২৭.
একটা সূক্ষ্ম স্নায়ু যুদ্ধ চলছে তিনজনের মাঝে।আকাশ টা ঝলমলে হলেও ঘরের ভিতরের পরিবেশ টা অনেক বেশি মেঘাচ্ছন্ন। ঝড় আসার পূর্বে যেমন রুপ নেয় প্রকৃতি ঠিক তেমন। তবে মলি যেন ঝড়ের গতিবেগ সম্পর্কে বেশ অবগত। শান্ত দেখাচ্ছে বেশ। বরঞ্চ বাকিদের মাঝে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। লনে সবাই একি সাথে বসা। ফাহাদ,পলাশ আর রুমকি আবিদের সাথে পরিচিত হলো। হাত বাড়িয়ে ফাহাদই বলল,
নাইস টু মিট ইউ আবিদ ভাই। আবিদ স্মীত হেসে শুধু উত্তর করলো।হ্যা না কিছুই বলল না। মলির দিকে তাকিয়ে বলল শুধু,
চলো তাহলে, বাসায় যাই। মলি আকাশ থেকে পরেছে এমন ভংগীতে বলল,
বাসায়? কেনো? মাত্রই আসলাম আমরা। তুমি যাও, আমরা পরে আসছি।
আবিদ সবার সামনে জোর ও করতে পারছে না, শুধু বলল, আমরা পরে আবার কখনো সবাই মিলে আসবো। এখন চলো, বাসায় যাওয়া জরুরী।
মলি কিছুই না বুঝার ভান করে বলল, কেন? হঠাৎ কি এত জরুরী। তুমি যাও না আমি বাচ্চাদের নিয়ে রাতে ব্যাক করবো।
আবিদ হতাশ ভংগীতে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পরে বলল ঠিক আছে আমার রুমে আসো। রুমকি ফাহাদ আর পলাশ আমতা আমতা করছিলো। পরিস্থিতি যে খুব একটা ভালো না তা বুঝতেই পারছে। এখানে সবার সামনে আবিদ সাহেব কিছু বলতে পারছে না কিন্তু এতগুলো মানুষের সামনে ভালোও সাজতে পারছে না। আবিদের কথায় মলির কোনো হেলদোল না দেখে আবিদ এক প্রকার টানতে টানতে নিয়ে এলো তার বুক করা রুমে। পিছনে এত গুলো চোখ তখন কি হবে কি হবে চিন্তায় চিন্তিত।
মলিকে নিজের রুমে এনে এক প্রকার ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দেয় আবিদ। মলি রেগে ফুসে উঠে,
তোমার এই রুপ টা সবার সামনে কেন দেখালে না? আড়ালে এনে বউ এর সামনে পুরুষ মানুষ সাজা হচ্ছে?
আবিদ তেড়ে আসে মলির দিকে,
তোমার সাহস কি করে হয় কত গুলো অপরিচিত ছেলের সাথে আমার বাচ্চাদের সহ তুমি এত দূর ঘুরতে এসেছো।
মলি জায়গা থেকে টললো না নড়লো না চুল পরিমান। চোখে চোখ রেখেই বলল,
মারবে আমাকে? থেমে গেলে কেনো? প্রথম কথা ওরা কেউ অপরিচিত নয় আমার ফ্রেন্ডস। দ্বিতীয় কথা সেখানে শুধু ছেলেই ছিলো না রুমকি মানে মেয়ে ফেন্ড ও ছিলো। আর এতদূর ঘুরতে আসার কথা বলছো? আমি তোমার থেকে বেশি সেইফ ফিল করি তাদের সাথে।
এহেন পরিস্থিতিতে মলির কথা বার্তা চাল চলন অংগভংগী দেখে আবিদ যেনো এক নতুন মলি কে আবিষ্কার করে। সাথে সাথে জবাব পেয়ে আবিদ কথা খুজে পায় না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবিদ বলে উঠে,
আমি ব্যাক করছি বাসায়। বাকি কথা বাসায় হবে। আবিদ বের হবে ঠিক ওই মুহুর্তে কেয়া প্রবেশ করে দরজায় নক না করেই। মলি আর আবিদ চমকে উঠে। মলি পিছন ফিরে কেয়া কে দেখে মুচকি হেসে বলে,
কারো রুমে প্রবেশ করার আগে নক করে আসতে হয়। তোমার কি জানা নেই সেটা?
কেয়া তীব্র অপমানের আভাস পেয়ে জ্বলে উঠে,
রুমটা আমার আর আবিদের। তাহলে নক করার প্রয়োজন হবে কেন শুনি?
মলি হেসে উঠে বলে, দারুণ, হাজবেন্ড আমার অথচ রুমটা তোমাদের দুজনের। তাহলে আবিদ তুমি তোমার ক্লাইন্ট দের কেন সত্যি টা বললে না।
আবিদ বিরক্ত হয়ে বলে, প্লিজ তোমরা চুপ করো, কেয়া আমি বেরুচ্ছি।
আবিদ বের হয়ে গেলেও মলি আর কেয়া বের হলো না। পিন পতন নীরবতা ভাংলো কেয়া নিজেই।
আমাকে ছাড়া আবিদ অচল, আমি চাইলে অফিসের সাথে সাথে ঘর ও সামলাতে পারি। তুমি কেন এখনো পরে আছো আমি জাস্ট বুঝিনা।
মলি হাসলো, বিছানার এক টা কোণায় বসলো, তীব্র তাচ্ছিল্য স্বরে বলল,
শো পিস চিনো কেয়া, তুমি হচ্ছো শো পিস। তবে খুব বেশি দামী না। অফিসেই শোভা পায়। কিংবা বাসা বাড়ির ড্রয়িং রুমে। তবে ভেংগে গেলে কিংবা পুরাতন হলে চেইঞ্জ করা যায় খুব সহজেই।
কেয়া ভাষা খুজে পেল না কিছু বলার, চিতকার করে মলির দিকে তেড়ে যায়। ঠিক সেই মূহুর্তে ফাহাদ রুমে ঢুকে পরে। কেয়ার বাড়ানো হাত ধরে ফেলে কঠিন স্বরে বলে উঠে,
ডোন্ট, ডোন্ট ইউ ডেয়ার টু টাচ হার। কেয়া পিছিয়ে হেসে উঠে,
মিসেস আবিদ,আমার আর তোমার মধ্যে পার্থক্য কি? আমি যদি আবিদের শো পিস হয়ে থাকি তাহলে তুমি কার শো পিস।
কেয়া আর দাড়ালো না, হাসতে হাসতে বের হবার আগে পিছন ফিরে তাকিয়ে আবার বলে, তবে মলি তোমাদের মানিয়েছে বেশ। তাই বলছি তুমি যেহেতু কাউকে পেয়েই গিয়েছো, নিজ থেকে সরে গেলে আবিদ আমাকে ঘরের শো পিস না ঘরের মালকিন বানাতে বাধ্য। ভেবে দেখো প্রস্তাব টা।
মলি কাঁদছে, কোনো শব্দ ছাড়া নীরবে কান্না। এই ট্যুরএর মজা টাই নষ্ট হয়ে গেলো। রুমকি কাছে বসে বলল,
ওই নষ্টা মেয়ে টা যা বলে গেলো এসব ভেবে কাদছো? মলি তুমি আগের চেয়ে কত স্ট্রং হয়েছ জানো? তুমি নিজের জন্য ফাইট করতে শিখেছো। আমি কতটা খুশি হয়েছি জানো?
রুমকি মলিকে জড়িয়ে ধরে। পলাশ ভরাট কন্ঠে বলে উঠে,
আমার যা মনে হলো আবিদ ভাই একটা ধাক্কা খেয়েছে। তোমার লুক আপ, গেইট আপে প্রথম ধাক্কার রেশ কাটতে না কাটতেই তোমার কথার জবাবে আরো বিশাল ধাক্কা খেয়েছেন। তবে মলি তোমাকে এভাবেই স্ট্রিক্ট থাকতে হবে।
ফাহাদের দিকে মলি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
আমি সরি ফাহাদ, আমার জন্য এত গুলো বাজে কথা শুনতে হলো।
ফাহাদ রাগত্ব স্বরে বলে, ওহ প্লিজ মলি, সরি কেন বলছো। আমি চিন্তা করছি অন্য কিছু। আবিদ ভাইকে কেয়া কিছু বললে এই ব্যাপারে উনি কিভাবে রিএক্ট করবে!! রুমকি খুশিতে লাফিয়ে উঠে,
এই ফাহাদ, আমরা তো এটাকে কাজে লাগাতে পারি পজিটিভ ভাবে। তাতে যদি আবিদ ভাই এসব থেকে ফিরে আসে জেলাসির চোটে।
মলি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কি বলছে এরা এসব।,কিন্তু বাকি তিনজন মিটিমিটি হেসে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
২৮.
রবিবার সকাল। এত সুন্দর সকাল টা বোধহয় মলি আগে কখনো দেখেনি। পাখির কোলাহল গুলো গান মনে হচ্ছে। চিলতে চিলতে রোদ গুলো জানালার পর্দার ফাকে ফাকে খেলা করে যাচ্ছিল। মলির মন টা পরে থাকে সেই ছোটবেলার বাড়িতে। বারান্দা পেরিয়ে উঠোন, বড়ই গাছ পেয়ারা গাছ আম জাম গাছ। সেই আম গাছের ডালে দোলনা ঝুলানো, আর তাতেই সারাদিন কেটে যেতো মলির।
ছেলেবেলা যতটা সুন্দর আর চিন্তাভাবনাহীন কেটেছে, বড় হউয়ার সাথে সাথে আতংক, নতুন নতুন সমস্যা সব কিছু বেড়েছে। জীবন টাই অনিশ্চিত হয়ে গিয়েছে।
সেদিন রিসোর্ট থেকে এসেই মলি জানতে পারে মলির মা ভাই কে ডাকা হয়েছে মলির বাসায়। ঘুম থেকে উঠেছে ময়নার ডাকে।
— ভাবী সাব ও ভাবী সাব। তাড়াতাড়ি উঠেন। উইঠা দেখেন কেডা কেডা আইছে।
মলি চোখ ডলতে ডলতে ড্রয়িং রুমে এসে দেখলো মলির মা, ভাই মাসুদ এসেছে। তাদের দেখে মলির বুঝতে বাকি নেই যে আবিদই তাদের আসতে বলেছে। কিন্তু মলির কোনো হেলদোল নেই। ধীরে সুস্থে ডাইনিং এ এসে জগ থেকে ঢেলে এক গ্লাস পানি খেলো। তারপর তাদের সামনে এসে বসলো। বসতে বসতে বলল,
— নাস্তা করে এসেছো তোমরা নাকি ময়না কে বলবো নাস্তা দিতে টেবিলে। মলির এত সাভাবিকতা দেখে মাসুদ চটে গেলো। সে কঠোর গলায় বলে উঠলো,
—- এসব কি শুনছি মলি? তুই বাচ্চাদের নিয়ে একদল ছেলেদের সাথে গাজীপুরে গিয়েছিলি বেড়াতে। তোর কি মাথা পুরাটাই গিয়েছে।
মলি কিছু বলল না, গ্লাসে আস্তে করে চুমুক দিয়ে দিয়ে পানি খাচ্ছিলো। মলির মা জোড়েশোরে বলে,
—- তোকে কি জিজ্ঞেস করছে তোর ভাই, কথার জবাব দিচ্ছিস না কেনো। লজ্জা শরমের মাথা খেয়েছিস তুই?
আবিদ এসে পরে, তারপর বলে
— ওকে আর কি জিজ্ঞেস করছেন আপনারা। আমি তো সব বলেছি ই। এখন আপনাদের ডেকেছি শুধু আপনাদের মেয়ে কে আপনারা বুঝিয়ে যান না সে না বুঝতে চাইলে সাথে নিয়ে যান।
মলির মা একদম মিইয়ে যায়। সোফা থেকে উঠে এসে আবিদের সামনে দাঁড়ায়। মিনতির সুরে বলে
—- বাবা তুমি রাগ করো না, আমি বুঝাচ্ছি ওকে। তেড়ে এসে মলির দিকে বলে উঠে,এই মলি, উঠ এখুনি, আবিদের কাছে মাফ চা। আর কখনো তুই আবিদের অনুমতি ছাড়া কোথাও যাবি না। বল এখুনি।
মলি তখনো চুপচাপ বসে আছে। মাসুদ ও মলির মা আবিদ কে বুঝিয়ে যাচ্ছে যে মলি ভুল করেছে, সে সংসারে মনোযোগ দিবে। বাচ্চাদের নিয়েই বিজি থাকবে আরো নানান কিছু। ঠিক তখন ই মলি উঠে চলে যাচ্ছিলো। মাসুদ মলির হাত ধরে ফেলে, তারপর চেচিয়ে উঠে,
— কথা কানে যাচ্ছে না তোর? আবিদ ভাই এর কাছে মাফ চা।
মলি তার ভাইএর দিকে তাকিয়ে বলে,
— সব তো তোমরাই বলছো। মাফ টাও তোমরাই চাও তবে।
ঠিক তখন ই মলির গালে কষে থাপ্পড় পরে।মাসুদ থাপ্পড় দেয়ার পর ও মলির কোনো পরিবর্তন হলো না, ভাই এর দিকে তাকিয়ে বলল,
—- আমি কোনো অন্যায় করিনি, তাহলে কেন সরি বলবো? তোমরা আমার চেয়ে বেশি আবিদ কে আপন ভেবে থাকলে তাই সই। কিন্তু যে অন্যায় আমি করিনি সেটার জন্য সরি আমি কেন বলবো। সরি বলতে হলে আবিদ বলবে, সাথে কেয়া ও বলবে। সরি বলবে আমার বিশ্বাস ভাংগার জন্য, আমার এত বছরের সংসারে অশান্তি আনার জন্য, আমার বাচ্চাদের থেকে তার বাবা কে সরিয়ে নেয়ার জন্য, আমার এই সংসারে এত ত্যাগের কোনো মূল্যায়ন না করার জন্য। আমি সরি বলবো না।
মাসুদ,মলির মা আর আবিদ কিছুক্ষণ থ বনে ছিলো। তারপর মলির মা বলে উঠে,
—- বিয়ের আগে পরে ছেলে মানুষের একটু আকটু মেয়ে ঘটিত সমস্যা থাকেই। আবিদের থাকলে থাকুক, তুই কেন নতুন করে নাগর খোজা শুরু করলি?
মলি স্তব্দ নিশ্চল চোখে চেয়ে মা কে বলে,
— নাগর আমি খুজিনি, আমার জন্য সতীন এর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
মাসুদ মা কে তাড়া দিয়ে বলে,
— চলো মা এখানে থেকে লাভ নেই। আমাদের কথার ও দাম নেই। আবিদ ভাই আপনি যা ইচ্ছা আপনার স্ত্রীর সাথে করতে পারেন আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। শুধু একটাই কথা মলি যেন আমাদের বাসায় গিয়ে না উঠে। যে মেয়ে স্বামীর ভালো নিজের ভালো বুঝে না সে মেয়েকে আমাদের বাড়িতে জায়গা দেয়া যাবে না। আমি চাইনা ও আমার সংসারে গিয়ে অশান্তি করুক।
মাসুদ ও তার মা চলে গেছে। মলি আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। যতটুকু নিজের মনোবল গড়েছিলো ততটুকুই ভেংগে গুড়িয়ে দিলো তার আপন ভাই ও মা। আবিদ মলির কাছে আসে। হাত দুইটা ধরে সান্তনা দেয়ার ভংগীতে বলতে থাকে,
—- যা হয়েছে সব ভুলে যাও, আমি তো সত্যি বলতে চাইনা তুমি আমাকে আমার সংসার ফেলে চলে যাও। আমি বরাবর ই চেয়েছি তুমি আমার সংসারের রানী হয়ে থাকো।
মলির চোখ ধক করে জ্বলে উঠে,
—- তাহলে রানীর জায়গা রানীর সম্নান বুঝি এভাবে করতে হয় আবিদ???
আবিদ হেসে উঠে,
—- আরে বোকা তোমার ভাই আর মা কে এনেছি তোমাকে বোঝানোর জন্য, আমি তোমাকে ছেড়ে দিলে তোমার যে যাবার জায়গা নেই কোথাও সেটা তো তুমি রিয়েলাইজ করতে পারতে না। এখন ঠিকই রিয়েলাইজ করতে পারবে। আর আশা করি আমার এগেইন্সটে কিছু করার সাহস করবে না তুমি।
মলি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে, আবিদ কে তার কাছে পিশাচ লাগছে। নিচে নামতে নামতে সে বিন্দু পরিমান সম্মানবোধের জায়গা রাখেনি মলির জীবনে। মলি চোখ মুছে আবিদ কে বলে,
—- তুমি যদি নিজের ইচ্ছা মতোন চলতে পারো তবে আমি কেন পারবো না???
আবিদ কঠোর কন্ঠে বলে উঠে,
—– বিকয ইউ আর মাই ওয়াইফ। এবং আমি একজন পুরুষ মানুষ। পুরুষ মানুষের জীবনে অনেক নারীই থাকতে পারে। কিন্তু তাই বলে ঘরের বউ বাইরে ফষ্টি নষ্টি করে বেড়াবে???
আবিদ, মলি চিতকার করে উঠে,
—– আমার এত অধপতন হয়নি যে আমি নিজেকে তোমার কাতারে ফেলবো। ওরা আমার কলেজ লাইফের বন্ধু। আমি কখনোই তোমার এক্সট্রা ম্যারিটাল এফ্যায়ারের কথা তাদের বলি নি। বরঞ্চ তুমি নিজেই নিজের মান সম্মান খুইয়েছো।
আবিদ দাতে দাত চাপে,
—- যা হবার হয়েছে। এখন থেকে এসব টাইম স্পেন্ডিং বাদ দাও। তোমার কাজ আমার ঘর আর বাচ্চা সামলানো। বাইরে টই টই করা না।
মলি আবিদের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
— আর ঘরের মালিক জলজ্যান্ত মানুষ টাই ঘরে থাকে না, তাহলে ঘর সামলে কি হবে আবিদ!!!
চলবে……