#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ২০]
বিয়ে করে উজ্জ্বল ভাই বাড়িতে বউ আনেননি এনেছেন দামী হীরা,যা অমূল্য।রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা চোখে চোখে রাখতে হয়,যত্ন নিতে হয়, সবসময় পাহাড়ায় রাখতে হয়।এই বুঝি উজ্জ্বল ভাইয়ের একটু অলক্ষ্যে কেউ হীরাটি নিয়ে যাবে এসব ভয়ে দিন দিন উজ্জ্বল ভাইয়ের মুখটা শুকিয়ে যাচ্ছে।একদিকে পরিবারের ঘাড়ত্যাড়ামি অপরদিকে রুমুর চিন্তা সব মিলিয়ে উজ্জ্বল ভাই রুদ্ধশ্বাস ছাড়েন।
যারপরনাই এত চিন্তার মাঝে গতরাতে রুমুর সাথে ঝামেলা বেঁধেছে মেয়েটা তাকে ছোঁচা বলে সম্বোধন করেছে।আশ্চর্য! উজ্জ্বল ভাই কি ছোঁচা হতে পারে?চকলেট প্রেমিরা যেমন চকলেট পাগল,আইস্ত্রিম প্রেমিরা যেমন গরম শীত বর্ষা কিছুই না মেনে গ্রোগ্রাসে সময় অসময়ে আইসক্রিমকে বরণ করে নেয়,বিরিয়ানি প্রেমিরা যেমন বিরিয়ানির সুঘ্রাণ পেলে মাতাল হয়ে উঠে তেমনি উজ্জ্বল ভাই তার বউকে দেখলে সকল ধ্যান ধারনা জলাঞ্জলি দিয়ে বেসামাল হয়ে উঠেন।
তাই বলে ছোঁচা ডাকবে!এত বড় অপমান না করলে কি চলে না?অন্যের বউয়ের কাছে কি উজ্জ্বল ভাই আবদার নিয়ে যায়?ঘরে নিজের একখান দামি বউ আছে তাহলে,তাহলে…
এসব বলে ভেবে কাজ নেই।উজ্জ্বল ভাই দ্বিতীয়বার রুদ্ধশ্বাস ছাড়েন।তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি শাড়ি পরে রঙঢঙ করছে, ছবি তুলছে অথচ উজ্জ্বল ভাই নিরবে নিভৃতে সবটা হজম করছেন।
আজ এই বাড়িতে আসার তৃতীয় দিন।উজ্জ্বল সেদিন তার বাবাকে বলেছিল মেহমানকে অন্তত তিনদিন আদর যত্ন করতে হয়।সৈয়দ শামসুল তাই করলেন তিনদিন ছেলে ও ছেলের বউকে একসাথে খাওয়ার অনুমতি দিলেন তবে এরপর থেকে তাদের হাড়ি আলাদা থাকবে।
” চুমু বউ।”
” বলুন।”
” কি বলবো?”
” আপনি ডেকেছেন আপনি জানেন কি বলবেন।”
” ওহ হ্যাঁ।ভালোবাসি।”
” তা তো জানি।”
” উত্তর দিবি না?”
” উত্তর দিয়ে কী বিপদে পড়বো?”
” মানে?”
” শেয়ালকে কখনো মুরগী ধরতে দেখেছেন?”
” হুহ, গ্রমে নানার বাড়িতে দেখেছিলাম।”
“আমি দেখিনি তবে শুনেছি।বিয়ের পর থেকে তা অনুভব করছি।তাই আমার উত্তর এখন দেওয়া যাবে না শেয়ালটা যে ওত পেতে আছে।”
উজ্জ্বল ভাইকে শেয়ালের সাথে তুলনা!বেচারা উজ্জ্বল ভাই ফসফস শ্বাস ছাড়ল।তার মুখের রিয়েকশনটা হলো তার অতি পছন্দের কিবোর্ডের সেন্টি নামক ইমুজিটার মতো()।তিনি এক মিনিট রুমুর দিকে একই অঙ্গভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন।রুমু হাসল।উজ্জ্বল ভাইকে জব্দ করার মতো আনন্দ ইদানীং আর কোন কিছুতে সে পায় না।এই যে রুমু হাসছে উজ্জ্বল ভাই কি ছেড়ে দেওয়ার লোক?হাহ,সে কথা রুমু নিজেও জানে, উজ্জ্বল ভাই ছেড়ে দেওয়ার লোক না।
উজ্জ্বল চুপচাপ থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুকে গিয়ে ফটাফট প্রফাইল চেঞ্জ করল।ছবিটা ছিল উজ্জ্বল আর রুমুর হাস্যজ্বল একটা ছবি সেখানে ক্যাপশনে লিখলো,
‘রাতের আঁধারে শিকার করা আমার মুরগিটা।’
উজ্জ্বল পোস্ট করে চুপচাপ ফোন রেখে বারান্দায় গেল।তার বারান্দা থেকে রুমুদের বাড়ির ছাদ স্পষ্ট দেখা যায়।আম গাছটার আড়ালে কেউ যে আছে বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারে উজ্জ্বল।তবে কে আছে এই ব্যপারটা মোটেও বুঝতে পারেনি।সে আবার রুমে ফিরল নিজেকে আড়ালে রেখে চেক করে বুঝতে পারল আম গাছের ঝোপের আড়ালে হিমেল দাঁড়িয়ে।উজ্জ্বল রেগে গেল না বরং হাই তুলে রুমুকে কাছে টেনে বলে,
” লিপস্টিকের কালারটা তো সুন্দর।এটা না আমি চয়েজ করেছিলাম?”
উজ্জ্বল এতক্ষণ ছিল নুইয়ে যাওয়া মুড়ির মতো অথচ এখন মুড়মুড় ভাবটা এলো কেন!রুমু অবাক হয় তবুও স্বাভাবিক ভাবে প্রত্যুত্তরে বলে,
” হ্যাঁ ওটাই।”
” ঘ্রাণটা উফফ চকলেট চকলেট।”
“খাবেন নাকি?”
” সিরিয়াসলি?”
” হ্যাঁ।”
উজ্জ্বল খুশিতে গদগদ হয় দ্রুত গিয়ে বারান্দার দরজা বন্ধ করে জানলার পর্দা টেনে দেয়।এক জোড়া তৃষ্ণার্ত চোখে আবেগ ঢেলে রুমুর কাছে আসতে রুমু মুচকি হাসে।উজ্জ্বল যেন আরো ঘায়েল হয়।উজ্জ্বল যতটা এগিয়ে আসে ততটাই পিছিয়ে যায় রুমু।দেয়ালের সাথে ঠেসে দাঁড়াতে উজ্জ্বল বাঁকা হাসে সে হয়তো বোঝাতে চায় এবার যাবি কই?উজ্জ্বলের সীমানায় বন্দি তুই চুমু বউ।উজ্জ্বল হাতের আঁজলায় রুমুর গাল পুরে যখনি মাথা ঝুকে তখনি রুমু হাতে থাকা লিপস্টিকটা উজ্জ্বলের হাতে ধরিয়ে বলে,
” নিন খান।”
” হোয়াট দ্যা…”
উজ্জ্বলের মেজাজটা চড়ে গেল সপ্তম আকাশে।লিপস্টিক খাবে মানে কি?উজ্জ্বল ভাই পর পর দুইবার দেয়ালে থাবা দেয়।রুমু প্রথম পর্যায়ে হাসলেও পরবর্তীতে ভয়ে মেয়েটা চুপসে যায়।
” আমি জিজ্ঞেস করলাম খাবেন নাকি আপনি কী বুঝলেন?”
” কি বুঝেছি তুই বুঝিস নি?”
” না আমি তো ভাবলাম লিপস্টিক খাবেন।”
রুমুর ইনোসেন্ট ভাবটা উজ্জ্বলের রাগ বাড়ায় অথচ তার রাগটা রোমান্সের কাছে ফিকে হয়ে আসে।রুমুকে এতটা কাছে পেয়ে সে কি সুযোগটা মিস করবে?না একদমি না।উজ্জ্বল ভাইকে রাগানো যাবে না খুনশুটি করতে গিয়ে যদি রাগিয়ে দেয় তাহলে উজ্জ্বল ভাই কন্ট্রোল হারিয়ে যা তা করে ফেলবে।রুমু উজ্জ্বলের ঘাড়ে হাত ঝুলিয়ে দাঁড়ায়।
” রাগ করছেন কেন?”
” রাগ করিনি।”
” তাহলে চুমু খেলেন না কেন?এতক্ষণে তো রেডি ওয়ান টু থ্রি গো হয়ে যাওয়ার কথা।”
” তোদের মেয়েদের মাথায় কি চলে বলতো?তখন বললি আমার নাকি কন্ট্রোল নাই,আমি ছোঁচা তাহলে এখন এই কথা বলছিস কেন?”
” আমি তো কত কথাই বলি।”
উজ্জ্বল আড় চোখে তাকাল।তার বউটা ভীষণ পাজি।উজ্জ্বল বারান্দার দরজা খুললো সেই সাথে জানলার পর্দা সরিয়ে রুমুকে কোলে তুলে বারান্দায় গেল।রুমু ভয় পায় আকড়ে ধরে উজ্জ্বলের শার্টের কলার।
” উজ্জ্বল কি করছেন কি..আমার বাড়ির ছাদ থেকে কেউ দেখে ফেললে মানসম্মান স্যুপ হয়ে যাবে।”
” হোক স্যুপ।এত ভয় পাচ্ছিস কেন?”
” প্লিজ রুমে চলুন।”
” আশ্চর্য শ্বশুর বাড়ির সামনে বারান্দা থাকলেও তো বিপদ দেখছি।উর্মি আপার বাসায় বারান্দায় এতকিছু করলাম নিষেধ করলি না আর এখন…আমার লাভ লস নাই আমার লাইফটাই লস।একটা বিয়ে করলাম শ্বশুর বাড়ির মধুর হাড়ি কিছুই কপালে জুটলো না।বাবা মা ভিন্ন করে দিল।বউ ছোঁচা বলল।যাও একটা বারান্দা আছে সেই বারান্দাতেও রোমান্স করা নিষিদ্ধ।এই উজ্জ্বলের জীবনে আর কী আছে?”
রুমু ফিক করে হেসে ফেলল।তাদের খুনশুটি ছাদ থেকে দেখছিল হিমেল।হিমেলের মনে জেদ জন্মালো,রাগে বিভোর হয়ে দাঁতে দাঁত কিড়মিড়িয়ে তাকিয়ে রইল।রুমু ছাদে তাকাতে হিমলে দেখতে পেয়ে ভড়কে যায়।উজ্জ্বলের ঘাড় আরো শক্ত করে ধরে বলে,
” উজ্জ্বল চ..চলুন।হিমেল এখানে।”
” জানি।”
” জানেন মানে?”
” জানি মানে জানি।তাকে দেখাতে হবে তো আমরা কতটা হ্যাপি আছি।”
” উজ্জ্বল আমার ভয় করছে প্লিজ চলুন।”
রুমু পুনরায় হিমেলের পানে তাকায়।উজ্জ্বল রুমুকে নিয়ে চলে যায় রুমে।
” তোর ছবি তোলা শেষ?”
” হুম।”
” তাহলে এখন কী আমাকে সময় দেওয়া যাবে?”
” উজ্জ্বল আমার ভয় করছে হিমেল ভাই হঠাৎ এই বাড়িতে কেন এলো!”
” সে আসতেই পারে তবে সত্যি করে বল রাশেদের সাথে তোর যোগাযোগ হয়?”
” না না।যোগাযোগ হয় না।আপনি বিশ্বাস করছেন না?আপনার রোমান্সের কসম আমি…”
উজ্জ্বল তেতে উঠলো।রুমুকে ঠাস করে কোল থেকে ফেলে দিল বিছানায়।
“কত্ত বড় সাহস উলটা পালটা কসম কাটতে তোকে কেউ বলেছে?তোর উলটা পালটা কসমে যদি আমার রোমান্সে এফেক্ট পড়ে তখন?যদি কলিকাতা হারবালের প্রয়োজন পড়ে যায় তখন কি হবে?”
রুমু চমকে যায় কোন মতে কোমড়ে হাত রেখে উঠে বসে।উজ্জ্বলের প্রশ্নের পালটা জবাব দিয়ে বলে,
” তখন আমিও গান গাইব,আমি জুয়ান একটা মাইয়া,বুড়া জামাইয়ের কাছে আমায় বাবায় দিছে বিয়া।”
” আমি বুড়া!”
ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে উজ্জ্বল।রুমু বাকি গান গাওয়ার আগে উজ্জ্বল শার্টের বোতাম খুলতে শুরু করে,
” আজ তোকে প্র্যাক্টিক্যালি বোঝাব কে বুড়া।”
” উজ্জ্বল আপনার এসব প্র্যাক্টিকেল বুঝতে বুঝতে এখন আর আমার মাথায় একাডেমির কোন পড়া ঢুকে না।”
শেষোক্ত বাক্যটি কাঁদো কাঁদো সুরে আওড়ালো রুমু।
.
রুমুর পরের দিন সকালটা শুরু হলো ভিন্ন ভাবে।আজকে কেউ তাকে নাস্তা করতে ডাকেনি,যদিও রুমু ভাবতেও পারেনি চাচাজান যা বলেছেন তা করবেন।তবে কি সত্যি সত্যি উজ্জ্বল আর রুমুর হাড়ি আলাদা!
দোকান থেকে গরম গরম পরোটা নিয়ে ফিরল উজ্জ্বল দুজনে একসাথে নাস্তা সেরে বসল।রুমুর মুখটায় আজ আঁধার নেমেছে।চিন্তায় মেয়েটার মুখটা কেমন ফ্যাকাশে লাগছে।
” তোর কি হয়েছে চুমু বউ?মন খারাপ কেন?”
” আমার কারণে আপনাকে আলাদা করে দিল।চাচাজান যে এমন করবে আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।”
” তোর বাপ আমার বাপ দুজনের ঘাড়ের রগ একটা বাঁকা জানিস না?”
” সেই সাথে আপনারো।”
” কার ছেলে দেখতে হবে তো।”।
” এখন কি করবেন উজ্জ্বল?এমন তো না যে চাকরি পেয়ে যাবেন বা জমানো মোটা অংকের টাকা আছে।”
” তোকে এতকিছু ভাবতে বলেছি আমি?তোর দায়িত্ব আমি নিয়েছি তাই সব চিন্তা আমার।তোর দায়িত্ব শুধু তুই আমাকে সাপোর্ট করবি,আমার পাশে থাকবি মাঝে মাঝে উপরে নিচেও থাকতে পারিস সমস্যা নাই।”
রুমু কোলের বালিশটা ছুড়ে দিল উজ্জ্বলের গায়ে।সিরিয়াস কথায় মজা উড়ানোর মানে আছে?
নার্গিস সকাল থেকে উজ্জ্বল এবং রুমুর উপর নজর রাখছেন।যতই রাগ জেদ দেখানো হোক মন তো মানে না।উজ্জ্বলো কম যায় না দুপুরে বিরিয়ানির প্যাকেট নিয়ে বাড়ি ফিরল সে।সৈয়দ শামসুল এবং নার্গিস তখন খেতে বসেছেন উজ্জ্বল তাদের দেখে গলা ছেড়ে বলে,
” উচিত কথার ভাত নাই তো কি হয়েছে?বিরিয়ানি তো আছে।আজ থেকে বিরিয়ানি খাব।”
ছেলের কান্ডে নার্গিস আড়ালে মুচকি হাসলেন।সৈয়দ শামসুল তাচ্ছিল্য হেসে বলেন,
” যাও যাও এতই সোজা!কতদিন খেতে পারো দেখবো।”
উজ্জ্বল বাবার কথায় পালটা উত্তর দিয়ে বলে,
“দাঁত আছে যতদিন খেয়ে যাব ততদিন।”
চলবে…
[গল্পটা কে কে পড়ছেন?সবাইকে সাড়া দেওয়ার অনুরোধ রইল।গল্পের কোন চরিত্র ভালোলাগে?উজ্জ্বল নাকি রুমু।]