কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(১৯)
লাল রঙের ইটের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টুকরো বিছানো চওড়া একটা রাস্তা৷ পাশ ঘেঁষে তার সূর্যমুখী ফুলের ছোট-খাটো ক্ষেত। উষ্ণ মধ্যাহ্নে,পথের গায়ে যানবাহন সংকট। সবটা জনমানবহীন। একটু আগে এই নিরিবিলি জায়গাতে ওঠা প্রবল দা*ঙ্গার ঝড়, শেষ হয়েছে কেবল৷
রাস্তার এক পাশে পরিচিত সেই কড়কড়ে লাল জিপ সূক্ষ্ম অযত্নে দাঁড়িয়ে। ফ্রন্টের সঙ্গে প্রসস্থ শরীরটা হেলে রয়েছে তীব্র। লম্বা-চওড়া, কান্তিমান যুবকটির শুভ্র ললাটের এক পাশ, গাঢ়ভাবে কে*টেছে। চোখের কোনায় তাজা র*ক্তের দাগ। ফোঁটা ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে কপোলে। অথচ নিরুৎসাহিত,উদ্বেগহীন সে! হলদে রুমালে র*ক্ত মুছতে মুছতে, ঠান্ডা চোখে পায়ের দিকে চাইল একবার। চারজন যুবক বালু ঢালা রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। কারো পা নড়ছেনা,কারো মাথা ফেটেছে। কেউ বা গভীর ভাবে আ*হত। সব তার গায়ের জোর প্রয়োগের ফলাফল। তীব্র হাতের মধ্যাঙ্গুল ঝাড়ল। আঙুলের ডগাটাও কে*টেছে,টনটন করছে কব্জি।
যুবকদের একজন বাকীদের তুলনায় আ*ঘাত পেয়েছে কম। তবে আ*তঙ্কিত নজর তীব্রর ওপর বন্দি। সে নিশ্চিত, সম্মুখের ব্যপ্ত চেহারার ছেলেটির গায়ে অসুরের ন্যায় শক্তি। অথচ বন্ধুরা কী বলে এনেছিল এখানে? কলেজের টিচার, ভোলাভালা দেখতে! জেন্টেলম্যান! দু এক ঘা খেলেই বাপ বাপ বলে পালাবে। অথচ সে এমন এক গুন্ডা পাঠিয়ে দিয়েছে,যে রীতিমতো ঘোল খাওয়ালো ওদের। ভালো ভালো কথা বলে কলেজের সামনে থেকে এখানে আনল,এই ধানের জমির পাশের ভেতরের রাস্তায়। আর তারপর , কথাবার্তা ছাড়াই এমন মা*রতে শুরু করল যে,ওরাই বাপের নাম ভুলে গেছে এখন৷ সে একবার ভী*ত চোখে ধূলোর ওপর পড়ে থাকা হকিস্টিকটাকে দেখল। এটা দিয়ে পেটাতে পেটাতে একেবারে কাম-তামাম করে দিয়েছে ওদের। বাম হাতটায় কী অসহ ব্য*থা! কোনও-দিন আগের মত নাড়াতে পারবে কী না কে জানে! এমন দ*স্যুর মত জোর এ ছেলের গায়ে এলো কী করে?
তীব্র হঠাৎ চাইতেই ছেলেটা চটপট মাথা নামিয়ে নিলো। ও হাসে। বুঝতে পারে তার মনের ভাষা। এই নিরোধ লড়াইয়ে সে নিজেও প্রহৃত। তাতে কী! এসব তার নিকট ভ্রুক্ষেপ করার মতন কোনও ব্যাপারই নয়। ও র*ক্ত চুপচুপে হওয়া রুমালটা আচমকা ছেলেটার মুখের ওপর ছু*ড়ে মারতেই,আঁতকে চাইল সে। ভাবল,হয়ত আবার তে*ড়ে আসছে!
তীব্র শব্দ করে হেসে উঠল এবার। মানুষকে ভ*য় দিতে,ভ*য় পেতে দেখতে তার আনন্দ হয়। এখনও হলো। এসে এক হাটুমুড়ে ওর সামনে বসতেই,গুটিয়ে বসতে চাইল ছেলেটা। পারল না,হাঁটু থেকে পায়ের গোড়ালি অবধি ব্য*থায় বিবশ বলে ।
তীব্র ওর কাছে বসে। ওর মতই বড় বড় চোখ করে শুধায়,
“ ভ*য় পাচ্ছিস আমাকে?”
ছেলেটা বিলম্বে মাথা নাড়ল, পাচ্ছে।
তীব্র তুষ্ট হয়ে বলল,
“ গুড! সব সময় পাবি। কেউ আমাকে ভ*য় পেলে,আমার ভালো লাগে। এঞ্জয় করি। তোকে একটু কম মে*রেছি কেন বলতো?”
ছেলেটা চেয়ে থাকে শঙ্কিত নজরে। তীব্র সুস্থ,না অসুস্থ বিভ্রান্ত সে। মুখটা মাস্কের আড়ালে বিধায়, দেখা যাচ্ছে দুটো বিলাই চোখ। অথচ ক্রোধিত ওই চাউনী যেন শতাধিক ভ*য়ানক!
তীব্র নিজেই বলল,
“ তোর শরীরে বাকীদের তুলনায় মাংস কম। তাই পেটাতে মায়া লেগেছে। আর তখন তুই বললি না,আমি দেয়াল টপকে পালিয়েছি? তাই মনে হলো তোর সাথে আলাপ হওয়া দরকার। আমাকে চিনিস?”
ছেলেটা ঢোক গিলে দুপাশে মাথা নাড়ে।
ও বলল,
“ বিট্টু মাস্তানের নাম শুনেছিস?”
ছেলেটা কয়েকবার মনে মনে আওড়াল। সে গাজীপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকে। মফস্বলে এসেছে কয়েক মাস। চেনেনা বুঝতে পেরে তীব্র নিজেই বলল,
“ কূয়োতে থাকলে সমুদ্রের বাদশাহ’র নাম শুনবি কী করে? নিজের এলাকায় কুকুরও রাজা,আসল রাজা সে,যে অন্য এলাকাতেও নিজের দম দেখানোর ক্ষমতা রাখে। বুঝলি?”
সে মাথা হেলাল। তীব্র উঠে দাঁড়াল। দর্প নিয়ে বলল,
“ একসাথে ছ/সাতজনকে অনেকবার পিটিয়েছি। তোরা দুজন কম নিয়ে এসে আমার সুবিধে করার জন্য থ্যাংক্স!”
ছেলেটা মুখ শুকনো করে মাথা নোয়াল। তারপর মায়া মায়া চোখে তাকালো তার দলবলের দিকে। একেকজন,এমন মা*র খেয়েছে! কী করুণ অবস্থা! তবে,শুধু যে ওরাই খেয়েছে তাও নয়। মে*রেছেও লোকটাকে। কিন্তু, বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। চারজন মিলে সামান্য একজন ওদের কুপোকাত করে ছাড়ল। হাত চেপে ধরলে,পা দিয়ে বুকে লা*থি মে*রেছে। আর তার এমন শক্তি যে, উড়োপাতার মতন ছিটকে গিয়ে পরেছে ওরা। মা*রপিট করল এমন ভাবে, যেন পেশাদার কোন মাস্তান!
তীব্রর মাথার ক্যাপটা ধস্তা-ধস্তিতে ধূলোর ওপর পরে গেছে। সোনালী চুল খাড়া হয়ে আছে। চকচক করছে রোদের আলোয়। তবে তুলে নেওয়ার মত আগ্রহ হলো না। সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে তার। পকেট হাতাল,লাইটার সিগারেট কিচ্ছু নেই দেখে তাকাল ছেলেটার দিক। মোটা গলায় শুধাল,
“ সিগারেট আছে?”
সে ভড়কে গেল,ভ্যাবাচেকা খেল। এতক্ষণ মে*রে-ধরে সিগারেট চাইছে? গোল গোল চোখ দুটো ধাতস্থ হলো দেরীতে। দুদিকে মাথা নেড়ে বোঝাল,
“ না।”
তীব্রর মেজাজ বিগড়ায়। যেন সাথে সিগারেট না থাকা এক দণ্ডনীয় অপরা*ধ। সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রকান্ড লা*থি মা*রল ওর উরুতে। ছেলেটা মৃদু আ*র্তনাদ করে কাত হয়ে পরে যায় মাটিতে । তীব্রর সাংঘা*তিক প্রহা*রে, এমনিতেই অবস্থা খারাপ। সে-ই একটু আস্ত ছিল,বাকীরা তো হিমশিমে দশায়। কিন্তু এই লা*থিতে হাড্ডি নড়ে যাওয়ার জোগাড়।
তীব্র ঘুরে গিয়ে পালের গোদার কাছে দাঁড়াল। ছেলেটা বুক চে*পে ধরে লেপ্টে আছে মাটিতে। তীব্র ঠিক সেখানেই পা দিয়ে চেপে ধরল। বুটের ঘা*য়ে,ছিন্ন স্থানে ফের আঘাতে জোরে-শোরে আর্তনাদ করে উঠল সে।
তীব্র দাঁত পি*ষে পি*ষে বলল,
“ মাদার****র বাচ্চা, বিট্টুর সঙ্গে লাগতে আসার সাহস করিস,কত বড় কলিজা তোদের!
ভালো কথা বলি শোন,
এই কলেজে হাজার হাজার মেয়ে পড়ে। তোরা সব গুলোকে বিরক্ত কর,যা মন চায় বল,কিন্তু ওই যে ওই মেয়ে? ওর দিকে ভুলেও তাকাবি না।
নাহলে আজ বিট্টুর মাস্তানির ট্রেলার দেখালাম,এরপর পুরো সিনেমা দেখাব। ওকে কিছু বলার জন্য হা করতে গেলেও,জ্বিভ খুঁজে পাবি না কিন্তু । মনে থাকবে?”
ছেলেটা আড়ষ্ট ত্রাসে। কাঁপল থরথরিয়ে। তীব্র ওকে উচ্ছিষ্টের ন্যায় পায়ে মাড়িয়ে ছাড়ে। পাশ থেকে হকিস্টিক তুলে নেয় হাতে। ওমনি চারজন ব্য*থা ভুলে তটস্থ, সতর্ক হয়ে গেল। আবার মা*রবে কি?
তীব্র ওদের চারপাশে কুন্ডলীর মত ঘোরে। স্টিক নাড়তে নাড়তে ঘোষণার মত বলে,
“ এখন থেকে ওকে ভাবি ডাকবি। কী ডাকবি?”
তিনজন থতমত গলায় বলল,
“ ভা..ভাবি।”
একজনের উত্তরে দেরি হতেই,তীব্র গোড়ালির ওপর স্টিক দিয়ে বারি মা*রে। সে তৎপর ছিটকে ওঠে যন্ত্র*নায়। ঘন-ঘন আওড়ায়,
“ ভাবি,ভাবি!”
তীব্র মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
“ গুড! যেখানে দেখবি সালাম দিবি। ওকে?”
জবাব এলো ত্রস্ত,
“ জি জি।”
তীব্র সন্তুষ্ট। আশে-পাশটা দেখল একবার সূচালো নেত্রে।
দোকান-পাট সব বন্ধ। কেউ নেই। স্টিক নিয়েই, তড়বড়ে কদমে গিয়ে উঠে বসল জিপে।
অনেকটা দূর এসে হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে মাস্ক খুলল। খাদবিহীন কণ্ঠে গান ধরল,
“ কোন রাখালের ওই ঘর ছাড়া বাঁশিতে,
সবুজের ওই দোল দোল হাসিতে,
মন আমার মিশে গেলে বেশ হয়!
যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়, তবে কেমন হোতো তুমি বলো তো!”
পরপর ফুরফুরে মনে ঠোঁট কা*মড়ে হাসল সে। সকালে পুষ্পিতার সঙ্গে শোনা গান,পুরো অধর কোণায় চলে এসেছে। কী বশীকরণ জানে এই মেয়ে?
তীব্র চোখ বুজল প্রিয় মুখ-খানা অনুভব করতে। বিধিবাম! কাকতালীয় ভাবে স্পটে ভেসে উঠল ভিন্ন কোনও দৃশ্য। সেই শাফিনের এক মেয়ের গা থেকে ওড়না টেনে নেওয়া। মেয়েটি ছলছল নয়নে,অসহায় চেহারায় ফিরে তাকাতেই চমকে গেল তীব্র। ধ্বক করে উঠল তার রুঢ় বক্ষস্থল।
পুষ্পিতা!
তীব্র চট করে ব্রেক কষল। উদিত রঙীন দুনিয়াটা মুহুর্তেই কেমন ঘোলাটে হয়ে আসে।
দোদুল্যমান ভুবনের ন্যায় মস্তিষ্কের সমস্ত কোষ দুলতে থাকে দ্বিগবিদিক।
যেন মনে হচ্ছে সবখানে পুষ্পিতা দাঁড়িয়ে। দিনের পর দিন করিমের দোকানে বসে বন্ধুদের একেকটা উত্যক্ত করা মেয়েগুলো পুষ্পিতার মত দেখতে। ওইত, সেদিন মিরাজ যে মেয়ের মুখে বোতলের পানি ছু*ড়ে মা*রল,সেও যেন পুষ্পিতা! ইস, কী করুণ চাউনী মেয়ের! তীব্রর বুক মু*চড়ে ওঠে। সব মেয়ের মাঝে পুষ্পিতাকে দেখছে কেন?
তক্ষুণি ভেতর থেকে কে যেন চেঁচিয়ে বলল,
“ তীব্র রেজা তালুকদার, এখন বুঝতে পারছো? তোমরা যখন মেয়েদের সঙ্গে এই আচরণ করো,রাস্তাঘাটে যাচ্ছে-তাই বাক্য ছু*ড়ে দাও, কেমন লাগে ওদের? ওরাও কাঁ*দে আড়ালে। ওরাও গ্রাসে সিটিয়ে থাকে। কিন্তু তোমার ক্ষ*মতার ভ*য়ে তারাও সবটা বাধ্য হয়ে সহ্য করে নেয়। ঠিক তোমার ভীতু মেয়ের মতোন। এই ছেলে-গুলোর মতন তাহলে তোমরাও তো অপরাধী তাইনা? ”
তীব্র চড়া গলায় প্রতিবাদ করল,
“ না। আমিতো কোন মেয়েকে আজ অবধি কিছু বলিনি। তাহলে আমি কেন হব?”
সত্তাটা হাসতে হাসতে আওড়াল,
“ অন্যায় যে করে,আর অন্যায় যে সহ্য করে দুজনেই সমান অপরাধী! তুমিত সহ্য নয়,স্বায় দিয়েছো বন্ধুদের। কখনও মানা করোনি, তবে? তোমার এই অপরাধের সীমা কী আছে?”
মাথা এলোমেলো হয়ে গেল তীব্রর। সত্যিইত,সে সব সময় ওদের সাপোর্ট করেছে। বলেছে, তোদের যা ইচ্ছে কর। এইত,একটু আগে এই ছেলে-গুলোকেও বলল না? চাইলেই তো ওদের নিষেধ করতে পারত।
সহসা সত্তাটা বলল,
“ অতীত না ভেবে বর্তমান ভাবো তীব্র। ভবিষ্যতের পাপ রুদ্ধ করো। ইচ্ছে থাকলে, এখনও এসব বন্ধ করতে পারবেনা তুমি?”
তীব্র দ্বিতীয় বার ভেবে সময় ক্ষয় করল না। হুইল ঘুরিয়ে ইউটার্ন নিলো। বাড়ির পথে না এগিয়ে রওনা করল শহরের পথে।
****
পুষ্পিতা ওড়নার মাথা খুঁটে খুঁটে আঙুলে প্যাঁচাচ্ছে । বারবার কুণ্ঠিত,চোরা নজর আড়ভাবে চাইছে নূহার পানে। সে মেয়ে হা করে তাকিয়ে ওর দিক। দুটো পীবর ঠোঁট, দুই মেরুতে।
পুষ্পিতা আই-ঢাই করে বলল,
“ আর কতক্ষণ তাকিয়ে থাকবি?”
নূহার নড়ন-চড়ন নেই। অমন বসে, শুধু বিস্ময়ে একাকার হয়ে বলল,
“ তুই সত্যিই দু-দুটো ছেলেকে থা*প্পড় মে*রে এসেছিস?”
পুষ্পিতা ঠোঁট টিপে মাথা নোয়াল। ওপর নীচ ঝাঁকাল একবার। নূহা বুকে হাত দিয়ে হুতাস করে বলল,
“ আল্লাহ! এ আমি কী শুনলাম? আমার মনে হয়, হার্টে-স্ট্রোক হয়ে যাবে।”
পুষ্পিতা বলল,
“ স্ট্রোক তো মাথায় হয়।”
নূহা সোজা হয়ে বলল,
“ জানি। কিন্তু তোর এই অষ্টমাশ্চর্যের কথা শুনে আমার স্ট্রোক মাথা থেকে নেমে হৃদয়ে এসেছে। যে মেয়ে জীবনে মশা ছাড়া কিছু মা*রেনা,সে দুটো বখাটে ছেলের গালে চ*ড় মে*রে এলো? মানে এটা কী করে সম্ভব, হাউ-হাউ?”
পুষ্পিতা লজ্জা- লজ্জা আননে চুপ করে থাকে। মানস্পটে হানা দিলো, তীব্রর জ্বল-জ্বলে ওই চোখ। কী দূর্জ্ঞেয় ভাষার আস্থা সেখানে! আমি আছি কথাটাতে কত ভরসা! নাহলে ওর সাধ্য কী ছিল কাউকে আ*ঘাত করার?
নূহা বলল,
“ তবে যাই বলিস,তোর স্যার কিন্তু একটা স্যালুট পাওয়ার যোগ্য। আমি এতকাল বলে বলেও তোকে দিয়ে কিচ্ছু করাতে পারিনি। আর উনি দু-দিনেই নরম মেয়েটাকে গরম বানিয়ে ফেলেছে?
নাহ,আজকে আম্মুর কথা মেনে নিলাম। তোর স্যার এখানে আসায় খারাপ হয়নি। পাশে ব্যাচেলর ওঠার রা*গটা পরে গেল। অন্তত কারো দৌলতে কাদামাটির মতন আমার এই বান্ধুবিটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটু হলেও মাথা উঁচাতে শিখেছে।”
পুষ্পিতা মুচকি হাসল। পরপরই চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
“ কিন্তু স্যার তো আমাকে পাঠিয়ে দিলেন,ওনার বিপদ হলে?”
নূহা কিছু বলতে যায়,আচমকা ওদের জানলায় ঢিল ছু*ড়ল কেউ একজন। শব্দে চমকে উঠল দুজনে। নূহার পিঠে লেগে পায়ের কাছে এসে পড়েছে সেটা। ওরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। দলিত-মত্থিত কাগজের টুকরো-টাকে ঝুঁকে হাতে তুলল নূহা। ভাঁজ খুললে একটা ছোট্ট পাথরের টুকরো বেরিয়ে আসে।
ভেতরে এব্রো-থেব্রো হাতে লেখা,
“ প্রেম করবা?”
নূহা দাঁত চেপে ধরল রা*গে। পুষ্পিতা বুঝতে না পেরে বলল,
“ কী হয়েছে?”
কিন্তু উত্তর পেলো না। নূহা ঝড়ের গতিতে গিয়েই জানলার কাছে দাঁড়ায়। বুঝতে বাকী নেই, এসব সেদিনের ওই ছেলে-গুলোর কাজ।
ক্ষেপে বলল,
“ এই হতচ্ছাড়া, অসভ্য গুলো! ঢিল মা*রলি কেন ঘরের মধ্যে?”
জবাব এলো দু সেকেন্ডে,একটা পুরুষ কণ্ঠ জানাল,
“ আরে মেয়েদের মুখে গালি শুনতেও কী সুন্দর লাগে রে! বুকটা ভরে গেল।”
তারপর স্বশব্দে হাসল দুটো স্বর।
নূহা তেলে-বেগুনে জ্ব*লে ওঠে,
“ পা-রা মে*রে, বুক ভরা ছুটিয়ে দেব কুত্তা গুলো। নূহার হাতে একটা চটকানা খেলে একশ দিন কানে শুনবিনা।”
পুষ্পিতা পিছু হতে চাপা কণ্ঠে বলল,
“ আহা, মানুষ জন শুনতে পাবে নূহা।”
ও ধমক দিল,
“ তুই থাম। অজাত গুলো সামনে আয়। জানলা আটকে কথা বলিস কেন?”
কে একজন উত্তর পাঠাল,
“ কেন? সামনে এলে বুঝি চুমু খাবে?”
পুষ্পিতা ঠোঁট চেপে ধরল হাত দিয়ে। চোখ ফুটবল হয়ে গেছে হতভম্বতায়।
নূহা উষ্মায় থরথর করে উঠল।
“ এক কো*পে মাথা কে*টে ফেলব শুয়োরের দল। দাঁড়া আসছি,দেখাব মজা।”
নূহা তেড়ে তুড়ে বাড়ি থেকে বের হতে চাইলেই পুষ্পিতা হাত টেনে ধরল।
“ যাস না। ওরা খারাপ ছেলে!”
“ ছাড় আমাকে। আজ একেক টাকে যে কী করব!”
“ আন্টি আসুক না? তারপর একটা সুরাহা হবে। তুই একা যাস না প্লিজ! ওরা কেমন না কেমন হয়!”
নূহা দমল খানিক। গতবার আয়েশা খাতুন বাড়িওয়ালাকে পাননি। তিনি দেশের বাইরে স্ব-পরিবারে ঘুরতে গিয়েছেন। কিন্তু এই অভদ্র ছেলে-পেলে তো আজ সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে! এখনও যদি স্টেপ না নেয়,তবে একটা যা-তা কান্ড ঘটতে কতক্ষণ?
***
তীব্র টাল-মাটাল কদমে ঘরে ঢুকল। সবকিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বাড্ডায় গিয়ে বন্ধুদের পায়নি। সবগুলো হুটহাট যেন কোথায় গায়েব হয়েছে! কিছু তো জানায়ওনি ওকে। যে কাজে গেল, হলো না যে। পেয়েছে, তার দলের কনিষ্ঠদের। যদিও ওদেরকে কড়া ভাবে মানা করে এসেছে, আজ থেকে এখানে আর কোনও মেয়েকে বিরক্ত করা যাবে না। বিট্টু মাস্তানের বাকী সব কাজ চলবে,কেবল মাত্র ইভটিজিং নয়। তীব্র যখন কথা গুলো বলছিল,করিম শাহ হা করে চেয়েছিলেন। তার দুচোখ ভর্তি অবিশ্বাসের আঁচ,তীব্র স্পষ্ট দেখেছে। ভদ্রলোক হয়ত খুশি হয়েছেন। কিন্তু তীব্র ওনাকে খুশি করতে কিছু করেনি। করেছে কেবল মাত্র বিবেকের দং*শনে,মানবিকতার দহ*নের দগ্ধতা থেকে বাঁচতে৷ অন্য কেউ পুষ্পিতার দিকে নোংরা বাক্য ছো*ড়াতে,তার শরীরটা জ্ব*লে যাচ্ছিল ক্রো*ধে। তাহলে ওরাও তো কারো বোন,কারো প্রিয় মানবী!
তীব্র ভেতরে এসে দেখল নাহিদ গালে হাত দিয়ে বসে আছে। ওকে দেখেই উঠে দাঁড়াল। তীব্রর কা*টা স্থানে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগানো। সে নিজেই লাগিয়েছে। নাহিদ হাহা-কার করে বলল,
“ একী! কী অবস্থা তোর? কী হয়েছে?”
তীব্র ক্লান্ত। উত্তরও দিলো অবসন্ন গলায়,
“ কিছু না।”
“ কিছু না? এরকম কাটল কীভাবে? এক্সিডেন্ট করেছিস?”
তীব্র জবাব দিলো না। বসার ঘরে পাতানো ডিভানে বসে,গ্লাসে পানি ঢেলে নিঃশ্বাস ভরে খেলো। নাহিদ নিজের মত হিসেব কষে৷ ফিসফিস করে সচেতন কণ্ঠে শুধায়,
“ তুই কি আবার মা*রপিট করেছিস? নিশ্চয়ই ওই ছেলেগুলোকে মে*রেছিস, তাইনা?”
তীব্র খুব শীতল চোখে তাকাল। যেই চাউনীতেই উত্তর পরিষ্কার। নাহিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুপাশে মাথা নাড়ে। তীব্র বলল,
“ খাবার দে কিছু।”
সে তাকাল। হতাশ গলায় বলল,
“ ক প্যাকেট বিস্কিট-চানাচুর ছাড়া বাসায় কিছু নেই। নীচে গিয়েছিলাম,খাবার হোটেল সব বন্ধ। যেগুলো খোলা,ওসব তুই খাস না।”
তীব্র বলল,
“ তুই না বাসা থেকে চাল ডাল কী কী এনেছিলি? কিছু একটা রান্না করে ফেল।”
নাহিদ চোখ প্রকট করে বলল,
“ রান্না? আমি তো রান্না জানিনা। ওগুলো তো ভাবি জোর করে ধরিয়ে দিয়েছিল।”
তীব্র রুমের পথে যেতে যেতে বলল,
“ সব ধুয়ে রেডি কর,আসছি আমি।”
নাহিদের কোটর ছেড়ে মনি-দুটো বেরিয়ে আসতে চাইল। বিট্টু করবে রান্না? এটাও সম্ভব? ক্ষুদ্র জীবনে আর কত চমক সইতে হবে তাকে?
***
গোটা বাসা ধোঁয়ায় ভরে গেছে৷ সেই ধোঁয়ার একাংশ গিয়ে আক্রমন করেছে নূহাদের ঘরেও। পুষ্পিতা ওড়না মুখে চেপে কাশতে কাশতে জানলা খুলে দিলো। যখনই দরজায় এলো, দেখল নিসঃহায়ের ন্যায় নাহিদও নাক-মুখ চেপে দাঁড়িয়ে আছে বাইরে।
ওর কৌতূহল হয়। ধোঁয়া আসছেও তাদের ঘর থেকে।
সে মিহি গলায় শুধাল,
“ কোনও সমস্যা হয়েছে ভাইয়া?”
নাহিদ উদ্বীগ্ন। বলতে গেল,
“ বি…”
কথা আটকায়। তীব্রর সাবধানী বাণী মনে পড়ে। পরপর বলতে যায়,
“ ভা…”
আবার আটকাল। তার দূর্বোধ্য, উশখুশে আচরণে,
পুষ্পিতা হতবুদ্ধি ভাবে চেয়ে ।
শেষে জ্বিভে ঠোঁট ভেজাল নাহিদ। বলল,
“ আসলে তোমার স্যার খিচুড়ি রান্না করছেন। এসব তারই ফল। জীবনে রান্নাঘরে ঢোকেনি,আর সে করছে রান্না! ওটাতো ও আমাকেও খাওয়াবে। ভাবো তো একবার,আমার ওপর দিয়ে কী যাবে আজকে?”
নাহিদ দুঃখী দুঃখী চেহারা বানায়। তক্ষুণি ভেতর থেকে তীব্রর চা*পা আর্ত-চিৎকার ভেসে আসে। শোনা মাত্র নাহিদ ছুটে যায় ঘরে। পুষ্পিতা দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না,বিপদের আভাস শুনে, কোনও কিছু না ভেবে,নিজেও গেল দ্রুত৷
তীব্রর আঙুল আগেই কা*টা ছিল। পেয়াজ কা*টতে গিয়ে সেখানেই ছু*রির ধাঁর বসেছে আবার। সমস্ত রান্নাঘর এলোমেলো। ইউটিউবে খিচুড়ির রেসিপি ছেড়ে রাখা। চূলার ওপর কড়াইয়ে পেয়াজ-রসুন সহ পোড়া তেল পরে আছে। একবার বসিয়ে পু*ড়ে ফেলার পর আবার পেয়াজ কা*টছিল ও।
নাহিদ এসেই দেখল হাত থেকে র*ক্ত পড়ছে। হা-হুতাশ করে বলল,
“ হায় হায়, এত র*ক্ত? হাত কা*টল কীভাবে? সাবধানে কাজ করবি না!”
তীব্র নিরুৎসাহিত। বলল,
“ এত রিয়্যাক্ট করার কিছু হয়নি। এমন ছোটখাটো কাটায় বিট…”
আচমকা,নাহিদের পেছনে চোখ যেতেই কথা সেখানেই স্থগিত। পুষ্পিতা শুকনো, ভীত চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে। তীব্র ঝট করে ছু*রি রেখে আঙুলটা চেপে ধরে বলল,
“ উফ,এত ব্য*থা! জ্বলে যাচ্ছে হাতটা।”
নাহিদ প্রথমে বোঝেনি। উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল,
“ ওয়েন্টমেন্ট আনছি দাঁড়া,একটু দাঁড়া।”
সে দৌড়ে গেল আনতে। তীব্র বারবার হাত ঝাড়ছে। তামাটে ওষ্ঠ একটার সঙ্গে আরেকটা চেপে। যেন যন্ত্রণা সওয়ার চেষ্টায়। নাহিদ যেতেই,পুষ্পিতা শশব্যস্ত ওর কাছে এলো। চামড়া ছেড়া গলগলে র*ক্ত দেখেই উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
“ ইয়া আল্লাহ! এতখানি কে*টেছে?”
তীব্র কাত*রানোর ভাণ করে বলল,
“ হ্যাঁ। ভীষণ জ্বা*লা করছে। উফ!’’
পুষ্পিতা র*ক্ত থামাতে ওড়না দিয়ে চে*পে ধরল জায়গায়। তীব্রর মনে হলো হাজার টুকরো বরফ খন্ড ছেড়ে দিয়েছে তার বক্ষপটে।
“ আপনি আসুন স্যার, এদিকে এসে বসুন…”
তীব্র ফটাফট নরম স্বরে অনুনয় করল,
“ আমাকে একটু ধরে নিয়ে যাবে? মাথাটাও ঘুরছে,এরকম কখনও কা*টেনি তো। আমি একদম কাটাছেঁ*ড়া দেখতে পারিনা। র*ক্তও সহ্য হয়না। হিমোফোবিয়া আছে।”
ও দয়া-মায়ায় একশেষ হয়ে বলল,
“ জি জি নিশ্চয়ই।”
ভেতরের সুপ্ত ইতস্ততা ঢেকে,তীব্রর হাত ধরল পুষ্পিতা।
নাহিদ এসে দাঁড়িয়েছে কেবল। তীব্রর কথায় হাত থেকে স্যাভলনের ক্রিমটা,মেঝেতে পরে যেতে নিলো।
পুষ্পিতা তীব্রকে ধরে ধরে রান্নাঘর থেকে বসার ঘরে নিয়ে যায়। সে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে আওড়ায়,
“ বিট্টুর রক্ত সহ্য হয়না? হিমোফোবিয়া আছে?”
তারপর বিরস ভঙিতে ওদের পিছু পিছু এলো। ব্যথিত শ্বাস ফেলল গোপনে। এই বিট্টুটা প্রেমে পড়ে আর কত মিথ্যে বলবে? শুনতে শুনতে তার কানটা না ঝাঝড়া হয়ে যায়!
পুষ্পিতা তীব্রকে চেয়ারে বসিয়েছে। নাহিদকে শুধাল,
“ মলম এনেছেন?”
ও নড়ে উঠল ধ্যান থেকে।
“ হু? হ্যাঁ লাগিয়ে দিচ্ছি।”
তীব্র ওমনি চোখ পাঁকাল। পুষ্পিতার নজর এড়ানো, ইশারায় বোঝাল, ওর কাছে দিতে। কিন্তু সে গর্দভ কিছুতেই বুঝছে না। তীব্র আমতা-আমতা করে বলল,
“ না, তুই, তুই কী করে লাগাবি? তোরও তো কাটাছেঁ*ড়া দেখতে ভয় লাগে তাইনা?”
বলতে বলতে বারবার ওকে ইশারা করছে তীব্র। নাহিদ মাথা চুল্কায়। ভারি মুসিবতে পড়ল তো! বলল,
“ কই,আমার তো…”
তীব্র পথিমধ্যেই কটমট করে বলল,
“ হ্যাঁ তোরই তো। তুই-ই তো ভ*য় পাস। কী পাস না?”
পুষ্পিতা কথাটা শুনে নিজে থেকেই বলল,
“ ও ,তাহলে আপনি আমার কাছে দিন।”
নাহিদের হাত থেকে, লেপন নিয়ে পাশে বসতেই বিজয়ী হাসল তীব্র। ঝটপট নিজে থেকেই বাড়িয়ে দিলো হাতটা। পুষ্পিতা এক হাত রাখল ওর আ*হত হাতের নীচে। যখন প্রযত্নে আগলে,স্বযত্নে আঙুলের মাথাতে উপলেপ লাগায় সে,তীব্র চেয়ে থাকে। খুব নিভৃতে,নিষ্পলকে দেখতে থাকে তার ভীতু মেয়ের সুশ্রী আদল। কী নয়নাভিরাম, হৃদয় জুড়িয়ে দেওয়া মুখ! কী মায়া! এই মুখের দিক চেয়ে থেকেই তো সারাজীবন কাটিয়ে দেয়া যাবে।
এতক্ষণে সবটা পরিষ্কার বুঝেছে নাহিদ। হতচেতনায় রীতি-মতো মাথা ঘুরছে তার।
মনে মনে বলল,
“ বিট্টুরে… এবার দেশসেরা নাটকবাজের এওয়ার্ডটা তুই-ই পাবি!”
চলবে,
একটা কথা বলি,যারা বলেন পুষ্পিতা এত নরম কেন? এত ভীতু কেন?
উত্তর হলো,গল্পের থিমটাই এমন। নিরেট তীব্রর সঙ্গী এক কোমল ফুল। তাছাড়া বাবা-মা ছাড়া অন্যের দ্বারস্থে বড় হলে
অনেকেরই গলার জোর কখনও চড়া হতে পারে না। যাদের পেছনে সাপোর্ট থাকেনা,যাদের হয়ে কথা বলার মানুষ থাকেনা, তাদের সিংহভাগ সাহস দেখাতে পারে না।
সামান্য বাবা-বড় ভাই যাদের নেই,ওদের দিকটাও এমনই হয়।