#পর্ব-২৭
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
সর্বনাশিনী..!
কেমন আছো? সুইজারল্যান্ডের পাকা রাস্তায় দাড়িয়ে তোমাকে মিস করি। আমার ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে দেখতে পাওয়া তুষারপাত মিস করে একজোড়া কপোত-কপোতীর। আমি তার মিস টাকে পরিপূর্ণ করতে তোমাকে এখানে নিয়ে আসবো ভেবেছি। তুমি আসবে তো ঐশি? জানালার পাশে দাড়িয়ে একসাথে তুষারপাত দেখবে তো?’
রুদ্র..
নাস্তার টেবিলে বসে রুদ্রের মেসেজটি পড়লো তটিনী। রিপ্লাই দিলো,
‘আপনার কাছে নিয়ে না গেলে দেখবো কিভাবে? নিয়ে যান না।’
রুদ্র রিপ্লাই দিলো,
‘ঘুরেফিরে বাড়ি ফিরো, দ্যান দেখছি।’
তটিনী খুশি মনে নাস্তা সারলো। নাস্তার টেবিলে রুপান্তর বার-বার আড়চোখে মিনহাজের দিকে তাকাচ্ছিল। মিনহাজ নির্লিপ্ত। যেনো তার থেকে ভদ্র বাচ্চা এই চৌধুরী বাড়িতে আর কেউ হতেই পারে না। রুপান্তর খাওয়ার ফাঁকে চোখ মারলো। মিনহাজের কাশি উঠে গেলো। তটিনী সবকিছু দেখে নিজের ও রুদ্রের এক টেবিলে বসে খাওয়ার স্মৃতি মনে করলো। কতশত এরকম খুনসুটি রয়েছে তাদের। সে খাওয়া থামিয়ে রুদ্রকে বার্তা পাঠালো।
‘আমার খাওয়ার মুহূর্তে একটা আপনি নামক মানুষ নাই, সবসময়ের মতো আমার সামনাসামনি চেয়ারে বসে থাকবে। আর আমি দুষ্টুমিতে মেতে থাকবো সবসময়ের মতো।’
রুদ্র সিন করলো তৎক্ষনাৎ। রিপ্লাই দিলো,
‘তোমার আপনি নামক মানুষটা তোমার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহুর্ত মিস করে ঐশি। খেয়ে নাও প্লিজ। আগামী কয়েকদিন পর আমি তোমার সামনাসামনি চেয়ারে বসবো প্রমিজ।’
তটিনী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। খেতে খেতে রুপান্তর ও মিনহাজের খুনসুটি দেখতে লাগলো।’
খাওয়ার টেবিলে এসে বসেছেন মিনহাজের বাবা। তটিনী ও রুপান্তরের সাথে পরিচিত হয়ে নিলেন। মিনহাজকে আদেশ দিলেন, ‘খেয়েদেয়ে মা’দের গ্রাম ঘুরে দেখিও।’
মিনহাজ বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়িয়েছে। তটিণী-র সাথে ভাব হয়ে গেলো মিনহাজের বাবার। সহজ সরল একজন মানুষ। তটিনী নানারকম দুষ্টুমি করতে লাগলো তার সাথে। মিনহাজের বাবা মন খারাপ করে বললেন,
‘এ বাড়িতে একটা তোমার মতো মেয়ের অনেক অভাব মা। আমার একটা মেয়ের অনেক শখ ছিলো। কিন্তু আল্লাহ দিলেন না। দুই ছেলেকে বিয়ে করিয়ে দুটো মা নিয়ে আসবো। সেটাই আপাতত পরিকল্পনা।’
তটিনী পান বানিয়ে দিয়ে বলল, ‘সেটা তো অবশ্যই করবেন। কিন্তু তার আগে আমি আছি। আমি ননদের ভূমিকা পালন করবো। আমি আপনার প্রথম মেয়ে হবো।’ বাকি দু’জন হবে আমার ভাবি অর্থাৎ আপনার ২য় ও ৩য় মেয়ে। ঠিক আছে?’
মিনহাজের বাবা হাসলেন। চোখের চশমা ঠিক করে বললেন, ‘ঠিক আছে মা। তোমরা গ্রাম ঘুরতে বের হয়ে যাও। আমি ঘরে যাই কেমন?’
তটিনী মাথা নাড়ালো। মিনহাজকে সাথে নিয়ে রুপান্তর ও সে গ্রাম ঘুরতে বের হলো।
গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে তিনজন হাঁটতে লাগলো। চারিদিকে সবুজে সবুজে ভরা। ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তটিনী মুখে হাত দিলো।
‘গ্রাম দেখার অনেক ইচ্ছে ছিলো। আমার দাদুর বারিধারায় বাড়ি আছে। কিন্তু আমার দাদুর বাবার গ্রামে বাড়ি ছিলো। সেখানে ছোটবেলায় গেলেও মনে নেই। মনে হচ্ছে আজ প্রথম গ্রাম দেখছি। এতোদিন টিভিতে দেখে এসেছি।’
মিনহাজ হাসলো। বলল, ধানক্ষেতে নামবি?’
রুপান্তর নাকচ করলো, ‘যদি জোঁক থাকে?’
তটিনী লাফ দিলো, ‘ওরে বাবা পারবো না।’
মিনহাজ জোর করলো না। দুজনকে নিয়ে আবার গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে লাগলো। গ্রামের মানুষেরা দলবেঁধে তাদের দেখছে। যেনো কোনো সেলিব্রিটি তারা। রুপান্তর কাঁধ নাচিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘নিজেকে সেলিব্রিটি মনে হচ্ছে ইয়ার।’
তটিনী চারিদিকে তাকালো। সবাই চোক বড়বড় করে তাকিয়ে তাদের দেখছে। কেউ কেউ ফিসফিস করছে। তটিনী ও রুপান্তর জিন্স সাথে ফতোয়া পড়েছে। গলায় স্কার্ফ জড়ানো। রুপান্তরের চুলে কালার করা, সেজন্য একটু বিদেশি বিদেশি লাগছে। তটিণী-র চুল স্টেট করা। দেখেই বুঝা যাবে শহরের ভালো পরিবারের কারো মেয়ে। গ্রামের মানুষ শহরের কেউ দেখলে এভাবেই থাকায়। তারা মূলত সেটা উপভোগ করে। গ্রামে নতুন মানুষ আসলে তাদের দেখতে ভালো লাগে। দলবেঁধে গ্রামের নতুন অতিথি দেখাটাও একপ্রকার আনন্দের তাদের কাছে। কিন্তু কিছু কুৎসিত ছেলেমেয়ে রয়েছে। যারা গ্রামে শহরের নতুন কোনো মানুষ এলে বাজে কমেন্টস করে। যেমন ফিসফিস করছে কিছু মেয়ে। তটিণী নিশ্চিত ওরা তাদের ড্রেসআপ নিয়ে কিছু বলছে। নাহলে রুপান্তরের চুলের রঙ নিয়ে কিছু বলছে। তটিণী-র কানে এলো,
‘চুলে কিতা গু লাগাইছে নি? দেখ দেখ।’
তটিনী রুপান্তরের দিকে তাকালো। বেচারি ভাগ্যিস শুনেনি। দু-দিনের জন্য বেড়াতে এসে এসব শুনে মন খারাপ করার কোনো মানে হয়না।
কিন্তু মিনহাজ শুনে ফেলেছে। সে উত্তর দিলো,
‘শহরের মানুষ তারা, আমার আপনার থেকে উন্নত হবে স্বাভাবিক। সেটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিতে চেষ্টা করুন। তারা আমাদের গ্রামের অতিথি। সুতরাং এমন কিছু বলবেন না যাতে তাদের মন খারাপ হয়। তাছাড়াও তারা আমার বন্ধু। আমি আমার বন্ধুদের অপমান মেনে নিবো না নিশ্চয়ই? নেক্সট টাইম কারো এমন কথাবার্তা কানে আসলে ভালো হবে না।’
যে মেয়েটি বলেছে সে মাথা নিচু করে বলল, ‘ভুল হয়ে গেছে ভাইয়া।’
মিনহাজদের গ্রামে দাপট অনেক। মিনহাজের বাবা এলাকার চেয়ারম্যান। সেটা সকালে জেনেছে তারা। গ্রামের মানুষ তাদের মান্য করে চলে।
রুপান্তর কিছু বুঝেনি। সেটাতেই স্বস্তি পেলো মিনহাজ।
দুই বন্ধুকে নিয়ে আরও হাটতে লাগলো। একটি আমগাছের সামনে এসে দাড়িয়ে বলল, ‘গাছে উঠে আম পেরেছিস কখনো?’
রুপান্তর হৈহৈ করে উঠলো, ‘পারিনি তবে এখন পারবো। আমি গাছে উঠতে চাই প্লিজ প্লিজ প্লিজ।’
মিনহাজ হাসলো,
‘গাছে উঠতে পারবি তুই?’ গাছ ভেঙে পড়ে যাবে না?’
রুপান্তর ফুসফুস করলো,
‘তুই কি ইনডিরেক্টলি আমাকে মোটা বলছিস?
‘আমি তো ডাইরেক্টলি-ই তোকে মোটা বলছি দোস্ত। প্লিজ গাছে উঠে বেচারা গাছকে মেরে দিস না।’
রুপান্তর রেগে তাকালো,
‘আমি গাছে উঠবোই।’
রুপান্তর জুতা খুলে রাখলো। পা দুটে গাছে পেচিয়ে উপরে উঠতে চেষ্টা করলো। বেচারি ঠাস করে নিচে পড়লো। মিনহাজ ও তটিনী শব্দ করে হেসে ফেললো। রুপান্তর কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,
‘না হেসে আমাকে উঠক পাপির দল। আমার কোমড় ভেঙ্গে গেছে।’
মিনহাজ টেন তুললো। বলল,
‘শহরের মেমসাহেব গাছে উঠতে পারবি না। আমিই উঠছি, তোরা আম কুড়তে থাক।’
মিনহাজ গাছে উঠে আম ফেলতে লাগলো নিচে। রুপান্তর ও তটিনী আম কুড়তে লাগলো। তটিনী মাঝে মধ্যে খুশিতে চিৎকার করছে। এতে আনন্দ তার কখনো হয়নি।
আম কুড়ানোর পর এলো আম ভাগাভাগি করা। তিনজন কাড়াকাড়ি শুরু করলো। তটিনী বেচারি সরে গেলো৷ ঝগড়া লাগলো মিনহাজ ও রুপান্তরের মধ্যে। মিনহাজ হার মেনে সব দিয়ে দিলো। বলল,
‘বাসায় গিয়ে সবাইকে নিয়ে খাস, এভাবে রাক্ষসের মতো খাস না যেনো। পেট ব্যাথা করবে তোর।’
রুপান্তর একটা আমে দাঁত দিয়ে কামড় বসালো। তটিনী বমি করার অভিনয় করে বলল, ‘ছিঃ না ধুয়ে খেয়ে ফেলছিস। খবিশ কোথাকার।’
রুপান্তর সুযোগ বুঝে বলল, ‘তুই যে কলেজে থাকতে সেন্টারফ্রুট মাটি থেকে তুলে না ধুয়ে খেয়ে নিছিলি সেটা কিন্তু আমি কাউকে বলিনি।’
মিনহাজ শরীর কাঁপিয়ে হাসলো। তটিনী নাক ফুলিয়ে বলল, ‘তুই যে আইসক্রিম ড্রেসের কাছে পড়ে যাওয়ার পর আবার তুলতে চেষ্টা করেছিলি সেটাও কিন্তু আমি কাউকে বলিনি।’
মিনহাজ কটাক্ষ করে বলল, ‘শেষ পর্যন্ত ড্রেসের পাশ থেকে আইসক্রিম তুলতে চেষ্টা করেছিলি। ছিঃ রুপ। ‘
রুপান্তর অসহায় চোখে তাকালো,
‘আমটা টুকরো হচ্ছে না কেন? দাঁত ব্যাথা হয়ে গেলো।’
মিনহাজ শার্টে আম মুছে দাঁত দিয়ে টুকরো করলো। রুপান্তর খুশি মনে আম খেতে ব্যস্ত। তটিনী আবারও বমি করার অভিনয় করতে লাগলো। রুপান্তর পেছনে লাথি দিয়ে বলল, ‘অভিনয় কম কর, তুই যে পথের ধারে গু’য়ে পা ফেলে দিয়ে জুতা পরিষ্কার করেছিলি সেটাও কিন্তু কাউকে বলিনি। চাইলে মাইক হাতে নিয়ে বলে দিবো এবার।’
মিনহাজের হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা করছে। তটিনী কাঁদো কাঁদো মুখ শুধু তাকিয়ে দেখলো নিজের অপমান।
(চলবে)