিয়ার। তাই অনায়াসেই এই ঘটনার জন্য এদুয়ার্দোকে দায়ী ভাবলো। ক্রুদ্ধ মেজাজে মনে মনে বললো,
– সবটাই এই রক্তপিপাসুর ষড়যন্ত্র। ও-ই কিছু একটা করেছে। হয়তো কোনো ইন্দ্রজাল বিছিয়ে ছিলো।
সিয়ার রাগ হলো। ভীষণ রাগ হলো। অকস্মাৎ মশালের আলো নিভে গেলো। অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে গেলো দৃষ্টির সম্মুখে থাকা সবকিছু। সজাগ হয়ে উঠলো সিয়ার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। চোখের পলকে ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো এদুয়ার্দো। সিয়া উৎকর্ণ কানে তার ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলো।
এদুয়ার্দোর শরীর থেকে ভেসে আসা মিষ্টি মৃদু সুবাস ঘ্রাণেন্দ্রিয় ভেদ করে সিয়ার মস্তিষ্কে পৌঁছে গেল। থমকে গেলো হৃৎস্পন্দন। সিয়া বিমোহিত হলো, অবশ হয়ে এলো ওর সর্বাঙ্গ। ধীরে ধীরে দু’চোখের নেত্রপল্লব বুঝে নিলো।
এদুয়ার্দোর চোখজোড়া থেকে সবুজ বর্ণের দুর্লভ দ্যুতি ছড়াচ্ছিলো। জ্বলজ্বলে চোখে সিয়ার পিঠে ছড়িয়ে থাকা ঘন বাদামী মসৃন চুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। সামান্য বিস্মিত হলো। আস্তে আস্তে সে নিজেও যেন কোনো অদ্ভুত নেশায় বুদ হয়ে যাচ্ছিলো। এ নেশা র’ক্তের। কি মিষ্টি রক্তের সুবাশ!
এদুয়ার্দোর হিমযুক্ত এক হাত সিয়ার কাঁধ স্পর্শ করলো। চার আঙ্গুলে আলগোছে সিয়ার ঘাড়ের কাছের চুল সরিয়ে দিলো। ভয়াবহ মাদক মেশানো মিষ্টি র’ক্তের সুবাশ। নিমেষেই এদুয়ার্দোর অভ্যন্তরে থাকা হিংস্র পি’শাচ সত্তা জেগে উঠলো। লাল টুকটুকে ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে ঝকঝকে সাদা দু’টো তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত বেরিয়ে এলো।
এমারেল্ড সবুজ মনিগুলোর রঙ বদলে র’ক্তবর্ণ হয়ে উঠলো। জ্বলতে শুরু করলো সিয়ার ক্রুশচিহ্ন। ওর কর্ণকুহরে আঘাত হানলো ক্রুদ্ধ গরগরে হিংস্র গর্জনের শব্দ। ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছিলো। সিয়ার ঘাড় স্পর্শ করলো একজোড়া ভেঁজা ঠোঁট। দু’টো ধারালো সাদা দাঁত চামড়া ভেদ করে র’ক্তনালিতে গিয়ে পৌঁছালো। চুকচুক করে র’ক্ত পান করলো।
সিয়া সম্বিত ফিরে পেলো। শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগে ডান হাতের কনুই দিয়ে এদুয়ার্দোর বুকে সজোরে আঘাত করলো ও। আঘাতের ধাক্কা সামলে নিয়ে এদুয়ার্দো কিছুটা পেছনে সরে গেলো। গম্ভীর মুখে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো। অবাক হলো সিয়া বশীভূত হয়নি বলে।
সিয়ার মন পড়ার উদ্দেশ্য নিয়ে এদুয়ার্দো ইম্যুভিলে এসেছিলো।তাছাড়া কারো কপালে হাত রেখে তার মস্তিষ্কে থাকা সমস্ত স্মৃতি জানতে পারার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এদুয়ার্দোর। যা শুরু থেকেই ছিলো। সে জানতে চেয়েছিলো, সেদিন রাতে এমন কি ঘটেছিলো? ভ্যাম্পায়ারদের মধ্যে কে বা কারা সিয়ার মা, দাদিন আর সাসোলি কুরীকে হ’ত্যা করেছিলো। কিন্তু ফ্রাঙ্কলিনের বাড়ি পর্যন্ত যেতে হয়নি তাকে। এই সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়াতেই সিয়াকে খুঁজে পেয়েছিলো সে। গভীর রাতে মেয়েটা পাহাড়ের চুড়ায় কি করছে? প্রথমে বিষয়টা ভাবলেও পরে আর এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি এদুয়ার্দো।
হয়তো প্রকৃতি চেয়েছিলো এদুয়ার্দোর তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত সিয়ার রক্তের আস্বাদন গ্রহণ করুক। অলৌকিক কিছু ঘটুক। আলো আঁধারিতে হারিয়ে যাওয়া এদুয়ার্দোর সমস্ত স্মৃতি ফিরে আসুক। আজকের আগেও এরকম হয়েছিলো। প্রথমবার সিয়ার র’ক্ত পান করার পর প্রায়ই এদুয়ার্দোর চোখের সামনে অস্পষ্ট কিছু ভিন্ন ভিন্ন স্মৃতি ভেসে উঠতো। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
র’ক্ত নয়, যেন হৃদপিণ্ড জ্বালিয়ে দেওয়া তীব্র ভয়ংকর বিষ পান করেছে এদুয়ার্দো। তার হৃদপিণ্ড জ্বলতে শুরু করলো। চোখের সামনে আবছা কিছু ভিশন দেখতে পেল। অতীতে হারিয়ে গেল। কর্ণকুহরে বেজে উঠলো হৃদয় নিংড়ানো ডাক। কিছু আদুরে শব্দ,
– বাবা এদুয়ার্দো। আমার বড় রাজকুমার। তুখোড় বুদ্ধিদীপ্ত সবুজ নেত্রের সুদর্শন ছেলে আমার। বড় ভাই হয়ে ছোট ভাইয়ের সাথে এভাবে কেনো লড়ছো?
– ও আমাকে বড় ভাই বলে গন্য করে না মা। —– এদুয়ার্দোর কন্ঠে রাগের বহিঃপ্রকাশ।
তার কথার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গর্জে উঠলো অন্য একটা ছেলে। অভিযোগ করে বললো,
– মিথ্যা বলছে ও।
এদুয়ার্দোর চিত্ত চঞ্চল হয়ে উঠলো। মহিলাটা কে? উনি তো পিদর্কা স্যাভেরিন নন। তাহলে কেনো উনাকে মা বলে ডেকেছিল এদুয়ার্দো? ছেলেটা নিশ্চয়ই আব্রাহাম ছিলো। ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণের জন্য এদুয়ার্দো অন্যমনস্ক হয়ে পড়লো।
কয়েক পল সময় গড়ালো। এদুয়ার্দো সম্বিত ফিরে পেলো সিয়ার তলোয়ারের খাপ খুলে ফেলার শব্দে। ভয়াল অগ্নিমূর্তি রুপ ধারন করে তার সামনেই সিয়া দাঁড়িয়ে আছে। সহসা আবারো দপ করে মশাল জ্বলে উঠলো। মেয়েটা পুরোপুরি সজ্ঞানে আছে। এর আগে এরকম ঘটনা ঘটেনি কোনোদিনও। আজই প্রথম ঘটলো। এদুয়ার্দো কাউকে বশীভূত করতে ব্যর্থ হলো।
দুর্দম্য আক্রোশ নিমেষে সিয়াকে কাবু করে ফেলল। ও শক্তহাতে তলোয়ার চেপে ধরলো। যেনো ওর দু’চোখের দৃষ্টিতে ভয়ংকর দাবানল জ্বলে উঠলো। ক্রোধের আতিশয্যে শরীরের সাথে পাল্লা দিয়ে ওর পাতলা কোমল গোলাপি রঙের ঠোঁটজোড়াও নিরন্তর কাঁপতে শুরু করলো।
মস্তিষ্কে উদিত হওয়া প্রশ্নগুলো ভুলে এদুয়ার্দো একপা দু’পা করে সিয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো। তার থমথমে পায়ের প্রতিটা পদক্ষেপে প্রগাঢ় দম্ভ প্রকাশ পেলো। জলন্ত মশালের আগুনের আলোয় মুখখানা স্পষ্ট হয়ে উঠলো। লাল টুকটুকে ওষ্ঠদ্বয়ে ক্রুর হাসল সে। সিয়ার পিত্তি জ্বলে গেলো। রক্তবর্ণ চোখে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে এদুয়ার্দোর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল। এদুয়ার্দো বাঁকা হেসে ডানদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো।
কয়েক পল সময় গড়ালো। নিজেদের মাঝখানে বেশ কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইলো দু’জন প্রতিপক্ষ। একজনের চোখে দুর্বোধ্য ভয়ংকর ক্রোধ, অন্যজনের ভাবুক দৃষ্টি।
– কিছু তো একটা আছে এই মেয়েটার মাঝে। —- এদুয়ার্দো মনে মনে ভাবলো।
অকস্মাৎ ভ্রু কুঁচকে নিলো। কুঁচকে যাওয়া ভ্রু আর সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সিয়াকে অভিনিবেশ সহকারে দেখছিলো। র’ক্ত হিম করে দেওয়া শীতল কন্ঠে অনুচ্চ স্বরে বললো,
– তুমি ফ্লোরেনসিয়া। এম আই রাইট?
এদুয়ার্দোর কন্ঠে নিজের নাম শুনে ফুঁসে উঠলো সিয়া। ভয়ংকর রোষানলে অন্ধ হয়ে গেলো। তলোয়ারের এক কোপে এদুয়ার্দোর শরীর থেকে মাথাটা আলাদা করে মশালের আগুনে জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করলো। চোখের সামনে মা-দাদিনের ফ্যাকাশে দু’টো মৃতদেহ ভেসে উঠলো। অসামান্য ক্রোধে থরথরিয়ে ওর সর্বাঙ্গ কাঁপছিলো। যেন শ’য়তান এদুয়ার্দোকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো না করা পর্যন্ত মনে শান্তি পাবে না ও।
– পাপিষ্ঠ দিয়াবল। আমার হাস্যোজ্জ্বল পরিবারটাকে ধ্বংস করে দিয়ে এখন অভিনয় করছিস?—— সিয়া ক্রুদ্ধ কন্ঠে মনে মনে বললো।
এদুয়ার্দোর বিস্ময়াভিভূত চাহনি। তার মুখাবয়বে বিরাজিত শক্ত দুরূহ গাম্ভীর্য। সহসা সিয়ার ধৈর্যচ্যুতি ঘটলো। ও আক্রোশপ্রসূত কন্ঠে বললো,
– হ্যাঁ। আমি ফ্লোরেনসিয়া। তোমার মৃ’ত্যুদূত।
তীব্র বাতাসে সিয়ার গাঢ় বাদামী চুলগুলো উড়তে শুরু করলো। এদুয়ার্দোর দু’চোখে সামান্য বিস্ময়। এই মুহূর্তে সিয়াকে বিধ্বংসী মনে হলো। যেন প্রচন্ড আঘাতে জর্জরিত কোনো আহত বাঘিনী দাঁড়িয়ে ছিলো। ক্রোধ আর ঘৃণার সংমিশ্রণে যার হৃদয় পুড়ে যাচ্ছিলো।
– আমাকে মা’রবে? বোকা মেয়ে। আমি না চাইলে তুমি এখান থেকে জীবিত ফিরে যেতে পারবে না।
এদুয়াদোর বিদ্রুপাত্মক কন্ঠস্বর। ঠোঁটের ভাঁজে লেগে আছে নির্দয় হাসি। অথচ মুখকান্তিতে কত মায়া! তার এমারেল্ড সবুজ চোখজোড়ায় মোহগ্রস্ত চাহনি। সিয়া ওর মনের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ একত্রিত করে প্রাণপণে নিজেকে ধরে রাখলো। অসম্ভব, ও এই মায়ায় গলবে না। গলতে পারে না।
– পাপাত্মার পি’শাচ। আমার মা-দাদিনের হ’ত্যাকারী। আমার হাতেই তোমার মৃত্যু লিখেছেন ঈশ্বর।–সিয়ার রাগান্বিত কন্ঠস্বর।
এদুয়ার্দোর ঠোঁটে পৈশাচিক হাসি। হিংস্রাত্মক শান্ত কন্ঠে সে বললো,
– আমাকে ভয় পাও। তোমার চোখে ক্রোধ নয়, ভয় দেখতে চাই।
– না আমি অক্ষম, না অসহায়। আর না আমি তোমাকে দেখে ভয় পাই।——সিয়ার কন্ঠে অমিত তেজ।
– এতোটা আত্মবিশ্বাস? এদুয়ার্দোর কন্ঠে বিস্ময়।
সিয়া ফোঁসফোঁস করে উঠলো। এদুয়ার্দো স্থির নেত্র মেলে চেয়ে রইলো। আরো কয়েক পা এগিয়ে সিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সিয়া যেন এতক্ষণ এই মূহুর্তটার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে প্রহর গুনছিলো। অবশেষে, অবশেষে মোক্ষম একটা সুযোগ পেলো ও।
অকস্মাৎ একটা অভাবনীয় কাজ করে বসে সিয়া। তলোয়ার দিয়ে এদুয়ার্দোর গলা বরাবর আঘাত করলো। এদুয়ার্দো ত্বরিত সরে দাঁড়াল। তলোয়ারের অগ্রভাগের ধারালো অংশের আঘাতে তার গলার চামড়া কেটে গেলো। টপটপ করে রক্ত ঝড়ে পড়লো। সে বিস্ময়ে অভিভূত। সিয়া পুনরায় তলোয়ার দিয়ে আঘাত করলো তাকে। এবার ওর তলোয়ার’টা বাম হাতে ধরে ফেললো এদুয়ার্দো।
এদুয়ার্দোর হাত থেকেও র’ক্ত ঝরছে। বেশি না। অল্প অল্প করে। সিয়া কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেলো, যখন এদুয়ার্দোর গলায় কেটে যাওয়া চামড়ার ক্ষতটুকু আপনা আপনি স্বাভাবিক হয়ে যেতে দেখলো। এখন আর রক্ত ঝরছে না ওখান থেকে।
সিয়া নিজের বাম হাত দিয়ে এদুয়ার্দোর চিবুকে আঘাত করলো। চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো এদুয়ার্দো। মুহূর্তেই ভয়ংকর রাগান্বিত চোখে তাকালো। সিয়ার বাম হাতটা নিজের ডানহাতে শক্ত করে ধরে হিংস্রাত্মক শীতল কন্ঠে বললো,
– নির্বোধ! এই সামান্য তলোয়ার দিয়ে র’ক্তপিপাসুদের মহারাজকে মা’রতে চাইছো?
সিয়ার ভয়াবহ ক্রোধিত দৃষ্টি খানিকটা বিস্ময়ে বদলে গেলো। এদুয়ার্দো ঠোঁট বাঁকিয়ে মৃদু হাসলো। মোহগ্রস্ত শ’ক্তিসম্পন্ন সুমধুর কন্ঠে বললো,
– ফ্লোরেনসিয়া, তুমি ভীষণ বোকা।
– অসভ্য, জানোয়ার! আমার মায়ের খু’নী। আমি তোমাকে ধ্বংস করবো। আমার হাতেই তোমার মৃ’ত্যু অবধারিত।
ক্রোধিত কন্ঠে কথাগুলো বললো সিয়া। ওর দু’চোখের দৃষ্টিতে অসামান্য ঘৃণা। এদুয়ার্দোর শান্ত চাহনি।
– নিকৃষ্ট পি’শাচ। তোমার এই অপবিত্র হাতে আমাকে স্পর্শ করার দুঃসাহস দেখিয়েছো। আমি এই হাত তোমার শরীর থেকে কেটে আলাদা করে ফেলবো।
এদুয়ার্দোর অসহিষ্ণু হয়ে পড়লো। বিরক্ত কন্ঠে বললো,
– মার্শাল আর্টে দক্ষ, তোমার মাস্টার বাবা তোমাকে এই প্রশিক্ষণ দিয়েছেন?
সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো সিয়ার। এদুয়ার্দোর ধরে থাকা ওর ডান হাতের তলোয়ার ছেড়ে দিলো। এদুয়ার্দো তলোয়ারটা মাটিতে ছুঁড়ে ফেললো। সিয়া নিজের শরীরের সমস্ত শক্তি ডান হাতের মুঠোয় জমা করে এদুয়ার্দোর বুকে সজোরে ঘুষি মারল। কিন্তু ওর হাতটা ধরে ফেললো এদুয়ার্দো। শক্ত গলায় বললো,
– তোমার প্রশিক্ষণের এই রণকৌশলগুলো আমি জানি। আঘাত কোন দিক থেকে আসবে, কিভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। সব জানা আছে। অযথা লাফালাফি না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো। তা নাহলে এই পাহাড় থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলবো। লা’শটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। হিংস্র জন্তু জানোয়ারের আহারে পরিনত হবে।
এদুয়ার্দোর কথাগুলো সিয়ার কানে বিষাক্ত হয়ে বাজে। ঘৃণা হয়। ভীষণ ঘৃণা হয়। ওর দু’চোখের মনিগুলো থেকে ক্রোধের ফুলিঙ্গ ঝরে পড়ে। নিজের দুই পা এদুয়ার্দোর বুকে রেখে উল্টো হয়ে পিছনে ঘুরে দাঁড়ালো। এদুয়ার্দো ওর হাত ছেড়ে দিলো। তাকে আঘাত করতে পুনরায় দৌড়ে এলো সিয়া।
এদুয়ার্দো স্থান পরিবর্তন করে সিয়ার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। সিয়া থেমে গেলো। চারপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে নজর বুলালো ও। পেছন ঘুরে দেখলো। চোখের সামনে বেশ কিছুটা দূরে এদুয়ার্দো দাঁড়িয়ে ছিলো। আক্রমনাত্মক হয়ে সিয়া পুনরায় দৌড়ে গেলো তার দিকে। কিন্তু ঝোঁকের বশে ভয়ংকর একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেললো।
দু’জনেই পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে ছিলো। এদুয়ার্দোর দিকে দৌড়াতে গিয়ে সিয়া পাহাড়ের নিচে গড়িয়ে পড়লো। বুকের গভীরে মৃ’ত্যুর হিমেল স্পর্শ অনুভব করলো। সিয়ার আফসোস হলো। নিজের ব্যর্থতা মেনে নিতে পারলো না ও। নিস্প্রভ কন্ঠে অনুচ্চ স্বরে বললো,
– মা! আমি আপনার অকৃতজ্ঞ মেয়ে। নিজের প্রতিজ্ঞা সম্পূর্ণ করে আপনার মৃ’ত্যুর প্রতিশোধ নিতে ব্যর্থ হওয়া এক অপদার্থ মেয়ে। ঈশ্বর কি আমাকে ক্ষমা করবেন? ক্ষমা করবেন আপনিও?
মা! এখন আর এই পৃথিবীর কোনো কিছু আমার ভালো লাগে না। আপনাকে ছাড়া সবকিছু বিষাক্ত মনে হয়। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আপনি কি জানেন? আমি কত রাত ধরে ঘুমাই না। এই পাহাড় থেকে নিচে পড়লে আমি তৎক্ষনাৎ মা’রা যাবো। মৃ’ত্যুকে ভয় পাইনা। কিন্তু আফসোস, আমি আমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারলাম না। মৃত্যুর পর স্বর্গে আপনার সাথে আমার আবারও কি দেখা হবে? আপনি আমায় বুকে আগলে রেখে ঘুম পাড়াবেন তো? আমি অনেকগুলো রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি মা।
আমি ব্যর্থ হয়ে আপনার কাছে ফিরে যাচ্ছি। ঈশ্বরের কাছে একটাই শেষ প্রার্থনা। যেন মৃ’ত্যুর পর আবারো আমাদের দেখা হয়।
কথাগুলো বলে দু’চোখের নেত্রপল্লব বুজে নিলো সিয়া। ধীরে ধীরে নিচে পড়তে লাগল। ভয় আর যন্ত্রণার সংমিশ্রণে একসময় চেতনা হারালো ও। হঠাৎ ওকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরল এদুয়ার্দো। সিয়ার নিষ্পাপ মলিন মুখখানার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললো,
– ফ্লোরেনসিয়া, বোকা বাঘিনী।
———-★
ইম্যুভিল।
প্রায় শেষ রাত। যেনো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছে প্রকৃতি। ঠান্ডায় জমে গেছে চারপাশ। হাঁড় কাঁপানো শীতে ঘুমের ঘোরে নাকের উপর পুরু কম্বল টেনে নিলো ইনায়া। কামরার বাইরে বারান্দায় কারো অস্পষ্ট পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো।
খট করে দরজা খুলে গেলো। দরজা খোলা ব্যক্তি বেশ হতবাক হলো। কারণ দরজাটা বাইরে থেকে লাগিয়ে রাখা ছিলো। খুব বেশি না ভেবে কামরায় প্রবেশ করলো সে। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস টেনে নিলো। যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। নিজের কাছেই নিজেকে চোর বলে মনে হলো। এই প্রথম, এই প্রথম সে বিনা অনুমতিতে কারো কামরায় প্রবেশ করলো। ভয় পেলো। মা’র খাওয়ার ভয়। পরমুহূর্তে নিজেই নিজেকে ঝারি দিয়ে বললো,
– কিসের ভয়? তুমি ভ্যাম্পায়ারদের এস্টীম রুলার।
কামরার এক কোণায় ছোট খাটো একটা মোমবাতি জ্বলছিলো। যার নিভু নিভু আলোয় আব্রাহাম বিছানার দিকে তাকিয়ে রইল। গায়ে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে থাকা দু’জন মেয়েকে দেখতে পেলো। অর্ধ মুখ ঢেকে ঘুমে নিমগ্ন থাকা ইনায়াকে দেখে তার হৃৎস্পন্দন থেমে গেলো। কতক্ষণ সময় গড়ালো কে জানে!
ধীরে ধীরে তার হৃদস্পন্দের গতি বাড়লো। এতটাই বাড়ল, যেনো মনে হচ্ছিল বক্ষস্থলে কোনো অলৌকিক দামামা বাজছে। একটা অসম্ভব সুন্দর প্রশান্তি। কি নাম দেওয়া যায় এই অনুভূতির?
আব্রাহাম ভাবলো। ভাবতে ভাবতেই সামনের দিকে পা বাড়ালো। একপা দু’পা করে হাঁটছিলো। শঙ্কিত হলো। যদি ইনায়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়! কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে ও?
ইনায়ার কাছে পৌঁছাতেই র’ক্তের নেশা জাগ্রত হলো। আব্রাহাম বিছানায় আলগোছে বসল। ঠোঁট ছড়িয়ে দুষ্টু হাসলো। ধীরহাতে ইনায়ার গা থেকে কম্বল টেনে নিলো। ইনায়া ঘুম জড়ানো মায়াবী কন্ঠে বললো,
– আর্নি। কম্বল টেনে নিও না প্লিজ। খুব ঠান্ডা লাগছে।
স্তব্ধ, বিমোহিত হলো আব্রাহাম। কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হয়ে তার কানে কানে বাজলো। দমে গেলো সে। কিন্তু পরমুহূর্তেই দু’দিকে মাথা নেড়ে মনে মনে বললো,
– উমহু। আমাকে র’ক্ত খেতে হবে।
আব্রাহাম পুনরায় ধীরে ধীরে কম্বল টেনে নিলো। রক্ত খেতে নয়, ইনায়াকে একনজর দেখতে এসেছিলো। কিন্তু সেকথা তাকে কে বোঝাবে? ভেতর থেকে তার দুষ্ট আত্মা বলে,
– আব্রাহাম তুমি রক্ত খেতে এসেছো, প্রেম করতে নয়। এভাবে লুকোচুরি কেনো খেলছো? ফটাফট র’ক্ত খাও আর তাড়াতাড়ি বিদায় হও।
আব্রাহাম ধমকে উঠলো তার দুষ্ট আত্মাকে। শঙ্কিত গলায় বলল,
– এখন তোমার কথা মতো কাজ করে মা’র খাই ওর হাতে। তাইনা?
দুষ্ট আত্মা শব্দ করে হাসে। আব্রাহাম কঠিন গলায় শাসানোর স্বরে বলে,
– একদম হাসবে না।
– হাসবো না! তুমি ভীতু। ভ্যাম্পায়ার সাম্রাজ্যের একজন শাসক হয়ে তুমি কিনা একটা সাধারণ মেয়েকে ভয় পাচ্ছো?
আব্রাহামকে উস্কে দিল তার দুষ্ট আত্মা। আব্রাহামের জেদ হলো। সহসা তার মধ্যে পি’শাচ সত্তা জেগে উঠল। ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে দু’টো সাদা ধারালো শ্বদন্ত বেরিয়ে এলো। ইনায়ার মুখের উপর থেকে কম্বল সরিয়ে ঘাড়ের কাছে মুখ ডুবিয়ে দিলো। এরই মাঝে তার একহাত আঁকড়ে ধরলো ইনায়া। মিষ্টি হেঁসে বললো,
– আমি তোমাকে ছেড়ে কখনো কোথাও যাবো না। সবসময় তোমার সাথে সাথে থাকবো। ভালবেসে পরম যত্নে বুকের মাঝে আগলে রাখবো। তোমার সব বিপদে-আপদে পাশে থাকবো।
আব্রাহাম থমকালো। কথাগুলো যেনো তার হৃদয় ছুঁয়ে গেলো। ইনায়ার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসিটুকু দেখে নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই মুখখানা মলিন হয়ে গেলো ইনায়ার মুখে ‘সিয়া’ নাম শুনতে পেয়ে। আব্রাহাম বেশ জোরালো গলায় বলে,
– ওহ! তারমানে এসব তুমি সিয়া নামের কোনো মেয়েকে বলছিলে?
কামরায় কোনো পুরুষের কন্ঠ শুনতে পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে গেলো ইনায়ার। দ্রুত উঠে বসে পড়লো। মোমবাতির নিভু নিভু আলোয় কাউকেই খুঁজে পেলো কামরার মধ্যে। মনের ভুল ভেবে পাশ ফিরে তাকালো। কিন্তু সিয়াকে বিছানায় না দেখে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো। দরজাটা হালকাভাবে চাপিয়ে রাখা ছিলো। ইনায়া বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। এগিয়ে গেলো বারান্দার দরজার দিকে। হয়তো সিয়া এখনো না ঘুমিয়ে বারান্দায় বসে আছে।
—————-★
কিয়েভ, স্যাভেরিন ক্যাসল।
স্নিগ্ধ ভোরের আলো ফুটে উঠল চারপাশে। একটি বদ্ধ কামরার দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন পিদর্কা স্যাভেরিন। দ্বাররক্ষীদের একজন দরজা খুলে দিলো। সগর্বে বুক টানটান রেখে পিদর্কা কামরায় প্রবেশ করলেন। চোখে মুখে প্রশান্তিময় হাসি। পেছনে দু’জন দাসী। এই কামরাটা প্রায় সবসময়ই অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে প্রয়োজনীয় কাজে কিছুক্ষণের জন্য যখন দরজা খুলে দেওয়া হয়, ভিতরে তখন কিঞ্চিত আলো প্রবেশ করে।
রাতের অন্ধকারে কামরাটায় আগুনের শিখা জ্বলেনি কখনো। ভয়! এখানে বন্দী থাকা রমনীকে ভয়ে জর্জরিত করার লক্ষ্যে এরকম শাস্তি দেওয়া হয়। রমনীর পরনে ছিল ময়লাযুক্ত ছেঁড়া পোশাক। ঢিলেঢালা সাদা রঙের লম্বা গাউন পরে কামরার এক কোনায় বসে ছিলেন তিনি। চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। মুখে ধুলোবালি।
কামরার দরজা খোলার শব্দে চমকে তাকালেন তিনি। প্রত্যেক বারের মতো এবারেও আশায় বুক বেঁধে আশাহত হওয়ার যন্ত্রণা অনুভব করলেন। কই? তাকে বন্দী দশা থেকে মুক্তি দিতে কেউ তো এই কামরায় আসে না। ব্যথা হয়, বুকের মাঝখানে চিনচিনে ব্যথা হয় তার। তিনি ভাবেন,
– সত্যিই কি মরে গেছে ক্লারেসিয়া? ওকে মে’রে ফেলেছে ওরা?
রমনী গুনগুনিয়ে কাঁদেন। বিরবিরিয়ে বলেন,
– ক্লারেসিয়া কি আসবে না? বি’নাশ হবে না পি’শাচদের? তাহলে কে রক্ষা করবে সাধারণ মানুষগুলোকে? এভাবেই কি শত শত বছর ধরে র’ক্তপিপাসুদের পাপের রাজত্ব চলতে থাকবে?
পিদর্কা স্যাভেরিন ধীরপায়ে রমনীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তার পরনে জমকালো দামী পোশাক। সোনালী রঙের জরি দিয়ে কারুকাজ করা খয়েরী রঙের গাউন। রমনী ঘৃণাভরা চোখে চেয়ে রইলেন। অতঃপর অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। পিদর্কা স্যাভেরিন ক্রুর হাসলেন। হাস্যোজ্জ্বল মুখে প্রশ্ন করলেন,
– কেমন আছো তুমি? কামরায় থাকা ইঁদুরগুলো তোমার ঠিকমতো খেয়াল রাখছে তো?
রমনী প্রত্যুত্তর দিলেন না। পাথরের মূর্তির মতো বসে রইলেন। পিদর্কা স্যাভেরিন উচ্চস্বরে হাসতে লাগলেন। হঠাৎ হাসি থামিয়ে আফসোস সূচক শব্দ করে বললেন,
– বেচারি! কতটা হতভাগীনি তুমি। আমি ছাড়া তোমাকে খাবার দেওয়ারও কেউ নেই। আমার দয়ায় বেঁচে আছো। নাও, খেয়ে নাও। তোমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি।
একজন দাসী শুকনো রুটি আর পানি দিলো রমনীকে। খেলেন না তিনি। হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেন খাবারের প্লেট। দৃঢ় কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
– আমার ছেলে কোথায়?
– গুস্তাভ ফ্লভেয়ার? —— চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে কৌতুহলী কন্ঠে জানতে চাইলেন পিদর্কা স্যাভেরিন।
– সেটা তো তোমার দেওয়া নাম। ওর আসল নাম পাওলো। পাওলো স্যাভেরিন।
– ভুলে যাও। মে’রে ফেলেছি ওকে।— পিদর্কা মেকি হেসে প্রত্যুত্তর দিলেন।
মূহুর্তেই রমনী ভয়াবহ রেগে গেলেন। ত্বরিত উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ক্রোধের আধিক্যে দু’হাতে পিদর্কা স্যাভেরিনের গলা চেপে ধরলেন।
………..
#চলবে