#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
তটিণী-রা ট্যুরে যাচ্ছে। তাও বড়সড় ট্যুর। সিলেটের মাটিতে তটিণী-র কখনো পা রাখা হয়নি। সেজন্য সে অনেক এক্সাইটেড। রাতের মধ্যে সবকিছু গুছিয়ে রাখা হয়েছিল। সকালের দিকে মাইক্রোতে সবাই চেপে বসে পড়লো।
তটিনী চিল্লিয়ে বলল, ‘হুর রে… এবার যাচ্ছি ট্যুরে সিলেটে।’
রুদ্র সামনের সিট থেকে কান চেপে ধরলো। শশি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।
*
সিলেট উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশের একটি প্রধান শহর, একই সাথে এই শহরটি সিলেট বিভাগের বিভাগীয় শহর। এটি সিলেট জেলার অন্তর্গত। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন এলাকাই মূলত সিলেট শহর হিসেবে পরিচিত। সিলেট ২০০৯ সালের মার্চ মাসে একটি মেট্রোপলিটন শহরের মর্যাদা লাভ করে। সুরমা নদীর তীরবর্তী এই শহরটি বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এ শহরটি দেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত। সিলেট অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে পরিচিত। শিল্প, প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক ভাবে সিলেট দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ধনী জেলা। এ শহরের বিশাল সংখ্যক লোক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাস করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ করে দেশের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। সিলেটের পাথর, বালুর গুণগতমান দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এখানকার প্রাকৃতিক গ্যাস সারা দেশের সিংহভাগ চাহিদা পূরণ করে থাকে।
সিলেট শহরের কেন্দ্রস্থল, সিলেট রেলওয়ে স্টেশন, সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম, চা বাগান, শাহজালালের মাজার, সিটি পয়েন্ট। শাহ জালাল ও শাহ পরান-এর পবিত্র মাজার শরীফ এ শহরে অবস্থিত। প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক ধর্মপ্রাণ লোক মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে আগমন করে। আসে বিপুল সংখ্যক পর্যটক। এছাড়াও রয়েছে জাফলং, রাতারগুল, বিছানাকান্দি, সাদাপাথর।
জাফলং (Jaflong) প্রকৃতির কন্যা হিসাবে পরিচিত। সিলেট জেলার দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে জাফলং সবার পছন্দ। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষা প্রকৃতির দানে রুপের পসরা সাজিয়ে আছে জাফলং। পাথরের উপর দিয়ে বয়ে চলা পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ পানির ধারা, ঝুলন্ত ডাউকি ব্রিজ, উঁচু উঁচু পাহাড়ে সাদা মেঘের খেলা জাফলংকে করেছে অনন্য। একেক ঋতুতে জাফলং একেক রকম রুপের প্রকাশ ঘটায়, যা পর্যটকদেরকে ভ্রমণের জন্য সারাবছরই আগ্রহী করে রাখে।
সিলেটের জাফলং এ বড়সড় ট্যুর দেওয়ার আনন্দে তটিণী-র খুশি যেনো ধরে না। রুদ্র বলেছে পারলে সিলেটে আরও অন্যান্য জায়গায় ও নিয়ে যাবে।
*
মেদিনীতে ঝিরিঝিরি বর্ষণ নেমেছে। বাতাসের দাপটে ধুলোবালি উড়াউড়ি করছে চারিদিকে। ঝিরি বর্ষণ শুরু হওয়ার মধ্যেই বাহিরে ঘুরাঘুরি করা দর্শকরা রিসোর্টে ঢুকে গেছে। এই অন্ধকারে বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া প্রকৃতি কন্যা জাফলংকে যেনো আরো সৌন্দর্যে ভরিয়ে দিচ্ছে। ধূলো কণা চোখে মুখে পড়তে পারে সেজন্য রিসোর্টে অবস্থানকৃত ব্যক্তিরা জানালা আটকে দিয়েছেন অনেক আগে। ধুলোবালি উড়ানো এই বর্ষণে জাফলংয়ের রিসোর্টের প্রবেশদ্বারে থামলো একটি যাত্রীবাহী মাইক্রোবাস। ছোটখাটো মাইক্রো থেকে নেমে আসলো একে একে রুদ্র তটিনী ও তাদের পরিবারের লোকজন।
রাত তখন আটটা। মাইক্রো থেকে নেমে সবাই দৌড়ে রিসোর্টের দিকে এগুচ্ছে। এই ধুলোবালি উড়ানো আবহাওয়াতেও তটিনী দুহাত দু’দিকে মেলে দিয়ে চিৎকার করে বলছে, ‘সবকিছু এতো সুন্দর কেন রুদ্র ভাই?’
রুদ্র হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘পরে সব দেখিস। আপাতত নিজেকে বাচা।’
অগত্যা তটিণী-র রাতে আর ঘুরাঘুরি করা হলো না। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে সবাই আরামের ঘুম দিলো কাঁথা মুড়িয়ে জাফলংয়ের রিসোর্টে।
রৌদ্রজ্বল আকাশে পেজা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাতাসে বইছে শীতল হাওয়া। সময় ভোর সাতটা। রাতের মধ্যভাগে আকাশের কান্না থেমে আস্তে আস্তে আকাশে আবারো মেঘ জমতে শুরু করেছিলো। অন্ধকার কাটিয়ে ধীরে ধীরে প্রভাতের আলো ফুটে উঠতেই সূয্যিমামা নিজের ক্ষমতা দেখালেন অল্প করে। ঘুম ঘুম চোখে তাকালো তটিনী। মুঠোফোন বের করে সময় দেখে নিলো। আটটা এখনো বাজেনি। সে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো।
পাহাড়, টিলা আর দিগন্ত বিস্তৃত চা-বাগান যেনো সিলেটকে ঢেকে রেখেছে সবুজ চাঁদরে। যেখানে পর্যটকরা মুগ্ধ হোন, প্রেমে পড়েন শীতল প্রকৃতির এই লীলাভূমিতে। সিলেট হচ্ছে দুটি পাতা একটি কুঁড়ির সবুজ রংয়ের নয়নাভিরাম চারণভূমি, হযরত শাহজালাল (রহ.) ও হযরত শাহপরান (রহ.)সহ ৩৬০ আউলিয়ার পুণ্যভূমি। এখানে জন্মেছেন মরমী কবি হাসন রাজা, রাধা রমন দত্ত, আরকুম শাহ, দূরবীন শাহ ও শাহ আব্দুল করিমের মত মরমী সাধকরা। প্রকৃতি কন্যা জাফলং সারাদেশে একনামে পরিচিত সিলেট জাফলং নামে। সেখানেই এসেছে তারা।
সকালের নাস্তা শেষ করে নয়টার পর রিসোর্ট থেকে বের হলো সবাই। তটিনী জিন্স ও টি-শার্ট পড়েছে। রোবা নাহার ও ঈশানী যেনো যুবতী হয়ে গেছেন হঠাৎ করেই। দুজনে জিন্স ও ফতোয়া পড়েছেন। নিজেদের বউদের দেখে হতভম্ব দু’ভাই। সাথে যোগ দিয়েছে আশারিয়া আহমেদ। আলপনা ও শশি জিন্স টিশার্ট পড়েছে। সবার মধ্যেই পর্যটক পর্যটক ভাব।
জাফলংয়ের পানিতে নেমেছে সবাই। এতো শান্তি যেনো আর কোথাও নেই। চারিদিকে সকালের শীতল বাতাস বইছে। এজন্যই বুঝি সবাই সিলেটকে শান্তির শহর বলে। ভারতের মানুষ আর বাংলাদেশের মানুষের মিলনমেলা যেনো এই জাফলং। কেউ কেউ পানিতে সাতার কাটছে, কেউ কেউ ছবি তুলছে, কেউ কেউ নৌকা চড়ে ব্রিজের কাছে গিয়ে ফিরে আসছে। আস্তে আস্তে সব দোকানপাট খুলছে দোকানীরা।
তটিনী পানিতে লাফাচ্ছে। সাথে যোগ দিয়েছে দুটো পিচ্চি কাজিন। রুদ্র কোমড়ে হাত রেখে বলল, ‘এখানেই লাফাতে থাক। দূরে যাস না। সাঁতার জানিস না কিন্তু তুই।’
তটিনী বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ালো। রুদ্র মোবাইলের ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে শুরু করলো। এদিকে রাজ ও তুরফান হাফপ্যান্ট পড়ে পানিতে নেমেছে। দুজনের খুশি যেনো ধরছে না। তুরফান ও রাজ সাঁতার জানে। সেজন্য তারা গভীরে গিয়ে সাঁতরাচ্ছে। তটিণী-র তা দেখে মন খারাপ হলো। রুদ্র তখন ছবি তুলতে ব্যস্ত। তটিনী তুরফানকে ডেকে বলল, ‘এই ভাই আমাকেও নে না। আমিও সাঁতরাবো।
তুরফান তটিণী-র এক বছরের ছোট। কিন্তু লম্বার কারণে বোঝার উপায় নেই কে ছোট কে বড়ো। তুরফান বড়ো ভাইয়ের মতো করে বলল, ‘একদম না বোন। তুই সাঁতার জানিস না। পরে ডুবে যাবি।’
তটিনী ঠোঁট উল্টে বলল, ‘আরে ডুববো না। তোরা দুটোয় ধরে রাখবি আর আমি সাঁতরাবো।
রাজ ও তুরফান একে অপরের দিকে তাকালো। রাজ ইশারায় মানা করতেই তুরফান বলল, ‘ নারে তুই বরং বাবাকে বল যা।’
অগত্যা তটিনী বাবার দিকে তাকালো। তাহের ইফফাত পানির উপর একটি পাথরে বসে আছেন। তটিনী সেদিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘আমাকে ধরে সাঁতার কা*টাও না বাবা প্লিজ।’
তাহের ইফফাত উঠে দাঁড়ালেন। মেয়েকে নিজের দুহাতে তুলে রাজদের কাছাকাছি নিয়ে গেলেন। তটিনী বিশ্বজয় করার মতো আনন্দ পেলো। রাজ ও তুরফানকে ভেংচি কেটে সে সাঁতার কাটতে লাগলো।
তাহের ইফফাত কিছু সময় পরই বললেন, ‘হাতে ব্যাথা করছে মা। চলো পাড়ে যাই।
তটিনী বাবার কথা মেনে নিলো। পাড়ে আসার পর রাজ মুখ ভেংচি ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘এবার কি করবি?’
তটিনী নাক ফুলিয়ে রুদ্রকে চেপে ধরলো। রুদ্র অবাক হয়ে বলল, ‘কি হলো তোর?
তটিনী কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, ‘সাঁতার শিখবো রুদ্র ভাই।
রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘তোর বাপকে বল।
‘বাবা তো কিছুক্ষণ পরই হয়রান হয়ে গেছে।’
‘কিছুক্ষণ হলেও তো কে*টেছিস। তাহলে আর মন খারাপ কিসের?’
‘আমি আরও সাঁতার কা*টবো।
রুদ্র পানিতে নেমে বলল, ‘আয়।’
তটিনী রাজ ও তুরফানের দিকে তাকিয়ে ভেংচি কা*টলো। রুদ্র সেটা দেখে হেসে বলল, ‘সবসময়ই সবকিছু নিয়ে প্রতিযোগিতা না করলে চলে না তোর?’
তটিনী পাম মা*রতে বলল, ‘আপনি কত্তো ভালো রুদ্র ভাই। আপনার কতো এনার্জি বলুন। আপনার কাছে তো কুস্তিওয়ালারাও ফেইল।’
রুদ্র মিনমিন করে বলল, ‘বেশি বেশি হয়ে গেলো না!
(চলবে)