কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(০৪)
সালমা বেগমের ঢিলেঢালা বোরখা,পুষ্পিতার গা থেকে যেন খুলে খুলে পড়ছে। নিঃসন্দেহে আরেকজন ঢুকতে পারবে এর মধ্যে। নিকাব বেঁধে একবার আয়নায় চাইল সে। কালো জুব্বার ন্যায় আবরণে নিজেকে দেখে হেসে ফেলল।
রাহাত জুতো পরছে সোফায় বসে। চর্বিযুক্ত পেটটার কারণে ফিতে বাঁধতে জান বের হয় সব সময়। এইটুকুতেই, নাদুসনুদুস গতরটা হাঁপিয়ে এলো। ডান পায়েরটা কোনওরকমে পরতে পারলেও,বাম পা অবধি হাত পৌঁছানো দুঃসাধ্য যেন।
বিফল শ্বাস ছাড়ল সে। মিথিলা ফোনে চোখ রেখে, ডায়নিং-এ জল খেতে এসেছে তখন। রাহাত ওকে দেখেই বলল,
‘ আপু আমার জুতোটা পরিয়ে দাও না!’
মিথিলা খ্যাক করে উঠল,
‘ পারব না। নিজেরটা নিজে কর। এহ,এলেন আমার জমিদার,ওনার জুতো পরিয়ে দাও।’
রাহাতের চেহারায় আমাবস্যা ঘনায়। আ*হত লোঁচনে চেয়ে রইল বোনের দিক। মিথিলা সেসবের তোয়াক্কা দেখায় না। গ্লাস ফাঁকা করে ফের ঢুকে গেল কামড়ায়।
পুষ্পিতা তৈরী হয়ে, বসার ঘরে আসে। রাহাতকে হতাশ ভঙিতে বসা দেখে মুচকি হাসল। বলতে হয়নি,নিজেই পায়ের কাছে বসল ওর। জুতোতে হাত দিতেই, হাসল রাহাত। ছোটপুর প্রতি তার ভালোবাসা আর টান আগেই ছিল। এইবার আর একধাপ বৃহৎ হয় তা!
সালমা বেগম ও তৈরী। ক্ষুদ্র পার্সের হূক লাগাতে লাগাতে বললেন,
‘ হয়েছে তোদের? চল এবার, সন্ধ্যা হয়ে যাবে তো।’
পুষ্পিতা উঠে দাঁড়ায়। রাহাত প্রফুল্ল চিত্তে ঘোষণা দেয়,
‘ আমি রেডি।’
‘ তাহলে নীচে গিয়ে রিক্সা ঠিক কর।’
রাহাত মাথা ঝাঁকাল। স্বতঃস্ফূর্ত কদমে দরজা খুলে দৌড়ে গেল।
পুষ্পিতা হাত কচলাচ্ছে। কিছু বলার প্রবণতা চেহারায়। সালমার একটু নিকটে এসে, আস্তে করে বলল,
‘ মণি, একটা কথা বলব?’
তিনি আগেই সাবধান করলেন,
‘ মিষ্টি নিয়ে কথা বার্তা বাদে।’
‘ না না ওসব না। এটা অন্য…’
সালমা ওর মুখের দিক চাইলেন এবার।
‘ কী কথা ?’
পুষ্পিতা পাশাপাশি দুটো শোবার ঘর সচেতন নেত্রে একবার দেখে নিলো। খোরশেদুল ঘুমোচ্ছেন। তার নাক ডাকার ভুসভুস শব্দ এখানেও স্পষ্ট। অন্যটায় মিথিলা। দুজনের কেউই শুনতে পেলে, আরেকদফা অশান্তির আশঙ্কা প্রবল।
মিনমিন করে বলল,
‘ আপুর বিয়েতে, নূহাকে দাওয়াত দেব?’
পুষ্পিতা যতটা রয়েসয়ে শুধাল,শোনা গেল সালমার ততোধিক নিরুদ্বেগ কণ্ঠ,
‘ ওমা! সে আবার বলার কী আছে? দিবি। তোর বোনের বিয়েতে বেস্টফ্রেন্ডকে ডাকবিনা?’
‘ না মানে,খালুজান যদি…’
‘ কিছু বলবেনা। বললে আমিতো আছি। মেয়েটা তোকে এত ভালোবাসে,তাকে এরকম বিশেষ দিনে না ডেকে পারা যায়?’
পুষ্পিতার দুগাল ফেঁপে উঠল খুশিতে। হাস্যজ্জ্বল চিলিকে জ্বলজ্বলে মুখশ্রী।
‘ তাহলে একটা কার্ড নিয়ে যাই? কুরিয়ারে পাঠিয়ে দেব?’
‘ আমি নিয়ে আসছি।’
সালমা বেগম ফের কক্ষে ঢুকলেন। মিথিলার বিয়ের অল্প কদিন বাকী! পলাশ অতিসম্প্রতি কানাডায় শিফট হবে বিধায়,সময় কম। তাই ব্যস্ত ভাবে কার্ড ছাপানো শেষ করেছেন খোরশেদুল। কাছের-দূরের সকলকে নিমন্ত্রণ করবেন কাল থেকে।
নূহার বাবা নেই। গত বছর মা*রা গিয়েছেন। মা আগে থেকেই চাকরিরত ব্যাংকে। দু মাস আগেই বাসা পালটে উত্তরায় পৌঁছেছে তারা।
পুষ্পিতার ওর সাথে আলাপ সেই স্কুল থেকে। যখন মতিঝিলে থাকত। মাখোমাখো বন্ধুত্ব তাদের। মেয়েটা পুষ্পিতা অন্ত প্রাণ! এই পৃথীবিতে, রাহাত আর সালমা বেগমের পর,পুষ্পিতাকে ভালোবাসার তৃতীয় মানুষ।
******
সাত বছরের এক শিশুকিশোর বেঞ্চে পা ঝুলিয়ে বসে। পড়নে স্কুলের ইউনিফর্ম, পাশে রাখা ব্যাগ। দুহাতের মুঠোয় দুটো বড় সাইজের ডেইরিমিল্ক। সারা মুখ লেপ্টে গিয়েছে তার প্রকোপে। আপাতত শিশুটির মন ও যোগ দুটোই চকলেটের ওপর। বেঞ্চের কাঠে সুতো দিয়ে বাঁধা বেলুনগুলো হাওয়ায় দুলছে। দৃশ্যটি অতীব চমৎকার!
কিন্তু সিকান্দার আৎকে উঠলেন,পাশে বসা আরমান, পেছন থেকে হাত উঁচালে। সূর্যের রশ্মিতে জ্বলজ্বল করে মাথা তুলল তার মুঠোর শাণিত ছু*রির রূপ। যার এক পো*চে,একটি বাচ্চা তো দূর,সবল যে -কেউ ঘায়েল হতে প্রস্তুত।
সিকান্দারের মুখ তত্র ফ্যাকাশে হয়ে আসে। ত্রাসিত লোঁচন নিক্ষেপ হলো উদ্বেগহীন তীব্রর মুখের ওপর। ভ*য়ার্ত কণ্ঠে আওড়ালেন
‘ আমার ছেলে! ওকে কিছু করবেন না,ও ছোট অনেক!’
তীব্র ফোন নামিয়ে আনল। নিরুৎসাহিত জানাল,
‘ এখনও করিনি। ভালোবেসে চকলেট দিয়েছি দেখলিনা? পরবর্তীতে, কিছু করব কী না,সেটা নির্ভর করছে তোর ওপর। পাঁচ সেকেন্ড দিচ্ছি! ভাব… ছেলে আগে? না জামশেদ তালুকদারকে বিপদে ফেলা?’
সিকান্দার কপালের হীরক রূপী ঘাম মুছলেন। খরখরে ওষ্ঠপুট জ্বিভে ভেজালেন চিন্তায়। নিজের বাড়ির গেটে,কেউ এমন,নিরস্ত্র,মানসিক, ঠান্ডা আ*ক্রমন করতে পারে, আজকের পূর্বে জানা ছিল না।
তীব্র সিগারেট ধরাল, নাকে মুখে ধোঁয়া ছড়িয়ে বলল,
‘ সময় শেষ। ‘
সিকান্দার ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। লোভী মন দ্বিধাদন্দে ভুগছে। এই ক্লিপ তিনি কত ক*ষ্টে যোগাড় করেছেন তিনিই জানেন। একবার কার্য সিদ্ধি হলে আর পেছনে তাকাতে হোতো না! কিন্তু জামশেদ যে এইভাবে পাশা ওল্টাবে কে জানত! তাকে মাত দিতে না পেরে তার একমাত্র ছেলেকে আটকেছে। তিনি এক পল তীব্রকে দেখলেন। সিগারেটে টান বসানোর বড়ই সুনিপুণ ভঙিমা ওর। বিলাতি,পঙ্কিল দুই অক্ষি, শীতল ভাবে তার দিকে চেয়ে। যেই চাউনীতে সিকান্দারের গুলিয়ে গেল সব। গাড়ি সমেত গেট দিয়ে ঢুকতে গেলেই,আকষ্মিক তীব্র সামনে এসে দাঁড়ায়। সিকান্দার ওকে এক দেখায় চিনে ফেললেন। এই গুন্ডা ছেলেকে কে না চেনে!
বেরিয়ে আসতেই, তীব্র কথাবার্তা ছাড়াই ফোন ধরল সম্মুখে। যেখানে পরিষ্কার, সঙ্কটে তার ছেলে। এমন নীরব,শান্ত হুমকি,গেটে ঝোলানো সিসি ক্যামেরাও ব্যর্থ হবে উদ্ধারে।
সিকান্দারের পিতৃসুলভ হৃদয়, লালসাকে ছাপিয়ে গেল এবার। ছেলের প্রাণের কাছে সব তুচ্ছ, নিপাত। হার মানলেন তিনি। একজন এমপি,তাও সাবেক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে নাকাল করার খেলায় নামা ঠিক হয়নি তার। সাথে যার,এমন মাস্তান ছেলে রুপী ডান হাত আছে,তাকে কে আটকাবে? তিনি চুপচাপ পকেট থেকে ফোন বের করলেন। সাইড খুলে, ম্যামোরি কার্ড নিয়ে, এগিয়ে দিলেন তীব্রর দিক। ছোট কণ্ঠে জানালেন,
‘ ক্লিপটা এই মেমোরিতে আছে। ‘
তীব্র হাতে নিলো। উল্টেপাল্টে দেখে বলল,
‘ আর কোনও কপি নেই? ‘
‘ না।’
‘ থাকলেও সমস্যা নেই,তোর ছেলে তো আছে। পরের ব্লাকমেইলিংয়ে না হয় আবার দেখা করব। ‘
একটু ঘনিষ্ঠ হলো পরপর। কানের পিঠে ঠোঁট এনে,
ফিসফিস করে বলল,
‘আজকে তোর ছেলেকে চকলেট খাইয়েছি,সেদিন বন্দুকের ছয়টা গুলি খাওয়াব। কী বলিস? ‘
সিকান্দারের চোখ কপালে ওঠে। ঢোক গিলে, উদ্বেগী হয়ে বললেন,
‘ সত্যিই নেই। বিশ্বাস করুন।’
তীব্রর কাঠ জবাব,
‘ বিট্টু মাস্তান নিজের বাপকেও বিশ্বাস করেনা।’
সে হাঁটা দিতেই সিকান্দার বললেন,
‘ আমার ছেলে? ‘
‘ ওউ।’
দাঁড়াল তীব্র। আরমানকে ভিডিও কল দিলো আবার। রিসিভ হতেই সংক্ষেপে বলল,
‘ কাজ শেষ। ‘
‘ ওকে।’
আরমান ছু*রি সরিয়ে আনে। কণ্ঠ নরম,
‘ চলো বাবু,তোমাকে গাড়িতে তুলে দেই।’
সানন্দে মাথা দোলাল শিশুটি।
আরমান কাঁধব্যাগ,আর ওর এক হাত ধরে গাড়ির কাছে এলো। জানলার সব কাচ তোলা। সে ঝুঁকে টোকা দিলো তাতে। সেকেন্ডে তরতর করে নামল কাচ। হাত,চোখ বাঁ*ধা ড্রাইভারের ভীত মুখটা উন্মুক্ত হলো। মূলত,তিনিই সিকান্দারের ছেলেকে স্কুলে আনা-নেওয়া করেন।
মুশফিক পাশের সিটে বসে। তার হাতেও ছুরি। নড়লেই গলা কা*টার, তর্জনে ড্রাইভার পাথর বনে রয়েছেন। আরমান বলল,
‘ চলে আয়। কাজ হয়ে গেছে। ‘
মুশফিক বিজয়ী হাসল। চালকের হাত বাঁ*ধা দড়িতে ছু*রি দিয়ে পো*চ দিলো। কে*টে,খুলে গেল বাঁধন। তিনি মুচড়ে উঠলেই হুকুম ছুড়ল,
‘ একদম নড়বিনা শালা! আমরা বলব, তারপর। ‘
চালক ভ*য়ে ভ*য়ে মাথা কাত করলেন। আরমান ব্যাক সাইডের দরজা খুলে বাচ্চাটাকে বসাল। দুজন,
সন্তর্পণে,কে*টে পড়ল তারপর ।
ড্রাইভার অনেকক্ষন,ওদের অনুমতির অপেক্ষা করলেন। সাড়াশব্দ না পেয়ে বললেন,
‘ স্যার,আমি কি এখন চোখ খুলব?’
উত্তর এলোনা। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তাও না। শেষে আস্তে-ধীরে চোখের বাঁধন টেনে নামাতেই দেখলেন কেউ নেই। বিদ্যুৎ বেগে পেছনে ঘুরলেন।
সিকান্দারের ছেলেকে অক্ষত, ঠিকঠাক দেখে র*ক্ত সঞ্চালন ফিরল শিরায়। বুকে হাত দিয়ে শ্বাস নিলেন। আজ এদের থেকে বাঁচলেও, এই ছেলেকে ছাড়া ফিরলে, সিকান্দার তাকে নিশ্চিত মাটিচা*পা দিত।
***
করিমের দোকান দুদিন ধরে বন্ধ। অসুস্থতায় খুলতে পারছেন না। অথচ ওনার হাতে চা, তীব্রর বছরকার অভ্যেস।
চৈত্রের অসহ্য রোদে মাথা ধরেছে তারওপর।
অন্যদিকে চেইন স্মোকার সে। গাদায় গাদায় সিগারেট সাবাড় করা চুটকির ব্যাপার। আজকেও দোকানের ঝাপ লাগানো দেখে বিরক্ত হয় তীব্র।
চ সূচক শব্দ তোলে জ্বিভে।
বাকীরা ক্লান্ত ভঙিতে, বন্ধ দোকানের বেঞ্চে বসে। সিকান্দারের ছেলে কিডন্যাপিং থেকে, সব কিছু মিটমাট করা একটা বিশাল যুদ্ধসম। একটারও খাওয়া হয়নি দুপুরে৷ তীব্রর চা শেষ হলে কাছাকাছি হোটেলে গিয়ে খেত৷ তুষার বলল,
‘ ভাই আপনি বসেন,আমি অন্য দোকান থেকে চা এনে দেই। ‘
‘ তোরা বোস,আমি যাচ্ছি…’
শাফিন বলতে গেল, ‘ আমরা থাকতে তুই…’
সে কেড়ে নেয় কথা, ‘ সমস্যা নেই।’
নীচু টঙ থেকে বেরিয়ে আসে তীব্র। সন্ধ্যে হবে,অথচ রোদের তাপ তখনও প্রখর। ভ্যাপ্সা গরমের অসহ্য রকম বাড়াবাড়ি। তীব্রর শার্টের তিনটা বোতাম আগেই খোলা ছিল। উষ্ণতায় আরো একটা খুলে ফেলল এবার। আশেপাশে তাকাল। ক’দিন আগে করিমের দোকানের সোজাসুজি একটা দোকান বসেছিল চায়ের। বেচারা চাঁদা নিয়ে বাকবিতন্ডায় মা*র তো খেয়েইছে,দোকানও হারিয়েছে সাথে।
তীব্র শ্বাস ফেলল। ভালোয় ভালোয় চাঁদা দিলে,আজ ব্যাটার দোকান ও থাকত,তারও চা খাওয়া হোতো। এই মোড়ে আর চায়ের দোকান নেই। আছে গলির মুখে একদম।
তীব্র যখন দাঁড়িয়ে, ক্ষি*প্রবেগে সাদা রঙের গাড়ি পাশ কাটায়। অপ্রস্তুতিতে ভরকাল সে। ত্রস্ত সরে গেল। আরেকটু হলে চাকা উঠে যেত পায়ে। মেজাজ তুঙ্গে উঠল সহসা। ক্ষে*পে,চিল্লিয়ে বলল,
‘ এই মাদা**** বাচ্চা!’
অকথ্য গালিটা চালকের কানে পৌঁছাল কী না জানা নেই। তবে পেছন থেকে মিরাজ হাতে পাথর নিয়ে ছুটে এলো। দ্বিরুক্তি ছাড়াই ছু*ড়ে মারল ওদিকে। অথচ গাড়ির টিকি নেই। হাওয়ার বেগে গায়েব হয়েছে আগেই।
উল্টোপাশ থেকে পুষ্পিতাদের রিক্সা আসছিল। পায়ের কাছে মিষ্টির প্যাকেট। রাহাত মায়ের কোলে বসে।
ক্ষুদ্র পাথর, দাপিয়ে গিয়েই, সালমার কপালে এসে লাগল। জ্বিভ কাটল মিরাজ। নিশানা ভুল হওয়ায়,চুপসে ঘুরে গেল ওমনি। তীব্র কটমটিয়ে বলল,
‘ নির্বোধ!’
মিরাজ ঠোঁট ওল্টায়।
সালমা বেগম কঁকিয়ে, আ*হত স্থান চেপে ধরলেন। কা*টেনি,তবে ব্য*থা পেয়েছেন। পুষ্পিতা হকচকিয়ে ওঠে। উতলা হয়ে বলে,
‘ মণি,লেগেছে? দেখি,হাত সরাও।’
‘ ঠিক আছি। কে মা*রল ওটা?’
রিক্সাচালক চার-পাশে চাইলেন। একটু দূরের তীব্রকে দেখেই ঘাবড়ে প্যাডেল ঘোরালেন দ্রুত। এই ছেলের মতিগতির ঠিক নেই। কখন এসে গলা চে*পে ধরে!
রাহাতের গোলগাল মুখে চমক। পাথর কে মা*রল? হন্যে চোখে এদিক-ওদিক চায় সে। দোকানের সামনে তীব্রকে দাঁড়ানো দেখল তখন। পুরুষালি ওষ্ঠপুট সিগারেটের দখলে। অন্যদিকে দৃষ্টি । কপালের ভাঁজে পরিচ্ছন্ন বিরক্তি। একটা মানুষ আ*হত হওয়ার চিন্তাভাবনার চিহ্ন মাত্র নেই। পাথরটা সেই মে*রেছে কী না রাহাত বুঝল না। তবে মিহি আওড়াল,
‘ বিট্টু ভাই!’
পুষ্পিতা, সালমাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল। চোখ ছিল তার কপালে। কিন্তু স্পষ্ট কানে পৌঁছাল ওই নাম। মুহুর্তে মূর্তির মত,স্তম্ভ বনে গেল। নিশ্চয়ই গুন্ডাগুলো আশেপাশে আছে! আ*তঙ্কে তাকানো তো দূর,মাথা যে নোয়াল,তুললই না আর।
***
খোরশেদুল বসে বসে চা খাচ্ছেন। বানিয়েই রেখে গিয়েছিলেন সালমা,শুধু গরম করেছেন তিনি। স্ত্রীর হাতের প্যাকেট গুলো দেখেই হাসলেন তিনি। পরিষ্কার প্রকাশ পেল তার বিদ্রুপ,তুচ্ছতাচ্ছিল্য।
সালমা বিশেষ পাত্তা দিলেন না।
নিশ্চুপভাবে ওগুলো এনে টেবিলে রাখলেন। পুষ্পিতার চেহারায় উৎকণ্ঠা। মণি রা না করলেও জায়গাটায় য*ন্ত্রনা হচ্ছে নিশ্চয়ই?
সে শশব্যস্ত বলল,
‘ মণি,ব্য*থা করছেনা? বরফ লাগিয়ে দেই একটু?’
খোরশেদুল ভ্রুতে ভাঁজ ফেললেন,
‘ কেন? কী হয়েছে?’
সালমার থমথমে জবাব,’ কিছু না। ‘
পুষ্পিতাকে বললেন, ‘ লাগবেনা। তুই হাত মুখ ধো গিয়ে।’
খোরশেদুল তিঁতিবিরক্ত হলেন। তিনি পুষ্পিতাকে দেখতে পারেননা কথাটা সঠিক! তাই বলে স্ত্রী তাকে শত্রু ভাববে? কেন? বিয়েতো ভালোবেসেই করেছিলেন। অথচ বোনের মেয়ের জন্য দরদী মহিলা স্বামীকেও পর ভাবে এখন। কাপে অর্ধেক চা রেখেই ঘরে গেলেন তিনি। পুষ্পিতা তখনও দাঁড়িয়ে। অসহায় চোখ সালমা বেগমের কপালে। তিনি ওমনি ধ*মক দিলেন,
‘ যাচ্ছিস না কেন?’
পুষ্পিতা ইচ্ছের বিরুদ্ধে বোরখা ছাড়তে চলল। অচিরেই তুলতুলে হৃদয়,ফুঁসে উঠল বিট্টু মাস্তানের ওপর। মণির কপাল ফুলে গেছে। খুব ব্য*থাও পেয়েছে সে জানে। অভদ্র ছেলে,গুরুজনকেও ছাড় দেয় না। নিশ্চয়ই মেয়ে দেখে পাথর ছু*ড়েছিল! মানুষ এত খা*রাপ হয় কী করে?
সালমা বেগমও ফ্রেশ হতে চললেন। ফিরে এসে মিষ্টি বিলাতে যাবেন। রাহাত কিছুক্ষণ চোরের মত করল। খাবার ঘর খালি হতেই, সে টেবিলের কাছে ছুটে এলো। আঙুলের কড় গুনল দ্রুত। ওপরের প্যাকেট ছি*ড়ল। প্লাস্টিকের বাটি নিয়ে গুনে গুনে পনেরটা রসগোল্লা তুলল। ঝড়ের বেগে, ঘর থেকে বেরিয়ে গেল আবার।
ভরসন্ধ্যে বেলা। সূর্য ডুবছে প্রায়। কমলা আলোয় রাঙা পশ্চিম। ধীরেসুস্থে অন্ধকার নামছে চারদিকে। তীব্র তার জিপে উঠে বসেছে। গন্তব্য, জামশেদের অফিস। ক্লিপের জন্য, ভদ্রলোক মাথা খেয়ে ফেলছেন। অধৈর্য তিনি। বাড়ি ফিরে নেওয়ার সহ্য টুকু নেই।
তীব্র রওনা করতে নেবে,এর মধ্যেই, পেছন হতে ক্ষুদ্র কণ্ঠের জোড়াল ডাক,
‘ বিট্টু ভাই!’
সে ভ্রু কুঁচকে মাথা ঝুঁকিয়ে চাইল। রাহাতকে ছুটে আসতে দেখে স্টার্ট দেওয়া গাড়ির গতি থামাল তৎক্ষনাৎ।
শাফিন বলল,
‘ আসছে ব্যাটা ফুটবল!’
রাহাত ছুটে এসে থামল। হাঁপালো কিছুক্ষণ।
‘ তুমি?’
সে জবাব না দিয়ে ফটাফট প্রশ্ন করল,
‘ একটু আগে কি আপনি আমার আম্মুর গায়ে পাথর মে*রেছেন?’
তীব্র ভ্রু বাঁকায়, ‘ তোমার মা ছিল?’
সে মাথা ঝাঁকাল ঘন। তীব্রর স্বর ধীর,
‘ ও মে*রেছে।’
রাহাত ক্ষুব্ধ চোখে চাইতেই, মিরাজ চুপসে বলল, ‘ ইচ্ছে করে মা*রিনি ভাইয়া। নিশানা ফেইল করেছে।’
তীব্র মারেনি,রাহাতের কোমল মন, এতেই ভালো হয়। মুহুর্তে, তুষ্ট, ঝকঝকে হাস্যে গাল ভরল তার। সে মিষ্টি আনলেও,যদি নিশ্চিত হতো,তীব্রই তার মাকে মেরেছে,তবে আর দিতোনা। যেমন এনেছিল,ওমন ফেরত নিতো। তাই জন্যেই না আগেভাগে প্রশ্নখানা করল!
রাহাত দাঁত মেলে বলল,
‘ আমিও তাই ভেবেছি। শুধু শুধু আপনি কেন মা*রবেন!’
তীব্র শুধায়, ‘ কোথায় গিয়েছিলে?’
রাহাতের চিত্ত চঞ্চল! ফুরফুরে কণ্ঠে জানাল,
‘ আমার ছোটপু পরীক্ষায় পাশ করেছে তো,তাই মিষ্টি কিনতে গিয়েছিলাম। আপনার জন্যেও এনেছি।’
বুকে চেপে বাটির ঢাকনা খুলল সে। তীব্র অবাক হয়ে বলল, ‘ এগুলো আমাদের জন্য এনেছ?’
‘ জি।’
মুশফিকের জ্বিভে জল আসে, টসটসে রসগোল্লা দেখে। হাত বাড়িয়ে বলল, ‘ দাও দাও খাই।’
রাহাত দিলোনা। বাটিটা তীব্রর পাশের সিটে রেখে বলল,
‘ সবাইকে একটা একটা দিয়ে,বাকী তিনটা আপনি খাবেন।’
মিরাজ কপাল কুঁচকে বলল,
‘ কেন,কেন? আমাদের একটা, ওর তিনটা কেন?’
আরমান দুষ্টুমি করে বলল,
‘ কেন আবার,সেদিন দুলভাই বানিয়ে গেল না!’
রাহাত মন খারাপ করে বলল,
‘ তা আর হবেনা। আপু গুন্ডা- মাস্তান একদম পছন্দ করেনা। আমাকেও বলেছে আপনাদের ধারে-কাছে না আসতে।’
তীব্র বলল,
‘ ঠিক বলেছে, এসোনা। ‘
‘ কেন? আপনি বুঝি খা*রাপ?’
তার ক্ষুদ্র জবাব,
‘ খুব!’
‘ তাতে কী হয়েছে? আমিও অত ভালো নই। আমি তো বড় হলে বক্সিং এ যাব। সবাইকে আ*ছাড় মে*রে মে*রে মা*রব। আপুতো ভালো মেয়ে,ও এসব বোঝেনা।’
শাফিন বলল,
‘ তোমার কাউকে আ*ছাড় মা*রতে হবেনা ভাই। তুমি কারো ওপর শুয়ে পড়লেই তার নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে যাবে।’
বাকীরা ভীষন মজায় হুহা করে হেসে উঠল ওমনি। রাহাত মুখ কালো করে তীব্রর দিক চাইল। শাফিন পাশেই ছিল তার। সে ওমনি মাথায় থা*প্পড় মেরে বলল,
‘ চুপ থাকতে বলেছি না তোকে?’
শাফিন থামল,তবে হাসল মিটিমিটি।
তীব্র রাহাতের দিক চেয়ে বলল, ‘ সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে, বাড়ি যাও এখন। ‘
‘ আচ্ছা, সামনের সপ্তাহে আমার আপুর বিয়ে। আপনারা সবাই আসবেন কিন্তু ।’
কিন্তু শাফিনকে দেখিয়ে বলল,
‘ শুধু ওনাকে রেখে আসবেন।’
সে তব্দা খেয়ে বলল,
‘ আমি কী করলাম?’
‘ আপনি আমাকে মোটা বলেছেন,তাই আপনি বাদ।’
তারপর, হাঁটা দিতেই তীব্র বলল,
‘ দাঁড়াও।’
থামল রাহাত। তুষারকে ইশারা করলে সে ছুটে গেল পাশের দোকানে। পলিথিনে চারটে আইসক্রিম পেঁচিয়ে ফেরত এলো। হাতে দিতেই,
রাহাতের চেহারা চকচকে হয়। হেসে তীব্রকে বলল,
‘ থ্যাংক ইউ!’
দুরন্ত পায়ে দৌড়ে যায় বাড়ির দিকে। শাফিন সেদিক চেয়ে বলল,
‘ কী ক্ষুদে ভক্ত বানালি রে ভাই! মিষ্টিও এনে খাওয়াচ্ছে! অন্তত এই ভালোবাসার মান রাখতে, ওকে তোর শালা বানানো উচিত।’
তীব্রর ওপর প্রভাব ফেলল না কথাটা। তার ফোন বাজছে সমানে। স্ক্রিনে জামশেদের নাম। সে পুনরায় স্টার্ট দিলো জিপ। বাকীদের রেখে এগিয়ে গেল সামনে।
****
বৈশাখের পাঁচ তারিখ। আজ মিথিলার বিয়ে। ছোটখাট ফ্ল্যাটে লোকজনের উপচানো সমাগম। খোরশেদুলের বহু আত্মীয় এসেছেন গ্রাম থেকে। এদিক থেকে,বেশ পিছিয়ে সালমা। এক ভাই ব্যাতীত তার নিজের কেউ নেই। অতিথি যা সব,শ্বশুররালয়ের। খোরশেদুলের পিতা মহিদুল সেকেলে মানব। ক্লাবে অনুষ্ঠান তার দুর্দান্ত অপছন্দের। খোরশেদুল বাধ্য সন্তান। পিতার মান্য হয়ে ফ্ল্যাটেই আয়োজন করলেন সবকিছুর। চার কামড়ার ফ্ল্যাট অল্প মানুষেই ভরে গেছে। গায়ে গায়ে বাড়ি খাওয়ার অবস্থা।
সুপ্রসন্ন ভাগ্য হিসেবে, তাদের বিল্ডিংয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোরটা মাঠের মতন। খোরশেদুল সেখানেই টেবিল- চেয়ার পাতিয়েছেন। প্যান্ডেল সাজিয়েছেন বড় করে।
মিথিলাকে সাজাতে পার্লার থেকে লোক এসেছে।
সালমার পদযূগলের বিশ্রাম নেই। শ্বশুর বাড়ির মানুষ, আবার অন্যান্য অতিথিদের দেখাশোনায় ব্যস্ত তিনি। পুষ্পিতা থাকায় অর্ধেকটা সাহারা মিলছে অবশ্য। মেয়েটাকে বলতে হয় না,আগ বাড়িয়ে নিজেই করে ফেলে সব।
এইত, এখন,গরমে সবার কাহিল দশা কমাতে,জগ ভরে ভরে শরবত বানিয়েছে। গ্লাসে ঢেলে ঢেলে দিয়েও আসছে সকলকে।
নূহা তার মাকে নিয়ে এসেছে কিছুক্ষণ। বোর্ড এক্সামের পর তাদের আজই দেখা হলো। অথচ কাজের চাপে পুষ্পিতা সময় দিতে পারছে না। সে গল্পে বসলে সালমা কিছু বলবেন না,কিন্তু বিবেক বলেও বস্তু আছে তো। উনি একা একা সব সামলাতে হিমশীম খাবেন যে।
মিথিলাকে সাজানো হচ্ছে। ঘরে মোটামুটি মানুষ। অন্য ঘরে জায়গা না পেয়ে, নূহাও এসে বসেছে সেখানে। তবে সেই আসনে মিথিলার থেকে সচেতন দুরুত্ব । মানুষ হিসেবে বেশ অহংকারী সে। এইজন্য নূহার সাথে বিশেষ জমেনা। আবার পুষ্পিতার সঙ্গে আজেবাজে ব্যবহারের জন্য দুচোক্ষে তাকে দেখতে পারে না ও।
মিথিলার ফোন বাজছে। স্ক্রিনে আনসেভ নম্বর। কয়েকবার নাহিদ হতে পারে ভেবে সে লাইন কা*টল। পরমুহূর্তে ফের কল আসে। গত কয়েক দিন যাবত নাহিদের সাড়াশব্দ নেই। ছেলেটা যেন হঠাৎই গায়েব হয়েছে। রাত-বিরেতে কল করে বিরক্ত করছেনা। মিথিলা বাধ্য হয়ে রিসিভ করল। তার শ্বশুর বাড়ির কেউ হয় যদি?
হা করার পূর্বেই, ভেসে এলো নাহিদের ব্যথিত কণ্ঠ,
‘ তাহলে বিয়েটা কোরছোই মিথিলা?’
অচিরে মেজাজ চটে গেল ওর। চেঁচাতে গিয়েও আশে পাশের মানুষ দেখে থামল। উঠে গেল বারান্দায়।
‘ আবার তুমি ফোন করেছ নাহিদ? আর ক’বার ব্লক করলে থামবে?’
‘ আর ব্লক করতে হবেনা। আজকেই শেষ, এরপর আর তোমায় জ্বা*লাব না।’
মিথিলা ভ্রু উঁচায়,
‘ হঠাৎ এত সুবুদ্ধি!’
নাহিদ মলিন হেসে বলল,
‘ কী লাভ বলো! তুমিতো আর আমার হবেনা। তাই সব আশা ছেড়ে, চাইছি তুমি ভালো থাকো।’
‘ থাক থাক,এত ভালো মানুষ সাজতে হবেনা। এসব বলতে ফোন করেছ? তাহলে বলে রাখি আমার সময় নেই,তৈরি হচ্ছি। ‘
‘ বউ সাজছো? কত শখ ছিল আমার, তোমাকে নিজের বউ রূপে দেখব। হলোনা!’
তার কণ্ঠে ক্লেশ,আক্ষেপ। কিন্তু মিথিলা বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ এসব লুতুপুতু কথা অন্য কাউকে বোলো নাহিদ। শুনলে খুশি হবে। আমি রাখছি…’
সহসা নাহিদের ব্যস্ত স্বর, ‘ না, শোনো..
‘ কী?’
নাহিদ অনুরোধ করল,
‘ একবার বাড়ির পেছনে আসবে,প্লিজ?’
‘ মানে? ওখানে কী কাজ?’
‘ একটাবার দেখব তোমায়। বউ সেজেছ, আমার না হোক,অন্যের। কেমন লাগে দেখতে ইচ্ছে করছে।’
মিথিলা তাজ্জব হয়ে বলল,
‘ মানুষ এত নির্লজ্জ হয় কী করে? আমাকে তো পাগল কুত্তায় কা*মড়েছে যে এখন এই অবস্থায় তুমি ডাকবে আর ছুটব। পারব না ভাই!’
নাহিদের আকুল কণ্ঠ,
‘ প্লিজ মিথিলা!’
‘ বললাম তো না। বেশি ঘাঁটিওনা! নম্বর এটাও ব্লক করব বলে দিলাম।’
নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ বেশ! আসতে হবেনা তোমায়। তাহলে বরং একবার বলে দাও,আংটিটা কী করব?’
‘ কীসের আংটি?’
‘ শেষ বার তোমাকে কিছু দেব বলে, টাকা জমিয়ে একটা হীরের আংটি কিনেছি। আসবেনা যখন,চলে যাচ্ছি।’
এতক্ষণের বিদ্বিষ্ট অভিব্যক্তি, উবে গেল মিথিলার। শিথিল হলো চোখমুখ। হীরে শব্দটা শুনেই, লোভাতুর মন নেঁচেকুদে উঠল।
থেমে থেমে শুধাল, ‘ হীরের আংটি? সত্যি?’
‘ মিথ্যে বললে কী তুমি ফিরবে? তাহলে ফিরে যাচ্ছি, আসবেনা যখন অপেক্ষা করে লাভ কী!’
সে শশব্যস্ত বলল, ‘ না না যেওনা। আমি কি তোমায় যেতে বলেছি না কী?’
‘ আসবে তুমি?’
মিথিলা স্বর মাত্রাধিক কোমল করে বলল,
‘ আসছি। কিন্তু একটু সময় লাগবে,তুমি আবার চলে যেওনা নাহিদ।’
‘ না না যাব না। এসো তুমি।’
মিথিলা ফোন নামাল কান থেকে। তাকাল রুমের চারদিক। এত এত মানুষ! ও বের হতে গেলেই তো হাজারটা প্রশ্ন করবে। তারপর নীচে নামা,বাবা সেখানে। কীভাবে যাবে? এদিকে আংটির জন্যেও ভেতরটা খুশখুশ করছে খুব!
মিথিলা ঠোঁট কামড়াল ভাবনায়। যাই হয়ে যাক,বলদাটার থেকে শেষ বার এত দামী উপহার হাতছাড়া করা যাবেনা।
সে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতে যাবে,ওমনি গুঞ্জন ছুটল বর আসার।
একজন রুমে এসে কথা ছু*ড়ল,
‘ বরের গাড়ি গলিতে ঢুকছে। গেট ধরতে তৈরী হও সবাই।’
সবাই হৈচৈ বাঁধিয়ে ফেললেও, মিথিলা মহা দুশ্চিন্তায় পড়ল। পলাশরা চলে আসবে এখন। ওকে তো থাকতেই হবে। তাছাড়া বউ,অন্য ছেলের সাথে একান্ত দেখা করতে যাওয়াও বিপদ। কেউ দেখে ফেললে সবশেষ!
সেই ক্ষণে, গ্লাস ভর্তি ট্রে নিয়ে কক্ষে ঢুকল পুষ্পিতা। ওকে দেখেই মিথিলার মস্তিষ্কে নিউরন বেজে উঠল গতিতে। দারুণ বুদ্ধিতে ছলকে উঠল কোষ।
এগিয়ে এসেই, পুষ্পিতার কনুই টেনে নিয়ে চলল এক কোণায়। ঈষৎ চমকালো ও। আবার কী কিছু করল!
মিথিলা চাপা কণ্ঠে বলল,
‘ আমার একটা কাজ করে দে।’
‘ কী কাজ আপু?’
‘ বাড়ির পেছনে যাবি। একটা পার্সেল আসবে আমার। নিয়ে চলে আসবি।’
‘ এখন? এখন তো ওখানে খুব অন্ধকার!’
মিথিলা নিরুদ্বেগ,
‘ তো?’
পুষ্পিতা ছোট কণ্ঠে বলল, ‘ ভ*য় লাগে!
মিথিলা কটমটিয়ে ওঠে,
‘ ন্যাকা ন্যাকা কথা বলবিনা। আমার বিয়ে নাহলে আমিই যেতাম। তুই যাস্ট যাবি,ডেলিভারি ম্যানের কাছ থেকে জিনিসটা নিয়ে ফেরত আসবি। ব্যাস! এত ভ*য়ের কী আছে? খালি কাজ না করার ছুঁতো তাইনা?’
পুষ্পিতা বলল,
‘ নূহাকে সাথে নেব?’
‘ এই না! নূহা কেন,কাউকে কিছু বলা যাবেনা। এনে সোজা আমার হাতে দিবি। মনে থাকবে?’
পুষ্পিতা মাথা নোয়াল। পরপর ঘাড় হেলাল।
‘ তাড়াতাড়ি যা। ট্রে আমাকে দে।’
হাত থেকে নিজ উদ্যোগে ট্রে নিলো মিথিলা। তাগাদা দিয়ে ওকে পাঠাল নীচে। নূহা কথাবার্তা না শুনলেও সব চুপচাপ দেখল। তবে বিষয়টা আহামরি নয় বলে, মাথা ঘামায়নি।
***
লাইন কে*টে, সিমটাই ফোন থেকে বের করে ফেলল নাহিদ। উজ্জ্বল চোখে চাইল তীব্রর দিক। আনন্দ চিত্তে জানাল।
‘ আসছে।’
‘ গুড। যখন বললাম,ঠিক তখন হাজির হবি। সময়টা মাথায় রাখিস। কারো কাছেই ফোন নেই,সো নো কল,নো মেসেজ। ‘
নাহিদ মাথা দোলাল, ‘ আচ্ছা।’
পরপর উদ্বীগ্ন গলায় বলল,
‘ সব ভালোয় ভালোয় হবে তো বিট্টু? মিথিলা আমার হবে তো?’
শাফিন বলল,
‘ হবে মানে, হতে বাধ্য। খালি একবার তোর গার্লফ্রেন্ড আসুক জায়গায়,বাকীটা আমাদের ওপর ছেড়ে দে।’
নাহিদ ভরসা পেলো। তীব্রর সাথে চললেও,সে বাকীদের মত এত সাহসী নয়। তারওপর মেয়ে তোলার ঘটনা জীবনে প্রথম। তীব্ররও তাই। সেজন্যে ভীষণ বিশ্বস্ত চারজন ব্যাতীত,বাকীদের জড়ায়নি সে। এমনকি সবার পরিচিত জিপ রেখে, অন্য গাড়ি ভাড়া করে এনেছে।
নাহিদ ফোনে হাত দিতে দিতে বলল,
‘ আচ্ছা আরেকবার ওর ছবিটা দেখে….’
মিরাজ বলল, ‘ লাগবে না। দেখিয়েছিলি তো একবার। মনে আছে।’
তীব্র তাগাদা দিলো, ‘ সময় কম,চল। আর তোকে যা বলেছি মাথায় রাখিস।’
নাহিদ বলল, ‘ আচ্ছা আচ্ছা।’
তীব্র ড্রাইভিং-এ বসে। পাশে শাফিন,পেছনে মিরাজ। মাথায় ক্যাপ,আর মুখে মাস্ক বাঁধে সবাই। কেউ দেখেই চিনে না ফেলার সুবিধায়। থেকে গেল নাহিদ। চলে যাওয়া,গাড়ির দিক চেয়ে ব্যকুল প্রার্থনা করল আরেকবার।
***
পুষ্পিতাকে সাবধানী কদমে, বাড়ির পেছনে যেতে দেখেই সন্দেহে ভ্রু গোটালেন খোরশেদুল। এই মেয়ে, এই রাতে, একা ওদিকে যাচ্ছে কেন? এলাকায় আসতে না আসতেই কি কাউকে জুটিয়ে ফেলেছে?
খোরশেদুলের পুরু নাক ফুলল। নেতিবাচক ভাবনায় মস্তিষ্ক তলাল। পুষ্পিতার নম্র পদচারণ অনুসরন করে ত্রস্ত পিছু নিলেন তিনি।
পুষ্পিতার শরীর সর্বদা গুটিয়ে থাকে। চেহারায় থাকে ভীতিকর প্রলেপ। যেন এক্ষুণি হার্ট অ্যা*টাক হচ্ছে,হবে। লাফ-ঝাঁপ দিয়ে ম*রে যাবে সে।
ওমন নেতানো চোখমুখেই বিল্ডিংয়ের পেছনে এসে দাঁড়াল ও। যতটা অন্ধকার ভেবেছিল,ততটা নয় দেখে স্বস্তি পেল খানিক। সারাবাড়ির সবুজ,লাল আলোর অল্পস্বল্প ছটা আসছে এখানেও। সব কিছু স্পষ্ট না হলেও ঘুটঘুটে নয়। কিন্তু ভ*য়টা কমেনি। নতুন বাড়ি,অচেনা জায়গা। সব মিলিয়ে শঙ্কিত সে। দূর্বল বুক কাঁ*পছে। মনে হচ্ছে, পেছনে ভূত দাঁড়িয়ে। এসেই মটকে দেবে ঘাড়। পুষ্পিতা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
সাউন্ড সিস্টেম বাজছে। হুল্লোড়ে সব গান। পুষ্পিতা অপেক্ষা করে। ডেলিভারি ম্যান আসছেনা কেন এখনও? আপু যে বলল,গেলেই পাবে।
পুষ্পিতা অধৈর্য হয়ে পড়ল। মশা ভিড়ছে ত্বকে। গরম লাগছে। ঘামে ভিজে যাচ্ছে শরীর। তারওপর ভূত-প্রেতের আ*শঙ্কা।
আচমকা, একটা শক্ত হাত পেছন থেকে থা*বা বসাল মুখে। পিলে চমকে গেল পুষ্পিতার। আ*ততায়ীর হাতের বাঁধন দৃঢ়। সাথে নরম কিছুর স্পর্শ। পোক্ত ভাবে ধরায়,পুষ্পিতার হৃদস্পন্দন তত্র থেমে যায়। ছলাৎ করে লাফিয়ে ওঠে কলিজা। পরপর নাসাছিদ্র ভেদ করে ঢোকে উৎক কিছুর গন্ধ।
ভীত,প্রকট চক্ষুদুটো নিভে আসে ক্রমে। একটা সময়, আগন্তুকের ওপরেই পিঠ ঢলে পড়ল তার।
পুষ্পিতাকে জ্ঞান হারাতে দেখেই ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল শাফিন। ক্লোরোফর্ম ভেজানো রুমাল,ঝটপট ভরল পকেটে। পেছন থেকেই কালো থলের মত কাপড়টা ওর মাথার মধ্যে ঢুকিয়ে, একেবার নামিয়ে আনল থুত্নীতে। পুরো চেহারা ঢেকে গেল এবার।
মিরাজ হন্তদন্ত ভঙিতে এসে পাশে দাঁড়াল। অবচেতন পুষ্পিতার,আপাদমস্তক দেখে বলল,
‘বউ,অথচ পড়নে বেনারসি নেই কেন? থি প্রিস পরে বিয়ে করবে নাকী?’
শাফিন বলল,
‘ শালা ওসব পরে ভাবিস! আপাতত ভাগতে হবে। কেউ দেখলে সর্বনাশ!’
মিরাজ মাথা দোলাল। ব্যস্ত ভাবে পুষ্পিতাকে পাঁজাকোলে তুলল।
তীব্রর কানে হেডফোন। লম্বা পা দুটো তুলে রাখা স্টিয়ারিং-এ। মিথিলাদের বিল্ডিং থেকে অনেকটা দূরে গাড়ি থামিয়েছে। কর্ণকুহরে দৃপ্ত আওয়াজে বাজছে মাইকেল জ্যাকশনের গান। শাফিনদের আসতে দেখেই চটপট সোজা হয়ে বসল ও। সিগারেট ফেলে,মাস্ক ঠিকঠাক করে ইঞ্জিন চালু করল গাড়ির।
শাফিন আগে আগে এসে দরজা খুলে দেয়। মিরাজ আস্তেধীরে পুষ্পিতাকে শুইয়ে দিলো সিটে। তীব্র সতর্ক গলায় শুধাল,
‘ কেউ দেখেছে?’
‘ না।’
‘ ওঠ,ফাস্ট।’
মিরাজ পাশে বসলে,শাফিন পেছনে এবার।
তীব্র ঘোড়ার গতিতে গাড়ি ছোটাল। পথেই পুষ্পিতার কোমল হস্তযূগল দঁড়িতে আটশাট করে বাঁধল ওরা।
****
খোরশেদুল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। হাত- পা ঠকঠক করে কাঁ*পছে। তীব্রকে স্পষ্ট দেখেছেন তিনি। সাথে দেখেছেন বাকীটাও। সব যেন এখন চোখের সামনে কাচের ন্যায় স্বচ্ছ।
“পুষ্পিতাকে, বিট্টু মাস্তান তুলে নিয়ে গিয়েছে” কথাখানা ভেবেই রুদ্ধ হয়ে এলো শ্বাসনালী।
দ্রুত পায়ে এগোলেন,সবাইকে জানাতে। এক পা বাড়িয়ে থেমে গেলেন আবার। তূখোড় বিরোধিতায় অন্তঃপট ভরে এলো। একপল চাইলেন সাজানো, তকতকে বাড়িটার দিক।
আজ তো মিথিলার বিয়ে। এখন যদি সবাই জেনে যায়,বাড়ির আরেক মেয়েকে মাস্তানরা তুলে নিয়ে গেছে,তবে তো বিয়ে ভে*ঙে যাবে। ন*ষ্ট হবে তার মেয়ের জীবন। না, না,বাবা হয়ে তাতো হতে দেওয়া যায়না। খোরশেদুল মাথা নাড়লেন দুপাশে। চোখমুখ পাথুরে করে ভাবলেন,
‘ পুষ্পিতা গোল্লায় যাক! সেতো প্রথম থেকেই চাইছিলেন মেয়েটা বিদেয় হোক তার ঘর থেকে। আজ কোনও এক ভাবে তো হচ্ছে। ওর জন্যে তাহলে নিজের মেয়ের গোছানো জীবন বরবাদ করবেন কোন দুঃখে? ‘
খোরশেদুলের স্বার্থপরতার ভিড়ে,বিবেক ঢাকা পড়ল অনিমেষ । বিচলিত চেহারা, আবৃত হলো মেকি সাবলীল হাবভাবে।
চলবে….