কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(২৪)
খাবারের সুগন্ধে ম ম করছে বাড়ি-ঘর। পুরো বসত পরিপাটি করে গোছানো। জানলার কোণায় আবার একটা ফুলদানিও রাখা। আর্টিফিশিয়াল জারবেরা দিয়ে ভরতি তা। কড়কড়ে রঙয়ের সোফায় বসে সেসব মনযোগ দিয়ে দেখছে নাহিদ। কখনো ঘরের দেয়াল,দেয়ালের রঙ ,কখনো দেখছে টেবিলে বিছানো পাতলা কাপড়ের নকশা। তার পাশেই তীব্র বসে। এই মুহুর্তে নূহাদের বাসায় নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছে ওরা । নাহিদ সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। শেষে ফিসফিস করল গলা নামিয়ে,
“ তোর শ্বশুর বাড়িটা কিন্তু ভালো! শাশুড়িও বেশ গোছানো মানুষ!”
দর্শনে সৌম্য মুখটা তৎপর গুটিয়ে ফেলল তীব্র। কন্ঠে বিরক্তি এনে বলল,
“ এটা আমার শ্বশুরবাড়ি হবে কেন?”
নাহিদ বুদ্ধিভ্রষ্টের ন্যায় আওড়ায়,
“ তাহলে কার?”
বদমেজাজি ছেলেটা চটে গেল ফের। নাকের ডগায় ভয়াবহ মেজাজ নিয়ে বলল, “ তোর।”
জিভ কা*টল সে। ঘনঘন মাথা নেড়ে বলল,
“ না না,ছি ছি! কী যে বলিস তুই! আমার কেন হবে?”
“ তাহলে আমার হবে কেন? বলদ একটা। এটা কী ভিতু মেয়ের নিজের বাড়ি?”
নাহিদ আরেকবার জ্বিভ কা*টে। দাঁত মেলে বলে,
“ তাই তো। এই সামান্য কথাটা ভুলে গেলাম কী করে? কত্ত বোকা আমি!”
তীব্রর ত্যক্ত-বিরক্ত জবাব,
“ বুঝলি তাহলে।”
অচিরাৎ মুখটা কালো হয় নাহিদের। জ্বিভখানা তেতে এসে বলতে চায়,
“ চালাক হয়ে কী হবে? মিথিলা তো আর ফিরে আসবে না।”
কিন্তু সাহস হলো না। মিথিলার নাম অবধি তার বন্ধুমহলে নেয়া বারণ। কেউ শুনতেই পারে না। বিট্টুর সামনে বললে এখানেই না মারতে শুরু করে। এমনিতেই কাল রাতে শোয়ার সময় বলছিল,
“ অনেকদিন কাউকে পেটাইনি। আঙুল গুলো কেমন নিশপিশ করছে!”
ত্রস্ত ঠিকঠাক হয়ে বসল নাহিদ। না,আর কোনো বাজে কথা বলা যাবে না। দাওয়াতে সে পোলাও-কোরমা খেতে এসেছে। বিট্টু গুণ্ডার কেলানী খেতে নয়!
এদিকে বারবার চারপাশ দেখছে তীব্র। তবে নাহিদের মতো ঘর-বাড়ি নয়। তার চোখের সবটুকু প্রতীক্ষা কোনো মানবীর আশায়। এখানে এসেছে প্রায় দশ মিনিট হবে। অথচ ভিতু মেয়েকে কোথাও দেখেনি । খোঁজার জন্যে একটু শান্তিতে উঁকিও মারতে পারছে না। শিক্ষক সেজে আচ্ছা মুশকিলে পড়ে গেল ছেলেটা। সর্বদা মান-সম্মান ধরে রাখতে তটস্থ থাকতে হয়। একটু এদিক-সেদিক হলেই তো পুরো চাল ঘুরে যাবে।
তীব্র ফোস করে দম ফেলল। যখন সে বাড্ডা ছিল, এমন কোনো দায়বদ্ধতাই ছিল না। ইচ্ছে মাফিক খাওয়া-দাওয়া, মারপিট মাস্তানি কত্ত কী করে বেড়িয়েছে। সেখানে গেলেই তার বাঁধাই করা রেকর্ড শোনা যাবে। আর এখন এক দুটো কথা বলতে গেলেও,হাজারবার ভেবে বলে তীব্র। পাছে না কেউ সন্দেহ করে বসে! কী অদ্ভুত তাই না? নিজের মর্জিতে চলা এক স্বেচ্ছাচারী মানবকে এক লহমায় পালটে ফেলল এক ঊনিশ বছরের তরুণী৷ এই মেয়ে তো কোনো তন্ত্র-মন্ত্র জানা জাদুকরীর চেয়েও সাংঘাতিক। তীব্র একপেশে হাসল। মনে পড়ল পুষ্পিতাকে প্রথম দেখা সেই দিনের কথা। মোমের অল্প আলোতে আশ্চর্য সুন্দর দুটি চোখ যখন তাক হয় তার দিকে? প্রসস্থ বক্ষ দুভাগ করে তারা হৃদয়ে বসে যায়। গুটিশুটি মেরে কাঁপতে থাকা মেয়েটিকে মনে হচ্ছিল সমস্যার জালে জড়িয়ে পড়া এক অচপল হরিণী। কিঙ্কিণীর সুরধ্বনি টলমল করছিল যার নয়ন জোড়ায়। তীব্রর মোহান্ধ বুকে নেচে উঠেছিল স্বয়ং জীবনানন্দ। বলেছিল,
“ সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে।
বলেছে সে, এতদিন কোথায় ছিলেন?
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে
নাটোরের বনলতা সেন।”
ভাবনের রাজ্যে ডুব দিয়ে স্ববশ মানবটি আরো স্থির হয়ে রইল। শক্তপোক্ত পিঠটা বদলি হলো স্টিলের বস্তুতে। তার কিছুক্ষণ বাদেই আয়েশা খাতুন ট্রে ভরতি নাস্তা নিয়ে এলেন । টি-টেবিলে রেখে একটা গ্লাস তুলে এগিয়ে দিলেন তীব্রর দিকে।
কণ্ঠে কোমলতার ঘাটতি নেই,
“ নাও বাবা।”
তীব্র চুপচাপ হাতে নেয়৷ এক পল চেয়ে দেখে সবুজ শরবতের গ্লাস। কদিন টানা বৃষ্টির পর আজ হঠাৎ করেই আগের মতো গরম পড়েছে। সংশয়হীন ভ্যাপসা উষ্ণতার হাত ছুঁয়েছে প্রকৃতি।
তবে নাহিদকে গ্লাস তুলে দেননি আয়েশা। সে নিজেই নিজেরটা নিলো। আর এতেই মনের খটকা গাঢ় হলো তীব্রর। ওকে কি একটু বেশিই তোষামোদ করা হচ্ছে? কেন? শুধু কি পুষ্পিতার স্যার বলে? আচ্ছা, এর ভেতরে অন্য কোনো গল্প নেই তো? এই মহিলা কোনো ভাবে ওকে নিজের মেয়ের জন্য ঠিক করছে না কি? তীব্রর ভাবনার সাথে সাথে শিরদাঁড়াও সটান হয়ে পড়ল। ও গড, নো নো। এমন কুচিন্তা যেন ভুলেও এনার মাথাতে না আসে। ভদ্রতার মুখোশ খুলে বিট্টু মাস্তান বাইরে চলে আসতে খুব বেশি দেরি হবে না তখন। ওপর ওপর দেখানো এই সম্মান, শ্রদ্ধা সব তোল্লায় দিয়ে, অমন নাকাল মাথাটাই বারি মেরে ফাটিয়ে ফেলব তবে। তীব্র চোখ নামাল মেঝেতে৷ তার শুভ্র দাঁত পি*ষে নেয়ার তোপে ক্ষয়ে পড়ার যোগাড়। শ্বেত রঙা আদল হঠাৎই জোয়ারে ফুলকো নদীর মতো দেখাল। আয়েশা নিজের মতো কথা বলায় ব্যস্ত। তিতিবিরক্ত তীব্র সেদিকে মুখ গোঁজ করে চেয়ে রইল শুধু।
**
সফেদ পর্দা সরিয়ে এক পল উঁকি দিলো পুষ্পিতা। তীব্রর ফরসা,ছাটা দাঁড়ির গালের একাংশ দেখেই ত্রস্ত বেগে সরে এলো আবার। বুকের ভেতরটা কেমন করছে! লাফাচ্ছে,ঝাঁপাচ্ছে। কখনো ধুপধাপ করছে অশান্ত পায়ের গতির মতোন৷ এমন হচ্ছে কেন? সব মিলিয়ে ভারি চিন্তায় পড়ে গেল বেচারী। মাথা নুইয়ে রুমের এমাথা-ওমাথা হাঁটল কিছুক্ষণ। নূহা সেই তখন থেকে এসব কাণ্ডকারখানা দেখছিল ওর। ঠোঁট জুড়ে মেয়ের মিটিমিটি হাসি। পুষ্পিতার চোখ পড়তেই পা থামাল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
“ কী ব্যাপার, হাসছিস কেন?”
নূহা পালটা ভ্রু কোঁচকায়,
“ আমার ঠোঁট,আমার ইচ্ছে, আমি হাসছি। তাতে তোর কী?”
পুষ্পিতা ঠোট উল্টাল ওমনি। হতাশের ন্যায় বসে পড়ল পাশে। দুশ্চিন্তায় থৈথৈ হলো গলার স্বর,
“ আমার না, ওখানে যেতে কেমন যেন লাগছে?”
নূহা তত্র এগিয়ে এলো কাছে। আগ্রহভরে বলল,
“ কেমন লাগছে একটু বলতো! উম,
লজ্জা করছে? বুকের মধ্যে ধুকপুক করছে?”
পুষ্পিতা মাথা দোলাতে চেয়েও থেমে গেল। গলা খাঁকারি দিলো প্রথমে। পরপরই কণ্ঠের বেগ বহাল রেখে বলল,
“ না। অস্বস্তি হচ্ছে।”
নূহা আশ্চর্য হয়ে বলল,
“ ওমা,অস্বস্তি হবে কেন?”
পুষ্পিতা চোখ নামায়। ফেলে রাখে নিজের সুন্দর দু জোড়া পায়ের ওপর। কথা বলতে চেয়েও রাঙা অধর গেঁথে রাখে একে-অন্যের পিঠে। গতকাল নূহার বলা একটা কথা এখনও মাথায় ঘুরছে তার। এই যে লাগাতার দপদপ করছে নিউরনে। কোষ-শিরা-উপশিরা সবেতে কেমন ছন্দময় গীত। নিরন্তর আওড়ে চলেছে কেউ,
“ তীব্র স্যার তোর সাথে বাচ্চাকাচ্চার প্ল্যানিংও করে রেখেছে!”
পুষ্পিতা নীরবে-নিভৃতে পুনর্বার হাসফাস করে উঠল। এমন কথা সে ভাবতে চাইছে না। একে বারেই না। শুনতেই তো কী অসম্ভব বাজে লাগছে! কিন্তু তাও, একইরকম শব্দগুলো মনের মধ্যে ছোটাছুটি করছে। উফ,মহাজ্বালা তো!
মেয়েটা আবার উঠে দাঁড়াল। দীঘল ঘন পাপড়ি গুলো এলোমেলো ঝাপটে ঝাপটে এদিক-সেদিক দেখল। নূহার চোরা হাসি প্রগাঢ় হয় এবার। উঠে এসে পাশে দাঁড়ায়। আচমকা কাঁধ দিয়ে ধা*ক্কা মে*রে বলে, “কী ব্যাপার, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এমন ব্লাশ করছিস কেন?”
আকাশ থেকে পড়েছে এমন ভাবে চাইল পুষ্পিতা। সে ব্লাশ করছিল? কই, না তো। উলটে অমন আজেবাজে চিন্তা মাথায় আসায় আই-ঢাই করছিল কুণ্ঠায়। যেন আর কোনো ভাবেই এসব মনে না পড়ে সেসবের প্রয়াস খাটানোকে ব্লাশ বলে না কি! কণ্ঠে তেমন বিস্ময় এনে বলল,
“ তা করব কেন?”
নূহা হাত উঁচিয়ে বলল,
“ থাক। আমাকে না তোর মতো গাধা ভাবিস না! তোর স্যারের সামনে অস্বস্তি হচ্ছে কেন জানিস?”
পুষ্পিতা নিভন্ত দৃষ্টি ব্যগ্র হলো সহসা।
“ কেন?”
নূহার মহাবিজ্ঞের ন্যায় হাবভাব।
“ এটা হচ্ছে প্রেমের প্রথম ধাপ।”
পুষ্পিতা এমন কিছু আশা করেনি। সমস্ত আগ্রহ ফুস করে উবে গিয়ে বিরক্তি ভিড়ল আদলে। চ সূচক শব্দ করে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“ ধুর! যত্তসব বাজে কথা।”
নূহা উদ্বেগ নিয়ে বলল,
“ আরে, বাজে কথা হবে কেন? আচ্ছা একটা ব্যাপার বোঝ, আমার কিন্তু তোর স্যারের সামনে যেতে অস্বস্তি হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? যেখানে হওয়ার কথা একশ ভাগ বেশি। কারণ আমিও তো একটা মেয়ে,উনিও একটা ছেলে। আবার আমার সাথে ওনার বিশেষ পরিচিতিও নেই। কিন্তু তোর সাথে ওনার এতগুলো দিনের জানাশোনা। তাও তোর অস্বস্তি হচ্ছে। কেন? কাল আমার কথাগুলোতেই। তাই না?”
পুষ্পিতা বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে চাইল। নূহার ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। ভ্রু উঁচাতেই মেয়েটা হাঁ করে বলল,
“ কী করে বুঝলি?”
“ আগে বল সেজন্যেই হচ্ছে না?”
ও মাথা ঝাঁকাল।
ওমনি হাত উলটে অন্য হাতের তালুতে বারি মারল নূহা। কণ্ঠে স্ফূর্তি তার,
“ এটাই তো। প্রেমের প্রথম পয়েন্টই তো এটা। প্রথমে অস্বস্তি, তারপর লজ্জা, তারপর বুক কাঁপা, আর তারপর..”
সুর দিয়ে গেয়ে উঠল সে,
“ কে প্রথম কাছে এসেছি!
কে প্রথম চেয়ে দেখেছি!
কিছুতেই পাই না ভেবে,কে প্রথম ভালোবেসেছি। তুমি,না আমি?”
পুষ্পিতা নিজের দুই কান চেপে ধরল এবার।
ঘনঘন মাথা নেড়ে বলল,
“ আসতাগফিরুল্লাহ! এসব বলিস না।
শুনতে খুব বাজে লাগছে!”
নূহার কিচ্ছু যায় এলো না। উলটে আরো কাছে এসে ওর কাঁধ জড়িয়ে দাঁড়াল। হৃষ্ট চিত্তে বলল,
“ মোটেও বাজে লাগছে না! শুনতে মনে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের গীত বাজছে বুঝলি। আচ্ছা একটা ব্যাপার লক্ষ্য কর, তোদের নামে কী দারুণ মিল! তীব্র, পুষ্পিতা। ইকুয়াল টু তীব্রতা। এই
তীব্রতা কিসের? প্রেমের?”
ফের কাঁধে ধাক্কা মারে নূহা। অথচ
তীব্রর পাশে প্রেম শব্দ শুনেই পুষ্পিতা শ্বাস রুদ্ধ হয়ে এল। বক্ষপিঞ্জরের সমস্ত কোষ অবধি শিউরে উঠল দোলাচলে। অবরুদ্ধ মস্তক, সাথে ঝাঁ ঝাঁ করছে কান।
এর মধ্যে ও ঘর হতে হাঁক ছুড়লেন আয়েশা।
“ নূহা,পুষ্পিতা! কোথায় তোমরা?”
মায়ের এক ডাকে সাড়া দিতেই, চটজলদি বেরিয়ে গেল নূহা। ঠায় দাঁড়ানো পুষ্পিতার শরীর ভিজল অপ্রতিভে। নূহাটা ওকে রেখে চলে গেল,এখন ও একা কীভাবে যাবে!
নূহা চঞ্চল পায়ে এসেই মায়ের পাশে বসল। তীব্রকে হাত উঁচিয়ে সালাম দিয়েই নাহিদ কে বলল,
“ কেমন আছেন?”
আচমকা কথার শর ঘুরে আসতেই, ছেলেটা খানিক থতমত খায়। মিনমিন করে বলে,
“ জি, মানে ভালো। আপনি?”
তীব্র এসবে অনীহ হলেও,আয়েশার কণ্ঠে বিস্ময়,
“ তোমরা একে-অপরকে চেনো?”
নূহা সানন্দে বলল,
“ হ্যাঁ আম্মু। প্রথম দিনই ওনার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। জানো,কাল অত বৃষ্টিতে আমি মোড়ের রাস্তায় অনেকক্ষণ আটকে ছিলাম। উনিই আমাকে গাড়িতে করে নিয়ে এসেছিলেন।”
মেয়ের হাসিহাসি মুখখানা লক্ষ্য করলেন আয়েশা। নূহা ভারি বুদ্ধিমতি মেয়ে! ছেলে ছোকড়া নিয়ে গদগদ স্বভাব কোনোকালেই ছিল না। এই ছেলেটির প্রসংশা করছে যখন,তখন এ নিঃসন্দেহে ভালো হবে! ভদ্রমহিলা তাকালেন নাহিদের পানে। বোকা বোকা ছাপ পড়া ছেলেটা মৃদূ হাসল তখন। এতক্ষণে আয়েশা নিজেও মন থেকে হাসলেন। বললেন,
“ বাহ, বেশ ভালো কথা! শুনেও ভালো লাগছে। আসলে এমনই তো হওয়া উচিত। আমরা প্রতিবেশী। আমরাই তো একে-অপরের পাশে দাঁড়াব । কী বলো বাবা?”
তিনি প্রশ্ন করেছেন
তীব্রকে। ছেলের হন্যে চোখের চাউনী রকেট বেগে ফিরে এলো। জবাব দিলো তৎপর,
“ জি।”
অথচ ঠোঁট চেপে হাসল নূহা। সাথে চাউনীতে কঠোর নিরীক্ষা এনে প্রথমবার নিপুণ ভাবে খেয়াল করল তীব্রকে। পায়ে চামড়ার দামী জুতো। চকচক করছে পলিশে। সুবিন্যস্ত বেশভূষা। শুভ্র গায়ে জাম রঙা শার্ট দাগ তুলেছে বড্ড। নাহ,দেখতে শুনতে ভদ্রলোক দারুণ। শুধু মাথার সোনালী চুল গুলো কালো করলে আরো মারাত্মক লাগতো। না করলেও বা! পুষ্পিতার সাথে একেবারে রাজযোটক জুটি হবে এনার৷ নূহা মুচকি মুচকি হাসছিল। আর এতেই সোজা ভ্রু বেঁকে গেল তীব্রর। এই ইঁচড়েপাকা মেয়েটা ওর দিক এমন করে তাকিয়ে আছে কেন? আবার হাসছেও। ভিতু মেয়ে এর বন্ধু হলে কী হবে! স্বভাবে একেবারেই উলটো জাতের৷ এতদিনে যতটুকু দেখেছে,বুঝেছে, এ মেয়ের মুখে ধান দিলেই খই ফোটে । অথচ বয়স দুজনেরই এক। তাও তার ভিতু মেয়ে কত নম্র-ভদ্র! কী আস্তে করে কথা বলে! কত মিষ্টি তার শব্দোচ্চারণ! শুনলে মনে হয় অঝোর ঝর্ণার ধ্বনি৷ কিংবা কাকভোরে দোয়েলের ডাক!
অন্যদিকে নূহার মানস্পটে একটি অষ্টম আশ্চর্যের বস্তু ধরা দিয়েছে। যাতে তার নিজের পিলেই চমকে উঠল। শেরওয়ানি পরুয়া তীব্রর বাহু ঘেঁষে পাশে বসে আছে পুষ্পিতা। একটা টুকটুকে বেনারসী দিয়ে ঘোমটা টেনেছে তালুতে। এই চলমান চিত্রে নূহার চোখ বেরিয়ে আসে প্রায়। এ বাবা, কী সর্বনাশ! এদের বিয়ে হলো কখন? একটু আগেই না পুষ্পিতাকে রুমে রেখে এলো?
নূহাকে আশ্চর্যজনক ভাবে চোখ ঝাপটাতে দেখে শার্টের কলার ঠিকঠাক করল তীব্র। বসল আরো গুছিয়ে। ভীষণ বিপন্ন দশায় ডুব দিয়েছে শরীর। না, এখানে দাওয়াত খেতে আসাটাই ভুল। এই মা-মেয়ের মতিগতি তো একদম সুবিধের লাগছে না। দাওয়াত দিয়ে আলগোছে ঘাড়ে কিছু গছিয়ে না দেয়!
আয়েশা এ যাত্রায় কিছুটা বিরক্ত হলেন। এতবার পুষ্পিতাকে ডাকছেন,মেয়েটা আসছে না কেন? নূহার ঘোর ভা*ঙল মায়ের গম্ভীর স্বরে,
“ কী ব্যাপার? তোমার বন্ধু কই? কতবার ডাকলাম?”
মেয়েটা নড়েচড়ে উঠল। তবে আবার বৃত্তাকার নয়ন মেলে দেখে নিলো তীব্রকে। এই ভর-দুপুরে এমন আজগুবি স্বপ্ন দেখার মানে কী?
পুষ্পিতা নরম পায়ে বেরিয়ে এসেছে। ভেতরটা লজ্জায় কাঠ। কেন এত লজ্জা,কীসের এত অস্বস্তি ও জানে না। শুধু জানে,তীব্রর দিকে চোখ তুলে তাকানোও দুরূহ৷
“ জি আন্টি!”
রিনরিনে কণ্ঠ পেতেই, তীব্রর এত সময়ের হন্তব্য নজরের গন্তব্য মেলে। খুব আলগোছে লাগাম টানে অগোছালো সত্ত্বায়।
আয়েশা বললেন,
“ তোমার স্যার এসছেন তোমার বাড়িতে। আর তুমি কী না ঘরে বসে ছিলে? স্যারের কী লাগে,কী আপ্যায়ণ করতে হয় একটু দেখবে না মেয়ে?”
পুষ্পিতা চোখের কোণা দিয়ে তীব্রকে দেখে নেয়। জ্বিভ ভরতি জড়তার পাহাড় ঠেলে শুধায়,
“ কিছু লাগবে স্যার?”
তীব্র স্বাভাবিক। অথচ তার জন্য একটা মেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছে না। বললও খুব সাবলীল ভঙ্গিতে ,
“ না।”
একটু থেমে বলল,
“ তুমি কি অসুস্থ? আসার পর থেকে দেখিনি যে!”
পুষ্পিতা কী বলবে খুঁজে পেলো না। যুতসই জবাব তার কাছে নেই। আপনার সামনে আসতে লজ্জা করছিল এসব কী বলা যায়? ইস!
এদিকে নূহা বসা থেকে উঠে গিয়ে পাশে দাঁড়ায় ওর৷ সবার দিকে চোখ রেখে, ফিসফিস করল,
“ তোকে কত মিস করেছিল দেখেছিস? আহারে,কীভাবে পারলি সম্মানীয় লোকটাকে এত ক*ষ্ট দিতে?”
নরম মেয়েটা বন্ধুর ওপর নাক ফোলাল তেজে।
“ চুপ করবি?”
নূহা তাও হাসে। হঠাৎ চোখ যায় নাহিদের ওপর। ছেলেটা মুখ ভার করে বসে আছে। ভাবমূর্তি উশখুশে। কিছু বলতে চাইছে বোধ হয়। সে আগ বাড়িয়ে শুধাল,
“ কোনো সমস্যা মিস্টার ঢেঁড়স?”
তার উত্তর আসার পূর্বেই আয়েশার ধম*ক তেড়ে এলো,
“ নূহা,এ আবার কেমন ডাক? উনি তোমার বড়ো না?”
নাহিদের ব্যস্ত স্বর,
“ সমস্যা নেই আন্টি। আমি কিছু মনে করিনি।”
তীব্র থুতনী ঘষল হাতের আঙুলে। বিড়বিড় করল,
“ করে লাভও নেই। পার্ফেক্ট নামই দিয়েছে তোকে।”
ঘনিষ্ঠে বসা নাহিদ শুনে নিয়েছে। মুখখানা কালো করে চাপা কণ্ঠে বলল,
“ ঢেঁড়স কতো উপকারী জানিস? দেখতেও কত সুন্দর!’’
তীব্র হাসল। আগের মতো সাদাটে আড়চোখ ঘুরপাক খেলো পুষ্পিতার ওপর। কেন যেন মেয়েটা ওর দিকে দেখছে না। কেন? কী হলো হঠাৎ? বাই এনি চান্স,এই মেয়ে আবার তার ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে না কি? তীব্রর ক্ষণিকের উদয় হওয়া চিন্তা পরপরই ঝেড়ে ফেলল। ধরে ফেললে ফেলুক,ওরই সুবিধে। তবে এতদিনের কষা অংক খুব সহজে মিলে যাবে। এত ক্যালকুলেটিং করে আগাতে হবে না৷
নূহা চ সূচক শব্দ করে বলল,
“ আহ আম্মু,তুমি এ ব্যাপারে কিছু জানো? জানো না যখন আমার বাকস্বাধীনতায় হাত দেয়াও ঠিক হচ্ছে না। আচ্ছা যাক গে, মিস্টার ঢেঁড়স,আপনি কিছু বলতে চাইছেন মনে হয়!”
নাহিদ একবার তীব্রর দিক তাকায়। চোখমুখে দ্বিধা। আয়েশা অভয় দিয়ে বললেন,
“ এতো কী ভাবছো? কিছু লাগবে তোমার?”
সে বলল,
“ না মানে একটু ওয়াশরুমে যেতাম।”
“ কী আশ্চর্য, এটা বলতে এত মোড়ামুড়ি করছিলেন? আসুন।”
ভারি কণ্ঠে মুখ ঝামটা খেয়ে নাহিদের মন খারাপ হয়। এই পৃথিবীতে সে শুধু ঝাড়ি খেতে এসেছে। বন্ধুরা ঝাড়ে৷ বাবা ঝাড়ে,মিথিলা ঝাড়ে। এখন এই পুচকি মেয়েও ঝাড়ছে।
দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে নূহার পেছনে চলল সে।
আয়েশা চুলার ওপর বিরিয়ানি দমে রেখে এসেছিলেন। তীব্রকে বললেন,
“ তুমি একটু বসো বাবা, আমি আসছি।”
সাথে বলে গেলেন,
“ পুষ্পিতা, স্যারের কিছু লাগে কি না খেয়াল রেখো।”
ওমনি তীব্রর কালচে ঠোঁটে ক্রুর হাসি ফুটল। অথচ পুষ্পিতার মুখটা শুকিয়ে যায়। আয়েশা চলে গেলেন। প্রকৃতিই যেন দুহাত ভরে দুপুরের এই একান্ত সময়টা তুলে দিয়েছে ওদের। পুষ্পিতা আড়ষ্ট দেহে দাঁড়িয়ে যখন, হুট করে ডেকে ওঠে তীব্র,
“ এই মেয়ে!”
আজকের ডাকে অকারণে বুক কাঁ*পল তার। শশব্যস্ত চোখ তুলে বলল,
“ জি!”
তীব্র তার পাশের জায়গা দেখাল,
“ এখানে বোসো।”
পুষ্পিতার নিভু নেত্র প্রকট হয়। নিশ্চিত হতে শুধায়,
“ জি?”
কপাল গোছায় সে। গম্ভীরতার রেশ ছাড়াল গলার স্বর,
“ জি জি করছো কেন? তুমি দেখছি ভারি বেয়াদব মেয়ে! টিচার কিছু বললে কথা কানে তোলো না। বোসো এখানে।”
পুষ্পিতা মেঘের মতো চেহারা নিয়ে এগিয়ে এলো। নিশ্চুপ বসল দুরুত্ব রেখে। কোলের ওপর রাখা পেলব হস্তযূগল কচলে গেল সমানে। তীব্র সতর্ক ভাবে একবার চারপাশ দেখে নেয়। আচমকা এগিয়ে আসতেই পুষ্পিতা সোফার হাতলে সেটে গেল। ঢোক গিলে চাইল বিহ্বল লোঁচনে।
তীব্রর মুখটা হাস্যহীন। যেন কোনো থমথমে অর্ণব। অথচ বিলাই চোখে চকচক করছে দুষ্টুমি।
শরবতের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলো আচমকা। হুকুম ছু*ড়ল,
“ খাও।”
পুষ্পিতার কণ্ঠ শৃঙ্গে,
“ হ্যাঁ?”
“ এত অবাক হওয়ার কী আছে? খাও।”
ও হাঁ করার পূর্বেই চোখ রাঙাল তীব্র,
“ খেতে বলেছি।”
আবিল অক্ষিতে উষ্ণতা দেখে কম্পিত হাত আস্তেধীরে বাড়াল পুষ্পিতা। খুব অনিচ্ছায় চুমুক দিলো গ্লাসে।
মিষ্টি স্রোত গলা থেকে নামার পুরোটা সময় আবিষ্টের ন্যায় চেয়ে রইল তীব্র। পুষ্পিতা এক ঢোক দিতেই,টেনে নিলো গ্লাস। কড়া কণ্ঠে বলল
“ হয়েছে ওঠো।”
মেয়েটা ভরকায়। কী করল হঠাৎ? বোকা বোকা চাউনীতে চেয়ে উঠে দাঁড়াল তাও। তীব্র বলল,
“ যাও এখন।”
“ কোথায় যাব?”
ও চোখ সরু করে,
“ আমি কি জানি? এখানে তোমার থাকার দরকার নেই। এমনিতেই মেয়েদের দেখলে আমার অস্বস্তি হয়!
পুষ্পিতার বলাকার মতো ভ্রু যুগলে ভাঁজ বসল সহসা। ওকে নিয়ে টানা দুদিন স্যার গাড়িতে এলেন, গেলেন। এত কথা হলো দুজনের! আর আজ বলছেন মেয়েদের দেখলে আমার অস্বস্তি হয়? কী ঘোলাটে লোক রে বাবা! চোখ যেমন, মানুষও তেমন।
পুষ্পিতা সত্যিই চলে গেল।
সামনে রাখা কাচের আসবাবে তাকে যেতে দেখল তীব্র। সঙ্গে সঙ্গে মাথা এলিয়ে দিলো সোফাতে।
চোখ বুজে গ্লাস মুখে তুলল। ঠিক সেইখানে চুমু খেলো যেখানে ঠোঁট রেখেছে পুষ্পিতা। তারপর গ্লাসটাকে চোখের সামনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলল,
“ আজকের চুমুটা গ্লাসে দিলেও,ঠিক করেছি পরের চুমুটা ডিরেক্ট তোমার ঠোঁটে বসাব।”
**
নাহিদ ওয়াশরুমে ঢোকার আগে মনে পড়ল পকেটে মানিব্যাগ আছে৷ পেছন ফিরে ডাকল তক্ষুণি,
“ শুনুন!”
নূহা ওকে রেখে চলে যাচ্ছিল। এগিয়ে আসে ফের৷ নাহিদ মানিব্যাগ বের করে ইতস্তত করে বলল,
“ একটু রাখবেন প্লিজ! তীব্রর কাছে দিলেও হবে।”
“ ভেতরে স্ট্যান্ড ছিল তো।”
“ ইয়ে মানে,যদি ভিজে যায়?”
নূহা হাতে নেয়। তবে মিটিমিটি হেসে বলে,
“ সত্যি করে বলুন তো, মানিব্যাগ ভেজার চিন্তা করছেন? না কি মিথিলা আপুর ছবি ভেজার?”
নাহিদ চমকাল। হতবাক হয়ে বলল,
“ আপনি মিথিলাকে চেনেন? আর আপু বললেন কেন?”
“ চিনব না কেন? মিথিলা আপু তো পুষ্পিতার কাজিন হয়। আমরা মতিঝিলে ওনাদের পাশাপাশি ফ্ল্যাটেই থাকতাম। সেজন্যে মিথিলা আপুর পুরো পরিবারকেই চিনি।”
এসব কথা নাহিদ আগেই জানে। শুধু ভান করল না জানার। পুষ্পিতাকেই তো মিথিলার বদলে তুলে নিয়ে গিয়েছিল শাফিন। সেজন্যেই না তার জীবনের চাকা এখনো কেমন আটকে রয়েছে স্থানে। আসলে দোষটা তো ওদেরও নয়। কিছু পেতে হলে সেটা ভাগ্যে থাকাও জরুরি। মিথিলা তো কপালেই লেখা ছিল না।
উত্তরে
একটু মাথা ঝাঁকাল নাহিদ। বলল,
“ ও আচ্ছা।”
নূহা প্রশ্ন ছুড়ল আবারও,
“ আপনার আর আপুর কতদিনের সম্পর্ক ছিল?”
নাহিদের মধ্যে জড়তা নেই। জবাব দিলো সংকোচহীন,
“ এই আগষ্টে তিন বছর হোতো!”
মেয়েটা বিস্ময়ে ভ্রু তুলল কপালে। এর মানে ও যা ভেবেছিল তা নয়! মিথিলা আপুর সাথে এই ঢেঁড়সটার সত্যিই প্রেম ছিল? তাহলে পুষ্পিতা যে বলেছিল…
অবশ্য মিথিলা আপু যা ব্যবহার করতো ওর সাথে। কোথায়, কখন প্রেম করেছে সেসব কী আর বলবে! হয়ত বেচারী এসবের কিছুই জানে না।
জিজ্ঞেস করল,
“ এতদিনের সম্পর্ক,ভে*ঙে গেল কেন? আপুর যে বিয়ে হয়ে গেছে আপনি জানতেন তখন?”
যেখানে মিথিলার নাম শুনলেও তার বন্ধুরা ক্ষেপে একশেষ হয়,সেখানে প্রথম কারো কথায় ব্যগ্রতার আঁচ পেলো নাহিদ। মৃদূ হেসে বলল,
“ জানব না কেন? ওকে দেখতে আসা থেকে ওর বউ সাজার ব্যাপার সবই জানি।”
“ তাহলে আটকালেন না কেন? এভাবে একটা সম্পর্ক শেষ করে দিলেন?”
“ আমি তো শেষ করতে চাইনি৷ ওকে আমার করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারলাম কই? যে নিজে থেকে চলে যেতে চায়,তাকে কি আটকে রাখা যায় বলুন?”
নূহা তাজ্জব হয়ে বলল,
“ আপু আপনাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিলো?”
কাষ্ঠ হাসল সে। যেই হাসি সরাসরি তিরের বেগে ঢুকে গেল মেয়েটার নরম মনে। নাহিদ গাঢ় কণ্ঠে বলল,
“ আসলে মানুষ হিসেবে আমাদের সব থেকে বড়ো ভুল কী জানেন? আমরা যাকে ভালোবাসি? ভাবি সেও আমাদের একইরকম ভালোবাসছে। যার বিরহে আমরা মরে যাব ভাবি, আমাদের বিরহে তার জ্বরও আসে না।”
নূহার মনটা তলিয়ে গেল বিষাদে। ঝুপ করে বৃষ্টি নামার মতোন, সবকিছু ভিজে এলো সমবেদনায়। নাহিদের মুখের আমাবস্যা হৃদয় ছুঁয়েছে তার। মিথিলাকে আগে থেকেও নূহার পছন্দ নয়। মাত্রাটুকু দ্বিগুণ বাড়ল আজ। এরকম একটা ভালো ছেলেকে ছেড়ে দিতে পারল মিথিলা? অবশ্য কেন ছেড়েছে নূহা বোঝে। মিথিলাকে তার পরতে পরতে চেনা। ওইতো,বরের সঙ্গে কানাডা গিয়ে নেচে বেড়াবে বলে। যত্তসব স্বার্থপরের দল!
****
ছয় চেয়ারের ডায়নিং টেবিলের চারটাই ফাঁকা। তীব্র আর নাহিদ খেতে বসেছে শুধু। সুস্বাদু বিরিয়ানি দেখেও চোখ গোটাল তীব্র। এই খাবারে আবার কিছু মিশিয়ে দেয়নি তো! উম,
ব্যাপারটা দেখতে হচ্ছে। সে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নূহার দিকে তাকায়। চমৎকার করে বলে,
“ একই তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? বোসো।”
সে হেসে বলল,
“ না স্যার, আপনি খান। আমি পরে খাব।”
“ তা বললে তো হবে না। আন্টি না হয় সার্ভ করবেন, তুমি তো বসতেই পারো। বোসো বোসো।”
নূহা মায়ের দিকে তাকায়। আয়েশা ইশারা করতেই,ভদ্রের ন্যায় চেয়ার টেনে বসল। একই জায়গা থেকে মেয়ের পাতে বিরিয়ানি তুলে দিলেন তিনি। এতক্ষণে সন্দেহ ভরতি চিত্ত মিটে গেল তীব্রর। এর মধ্যে কিছু থাকলে অন্তত নূহাকে দেয়া হোতো না। মুঠো করে রাখা হাতটা এই বার খাবারে ছোঁয়াল সে ।
পুষ্পিতা ফিল্টার থেকে জগে পানি ভরে এনেছে। টেবিলে রাখতেই আয়েশা বললেন,
“ তুমিও বোসো।”
“ পরে খাব আন্টি।”
নূহার সেই দুষ্টু হাসি ওমনি ফেরত আসে। পুষ্পিতা কেন বসতে চাইছে না সে জানে। ইচ্ছে করে বলল,
“ না পরে না,আমার সাথে খাবি। চুপচাপ বোস।”
পুষ্পিতা চোখ রাঙায়। কিন্তু সে শুনলে তো! উলটে জোর করার পরিমাণ বাড়িয়ে দিলো আরো।
নাহিদ খাবার চিবোতে চিবোতে বলল,
“ আহ,কী দারুণ রেধেছেন আন্টি! মনে হচ্ছে রেস্তোরাঁয় খেতে এলাম।”
বিগলিত হাসলেন আয়েশা। কিন্তু নূহার হাসি মুছে যায়। মায়া মায়া চোখে চেয়ে থাকে ওর দিকে। একটু আগে বলে যাওয়া কথাগুলোই কানে বাজে ফের। এই ছেলের হাসি মুখখানা দেখে কে বলবে,ভেতরে কত কষ্ট লুকানো! শখের মানুষ ছেড়ে যাওয়ার মতো কষ্ট কী আর, পৃথিবীর কোনো কিছুতে হয়?
পুষ্পিতাকে ঠায় দাঁড়ানো দেখে আয়েশা বললেন,
“ কী হলো পুষ্পিতা,বোসছো না কেন?”
ও মিনমিন করে জানাল,
“ না মানে আপনার সাথে খেতাম।”
তীব্রর মেজাজ খারাপ হয়। আপনার সাথে খেতাম!
কেন,ওই মহিলার সাথে খেতে হবে কেন? সারাজীবন তো ওর সঙ্গে একসাথে বসে খেতে হবে। তাহলে এখন এতো মোচড়াচ্ছে কেন মেয়েটা?
আয়েশা বললেন,
“ আরে সে অনেক দেরী আছে। রান্নার গন্ধে আমার অর্ধেক খিদেই শেষ। তুমি বোসো।”
পরপরই সন্দিহান কণ্ঠে বললেন,
“ তোমার কী হয়েছে বলো তো! সকাল থেকে কেমন কেমন করছো দেখছি। কোথায় তোমার কলেজের স্যার এসছে,তোমার উদ্বেগ থাকবে সবার চেয়ে বেশি, তা না! সব বিষয়ে কেমন থম মে*রে থাকছো।”
তীব্র খোঁচা মে*রে বলল,
“ ও বোধ হয় আমার আসা পছন্দ করেনি।”
পুষ্পিতা ব্যস্ত হয়ে বলল,
“ না না স্যার, ছি ছি কী বলছেন! এমন কিছু না।”
আয়েশা শুধোলেন,
“ তাহলে কেমন কিছু? তোমার কী মন খারাপ পুষ্পিতা?”
“ না আন্টি।
আচ্ছা ঠিক আছে, বসছি আমি।”
হার মেনে নূহার পাশের চেয়ারে বসতে এলো মেয়েটা।
নূহা বিড়বিড় করল,
“ আর মন,ওটা নিজের কাছে থাকলে না খারাপ হবে।”
পুষ্পিতা শুনতে পায়নি। চেয়ারে শরীর রাখতে যাবে কোত্থেকে কাগজের ঢিল উড়ে গায়ে পড়ল এসে। হকচকাল সবাই। সব থেকে বেশি ভয় পেয়েছে নাহিদ। কাগজ না দেখে,শুধু শব্দ শুনেই চেঁচিয়ে উঠল,
“ ককটেল! ককটেল!”
তীব্র ধমক দেয়,
“ থাম।”
এক ধমকে থামল ও। তবে ভীত চোখ ঘুরে বেড়াল চারপাশে।
পুষ্পিতা চোর চোর ভাব করে নূহার দিকে তাকায়। মেয়েটা দাঁত চেপে, বহু কষ্টে গালি আটকাচ্ছে মুখের। ঢিল ছোড়া কাগজের টুকরো টেবিলের ওপরেই পড়েছে। তীব্র ধারালো চোখে একবার একবার করে হাবভাব দেখল সবার। বিব্রতকর পরিস্তিতে,কুণ্ঠায় নুইয়ে এসেছেন আয়েশা। কী করবেন বুঝতে পারছেন না! কেউ কিছু বলার আগে কাগজটা ফেলে দেয়াই ভালো। তীব্র নিজের বুদ্ধি দিয়ে বুঝে নিলো,কাগজে কিছু একটা আছে। আয়েশা হাত বাড়ালেন যখন,পূর্বেই ছো মেরে কাগজ নিয়ে নিলো সে। তাড়াহুড়ো হাতে ভাঁজ খুলে চোখের সামনে ধরল। সেদিনের মতো মাঝারি সাইজের একটা খোয়া,আর গোটা গোটা কিছু লেখা ভেতরে..
“ সুন্দরী তোমাকে দেখার পর থেকে রাতে আমাদের কারোর ঘুমই আসছে না। মনে হয় বিরল রোগে ধরেছে।
একবার দেখা দিয়ে রোগ সাড়িয়ে দাও না!”
তীব্রর শুভ্র কপাল বেঁকে আসে।
“ এসব…”
এটুকু বলতেই রাগে হৈহৈ করে উঠল নূহা,
“ আর বলবেন না,এই পাশের বাড়িতে কতগুলো জা*নোয়ার উঠেছে বুঝলেন। দিন-রাত পুষ্পিতাকে বিরক্ত করে বেড়ায়।”
তুরন্ত, সচল চোখের চাউনী থমকে গেল তীব্রর। থেমে গেল খাবারে মাখা এঁটো হাত।
নাহিদ ফোস করে দম ফেলল। মনে মনে ভাবল,
“ ব্যস,হয়ে গেল! বেচারাদের কপালে কী শনি নাঁচছে কে জানে!”
চলবে..
মেয়েটাকে নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম, সেজন্যে গত সপ্তাহে গল্প দিতে পারিনি। তাই আজ বড়ো করে গ্যাপটুকু পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি। ভালোবাসা রইল।
ও হ্যাঁ অন্তঃবাসিনীর প্রি অর্ডার চলছে। ধূসর-পিউ ফিরে এসেছে আবার। কিনেছেন তো?