#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ৩]
” বউ অন্য ছেলেদের দিকে চোখ দিচ্ছিস কেন?”
” সুন্দর জিনিস দেখতে হয় উজ্জ্বল ভাই।আপনিও দেখুন বারণ করেছে কে?”
” আমি তো বছরের পর বছর দেখেই যাচ্ছি এখনো দেখছি।”
রুমু চোখ সরিয়ে তাকালো উজ্জ্বলের পানে।ছেলেটাকে ভেঙচি কেটে বলে,
” কে সে শুনি?”
” যে প্রশ্নটা ছুড়েছে সে।”
রুমু প্রত্যুত্তর করলো না।পুনরায় তাকালো পাশের টেবিলে থাকা ছেলেটির দিকে।বুকের ভেতরটা মুহূর্তে ছ্যাত করে উঠলো উজ্জ্বলের।নিয়ন্ত্রণহীন ছেলেটা কি করে যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখছে তা তো সেও বুঝতে পারছে না।কলেজের পাশে একটি সাধারণ হোটেলে বসে আছে তারা।এখানে কম দামে পেট ভরে খাওয়া যায় বিধায় সকল স্টুডেন্টদের ঢল নামে।গরম গরম সিঙারা,সমুচা,পুরি,খিচুড়ি,পরোটা সহ ইত্যাদি বেশ কম দামেই পাওয়া যায়।
” রুমু কি খাবি?”
” খিচুড়ি সাথে ডিম ভাজা।”
উজ্জ্বল খাবার অর্ডার করে পুনরায় তাকালো রুমুর পানে অথচ মেয়েটা এখনো সেই ছেলেকে পরখ করছে।
” উজ্জ্বল ভাই জানেন এই ছেলেটা অনার্স ফাস্ট ইয়ারের।ইন্টারের মেয়েরা তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে।একটা ছেলে কি করে পারে এতটা কিউট হতে পারে!পুরা মাখন।”
উজ্জ্বল ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো।হাক ছেড়ে ডাকলো ছেলেটাকে।উজ্জ্বলের ডাক পেয়ে দ্রুত উঠে আসলো ছেলেটা।সৌজন্যের হাসি দিয়ে বলে,
” উজ্জ্বল ভাইয়া ভালো আছেন?ভাবিও এসেছে দেখছি।”
ভাবি!এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বিরক্তিকর শব্দ বলে মনে হচ্ছে রুমুর সুন্দর ছেলেটা তাকে ভাবি ডাকছে!রুমু কটমট চোখে তাকালো উজ্জ্বলের পানে।অথচ উজ্জ্বলের সেদিকে পাত্তা নেই সে ছেলেটার সহিত কথা বলতে ব্যস্ত।
সময় পেরিয়ে গেল আরো কিছুক্ষণ।গরম গরম খিচুড়ি গপাগপ মুখে পুরছে মেয়েটা।উজ্জ্বল সেদিকে তাকিয়ে চোখের তৃপ্তি মেটাচ্ছে।আচমকা পিঠে দানবীয় থাবায় চোখ কুচকে নেয় রুমু।ঘাড় ঘুরিয়ে বন্ধু ফাহিমকে দেখে দাঁতে দাঁত পিষে।গা ঝারা দিয়ে বলে,
“এভাবে কেউ মারে?ব্যথা পেয়েছি ফাহিম।”
” তুলোর বস্তা আবার ব্যথা পায়?”
ফাহিম কথাটা বলে দ্বিতীয়বার রুমুর ঘাড়ে হাত রাখলো।যারপরনাই এই ব্যপারটা মোটেও পছন্দ হলো না উজ্জ্বলের।চট করে রাগটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফিরে এলো তার মুখোশে।চোখের পলকে ফাহিমের হাত মুচড়ে ধরলো সে।টনটন ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলো ফাহিম।হাতটা যেন এক্ষুনি ভেঙে গুড়িয়ে যাবে।
” এই হাত আমি রাখবো না।এই হাত আস্ত থাকবে না…”
দ্বিতীয় বার ফাহিমের হাত উলটে মোচড় দিল উজ্জ্বল।তার রাগান্বিত মুখটা দেখে দিক-বেদিক সব গুলিয়ে গেল রুমুর।বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উজ্জ্বলের হাত টানতে উজ্জ্বল তাকে এক ধমকে স্থির করে ছাড়ে।হোটেলে সকলে জড়ো হয়ে যায়।উজ্জ্বলের অনেক পরিচিত ছোটভাই ক্লাসমেট বড়ভাইরা এগিয়ে আসে।হোটেলের ক্যাশে বসা লোকটির সাথে উজ্জ্বলের বেশ ভালো সম্পর্ক।তিনি চাইলেন উজ্জ্বলকে থামাতে কিন্তু বেপরোয়া উজ্জ্বল কাউকে কি মানে?পাত্তা দেয়?ফাহিমের পিঠে তিন চারটে ঘুসি দিয়ে স্থির হয় সে।তার অগ্নিশর্মা মুখখানি দেখে রুমু তাকে থামানোর সাহস করে না।উজ্জ্বল হাত টেনে এগিয়ে আনে রুমুকে এবং মুখোমুখি করায় ফাহিমের সহিত।
” কিরে বন্ধু পাতিয়েছিস বলে এই ছেলে তোর গায়ে হাত দেবে?এতটা অনুমতি দিয়ে দিয়েছিস?”
” আ…আমি বুঝতে পারিনি উজ্জ্বল ভাই।ফাহিম এমন ছেলে নয়।”
” কেমন ছেলে?বল বল,বল আমায় সে কেমন ছেলে।আমি দেখলাম তো আমার চোখ কি ভুল দেখেছে।”
” উজ্জ্বল ভাই…”
” কে ভাই?কে ভাই?এমন থাপ্পড় দেবো জীবনে গালে আর ব্লাশন লাগাতে হবে না।”
রুমু চুপসে যায়।ফাহিম উজ্জ্বলের পা ছুঁয়ে বসে যায় সে যানে এই ছেলে মারপিটে কতটা ওস্তাদ।ফাহিম নিজের জান বাঁচাতে বলে,
” উজ্জ্বল ভাই আমাকে এবারের মতো ছেড়ে দিন আর কোন দিন এমন ভুল হবে না।”
” ছাড়বো।রুমুকে আগে খালাম্মা ডাক।ডাক খালাম্মা..”
শেষোক্ত বাক্যটি বেশ জোরেই বললো উজ্জ্বল।খালাম্মা!শেষ পর্যন্ত তাকে খালাম্মা বানিয়ে ছাড়লো!রুমু চোখ মুখ খিঁচে উজ্জ্বলের পানে তাকাতে উজ্জ্বল চোখ রাঙায়।ফাহিম নিজেকে ছাড়াতে রুমুকে উদ্দ্যেশ্য করে বলে,
” খা..খালাম্মা।”
উজ্জ্বল ঠোঁট বাকিয়ে হাসে।শীতল হয় উত্তপ্ত রক্তকণা।টগবগে মস্তিষ্ক স্থির হয় মুহূর্তে।
” শুধু রুমু নয় কোন মেয়ের গায়ে যদি এভাবে হাত দিস হাতটা ভেঙে দেব জানোয়ার।”
দশ মিনিটে যেমন হোটেলের পরিবেশ পালটে যায় ঠিক তেমনি দশ সেকেন্ডে পুনরায় পালটে যায় যে যার কাজে ব্যস্ত হয়।রুমুর গলা দিয়ে খাবার নামার পরিস্থিতি নেই অথচ উজ্জ্বল জেদ ধরে বসে আছে যে করে হোক তাকে খাবারটা শেষ করতেই হবে।
” কি হলো এতটুকু খিচুড়ি শেষ করতে কতক্ষণ লাগে?”
” খাব না।প্লিজ এখান থেকে চলুন।”
” আবার কথা বলে।আদর করে খাওয়াতে হবে?আয় কোলে বস গাল চটকে আদর করে খাইয়ে দেব।না থাক ওসব বিয়ের পর করা যাবে এখন বরং নিজ হাতে খা।”
” আপনার কি লজ্জা শরম নেই?ছোট বোন হই বুঝলেন?”
” তুই আমার হবু বউ বুঝলি?”
” আপনার মতো ছেলের কাছে কে মেয়ে বিয়ে দেবে?”
” তাই নাকি?টেস্টোস্টেরন হরমোন আমার শরীরে লাফালাফি করার আগেই তোর বাপ আমাকে মেয়ে জামাই হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে আর তুই বলছিস কে মেয়ে দেবে?”
” আমার ভাইর চক্ষুশূল আপনি বুঝলেন?”
” তোর ভাইকে গুনছে কে?তুমি রাজি জামাই সাজি কেয়া কারে গা কাজি?বিয়ের পর দুজন মিলে ভাজবো ডিম ভাজি।”
” শুধু ডিম ভাজি দিয়ে আমি ভাত খেতে পারি না উজ্জ্বল ভাই।”
” দূর গানটাতো শেষ করতে দিবি।”
রুমু চুপচাপ খাওয়ায় মনোনিবেশ করে।তার সামনে বসে থাকা যুবকটি তাকে না পেলে ঠিক কি কি করতে পারে তার যুত সামান্য টের পাচ্ছে সে।
.
রুমু বাড়ি ফিরলো ভরদুপুরে।উজ্জ্বল ভাইয়ের কত শখ রুমুকে বাইকে চড়িয়ে এই শহর ঘুরবে অথচ সেই সুযোগ আর কই?উজ্জ্বলের ত্রিসীমানায় রুমুকে পেলে তান্ডব চালাবে রাশেদ।
বাড়িতে প্রবেশ করতে একমাত্র খালা হালিমাকে দেখে রুমুর কলিজা কেঁপে উঠে।গত রাতে সবাই তাকে বিয়ের হুমকি দিয়েছিল আর আজ খালামনি এসে হাজির!নিশ্চয়ই মামতো ভাইও এসেছে।এই বেয়াদবটার মুখোমুখি হতে চায় না সে।রুমু নিশব্দে প্রবেশ করলো ঘরে কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয় বসার ঘর পার হতেই হালিমার নজরে আসে রুমু।মেয়েটাকে পেয়ে আনন্দিত হয়ে ছুটে এলেন তিনি।
” রুমু আম্মু কেমন আছো?”
” ভালো খালামনি।তুমি কেমন আছো?”
” তোকে দেখে ভীষণ ভালো লাগছেরে মা।”
” তুমি বসো আমি জামা পাল্টে আসি।”
” এই দাঁড়া।তোর গালে চড়ের দাগ?কে মেরেছে তোকে?কোন জানোয়ার তোর গায়ে হাত তুলেছে?”
হালিমা রেগে গেলেন।গলা ছেড়ে বকতে শুরু করলেন।রুমু মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন চড় খেয়েছে সেই কথা শুনলে নিশ্চয়ই উনিও আরেকটা চড় বসিয়ে দেবেন।
বকাবকির মাঝে হালিমা বলেন, ” আমার ছেলের বউয়ের গায়ে কে হাত দিল আমিও দেখতে চাই তাকে।আমার ছেলে জানলে সেই হাত আস্ত রাখবে না।”
ব্যস দম আটকে আসলো রুমুর।ছেলের বউ মানে!ওই কুলাঙ্গারটাকে জীবনে বিয়ে করবে না রুমু।মুহূর্তে মাথার মধ্যে দপাদপ আগুন জ্বলে উঠলো।কাধের ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে চলে গেল নিজ কক্ষে।
এতক্ষণ হালিমার কথাগুলো গিলছিলেন রুমুদের বাড়ির কাজের মহিলা রহিমা।এক বাড়িতে কাজ করে মাসে যত টাকা ইনকাম করেন তার থেকেও ডাবল ইনকাম করেন রুমুদের বাড়ির সব কথা উজ্জ্বলকে সাপ্লাই করে।উজ্জ্বলের বেশ ভক্ত তিনি।ভক্ত হবেন না কেন?রুমুদের বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য প্রদানের মাধ্যমে উজ্জ্বল আর্থিক ভাব উনাকে বেশ সাহায্য করে।
.
ঘামাক্ত শরীরে রাগে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বাড়ি ফিরলো উজ্জ্বল।সৈয়দ শামসুল ছেলের রাগটাকে মূল্যায়ন না করে কড়া গলায় ডাকলেন,
” এই আলালের ঘরের দুলাল।”
” আমি দুলাল নই বাবা।শামসুইল্লারর ঘরের উজ্জ্বইল্লা।”
” চুপ কর।ইদানীং তোকে সময় মতো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোথায় থাকিস?আমার ব্যবসায় একটু সময় দিতে পারিস।”
” শুরু হলো তোমার এক ক্যাচাল।”
” হ্যাঁ শুরু হলো।এই যে পড়াশোনা করছো এসব কোন কাজের নয় যতটুকু শিক্ষা নেওয়ার নিয়েছো যথেষ্ট হয়েছে এখন তোমাকে শিখতে হবে কিভাবে রুজিরোজগার করতে হয়।আমার ভাইয়ের ছেলেকে দেখো না?তোমার লজ্জা হয় না?রাশেদ নিজের বাবার ব্যবসা সামলাচ্ছে কিভাবে আরো উন্নত করা যায় সেই চেষ্টায় আর আমার ছেলে..বাইক একটা নিয়ে সারাদিন এদিক থেকে সেদিক,সেদিক থেকে এদিক।”
” উফফ বাবা রাশেদের সাথে আমার উদাহরণ দিবে না।রাশেদ কেন বাবার ব্যবসায় বসেছে তুমি জানো না?মাত্র একুশ বছরে পালিয়ে বিয়ে করে বাড়িতে উঠেছে।সে পড়াশোনা গোল্লায় নিয়ে প্রেমে পিএইচডি করেছে।”
“চুপ কর।সে যা ইচ্ছা করুক তুই তো তার মতো হতে পারবি না।আমি কোমড় ভেঙে পড়লে আমার ব্যবসা নিশ্চয়ই সাত আসমানে উঠে যাবে।আমার অতিব্যস্ত পুত্র এসব ছুঁয়েও দেখবেন না।”
” দেখবো আব্বা দেখবো।বয়স তো আমার জন্য অপেক্ষা করছে না লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।আমাকেও ওই রাশেদের মতো বিয়ে করিয়ে দাও কথা দিচ্ছি তোমার ব্যবসায় সবুজ বাত্তির ছড়াছড়ি থাকবে।”
” তোর নিতম্বদেশে লাথি না মারতে এখান থেকে সর।রাস্তার পাগলেও তোকে মেয়ে দেবে না।”
উজ্জ্বল দাঁড়ালো না।বাবার এসব অপমান গায়ে মাখলে শুধু শুধু সময় অপচয়।তার এখন অনেক কাজ রুমুকে শাসাতে হবে।
.
বালিশে মুখ লুকিয়ে কাঁদছিল রুমু।হালিমার মুখে এমন কথা শুনে তার মন মরে গেছে।উজ্জ্বল অনেক্ষণ যাবৎ দেদারসে ফোন করে যাচ্ছে কিন্তু উজ্জ্বলের ফোন ধরার মতো ইচ্ছা কিংবা আগ্রহ কোনটাই খুঁজে পাচ্ছে না সে।তার এই অনাগ্রহকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে উজ্জ্বল পাঠিয়ে দিল হুমকির বাক্য।
” ফোন না ধরলে তোর বাসায় এসে হাজির হবো।ব্যপারটা কি খুব ভালো হবে?”
ব্যস ফোন না ধরার আর সাহস পেল না মেয়েটা।প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে ফোন তুললো সে।
” উজ্জ্বল ভাই বলুন।”
“রুমু ডার্লিং গলা এমন লাগছে কেন?কাঁদছিস?”
” ক..কই।”
” ন্যাকামি করে মিথ্যা বলবি না আমার সাথে।তোর নাকি বিয়ে ঠিক তোর খালতো ভাইয়ের সাথে?”
” আপনাকে কে বললো?”
অবাক চুইয়ে চুইয়ে পড়লো রুমুর কণ্ঠে।তার এই অবাক হওয়াটাকে পাত্তা দিল না উজ্জ্বল বরং চেচিয়ে বললো,
” কিরে কথা কি সত্যি?”
” জানি না আমি।”
” তবে কি জানিস?”
” এই বিয়ে হোক আম্মা এটাই চান।”
” তুই কি চাস?”
” যদি বলি আমিও তাই চাই।তবে কি করবেন আপনি?”
“তোকে তুলে নিয়ে আসবো।”
#চলবে..