#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ২৪]
” উজ্জ্বল আব্বা নিচে নেমে আয়।”
মায়ের ডাকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল উজ্জ্বল।হাত ইশারায় নার্গিসকে যেতে বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল ছাদে।একেরপর এক বজ্রপাত আজ ভূমি কাঁপিয়ে তুলছে, বিজলির চমকে আকাশ ফেটে চৌচির।আঁধারের কোলে যখনি বিজলির আলো ছড়িয়ে পড়ে বাচ্চা বৃদ্ধ সবারি বুক কেঁপে উঠে অথচ উজ্জ্বল এসবকে পরোয়া করল না ছেলেটা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল নিগূর চুপচাপ।ভিজে একাকার অবস্থা চুল চুইয়ে চুইয়ে পানি ঝরছে।রুমু কোথায়?যেখানেই হোক পালিয়ে আসার চেষ্টা করত অন্তত একবার ফোন করত অথচ রুমু নিরুদ্দেশ কোন খোঁজ নেই।উজ্জ্বল আর মনকে বোঝাতে পারে না রুমু যে তাকে ঠকালো সবাই এটাই মেনে নিল অথচ উজ্জ্বল কখনোই তা মানবে না।উজ্জ্বলের কান্না পায় কেঁদেও ফেলে দমকা হাওয়া আর বৃষ্টির দাপটে তার কান্না দেখা গেল না।অপরদিকে বজ্রপাতে এবং ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে শোনা গেল না তার হাউমাউ কান্নার আওয়াজ।না চাইতেও কেন মনে হচ্ছে রুমু তাকে ঠকালো?
উজ্জ্বল সারা ছাদ পাইচারি করল।বুকের ভেতরটা কেমন চিনচিন করছে।বৃষ্টি কমার নেই উলটা বাড়ছে আকাশটাও আজ ক্রমশ ধমক দিচ্ছে।
ছোট বেলায় সে বজ্রের শব্দে ভয়ে মায়ের কোলে আড়াল হতো তখন তার মানুষ হারানোর ভয় ছিল না কিন্তু এখন তার মানুষ হারানোর ভয় হয়েছে সেই ভয়ের কাছে বজ্রের শব্দ কিছুই না।
রুমুদের বাড়ির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল উজ্জ্বল।সারা পাড়ায় বিদ্যুৎ চলে গেছে অনেকক্ষণ আগেই সারাটা পাড়া অন্ধকার ভুতুড়ে।রুমুদের জানলার আলোয় একটুখানি আলোর দেখা মিলছে এটা রুমুর ভাইয়ের রুম।ছাদে তাকিয়ে উজ্জ্বলের যন্ত্রণা বাড়ে সে আম গাছের ডাল বেয়ে কতবার যে রুমুদের ছাদে গিয়ে তার সাথে দেখা করেছে তার হিসাব নেই।পুরোনো স্মৃতির ডায়রিটা খুলে উজ্জ্বলের ইচ্ছে জাগল আবার সেই ছাদে যেতে।তবে বৃষ্টির কারনে পিচ্ছিল হয়ে আছে গাছের ডাল একবার পা পিছলে পড়লে কেলেঙ্কারি কাণ্ড বাঁধবে।উজ্জ্বল এতসব সতর্ক বার্তা গায়ে মাখল না নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে গাছ বেয়ে চলে গেল রুমুদের ছাদে।
প্রবল বৃষ্টি সেই সাথে বাতাসের দাপট কমার নাম নেই উজ্জ্বল ছাদে লেপ্টে বসল। কিছুটা সময় কাটানোর পর তীব্র জোরে বজ্রপাত হতে দ্রুত গিয়ে চিলেকোঠার ঘরের সামনে দাঁড়ায়।এই বাজটা নিশ্চয়ই আশেপাশে পড়েছে প্রচন্ড শব্দে কেঁপে উঠে মৃত্তিকা, ভয় না পাওয়া উজ্জ্বল এবার একটু হলেও ভয় পেয়েছে।উজ্জ্বল চিলেকোঠার দরজার পানে তাকায় রুমুকে সাড়া বাড়ি খুঁজলেও চিলেকোঠার ঘরটায় খোঁজা হয়নি।দু’চোখের দৃষ্টি ছলকে উঠে উজ্জ্বলের, হৃৎস্পন্দনের গতি ক্রমাগত বাড়তে থাকে।এক মুহূর্ত দেরি না করে চিলেকোঠার দরজায় পরপর বেশ কয়েকবার পদাঘাত করলো।দরজার কবজায় ছোট্ট একটা তালা ছিল সেই তালাটাকে ভাঙলো ইটের সাহায্যে বেশ কয়েকবার চেষ্টায় উজ্জ্বল সফল হলো।তবে দরজা খুলে কিছুই দেখতে পেল না ।নিবিড় অন্ধকারে ভ্যাপসা গন্ধ এবারেও হতাশার শ্বাস ছাড়লো সে।
আচমকা বিজলি চমকালো।বিজলির আলো প্রবেশ করল চিলেকোঠার ঘরে। সেই আলোতে উজ্জ্বল একপলক দেখল হাত পা বাঁধা একটা মেয়েকে।বুকটা ধক করে উঠল তার শ্বাস প্রশ্বাসের আন্দোলন বাড়ল।শনশন বাতাসে গায়ে কাটা দিল মুহূর্তে।উজ্জ্বল এগিয়ে গেল অন্ধকারে টেনে ধরল মেয়েটাকে উজ্জ্বলের শীতল হাতের ছোঁয়ায় মেয়েটার দেহ ছটফট করে উঠে।দ্রুত হাতে মেয়েটার মুখ থেকে টেপ টেনে ছিঁড়ে খুলতে শুরু করে। পুনরায় বিজলিতে উজ্জ্বল দেখতে পেল রুমুর মুখ এক পলকে উজ্জ্বলের বুকটা খাঁখাঁ করে উঠল।ছেলেটা কাতর কণ্ঠে শুধায়,
” আমার রুমু।”
অনেক চেষ্টার পর রুমুর মুখ থেকে টেপ খুলতে সক্ষম হলো।ঠোঁট থেকে ঘাড় প্যাঁচিয়ে টেপ লাগানো হয়েছিল বলে টেপ খোলার সময় রুমু বেশ ব্যথা পায়।মেয়েটা ক্ষণে ক্ষণে ব্যথায় গোঁ গোঁ শব্দ তুলে।হাত পা সম্পূর্ণ টেপের সাহায্যে বাঁধা,নিঃসন্দেহে বলা যায় কোন পাষাণ লোকের কাজ ছাড়া আদৌ কারো পক্ষে এমন কাজ সম্ভব নয়।উজ্জ্বল হাতের টেপ গুলো টেনে খুলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠে এত এত এত টেপ এলোমেলো ভাবে বাঁধা তার উপর প্রতিটা টেপ রুমুর চামড়ার সাথে লেগে থাকায় পশমে টান লাগলেই ব্যথা লাগছে।রাশেদের মার খেয়ে মেয়েটার সারা দেহের অনেকাংশ ছিলে গেছে তাই ব্যথা আরো বেশি লাগছে।উজ্জ্বল পাগলের ন্যায় বিলাপ করছে ধমকি ধামকি গালাগাল যা আসছে তাই বলছে।উজ্জ্বলকে বাঁধা দিয়ে
রুমু হ্যাঁচড়প্যাঁচড় অবস্থায় ভাঙা গলায় বলে,
” ব..ব..ব্যথা।”
” রুমু একটু ধৈর্য ধর,একটু।”
রুমু কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়ায় অর্থাৎ সে পারবে না।উজ্জ্বল টেপ ছেড়ে রুমুর গালে হাত রাখে তীব্র ব্যথায় কুঁকড়ে যায় সে।
” তোকে নিয়ে যাব, নিয়ে যাব আমি।”
উজ্জ্বল রুমুকে হাত পা বাঁধা অবস্থায় কোলে তুলে নেয়।বৃষ্টির তেজ তখনো কমেনি।বাতাস বৃষ্টি বজ্র সব মিলিয়ে পরিস্থিতি ভীতিপ্রদ।ছাদের দরজাটা বন্ধ উজ্জ্বল পড়ল ব্যপক দুশ্চিন্তায় রুমুকে নিয়ে তো গাছ বেয়ে নামা যাবে না।কী করবে সে?মেজাজটা এমনিতেই খিঁচে ছিল তার উপর বাঁধা পেয়ে রাগে গর্জে উঠল উজ্জ্বল।রুমুকে পাঁজা কোলে রেখেই একেরপর এক পদাঘাত করল লোহার দরজাটাতে।রুমু উজ্জ্বলের রাগ ক্ষোভ কিছুই পরখ করল না সে শুধু উজ্জ্বলের বুকে নিজের আগলে থাকা অস্তিত্ব অনুভব করল। এ যেন পরম শান্তি শান্তি শান্তি!এই তো আমার শান্তির স্থান।
.
সৈয়দ ইসমাইল বাক্যহারা হয়ে বসে আছেন তার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছে আনিকা।রাশেদের কতটা দুঃসাহস হলে এবার বাইরে ছাড়িয়ে ঘরের মানুষের উপর আঘাত করে।এত বড় ষড়যন্ত্র করার দুঃসাহস করার ইন্ধন নিশ্চয়ই রাবেয়া দিয়েছে।ইসমাইল উঠে দাঁড়ালেন আনিকাকে ধমক দিয়ে বলেন,
” রুমুর বিয়ের ব্যপারটা আমি জানতাম আর আমি তাদের পক্ষে ছিলাম।উজ্জ্বলকে রুমুর পাশে পেয়ে কতটা নিশ্চিন্ত হয়েছি তোর ধারণার বাইরে।আমি তোকে আমার আরেক মেয়ে ভেবেছি আর তুই আমার মেয়েটার সংসার ভাঙতে উঠে পড়ে লাগলি!”
আনিকা কান্নায় ভেঙে পড়ল।দ্রুত ইসমাইলের পা জড়িয়ে বসল।
” আব্বা আমি নিজের সংসার বাঁচাতে….”
অনিকা থেমে গেল।ছাদ ঘরের দরজা থেকে ধুমধাম শব্দ হচ্ছে।শব্দটা কমার পরিবর্তে ক্রমশ বাড়তে থাকল।দরজাটা যেন এক্ষুনি ভেঙে যাবে।সৈয়দ ইসমাইল টর্চ লাইট নিয়ে ছুটে গেলেন ছাদে তার পেছন পেছন গেল আনিকা।প্রথমে তিনি দরজা খোলার সাহস করলেন না কিন্তু উজ্জ্বলের আওয়াজ পেয়ে দরজা খুলতে চমকে যান যখন দেখলেন ভেজা জবুথবু উজ্জ্বল তার কোলে রুমু।
” উজ্জ্বল এত রাতে তুমি ছাদে?”
” চাচাজান কবে আসলেন?”
” আজ।রুমুকে কোথায় পেলে?মেয়েটার কি হয়েছে?আমার রুমু ঠিক আছে তো?”
” আপনি আমার বিপদে পাশে ছিলেন না চাচা,পাশে ছিলেন না।আমার কাছের আপন কেউ আমার বিপদে পাশে ছিল না।কেউ না।”
অভিযোগের সুরে কথাটি বলে প্রস্থান করল উজ্জ্বল।যাওয়ার আগে আনিকার দিকে তাকাল ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে।
নিজ বাড়িতে ফিরে উজ্জ্বল কারো সাথে কোন কথাই বলল না।রুমুর করুন পরিস্থিতি দেখে নার্গিস কান্না আটকাতে পারলেন না।মেয়েটার সারা শরীরে ছোপ ছোপ রক্তের জমাট বাঁধা দাগ।
মাঝ রাতে যে যার রুমে উজ্জ্বল বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুনছিল রাশেদের চিৎকার চেচামেচি সেই সাথে থেমে থেমে রাবেয়ার গলার আওয়াজো পাওয়া যাচ্ছে।বৃষ্টির দাপট তখন কমে এসেছে সেই সাথে বাতাসের তীব্রতা।এখন শুধু ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে।উজ্জ্বলের কানে এলো রুমুর কান্নার আওয়াজ ছেলেটা ছুটে নিজ কক্ষে ফিরল।
” রুমু কি হয়েছে কাঁদছিস কেন?”
” আপনি কোথায়?”
” এই তো।”
” আমার প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছে।”
রুমুকে তিনটা কাঁথা দেওয়া হয়েছে অথচ মেয়েটা থেকে থেকেই বলছে ঠান্ডা লাগছে উজ্জ্বল এগিয়ে এলো বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল রুমুকে।
” এবার ঠিক আছে?”
” আপনি যাবেন না।আমার ভয় লাগে।”
” ঘুমা।”
” না না চোখ বন্ধ করলেই ভয় লাগে।অন্ধকার দেখি,সব অন্ধকার।”
” কিন্তু আলো তোর চোখে সয় না।”
” অন্ধকারেও তো ভয় লাগে।”
উজ্জ্বল চুপ রইল।এতদিন একা অন্ধকার রুমে বন্ধ থাকায় রুমুর চোখে আলো লাগলেই অস্বস্তি লাগে অপরদিকে অন্ধকারে সে ভয় পাচ্ছে এই মুহূর্তে উজ্জ্বল কি করবে?ভেবে পায় না ছেলেটা।
উজ্জ্বল রুমুর চুলে বিলি কেটে দেয় তৎক্ষনাৎ চাপা আর্তনাদ করল রুমু।উজ্জ্বল ঘাবড়ে যায়,
” কিরে কি হয়েছে?”
” ব্যথা ব্যথা।”
” চুলেও ব্যথা?”
” চুল টেনে মেরেছিল।”
উজ্জ্বল চোখ বন্ধ করে।রাশেদকে জ্যান্ত গিলে খেলে শান্তি পেত।
“উজ্জ্বল।”
” হুম।”
” আমি কি সত্যি আমার মায়ের মেয়ে?”
” এমন কেন মনে হলো?”
” পরিস্থিতি অনেক কিছুই মনে করাতে বাধ্য করে।”
” পাঁকা পাঁকা কথা না বলে ঘুমা।”
” ঘুমাব না।অনেক ঘুমিয়েছি।”
উজ্জ্বল প্রত্যুত্তর করে না।দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।আগামীর দিনগুলো কেমন যাবে তার জানা নেই রাশেদের কর্মকান্ডে মার্ডার করার মতো দুঃসাহস সে করে দেখাতে পারে।রুমুর যখন চোখ লেগে এলো তখনি করাঘাতের শব্দে তার ঘুম ভেঙে গেল।উজ্জ্বল উঠে গিয়ে দরজা খুলল এত রাতে নার্গিসকে দেখে বলে,
” আম্মা এত রাতে উঠলেন কেন?”
” রাশেদের চিৎকার শুনছিস?হারামজাদাটা তোর চাচার কোন ক্ষতি করে দেবে।”
” সেই সাহস করবে না।”
” যে ছেলে তার আপন বোনের সাথে এতটা করতে পারে সে ছেলে নিজের বাপকেও খু ন করতে পারবে।”
” ঘুমান আম্মা।ওদিকে কান না দিলেই ভালো হবে।”
নার্গিস চলে গেলেন।উজ্জ্বল দরজা বন্ধ করে ফিরে এলো রুমুর কাছে।
” রুমু একটা প্রশ্ন করব উত্তর দিবি?”
“কি প্রশ্ন?”
” আমাকে ডিভোর্স দিবি?”
চলবে…