#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
রাত আটটা। রুদ্রদের হৈহৈ করা বাড়িটা আজ নিস্তব্ধতায় মুড়িয়ে গেছে। মেঝেতে উদাসীন হয়ে বসে আছে সকলে৷ চব্বিশ ঘণ্টা না গেলে থানায় জিডি করা যাবে না। রাজ ও তুরফান যেনো আজ সবার চেয়ে বড়ো হয়ে গেছে। শরবত করে এনে রুদ্রকে ও নিজের বাবাদের দিয়ে বলছে, ‘তোমরা তো সারাদিন বাহিরে ছিলে, এটা খেয়ে নাও হালকা লাগবে।’
রুদ্র নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো শুধু শরবতের গ্লাস হাতে নিলো না। তটিণী-র মামারা রওনা দিয়েছেন ইতিমধ্যে। তাহের ইফফাতের গোষ্ঠীর সবাই হয়তো এতোক্ষণে অর্ধেক চলে এসেছেন।
রুদ্র যখন উদাসীন হয়ে মেঝেতে তাকিয়ে, তখন বিকৎ শব্দে বেজে উঠলো তার মুঠোফোন। রাজ ডেকে বলল, ‘ভাইয়া তোমার ফোন বাজছে।’
রুদ্র পকেট থেকে ফোন বের করে আননন নাম্বার দেখে রিসিভ করলো। কানে নিতেই ভেসে এলো চিরপরিচিত কন্ঠস্বর।
‘রুদ্র ভাই? হসপিটালে আসুন না একটু। আমাকে এসে নিয়ে যান। মা বাবা নিশ্চয়ই চিন্তা করছে। অনেক লেট হয়ে গেছে তো।’
রুদ্র কথা বলতে চেষ্টা করলো। কিন্তু তার গলা দিয়ে স্বর এলো না। অগত্যা লাউঞ্জে দিয়ে মোবাইল নিজের বাবার দিকে এগিয়ে দিলো। তাহসিন ইরফান অবাক হয়ে বললেন, ‘হ্যালো?’
তটিনী নাক ফুলিয়ে বলল, ‘ওহ হ বড়ো বাবা? নিতে আসো আমায়। আমি আটকে গেছি তো।’
রোবা নাহার তৎক্ষনাৎ মোবাইল কেড়ে নিলেন। বললেন, ‘কোথায় তুই তটিনী মা?
তটিনীর গলা ভেসে এলো, ‘আমি হসপিটালে আটকে গেছি বড়ো মা। রুদ্র ভাইকে পাঠাও জলদি।’
‘কোন হসপিটাল মা?’
তটিনী হসপিটালের নাম বলে রেখে দিলো। রোবা নাহার রুদ্রের দিকে তাকালেন। রুদ্র মাথা নাড়িয়ে না করলো। অগত্যা তাহের ও তাহসিন বের হলেন নিজেদের মেয়েকে আনতে। রোবা নাহার বরফ এনে রুদ্রের বুকে মালিশ করে দিতে দিতে বললেন, ‘চিন্তা নেই রুদু, ও চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে।’ মেয়েটিকে আমরা বকে দিবো। কিরকম চিন্তায় ফেলেছিল আমাদের।’
মুখ বন্ধ করে নির্বাক হয়ে বসে আছেন ঈশানী। রাজ ও তুরফানের মুখে হাসি ফুটেছে। দুজন খুশিতে কেঁদে ফেললো।
চল্লিশ মিনিটের মাথায় বাড়িতে প্রবেশ করলো তটিনী। বাড়ির প্রাণ ফিরে পেয়ে রোবা নাহার দৌড়ে আসলেন। বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। তটিনী মন খারাপ করে বলল, ‘কেঁদো না বড়ো মা। কিছু হয়নি তো।’
রোবা নাহার চুলের ভাঁজে চুমু খেয়ে বললেন, ‘একটা খবর কেন দিসনি মা? তুই হসপিটালে কি করছিলি?’
তটিণী-র মাথায় ব্যান্ডেজ করা। ঈশানী সোফা থেকে হাত মেলে দিলেন। তটিনী দৌড়ে নিজের মায়ের কাছে গেলো। বলল, ‘আমি স্যরি মা, আর দুষ্টুমি করবো না।’
তাহের ইফফাত সোফায় বসতে বসতে বললেন, ‘তোমার মেয়ে রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বাড়িতে আসছিল। রিক্সার সাথে ধাক্কা লেগে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলো৷ পাশের হসপিটালে নিয়ে গেছিল লোকজন। সন্ধ্যার দিকে জ্ঞান ফিরে।’ বাড়িতে গাড়ি রেখেছি কি জন্য? গাড়ি থাকতে যদি দৌড়ে দৌড়ে যাতায়াত করতে হয় তো আমি কালকে গাড়ি ভেঙে ফেলবো।’ মনে থাকে যেনো। বলেই তাহের ইফফাত নিজের রুমে চলে গেলেন।’
তটিনী ঠোঁট উল্টে বলল, ‘আমি আর দৌড়াদৌড়ি করবো না।’
রোবা নাহার রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন, ‘সবই ঠিক আছে রে মা। তোর বাপ মায়ের গোষ্ঠী আসতেছে। রান্না চাপাই গিয়ে।’
তটিনী ফিক করে হেসে বলল, ‘ওমা ওরাও খবর পেয়ে চলে আসছে।
ঈশানী মেয়ের কপালে হাত রেখে বললেন, ‘অনেক রক্ত গেছে নিশ্চয়ই? আরও করিস শয়তানি, আরও দৌড়াদৌড়ি করিস তুই।
ঈশানী রান্নাঘরে চলে গেলেন। তটিনী রাজ ও তুরফানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোদের চোখমুখ ফুলে আছে কেন? বাপ্রে তোরাও কেঁদেছিস?’
রাজ ও তুরফান দৌড়ে এসে দুদিক থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আর কখনো এমন করিস না। কয়েক ঘন্টায় সবার কিরকম অবস্থা হয়েছে দেখ। ভাইয়া তো অসুস্থ হয়ে গেছে।’
তটিনী এবার চোখ তুলে মেঝেতে মাথা নিচু করে বসা রুদ্রের দিকে তাকালো। সোফা থেকে নেমে রোদ্রের পাশে বসে পড়লো। রুদ্র চোখ তুলে তাকাতেই তটিনী হাসলো। রুদ্র নিজেও মুচকি হাসলো। তটিনী কানে ধরে বলল, ‘আমি অনেক স্যরি রুদ্র ভাই।’ আর এমন হবে না।’
রুদ্র নাক টেনে বলল, ‘কাছে আয়।’
তটিনী রুদ্রের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি ভেবেছি আপনি রাগ করবেন। ওমা আপনি দেখি হাসছেন।’
রুদ্র তটিণী-র কপালে হাত ভুলিয়ে বলল, ‘অনেক লেগেছে না তোর?
তটিনী ঠোঁট উল্টে বলল, ‘অনেক।’
রুদ্র পকেট হাতড়িয়ে চকলেট বের করে দিয়ে বলল, ‘বিকেলে কিনে রেখেছিলাম তোর জন্য।’
তটিনী দাঁত বের করে হেসে চকলেট নিয়ে নিলো। পাঁচটা চকোলেটের মধ্যে দুটো রাজ ও তুরফানকে দিয়ে একটা রুদ্রকে দিয়ে বলল, ‘আপনিও খান। বাবা বলেছে আপনি আমাকে অনেক খুজেছেন। এনার্জি পাবেন এটা খেলে।’
রুদ্র চোখে জল নিয়ে হাসলো। তটিনী চকোলেট মুখে দিয়ে বলল, ‘আমি তো এখন অসুস্থ। অসুস্থ রোগী কি স্কুলে পড়তে যায় রুদ্র ভাই?’
রুদ্র মাথা নাড়িয়ে না বললো। তটিনী দাত বের করে বলল, ‘সেজন্য আমিও যাবো না। এই ফাঁকে চলুন কোথাও ঘুরতে যাই হ্যাঁ? ‘
রুদ্র নির্মিমেষ চোখে তটিণী-র চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তটিনী ঢুক গিলে বলল, ‘আপনি ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?
রুদ্র এক হাত দিয়ে তটিনীকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তোর তো ধান্দা ভালো না। অসুস্থ হয়েও তার ফায়দা তুলছিস। ধান্দা বাজ একটা।’
তটিনী ঠোঁট উল্টে বলল, ‘আমি বলেছি নাকি? ডাক্তার বলে দিয়েছে অসুস্থতার সময় ঘুরাফেরা করলে মন ভালো থাকে।’
রুদ্র চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে নিয়ে যাবো।’
রোবা নাহার রান্নাঘর থেকে বের হয়ে বললেন, ‘তোর চিন্তায় সবার খারাপ অবস্থা হয়েছিল। রুদুর বুকে ব্যথা করছিল। তোকে পাওয়ার পর সুস্থ হয়ে গেছে।’ আমাদের এতো কাদানোর জন্য তোকে কি করা উচিত বল তো?’
তটিনী মুখ গুমড়া করে বলল, ‘আমি কি ইচ্ছে করে কাঁদিয়েছি? ‘
রুদ্র মানা নাড়িয়ে বলল, ‘একদমই না। মা তুমি ওকে আর দোষ দিও না। বেচারি মাথা ফা*টিয়ে বসে আছে। ওর জন্য শাকসবজি রান্না করো। অনেক রক্ত চলে গেছে নিশ্চয়ই?’
তটিনী হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘এতো এতো গেছে রুদ্র ভাই।’
রুদ্র বলল, ‘উঠে দাড়া। আমাকে টেনে তুল।
তটিনী উঠে দাঁড়ালো।যতোটুকু শক্তি ছিল সবটুকু দিয়ে টেনে তুলতে চেষ্টা করলো রুদ্রকে। কিন্তু একচুলও পারলো না। রুদ্র নিজ থেকে উঠে দাঁড়ালো। তটিনীর কাঁধে হাতের ভর দিয়ে বলল, ‘রুমে নিয়ে চল।’
তটিনী সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলল, ‘আপনার অনেক খারাপ লাগছে রুদ্র ভাই? ডাক্তার ডাকি?’
রুদ্র হেসে বলল, ‘লাগবে না, ঠিকই আছি।’
রুদ্রকে নিজের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তটিনী দাড়িয়ে রইলো। রুদ্র চোখ বন্ধ করে চুপ করে শুয়ে রইলো। তটিনী মিনমিন করে বলল, আপনার কি মাথা যন্ত্রণা করছে রুদ্র ভাই? টিপে দেই?’
রুদ্র কোনো শব্দ করলো না। তটিনী নিজ থেকে মাথার কাছে বসে হাত বাড়িয়ে মাথা টিপে দিতে লাগলো। রুদ্র চোখ বন্ধ রেখেও মুচকি হাসলো। তটিণী-র কোলে বালিশ রেখে সেখানে মাথা রেখে বলল, ‘এবার টিপে দে বুড়ি।’
তটিনী মন খারাপ করে বলল, ‘আমি বুড়ি নই।’
রুদ্র ঠোঁট চেপে হাসলো। তটিনী কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, ‘আমি বুড়ি নই রুদ্র ভাই।’
রুদ্র চোখ মেলে বলল, ‘তুই বুড়ি নোস তুই মাইয়া। এবার দে মাথা টিপে দে। তবুও কাঁদিস না। আর সহ্য হচ্ছে না। মে*রে ফেলবো এবার।’
তটিনী নাক ফুলিয়ে নিজের কাজ করতে লাগলো। রুদ্র ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে বিরবির করে বলল, ‘স্যরি ঐশি।
তটিনী সেটা শুনে ফেললো, নাক ঠিকঠাক করে মুচকি হাসলো। যাক তার রুদ্র ভাই আর রেগে নেই।’
(চলবে)