#সাদিয়া_শওকত_বাবলি
#পর্ব_২৩
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
পলাশ শিকদার একবার তাকালেন স্ত্রীর সন্তানদের পানে। অতঃপর থমথমে কন্ঠে বললেন,
-“আমি এতটাও নির্বোধ নই যে আমি আমার তালাকহীনা মেয়ের বিয়ে দেব অন্যত্র। আমি শুধুমাত্র দেখতে চেয়েছিলাম তুর্য আমার মেয়ের জন্য কি কি করতে পারে। আমি জানতাম তুর্য এখানে আসবে। পৃথার বিয়ের খবরটা ওর নিকট সুকৌশলে আমি নিজেই পাঠিয়ে ছিলাম নয়তো ওর সাধ্য ছিল না কিছুই জানার যেখানে তোমরাই সবটা জেনেছিলে দুপুরে।”
-“কিন্তু বাবা…”
এইটুকু বলতেই পিয়ালকে থামিয়ে দিলেন পলাশ শিকদার। আবার বললেন,
-“হ্যা আমি আগে বলেছিলাম পৃথার সাথে তুর্যের তালাকটা গোপনে করিয়ে দেব, পৃথাকে না জানিয়ে। কারন আমি এই সম্পূর্ণ বিয়ের বিষয়টাই পৃথার থেকে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি চাইলেই কি ওদের গোপনে তালাক হয়ে যেতো? স্ত্রীর অনুপস্থিতে তালাক দেওয়া বা স্ত্রীকে জানানো না হলে তালাক হয় না। তালাক দেওয়ার জন্য স্বামীকে অবশ্যই স্ত্রীর উপস্থিতে স্পষ্টভাবে তিনবার তালাক বলতে হবে। বিষয়টা নিয়ে এমনিই সর্বদা চিন্তিত ছিলাম আমি। তার উপর তুর্য ফিরে এলো। সেদিন তুর্যকে তালাকের কথা বললেও তুর্য শক্ত কন্ঠে নাকোচ করে দিল। ওর কন্ঠে আমি দৃঢ়তা অনুভব করেছিলাম। তোমরা বসে থাকলেও আমি বসে থাকিনি। ওর বিষয়ে সম্পূর্ণ খোঁজ খবর নিয়ে আমার মনে হয়েছিল ওকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিৎ। সাত বছর আগে ও আমার মেয়েকে ত্যাগ করে ভুল করেছে ঠিক আমরাও তো কম ভুল করিনি। তাছাড়া বিচ্ছেদ কোনো সমাধান হতে পারে না। ভুল তো আমাদেরও ছিল। অন্তত নিজেদের ভুলটা শুধরে নিয়ে ছেলে মেয়ের ভবিষ্যৎ সুন্দর করার জন্য হলেও তুর্যকে একবার সুযোগ দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। সেই সুযোগটাই আমি তাকে দিয়েছি।”
থামলেন পলাশ শিকদার। শক্ত কন্ঠে বললেন,
-“তবে ভেবো না ঐ তুর্য চৌধুরীকে আমি এত সহজে ছেড়ে দেব। সাত বছর আমার মেয়েকে অনিশ্চিতার মধ্যে রেখেছে, বিয়ের আসরে আমার মেয়েকে ত্যাগ করেছে। সাত বছর পরে এত সহজে অবশ্যই ওর পরীক্ষা শেষ হবে না। আমি আমার মেয়েকে আবার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করবো ওর থেকে, ও যদি ভালোবেসে থাকে তবে ভালোবাসার নারীকে ধরে রাখার দায়িত্ব ওর।”
কথাটা বলে কাউকে আর কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে প্রস্থান করলেন পলাশ শিকদার। পিছনে ফেলে রেখে গেলেন তিন জোড়া বিস্ময় পরিপূর্ণ চোখ।
২৫.
তুর্য পৃথাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পৃথাকে নিয়ে সোজা চলে এসেছে কাছে পিঠে এক উকিলের অফিসের সম্মুখে। আইনিভাবে এবার তার বিয়েটা করে নেওয়া প্রয়োজন নয়তো বলা যায় না কখন আবার তার রা’জা’কা’র শ্বশুরটা মুরগির বাচ্চার মতো বউয়ের উপরে খাবলা বসায়। পৃথা, আরুশ এবং গার্ডসদের নিয়ে অফিস বিল্ডিং এ ঢুকলো তুর্য। পৃথা ক্ষানিকটা অবাক হলো। বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় এ অফিস চিনতো সে আগে থেকেই। মেয়েটা কপাল কুঁচকে তুর্যকে শুধালো,
-“আমরা এখানে কেন এসেছি?”
তুর্য সম্মুখ পানে পা দিতে দিতে জবাব দিল,
-“বিয়ে করতে।”
পৃথা ভ্রু কুঁচকালো। সন্দিহান কন্ঠে বলল,
-“আমাদের বিয়ে না হয়ে গেছে?”
-“আইনিভাবে হয়নি এখনও।”
-“কিন্তু আইনিভাবে বিয়ের করার বয়স তো আমার হয়নি এখনও।”
তুর্য ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো পৃথার পানে। বাঁকা হেসে বলল,
-“তুমি শুধু বিয়ের জন্য প্রস্তুত হও বউ তারপর তোমার বয়স বাড়ানোর দায়িত্ব আমার।”
পৃথা ওষ্ঠ ফাঁক করলো কিছু বলার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে তুর্য বলল,
-“দেখো আমি এই মুহূর্তে কোনো জটিলতা চাইছি না। তোমার আর আমার বিয়ে সাত বছর আগেই হয়ে গেছে। এখন তুমি মানলেও আমার বউ না মানলেও আমার বউ। আইনি বিয়ে না হলেও রেকর্ডের ভিত্তিতে আমাদের বিয়েকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তবুও আমি চাইছি এবার আমাদের আইনি বিয়েটাও হয়ে যাক। ধর্ম এবং সমাজ দুটো মেনেই আমি তোমাকে নিজের করে চাইছি। সুতরাং কন্ঠে কোনো না না ধ্বনি তুলে ঝামেলা বারিও না।”
পৃথাও আর কিছু বলল না। সত্যি বলতে বিয়ে তো সেই কবেই হয়ে গেছে। এখন সারাদিন না না করলেও কাজ হবে না কোনো। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো পৃথা। তুর্যকে অনুসরণ করে ঢুকলো এক কক্ষের ভিতরে। সেখানে চেয়ারে আগে থেকেই বসা ছিলেন কোর্ট প্যান্ট পড়া একজন ভদ্রলোক। সম্ভবত উকিল হবেন ইনি। তুর্যকে ঢুকতে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন তিনি। হাসিমুখে বললেন,
-“এসেছেন আপনারা! আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম আমি।”
তুর্যও হাসলো। ভদ্রলোকের সাথে কুশলাদি বিনিময়ে করে পৃথাকে নিয়ে বসলো ঐ দুটি কাঠের তৈরি চেয়ার দখল করে। নিজের হাতটা তুলে হাতঘড়ির পানে তাকালো একবার। উকিলকে তাড়া দিয়ে বলল,
-“কি কি করতে হবে তাড়াতাড়ি করুন। আমাদের আবার ঢাকায় ফিরতে হবে।”
উকিল সাহেবও বসলেন। আগে থেকেই প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র গুছিয়ে রেখেছিলেন। তুর্য তাড়া দিতেই তিনি প্রয়োজনীয় কাগজ এবং কলম এগিয়ে দিলেন তুর্য ও পৃথার পানে। আঙ্গুল তুলে কাগজের দিকে ইশারা করে বললেন,
-“এখানে সই করে দিন।”
কাগজটা হাতে পেয়েই দ্রুততার সাথে সই করলো তুর্য অতঃপর পৃথার পানে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“তাড়াতাড়ি সই করে দেও।”
পৃথা তাকালো কাগজটার দিকে। হৃদয় ভারী হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। একবার না জানিয়ে অগোচরে অল্প বয়সে পরিবারের লোকেরা তাকে বিয়ে দিলেও আজকের বিয়েতে সেই পরিবারই নেই। যতই পরিবারের উপর অভিমান করুক মেয়েটা তবুও তার পরিবার তো। ঐ বাবা মা ই তাকে জন্ম দিয়েছেন। এত বছর আদর যত্ম দিয়ে বড় করেছেন। জীবনের এই মুহুর্তে এসে পৃথার ভীষন মনে পড়ছে বাবা মাকে। হয়তো তুর্যের সাথে তার বিয়েটা আগেই হয়েছে। কিন্তু তখন কোনো অনুভূতির উপস্থিতি ছিল না। বিয়ের মানেই তো তখন পৃথা বুঝে উঠতে পারেনি ভালোভাবে। তার জন্য আজ অনুভুতিটা প্রথম আর সেই অনুভূতিতে বাবা মা ভাই কেউ পাশে নেই।
বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হলো। পৃথা এখনও কলমই তুললো না সই করবে কি? তুর্য ভ্রু কুঁচকে তাকালো মেয়েটার পানে। দেখলো মেয়েটা টলমল চোখ নিয়ে কিছু ভাবছে আবার মাঝে মাঝে নিচু হয়ে পা চুলকাচ্ছে। তুর্য সজাগ দৃষ্টিতে তাকালো আশেপাশে। কান খাঁড়া করে শুনলো কিছু মশার গান। ইসস তার ছোট বউটাকে নিশ্চই মশায় কামড়ে রক্ত চু’সে নিচ্ছে। তুর্য আশেপাশে তাকালো। উকিলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“আপনার এখানে কি মাশারি আছে?”
উপস্থিত সবাই ভরকালো তুর্যের কথায়। উকিলও চকিত দৃষ্টিতে তাকালো ছেলেটার পানে। এই প্রথম কিনা কেউ বিয়ে করতে এসে মশারি খুঁজছে। বিয়ে করতে এসে মশারি দিয়েই বা কাজ কি! উকিল কৌতুহল অনুভব করলেন। আগ্রহ নিয়ে বললেন,
-“না তো। মশারী দিয়ে কি করবেন?”
তুর্য হাত উঠিয়ে দুই হাত দ্বারা ঠাস করে শব্দ করে মশা মা’রা’র চেষ্টা করলো। নাক মুখ কুঁচকে বলল,
-“আমার বউকে মশায় কামড়াচ্ছে।”
উকিল সহ সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। পৃথাও নিজের চিন্তা ভুলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো তুর্যের পানে। বিয়ে করতে এসে কিনা এই লোক মশারী খুঁজছে তাও কিসের জন্য তার বউকে দুই একটা মশায় কামড়াচ্ছে বলে। তুর্যের এ ধরনের কথা বার্তার সাথে আর কেউ পরিচিত না থাকলেও আরুশ ঠিক পরিচিত। ছেলেটা এগিয়ে এলো তুর্যের পানে। মাথা চুলকে বলল,
-“অফিস কক্ষে মশারি কোথা থেকে আসবে স্যার? কয়েল থাকলেও থাকতে পারে।”
আরুশের কথা শুনে চকচক করে উঠলো তুর্যের চোখ দু খানা। গদগদ হয়ে বলল,
-“সাব্বাস ব্যাটা কে বলেছে তুই আকার রশিকার ছাড়া বলদ। এই তো তোর মাথায় বুদ্ধি আছে। ঐ রাজাকার জনগোষ্ঠীর সাথে বাক বিতণ্ডায় জড়িয়ে আমি তো কয়েলের কথা ভুলেই বসেছিলাম।”
কথাটা শেষ করেই তুর্য ফিরে তাকালো উকিলের পানে। ভীষন আশা নিয়ে শুধালো,
-“আপনার অফিসে কয়েল আছে?”
উকিল তুর্যকে হতাশ করে জবাব দিলেন,
-“না, আমার অফিসে কয়েলও নেই।”
তুর্যের মেজাজ খারাপ হলো কিছুটা। কি একটা অফিস যেখানে কিছু রাখে না। তার বউকে মাশায় কামড়াচ্ছে অথচ একটা কয়েল পর্যন্ত নেই? এক মিনিট, এক মিনিট মশায় কামড়াচ্ছে নাকি চু’মু খাচ্ছে? তুর্যের হৃদয়টা হাহাকার করে উঠলো। মস্তিষ্ক বলে উঠলো,
-“এত বছর বিয়ে করে বউকে এখনও চু’মু খেতে পারলি না। অথচ দেখ মশাগুলো এসে কি সুন্দর তোর বউকে চু’মু খেয়ে যাচ্ছে। ছিঃ তুর্য ছিঃ।”
তুর্য হাঁসফাঁস করে উঠলো। বিরবিরিয়ে বলল,
-“এই রাজশাহীর মশাগুলোই বেয়াদব, অ’স’ভ্য মার্কা। কত বড় সাহস এদের আমার বউকে চু’মু খায়। আমার অধিকারে ভাগ বসায়।”
কথাগুলো বলেই তুর্য পাশ ফিরে তাকালো পৃথার পানে। মেয়েটা এখনও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে তার পানেই। তুর্য ধমকে উঠলো পৃথাকে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-“তাড়াতাড়ি কাগজে সইটা করে আমাকে উদ্ধার করো। আমার এই মামলাগুলোকে সহ্য হচ্ছে না।”
আকস্মিক ধমকে পৃথা কেঁপে উঠলো। তুর্যের বলা শেষ কথাটা বোধগম্য না হলেও মুখ খুলে কিছু জিজ্ঞেস করলো না আর। সামনে রাখা কলমটা হাতে নিয়ে কাগজে খসখসে ধ্বনি তুলে সই করে দিল দ্রুত। ব্যস তুর্য এবং পৃথার আইনি বিয়েও শেষ এবার। তুর্যের চিন্তা অনেকটাই কমলো এবার। নিশ্চিন্ত মনে উঠে দাঁড়ালো চেয়ার ছেড়ে। উকিলের সাথে শেষ একবার হাত মিলিয়ে এবং তার পাওনা পরিশোধ করে বেরিয়ে এলো অফিসের বাইরে।
২৬.
রাত বেড়েছে কিছুটা। চারদিকটা নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে। অন্ধকারেরা গ্রাস করে নিয়েছে পরিবেশ। এই নিস্তব্ধ অন্ধকারের বুক চিড়েই হাইওয়ে ধরে সাঁই সাঁই করে গন্তব্যের পানে ছুটে চলছে তুর্যদের গাড়িটা। সামনের ড্রাইভিং সিটে বসে আরুশ গাড়ি চালাচ্ছে আর পিছনের সিটে রয়েছে তুর্য আর পৃথা। তখন উকিলের অফিস থেকে বেরিয়েই গাড়িতে চেপে বসেছিল তারা তিনজন আর গার্ডসরা চেপেছে তাদের নির্ধারিত অন্য গাড়িতে। তুর্য আর পৃথা পাশাপাশি বসলেও দুজনের মধ্যে দূরত্ব রয়েছে বেশ। অবশ্য এই দূরত্বটা রেখেছে পৃথা নিজেই। তুর্যও আর আগ বাড়িয়ে বলেনি কিছু। এমনিই মেয়েটার উপর থেকে কম ধকল আজ যায়নি। তাই নিশ্চুপভাবেই সবটা মেনে নিয়েছে সে। মেয়েটাকে একটু একা থাকতে দিয়ে নিজে মনোনিবেশ করলো মোবাইলে।
ক্ষানিক সময় গড়ালো। তুর্য মোবাইল থেকে দৃষ্টি সরিয়েই তাকালো পৃথার পানে। মেয়েটা গাড়ির সিটের সাথে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সি স্নিগ্ধ লাগছে প্রিয়তমার ঘুমন্ত মুখশ্রী। তুর্যের দৃষ্টি মুগ্ধ হলো, হৃদস্পন্দন বাড়লো তরতর করে। হৃদয়ে নিষিদ্ধ অনুভূতিরা চনমনে হয়ে উঠলো। ইসসস এসব কি ভাবছে সে? একটা মেয়ের ঘুমন্ত অবস্থার সুযোগ নিবে? পরক্ষনেই তুর্যের হৃদয় হানা দিল মেয়েটা তার স্ত্রী। আর স্ত্রীকে ভালোবাসা নিশ্চই সুযোগ নেওয়া নয়। তুর্য ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকালো আরুশের পানে। ছেলেটাকে সজাগ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে একটু চেপে বসলো পৃথার পানে।
চলবে…..