#পর্ব-১৭ (চাঁদরাত স্পেশাল পর্ব)
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
ঈদের চাঁদ দেখার জন্য দৌড়ে ছাঁদে উঠছে তারা। তটিনী ছাদের চারিদিকে ঘুরেঘুরে ঈদের চাঁদ খুঁজতে লাগলো। রুদ্র পেছন থেকে আকাশের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘এই-যে ঈদের চাঁদ ঈশি।’
তটিনী ঈদের চাঁদ মনোযোগ দিয়ে দেখলো। বলল, ‘ঈদের চাঁদ এতো সুন্দর কেন রুদ্র ভাই?’
রুদ্র হেসে বলল, ‘যার মন সুন্দর তার কাছে সবকিছু সুন্দর লাগে তা-ই।’
তটিনী অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি কি আমার প্রশংসা করলেন?’
রুদ্র পকেটে হাত গুঁজে টান টান হয়ে দাড়ালো। বলল, ‘একদমই না।
তটিনী পুনরায় চাঁদ দেখতে মন দিলো। রাজ ও তুরফান চিল্লিয়ে আশেপাশের ছাদের ছেলেমেয়েদের সাথে চাঁদ দেখার আনন্দ উদযাপন করছে। রুদ্র ফিসফিস করে বলল, ‘তুমি একদম বোকা আমার বোকা ঈশি।
চিল্লাচিল্লির জন্য তটিণী-র কানে কিছু গেলো না। চাঁদ দেখা কমিটির জন্য অপেক্ষা না করে নিজেরাই চাঁদ দেখে ঈদ ঈদ ফিল নিয়ে মেহেদি দিয়ে হাত রাঙাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই।
*
চারিদিকে বিদায়ের ঘন্টি বাজছে৷ মুসলমানদের মাসব্যাপী রমজান বিদায় নিচ্ছে। দিয়ে যাচ্ছে মুসলিমদের ঈদ উল ফিতরের আনন্দ। সময়টা চাঁদরাত। পার্লার থেকে মেহেদি আর্টিস্ট বুক করা হয়েছে। তাদের হাতেই মেহেদির রঙে নিজেকে রাঙাতে ব্যস্ত তটিনী। দু’হাতে মেহেদী দিয়ে দুপায়ে দিতে বসেছে আপাতত। এদিকে তার মা চাচীরা পিঠা বানাতে ব্যস্ত। তটিণী-র হয়ে গেলে আর্টিস্ট তারা দিতে লাগলো। আরও কাস্টমার আছে তাদের। ঈশানী রোবা নাহারকে ঠেলে পাঠালেন৷ বললেন, ‘আপনি আগে দিয়ে নিন ভাবি। আপনি দিতে দিতে আমি এগুলো ভেজে নেই। তারপর আমিও দিয়ে দিবে না-হয়।
রোবা নাহার অগত্যা দিতে রাজি হলেন। আর্টিস্ট মেহেদি পড়াতে শুরু করলো। রোবা নাহার সোফায় বসে থাকা রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কি যে পাগলামি করিস না রুদু, আমার কি এখন বয়স আছে মেহেদী দেওয়ার?
রুদ্র মোবাইল স্কিন থেকে চোখ তুলে এক নজর তাকালো। বলল, ‘সারাবছর না দাও, ঈদে অন্তত খুশি ডাবল করতে মেয়েদের মেহেদি দেওয়া প্রয়োজন। তার জন্য বয়স কোনো মেটার না মা। তুমি আমার চোখে সবসময়ই সুন্দর। আমার মাকে মেহেদি রাঙা হাতেও মানায়। রান্নাঘরে খুন্তি হাতেও মানায়।
রোবা নাহার হেসে বললেন, ‘হয়েছে আর পাম দিতে হবে না তোকে।’
রুদ্র উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলো। ঈশানীর সাথে নিজেও পিঠা ভাজতে শুরু করলো। ঈশানী মানা করে বললেন, ‘তোমাকে এসব করতে হবেনা রুদু। তুমি গিয়ে বসে থাকো। আমি ভেজে তোমাকে দিয়ে আসবো।
রুদ্র গরম তেলে পিঠা ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘করতে হবে না বললে তো হবে না চাঁচি আম্মা। মায়ের পর তোমাকেও দিতে হবে। সুতরাং গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি ভেজে নিতে পারবো।
তটিনীদের বাসার কাজের খালাটি ঈদের ছুটিতে চলে গেছে সকালে। সুতরাং হেল্প করার জন্য আর কেউ নেই। ঈশানীকে জোর করে বের করে দিলো রুদ্র। তটিনী হাত উপরে উঁচু করে মেহেদি রাঙা পা দিয়ে ধীরে ধীরে রান্নাঘরে ঢুকলো। হা করে বলল, ‘দিন তো একটা পিঠে মুখে দিন।’
রুদ্র একটা পিঠার কিছু অংশ ফু দিয়ে তটিণী-র মুখে দিলো। খেতে খেতে তটিনী বলল, ‘বাহ সেই টেস্ট।’
রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলল, ‘বসে বসে খেতে সবারই টেস্ট লাগে।’
তটিনী চোখমুখ কুঁচকে বলল, ‘আপনি কি বলতে চাইছেন? আমি বসে বসে খাই?’
রুদ্রের সহজ উত্তর, ‘হ্যাঁ।’
তটিনী ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘একদমই না। আমি বসে বসে খাই না আপনার মতো রুদ্র ভাই।’
রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘তাহলে কিভাবে খাস?
তটিনী দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘এখন যেভাবে খেলাম, দাড়িয়ে দাড়িয়ে। হে হে হে।’
তটিনী রান্নাঘর ত্যাগ করলো। রুদ্র হেসে নিজের কাজে মন দিলো।
রোবা নাহার মেহেদি পড়ে সোফাতে বসে আছেন। তটিনী মেঝেতে বসেছে। রাজ ও তুরফান তটিণী-র আশপাশে ঘুরঘুর করছে। সুযোগ খুঁজছে কিভাবে তটিণী-র রাঙা হাত-পায়ের সুন্দর ডিজাইন ছড়ানো যায়। তটিনী এদের মতলব খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে। সেজন্য সে তার বড়োমার পায়ের কাছে বসে মেহেদি শুকাচ্ছে। ঈশানীর হাতে মেহেদি দিয়ে আর্টিস্ট বিদায় নিলো। রুদ্র পিঠা এনে রেখেছে সোফার পাশের কাঁচের ছোট্ট টেবিলে। রাজ ও তুরফান পিঠা খেতে খেতে তটিণী-র দিকে তাকিয়ে জিহ্বা বের করছে।
রুদ্র তটিণী-র মুখে পিঠা ঠেসে দিয়ে বলল, লাগালাগি বাদ দে।
তটিনী কটমট করে তাকিয়ে পিঠা গিলে ফেললো। বলল, ‘আমি লাগি? নাকি আপনার ভাইয়েরা লাগে? সব দোষ আমাকে দেয় সবাই, অথচ দু’টো বান্দর যে সবসময় আমার পিছনে লেগে থাকে সেটা কেউ দেখে না।
রুদ্র চোখ বড়ো করে তাকালো। তটিনী মা নুইয়ে নিজের পায়ের মেহেদি দেখতে লাগলো। রুদ্র এবার রাজ ও তুরফানের দিকে তাকালো। দুজন হঠাৎ করেই ফেরেস্তা হয়ে গেলো। যেনো তাদের মতো ভালো মানুষ সভ্য বাচ্চা পৃথিবীতে আর একটাও হতে পারে না। রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলল, ‘কি ব্যাপার তোদের?
রাজ মুখ ভার করে বলল, ‘কোনো ব্যাপার না ভাইয়া। আমরা ভদ্র বাচ্চা। আমাদের থেকে ভদ্র বাচ্চা পৃথিবীতে আর একটাও তুমি খুঁজে পাবে না। আমরা না থাকলে জাতি ধ্বংস। আর তুমি কি না আমাদের দিকে চোখ বড়ো করে তাকাচ্ছো!
তুরফান তাল মিলিয়ে বলল, ‘আমার মতো ভদ্র বাচ্চা জগৎসংসারে আর দুটোও পাবেন না। পৃথিবীর কোনো কোণাতেও পাবেন না। বোন সবসময়ই মিথ্যা বলে। আমি কিছু করিনা কখনো। আমি তো ফিডার খাই এখনো। তাই না মা?
ঈশানী চোখ বড়বড় করে তাকালেন। রুদ্র গলার স্বর যতটুকু সম্ভব উঁচু করে বলল, ‘তাই নাকি? তোদের মতো ভদ্র বাচ্চা পৃথিবীর কোনো কোণায়ও পা-ওয়া যাবে না? তার মানে বলতে চাইছিস তোরা ছাড়া পৃথিবী নিঃস্ব, পৃথিবীর কোনো মানে নেই!
তুরফান ও রাজ মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘একদম।
রুদ্র হিসহিস করে বলল, ‘এতো অ-মূল ধন আমার বাড়িতে কি করছে? তোদের কালই বিজ্ঞানীদের হাতে তুলে দেওয়া দরকার। পৃথিবীর অমূল্য ধন এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলে তো মহা সমস্যা হবে জাতির।
রাজ ও তুরফান মুখ গোমড়া করে বলল, ‘একদমই না। আমরা অবশ্যই গবেষণার বস্তু নই। আমরা মানুষ। আমরা পৃথিবীর যেকোন কোনায় থাকতে পারি।
রুদ্র পিঠার প্লেট রেখে দুজনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রাজ ও তুরফান ঘাবড়ে গেলো৷ রুদ্র দুজনের পিঠ চাপড়ে বলল, ‘ছোট মা?
ঈশানী ‘হু’ বলতেই রুদ্র হেসে বলল, ‘এই দুজনকে ঈদের বোনাস হিসেবে কি দেওয়া যায় বলো তো?’
ঈশানী হেসে বললেন, ‘দাও যা ইচ্ছে। ঈদের খুশি বাড়িয়ে দাও।
রুদ্র ভ্রু নাড়িয়ে বলল, ‘রেডি তো দুজন?
রাজ ও তুরফান একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। তুরফান কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, ‘আমি পৃথিবীর অমূল্য কোনো ধন নই ভাইয়া। আমি তো আমার রুমের সামান্যতম ধন। যাকে মা প্রতিদিন একবার হলেও খুন্তি নিয়ে দৌড়ায়।
রাজ ভয় পেয়ে বলল, ‘আমিও কোনো অমূল্য ধন নই ভাইয়া৷ আমি তো এই বাড়ির ঘরের এক কোণে পড়ে থাকি। পৃথিবীর কেনো এই বাড়িরও কোনো অমূল্য ধন নই।
রুদ্র দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো। রোবা নাহার দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমরা হয়তো পৃথিবীর নয়, কিন্তু তোমাদের মায়েদের কাছে অমূল্য ধন। মনে থাকবে?
রাজ ও তুরফান মাথা নাড়ালো। রুদ্র সোফায় বসে বলল, ‘দুজন আর কখনো ঐশির পিছনে লাগবে না। বোনকে যেনো আর ডিস্টার্ব করতে না দেখি তোমাদের। মনে থাকবে?
রাজ ও তুরফান মাথা নাড়ালে। তটিনী দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘যাক বাবা দু’টোর আজ শিক্ষা হলে তাহলে।
রাজ ও তুরফান কটমট করে তাকালো। অর্থাৎ পরে দেখে নেবো।
(চলবে)