কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১২)
স্বাভাবিকত্বের হাওয়ার মাঝে প্রকৃতির আচমকা বিরুদ্ধাচারণ শঙ্কা ডাকে জন-জীবনে। উত্তপ্ত সূর্যের তেজস্বী রোদের মধ্যে, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলে পিলে শুদ্ধ চমকে উঠতে হয়। কিন্তু এই চমক তার থেকেও দ্বিগুণ ভারী! উপস্থিত পাঁচ যুবকের দৃষ্টিতে পৃথিবী কাঁ*পানো বিস্ময়। ওরা কিংকর্তব্যবিমুঢ়, স্তব্ধ!
মুখে কথা নেই। জ্বিভে ভাষা নেই। না আছে চক্ষুপল্লবের নড়চ-চড়ন। বিমুঢ় নেত্ররা শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল সম্মুখের নিরুত্তাপ পুরুষটির পানে।
তীব্র খুব আরামসে বসে। রৌদ্রজ্জ্বল তাপ অতিকায় ফর্সা মুখে আড়া-আড়ি এসে পড়েছে। বিলাতি নয়ন জ্বলছে আরও! মণি দুটো, রাত-বিরেতে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো চিতার ন্যায়।
তার জোয়ার-ভাটা হীন নদীর মতোন শান্ত আঁখি একভাবে সামনে চেয়ে। দুপাশে বসা বন্ধুদের বিহ্বলতার তোয়াক্কা নেই সেখানে। ওদের উত্তর-দক্ষিণে আলাদা হওয়া ওষ্ঠদ্বয়ের গুরুত্ব নেই কোনও । এই যে নিশ্চল চোখে ওকে দেখছে সবাই,তার ছিঁটেফোঁটা প্রভাব নেই ঐ চেহারায়।
আয়েশের রেশ বাড়াতে,কেবল সামনে দু পা ছড়িয়ে দিল। খুব ধীরুজ গলায় বলল,
“ এভাবে চেয়ে থাকলে আমার চেহারা পালটে যাবে না।”
কথাটায় নড়ে উঠেছে ওরা। হা হওয়া ঠোঁটগুলো বন্ধ হয়েছে। কিন্তু হোচটের পরিমান কাটেনি। মিরাজ,নাহিদ, মুশফিক, আরমান, শাফিন, দৃষ্টিতে তাদের বিভ্রম,বিভ্রান্তি।
তন্মধ্যে, বিলম্বহীন ধাতস্থ হলো শাফিন৷ কেমন কণ্ঠ কেঁ*পে আসে কিছু বলতে যেয়ে৷
“ মজা করছিস?”
তীব্র ঘাড় বাঁকাল।
কপাল কুঁচকে বলল, “ কী নিয়ে?”
বিদ্রুপ করে হাসল শাফিন। কন্ঠে ও বিদ্রুপ,
“ তুই পুস্পিতাকে পছন্দ করিস, এটাও এখন বিশ্বাস করতে হবে আমাদের? যে বিট্টু কোনও দিন মেয়েদের সাথে তুই থেকে তুমি তে আসেনি, সে পছন্দ করে কোনও মেয়েকে?”
তীব্র কপট চিন্তা নিয়ে বলল,
“ তুই বলতে চাইছিস, আমার কোনও ছেলেকে পছন্দ করা উচিত?”
ফিক করে হেসে ফেলল নাহিদ। আওয়াজ কণ্ঠফু*ড়ে চলে এলো বাইরে। শাফিন জ্বল*ন্ত চোখে চায় তার দিক। এমনিতেই মেজাজ প্রচন্ড তেঁতে আছে। তত্র হাসি থামিয়ে ঠোঁটে-ঠোঁট চেপে ধরল নাহিদ। কিন্তু চোখদুটোতে কৌতুকে হাসি স্পষ্ট তখনও।
তীব্র দ্বায় সাড়ানো, ঠান্ডা গলায় বলল,
“ মেয়েদের সাথে তুই তোকারি করি মানে এই নয় যে কোনও দিন বাচ্চাগাচ্চার বাপ হব না। ”
পূর্ণবার ঝটকা খায় সবাই। মিরাজ হা হয়ে বলল,
“ বাচ্চা অবধি চলে গিয়েছিস?”
আরমান অস্থিরতায় বাইক থেকে লাফ দিয়ে নামে। ঝটপট তীব্রর সামনে এসে বলে,
“ তোর পুষ্পিতাকে পছন্দ? তাহলে আমরা যখন জিজ্ঞেস করতাম,তখন যে বলতি, না মেয়ের প্রেমে পড়িনি। অস্বীকার করতি কেন?”
সরু চোখে চাইল তীব্র,
“প্রেমে পড়েছি কখন বললাম?”
ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল ছেলেটা। হতবুদ্ধিভাবে বন্ধুদের দিকে চোখ বোলাল। থেমে থেমে বলল,
“ প্রেমে পড়িসনি?”
“ না।”
মিরাজ বিভ্রান্তিতে হাবুডু*বু খেয়ে বলল,
“ একটু খোলাসা করে বল না ভাই৷ ছোট মাথায় এত প্যাঁচ নেওয়া যায় না!”
তীব্র চোখের ইশারায় ওকে কাছে ডাকে। মিরাজ এগিয়ে আসে চটপট। পাশে বসলে, তীব্র ওর কাঁধ পেঁচিয়ে,গুছিয়ে বলল,
“ মেয়েটাকে ভালো লেগেছে! কেন লেগেছে জানি না। তবে প্রেমে পড়িনি। প্রেমে পড়লে বুক ধুকপুক করে শুনেছি। আমার ওসব হয়নি।”
এরপর নাহিদের দিক চাইল। নিশ্চিত হতে শুধাল,
“ ঠিক বললাম?”
সে অবিলম্বে মাথা ঝাঁকায়।
“ হ্যাঁ। মিথিলার সামনে গেলে করত আমার।”
মুশফিক চ সূচক শব্দ করে বলল,
“ আবার মিথিলা সঙ্গীত শুরু।”
নাহিদ চোখ-নাক কুঁচকে বলে
“ এমন করিস কেন? ওকে তো ভালোবাসি আমি।”
“ চুপ কর ব্যাটা! পরের বউকে ভালোবাসিস শুনলে পাব্লিক ঝাড়ু মার*বে তোর কপালে।”
নাহিদ চুপ করে গেল। ‘পরের বউ’ কথাটা বুকের মধ্যে জন্ম দিলো চিনচিনে এক ব্য*থার। মিথিলা যাই করুক,ওর ভালোবাসা তো মিথ্যে ছিল না। বিয়ে হলেই কী ভালোবাসা ম*রে যায়?
মিরাজ দেখল প্রসঙ্গ ঘুরে যাচ্ছে। বলল,
“ এই তোরা থাম তো। বিট্টু তুই বল ভাই,তারপর কী!”
তীব্র লম্বা শ্বাস টেনে বলল,
“ হঠাৎ করে মনে হয়েছে ওকে পছন্দ হয়েছে। আর যেখানে তীব্র রেজা তালুকদার কোনও দিন এসব মেয়ে-টেয়ে নিয়ে ভাবেইনি, সেখানে হুটহাট কাউকে ভালো লেগে যাওয়া মানে সাংঘাতিক কিছু নয় কী? ”
সে মাথা দোলায়,
“সেতো বটেই।”
মুশফিক মুখ কালো করে বলল,
“ কিন্তু এখন কী হবে বিট্টু! তুইও পছন্দ করলি আর মেয়েও শহর ছেড়ে ভাগল। এখন আবার কী করে খুঁজে পাবি? কলেজে তো আর আসবে না। “
ভারী চিন্তার কথাটা শুনে হেসে ফেলল তীব্র। পরিচ্ছন্ন ঠাট্টার হাসি দেখে
মুশফিকের মাথা আউলে আসে। বুঝতে না পেরে শুধায়,
“ হাসছিস কেন?”
“ তোদের কী মনে হয়,যাকে পছন্দ বললাম,তার কোনও খোঁজ আমি রাখিনা?”
তারপর প্রশ্নবিদ্ধ নজর তাক করল সে। সবাই ঔৎস্যুকে একাকার!
তীব্র তেজী কণ্ঠে জানাল,
“ ওরা গাজীপুর যাওয়ার জন্য যেদিন মাটিতে পা রেখেছে,খবর সবার আগে আমি পেয়েছি।”
এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনছিল শাফিন। বিস্মিত নজরে চাইল এবার। স্তম্ভিত বাকীরা আর্ত*নাদ করে বলল,
“ কী?”
শাফিন অধীর গলায় আওড়াল,
“ তুই আগেই জানতি এ কথা?”
তীব্রর প্রতাপী আওয়াজ,
“ জানতাম। ইভেন ওরা কোন জায়গায় আছে,কত নম্বর ফ্ল্যাট সব জানি। তীব্র রেজা ঘাস খায়না। ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস কাটার ক্ষমতা রাখে।”
নাহিদ অনর্থক আলাপে গেল না৷ আনচানে মনে,সোজাসুজি প্রশ্ন ছু*ড়ল,
“ বিট্টু, একটা কথা বল! তুই কি পুষ্পিতাকে নিয়ে সিরিয়াস?”
এই পর্যায়ে চুপ করে গেল ও। উত্তর জানতে সমান আগ্রহী সকলে। তীব্র সময় নিয়ে বলল,
“ জানিনা।”
উৎসুক চাউনী গুলো এবার কোটরে ছড়ায়। আরমান চোখ পিটপিট করে বলল,
“ জানিস না? তাহলে মেয়েটার এত খোঁজ খবর রাখছিস কেন? নেহাত পছন্দ বলে? সেতো আমরা রাস্তায় একটু সুন্দর মেয়ে দেখলেই পছন্দ করে ফেলি। কিন্তু তু…”
তার কথা মাঝপথে টেনে নিলো মুশফিক। চড়া কণ্ঠে বলল,
“ তুই বাজে কথা বন্ধ কর। আমরা আর বিট্টু এক না।”
তীব্র কিয়ৎক্ষণ, নীচের পো*ড়া ঠোঁট,শুভ্র দাঁতে কাম*ড়ায়। মুহুর্ত পেরিয়ে বলে,
“ কিছু একটা ব্যাপার তো নিশ্চয়ই আছে। সেটা জানার জন্যে, আমাকেও যেতে হবে ওখানে।”
মিরাজ অবাক হয়ে বলল,
“ ওখানে মানে গাজীপুর? তুইও যাবি? গিয়ে কী করবি? মেয়েটাকে সোজা বলে দিবি তুই তাকে পছন্দ করিস?”
তীব্র খানিক দোলাচলে পড়েছে। এ বিষয়ে কোনও রকম অভিজ্ঞতা তার নেই। সংশয়ী কণ্ঠে শুধাল,
“ পছন্দ করার কথা সরাসরি বলা ভালো?”
নাহিদ মাথা নেড়ে বলল,
“ বিট্টু, আমার মনে হয় সেটা ঠিক হবে না। মেয়েটা তো জানে তুই মাস্তান। আবার ওকে তুলেও এনেছিলি। সে কারণ যাই হোক না কেন!
কোনও মাস্তান পছন্দ করে শুনলে মেয়েরা উল্টোপথে দৌড়ে পালায়। কাছে আর আসে না। তাছাড়া মিথিলা যাই হোক তোদের কাছে,ওর পরিবার কিন্তু ভদ্র -সভ্য ছিল। বাবা মন্ত্রণালয়ে চাকরিজীবী! আর সেই পরিবারে মানুষ হওয়া কোনও মেয়ে নিশ্চয়ই মাস্তানি পছন্দ করবে না!”
তেঁতিয়ে উঠল আরমান,
“ এখন কি বিট্টুকে তোর বুদ্ধিতে চলতে হবে?”
নাহিদ থেমে রইলেও, তীব্রর চাউনী পালটে আসে। বাক্যগুলো তূখোড় ভাবে কড়া নাড়ে মাথায়। একের পর এক স্নায়ুযু*দ্ধের হুটোপুটি চলে ।
একদিকে ঘুরছে নাহিদের কথা। অন্যদিকে চোখে ভাসছে পুষ্পিতার ওকে দেখেই পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য!
সত্যিই তো,মেয়েটার চোখে ও তো মাস্তান। আর এলাকায়- এলাকায় তার যা বাঁধাই করা রেকর্ড, সেও শুনেছে নিশ্চয়ই! তাহলে জোরা-জোরি ছাড়া ওই মেয়ের সান্নিধ্য পাবে কী করে?
মিরাজ ওকে ভাবুক দেখে বলল
“ তাহলে কী করবি, কিছু ঠিক করলি?”
তীব্র একটু চুপ থেকে, ছোট করে বলল,
“ ভাবছি।”
তারপর বসা থেকে উঠে গেল। দু কদম এগিয়ে, দোকানের একদম বাইরে গিয়ে সিগারেট ধরাল। একেকটা ধোঁয়া বাতাসে ছেড়ে ডুব দিলো, গভীর চিন্তার কূয়োতে।
শাফিনের মুখে অমাবস্যা। ঘুটঘুটে অন্ধকারে, হুরহুরে মেঘমালা স্তূপ হয়ে উড়ছে। মুশফিকের তীক্ষ্ণ চোখে, সেই নিরস মুখখানা খুব স্বচ্ছ ভাবে ধরা পড়ে। সে ওপাশ থেকে এসে বসল ওর কাছে। কাঁধে হাত রাখতেই চাইল শাফিন।
ও বলল,
“ তুই মুখে না বললেও, আমি জানি তোর মনে কী চলছে এখন! মেয়েটাকে তোরও পছন্দ,এইত?”
শাফিন চমকেছে। আশ্চর্য হয়েছে। চটপট করে নিজের হয়ে সাফাই দিতে গেলে, মুশফিক শুনল না। আটকে দিয়ে বলল,
“ কিছু বলতে হবে না। বিট্টুর মত তুই অতটাও নিজেকে ঢেকে রাখার ক্ষমতা আয়ত্ব করতে পারিসনি শাফিন। তোর চোখ দেখে মন ঠাওড় করার এইটুকু যোগ্যতা আমাদের আছে।
তবে আমার কী মনে হয় জানিস?বিট্টু হয়ত আরো অাগেই তোর হাবভাব বুঝতে পেরেছে। যাতে তুই আর সামনে না এগোস তাই এইভাবে ও আমাদের সবার সামনে সবটা বলে দিলো। নাহলে ওর যেই ইগো,এত সহজে,একটা মেয়েকে ভালো লাগার স্বীকারোক্তি ও কোনও দিন দিতো না।
( একটু থেমে)
বন্ধু হিসেবে বলছি, আমারও তাই মনে হয়। সব জেনে তোর আর না এগোনোই ভালো। এরকম মেয়ে হাজারটা আসবে-যাবে। কিন্তু বিট্টুর মতো বন্ধু লাখে একটা। সেটা আমার থেকেও তো তোর ভালো জানার কথা। যে বন্ধু কেবল মুখের কথায় হাতে পাঁচ লাখ টাকা বিনাশর্তে ধরিয়ে দিতে পারে,তার বিরোধিতা করা মানে নিজেকে অমানুষ হিসেবে পরিচয় দেওয়া। মাস্তান হই, যাই হই কারো সাথে বেঈমানী করার মত খারাপ হতে চাই না। এই অপরাধ ক্ষমার যোগ্য না রে বন্ধু!”
ফোস করে শ্বাস ফেলে চলে যায় মুশফিক। শাফিন নিরুত্তর বসে ছিল৷ মাথা নামিয়ে নিলো আরও। চেহারায় লেশমাত্র পরিবর্তন আসেনি। শুধু ঢোক গিলে চুপ করে থাকে।
***
এয়ারপোর্টের বাইরে বিরাট ভীড়। একেকজন তাদের প্রিয়জনকে বিদায় জানাতে এসেছে। কেউ হৈহৈ করে ঘুরতে যাচ্ছে বিদেশে৷
কারো চোখে জল,কারো ঠোঁটে হাসি। পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ পৃথক চিন্তায় বাঁচে। আলাদা আলাদা উদ্বেজনায় গতিপথ ধরে তাদের মস্তিষ্কের কোষ।
আজ মিথিলা- পলাশের দেশ ছাড়ার দিন। গন্তব্য কানাডা! সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দেশ, অচেনা এক জায়গা। ধুলো ময়লা-হীন পরিষ্কার ভূমি ।
ওদের দুই পরিবারের সদস্যরাই বিদায় জানাতে এসেছে। সালমা বেগম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁ*দছেন। ভীষণ রকম চেষ্টা করছেন চোখের জল আটকাতে। এবার গেলে পলাশ দেশে ফিরবে আগামী দুই বছর পর। এতগুলো দিন মেয়েকে দেখতে পারবেন না,চাইলেও ছুঁতে পারবেন না বলে হাহা*কার বাঁধ মানছে না নারীটির। ওদিকে খোরশেদুলও ভাসছেন সমান দুঃখে। ভদ্রলোকের চোখ ছলছলে। মেয়েটাকে বড্ড আদরে মানুষ করেছেন। কখনও একটু বকাঝকাও করেননি।
আশ্চর্য হলেও সত্যি, প্রিয়জনদের এত কা*ন্না,এত হা-হুতাশ,মিথিলার হৃদয় ছুঁতে পারে না। অন্তঃপটের চওড়া পৃষ্ঠ ভেদ না করে পাশ কাটিয়ে গত হয় সব। ওর দুচোখে উপচে আসছে খুশি। উত্তেজনায় শরীরের ধমনীগুলোও কাঁ*পছে। একদন্ড তর সইছে না যে! কখন যাবে,কখন দেখবে রঙচঙে ওই দেশ? কখন পাবে একটা বিলাসপ্রিয় জীবন?
প্লেন ছাড়ার সময় ঘোষণা করা হচ্ছে। যাত্রীদের ভেতরে যাওয়ার পালা। মিথিলা শ্বশুর বাড়ির লোকদের সাথে কথা বলে মায়ের কাছে এলো। হেসে হেসে বলল,
“ আসি আম্মু,ভালো থেকো।”
এতক্ষণের চেপে রাখা কা*ন্না দলা পাঁকিয়ে বেরিয়ে এলো সালমার। নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ তিনি, হাউমাউ করে কেঁ*দে উঠলেন। ত্রস্ত দুইহাতে জড়িয়ে ধরলেন মেয়েকে। খোরশেদুল আরেক দিক চেয়ে,চোখ মুছলেন।
মিথিলা মায়ের বুকে বেশিক্ষণ টেকেনি। মিনিট কয়েকেই সরে এলো।
বিদ্বিষ্ট হয়ে বলল,
“ উফ, এমন করে কেঁদো না তো! আর আব্বু তুমিও কাঁদছো কেন? ধুর! দেশ ছেড়ে যাচ্ছি আমি। ম*রে তো যাচ্ছি না ।”
খোরশেদুল জড়ীভূতের ন্যায় চাইলেন মেয়ের দিকে। বুকে আগলে বড় করা মেয়েটা, বাবা- মায়ের কা*ন্নায় বিরক্ত হচ্ছে?
সালমার অবশ্য বিশেষ যায় এলো না। মেয়ের খচ্চরে স্বভাব আয়ত্বে তার। শুধু স্বামীকে দেখলেন একপল। এখনও অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে খোরশেদ। ওনার চোখ-মুখের বিমুঢ়তা দেখে ছোট্ট শ্বাস ফেললেন তিনি।
একমাত্র এসবে মন নেই রাহাতের। সে নিরুৎসাহিত বোনের যাওয়া নিয়ে। বরং স্ফূর্ত মন মেজাজে বিদায় দিতে এসেছে। একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্টের ওপর মটু-পাতলুর কার্টুন আঁকা টিশার্ট পরে, দাঁড়িয়ে মায়ের পাশে।
মিথিলা বাবা-মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করে। পূর্বের ন্যায় বিস্তর হেসে বলে,
“ যাই তাহলে। যখন যা লাগবে আমাকে শুধু জানাবে,পাঠিয়ে দেব।”
সালমা কিছু বললেন না। খোরশেদুল মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“ ভালো থেকো মা। নিজের যত্ন নিও।”
ও মাথা দোলায়,
“ আচ্ছা।”
তারপর চোখের নজর নেমে আসে নীচে। রাহাতের দিক চায় সে। বলে,
“ ভালো থাকিস। ঠিক করে পড়াশুনা করবি। তোর জন্য অনেক চকলেট পাঠাব। আর একটু কম কম খাস। দিন দিন তো আলু হচ্ছিস। এরপর তো গোল আলু হবি।”
রাহাতের হাসিটা ওমনি মুছে গেল। এমনিতেই ও মিথিলাকে পছন্দ করে না । তার দেশ ছাড়া নিয়ে ছোট্ট মাথায় ব্যথাও ছিল না ।
স্বাস্থ্য নিয়ে খোঁচা দেওয়ায়,কোমল মন ফুঁসে উঠল গতিতে। আরো ক্ষে*পে গেল এবার। মিথিলা যেতেই চোখ-নাক কুঁচকে,
বিড়বিড় করল,
“ শাঁকচুন্নিটা, তুই দেশ ছাড়লেই বাঁচি!”
পলাশ তখন ওর পরিবারের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। মিথিলা বিদায় পর্ব শেষ করে এসে দাঁড়াল।
স্ফীত মুখবিবরে,হৃষ্ট চিত্তে বলল,
“ চলো!”
কথা থামিয়ে চাইল পলাশ। মিথিলাকে দেখল পূর্ণ পূর্ণ চোখে। মেয়ের খুশি ধরছে না, উল্লাসিত বদন। পলাশ শ্বাস ফেলে, একপাশে ঠোঁট উঁচু করে হাসে। যেই হাসির পরতে পরতে হয়ত বা কোনও নতুন কিছুর আভাস!
**
গাজীপুরে কদম ফেলার সপ্তাহখানেক ফুরিয়েছে পুষ্পিতার। আজ ওদের অনার্সে ভর্তি হওয়ার দিন। আয়েশা খাতুনের ছুটি নেই, সাথে যেতে পারবেন না। তারওপর নতুন অফিস,কামাই করাও অসম্ভব। তবে সকল বন্দোবস্ত সেড়ে রেখেছেন আগেই।
নুহাদের এই বাসাটা ছোট-খাটো। ড্রয়িং-ডাইনিং এর আলাদা জায়গা নেই। দুটো একত্রে যোগ করে তৈরী। তবে গাজীপুরের এই এলাকায়,এই বিল্ডিংয়েই সবচেয়ে বেশি ভাড়া।
আজকের সকাল বিষণ্ণ ভীষণ! নূহা খাবার টেবিলের ওখানটায় মনমরা হয়ে বসে। কাল রাত থেকেই, তার ঠোঁটের হাসি গায়েব। তার পেছনে,দেয়ালে সেটে এক কোণায় দাঁড়িয়ে পুষ্পিতা। চোখে-মুখের অবস্থা ভালো নয়। একটু পরপর ব্যাকুল ভাবে দেখছে নূহাকে।
আয়েশা অফিসের জন্যে একেবারে তৈরী হয়ে বসার ঘরে এলেন। দুই দিকে দাঁড়ানো দুজনকে একবার করে দেখে, মেয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। ওর সামনে সাদা খাম বাড়িয়ে বললেন,
“ তোমার ভর্তির টাকাটা!”
নূহা নড়ল না। একবার চেয়েও দেখল না সেদিকে। যেমন ছিল বসে রইল অমন।
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আয়েশা। মেয়েটা সেই রাত থেকে মুখ কালো করে আছে। রেগেমেগে খায়নি , কথাও বলছে না।
তার এই অদম্য তেজের কারণ খুব সাধারণ হলেও,নূহার নিকট তা বিরাট কিছু। পুষ্পিতা আর তার ভার্সিটি আলাদা হবে এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না । সেই স্কুল লাইফ থেকে দুজন একসাথে। বসেছেও একই বেঞ্চে। তাহলে এখন দুজনের দুপ্রান্তে ভার্সিটি হলে মানা সম্ভব?
পুষ্পিতা খুব সস্তা একটা ন্যাশনালে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেখানে খরচ অতী সামান্য! ওর এই সিদ্ধান্তের কারণ,যাতে একটা টিউশনি দিয়ে হলেও নিজের পড়ার খরচটুকু চালাতে পারে।
আর ওখানকার পড়াশুনার অবস্থা একেবারেই সচ্ছল নয়। ভালো প্রফেসর,লেকচারার কিছুই নেই। সব রকম খোঁজ আয়েশা নিয়েছেন। জেনে-শুনে নিজের মেয়েকে ওখানে পড়ানোর মত ভুল কোনও মা করে?
তিনি জানেন, পুষ্পিতা এক রকম বাধ্য হয়েই ওখানে ভর্তি হচ্ছে। কিন্তু নূহার সেই বাধ্য-বাধকতা নেই। আর যাই হোক,ওকে অন্তত একটা নামি-দামি ভার্সিটিতে পড়াতে চান আয়েশা।
পড়াশুনার যে কত গুরুত্ব সেটা নিজেকে দিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন নারীটি। আজ যদি গণ্ডমূর্খ হতেন,স্বামী মারা যাওয়ার পর এর-ওর ঘাড়ে বোঝা হতে হোতো। সাথে নানান রকম মুক্ত কটুবাক্য! কিন্তু না,আজকে কেবল মাত্র চাকরিটার জন্যই মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারছেন তিনি। আত্মীয়-স্বজন প্রথম প্রথম বাঁকা কথা শোনালেও, এখন যেন গলে গলে পড়ে।
মেয়ের নিরুত্তর ভাবমূর্তি দেখে আয়েশা চুপচাপ খামটা টেবিলের ওপর রেখে দিলেন। রাগ-ঢাক নিয়ে টু শব্দও করলেন না। মেয়ে অবোধের মত কিছু বললেও বা,স্বায় দিতে হবে? দুনিয়ায় তার সব জেদ মেনে নিলেও এই লেখাপড়া নিয়ে কোনও রকম আদিখ্যেতা দেখাতে পারবেন না তিনি।
পুষ্পিতার শুকনো আদল। ভীষণ রকম ক*ষ্টে দাপাচ্ছে বুক৷ নূহার ভার্সিটি আলাদা হবে ভাবলেও কা*ন্না পেয়ে যাচ্ছে।
অথচ সেই কলেজে বসেই দুজনের কত শত পরিকল্পনা! ভার্সিটিতে এই করবে,সেই করবে…
জীবনের ঐ একটা ঘটনা, আজ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওকে।
পুষ্পিতার বক্ষ ফু*ড়ে দীর্ঘশ্বাস আসে। ব্যর্থতায় মোড়ানো সেই দীর্ঘশ্বাসের প্রতিটি লিপি।
তারওপর নতুন জায়গা। সব কিছু অচেনা,অদেখা। ভার্সিটিতে একটা মানুষকেও তো চেনা নেই। কে কেমন হবে তাও জানে না। সে যে মাত্রার অন্তর্মুখী মেয়ে,কার সাথে মিশবে? কীভাবে মিশবে? কিচ্ছু জানে না।
আয়েশা এবার ওর কাছে এলেন। মাথা নীচু করা মেয়েটাকে দেখলেন সূক্ষ্ম নজরে। ফুলের মত মেদুর মুখমণ্ডলটা দেখলেই প্রখর মায়ায় ভেতরটা উত্থলে আসে ওনার। এই যে দুই বান্ধুবী আলাদা হয়ে যাচ্ছে, এটা কী চান তিনি? চাইতে পারেন?
কিন্তু সেও যে অপারগ এখানে। নূহার ভার্সিটির সেমিস্টার ফি মোটা অঙ্কের। সেখানে পুষ্পিতাকে পড়ানোর সাধ্য তার নেই। একা মানুষের বেতন দিয়ে এত কিছু সম্ভব? তারওপর নূহার বাবার লোন ছিল কিছু। যেগুলো একটু একটু করে প্রতি মাসে বয়ে যাচ্ছেন তিনি।
পরাস্ত শ্বাসটা খুব সন্তর্পণে বক্ষপিঞ্জরে আগলে নিলেন আয়েশা৷ মাঝেমধ্যে, না চাইতেও কঠোর হতে হয়। এর জ্বা*লা যে কত ভ*য়াবহ, যে সম্মুখীন হয়েছে সেই জানে।
আয়েশা একই রকম খাম বাড়ালেন পুষ্পিতার দিকেও। খুব নম্র কণ্ঠে জানালেন,
“ এটা তোমার। ভর্তির চার হাজার টাকাই আছে।”
ওমনি শশব্যস্ত ঘুরে চাইল নূহা। আশ্চর্য তার চাউনী। এতক্ষণের হাস্যহীন মুখটা ঝলকে উঠল সবেগে।
পুষ্পিতা মুখ তুলল। কোটর ভর্তি অবিশ্বাস নিয়ে একবার খাম দেখল,পরেরবার আয়েশাকে। অনিশ্চিত তার কণ্ঠ,
“ আমার?”
“ হ্যাঁ! তোমার। তুমিওতো ভর্তি হবে আজ। সেখানে টাকা জমা করতে হবে না?”
বিস্ময়ে বিভোর পুষ্পিতা। গোটা বিষয়টা কল্পনারও বাইরে ছিল যে! শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ।
আয়েশা কপাল কুঁচকে বললেন,
“ এমন করে তাকিওনা! অস্বস্তি হচ্ছে। ধরো,অফিসে যাব, না সারাদিন খাম ধরে দাঁড়িয়ে থাকব?”
গত রাত থেকে মায়ের ওপর চড়াও হওয়া অভিমান হুরহুর করে উবে গেল নূহার। ফটাফট, ফূর্ত পায়ে ছুটে এলো সে।
খুশিতে আপ্লুত কণ্ঠে বলল,
“ আম্মু তুমি সত্যিই ওকে ভর্তির টাকা দিচ্ছো?”
মেয়ের দিক চাইলেন আয়েশা। কপালের ভাঁজ মিলিয়েছে। নূহার দু ঠোঁট ভর্তি হাসিটায় ভীমড়ি খেলেন নীরবে। রাত থেকে, এই মেয়েই গোমড়ামুখে বসেছিল কে বলবে!
দুপাশে মাথা নেড়ে বললেন,
“ বিশ্বাস নাহলে খাম খুলে দেখে নাও।”
নুহা বিগলিত হেসে বলল,
“ না না বলেছ ওতেই হবে।”
তারপর বুক ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল সে। চকচকে নেত্রে পুষ্পিতার দিক চাইল। সে তো মনে মনে ভেবেই রেখেছিল ওর ভর্তির অর্থটুকু নিজের জমানো টাকা থেকে দেবে। মা আগেভাগে দেয়ায়,ভালোই হোলো।
পুষ্পিতা তখনও একইরকম চেয়ে। বাকরুদ্ধ সে নড়ছে না,খাম ধরছেনা দেখে, তাড়া দিলেন আয়েশা,
“ কী দেখছো? ধরো।”
পুষ্পিতা মাথা নুইয়ে নিলো এবার। খুব ধীরুজ গলায় বলল,
“ ইয়ে আন্টি,কিছু মনে করবেন না, টাকাটা আমি নিতে পারব না।”
ওনার আগেই নূহা হড়বড়ে ভঙিতে বলল,
“ নিতে পারবি না মানে? কেন পারবি না? হাতে ব্যথা তোর? নয়ত৷ তাহলে সমস্যা কী? টাকা নাহলে ভর্তি হবি কী দিয়ে?”
আয়েশা বললেন, “ আহ থামো।”
তারপর পুষ্পিতাকে বললেন,
“ তুমি কি আমার সাথে ফরমালিটি করছো পুষ্পিতা? তা করা ভালো। কিন্তু এখন তোমার যা পরিস্থিতি তাতে ফরমালিটির সময় এটা নয়। আর যদি ভাবো আমি তোমাকে করুণা করছি তবে বলব তুমি ভুল। আমি তোমাকে সাহায্য করছি মাত্র৷ জীবনে একটু এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা চেনাচ্ছি। কতটা এগিয়ে দিতে পারব জানি না। তবে সর্বচ্চ চেষ্টাটুকু করব। এরপরেও যদি নিতে অস্বস্তি লাগে,তাহলে বলব ধার নাও। যখন নিজের অবস্থা ফিরবে, তখন নাহয় ফেরত দিয়ে দিও।”
পুষ্পিতা গতিতে ওনার বাড়ানো হাত মুঠোতে ধরে বলল,
“ আমায় ভুল বুঝবেন না আন্টি, আমি আসলে বলতে চাইছিলাম, আমার এখন টাকার প্রয়োজন নেই। আমার কাছে যা আছে তা দিয়ে হয়ে যাবে। “
নুহা তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলল,
” তোর কাছে টাকা আছে মানে? কোত্থেকে এলো টাকা? তুইতো সেদিন ঘর থেকে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছিলি। একটা ওড়না অবধি গায়ে ছিল না যেখানে,সেখানে টাকা কি উড়ে উড়ে এলো?”
নূহা রেগে যাচ্ছে। আয়েশা ওকে শান্ত করতে বললেন,
“ উত্তেজিত হোয়ো না। ও কী বলে শুনতে দাও!’’
“ ও কী বলবে? ও কেন টাকা নিচ্ছেনা আমি জানি। ভাবছে আমরা দয়া কর…”
পুষ্পিতা মাঝপথে উদ্বেগ নিয়ে বলল,
“ না না, আমি তা কেন বুঝব? তুই ভুল বুঝছিস আমাকে।”
“ তাহলে টাকা কোথায় পেলি ব…
বলতে বলতে আচমকা ওর চোখ পড়ল পুষ্পিতার হাড় দেখানো গলায়। তৎক্ষনাৎ কথা থামে। চিবুক শক্ত করে বলে,
“ তোর গলার চেইন কোথায় পুষ্পিতা?”
পুষ্পিতা নিশ্চুপ। চিবুক, গলায় নেমেছে। নুহা যা বোঝার বুঝল। রে*গে-মেগে অস্থির হয়ে বলল,
“ তুই আমাকে বেস্টফ্রেন্ড বলিস কেন? আমাকে এভাবে অপমান করবি সেজন্যে? আমার সাহায্য নিবি না। মায়ের শেষ চিহ্ন দেওয়া চেইনটাও বেঁচে আসবি। তাহলে বন্ধু ডাকিস কেন আমাকে?”
পুষ্পিতা ছটফট করে উঠল ওর রাগ থামাতে, নিজের পক্ষে সাফাই দিতে। কিন্তু কী বলবে, কোত্থেকে বলবে, জানেনা।
আয়েশা সমান তাজ্জব হয়ে বললেন,
“ এই কাজ কখন করেছ? তুমিতো বাইরেও যেতেনা। কার কাছে বিক্রি করলে?”
পুষ্পিতা বেশ কয়েকবার শুষ্ক ঠোঁট জ্বিভে ভেজাল। নুহার প্রতিক্রিয়া নিয়ে আতঙ্ক লাগছে।
সময় নিয়ে, থেমে থেমে বলল,
“ উত্তরায় থাকতে করেছি। আপনাদের পাশের বাসার আন্টিটার কাছে।”
হাত তালি দিয়ে উঠল নূহা,
“ বাহ বাহ! খুব ভালো কাজ করেছিস! একেবারে সেরা চেইন বিক্রেতা এওয়ার্ড দেওয়ার মতোন যোগ্য কাজ।”
“ তুই প্লিজ আমার কথাটা শোন।”
ও তেঁতে বলল,
“ একদম চুপ। কিচ্ছু শুনব না আমি। তুই আমার সাথে কোনও দিন কথা বলবি না। আমার নামও নিবি না মুখে।”
পুষ্পিতা কাতর চোখে চায়। ভরে ওঠে তার হরিনী নয়ন।
আয়েশা বললেন,
“ আহ হা! নূহা তুমি অহেতুক রেগে যাচ্ছো কিন্তু।”
“ অহেতুক রেগে যাচ্ছি? সব জেনেও এটা বলবে আম্মু?”
“ হ্যাঁ, বলব। কারন পুষ্পিতার বিষয়টা আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি পারছো না,অবশ্য তোমার পারার কথাও নয়।”
তিনি, পুষ্পিতার আরেকটু কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। ওর দু বাহু ধরে, মৃদূ হেসে বললেন,
“ খুব ছোট থেকে দেখছি তোমাকে। স্বভাবে তুমি অত্যন্ত নরম একটা মেয়ে। কাঁদামাটির মত যাকে আ*চড়ে,খাম*চে নিঃশেষ করা যায়। কিন্তু সেই নরম মেয়েটির ভেতর ভেতর আত্মসম্মান যে এত প্রবল, তা তো জানতাম না!’’
পুষ্পিতা অশ্রুসজল চোখ তোলে।
নুহা হতবাক হয়ে বলল,
“ আম্মু কীসের আত্মসম্মান? তুমিও ওকে স্বায় দিচ্ছো?…”
“ না,স্বায় দিচ্ছি না। তবে এপ্রিসিয়েট করছি ওর নিজেকে সম্মান করার বিষয়টাকে। আসলে এই পথটা আমিও পার কর এসেছি তো নূহা,তাই আমি জানি। তোমার বাবা মারা যাওয়ার পর, আমাকেও কম কিছুর সম্মুখীন হতে হয়নি কিন্তু। কত মানুষ দয়া দেখাতে এসেছিল। তোমার কাকারা, তোমাকে লেখা-পড়া করানোর জন্য নিজেদের বাসায় রাখার কথাও বলেছিলেন আমায়। কিন্তু আমি তাদের প্রস্তাবে রাজী হইনি। কারণ, আমি চাইনি তুমি কারো দান নিয়ে বড় হও। সবার নিকট দানের পাত্রী হয়ে মাথা নিচু করে বাঁচো। নিজে চাকরি নিয়েছি। কষ্ট হলেও তোমাকে শিরদাঁড়া উঁচু করে বাঁচার পথ করে দিচ্ছি।
একটা কথা আমি বিশ্বাস করি জানো,নিজের টাকায় কুড়েঘরে থাকার যে আনন্দ,অন্যের টাকায় বিলাসবহুল কামড়াতে থাকার মধ্যেও তা নেই।
পুষ্পিতা আমি তোমাকে সাপোর্ট করছি। এই আত্মসম্মানটা সব সময় বজায় রেখ।
তবে হ্যাঁ, চেইন-টেইন বিক্রি করে নয়। তুমি চাইলে আমি তোমাকে কিছু টিউশনির ব্যবস্থা করে দিতে পারি।”
পুষ্পিতার ব্যগ্র কণ্ঠ,
“ সত্যি আন্টি?”
“ হ্যাঁ। আজকেই ব্যবস্থা করছি দাঁড়াও। আর এবারের মতন টাকা ব্যাগে ভরে নিলাম। যদি কখনও লাগে, চাইতে কিন্তু সঙ্কোচ কোরো না।”
পুষ্পিতা চোখে জল নিয়ে হাসল। পরপর , চট করে আয়েশাকে জড়িয়ে ধরল দুহাতে। ফুঁপিয়ে কেঁ*দে বলল,
“ আমার মণিও আপনার মত ছিল। আমার কিছু না বলতেই কীভাবে যেন সব বুঝে যেতেন।”
কিছু চমকেছেন আয়েশা। হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“ বড় হও মা। অনেক বড় হও জীবনে।”
নুহা ভেঙচি কে*টে মুখ ঘোরাল। থমথমে কণ্ঠে বলল,
” মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁ*দলেই সে গলবে। কিন্তু আমি গলব না।”
ঘরের দিক হাঁটা ধরতেই পুষ্পিতা ওর গলা হা*মলে ধরল পেছন হতে। ঝুলতে ঝুলতে বলল,
“ তোর গলতে হবে না। তুই এমনিতেই আমার আদুরে বরফ।”
***
হঠাৎ রাতের বেলা, তীব্রকে খাবার টেবিলে দেখে সিড়িতেই থমকালেন জামশেদ। দুই আঁখিতে বিভ্রম নিয়ে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। একবার চোখ বোলালেন দেয়ালঘড়ির দিকে। সবে দশটা বাজে এখন। সরকারি ছুটির দিন বলে,তিনিও তাড়াতাড়ি ফিরেছেন। কিন্তু এ ছেলে তো বারোটার আগে ঘরে ঢোকে না। দশটায় তো ভুলেও না। আজ হঠাৎ কী হোলো?
“ দাঁড়িয়ে কেন? খাবারটা কি ওখানেই খাবেন?”
গভীর ধ্যানে থাকা জামশেদ নড়ে উঠলেন সহসা। ছেলের ত্যারা কথায় মেজাজটা চটে গেল। গম্ভীর চেহারায় নেমে এলেন নীচে।
টেবিলের কাছে আসতেই লুৎফা তাড়াহুড়ো করে চেয়ার টেনে দেন। নবাবের ন্যায় বসলেন তিনি। তীব্র মায়ের দিক কপাল কুঁচকে তাকায়
“ ওনার তো হাত আছে। চেয়ারটা নিজেও টেনে নিতে পারতেন। তোমার দিতে হোলো কেন? তুমি ওনার বউ, বেতনভুক্ত চাকর নও কিন্তু ।”
লুৎফা চাপা কন্ঠে বললে,
“ আহ চুপ কর না! ”
ভেতর ভেতর কটমটিয়ে উঠলেন জামশেদ। কিন্তু এই মুহুর্তে তর্ক করে অশান্তি সৃষ্টির বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই বলে, চুপচাপ গিলে নিলেন তেজ।
ভাতে হাত দিতে দিতে একপল তীব্রর দিক চাইলেন। উশখুশের মাত্রা জোড়াল। কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছেন।
তীব্র একবারও ওনাকে দেখেনি। কিন্তু ফটাফট বলে ফেলল,
“ কিছু বলার থাকলে বলুন। মনের মধ্যে কথা চেপে রাখা ঠিক না!”
থতমত খেলেন তিনি । বিস্ময়টুকু ঢেকে রেখে, ভারী কন্ঠে বললেন ,
‘’ আজ কি মনে করে এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলে?”
তীব্র মুখের ওপর জানাল,
“ কোন মদের ক্লাব খোলা ছিল না, তাই যেতে পারিনি।”
ভ*য়ানক রুষ্ট চোখে চাইলেন তিনি। চেঁতে কিছু বলার পূর্বেই তীব্র বলে দিলো,
“ পরের লাইনে এটাইত বলতে চেয়েছিলেন। আপনার কষ্ট কমাতে আমিই বলে দিলাম।”
জামশেদ হতভম্ব। পরপর ক্ষ্যা*পাটে গলায় বললেন,
“ তুমি কী জানো,দিন দিন বেয়াদবির সব সীমা তুমি ছাড়িয়ে যাচ্ছো য?”
তীব্র উদ্বেগহীন জানাল,
“ জানি। নিজের কথা না জানার মত বেকুব কেউ হয়? আমি নিঃসন্দেহে ভীষণ বেয়াদব একটা ছেলে। আসলে ছেলে-মেয়েদের আদব শেখাতে হলে বাবাদের সময় দিতে হয়। আপনি সময় দেননি,তাই আমি বেয়াদব।”
জামশেদ টেবিল থা*পড়ে বললেন,
“ বারবার এক কথা! সময় দিইনি বলেই আজ এই বিশাল এপার্টমেন্টে হেলেদুলে ঢুকতে পারছো। মদ গিলে এসে,এসির মধ্যেও বসে ঝিমোতে পারছো।”
শব্দ করে হেসে উঠল তীব্র। কিছু বলল না,এতেই গায়ে আগু*ন ধরে গেল জামশেদের।
হাসির মধ্যে স্পষ্ট বিদ্রুপের আভাস পেয়েই তেঁতিয়ে এলো মস্তক।
রা*গে গজগজিয়ে খাবার ছেড়ে দাঁড়ালেন। লুৎফা আঁতকে উঠলেন আরেকবার। সব সময় বাবা ছেলের ঠান্ডা তর্কযু*দ্ধে অসহায় হয়ে পড়েন তিনি।
বাবার দেখাদেখি তীব্রও দাঁড়াল আজ। পেছন থেকে ডেকে বলল,
“ পালিয়ে যাচ্ছেন কেন?”
জামশেদ থেমে দাঁড়ায়। চোখ কুঁচকে ঘুরে চেয়ে বলে,
“ পালিয়ে যাচ্ছি, মানে?”
“ প্রতিবার আমার সাথে কথায় না মিললেই খাবার রেখে উঠে যান, এটা একরকম পালিয়ে যাওয়াইতো।”
“ তাহলে কী করা উচিত, তোমার মত অসভ্যের সাথে তর্কে গিয়ে সময় নষ্ট করব?”
তীব্র এবারেও হাসে। ঘাড়টা দুদিকে মটমট করে কাত করে বলে,
“ এই অসভ্যের যে এখন আপনার থেকে একটা জিনিস চাই ড্যাড! আর সেখানে না বলার কোনও সুযোগই আপনার নেই।”
জামশেদ ভ্রান্ত নজরে চেয়ে। অনীহ তার কণ্ঠ,
“ তোমার আবার কী চাই?”
তীব্র গ্লাস উঠিয়ে চুমুক দিলো। দু ঢোকে গলা ভিজিয়ে রেখে দিলো স্থানে। তার অহেতুক সময় কাটানো,আর বাবাকে অপেক্ষা করানোর ফন্দি, বেশ বুঝলেন ভদ্রলোক । দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলেন তাও।
তীব্র আঙুলে ঠোঁট মুছে চায়। চোখ ছোট করে বলে,
“ কী যেন বলছিলাম!”
“ ইয়ার্কি করছো তুমি? কী বলার আছে বলো।”
পুরু কণ্ঠ জামশেদের।
“ আমি এখন থেকে শহরে থাকব কম। গাজীপুরে যাব।”
লুৎফা তড়িঘড়ি করে শুধোলেন,
“ গাজীপুর? ওখানে কেন যাবি?”
জামশেদেরও একই প্রশ্ন,
“ ওখানে কী কাজ?”
“ কাজ তো একটা আছে। আপনাদের বলতে চাইছি না। তবে ভাববেন না,আপনার দরকার পড়লে ডাকবেন,সময় পেলে নিশ্চিয়ই আসব।”
জামশেদ একটু চুপ থেকে বললেন,
“ কী চাওয়ার কথা বললে যেন?”
“ ওখানে একটা ভার্সিটি আছে… উম নামটা,***** ভার্সিটি। সেখানে আমার ঢোকার ব্যবস্থা করে দিন।”
জামশেদ কৌতূহলে ডু*বুডু*বু দশায় স্ত্রীকে দেখে নেন একবার।
“ সেখানে তোমার কী দরকার? নতুন করে এই বয়সে আবার পড়াশুনা করবে না কি?”
তীব্র ফিচেল হেসে বলল,
“ মন্ত্রীদের মুখে এমন কথাবার্তা মানায়? আমি এই বয়সে নিশ্চয়ই পড়তে যাচ্ছি না।”
“ তাহলে?”
“ পড়াতে যাব।”
“ পড়াতে যাবে?”
“ হু, এ্যাজ আ জুনিয়র লেকচারার। আপনি আজ/কালের মধ্যে তার সমস্ত বন্দোবস্ত করে দেবেন।”
জামশেদ অবরুদ্ধ! বিস্ময়াহতের মতন ফ্যালফ্যালে নজরে চেয়েই রইলেন ছেলের দিক। এব্রো-থেব্রো, খাড়া খাড়া সোনালী চুল,এলোমেলো শার্টের কলার,হা করে বেরিয়ে থাকা বক্ষভাগ,কব্জিতে ব্রেসলেট,গলায় রূপোর শিকলের ন্যায় চেইন পড়ুয়া ছেলে হবে লেকচারার? মোড়ের বিখ্যাত বিট্টু মাস্তান, যে কী না নিজেই পাশ করত শিক্ষকদের ভ*য় দেখিয়ে নম্বর আদায় করে, সে ছাত্র-ছাত্রী পড়াবে?
অমন দূর্লভ দৃশ্যটা কল্পনা করেই, খুকখুক করে কেশে উঠলেন জামশেদ। কাশির তোপে রীতিমতো বুকে ব্যথা উঠে গেল। বাম পাশটা চেপে ধরে তৎক্ষনাৎ ধপ করে বসে পড়লেন সোফাতে।
চলবে।