#অনুপ্রভা_মেহেরিন
[পর্ব ২৭]
বলা যতটা সহজ করা ঠিক ততটাই কঠিন।জমির ব্যাপারে বাবার অনুমতি নিতে পারলেও উজ্জ্বল ঠিকঠাক ভাবে টাকা গুছিয়ে উঠতে পারেনি।ভেবেছিল একটা এনজিও থেকে লোন নেবে কিন্তু এনজিওর লোক উজ্জ্বলকে টাকা দিতে রাজি হয়নি।রাজি হবে কি করে?উজ্জ্বলের পেশা কি?এই যে টাকা নিচ্ছে সময় অনুযায়ী টাকাটা যে দিতে পারবে তার নিশ্চয়তা কী?তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজপত্র দরকার যা উজ্জ্বলের কাছে নেই।উর্মির মাধ্যমে তামিমের কাছ থেকে কিছুটা টাকা পেয়েছে রুমু তার বাবার কাছ থেকে চেকটা এনে দিয়েছে।এই চেক নিয়েও উজ্জ্বলের ছিল ঘোর নিষেধাজ্ঞা কিন্তু রুমু কি তা শুনে?ঠিকি উজ্জ্বলের বিরোধীতা করে চেকটা আনল।
রৌদ্র তাপে শরীর পুড়ে যাচ্ছে রুমু উজ্জ্বলের পাশে দাঁড়িয়ে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওই যে তাদের স্বপ্নের রেস্টুরেন্ট তৈরির কাজ চলছে।রেস্টুরেন্টা হবে সম্পূর্ণ বিদেশি স্টাইলে। রেস্টুরেন্টের দেয়াল থেকে শুরু করে ভেতরের বাইরের সবকিছুই হবে বিদেশি স্টাইলে।এই শহরে এমন রেস্টুরেন্ট আর দুটি নেই তাই উজ্জ্বলের এক বিশেষ বন্ধু তাকে অফার করল একটি রেস্টুরেন্টের ডিজাইন।উজ্জ্বল বারণ করেনি এক দেখায় তার পছন্দ হয়ে যায় এবং কাজে লেগে পড়ে।
প্রচন্ড রোদে ঘেমে উঠল উজ্জ্বল কপালের ঘাম মুছে রুমুকে বলে,
” রুমুরে জেদ দেখিয়ে সব করছি আমি পারব তো?”
” আরে চিন্তা কিসের?পারবেন মানে পারবেন বুঝলে?”
” কিন্তু টাকা হাতে এখন যা আছে সব অতিদ্রুত শেষ হয়ে যাবে।ইট বালু সিমেন্ট লোকের খরচ উফফ মাথা কাজ করছে না।এরপর তো আরো খরচ আছে।”
” এত চিন্তা কিসের?আব্বা কি বলেছে মনে নাই?টাকা নিতে এতই যখন গায়ে লাগে তখন ধার নেবেন ধারের টাকা তো শোধ দিতেই হয় তাহলে আর আপনার গায়ে লাগবে না।”
” তোর ভাই জানলে জন সম্মুখে রটিয়ে বেড়াবে শ্বশুরের টাকায় রেস্টুরেন্ট দিয়েছি।”
” আমার ভাই জানলে তো।আপনি অযথা চিন্তার সাগরে ডুবে যাবেন না।”
উজ্জ্বল হতাশার শ্বাস ছাড়ল।ভেতরে ভেতরে ভয়েরা বাসা বেঁধেছে।
সিয়াম দুই গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে এগিয়ে এলো।রুমু এবং উজ্জ্বলের হাতে দিয়ে বলে,
” উজ্জ্বল দিনকে দিন তোর চোখ মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে।এতটা চিন্তা করছিস কেন?দেখবি যা হবে ভালোই হবে।”
” তাই যেন হয়।আমি ভালোর অপেক্ষায়।”
” রুমুকে নিয়ে আজ রাতে মনে করে আসবি কিন্তু।”
রুমু ভ্রু কুচকায় সিয়ামের পানে তাকিয়ে বলে,
” রাতে কেন যাব সিয়াম ভাই?”
” আজ সুরাইয়ার জন্মদিন।”
” তাই নাকি!দেখলে ভুলেই গেলাম আমার ফ্রেন্ড অথচ আমারি মনে নেই।”
” তোর মনে থাকা কি স্বাভাবিক রুমু?তুই কতটা ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিস।যাই হোক আজ রাতে চলে আসবি।”
রুমু আরো কিছুক্ষণ উজ্জ্বলের সাথে সময় কাটাল।ফেরার পথে দুজন যখন বাইকে ছিল তখন রাস্তায় হাটতে থাকা রাশেদের সাথে চোখাচোখি হলো।দ্রুত বাইক থামাল উজ্জ্বল ছেলেটার এমন কান্ডে রুমু ঘাবড়ে গেল রাশেদকে দেখে বাইক থামাল কেন?আবার কি ঝামেলা বাঁধবে নাকি!উজ্জ্বল বাইক থামাতে রাশেদ তার দিকে ঘাড় কাত করে তাকায় উজ্জ্বল আড় চোখে তাকিয়ে দোকানে বসে থাকা একজন মুরব্বিকে বলে,
” চাচা ভালো আছেন?”
” এই তো।তুমি ভালো আছো?”
” জি চাচা আলহামদুলিল্লাহ।চাচা সাবধানে থাইকেন দেশে নাকি রাশেদ ভাইপারের আতঙ্ক দেখা দিসে।”
” রাশেদ ভাইপার!কও কি আমি শুনলাম রাসেল ভাইপার।”
” ঠিকটাই শুনছেন চাচা তবে এটা রাসেল ভাইপারের জমজ ভাই রাশেদ ভাইপার।আমি গেলাম চাচা সাবধানে থাইকেন।”
অদূরে দাঁড়িয়ে উজ্জ্বলের কথা শুনে মুহূর্তে রেগে গেল রাশেদ।এত বড় সাহস তাকে নিয়ে বাজে কথা তুলছে!রাশেদ তেড়ে আসতে নিলে উজ্জ্বল দ্রুত বাইক স্টার্ট দেয়।খেপা ষাড়টাকে রাগিয়ে দিয়ে উজ্জ্বল বেশ মজা পেয়েছে।
.
সন্ধ্যার পর রুমু তৈরি হয়ে নিলো ।কতদিন পর দাওয়াতে যাচ্ছে মেয়েটা সাজতে আলসেমি করেনি।উজ্জ্বল তাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সিয়ামদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।রাতে কেক কেটে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন শেষে উজ্জ্বলের সব বন্ধুরা মিলে চলে গেল ছাদে।রাত তখন প্রায় একটা উজ্জ্বল রুমুকে বারবার নিষেধ করেছে ছাদে না আসতে সে যেন সুরাইয়ার সাথে থাকে।রুমু প্রথমে উজ্জ্বলের আদেশ মানলেও যখন উজ্জ্বলের বন্ধুদের হাসির আওয়াজ পেল তখনি নিজেকে সামলাতে পারেনি দ্রুত পায়ে সুরাইয়াকে নিয়ে চলে গেল ছাদে।ঝকঝকে আকাশে আজ চাঁদ হাসছে সেই সাথে তারাদের সন্ধি।আকাশটা আজ বড্ড সুন্দর ছাদে কোন লাইটের প্রয়োজন নেই চাঁদের আলোয় পরিপূর্ণ ছাদটা। রুমুকে দেখেই উজ্জ্বলের মেজাজ খিঁচে গেল।এখানে তারা পাঁচজন ছেলে বন্ধু তার মাঝে রুমুর আসার কি দরকার?সুরাইয়া ভাইয়ের ভয়ে ছাদে আসেনি মেয়েটা সিড়ির কাছেই দাঁড়িয়ে রইল।রুমুকে দেখেই উজ্জ্বলের মেজাজ খারাপ হয় তাকে টেনে নিয়ে গেল ছাদের এক কোণে।
” তোকে বললাম আসবি না নিচে থাকবি।আসলি কেন?”
” আহ লাগছে উজ্জ্বল ভাই হাতটা ছাড়েন।”
” আবার ভাই!কে তোর ভাই?”
” ইয়ে মানে কেউ না।”
” নিচে যা।”
” যাব না।আপনাদের সাথে আড্ডা দিব।”
” ছেলেদের সাথে আড্ডা দিবি!পাগল নাকি রে।”
” দিলে কি হয়?”
” আমরা ছেলেরা ছেলেরা আড্ডা দিব সেখানে তুই মেয়ে যাবি কেন?”
” কেন আড্ডা দিলে কি হবে?এই শুনুন আমারো কলেজে গ্রুপ ছিল সেই গ্রুপে ছেলে বন্ধু ছিল কিন্তু আপনার জন্য সব ত্যাগ করেছি।”
“আমায় উদ্ধার করেছেন এখন এখান থেকে যান।”
” যাব না।আপনারা কি কথা বলছিলেন?”
” বাজে বাজে কথা বলছিলাম।”
” বাজে কথা!কি বাজে কথা শুনি।”
” কিহ!মাথা ঠিক আছে?”
” আমিও শুনবো বাজে কথা।”
” রুমু আমার ধৈর্য কিন্তু ছাদ লাফিয়ে পালাচ্ছে।”
” বলেন না, কি বাজে কথা বলছিলেন।”
” আমরা ছেলেরা যখন একদল হয়ে যাই তখন বাজে বাজে কথা বলি বুঝলি।”
” কেমন বাজে কথা?”
” বাজে কথা মানে বাজে কথা।”
রুমু সরু চোখে তাকাল।উজ্জ্বলকে টেক্কা দিয়ে চলে গেল সিয়ামের কাছে।
” সিয়াম ভাই আপনারা নাকি বাজে কথা বলছিলেন?আমার বরটাকে কেন খারাপ বানাচ্ছেন?”
রুমুর প্রশ্নে হতভম্ব সকলে উজ্জ্বল রুমুকে টেনে নিয়ে যায় অথচ রুমু কিছুতেই যাবে না।
” সিয়াম ভাই সত্যিটা বলুন।আমার বরকে বাজে কথা কেন শেখাচ্ছেন!”
” ব..বাজে কথা!রুমু তোর মাথা ঠিক আছে?আমরা তো এমনিতেই কথা বলছিলাম।”
” তাহলে উজ্জ্বল যে বলল আপনারা বাজে কথা বলছিলেন।”
উজ্জ্বল পড়ল মহা বিপদে এই গাধীটাকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে শান্তি পেত।একদল ছেলের মাঝে রুমু বসে হাসাহাসি করবে এসব উজ্জ্বলের সইবে না,তাই তো সে রুমুকে মিথ্যা বলল।সিয়াম কথা পাল্টাতে দ্রুত বলে,
” রুমু বস একটুপর উজ্জ্বল গান গাইবে।শুনবি না?”
রুমু দ্রুত বসে পড়ল।কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বসে পড়ল উজ্জ্বল নিজেও।সুরাইয়া এসে রুমুর পাশে বসলো।তাদের আড্ডায় চলল অনেকটা সময়।চাঁদটা যখন মাথার উপর তখন রাত প্রায় দুইটা।উজ্জ্বলের বন্ধু দিপু গিটারটা আজ নিয়ে এসেছে।চাঁদের ঝকঝকে আলোয় গান ধরল উজ্জ্বল,
Tu hi haqeeqat khwaab tu
Dariya tu hi pyaas tu
Tu hi dil ki bekarari
Tu sukoon tu sukoon
Jaoon main ab jab jiss jagah
Paoon main tujhko uss jagah
Saath hoke na ho tu hai
Rubaroo rubaroo
Tu humsafar tu humkadam tu humnawah mera
Tu humsafar tu humkadam tu humnawah mera.
রুমু ফোন নিয়ে ভিডিও করল উজ্জ্বলের গাওয়া গানটা।গান শেষে মেয়েটা খুশিতে গদগদ হয়ে সুরাইয়াকে বলে,
” এটা আমি আপলোড করব সুরু।”
” উজ্জ্বল ভাই জানলে তোকে ড্রেনে চুবিয়ে দেবে।”
” ওঁকে ভয় পাই নাকি?সুযোগ বুঝে পোস্ট করে দেব।”
.
পড়ার টেবিলে টানা তিন ঘন্টা বসে থেকে রুমুর কোমড় ধরে গেছে উজ্জ্বলের জন্য নড়তেও পারছে না।উজ্জ্বলের একটাই আদেশ দুইদিন পর পরিক্ষা টেবিল ছেড়ে উঠবি না।আজ সকাল থেকেই উজ্জ্বল রুমুকে পাহারা দিচ্ছে ফোন নিয়ে নিয়েছে তার আয়ত্তে সব মিলিয়ে মেয়েটার নাজেহাল অবস্থা।উজ্জ্বল বিছানায় শুয়ে ফোন দেখছে রুমু অতি আফসোস সুরে শুধায়,
” জানেন,আগে বলতাম পড়াশোনা থেকে বাঁচতে বিয়ে করব এখন দেখি বিয়ে করে উলটা ফেঁসে গেছি।পড়াশোনার জন্য এতটা চাপ আমার পরিবারো আমাকে দেয় নাই।”
” চুপচাপ পড়।”
” কি পড়ব?কিসব লজিক গেইট বিয়ের গেইট।আইসিটিতে এসব কি ফাও জিনিস দিয়ে ভরা।”
” লাঠির বারি খাওয়ার আগে পড়।”
” উজ্জ্বল ভাই লজিক গেইট NOR গেইট সব মিলিয়ে দেখতে বাথরুমের পাইপের মতো না?এই যে দেখেন না একটা আরেটার সাথে আঁকাবাঁকা হয়ে জুড়ে যাচ্ছে।”
” এই তোর মাথায় এসব আজে বাজে কথা আসে কি করে?”
” আরেহ দেখেন না।”
” রুমু মেজাজটা কিন্তু গরম হচ্ছে।”
রুমু চুপসে যায় ইদানীং উজ্জ্বল ভাই আদর সোহাগ বড্ড কম দিচ্ছেন।সারাদিন পড় আর পড় এই ছাড়া উজ্জ্বলের ভাইয়ের মুখে ভালোবাসার কোন বুলি ফুঁটে না।বিবাহিত জীবনে কি পড়ার ইচ্ছে জাগে?ইচ্ছে জাগে শুধু স্বামীর সোহাগ পেতে।রুমু খাতায় কিছু একটা লিখল লিখেই চেচিয়ে ডাকল উজ্জ্বলকে।
” উজ্জ্বল এই অংকটা পারি না।”
” দেখি খাতা দে।”
রুমু খাতা এগিয়ে দিল।উজ্জ্বল খাতায় একপলক তাকিয়ে রুমুর পানে আরেক পলক তাকাল।খাতায় অংক থাকার পরিবর্তে লেখা,
” উজ্জ্বল জানু দরজাটা লাগিয়ে আসো তোমার আদর পেতে ইচ্ছে করছে।”
উজ্জ্বল মিষ্টি হেসে শোয়া থেকে উঠে দাঁড়াল রুমু ভীষণ খুশি হলো এই তো ব্যাটাকে পটিয়ে ফেলেছি।রুমু চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠতে উজ্জ্বল তাকে হাতের খাতাটা দিয়ে ধুমধাম একেরপর এক কিল বসিয়ে দিল।রুমু হতবুদ্ধ হারিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল।তবে উজ্জ্বলের মার থামল না খাতা দিয়েই রুমুকে আরো তিন চারটা প্রহার করল।
উজ্জ্বল দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,
” আদর?আদর লাগবে আর?”
” এটা আপনি কি করলেন!”
” আদর দিলাম।পরিক্ষার সময় স্পেশাল আদর।এরপরেও যদি পড়তে হেলামি করিস তবে ডাবল আদর দিয়ে দেব।পড়তে বস।”
উজ্জ্বলের ধমকে চুপচাপ চেয়ারে বসল রুমু।
চলবে…