কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(০৮)
সময়টা বৈশাখের রূপ বদলের। নৈশভর প্র*লয় নৃত্যের পর, মধ্যদুপুরের প্রচন্ড গরম! তেজস্বী উ*ত্তপ্ত সূর্য তখন মাথার ওপর। দগদগ করে শরীর ঘামে। আজ আটদিন পর,দোকান খুলেছেন করিম শাহ। সর্বদা ফজরের আযানের সঙ্গে সঙ্গে ঝাপ মেলে বসেন তিনি। আর বিট্টুর গ্যাং এখানে হানা দেয় ঠিক এগারটায়। তীব্র আসে আস্তেধীরে । তার লাল জিপ দূর থেকে দেখলেও হিড়িক পড়ে আওয়াজের। হুকুম ছাড়াই করিমের তটস্থ হস্তযূগল ব্যস্ত হয়, ত্রস্ত চা বানানোর যু*দ্ধে।
প্রায় অনেকদিন পর চেনা-জানা মুখ গুলি দেখে, এক টুকরো হাসলেন করিম। তীব্র হাজির হতেই, সেই হাসি বাড়ল। সত্যি বলতে হাসিটুকু টেনে-হিঁচড়ে আনা। তীব্রকে দেখলেই তার পৌঢ় হাঁটু কাঁ*পে। অজ্ঞাত আ*তঙ্কে সিটিয়ে থাকেন। চায়ে চিনি কম-বেশি হলেই ছেলেটা চেঁতে তার সাধের দোকান ভে*ঙে না দেয়,সেই শঙ্কায় শিরদাঁড়া সবসময় ভেসে থাকে পিঠের ওপর। তবুও, আজ দুগাল ভর্তি প্রফুল্লতা নিয়ে, বরাবরের ন্যায় সালাম দিলেন তিনি। শুধালেন,
‘ ভাই কেমন আছেন?’
তীব্র বেঞ্চে বসল। পাশ ঘেঁষে বসল বাকীরা। কতকে জায়গা না পেয়ে পা ঝোলাল স্বীয় বাইকে।
‘ ভালো। কই ছিলে এতদিন?’
‘ গ্রামে গেছিলাম ভাই। বউটারে রেখে আসতে। শ্বাশুড়ি আপ্যায়নের জন্য আর আসতে দিলোনা। এতদিন ওখানেই বেরিয়েছি। অনেক বছর পর গেলাম তো।’
বলতে বলতে কাচের কাপে চামচ নাড়লেন করিম। টুং টুং শব্দে টঙ তখন আলোড়িত।
মিরাজ জলের বোতলের ছিপি খুলল। ঠোঁটে বসাতে বসাতে শুধাল,
‘ বউ রেখে এলে কেন? আরেকটা বিয়ে করবে না কী? ‘
‘ না না ভাই৷ কী যে বলেন!’
পরপর লাজে নুইয়ে এলেন করিম। আই-ঢাই ভাব করে বললেন,
‘ আসলে বউ পোয়াতি। ঢাকায় আমাদের আত্মীয় স্বজন নেই। ওর যত্ন আত্তির জন্যেই… “
পথিমধ্যেই, মিরাজের সবে নেওয়া, মুখের পানিটুকু বিদ্যুৎ বেগে বেরিয়ে এলো বাইরে। ভ্যাবাচেকা খেয়ে থেমে গেলেন তিনি।
মুশফিক গোল গোল চোখে ওনার আগা-মাথা দেখল। দাঁড়িতে পাক ধরেছে,চামড়া কুঁচকেছে। এই বয়সে আবার বাচ্চা?
শাফিন একধাপ এগিয়ে, মুখের ওপর বলে বসল,
‘ তোমার না আগের আরো ছয়টা ছেলে-মেয়ে? এখন আবার? এইবার তো চাচিরে রেহাই দাও। বুইড়া হইতেছ বাপ,আর কত? এই তোমাদের জন্যেই দেশে জনসংখ্যা বাড়ে, রাস্তায় জ্যাম হয়,অর্থমন্ত্রীর বাজেটে ঘাটতি আসে,গ্যাসের দাম বাড়ে,ডিম খাওয়া যায়না।’
করিমের হাসি গায়েব। চুপসে গেল মুখমণ্ডল। তবু, রা করার স্পর্ধা তার নেই। চুপচাপ হজম করলেন কথাগুলো। চোখ-মুখ অন্ধকার করে সবার হাতে হাতে কাপ দিয়ে গেলেন ।
তীব্রর বিলাতি নয়ন রাস্তার ওপর। শুভ্র ললাটে গুটিকতক ভাঁজ। সূক্ষ্ণ চাউনী ছুটে যাওয়া যানবাহনে। ওইভাবেই গরম চায়ে চুমুক দিলো সে।
বাকীরা গল্পে ব্যস্ত হলো। হাসাহাসি, ঠাট্টায় লুটিয়ে পড়ল একেকজন। করিমের শান্ত টঙ, মুহুর্তেই কেমন টগবগিয়ে ওঠে। রাস্তা থেকে মেয়ে গেলেই, চিরচেনা সেই রসিকতা ওদের। সিটি বাজানো,আকার-ইঙ্গিতে টেনে টেনে কথা শোনানো।
শাফিনের আগামী সপ্তাহে ফ্লাইট। মায়ের উন্নত চিকিৎসার জন্যে চেন্নাই যাচ্ছে। এখানে আরমান নেই। তীব্রর কথায় নাহিদের ছায়াসঙ্গী বনেছে। নাহিদের পাগলামি বাড়ছে। চেঁচিয়ে গলা ভে*ঙেছে। উল্টোপাল্টা কী করে বসে আবার,বন্ধুমহল আড়ষ্ট সেই আশঙ্কায়।
শাফিন ওর যাওয়ার কথা তুলল। মাকে নিয়ে তার চিন্তার কমতি নেই। প্রত্যেকে আশ্বাস দিলো তাতে।
শুধু তীব্র নিরুত্তর বসে। তামাটে নিম্নাষ্ঠ, সম্মুখ দাঁতে কা*টা। বিড়াল অক্ষি উদাসীন। চেহারায় কোনও কিছুর চিন্তা,কোনও দক্ষ ধ্যান!
শাফিন কথার ফাঁকে ফাঁকে অনেকক্ষণ ওকে দেখছিল৷ তীব্র এমনিতে চুপ থাকেনা। আজ কী হলো? গ্যাংয়ের মধ্যমণি নীরব থাকলে জমে?
সে ওপাশের বেঞ্চ থেকে উঠে, এপাশে এলো। পিঠে হাত রাখতেই, খানিক চমকে চাইল তীব্র। শাফিন অবাক হয়ে বলল,
‘ কী রে,চমকে উঠলি কেন? কী ভাবছিলি এত?’
তীব্র সামনে ফিরল। ছোট করে বলল, ‘ কিছু না।’
শাফিনের সন্দেহ বাড়ে। চুপ থাকা দলের দিক চেয়ে ভ্রু উঁচায়। মুশফিক-মিরাজ মাথা নাড়ল দুপাশে। তারাই যখন জানেনা,বাকীরা কী জানবে!
বন্ধুদের চোখাচোখির মধ্যেও তীব্রর হেলদোল দেখা গেল না।
শাফিন মাথা চুল্কাল। বুদ্ধি আঁটল তীব্রর মনোযোগ পেতে। অচিরে, কিছু একটা ভেবে মিটিমিটি হাসল ও। দুষ্টুমি করে বলল,
‘ কিছু ভাবছিলি না? কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে তুই ওই মেয়েটার কথা ভাবছিলি। কী যেন,পুষ্পিতা…!
শুধুমাত্র তীব্রকে খোঁচানো আর মজা করতে বলছিল শাফিন৷ অথচ ঝট করে চাইল তীব্র। দৃষ্টি,কণ্ঠ প্রগাঢ় করে শুধাল,
‘ তোর এমন কেন মনে হলো?’
শাফিন কাঁধ নাঁচায়৷
‘ এমনি। কেন সত্যিই বললাম নাকী? তুই,তুই মেয়েটাকে নিয়েই ভাবছিলি?’
তীব্র বিরস আওড়াল,
‘ ফালতু কথা-বার্তা!’
মিরাজ সন্দিহান গলায় বলল,
‘ আসলেই কী তাই? তোর কি মেয়েটাকে একটুও ভালো লাগেনি বিট্টু? প্রেমেও পড়িসনি? লাইক,লাভ এট ফার্স্ট সাইট!’
ঘটনার আগামাথা না জানা ছেলেদের চেহারায় কৌতূহল। উৎসাহী চোখ-মুখ গুলো একভাবে চেয়ে।
তীব্র এমনভাবে তাকাল, যেন মহাভারত অশুদ্ধ হওয়ার মতোন বাক্য বলেছে মিরাজ। উত্তর দেওয়ার আগেই শাফিন মাঝখান থেকে ফটাফট দাঁড়িয়ে যায়। হাত-পা নাডিয়ে, স্বর পাল্টে, সিনেম্যাটিক ভঙিতে দেখাল,
‘ গাইস,ভাবো, একটা অন্ধকার রাত। বাইরে বাঁজ পরার শব্দ। হাতে একটা মোম নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে জামশেদ কাকার বংশের বাতী, আমাদের নায়ক বিট্টু। ওরফে দ্যা গ্রেট তীব্র রেজা তালুকদার। তারপর, তারপর একটুখানি ঝুঁকে যাওয়া। চোখে চোখ রাখা দুজনের। সামনে একটি অপরূপ সুন্দরী মেয়ের দিক হা করে চেয়ে আছে সে। আহ কী দৃশ্য! কী অমায়িক সিন! আনন্দে বৃষ্টিরা নাঁচল, বাতাসের শো শো শব্দে গান বাজল,
‘ চোখে চোখে চোখ পড়েছে, কী বলব মুখে? কে তোমায় সাজিয়েছে এত অপলকে!
দারে দুম না রে, দুম নারে না রে নারে….
তীব্রর মানস্পটে সত্যিই সেসব গল্পের মতো হানা দিলো। সেই ভীত চাউনী,কম্পিত এক জোড়া অধর… এলোমেলো চুল…
কল্পনা বিস্তর হওয়ার আগেই চট করে চোখ খিঁচে নিলো সে। শাফিন হাত দিয়ে গিটার বাজানোর ভং ধরেছে৷ বাকীরা মাথা ঝুলিয়ে তাল দিচ্ছে। কাঠের বেঞ্চে ঢোল বাজানোর শব্দটায় বিরক্ত হয় তীব্র।
রেগেমেগে ধমক দেয়, ‘ থাম! ‘
সহসা থামল ওরা। করিম ঠোঁট চেপে হাসছিলেন। শশব্যস্ত ঠিকঠাক করলেন নিজেকে। তীব্র নাক ফুলিয়ে বলল,
‘এখানে প্রেম আসছে কোত্থেকে?’
‘ আসেনি?’
‘ না। কারো দিক চেয়ে থাকা আর প্রেমে পড়া এক না। এইত তোর দিক তাকালাম,এর মানে কী তোর প্রেমে পড়েছি? ‘
শাফিন দুপাশে মাথা নাড়ল।
তীব্র প্রতাপী গলায় বলল,
‘প্রেম হচ্ছে নাহিদের মত লুতুপুতু ছেলেদের সম্পত্তি। আমার জন্য ওসব নয়।’
সকলে সহমত পোষণ করল, ‘ ঠিক, ঠিক।’
আলোচনা স্থগিত হওয়ায়,স্বস্তি পেলো তীব্র। শ্বাস ঝাড়ল ফোস করে। তন্মধ্যে শাফিন রাস্তার দিকে ইশারা করে দেখায়,
‘ ওই দ্যাখ তোর ফুটবল যাচ্ছে।’
ঘাড় ঘোরাল তীব্র। হেঁটে যাচ্ছে রাহাত। তার স্কুল মর্ণিং শিফটে। পড়নে ইউনিফর্ম,বাড়ি ফিরছে। প্রায় অনেক দিন পর ওকে দেখল তীব্র। শাফিন নিজেই হাঁক ছুড়ল,
‘ এই গোলুমোলু,এই রাহাত।’
ডাক শুনে থামল রাহাত। আশপাশ চেয়ে, ফিরে তাকাল। অন্যমনস্কতায় ওদের খেয়াল করেনি এত সময়। তীব্রকে দেখা মাত্রই,চোখ-মুখ পালটে এলো গতিতে। সঙ্গে সঙ্গে অবজ্ঞায় ঘুরিয়ে নিলো চেহারা। ছোট্ট ছোট্ট কদম হনহনে গতি ধরতেই কপাল গুছিয়ে এলো তীব্রর। মিরাজ বিস্মিত হয়ে বলল,
‘ কী হলো ব্যাপারটা? তোর ক্ষুদে ফ্যান এমন করলো যে!’
‘ গোলুমোলু বলায় ক্ষেপেছে বোধ হয়!’
শাফিন হাসলেও,তীব্রর কাছে অদ্ভুত লাগে। যেখানে সামান্য ওকে রাস্তায় দাঁড়ানো দেখলেও, ছেলেটা ছুটে এসেছে,আঙুল ধরেছে জড়োতাহীন, সেখানে এই আচরণ ভাবনায় ফেলল। একটা ছোট্ট, বাচ্চা ছেলে তো আর,এমনি এমনি এমন করবেনা!
সে তৎপর উঠে পড়ে। কেন,জানেনা। রাহাতকে নিয়ে আগ্রহ কেন তাও না। হয়ত, প্রথম কোনও আদুরে শিশু স্বেচ্ছায় কোল ঘেষায় পাথুরে মন একটু নরম হয়েছিল।
বাকীরা উঠল ওর দেখাদেখি। রাহাতের মুখবিবর লালচে। অথচ ক্ষুদ্র নাক ফুঁ*সছে। যদি ক্ষমতা থাকত এক্ষুণি তীব্রকে শেষ করে ফেলত মে*রে। শুধুমাত্র তার জন্যেই আজ দুটো দিন ছোটপু ঘর ছাড়া। আর ফিরবেওনা হয়ত। রাহাতের কোটর ভরল পুষ্পিতার আনন মনে করে । সে হাতের উল্টোপিঠে চক্ষু মুছে নেয়৷ পেছন থেকে আচমকা অন্য হাতটা টেনে ধরল কেউ।
চকিতে ঘুরল ও। ভেজা আঁখি তীব্রকে দেখেই দপদপ করে জ্ব*লে উঠল। হাত মুচ*ড়ে বলল,
‘ ছাড়ুন। ‘
হা হয়ে গেল প্রত্যেকে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ল তীব্রর চেহারায়। হতবাক সে! হতচেতন!
শাফিন গোল চোখে সবাইকে দেখল। বিষয়টার সঙ্গে বন্ধুর সম্মান জড়িয়ে। দলের কনিষ্ঠদের আদেশ করল,
‘ তোরা টঙে গিয়ে বোস। আমরা আসছি।’
টা-টু আওয়াজবিহীন প্রস্থান নেয় তারা। রয়ে যায়,মুশফিক,মিরাজ আর ও। তীব্রর কপালের ভাঁজ প্রখর হয় আরও। বুঝতে না পেরে বলল,
‘ কী হয়েছে তোমার?’
‘ আপনি আমার সাথে কখনও কথা বলবেন না। আপনি খুব খারাপ একটা লোক!’
নির্ভীক চিত্তে আওড়াল রাহাত। বোনের শোকে দিশেহারা যেন। এলাকার দাপুটে,একমাত্র ভয়া*বহ মাস্তানের সামনে এমন ভঙিতে বলতেও,ক্ষুদ্র মুখে, লেশমাত্র আ*তঙ্ক দেখা গেল না।
তবে বলতে বলতে চোখ দুটোতে ছাপিয়ে এলো জল। রাঙা ওষ্ঠপুট নিঙরে বিলম্বহীন কেঁ*দে ফেলল সে। তীব্র তাজ্জব বনে গেল।
অবুঝের ন্যায় মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল বন্ধুদের সাথে। রাহাত নাক টানল। গোল গোল কপোলে চটচটে অশ্রু। হেচকি তুলতে তুলতে বলল,
‘ আমি আপনাকে কত পছন্দ করতাম! ছোটপুর কথার কখনও অবাধ্য হইনি। কিন্তু এবার ও মানা করা সত্ত্বেও আপনার সাথে লুকিয়ে লুকিয়ে মিশেছি। আর আপনি কী করলেন! এমনটা করতে পারলেন আপনি? ‘
কাতর কণ্ঠের প্রতিটা কথায়, বিশ্বাস ভা*ঙার শোক। অথচ পুরো বিষয় মাথার ওপর দিয়ে গেল ওদের। এই অভিযোগ,এই কা*ন্না, এই আচরণ সব যেন প্রহেলিকা!
তীব্র রাহাতের হাত ছাড়েনি তখনও। এখনও ছাড়ল না। শুধু মেইন রাস্তা থেকে টেনে নিয়ে এলো এক পাশে। মুখোমুখি হাঁটু গেড়ে বসে, দু বাহু ধরল। কণ্ঠ যথাসাধ্য কোমল করে বলল,
‘আমি সত্যিই বুঝতে পারছি না আমি কী করেছি! তবে তুমি কাঁদছো তাতে খারাপ লাগছে। জেনে শুনে তোমার তো কোন ক্ষতি করিনি। তাহলে?’
রাহাত আদ্র গলায় তেজ এনে বলল,
‘ করেছেন, অনেক বড় ক্ষতি করেছেন। শুধু আমার কেন,ছোটপুরও ক্ষতি করেছেন। আপনার জন্য,আপনার জন্যে, আমার ছোট আপুকে বাবা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। ‘
তীব্র হোচট খেল। বিহ্বল হয়ে বলল, ‘ আমার জন্যে? আমি তো তোমার ছোটপুকে চিনিইনা।’
রাহাত অমনি বাহু থেকে হাত দুটো সরিয়ে দেয়।
‘ মিথ্যে বলছেন কেন? আপনি তো দুদিন আগে আমার আপুকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন। আবার তাকে নিজের জামা পরিয়ে ফেরতও দিয়েছেন।’
প্রখর রোদে,তপ্ত আবহাওয়ায় এক বিশালাকৃতির বাঁজ পড়ল মুহুর্তে । তীব্র কিংকর্তব্যবিমুঢ়! বিস্ময় বাকীদের দৃষ্টিতে। মুশফিকের জ্বিভ ফুড়ে বেরিয়ে আসে,
‘পুষ্পিতা? ‘
মিরাজ ছটফটে কন্ঠে বলল, ‘পুষ্পিতা কি তোমার বোন?
রাহাত ভগ্ন,আহ*ত কণ্ঠে বলল,
‘ আজকে দুদিন হয়েছে, আপু চলে গেছে। আমাকে এখন কেউ আদর করছে না! আম্মু শুধু কাঁদছে। আজ আমার আপুর বৌভাত, কিন্তু আমি যাইনি। বাড়িতেও এক দন্ড মন টিকছেনা আপুকে ছাড়া। আমার শুধু কান্না পাচ্ছে। আপনি কেন এরকম করলেন ভাইয়া? আমার আপু কি আপনাকে কিছু বলেছে কখনও? কোনও ক্ষতি করেছে আপনার? ‘
শাফিনের মাথা রকেট বেগে চক্কর কা*টছে। ছোট আপু পুষ্পিতা, আরেক আপুর বৌভাত। হিসেব কষলে কি মিথিলাই ওর বোন? পৃথিবী আসলেই এত গোল!
ভেতরে ওঠা কৌতূহল দমাতে ব্যর্থ সে। চেপে রাখতে পারল না। জিজ্ঞেস করল,
‘ তোমার বড় বোনের নাম কি মিথিলা?’
মাথা ঝাঁকাল রাহাত। চক্ষুকোটরে টলটলে বারিধি। যেন পিচের রাস্তা ভাসিয়ে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছে সেখানে৷ তীব্র তখনও বিস্ময় সামলে উঠতে পারেনি। সাদাটে দুই নয়ন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে। ধাতস্থ হতে সময় নেয়। জ্বিভে ঠোঁট ভিজিয়ে আস্তেধীরে শুধায়,
‘ তোমার আপু কোথায়, জানো?’
রাহাত পুনর্বার কেঁদে ফেলল।
সে জানলে এখানে থাকতো? দুটো পাখা লাগিয়ে উড়ে যেত না?
‘ জানিনা। আমাদের সব আত্মীয়রা তো বিয়ে খেতে এসেছেন। তাদের বাসায় যাওয়ার তো কোনো উপায় নেই। আপু ঢাকার কিছুই চেনে না ভালো করে, কোথায় যাবে ও?’
তীব্র নীচের ঠোঁট কাম*ড়াল। সেতো এই এক কারণেই অমন গভীর রাতে মেয়েটাকে নিয়ে রওনা করেছিল সেদিন। কারণ জানত,এসব জানাজানি হলে বদনাম রটবেই। যেখানে ওর গায়েও লাগবেনা ওসব৷ কিন্তু মেয়েটিকে নামিয়ে দেওয়ার সময়ে, আশেপাশে একটা কাকপক্ষীও তো ছিল না। তাহলে?
জিগেস করল, ‘ তোমার আপুকে যে আমি নিয়ে গিয়েছি,কে বলেছে তোমাদের?’
‘ হাকিম চাচা! তিনি দেখেছেন। আর গিয়ে সবাইকে বলেছেন। তারপর, বাবা, বাড়িওয়ালা আন্টি আঙ্কেল,আমার দাদু সবাই মিলে আপুকে খুব বাজে বাজে কথা শুনিয়েছেন।’
সেই ভোরের বর্ণনা হুবহু দিলো রাহাত। বিরতি নিতেই, মিরাজ খটমট করে বলল,
‘শালার এটা আবার কেমন বাপ? কেমন ফ্যামিলি? মানলাম নিয়ে গেছে, তাই বলে বাবা হয়ে মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে? তাও আবার যে মেয়ে নাকি ঢাকা শহর কিছু চেনে না। ঘটনা হয়ে গেল দুদিন অথচ মেয়ে এখনও ফেরেনি,আর বৌভাত খায়? আশ্চর্য! ‘
রাহাত উদ্বেগ নিয়ে বলল,
‘আমার আব্বু তো ছোট আপুর বাবা নয়। আপুর তো বাবা-মা নেই। ‘
তীব্র ভাবনায় বুঁদ। সেখান হতে ছিটকে পড়ল কথাটায়। বজ্রাহতের ন্যায় বলল,
‘ কী!
‘ হ্যাঁ। বড় খালামণি তো অনেক আগেই মা*রা গিয়েছেন। আমি দেখিওনি ওনাকে। খালু কোথায় কেউ জানে না। আপু তো ছোট থেকে আমাদের বাসাতেই থাকে। সেজন্য বাবা আর বড় আপু ওকে কত কথা শোনায়! কত অপমান করে! আর পরশু তো ওইভাবে বেরই করে দিলো। আমি আর আম্মু ছাড়া আপুর কেউ নেই। এখন আমি আপুকে কোথায় পাব?’
চোখের চাউনী থমকে গেল তীব্রর। মূর্তির ন্যায় শক্ত বনে রইল। আবিল অক্ষি অনড়,নিশ্চল,নিষ্প্রভ। শুভ্র,সতেজ চেহারার আনাচে-কানাচে তমশা ছড়ায় সবেগে। নিরেট আস্তরণে ঢাকা পরা হৃদয়টা কী খোলস ছাড়ল তবে?
ফিরতি জবাব এলো না। তবে অনুতাপ দেখা যায় শাফিনদের চেহারায়। একে ওদের করা মস্ত বড় ভুল,সাথে আবার মেয়েটা এইভাবে শাস্তি পেলো? সবার আদল সংকীর্ণ হয় নিমিষে।
তীব্র উঠে দাঁড়াল হঠাৎ। রাহাতের হাত ধরে বলল, ‘ এসো।’
****
লোহার গেটের পাশে একটা সবুজ প্লাস্টিকের চেয়ার পাতানো। হাকিম সেখানে আরাম করে বসে বিড়ি ফুঁকছেন। গলায় গুনগুন গান। ঠোঁটের ভাঁজে ধরতে ধরতে, মনে হলো কেউ একজন দাঁড়িয়েছে এসে। ঘাড় ফেরালেন তিনি। মোটা শিকের ওপাশে বখাটে বিট্টু মাস্তান দাঁড়িয়ে। টানটান বক্ষঃস্থলে,সাদা অক্ষিকূট ওনাকেই দেখছে। সহসা উঠে দাঁড়ালেন হাকিম। বিড়ি ফেলে, সেই হাত ঠেকালেন কপালে।
‘ সালাম বিট্টু ভাই!’
তীব্রর দূর্বোধ্য মতিগতি। শুধু চিবুকের একধার তর্জনীর নখে চুল্কে বলল, ‘ কথা আছে। এদিকে আয়।’
তার কণ্ঠ তরঙ্গের ন্যায়। যৎসামান্যতেই, ঘাবড়ে গেলেন হাকিম। চোরা-মনে স্বশব্দে বাজল কীর্তি-কলাপের টুংটাং বাদ্য।
পুষ্পিতা আর বিট্টুকে জড়িয়ে দুদিন পূর্বে যে কথাবার্তা ছড়িয়েছে,সেসব কী ওর কানে চলে গেল? জেনে যায়নি তো উনিই মূলহোতা এসবের? সে গিয়ে মামুনের কানে কথা না দিলে,এমন কিছুই হোতো না হয়ত। যদি জেনে থাকে? স*র্বনাশ! তবে যে….
হাকিম এরচেয়ে বেশি ভাবতে পারলেন না। ঢোক গি*লতে গি*লতে,কেচি গেট খুলে তীব্রর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তখনই চোখ গেল, বাউন্ডারি ঘেঁষে থাকা,মিরাজ,শাফিন মুশফিকের সঙ্গে চেনা-জানা রাহাতকে। বক্ষ ধ্বক করে উঠল ওমনি।
এইবার যা বোঝার বুঝে গিয়েছেন। বদমাশ পিচ্চিটা নির্ঘাত গিয়ে নালিশ ঠুকেছে বিট্টুর কাছে। ঠুকবেইত,দুলাভাই লাগেনা? হাকিম মনে মনে ক্ষেপে গেলেন রাহাতের ওপর। ইচ্ছে করল,একটা কষিয়ে থা*প্পড় মে*রে,ওর ফোলা গাল থেকে র*ক্ত বের করতে।
পরমুহূর্তে চিন্তায় পড়লেন নিজেকে নিয়ে। এইবার কী হবে? বিট্টু মাস্তান তো আর ভালো কথা বলতে আসেনি।
হাকিমের চওড়া কপাল দরদর করে ঘামছে। সংকীর্ণ চোখে তীব্রর দিক চাইলেন। সে খুব শান্তভাবে দাঁড়িয়ে। আদলে লেশমাত্র উদ্বেগ নেই। ওমন শান্ত গলাতেই, মিরাজকে বলল,
‘ বিল্ডিংয়ের সব কটা ফ্লাটে যাবি,সবাইকে ডেকে নিয়ে আসবি এখানে। পাঁচ মিনিট সময়, যা।’
ও ঘাড় দোলাল। স্বতঃস্ফূর্ত ভঙিতে ঢুকল বাড়ির ভেতর। হাকিমকে দেখে দেখে, যেতে যেতে দুদিকে মাথা নেড়ে হাসল।
বিট্টু মাস্তানের সাথে সাথে তার গ্যাং-ও পরিচিত। সু-কু যে কোনও এক ভাবে এলাকার সকলে ওদের এক দেখায় চেনে,জানে। বিশেষ করে যারা পুরোনো। মিরাজের এক ডাকে যে, যেভাবে ছিল হূলস্থূল বাঁধিয়ে নেমে এলেন। এমনকি খোরশেদুলরাও আছেন। গ্রাউন্ডফ্লোর মুহুর্তে ভরে গেল মানুষে।
খোরশেদুলের পড়নে এখনও নতুন পাঞ্জাবি। মেয়ে-জামাই নিয়ে বৌভাত থেকে ফিরেছেন কেবল। এইত,মিথিলা-পলাশ দুজনেই আছে। মেয়েটা একহাত গুটিয়ে গিয়েছে ডরে। নাহিদের সূত্রে এদেরকে ও চেনে। সামনাসামনি প্রথম হলেও, দলবলের ছবি দেখেছিল। আবার আলেয়ার মুখে, ওইদিন ভোরের সব ঘটনাও শুনেছে।
পুষ্পিতা-বিট্টু দুজনকে জড়িয়ে যে কূৎসা রটেছে,নির্ঘাত সে নিয়েই কিছু করতে এসছে মাস্তানটা। ও গড! এই ভেজালে এখন ও না ফাঁসলেই হলো।
সালমা বেগমের হুট করে জ্বর এসেছে। একেবারে হাড়-হিম করা জ্বর। বিছানা রেখে উঠতে না পারার ন্যায় দশা। গত দুদিন ধরে একটা দানাও দাঁতে ঠিকঠাক কাটেননি যে । কেঁদে-কেটে আরো দূর্বল হয়ে পড়েছেন। মেয়ের শ্বশুর বাড়িতেও যেতে পারেননি।
বলহীন দেহ বিছানায় মিশে থাকায়,খোরশেদুল নেমে আসার সময় স্ত্রীকে আর ডাকলেন না। বিশেষ করে যখন মিরাজ, দরজায় কড়া নেড়ে জানাল, ‘ নীচে বিট্টু ডাকছে,সবাইকে। ‘
এরপরে তো এখানে ওনাকে আনার ভুল করবেনই না তিনি। সালমা, পুষ্পিতার শোকে আধমরা হলেও,ওদের মিথ্যে সম্পর্ক নিয়ে, ভেতর ভেতর একটু হলেও বিশ্বাস করেছেন তিনি জানেন। কোনও মেয়ে এমনি এমনি এক ছেলের শার্ট পরে আসবে না। তাও পুষ্পিতার মত মেয়ে! আর এই বিশ্বাস কোনও ভাবে ভে*ঙে যাক,খোরশেদুল চান না। এত বেগ পোহানোর পর ঝামেলাটা ঘাড় থেকে নেমেছে,ওটাকে দ্বিতীয় বার তোলার মানে নেই।
আলেয়া,মহিদুল সাহেব আর দু চারজন আত্মীয় ব্যাতীত বিশেষ কেউ নেই এখন। বাকীরা বৌভাত শেষ করে, ফিরে গিয়েছেন। তীব্রকে দেখতেই চিবুকের পেশী টানটান করলেন খোরশেদুল। কী মাস্তানি করতে এসেছে কে জানে! হঠাৎ চোখ গেল শাফিনের কাছে দাঁড়ানো রাহাতের দিক। বিমূর্ত দৃষ্টি ঝাপটালেন উনি। তার ছেলে এই বেয়াদব গুলোর কাছে কী করছে? তিনি মোটা গলায় ডাক ছুড়লেন,
‘ রাহাত! এদিকে এসো।’
রাহাত ভয় পেলো। মুখ শুকিয়ে গেল বাবার কড়া দৃষ্টিতে। একবার তীব্রর দিক দেখল। সে ইশারায় বোঝাল, ‘ যাও।’
রাহাত মাথা নামিয়ে,গুটিগুটি পায়ে গিয়ে বাবার পাশে দাঁড়ায়। মুহুর্তে ছেলের দুবাহু চেপে ধরলেন তিনি। ধমকে বললেন, ‘ ওদের কাছে কী করছিলে?’
রাহাত হা করার আগেই,শাফিন সমগ্র গেট টান মে*রে এক পাশে নিয়ে গেল। শব্দে, থেমে চকিতে চাইল দুজন। এবার পুরোদস্তুর খোলামেলা হলো জায়গাটা। এত গুলো মানুষের উপস্থিতি, অথচ কোনও রূপ টা-টু শব্দ নেই।
আলেয়া বানু ছেলেকে ফিসফিস করে শুধোলেন,
‘ এরা ক্যারা খোরশেদ?’
তিনি জবাব দিলেন না। বিভ্রান্ত,প্রশ্নবিদ্ধ চাউনীতে বাকীদের ন্যায় চেয়ে থাকলেন চারজন তাগড়া যুবকের পানে।
মামুন শাহ তীব্র এসেছে শুনেই নেতিয়ে গেছেন। এখন সামনে দাঁড়িয়ে আরো বাজে অবস্থা ওনার। কেন যে গিন্নীর কথায় করতে গেলেন ওসব! কী খেলা দেখবেন কে জানে! তিনি দোয়া-দরুদ পড়ে,ত্রস্ত কদমে, তীব্রর কাছে এলেন। দুনিয়ার সকল নম্রতা কণ্ঠে মেখে বললেন,
‘ বিট্টু ভাই,কোনও সমস্যা হয়েছে কী?’
তীব্র হু-হা করল না। সোজাসুজি হুকুম ছুড়ল,’নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়া। ‘
চুপসে গেলেন তিনি। আড়চোখে একবার হাকিমের দিক দেখলেন। তার হাঁটুতে নিরব ভূমিকম্প নেমেছে। কপালে আজ শনি আছে,তা পরিষ্কার।
মামুন টলমল ভঙিতে এসে বউয়ের পাশে দাঁড়ালেন । চাপা,চিন্তিত গলায় বললেন,
‘ বলেছিলাম,যেখানে বিট্টু মাস্তান জড়িত তা নিয়ে ঘাঁটতে যেওনা। এখন দ্যাখো কী হয়!’
ডলি পালটা উদ্বীগ্ন হয়ে বললেন, ‘ আমি কি জানতাম এ ছেলে সব শুনে বাড়িতে চড়াও হতে আসবে? ভেবেছিলাম মেয়েটাকে ফেরত দিয়ে ফিরেও তাকাবে না। আর ওসব শুনে অমন মেয়ে কী বাড়িতে রাখা যায় তুমিই বলো!’
মামুন হতাশ ভঙিতে মাথা নাড়লেন। একটা ছোট বিষয় পেলেও,ডলি যে তাল বানিয়ে ফেলেন এসব তার জানা। কিন্তু এখন কী হবে? শেষ মেষ বিপদে পড়বেন নিজেই।
হাকিমের দেহ নড়বড়ে। তান্ডব চলছে বুকেও। নিজের চিন্তায় ওষ্ঠাগতপ্রাণ। আচমকা কাঁধে শক্ত কিছুর পতন পেতেই কেঁ*পে উঠলেন। তীব্র হাত রেখেছে। হাকিমের ভয়া*র্ত চাউনী প্রকট হলো এবার। তুঁতলে বললেন,
‘ ববববিট্টু ভাই,আমি,আমি কী কিছু করেছি?’
তীব্র সেই উত্তর দিলো না। নিজের মত রাহাতের দিক আঙুল তাক করে শুধাল,
‘ ওর বোন,পুষ্পিতা,চিনিস তাকে?’
হাকিম সহ আরো একটি বক্ষ ধুকপুক করে কাঁ*পে। যা ভয় পেয়েছিল তাই হচ্ছে। মিথিলা চোরা নজরে পলাশের দিক দেখল। তার কপালে গাঢ় ভাঁজ। এখানে কী ঘটছে আগামাথা বুঝতে না পারার চিহ্ন।
মিথিলা কব্জি দিয়ে নাকের ঘাম মোছে। নতুন বরের সামনে কেঁচো খুড়*তে সাপ না বের হয়!
হাকিম ঢোক গিললেন। নীরব দেখে তীব্র ভ্রু নাঁচাল,
‘ চিনিস?’
ভ*য়ে ভ*য়ে মাথা দোলালেন উনি।
‘ ও যে গত পরশু রাতে আমার সাথে ছিল,তোকে কে বলেছে?’
‘ ককেউ ববলেনি।’
তীব্র চোখ ছোট করল,
‘ আজব! কেউ বলল না, তাহলে তুই বুঝলি কী করে?’
হাকিমের কণ্ঠরোধ হয়ে আসছে। কোনও রকমে বললেন,
‘ আপনার, আপনার গাড়ি থেকে নামতে দেখেছিলাম সকালে।’
তীব্র অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল, ‘ তাই? এতেই বুঝেছিস? মানে আন্দাজ করেছিলি, এইত?’
হাকিম দিশাহীন কী করবেন,কী বলবেন সে নিয়ে। মিথ্যে বলেও পার পাবেন না। তীব্র নিশ্চয়ই আঁটঘাট বেধেই ধরেছে তাকে। এবারেও আ*তঙ্কে,মন্থর বেগে মাথা ঝাঁকালেন তিনি। তীব্র কাঁধের হাতটা নামাল। শাফিনকে বলল,
‘ শাফিন,মানুষ আন্দাজ করে কোথা দিয়ে?’
সে ফটাফট বলল, ‘ মাথা দিয়ে।’
‘ তাহলে তো ওর মাথায় অনেক বুদ্ধি! এই বুদ্ধির জন্যে ওকে একটা পুরষ্কার দেওয়া উচিত না?’
তিনজন প্রফুল্লতায় আওড়াল,
‘ অবশ্যই। ‘
অথচ আতঙ্কে কাঠ হয়ে এলেন হাকিম। পুরষ্কারের নামে নির্ঘাত ভোগ আছে কপালে। তীব্র বলল,
‘ উম,পুরষ্কার দিলে এই কটা লোকের সামনে কেন দেব? এক কাজ কর, আশেপাশের যত লোকজন,সব ডেকে আন। এই বুদ্ধির তারিফ করা তাদেরও কর্তব্য! ‘
মুশফিক-মিরাজ ঠোঁট চেপে হেসে ছুটে গেল। হাকিম ধড়ফড় করে বলতে গেল,
‘ ভাই আমি আর…
আ*গুন চোখে চাইল তীব্র। ওখানেই আটকে গেলেন তিনি। চাউনীতে ঝলসে দেওয়া ভ*য়ানক দাবানল দেখে একটা বাক্য উচ্চারণেরও স্পর্ধা পেলেন না।
মিরাজ, মুশফিক ফিরে এলো। হাতে জিনিসপত্র আছে। ডাকা-ডাকিতে লোকজন একে একে আসছে। মিনিটে ভিড় বাড়ল সেখান-কার৷ গেটের ওপার-এপারের মাঝমাঝিতে তীব্রদের রেখে,দুপাশে গাদা-গাদি হলো।
হাকিম অদৃশ্য হস্তে কপাল চাপড়াচ্ছেন। আহা*জারি করছেন কৃতকর্মের। কেন গিয়েছিল ওসব বলতে? কী দরকার ছিল আগুন নিয়ে খেলার? তার সুপ্ত হা হুতাশের মধ্যেই আচমকা তীব্র ওনাকে নিজের দিক টেনে ঘোরাল। বাক্যব্যয়-হীন,প্রকান্ড এক থা*প্পড় মা*রল গালে। হতচকিত হাকিম,টাল-মাটাল হয়ে ছিটকে পরলেন নীচে। আঁতকে উঠল সকলে। মামুন চোখ-মুখ খিচে, চেহারা ঢেকে ফেললেন। যেন ঘুষিটা ওনার লেগেছে।
‘ যেই মাথায় এত বুদ্ধি সেই মাথায় চুল বেমানান। এই নাপিত…
স্থূল কণ্ঠের ডাকে ছেলেটি নড়েচড়ে চাইল।
‘ জজি ভাই!’
তীব্র হাকিমের দিক আঙুল তাক করে বলল ,
‘ মাথা ন্যাড়া কর ওর। কুইক!’
হাকিম ছটফট করে পেছনে তাকালেন। বোবা সাহায্য চাইলেন মামুনের নিকট। কিন্তু সে লোকের এক পা আগানোর দুঃসাহস নেই। নাপিত ছেলেটি কমবয়সী! তীব্রর আগেভাগে বলে রাখাতে,মিরাজ-মুশফিক ওকে সেলুন থেকে বগলদাবা করে এনেছে।
হাকিমের দৃষ্টি অস্থির! পেশায় ছোটখাটো হলেও,মাথা ন্যাড়া করার মত অসম্মান তো কাম্য নয়।
এখন বাঁচার একটাই উপায়। মস্তিষ্কে উদয় হয় ছুটে পালানোর চিন্তা। বিধিবাম! উঠতেও পারলেন না,আকষ্মিক দুইপাশ থেকে ঘাড়ের দুইদিক চেপে ধরল শাফিন আর মুশফিক। নড়াচড়া রুদ্ধ করে দিলো মুহুর্তে।
মাথার তালুতে খুরের টান পড়তেই হাকিম ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটে হাসি ফুটল রাহাতের।
পঞ্চাশের অধিক মানুষ দুপাশ ঘিরে। তীব্র পায়ের ওপর পা তুলে পাতানো চেয়ারে বসে। লাইটার দিয়ে দামী সিগারেটের মাথা জ্বালায়। ধোঁয়া ওড়ে,সাথে বাতাসে ওড়ে হাকিমের অসহায়ত্ব। তার অপমানিত হওয়ার ক্রন্দন। অশ্রুজল পীচের রাস্তায় পরে মিশে যায়। প্রত্যেকে মুখ ছোট করে দেখছে সেসব।
এক পাশের চুল কাটতেই তীব্র হাত উঁচিয়ে থামতে বোঝাল। কিছু বলতে হয়নি। মিরাজ নিজ উদ্যোগে, বয়ে আনা জিনিস থেকে কালির দোয়াত তুলল। ছিপি খুলে উপুড় করে ঢেলে দিলো উন্মুক্ত তালুর ওপর। হাকিমকে স্তম্ভিত করে দিয়ে,পরপর সারামুখে লেপ্টে দিলো ধবধবে সাদা চুন। জড়বুদ্ধি হয়ে গেলেন তিনি। চেয়ে থাকলেন নিহ*তের ন্যায়। হাউমাউ করে কেঁ*দে উঠলেন পুনরায়।
তীব্রর ওপর সেই কান্নার প্রভাব পড়ল না। উলটে চোখ বুজে বিশাল শ্বাস টানল সে। কেন যেন মনে হচ্ছে,এই কা*ন্না, পুষ্পিতা মেয়েটির কা*ন্নার কাছে কিছু হবেনা! ওইদিন নিরপরাধ হয়েও,চরিত্রের দোষারোপে সে নিশ্চয়ই আরো বেশি কেঁ*দেছিল? তীব্র বাম হাতে সোনালী চুল টেনে টেনে চোখ মেলল। আদেশ করল,
‘ ছবি তোল ওর।’
অর্ধ মাথা ন্যাড়া, আর মুখ ভর্তি চুনকালী মাখা হাকিমের ফটাফট ছবি ওঠাল মিরাজ। এরূপ সম্মানের আহুতিতে হাকিম তখন বিমূর্ত, বি*ধ্বস্ত।
তীব্রর চিবুক মটমট করে উঠল। বলল,
‘ সামান্য চেহারায় চুনকালি পড়ায় কেঁদে ভাসাচ্ছিস হাকিম! সেখানে আন্দাজ করে একটা মেয়ের চরিত্রে কালি মেখেছিলি। ভাব তবে ,তখন মেয়েটার কেমন লেগেছিল?’
সকলে নিস্তব্ধ রইলেও চোখ-মুখ জ্বলজ্বল করছে রাহাতের। সে খুশিতে হাত তালি দিয়ে উঠল। ত্বরিত হাতদুটো চেপে ধরলেন খোরশেদুল। বাবার চোখ রাঙানো দেখেই নিভে গেলো ছেলেটা।
তীব্র ঝট করে ঘাড় কাত করে চাইল মামুনের দিকে। ওমনি কলিজা লাফিয়ে উঠল ওনার। এইবার নিজের পালা বুঝতেই, ঝড়ের বেগে এসেই ওর পায়ের কাছে বসে পড়লেন। হাহা*কার করে বললেন,
‘ আমি কিছু বলিনি ভাই মেয়েটাকে। যা বলার সব আমার বউ বলেছে। আমি বারণ করেছিলাম শোনেনি। আমাকে ছেড়ে দিন।’
ডলি বেগম দাঁত কটমট করলেন। নিজে বাঁচতে কী সুন্দর তাকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে!
তীব্র বিরক্ত গলায় বলল ,
‘ পা ছাড় শালা! নাহলে এক লা*থিতে মাজা ভে*ঙে দেব।’
মামুন হুমকি শুনলেও,মানেনি। অমন দুহাতের মাঝে তীব্রর এক পা জড়ো করে বসে রইলেন। তীব্র চ সূচক শব্দ করে। বেজায় খারাপ হওয়া মেজাজ নিয়ে বলল,
‘ তুই পা ছাড়বি? ‘
মামুন কেঁদে ফেলেছেন। জোরে জোরে মাথা নেড়ে বললেন,
‘ না ভাই, আপনি মাফ না করলে আমি নড়বও না।’
তীব্রর ত্যাড়া রগটা সক্রিয় হয়ে উঠল। সত্যিই দুরন্ত এক লা*থি মারল। সহসা ঠিকড়ে পড়লেন মামুন। হকচকিয়ে উঠল বাকীরা।
তীব্র ঝুঁকে মামুনের কলার টেনে ধরল। ত্রা*সে জুবুথুবু ডলির দিক দেখল একপল৷ সদর্পে জানাল,
বলল,
‘ মহিলা মানুষ কে আমি কিছু বলিনা। গায়ে হাত দেওয়া তো বিশাল ব্যপার। কিন্তু তোর বউকে একটা শাস্তি না দিলে শান্তি পাব না রে মামুন।
কী দেয়া যায়?
তীব্র বা হাতে থুত্নী ঘষল। নাটক করল ভাবছে। ডলির গলবিল তখন মরুভূমি। আশপাশ চাইছেন ভীত নজরে। যেখানে বিল্ডিংয়ের সবার ওপর তিনি ছু*রি ঘোরান,সেখানে এত ভাড়াটিয়ার সামনে এ কী দূর্দশা আজ!
তীব্র চট করে বুদ্ধি পেয়েছে এমন ভাবে বলল ,
‘ হ্যাঁ। মেয়েটা,মানে পুষ্পিতা, যদি এখানে ফিরে আসে,তবে তোদের একটা ফ্ল্যাটে ওকে মাগনা রেখে দিবি। যাকে বলে বিনামূল্যে! আর ও যতদিন এখানে থাকবে, ওর সমস্ত কাজ করবে তোর বউ। রান্নাবান্না, কাপড় কাঁচা, সব মানে সব। রাজী?’
মামুন চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই বলল,
‘ রাজী, আমি রাজী।’
তীব্র চাইতেই ডলি শুষ্ক চেহারায় মাথা কাত করলেন। মিনমিন করে বললেন,’ আমিও রাজী।’
তীব্র কলার ছাড়ল না,যেন ছুড়ল মামুনকে। রোগা-শোকা লোকটা খানিক পিছিয়ে গেলেন। এদিকে পলাশ হা করে সব দেখছে। একইরকম বিস্মিত আলেয়া বানুও। তীব্রর একেকটা দড় আওয়াজ,নির্ভীক চিত্ত দেখে ভ্রান্ত তারা।
তীব্র চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল। এসে থামল একদম খোরশেদুলের মুখোমুখি। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি নামালেন তিনি। ডানে-বামে এলোমেলো পাতা ফেললেন।
তীব্র ভীষণ চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
‘ তোকে কী করা যায়, বলতো!’
খোরশেদুলের দেহ শক্ত হয়ে গেল। পেশায় একজন উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হয়েও হাঁটুর বয়সী ছেলের মুখে তুই ডাকটা অবিলম্বে হজম হলো না। তিনি চুপ থাকলেও,পাশ থেকে আলেয়া ক্ষে*পে বললেন,
‘ ওই পোলা! তুমি আমার পোলার লগে এমনে কথা কও কোন সাহসে? তুমি জানো হে কেডা? কত নামি-দামি লোকগো লগে আমার পোলার ওটবস তুমি জানো? দুইদিন গো ছোকড়া,এক থাপ্প*ড়ে সিধা বানাই দিমু ক…’
খোরশেদুল চ সূচক শব্দ করলেন। তার মা এখানে থাকেনা। তীব্রর সম্পর্কে জানেওনা কিছু। আর তাই জন্যেই এমন ফটরফটর করছে।
কথার মধ্যেই তীব্র লাল চোখে,সজোরে ধমক দিল,
‘ এই বুড়ি চুপ!
বক্ষ ছ্যাত করে উঠল বৃদ্ধার। আঁতকে উঠলেন একরকম। শীর্ণ বুকে হাত দিয়ে ছেলের ধার ঘেঁষে দাঁড়ালেন। ভীতসন্ত্রস্ত চোখে দেখে গেলেন তীব্রকে।
খোরশেদ জ্বিভে ঠোঁট ভেজালেন। পরিস্থিতি সামলাতে বললেন,
‘ আমি,আমি কী করেছি? তুমি কেন আমাকে…’
পেছন হতে শাফিন পুরু কণ্ঠে শুধরে দিলো,
‘ তুমি না,আপনি। এই এরিয়ায় বিট্টুকে তুমি বলার সাহস কেউ করেনা। ‘
খোরশেদুল বিঘ্ন পেয়ে থামলেন। আমতা-আমতা করে বললেন,
‘ আপনি এভাবে আমাকে কেন দেখছেন বলুন তো? আমিতো কিছুই করিনি। পুষ্পিতা এতকাল আমার বাড়িতেই ছিল তাইনা? আমিই ওকে আশ্রয় দিয়েছি। নিজের টাকায় খাইয়ে-পড়িয়ে বড় করেছি। আপনি হয়ত সবই জেনে গিয়েছেন এতক্ষণে। তাহলে আমি কেন বিনাদোষে সাজা পাব?’
তীব্র এমন ভাব করল যেন কানের এক পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে সব৷ খোরশেদুলকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করে রাহাতকে শুধাল,
‘ রাহাত,তোমার বাবা কিছু করেনি ওইদিন?’
রাহাত নিশ্চুপ ভাবে মাথা নোয়াল। তার চোখ-মুখ সহায়হীন! বাবার দোষ তার সামনে বলার সাহস, এইটুকু বাচ্চার হবেনা তীব্র বুঝল । ফোস করে শ্বাস ঝাড়ল সে। খোরশেদুলের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ তুই কী করেছিস আমি জানি। আ বললে আব্বা বোঝার ক্ষমতা বিট্টুর আছে। এলাকার সকলের হাঁটু কাঁপানোর যোগ্যতা কারো এমনি এমনি হয়না।
শুধু রাহাতের বাপ বলে তোকে কিছু বললাম না। তবে হ্যাঁ, মেয়েটা ফিরবে কী না জানিনা। ধর ফিরল,
আর তখন যদি আমার কানে যায়,তুই আবার কিছু বলেছিস ওকে, সেদিন বিট্টু ভুলে যাবে তুই মানুষ। মনে করবে তুই ফুটবল,আমি রোনালদো,তারপর লাথাতে লাথাতে এ গোল-পোস্ট থেকে ও গোল পোস্টে নিয়ে যাবে তোকে। ঢুকেছে মাথায়?’
এত লোক,আত্মীয় স্বজন,ফ্লাটের পরিচিত-অপরিচিত মানুষ, সর্বপরি ছেলে-মেয়ে আর জামাইয়ের সামনে এমন মানহীনতা কল্পনাও করেননি খোরশেদুল৷ অপ্রত্যাশিত অপমানে কাঁটা হয়ে রইলেন। ভেতর ভেতর ক্ষিপ্ততার অনলে অঙ্গার হলেও টু শব্দ করলেন না।
প্রথম দিনই, সেই চায়ের দোকানে বিট্টু মাস্তানের যে বায়োডেটা পেয়েছিলেন, তাতে চুপ থাকা ছাড়া কিচ্ছু করার নেই। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলের সামনে , ওনার মতো সাধারণ মানুষের ক্ষমতা কী? বাধ্য হয়ে দাঁত চেপে হজম করলেন কথাগুলো।
উত্তরে, ওপর-নীচ মাথা নাড়লেন কেবল।
শ্বশুড়ের এমন অপমানে, পলাশ বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে। পাথর বেশে দাঁড়ানো মিথিলাকে বলল,
‘ আশ্চর্য, এই ছেলে কে? এভাবে তোমার বাবাকে কথা শোনাচ্ছে কেন? দারোয়ানকে ন্যাড়া করে চুল ফেলে মুখে কালি মাখছে। বাড়িওয়ালাকে লাথি মা*রছে। আর কেউ কিছু বলছে না? পুলিশে খবর দাও যাও।’
মিথিলা চাপা কণ্ঠে বলল, ‘ চুপ থাকো। তুমি একে চেনোনা’
তীব্র কপাল কুঁচকে শব্দের উৎস খুঁজতে তাকাল। মিথিলার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই,ভ্রু দুটো একেঁবেঁকে এলো এবার।
কিছু মনে করার চেষ্টা করল। মিথিলা থতমত খেয়ে আগেই চোখ নামিয়েছে। কিন্তু,তীব্র থেমে থাকল না। অনিশ্চিত কণ্ঠে, আঙুল উঁচিয়ে বলল,
‘ তুই নাহিদের গার্লফ্রেন্ড না?’
মিথিলা চমকে উঠল,থমকে গেল৷ চাইল হতভম্ব, গোলাকার চোখে। স্বামী,বাবা সাথে এত মানুষ! এদের মধ্যে গুন্ডাটা বেঁফাস কিছু বললেই সে শেষ! হা করার আগেই, তীব্র শব্দ করে হেসে ফেলল। হাসিটায় মস্তিষ্ক সহ কেঁ*পে উঠল মিথিলার। তাকে বিমুঢ় করে দিয়ে,তীব্র উঁচু কণ্ঠে বলল,
‘ পুষ্পিতাকে আমি চিনতাম না। আগে কখনও দেখিওনি। তবে ওর সাথে যা হয়েছে তার জন্য দ্বায়ী এই মেয়েটা,মিথিলা!
সকলের বি*ক্ষিপ্ত, শশব্যস্ত চাউনীগুলো এসে নিক্ষেপ হলো তীব্রর তর্জনীর ওপর। নিশানায় থাকা মিথিলার মুখ,তত্র ফ্যাকাশে হয়ে আসে। বক্ষস্পন্দন রুদ্ধ ওখানেই। পলাশ আ*র্তনাদ করে বলল,
‘ কী? কী যাতা বলছেন?’
মিরাজ বলল,
‘ যা তা না। এই মিথিলা একটা চূড়ান্ত লোভী মেয়ে। আমাদের বন্ধু নাহিদের সাথে দীর্ঘদিন প্রেম করে,টাকা পয়সা,দামী-দামী গিফট হাতিয়েছে। এই যে এই এলাকায় এসেওছিল ওর কাছাকাছি থাকবে বলে। কিন্তু যেই নাহিদের থেকে ভালো ঘর দিয়ে সমন্ধ এলো, ওমনি ওর সাথে ব্রেক-আপ। ওদিকে আমাদের বন্ধু এর জন্যে কেঁদে*কেটে ম*রছিল। তাই আমরা চাইছিলাম একে তুলে নিয়ে নাহিদের সঙ্গে বিয়ে দিতে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত পুষ্পিতা মেয়েটাকে ভুলে নিয়ে গিয়েছিলাম। আর যখন বুঝলাম, তখন ফেরতও পাঠিয়েছি৷ তাও একেবারে অক্ষত অবস্থায়!
‘ অক্ষত মানে তোরা যা ভাবছিস তাই। যে হারামজাদা এর মধ্যে দ্বিতীয় মানে বের করবি সেটাকে সেখানেই পুঁ*তে ফেলব আমি। তোদের যা বলার হয় এই গোল্ড ডিগারটাকে বল। কিন্তু ওই মেয়ে নির্দোষ, ওকে না।’
তীব্রর কথায় খোরশেদুলের পৃথিবী দুলে ওঠে। স্তব্ধ লোঁচনে মেয়ের পানে চাইলেন। মিথিলার চিবুক তখন গলায়। কুণ্ঠায় মাটিতে মিশে যাওয়ার অবস্থা! পলাশ উষ্মায় থরথর করে উঠল। ওর কনুই চেপে নিজের দিক ফিরিয়ে বলল,’ এসব সত্যি?’
মিথিলা সজল চোখে চাইল। নিষ্পাপ কণ্ঠে, সাফাই দিতে বলল,
‘ আমার কথাটা শোনো…’
তীব্র কানের মধ্যে কনিষ্ঠ আঙুল ঝাড়ে। অনীহ গলায় বন্ধুদের বলে,
‘ এখানে এখন নাটক চলবে। আমাদের কাজ নেই,চল।’
তারপর বাকীদের দিক চেয়ে শুধাল, ‘ আর কেউ কিছু বলবি?’
মামুন শাহ মাথা নাড়লেন সবার আগে। তীব্র সাঙ্গপাঙ্গ সমেত পা বাড়াল। হঠাৎ দাঁড়িয়ে, ফিরে চাইল। আঙুল উঁচিয়ে তর্জন দিলো,
‘ কসম আল্লাহর, আর একবার যদি আমার কানে যায়,আমাকে জড়িয়ে ওই মেয়েকে কেউ কিচ্ছু বলেছিস,সেটার ঠোঁট কে*টে, উলটো করে ঝুলিয়ে রাখব আমি।’
ভীত মানুষ গুলোকে পেছনে ফেলে, হনহনে কদমে বাড়ির আঙিনা ছাড়ল তীব্র। সে যেতেই,
এতক্ষণের শান্ত থাকা পরিবেশ মুহুর্তে সরব হয়ে উঠল। চাপা গুঞ্জন ঝমঝমিয়ে বাজল গীতবিতানের ন্যায়। সবার বক্র চাউনী,ক্রমে ক্রমে মিথিলাতে বর্তাল।কানা-ঘুষা চলল সেদিনের মতোন। ডলি বহ্নিতে ঘি ঢেলে বললেন,
‘ এর মানে আপনার মেয়েই এসবের মূলে? ছি ছি! কী লোভ! কী লোভ! এক ছেলের থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে আরেক ছেলের গলায় ঝুলে পড়া? তাও আবার গুন্ডা ছেলের সাথে প্রেম? আর কী কী করেছে কে জানে! শুধু শুধু পুষ্পিতা মেয়েটিকে কথা শোনালাম ওইদিন।’
খোরশেদুল বাকরুদ্ধ। মাথায় অনাকাঙ্ক্ষিত বাঁজ পড়ার তোপে দৃঢ়ীভূত তিনি। আলেয়ার মুখ বন্ধ। নিজের নাতনীর কীর্তিকলাপের বিরুদ্ধে কী বলবেন!
ডলি বেগমের সাথে আরো কজন গলা মেলালেন। মিথিলার জমিন কাঁপছে। সে কাতর চোখে স্বামীর দিক চাইল। পলাশের কটমটে চাউনী পায়ের জুতোর ওপর। আশেপাশের কথাবার্তা সব স্পষ্ট আসছে কানে। ক্রোধে লাল হয়েছে মোটা নাক।
মিথিলা তার হাবভাব নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগল। ভ*য়ে ভ*য়ে হাতটা ধরতেই,পলাশ স্ফূলিঙ্গের ন্যায় ফুলকি তোলে। একেবারে ঝাড়া মে*রে ছাড়িয়ে নেয় বাহু। মিথিলা বক্ষ থামে,ধড়ফড় করে হৃদয়। কম্পিত কণ্ঠে কিছু বলতে চাইলে আটকে দিলো পলাশ। সবার সামনে মুখের ওপর আঙুল তুলে বলল,
‘ তোমার মত মেয়ের, আমার বাড়িতে কোনও জায়গা নেই। ‘
চলবে।
আজকের পর্ব পুরোটাই তীব্রময়। নায়ক-নায়িকার প্রেম,বিয়ে, দেখা- সাক্ষাৎ নিয়ে যাদের অধিক ব্যস্ততা তারা প্লিজ গল্প শেষ হলে পড়বেন। কারণ,এই গল্পের থিম আলাদা। আর আমি সেভাবেই আগাব।
আমি পাঠকদের কথায় কেন যেন তাড়াহুড়ো করতে পারিনা।