১৬.
তোমার মনে আছে রুমকির কথা? কফির মগে চুমুক দিতে দিতে ফাহাদ মলিকে শুধায়।
হ্যা মনে আছে তো, ও খুব চঞ্চল আর বোকা বোকা ছিলো।
ব্যস এতটুকুই? আচ্ছা তুমি কি মেহেদী স্যারের সম্পর্কে কিছু জানতে? মানে পুরো কলেজের সবাই জানতো রুমকি মেহেদী স্যারের জন্য কতটা পাগল ছিলো। তুমি শুনোনি কিছু?
হ্যা হালকা পাতলা জানতাম তো। তাও কতদিন আগের কথা। আসলে অত ক্লোজ ছিলাম না তো রুমকির সাথে। মলির কফি শেষ, চেয়ারে হেলান দিয়ে তাই অলস ভংগীতে বলল তাহলে কি এত দিন পর স্যারের সাথেই বিয়ে হচ্ছে রুমকির?
আরেহ না, কি বলো, ওই লম্পটের সাথে রুমকির বিয়ে??? ভাবা যায়। তাহলে পরের ঘটনা কিছুই জানো না বোধহয়।
মলির মাথায় আসলেই কিছু ঢুকছে না, নিজের জীবনের হিসাব মিলাতে পারছে না আর ফাহাদ অন্যএর জীবনের কাহিনী শোনাতে এসেছে এই কফি শপে। না চাইতেও ভদ্রতার খাতিরে চুপচাপ শুনে যাচছিলো।
ফাহাদ গলা ঝেড়ে আবারো বলা শুরু করলো, রুমকি যে মেহেদী স্যারের জন্য পাগল ছিলো তা মেহেদী স্যার ঠিক ই বুঝতো। আর সেই সুযোগ ই নিতে চেয়েছিলো উনি। একদিন স্যারের চেম্বারে ডেকে নিয়ে রুমকিকে উনি এবিউস করেছিলো। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি উনি যে বিবাহিত এবং এক বাচ্চার বাপ তা কেউ জানতো না সবাই জানতো স্যার সিংগেল। আর ভাবসাব ও এমনই ছিলো।
মলি এবার নড়েচড়ে বসলো, চোখ গুলো কোটর থেকে প্রায় বের হয়ে আসছিলো, সে অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলে উঠে বলো কি? তারপর, তারপর কি হলো?
কি আর স্যারের পর্দা ফাঁস,কিন্তু রুমকি মারাত্মক ট্রমাতে চলে গেলো। মেয়েটা আসলেই বেশি সহজ সরল ছিল।
মলি এবার কাঠ কাঠ গলায় বলে, ছিলো মানে কি এখন কি নেই?
না তা বলছি না তবে আগের চেয়ে অনেক চেইঞ্জ হয়েছে। আর এই চেইঞ্জ টা আনতে পেরেছে কে জানো?
মলি আরেকটু ঝুকে বলল কে?
আমাদের পলাশ, ফাহাদ মুচকি হেসে সোজা হয়ে বসল।
পলাশ, ওই যে ফর্সা হেংলা করে ছেলেটা? তোমার বন্ধু যে।
হ্যা হ্যা, ও রুমকির পাশে দাঁড়িয়েছিলো। আসলে সেখান থেকেই একদিন দুইদিন করে আস্তে ধীরে ওদের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক হয়ে উঠে। আর পলাশ খুব কেয়ারিং ছেলে। ওর কেয়ারইং এর জন্যই আজ রুমকি ভালো আছে। ভালো জব ও করে। দুইজন সব গোছাতে গোছাতে এত দিন লাগলো এখন বিয়ের পালা।
বাহ, দারুণ তো। ভালোই লাগলো শুনতে ওদের বন্ডিং টা বেশ তাই না?
গতরাতেই পলাশ কে তোমার কথা বলেছিলাম ওরা তোমাকে বিয়েতে ইনভাইট করবে। তোমার ফোন নং টাও দিয়েছি। সরি অনুমতি ছাড়াই দিয়েছি।
আরে ধুর, ওরা ও তো বন্ধু মানুষ। কিন্তু ইনভাইট করলেই কি আমি কি আর যেতে পারবো? আর এত দিন পর তোমাদের এত ভালো বন্ডিং এর মাঝে আমি কি খাপ খাওয়াতে পারবো?
ফাহাদ ফস করে উঠে, আজব কি বললা? খাপ না খাওয়ানোর কি আছে। শোনো আমি যত টুকু বুঝেছি, তুমি খুব ফ্রাস্ট্রেশনে আছো। আমার ও মনে হয়েছে সব কিছুর বাইরে নিজেকে সময় দেয়া জরূরী। আর সত্যি আমাদের সাথে আবার আড্ডা দাও, সময় দাও দেখবে ভালো লাগবে। সংসার সংসারের জায়গায় কিন্তু ব্যক্তিগত তুমিও প্রাধান্য দেয়া উচিত।
মলির কথা গুলো মনে ধরেছে খুব। আসলেই আবিদ তো তার কাজ নিয়ে বিজি। মলির নিজেকে ও নিজের সময় দেয়া প্রয়োজন। কিছুটা তাহলে গন্ডির বাইরে জীবন কাটাতে পারবে।
১৭.
রাত ১১ টা। কলিং বেলে চাপ পড়তেই কেয়া ছুটলো দরজা খুলতে। সে জানে কে এসেছে। তাইতো প্রিপারেশন নেয়াই ছিলো। ছেলে কে ঘুম পাড়িয়ে নিজে ফ্রেস হয়ে একটা সুন্দর নাইটি পরেছে। কপালে টিপ আর সুগন্ধি মেখে আবিদের জন্য একদম রেডি হয়েই ছিলো।
দরজা খুলতেই আবিদের নাকে কেয়ার ইউজ করা মাতাল করা তীব্র পারফিউমের স্মেল নাকে এলো। মাতাল করার জন্যই বুঝি কেয়া তৈরি হয়ে আছে। আবিদ ভিতরে এসেই কেয়ার ঠোঁট দখল করে নিলো। অনেকটা সময় পর কেয়া নিজেক ছাড়িয়ে বলল প্লিজ রুমে চলো।
মাঝের সময় টা তাদের ভালোবাসায় মাখামাখিতেই চলে গেলো। রাত তখন প্রায় ১ টা। আবিদের বুকে মাথা রেখে রঙ বেরংগের স্বপ্ন বুনছে কেয়া। আহ্লাদ করা সুরে বলে উঠলো,
কই আমার সারপ্রাইজ কই????
আবিদের চট করে মনে পড়লো আহা তাই তো, কেয়া কে পাশ কাটিয়ে নিজের কোটের পকেটে হাত দিয়ে একটা ছোট্ট বক্স খুলে লকেট বের করে সে। তারপর কেয়ার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে দেখোতো পছন্দ হয় কিনা?
কেয়া খুশিতে নেচে উঠে, ওয়াও ডায়মন্ড?
কেয়ার খুশির সাথে পাল্লা দিয়ে আবিদ বলে, ইয়েস মাই লাভ।
কেয়া আবিদের গলা জড়িয়ে ধরে। চুমুতে চুমুতে আবিদ কে পাগল করে ফেলে। আবিদ ও আবার ডুব দেয় কেয়ার মাঝে। এভাবেই তাদের অবৈধ ভালোবাসা চলতে লাগলো। আশেপাশের সমাজ নিজের পরিবার, পুরো অফিস জুরে তাদের ব্যপারে কানাঘুষাকে পাত্তা না দিয়ে তারা তাদের সম্পর্ক কে এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলো।
বসুন্ধরা শপিং মলে দাঁড়িয়ে আছে৷ মলি, রুমকি আর পলাশ। পলাশ ফোনে কথা বলছে ফাহাদের সাথে। ফাহাদের আসার কথা আরো আগেই কিন্তু এখনো আসছে না৷। অবশেষে ফাহাদ কে রেখেই শপিং এ গেলো তারা। পলাশের ইচ্ছা ছিলো রুমকি আর মলি শপিং করতে করতে সে ফাহাদ কে নিয়ে নিজের শপিন্ং টা করে ফেলবে। তাতে করে সময় বাচবে। অথচ ফাহাদের আসতে আরো লেইট হবে। তাই দুইটা মেয়ের সাথেই তার আপতত গন্তব্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এমনিতেই অনেক লেইট হয়ে গেছে। প্রথম দেখায় রুমকি মলি কে দেখেই যে চিতকার দিয়ে উঠেছিলো আশেপাশের মানুষ তো পুরাই বোকা বনে গিয়েছিলো। রুমকি মেয়েটাই এমন খুব সহজেই সবাই কে আপন ভেবে নেয়।
যদিও মলির সাথে রুমকির অত ভাব ছিলো না কলেজ লাইফে। তবে রুমকি খুব আন্তরিক আর মিশুক হউয়াতে মলির গা ঘেঁষে ঘেঁষেই থাকতো।
এতদিন পর পরিচিত মুখ পেয়ে মলি অবশ্য বেশ খুশি। একটা সময় পুরাতন মুখ গুলো দেখতেই মন আঁকুপাঁকু করে উঠে।
অনেক গুলা শাড়ি দেখে দেখে যখন ওরা ক্লান্ত তখন মলির চোখ যায় পিংক কালারের একটা লেগেংগার দিকে। মলি সেটা নামাতে বলে দোকানের মাঝ বয়সী ছেলে কে। ছেলেটা নামানোর সাথে সাথেই মলি আর রুমকি এক সাথে বলে উঠে, ওয়াও।
রুমকি চাচ্ছিলো মেরুন রংগের কিছু নিতে তাই পিংক টা আপাতত প্ল্যান থেকে বাদ দিলো। কিন্তু সে ঠিক ই বুঝতে পারছিলো যে মলির লেহেংগা টা খুব পছন্দ হয়েছে। তাই সে বলে উঠলো,
“মলি তোমাকে কিন্তু হেব্বি লাগবে, নিয়ে নাও এটা। “
মলি কিছুটা অবাক আর৷ লজ্জা পেয়ে বলল,
“তোমার মাথা খারাপ, আমি???? “
“হ্যা৷ অবশ্যই তুমি। কেনো কি সমস্যা??? ”
মলি এবার হাত থেকে রেখে কাপড় টাকে বলে উঠলো,
“আমরা তো তোমার বিয়ের শপিং করতে এসেছি, তাই না? আগে তুমি পছন্দ করে তোমার জিনিস গুলো নাও তো। পরে দেখা যাবে তোমার কিছুই কেনা হয়নি। “
রুমকি অনেক জোর করলেও মলি পাত্তা দিলো না। মলি নিজের আবেগ কে কন্ট্রোল করতে শিখে গিয়েছে। ওর খুব শখ ছিলো ওর রিসেপশনে এমন সুন্দর একটা লেহেংগা পরবে। কিন্তু বিধিবাম। আবিদের মেরুন পছন্দ বলে পরা হয়নি৷।
শাড়ি লেগেংগা কেনার মাঝেই ফাহাদ এসে জুটলো।দোকান৷ থেকে৷ বের হবার আগে৷ আবার রুমকি বলে উঠলো,
” মলি, ইফ ইউ হেভ মানি ইস্যু দেন ইউ কেন বোরো৷ ফ্রম৷ মি ডিয়ার। কিন্তু বিশ্বাস করো তোমাকে অনেক মানাবে এটা। “
ফাহাদ আর পলাশ মুখচাওয়া চাওয়ি করে জিজ্ঞেস করলো কি সমস্যা। আমাদের বলো। মলি এবার সত্যি লজ্জায় পরে গেলো। এখানে আসলে টাকা কোনো ইস্যু না, মেইন সমস্যা হলো কত বছর যাবত মলি এসব ড্রেসে নিজেকে সাজায় নি। এখন তো দুই বেবির মা, মলি নিজেকে খুব ব্যাক ডেটেড ভাবে আর হীনমন্যতায় ভুগে। কিছুটা ওয়েট গেইন করাতেও মলির নিজেকে কেমন লাগবে সেটা নিয়ে দ্বিধায় থাকে। তাই আসলে এই লেহেংগা নিতে চাচ্ছিলো না।
সবার সামনে এসব প্রকাশ করাটাও অনেক লজ্জার ব্যপার তাই মলি বেশ বিরক্ত হয়ে বলল,
রুমকি তুমি আজো বেশি বুঝো। একটু রাগ দেখিয়ে মলি হন হন করে এগিয়ে ছুটলো। তারা তিনজন ও ছুটলো মলির পিছনে পিছনে।
আরো ঘন্টাখানেক পর তারা বসলো ক্যাফের ফ্লোরে। এত ক্লান্তি আর গরমের জন্য আপাতত খাবারের দিকেই মনোযোগ দিলো তারা। রুম্মকির আর পলাশের বৃহস্পতি বার গায়ে হলুদ। তারা এগুলো নিয়েই আলোচনা করছিলো।
মেয়ে পক্ষের সবাই অরেঞ্জ শাড়ি বা জামা পরবে যে যেটাতে কোম্ফোর্ট পায় আর কি। আর ছেলের পক্ষে সবাই বেগুনি পাঞ্জাবী পরবে। এর মাঝে ফাহাদ বলে উঠে,
“আমি তো ভাই দুই পক্ষের ই তাই ঠিক করেছি সাদা পরবো।”
পলাশ ফাহাদের প্রস্তাব নাকচ করে বলে উঠে,
“সব সময় আমার পাশে থাকবি অথচ বলিশ দুই পক্ষের। আগে তো তুই ছিলি শুধু তাই দুই পক্ষের বলতে পারতি। এখন তুই আমার পক্ষের আর রুমকির পক্ষ নেয়ার জন্য আমাদের মলি আছেনা?? “
সবাই হো হো করে হেসে উঠে, আসলেই তো ভালো যুক্তি দাঁড় করিয়েছে পলাশ।
১৮.
আজকে কয়দিন যাবত আবিদের মন মেজাজ ভালো যাচ্ছে না। ব্যবসায়িক কিছু ঝামেলার জন্য তাকে শীঘ্রই সিংগাপুর যেতে হতে পারে। তাই মানসিক রিলাক্সেশনের জন্য সে আজকাল কেয়ার বাসা ছাড়ছেই না। আজকে রাতেও অফিস থেকে দুইজন একি সাথে আসলো কেয়ার ফ্ল্যাটে।
রাতে ডিনার শেষ করে কেয়ার সব গুছিয়ে আবিদের কাছ আসতে আসতে অনেক সময় লেগে যায়। আবিদ ততক্ষণে চরম বিরক্ত হয়ে ল্যাপটপের কাজে মনোযোগ দিয়ে চেষ্টা করছিলো। এমন সময় কেয়া এসে আবিদ কে জড়িয়ে ধরলো।
আবিদ একটু জোর করে হাত ছাড়িয়ে বলে উঠলো,
“এখন তোমার আসার সময় হলো!!!! “
কেয়া আরেকটু কাছে এসে বলল,” খুব মিস করছিলে? “
” আমি আসিই ত তোমার কাছে একটু শান্তির জন্য। তারপর ও যদি এত অপেক্ষা করা লাগে তাহলে বাদ দাও। আমি আর আসব না। ”
আবিদের এমন কথায় কেয়া চমকে উঠে। তারপর ধীরে সুস্থে বলে উঠে,
“বিয়ে করে বউ বানিয়ে নাও, তাহলে তো এত অপেক্ষা করা লাগে না। “””
এই কথার পর আবিদ কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলো, “বিয়ের মতোন এমন কমিটমেন্টে আমি যাবো না তুমি খুব ভালো করেই জানো। তারপর ও বার বার কয়েকদিন পর পর তুমি এই প্রসংগ তুলো। “
কেয়া আবিদ কে কাছে টেনে বলল, “
কেন আবিদ, আমার কি তোমাকে পুরোপুরি বৈধ উপায়ে সারাজীবনের জন্য পেতে মন চাইতে পার না???”
আবিদ এবার সত্যি রেগে উঠে বলে, ” তোমাকে বা তোমার কোনো চাওয়ার অপূর্ণতা রেখেছি কেয়া? আমার সব শর্ত মেনেই এসেছিলে আমার জীবনে। এখন কেন মানতে পারছো না তুমি। “
কেয়া অসহায় ভংগীতে বলে উঠলো,
“আমারো নিজের তোমার প্রতি সব অধিকার পেতে মন চায়। ওসব হয়ত তুমি বুঝবে না। “
“এসব টিপিক্যাল মেয়েদের মতোন কথা বার্তা বললে আমার পক্ষে রিলেশন রাখা সম্ভব না। দুই দিন পর আমি সিংগাপুর যাচ্ছি, তুমি দুই দিন সময় পাচ্ছো কেয়া। ভেবে চিনতে আমাকে জানাবে প্লিজ। আজ আসি। ব্লাডি হ্যাল। আমার মুড টাই নষ্ট করে দিলে। “
আবিদ হন হন করে বের হয়ে গেলো। কেয়া বসে আছে আধশোয়া ভংগীতে, মুর্তির মতন। নড়লো না টললো ও না শুধু চোখের কয়েক ফোটা পানি ঝড়লো।
চলবে…….