কলমে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(৩২)
মিথিলা এক ছুটে নিজের ঘরে এলো। বিধ্বস্তের ন্যায় পায়ের গতি। কান্নায় কণ্ঠ বুজে আসছে। এই ক্ষুদ্র জীবনে এতো বড়ো অপমান সে কোনও দিন হয়নি। শেষে কী না একটা দুশ্চরিত্র লোকের সাথে বিয়ে হলো? যে নিজের স্ত্রীকে বাইরের মেয়ের কাছে কাজের লোক বলে পরিচয় দিতেও দুবার ভাবে না!
কান্নার তোপে মিথিলার হেঁচকি উঠে যায়। প্রতি পরতে পরতে মেয়েটার বুক জুড়ে পরিতাপের জোয়ার ফুঁসল আজ । লোভের কারণে কারো সত্যিকারের ভালবাসাকে পায়ে ঠেলে, পলাশকে বেছে নেয়ার শাস্তি হয়তো এটাই! এত অসম্মান তো লেখাই ছিল কপালে।
মিথিলা ঠোঁট ভেঙে ভেঙে কাঁদল। সেদিনের মতো নাহিদের মুখখানা মানস্পটে স্পষ্ট রূপে ভাসছে। ইস,ছেলেটা কত ভালোবাসত ওকে! আর ও কী করল? টাকা-পয়সা, কানাডায় বাড়ি-গাড়ির লোভে মুখের ওপর অবজ্ঞা করল সব কিছু।
তাদের বছর দুয়েকের প্রেমের দিন গুলি ছবির মতো মনে পড়ে মিথিলার।
প্রতিটা সাক্ষাৎ-য়ে হাতে ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত নাহিদ। আর প্রতিবার দেরি করে পৌঁছুত সে। অথচ ছেলেটা কোনওদিন অভিযোগ করেনি। মিথিলা যা কিনতে চায়,যা খেতে চায় সবটা দুহাতে তুলে আনত নাহিদ। তার দুচোখ ভরতি শুধু ভালোবাসা ছিল! যেথায় কোনও খাদ নেই, খামতি নেই। কাউকে নিয়ে ভাবা তো দূর,অন্য মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকায়নি অবধি৷ অথচ
বিনিময়ে মিথিলা কী দিয়েছে? নরম গলায় কোনওদিন একটা কথা বলেনি ওর সাথে। দূর-ছাই করেছে সব সময়।
কীসের আশায়,কোন সুখে হীরে ছেড়ে কাচ বেছে নিলি মিথিলা?
মেয়েটা প্রশ্ন করল নিজেকেই ৷ উত্তর না এলেও,বেড়ে গেল কান্নার গতিবেগ। হঠাৎ চোখ পড়ল ব্লাঙ্কেটের এক ফাঁক গলে ফোন বেরিয়ে আছে পলাশের। অমনি তীরস্থ হলো মেয়েটা। চোখ মুছে ত্রস্ত গিয়ে ফোন হাতে তুলল। পলাশের লক ওর জানা। পাশাপাশি শোবার সময় কয়েকবার আড়চোখে দেখেছিল। মিথিলা ত্রস্ত ঢুকল অনলাইনে। লিস্ট ঘেটে কল করল বাবাকে। বিধিবাম! ঝড়ের বেগে ফোনটা হাত থেকে ছিনিয়ে নিলো কেউ একজন। মেয়েটা ভরকায়। গোল চোখের চাউনীতে ধরা পড়ে পলাশের মিইয়ে থাকা মুখ। লাইন কেটে দিতেই মিথিলা রাগে আগুন হয়ে বলল,
“ ফোন নিয়েছ কেন? আমি আমার বাবার সাথে কথা বলব পলাশ। ফোন দাও।”
পলাশের দৃষ্টি কোমল। অমন নম্র স্বরেই বলল,
“ মিথিলা আমার কথাটা শোনো, এসব সামান্য বিষয় নিয়ে কেন পরিবার জানাতে হবে? এমন টুকটাক ঝামেলা তো প্রতিটা স্বামী-স্ত্রীর মাঝেই হয়।”
মিথিলা অবাক হয়ে বলল,
“ সামান্য? এই ব্যাপারটা তোমার কাছে সামান্য পলাশ? বিয়ের পরেও তুমি আরেকটা মেয়ের সাথে লাগাতার ঢলাঢলি করে যাবে,তার কাছে আমাকে পরিচয় করাবে আমি কাজের লোক? সেই মেয়ের জন্যে গায়ে হাতও তুলবে আমার? আর এসব কিছু সামান্য ভেবে আমি মনে নেব? আমাকে তোমার এতটাই বোকা মনে হয়?”
পলাশ জ্বিভে ঠোঁট ভেজাল। ঠিক এই অশান্তির ভয়েই ছিল এতদিন। বলল,
“ দ্যাখো মিথিলা,জেনি ভুল বলেছে। ও কেন আমার গার্লফ্রেন্ড হবে? শী ইজ মাই ফ্রে..”
পথিমধ্যেই আঙুল তুলল মিথিলা। কড়া কণ্ঠে সাবধান করল,
“ মিথ্যে কথা বলবে না পলাশ। আমি কচি খুকি নই যে তুমি আমায় যা বোঝাবে তাই বুঝব। ছি!ছি! আমার ভাবতেও ঘেন্না করছে যে তোমার মতো এরকম একটা দুশ্চরিত্র ছেলের সাথে বিয়ে হয়েছে আমার।”
পলাশের চাউনী বদলে গেল সহসা। হুঙ্কার ছুড়ল মৃদূ গলায়,
“ মিথিলা!”
“ একদম চোখ রাঙাবে না। তোমায় আমি ভয় পাই? লজ্জা করে না? লজ্জা করে না,এরকম নোংরা কাজ করে আবার চড়া গলায় কথা বলতে?”
“ আমি আবারও বলছি, তুমি ভুল ভাবছো। জেনির সাথে আমার এমন কোনো সম্পর্ক নেই। হতে পারে ও আমাকে অন্য চোখে দ্যাখে,কিন্তু আমি তো জানি আমার বউ আছে তাই না?”
“ চুপ,একদম চুপ। এতগুলো মিথ্যে গড়গড় করে বলতে একটু বাঁধছেও না মুখে? আমি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না পলাশ।
এইজন্যেই,এইজন্যেই প্রথম থেকে তোমাদের হাবভাব নিয়ে সন্দেহ হচ্ছিল আমার। এখন তো সব জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল! ছি! ছি! এতোটা নির্লজ্জ তুমি হতে পারলে পলাশ? ঘরে বউ রেখে অন্য মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাকে কী বলে জানো?” , আ
হঠাৎ রাগের মাঝেও হেসে ফেলল পলাশ। তুচ্ছ তার হাসির ধরণ। বিদ্রুপ করে বলল,
“ এসব তুমি বলছো? যে মেয়ে টাকার জন্যে নিজের পুরোনো প্রেম ছেড়ে লাফিয়ে আসে আমায় বিয়ে করতে,সে মেয়ে বলছে এসব কথা?”
“ হ্যাঁ বলছি। কারণ আমি যা করেছি বিয়ের আগে। তোমার মত বউ-গার্লফ্রেন্ড সব একসাথে মেইনটেইন করিনি।
আমার ওই এক অতীত নিয়ে আর কতবার খোটা দেবে? খুঁজতে গেলে অমন হাজারখানেক অতীত তোমারও বেরিয়ে আসবে পলাশ। অবশ্য অতীত খোঁজার কী দরকার? চোখের সামনে যার একটা জঘন্য বর্তমান পড়ে আছে,তাতেই তো চরিত্র স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
পলাশ কটমট করে বলল,
“ বারবার আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলবে না।”
মিথিলা পালটা চ্যাঁচায়,
“ বলব,একশবার বলব। কী করবে হ্যাঁ? সত্যি কথা শুনতে
খুব গায়ে লাগছে তাই না? তুমি আসলেই একটা নোংরা, দুশ্চরিত্র লম্পট ছে…”
কথা শেষ হয় না। পূর্বেই মেয়েটার সেই একই গালে দ্বিতীয় চড় বসাল পলাশ।
অথচ একটু আগের প্রহারের আঁচই কাটেনি। লালচে কপোলে ফের আঘাতে চামড়া সুদ্ধ বিবশ হয়ে থাকে। আর্ত চোখ তুলে চাইল মিথিলা। কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে জল। ভেজা কণ্ঠে হতবাক হয়ে বলল,
“ তুমি আবার আমাকে মারলে পলাশ? আবার?”
পলাশ ক্ষুব্ধতায় একাকার হয়ে বলল,
“ হ্যাঁ মারলাম। দরকার পড়লে আবার মারব। এখানে তোমার বাবা মা নেই যে আহ্লাদে যা ইচ্ছে তাই করবে। আর একটা শব্দও উচ্চারণ করলে মারতে মারতে তোমায় শেষ করে দেব মিথিলা।
আমার বাড়িতে, আমার টাকায় খেয়ে-পরে থাকতে হলে চোখ নামিয়ে কথা বলতে হবে। এটা তোমাকে আগেও বলেছি,আবার বলছি। মেয়ে মানুষের এত ঔদ্ধত্য আমি পছন্দ করি না।”
মিথিলা দমে যাওয়ার মেয়ে নয়। আঘাতের ধাত সামলে উঠল মিনিটে। স্ফূলিঙ্গের ন্যায় জ্বলেপুড়ে বলল,
“ পারব না আমি। তিন বেলা কটা খাওয়াচ্ছো বলে তোমার সব অন্যায় মেনে নিতে হবে?
আগে অন্তত যেমন তেমন ছিল। আমাকে কাজ করাতে,খাটাতে৷ কিন্তু তাই বলে আমার চোখের সামনে একটা অন্য মেয়ের সাথে নোংরা সম্পর্ক রাখবে,আর আমি বসে বসে দেখব?”
পরপরই হুহু করে কেঁদে উঠল মেয়েটা। চটচটে মুখ ঢেকে প্রলাপ করল বোজা স্বরে,
“ আমি কতো বড়ো ভুল করেছি। কতো বড়ো পাপ করেছি একজনকে ঠকিয়ে। নাহলে আমার কপালে এমন স্বামীই জুটল? যে কী না ঘরে বউ রেখে, সংসার রেখে এসব পরকীয়ায় লিপ্ত হয়! আল্লাহ,এখন আমার কী হবে? আমার ঘেন্না লাগছে নিজেকে! এমন ছেলে দিনের পর দিন ছুঁয়েছে আমাকে। দিনের আলোতে যদি ওরা এত গা ঘেষতে পারে,না জানি এতদিন ধরে কী কী করে বেড়িয়েছে। ছি!”
পলাশ দাঁত খিঁচে চোখ বুজল। দম ঝাড়ল দীর্ঘকায়। মিথিলা হড়বড় করছে তখনও,
“ এসব করার আগে একবারও নিজের কথা ভাবলে না পলাশ? একবারও নিজের সংসারের কথা ভাবলে না? এতোটা নিচ তুমি!’’
ও চ্যাঁচিয়ে উঠল অমনি,
“ কীসের বউ হ্যাঁ? কীসের সংসার? কীসের কথা বলছো তুমি? এগুলোর মানে তুমি বোঝো মিথিলা? তখন থেকে স্বামী স্বামী করে যাচ্ছো,অথচ
আজ অবধি সেই স্বামীর জন্য ভালোবেসে এক কাপ চা বানিয়েছ? কখনও অফিস থেকে দেরি করে ফিরলে ফোন করে খবর নিয়েছ আমার? দু বেলা রান্না করতে যাও আমাকে কত গালাগাল করে আমি জানি না? কী দেখে সংসার করব তোমার সাথে? না আছে রূপ,না আছে গুণ! আর না আছে আমার প্রতি কোনো রকম কোনো যত্ন। সব সময় নিজের মতো আরাম আয়েশে থাকতে চাও।
আমাকে বিয়েটাও তো ভালোবেসে করোনি। করেছিলে টাকার লোভে। ছেলে কানাডায় সেটেল্ড৷ বড়ো চাকরি করে জেনে নিজের দুই বছরের সম্পর্ক এক কথায় শেষ করে দিয়েছিলে। তার থেকে সব রকম সুবিধে নেয়ার পরেও, লালা ফেলতে ফেলতে এসে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছ। তাহলে এখন এতো আহাজারি কীসের তোমার? যেই আমার একটা দূর্বলতা পেয়েছ অমনি সাধু সাজছো তাই না?”
মিথিলা ফিরতি জবাব দিলো,
“ তোমার কাছে আমার সাধু সাজার কোনো দরকার নেই পলাশ। কারণ আমি যাই করে থাকি,তোমার আর জেনির এই নোংরামো সেই সব কিছুর উর্ধ্বে। নাহিদের সাথে সম্পর্ক থাকলেও,ও আমার হাত ছাড়া অন্য কোথাও ছোঁয়নি আজ অবধি। কিন্তু তুমি? তোমরা কী করে বেড়াচ্ছো সেসব তো আমি
নিজের চোখে দেখছি। পাপের কথা বড়ো মুখ করে এখনও অস্বীকার করে যাচ্ছো! লজ্জার ছিটেফোঁটাও কি তোমার মধ্যে নেই?”
“ না নেই। তো কী হয়েছে? আচ্ছা,তোমার সত্যিটা শোনার এত শখ? ঠিক আছে যাও মেনে নিলাম। জেনি সত্যিই আমার গার্লফ্রেন্ড। এক দুদিনের নয়,গত দেড় বছর ধরে আমাদের সম্পর্ক। হয়েছে? শান্তি পেয়েছ এখন?”
মিথিলা স্তম্ভিত হয়ে আওড়ায়,
“ পলাশ?”
ছেলেটা তেতে ওঠে,
“ কী পলাশ? এখন অবাক হওয়ার নাটক করছো কেন? তোমার কি মনে হয়,এই বিয়েটা আমি স্বেচ্ছায় করেছিলাম? না। একদমই নয়। এত বছর পর দেশে গিয়ে শুনলাম,মা আমার জন্য মেয়ে ঠিক করে রেখেছে। না করিনি। ভাবলাম,মনের মতো মেয়ে হলে জেনি টেনি সব বাদ দিয়ে দেব। কিন্তু তুমি আমার মনের মতো তো দূর,তার আশেপাশেও নও। না দেখতে,না শুনতে। কিন্তু লোভ আছে সাড়ে ষোল আনা। তাও অমত করিনি। কারণ শুনলাম তোমার বাবা বিয়েতে শুধু মেয়ে দিচ্ছেন না,সাথে নগদ টাকা আরও অনেক কিছু আসবে। ভেবেছিলাম তোমাকে ওখানে রেখে এসে,এখানে নিজের মতো থাকব। কিন্তু কী হলো তারপর? মা বললেন, মেয়ে বরের সাথে কানাডা আসবে এমনই নাকি কথা ছিল দু-পক্ষের। আমার এত মেজাজ খারাপ লাগছিল!
তারওপর এলাকা সুদ্ধ লোকের সামনে জানলাম তোমার চরিত্র ঠিক নেই। ঠিক তক্ষুনি একটা মোক্ষম অজুহাত গড়িয়ে তোমাকে ফেলে আসতে চাইছিলাম। কিন্তু তুমি এতো চালাক একটা মেয়ে! রীতিমতো থানা-পুলিশের হুমকি দিয়ে আমার সাথে এসেছ। সেদিনই ভেবে রেখেছিলাম,একবার তোমাকে নিয়ে এসে এখানে ইচ্ছেমতো কাচব। লোভের যে রঙিন চশমা পড়েছিলে এতদিন? সব ছুটিয়ে দেব একদম। তোমাকে তোমার পরিবার থেকে দূরে রাখতেই তো ইচ্ছে করে এখানকার সিম কিনে দেইনি।”
মিথিলার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বাকরুদ্ধ মেয়েটা কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারে না।
পলাশ নিজেই ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
“ সত্যি কথা হলো আমার বউ হওয়ার কোনো যোগ্যতাই তোমার নেই। আরে, এর চাইতে ভালো হোতো যদি তোমাদের বাড়ির আশ্রিতা মেয়েটাকেও বিয়ে করতাম। কী যেন নাম? হ্যাঁ পুষ্পিতা। ওর অন্তত রূপ আছে। কিন্তু তোমার কী আছে মিথিলা? তোমার কীসের এতো দম্ভ? শরীর ভরা জেদ,লোভ আর হিংসে ছাড়া কোনো গুণই তো আমার চোখে পড়ে না। বাবা মা সারাদিন গাণ্ডেপিণ্ডে গিলিয়েছে। সংসার কী জিনিস সেসব জানো? জেনি সম্পূর্ণ একটা কানাডিয়ান মেয়ে হয়েও, আমার জন্য কত বদলেছে নিজেকে দেখছো? আমার পছন্দের রান্না করে আনে দেখেছ?
নিজেই ভাবোতো, ওর কাছে কেন যাব না আমি? স্বামীকে ঘরে আটকে রাখার মতো ক্ষমতা আছে তোমার? তুমি কি জেনির পায়ের যোগ্যতাও রাখো?”
মিথিলার কণ্ঠরোধ! আরেকটাও উচ্চবাচ্য না করে,আহতের ন্যায় ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়। চোখের জল গলগল করে গলায় ছুটে যাচ্ছে।
খুব আস্তে বলল,
“ আমাকে দেশে দিয়ে আসবে? প্লিজ!”
পলাশের কণ্ঠ শক্ত,
“ দেশে যাওয়া কি মামার বাড়ির আবদার না কি? কত টাকা পয়সার ব্যাপার জানো?”
“ আমার বাপিকে একটা ফোন দাও। যা লাগে দিয়ে দেবে। দয়া করে আমায় দিয়ে এসো পলাশ। আচ্ছা বেশ,তোমাকে যেতে হবে না,আমায় পাঠিয়ে দাও। তুমি ঠিকই বলেছ,সংসার করার কোনও যোগ্যতাই আমার নেই। তাই আমি চলে যাই।
তারপর তুমিও শান্তিতে থাকো। আমিও একটু মুক্তি পাই। এই কানাডার মাটিতে দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার। আমি আর এক মুহুর্তও থাকতে পারছি না এখানে। বিশ্বাস করো পলাশ, নিঃশ্বাস আটকে মরে যাব আমি।”
পলাশ তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। মিথিলার চোখ ভরতি টলটলে জল। সাথে গাল, গলা নেমে সব বুক অবধি আসছে।
ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবল সে। বলল,
“ ঠিক আছে। তোমার যাওয়ার বন্দোবস্ত করতে পারি। তবে হ্যাঁ একটা শর্তে..”
অনেক আশা নিয়ে মুখ তুলল মিথিলা। স্বরের হাল অনুচ্চ,
“ কী শর্ত?”
“ যেতে হলে,ডিভোর্স পেপারে সই করে দিয়ে যেতে হবে।”
মিথিলা কিংকর্তব্যবিমুঢ়! অথচ সেই মুঢ়তা শরীর ছোঁয় না পলাশের৷ নিরুদ্বেগ ভাবে কাঁধে তোয়ালে ঝোলায় সে। বলে যায় নিরেট স্বরে,
“ শাওয়ারে যাচ্ছি। বের হতে হতে ভাবো কী করবে!”
ওয়াশরুমে ঢুকে গেল তারপর।
মিথিলা নিথরের ন্যায় ঠায় বসে রয়। কেন, কীজন্য,কিংবা কীসের কারণে মেয়েটা জানে না । শব্দ করে কেঁদে উঠল হঠাৎ।
আলোয় ভরা সকাল যখন কড়া রোদের হয়? সেই আলো এসে ছিটকে পড়ে তার কান্নাভেজা মুখেও। অলিন্দ গুলো কৌতূহলে ফেঁপে উঠতে চায়। জিজ্ঞেস করে,
“ নাহিদ কি এখনও আমার অপেক্ষা করছে?”
****
দুপুর বারোটা বাজে প্রায়৷ ঘরের কাঠের চেয়ারটার ওপর ছড়িয়ে রাখা তীব্রর শার্ট-প্যান্ট। আর সেইদিকে
ওৎ পাতা শিকারীর ন্যায় চেয়ে আছে নাহিদ। এই প্যান্টের পকেটেই সে নূহার দেয়া চিঠিটা রেখেছে। না না, নূহার নয়। পুষ্পিতার লেখা চিঠি। তবে ভেতরে কী লেখা নাহিদ পড়েনি৷ অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানোর স্বভাবটা তার চিরকাল লঘু।
তবে,ছেলেটার বুকখানা উত্তেজনায় ফাটছে।
গতকাল ঢাকা থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে এখানেই প্যান্ট মেলে রেখেছিল তীব্র। এতো বেলা হলো! অথচ এখনও কী ভোসভোস করে ঘুমোচ্ছে দ্যাখো।
আজ শুক্রবার বলে সজাগ হওয়ার কোনও নামই নেই। কিন্তু নাহিদের যে আর তর সইছে না ৷ বিট্টু কখন উঠবে,আর কখন পরবে প্যান্টটা?
এর মাঝেই তীব্র নড়েচড়ে উঠল। এতক্ষণে ঘুম ভেঙেছে জনাবের। অমনি তীরস্থ হয়ে উঠে দাঁড়াল নাহিদ।
তীব্র চোখ মেলল, শোয়া থেকে উঠে বসে আড়মোড়া ভাঙল দুহাতের। তন্দ্রিত সাদা চোখ দুটো তাক হতেই নাহিদ থতমত খেয়ে দৃষ্টি নামায়। ভ্রু কুঁচকাল ও। নিরেট,জমাট কণ্ঠস্বর ঘুমের জন্য গাঢ় শোনাল,
“ কী হয়েছে?”
নাহিদের ফটাফট জবাব,
“ কই, কিছু না তো। কী হবে?”
তীব্র আর কথা বাড়ায় না। ওয়াশরুমের পথ ধরে চুপচাপ। উদাম দেহের কোমরের অংশে ট্রাউজার দাগ তুলে চেয়ে। যেতে যেতে চেয়ারের ওপর থেকে শার্ট-প্যান্ট তুলে নিলো হাতে। তুরন্ত, নাহিদের চোখ দুটো চকচক করে উঠল। বিট্টু নিশ্চয়ই চেঞ্জ করবে এখন। আর প্যান্টটা পরতে গেলেই তো পকেটে চোখ যাবে৷ তখনই চিঠি পাবে হাতে। উফ! নূহা যে উৎসাহ আর আয়োজন নিয়ে দিয়ে গেছে এটা। কোনো না কোনো ভ্রম্মাস্ত্র তো নির্ঘাত আছে এতে!
এইবার সেই অস্ত্রের ঘায়ে বিট্টু-পুষ্পিতার প্রেম জমে যাবে! আহা, ভাবা যায় এতো বড়ো একটা কাজে নাহিদ নিজে অবদান রাখছে? ভবিষ্যতে যখন বিট্টুর ছেলে-মেয়ে হবে,গর্বে বুক ফুলিয়ে ওদের এই গল্প শোনাবে নাহিদ। ভাবতেই, ছেলেটার শরীর সুদ্ধ গলে যাচ্ছে আনন্দে।
ঠিক সেসময়, ওয়াশরুমের ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে আসে তীব্র।
নাহিদ ত্রস্ত পেছন ফিরে চাইল। তীব্রর হাতে ব্রাশ। কাছে এসে বলল,
“ নাস্তা এনেছিস?”
নাহিদ উত্তর দিলো না। কপাল কুঁচকে ওর আপাদমস্তক দেখল এক পল। যেমন ভাবে ঢুকেছিল,তেমন ভাবেই বাইরে এসেছে তীব্র। কই,চেঞ্জ তো করেনি। বিভ্রমে চোখ পিটপিট করে বলল,
“ তোর প্যান্ট কোথায়?”
তীব্র নিজেতে চোখ বোলায়। বুঝতে না পেরে বলে,
“ পরেই তো আছি। এমন ভাবে দেখছিস, যেন শালা পরনে কিছুই নেই।”
নাহিদ ফের থতমত খেল। পরপরই উদ্বীগ্ন হয়ে বলল,
“ তুই যে প্যান্টটা একটু আগে সাথে করে নিয়ে গেলি, সেটা কোথায়? ওটা পরবি না?”
সদ্য ঘুম ভাঙায় তীব্রর মেজাজ বেশ চড়া৷ এত অল্পতেই রেগেমেগে বলল,
“ কেন? তাতে তোর কী? আমি প্যান্ট পরব না প্যান্ট ছাড়া থাকব সেটা আমার ব্যাপার। তুই কি আমার ঘরের বউ যে প্যান্ট নিয়েও এখন জবাব দিতে হবে?”
নাহিদ অতীষ্ঠ হয়ে বলল,
“ উফ কী যে বলিস তুই! গুণ্ডার পোশাক আশাক ভালো হলেও, ব্যবহার কোনোদিন ভালো হয় না।”
বলতে বলতে চপল পায়ে নিজেই এগিয়ে এলো সে। তীব্রর পাশ কাটিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। চোখের হোচট খেয়ে ছিটকে পড়ল অমনি। আর্তনাদ করল সজোরে,
“ এ কী! এটা তুই কী করেছিস?”
তীব্র সুন্দর মুখটা কোঁচকায়,
“ হয়েছে টা কী?”
নাহিদ মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“ তুই প্যান্টটাকে পানিতে ভিজিয়েছিস কেন?”
তীব্রর সব মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। মহাবিরক্ত হয়ে বলল,
“ এতো ঢং করছিস কেন? ময়লা হয়েছে তাই ভিজিয়ে রেখেছি। এমন ভাব করছিস যেন আজ অবধি কাউকে জামাকাপড় ধুতে দেখিসনি।”
নাহিদ কোনও কথায় কান দিলো না। একেবারে দৌড়ে গিয়ে ফ্যানা ভরতি পানির বালতি থেকে প্যান্ট টেনে তুলল ওপরে। ঝপঝপ ঝপঝপ করে জল ঝরছে তা থেকে।
ছেলেটা দ্রুত পকেট হাতাল। মনে একটুখানি আশা! পাছে চিঠিটা যদি অক্ষত থাকে এখনও। বিধিবাম!
সার্ফ-এক্সেলের ছোঁয়ায় কাগজ গলে টলে একাকার। পকেটের ভেতর হতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে নাহিদের আঙুলে চলে এলো। বেচারার চেহারাটা চুপসে গেল হতাশায়। সব উচ্ছ্বাস নেতিয়ে যাওয়ার সাথে দারুণ এক ভয় জাগল মনে। এখন কী হবে? মিস নূহা যদি এসব ঘটেছে শোনেন! এমনিতেই সারাদিন ঢেঁড়স বলে ডাকে। এরপর কী বলবে তাহলে?
তীব্র দরজায় দাঁড়িয়ে ওর হাবভাব দেখছিল। ছেলেটা ব্যর্থতার তোপে কেমন পাথর হয়ে আছে।
“ সমস্যা কি তোর নাহিদ? কী হয়েছে একটু বলবি আমায়?”
নাহিদ ফোস করে দম ফেলল। প্যান্টটাকে আগের জায়গায় রেখে ঘুরে চাইল ওর দিক। কণ্ঠে তার উপচে পড়ছে বেদনা,
“ কিছু হওয়ার আগেই তো সব শেষ করে দিলি। যা বুঝলাম,এতো তাড়াতাড়ি আমার চাচা হওয়া হবে না।”
তারপর মুখ কালো করে চলে গেল ছেলেটা। তীব্রর মেজাজ বিগড়াল। বিড়বিড় করল বীতঃস্পৃহায়,
“ শালা ভুলে ছেলে হয়ে গেছে। মাঠের গরু কোনওদিন মানুষ হয়?”
****
ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে নূহা। মাঝেমধ্যে অশান্ত পায়ে হাঁটছে দুদিক। ওদিকে আকাশের বুকে দাপট চলছে মেঘেদের। হালকা-পাতলা বাঁজ পড়ছে কোথাও। বেশ আয়োজন করে বৃষ্টি আসবে হয়ত।
নূহা অপেক্ষা করছিল নাহিদের। কাজটা ঠিকঠাক হলো কী না জানতে!
মিনিট কয়েকেই বেরিয়ে আসে সে৷ সন্তর্পণে দোর চাপায় প্রথমে। নূহা অমনি মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াল। উত্তেজিত কণ্ঠেও ফিসফিস করে বলল,
“ রেখেছিলেন চিঠিটা? পড়েছেন উনি? কী বললেন পড়ে? বুঝতে পারেনি তো কিছু?”
এতগুলো প্রশ্নের পিঠে কেবল মুখ গোঁজ করে চেয়ে থাকল নাহিদ। ভেতরটা তার আফসোসে চৌচির৷ এখন কী করে বলবে? তীব্র চিঠি পড়া তো দূর,হাত দিয়ে ছোঁয়ওনি।
নূহা অধৈর্য হয়ে বলল,
“ আরে হলোটা কী? কথা বলছেন না কেন?”
ও খুব মন খারাপ করে বলল,
“ আসলে মিস নূহা,একটা বড়ো অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে বুঝলেন।”
মেয়েটা আঁতকে বলল,
“ অ্যাক্সিডেন্ট? কার অ্যাক্সিডেন্ট? তীব্র স্যার ঠিক আছেন তো?”
“ আরে সেরকম কিছু না। চিঠিটার কথা বলছি। ”
নূহা নাক-চোখ কোঁচকাল,
“ কী যা-তা বলছেন বলুন তো। ঝেড়ে কাশুন না মশাই।”
নাহিদ মেয়েদের মতো ঠোঁট উল্টেপাল্টে বলল,
“ হয়েছে কী,আমি তীব্রর পকেটে চিঠি রেখেইছিলাম। কাল রাতে ও যে প্যান্ট পরে খুলে রাখল চেয়ারে, ওটাতে।”
নূহা খুশি হয়ে বলল,
“ সাব্বাশ। তারপর,তারপর কী হলো?”
নাহিদের সারা মুখে অদৃশ্য কালি লেপটে গেল এই সাব্বাশ শুনে। ঘটনার পরেরটুকু তো এখনও বলা বাকী। সব জানলে মেয়েটা কী বলবে? সাব্বাশের বিপরীত শব্দটা কী? না,চিন্তায় নাহিদ মনে করতে পারল না। নূহা তাগিদ দেয়,
“ আহা আজব তো! একটা কথা অর্ধেক বলে মুখে স্কচটেপ লাগাচ্ছেন কেন? শেষ করবেন তো না কী।”
নাহিদ গলা খাঁকারি দিলো এবার। বলল মিনমিনিয়ে,
“ ওই হয়েছে কী,চিঠি তো রাখলাম প্যান্টে। কিন্তু তীব্র পকেট-ফকেট চেক না করেই আস্ত প্যান্ট সার্ফ এক্সেলে চুবিয়ে দিয়েছে। সাথে শার্টও ছিল।”
নূহার সব আনন্দ মাটি। চোখ দুটো প্রকট হলো উলটে। বিস্ফোরিত কণ্ঠে চ্যাঁচাল,
“ কী? কী বল…”
হাঁসফাঁস করে ওর মুখটা চেপে ধরল নাহিদ। ওরা দাঁড়িয়েছিল সিঁড়িতে। যেখানে আস্তে কথা বললেও প্রতিধ্বনির তোপে বেশ জোরে শোনায়৷ সেখানে এই মেয়ে চ্যাঁচাচ্ছে! পুরো বিল্ডিংয়ের লোক তো জড়ো হলো বলে।
চাপা কণ্ঠে বলল,
“ আরে চুপ চুপ। কী করছেন? এভাবে চ্যাঁচালে তো সবাই শুনে ফেলবে।”
নূহা মাথা নাড়ল। তবে এই মুখ চেপে ধরার অজুহাতে বড্ড কাছে চলে এসেছে নাহিদ। যেই ঘনিষ্ঠতায় শ্বাস-প্রশ্বাসও লিপ্ত হচ্ছে লড়াইয়ে।
তরুণীর সেই আগের রোগটাই চট করে ফেরত এলো আবার। গলা শুকাচ্ছে,বুক কাঁপছে। মেয়েলি কোটর দুটো না চাইতেও ভরতি হয়েছে লজ্জার শ্রাবণে। অমন চোখেই নাহিদের দিকে চাইল সে। ছেলেটা তখনও চারপাশ দেখছে। কেউ এলো কী না! দেখল কী না ওদের!
যখন ফিরল তার দিক,নূহার চাউনীতে আটকে গেল সব। বদলে এলো দৃষ্টিযুগল। কিছু অস্বস্তি, কিছু বিব্রতবোধের কবলে পড়ল সেও। চট করে মেয়েটাকে ছেড়ে সরে আসে নাহিদ।
নূহার শরীর চুবল জড়োতার স্রোতে। কণ্ঠনালীতেও ব্রীড়ার বাণ।
দুজনেই সংকোচে জবুথবু তখন। নাহিদ এলোমেলো পাতা ফেলছে ফ্লোরে৷ পিঠ ফিরিয়ে উলটো ঘুরে আছে ওরা। সে ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে বলল,
“ সরি!”
নূহার নিভু স্বর,
“ ইটস ওকে।”
সামান্য ব্যাপারটা নিয়ে দুজনের লজ্জার কমতি নেই। কেউ কারো দিকে তাকাতেও পারছে না।
নাহিদের মাঝের রাখ-ঢাক কমে এলো এবার। একটু আগের ঘটনায় পরিবেশ রাতারাতি পাল্টেছে। বেশ ঝরঝর করে বলল,
“ চিঠিটা তীব্র পড়তে পারেনি। কাগজ গলে গেছে। আপনি আমাকে একটা কাজ দিলেন,অথচ ঠিক করে করতে পারলাম না। সরি এগেইন!”
নূহা কী বলবে বুঝতে পারছে না৷ তবে চোখের কোণা তুলে মানুষটাকে দেখতে চাইল একবার। বলল ছোটো গলায়,
“ আচ্ছা।”
অমনি ঘুরে চাইল নাহিদ। সব ভুলল চোখের পলকে। খুব চিন্তা নিয়ে বলল,
“ এখন কী করবেন তাহলে? প্রথম মিশন তো ফেইল করে গেল।”
নূহা ভেতরের আইঢাই ভাব সামলে ওঠে। নিজেও তাকায় ওর দিক। নিম্নোষ্ঠ কামড়ে বলে,
“ দেখছি। পরের মিশন ভাবতে হবে। আচ্ছা, আমি এখন যাই। পুষ্পিতা একা ঘরে। মেয়েটা আবার বাঁজ পড়লে ভয় পায়।”
“ ঠিক আ..”
বলতে বলতেও থামল নাহিদ। হুলস্থূল প্রস্তাব ছুড়ল,
“ আচ্ছা একটা কাজ করলে হয় না?”
নূহা এক পা বাড়িয়েছিল যেতে। থেমে দাঁড়িয়ে বলল,
“ কী?”
“ এখন তো আকাশে বাঁজ পড়ছে। আমি না, অনেক সিনেমায় দেখেছি বাঁজ পড়লে হিরোইন ভয় পেয়ে হিরোর কাছাকাছি আসে। তীব্রকে আপনাদের বাসায় পাঠিয়ে দেব?”
নূহা তব্দা খেল৷ হাসবে না রাগ করবে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগল সিদ্ধান্ত নিয়ে৷ ওকে হাঁ করে চেয়ে থাকতে দেখে বুক ফুলিয়ে হাসল নাহিদ। ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
“ কেমন বুদ্ধি দিলাম বলুন? দারুণ না?”
নূহা তাজ্জব বনে বলল,
“ অ্যাই আপনার বয়স কত?”
নাহিদের হাসি মুছে যায়।
“ কেন?”
নূহা আর কিছু বলল না। অতীষ্ঠতায় দুপাশে মাথা নাড়তে নাড়তে চলে গেল। বোকা ছেলেটা কিছুই বোঝেনি৷
মনের মাঝে হাজারখানেক প্রশ্ন নিয়ে ঘরে ঢুকল নিজেও।
অমনি সামনে পড়ল তীব্র৷ হাতে চায়ের কাপ নিয়ে মাত্রই ডিভানে বসেছে। নাহিদ দাঁড়িয়ে গেল। পরপরই শঙ্কা জাগল মনে। বিট্টুটা আবার কিছু শুনে ফেলেনি তো?
তীব্র চাইতেই,
হেহে করে হাসল সে। ও অকারণেই ধমকাল,
“ ছাগলের মত না হেসে সামনে থেকে সর।”
দপ করে হাসি নিভে গেল ছেলেটার। মনঃক্ষুন্ন হয়ে বলল,
“ এভাবে বলতে পারলি আমাকে? আমার এই হাসির ওপর ভার্সিটির কত মেয়ে ক্রাশড ছিল জানিস?”
তীব্রর চোখ দেওয়ালে ঝোলানো টিভিতে৷ নিষ্পৃহ বলল,
“ তাহলে ওদের কারো সাথে প্রেম করতি। শুধু শুধু লাইফটাকে হ্যেল করার জন্যে একটা গোল্ড ডিগারকে বেছে নিলি কেন?”
নাহিদের যেটুকু হাসি বাকী ছিল, উবে গেল সব।
“ আবার মিথিলার কথা তুলছিস কেন? আমি তো ওকে ভুলতে চাইছি তাই না?”
তীব্র কিছু বলল না। টিভি ছেড়ে, মেঝের দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইল । নাহিদ নিজেই এগিয়ে আসে কাছে। শুধায়,
“ তোর কি মন খারাপ?”
“ না।”
“ তাহলে? “
“ মেজাজ খারাপ।”
“ কেন?”
তীব্র বলল,
” কাল দুপুর থেকে পুষ্পিতাকে দেখিনি। মেয়েতো বাইরেও বের হয় না। একটা বুদ্ধিও পাচ্ছি না ওদের বাসায় যাওয়ার।”
বুঝতে পেরেছে এমন ভাবে মাথা ঝাঁকাল নাহিদ। বিজ্ঞের ন্যায় চিন্তার ভান করল কিছুক্ষণ। অনেকটা সময় খাটিয়ে বলল,
“ আমিও পাচ্ছি না।”
তীব্র উঠে দাঁড়ায়। বলল মুখের ওপর,
“ তোর বুদ্ধিতে চলব,তীব্রর অত খারাপ সময়ও আসেনি ।”
****
আজকে সমস্ত অফিস-আদালত বন্ধ। তাও আয়েশা খাতুন বাড়িতে নেই। খুব কাছের এক কলিগের বাড়িতে তাদের শাখার সবাইকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। ভদ্রমহিলা সেখানেই গিয়েছেন। ফেরার কথা বিকেলে। অথচ,
আছরের আযান পড়তে না পড়তেই হুটহাট ঝড় তেড়ে এলো। বেড়ে গেল মেঘের তেজ। সেই সাথে তুফান রূপি বাতাসে কলিগের বাড়িতেই আটকে গেলেন আয়েশা। এদিকে,নূহা-পুষ্পিতা একা বাসায়। সন্ধ্যা হয়নি অথচ প্রকৃতির বুকে আমবস্যার মতো অন্ধকার নেমে এসেছে। ধুলো-বালি উড়ে আসছে হাওয়ায়। ঝড়-বাতাসে জানলার কপাট একটার সাথে আরেকটা বাড়ি খাচ্ছে ক্রমে। সাথে লাগাতার বজ্রপাত,বিদ্যুৎ চমকানো তো আছেই। পুষ্পিতার সাথে সাথে আস্তেধীর ভয়ে গুটিয়ে আসছে নূহাও। তারপর হুট করে লোডশেডিং হলো। কাছেপিঠে কোথাও খুব জোরে বাঁজ পড়তেই,ট্রান্সমিটার ফাঁটার বিকট শব্দ ভেসে এলো বাতাসে। ফাঁকা বাড়িতে দুই তরুণীর শীর্ণ বুক ছলকে উঠল অমনি। গলা ফাঁটিয়ে একই সাথে চিৎকার ছুড়ল দুজন।
তীব্রদের ঘরের দরজা খোলা ছিল তখন।
ডিভানে শুয়ে মুঠোফোনে ভিডিও দেখছিল নাহিদ। তার পাশের টেবিলে বসে নোটস ঘাটছিল তীব্র। হঠাৎ চিৎকারে ভরকে গেল ওরা। একে-অপরকে দেখে,ঝড়ের বেগে ছুট লাগাল বাইরে।
নূহা ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়েছে। তক্ষুণি দরজার কাঠে টোকার শব্দ শোনা যায়। পুষ্পিতা ভয়ে ভয়ে বলল,
“ কে এলো এখন? ভূত না তো!”
উত্তর হিসেবে ভেসে এলো একটি স্থূল,ধৈর্যহীন কণ্ঠস্বর,
“ নূহা, দরজা খোলো। আমি তীব্র।”
পুষ্পিতার ভয়ডর শেষ। উলটে মৃগের ন্যায় নয়ন জোড়া ঝলমলিয়ে উঠল। কারো অপেক্ষায় না থেকে, দৌড়ে গিয়েই ছিটকিনি টেনে নামাল সে। ওপাশে দাঁড়িয়ে তীব্র। গোটা একদিন পর দেখা হলো দুজনের। ফ্ল্যাশলাইটের কড়া আলো সোজা গিয়ে ছেলেটার মুখের ওপর পড়ে। চোখের সাদা চশমা ঝলসে যায় তাতে। হাত দিয়ে মুখটা আড়াল করল তীব্র। বলল ছোটো করে
“ আলো নামাও।”
হুশে এল মেয়েটা। হাত নামাল জলদি। ততক্ষণে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে নূহাও।
“ স্যার আপনি?”
তীব্রর কপালে ভাঁজ।
“ এভাবে চ্যাঁচালে কেন?”
পুষ্পিতা বলল,
“ আসলে হুট করে কারেন্ট গেল। আবার একইসাথে বাঁজ পড়ায় ভয় পেয়ে গেছিলাম।”
“ আন্টি আসেনি?”
“ উহু। আটকা পড়েছে বৃষ্টিতে।”
নূহা বলল,
“ স্যার আপনি বাইরে কেন? ভেতরে আসুন।”
মেয়েটার কথায় সংকোচ নেই আজ। কিন্তু ইতস্তত করল তীব্র। শূন্য বাসায় দুটো মেয়ে। এই মুহুর্তে ওর ভেতরে যাওয়া কি ঠিক হবে?
কেউ দেখলেও তো বিষয়টায় রং ছড়িয়ে ফেলবে। পরপরই চোখ পড়ল পুষ্পিতার ওপর। মেয়েটা কেমন মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় দেখছে ওকে! হাতের ফ্ল্যাশটা উলটো করে ধরায়, শুভ্র কিরণ সোজাসুজি মুখে পড়ছে গিয়ে। এমনই এক ঈষৎ প্রভায় মেয়েটিকে দেখেছিল সে!
অমনি তার সব সংকোচ উধাও। টানটান বুকে, লম্বা পা এগিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকল তীব্র। কেউ যদি ব্যাপারটা দেখেও নেয়, সাথে যেন দু-চারজন লোক জড়ো করে। এমন একটা মোক্ষম সুযোগকে কাজে লাগিয়েই, ভিতু মেয়েকে সে বিয়ে করে ফেলবে না হয়!
তীব্রর পেছন পেছন নাহিদ ঢুকল।
নীরব বাতায়ণে হইহই করে বলল,
“ দেখলেন মিস নূহা,কাল রাতে আমাকে ভূতের ভয় দেখালেন, অথচ নিজেই সেই ভয়ে সাত বাড়ি চ্যাঁচিয়ে মাথায় তুললেন আজ।”
তীব্র সন্দেহী চোখে চাইল,
“ কাল রাতে ও তোকে ভয় দেখিয়েছে? কখন?”
“ হ্যাঁ ওই তো যখন ছা…”
নূহা হাঁসফাঁস করে জ্বিভ কাটল। ঢেঁড়সটা সব বলে দিলো রে!
খেয়াল পড়তেই কথায় দাঁড়ি টানল নাহিদ। আমতাআমতা করল,
“ না আসলে, কাল ঘুম আসছিল না বলে ছাদে গেলাম না? গিয়ে দেখলাম উনিও ছিলেন। তখনই আর কী!”
সাথে পুরূ ঠোঁট টেনে হাসল ছেলেটা। কিন্তু
তীব্রর সন্দেহ গেল না। চোখ সরু করে চোর চোর ভাব করা দুজনকেই একবার একবার দেখল সে।
অথচ পুষ্পিতার এসব কিছুতে খেয়াল নেই। তার বিমোহে বুঁদ হওয়া নয়ন তীব্র থেকে সরছেই না। পুরোটা সময় মানুষটার দিকে চেয়ে রইল সেই সুরূপা তরুণী।
সদ্য প্রেমের কবলে দিশেহারা যে।
তীব্র চাইতেই চট করে মাথা নোয়ায় পুষ্পিতা। সেই ফাঁকে নাহিদ কে চোখ রাঙাল নূহা। ছেলেটা ঠোঁট ওল্টাল আবার। বলল শব্দহীন,
“ সরি!”
নূহা ওসবে মন দেয় না। তীব্রকে বলে,
“ স্যার দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন না।”
পুষ্পিতার দিকে চোখ রেখেই বসল সে। মেয়েটার এখন ভীষণ লজ্জা লাগছে! মনে হচ্ছে পাত্রপক্ষ দেখতে এসছে ওকে। কুণ্ঠা ঢাকতে কী করবে ভেবে পেল না ও। কোথাও যে পালাবে,সেই অজুহাত নেই। অজুহাত থাকলেও বা,যেতো পুষ্পিতা? তীব্রর সামনে থাকতে ভালো লাগছে যেমন,তেমনই লজ্জায় চুর হচ্ছে শরীর। কী এক অদ্ভূত যন্ত্রণা এসব!
নূহার মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি খেলে গেল। ঝলঝলে চেহারায় উদ্বেগ এনে বলল,
“ আচ্ছা, সবাই এভাবে ভূতের মতো বসে থেকে কী করব? তার থেকে চলুন আমরা চারজন মিলে ট্রুথ- ডেয়ার খেলি!”
তীব্র চোখ গোছায়,
“ কী?”
“ ইয়ে, ট্রুথ ডেয়ার। আপনি দাঁড়ান আমি ব্যবস্থা করছি।”
মেয়েটা আর কারো অনুমতি নিলো না। হুট করে ছুটে ছুটে দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে এলো সাথে। দুই সোফাসেটের মাঝে বসিয়ে টি টেবিলটাকে আরো কাছে এনে বসাল।
পুষ্পিতা আর নাহিদকে বলল,
“ বোসো সবাই।
পুষ্পিতা বলতে যায়,
“ এখন এসব…”
নূহা চোখ পাঁকাল,
“ বোওওওস।”
নিরুপায়ের মতো বসল সে। তবে সিটটা ঠিক তীব্রর মুখোমুখি থাকায় গুটিয়ে গেল আরো।
নূহা কাচের বোতল এনে টেবিলে রাখে। তীব্র সবটা অনীহা নিয়ে দেখছে। এসব বাচ্চামো খেলা খেলতে হবে এখন, ও গড! অবশ্য ভিতু মেয়ে আছে তো! মেয়েটা আশেপাশে থাকলে এমন দু চারটে খেলা কেন? সব পারবে তীব্র।
আচ্ছা,তাদের দুজনের ঠিক এইরকম এক ঝড়ের রাতে দেখা হলো না? আজও তো ঠিক তেমনই ঝড় বইছে বাইরে। ঠিক তেমনই ছোট্টো আলো জ্বলছে কামরায়। শুধু দু পাশের এই দুটো না থাকলেই ভালো হোতো। তীব্র চেহারা গুটিয়ে একবার নাহিদকে,আরেক বার নূহাকে দেখল। ইচ্ছে জাগল, একটাকে কোথাও আটকে রাখার। আরেকটাকে এক লাথিতে ঘরের বাইরে ফেলে আসার। এখানে শুধু ভিতু মেয়ে আর ও থাকবে। এই ভাবে মুখোমুখি, কাছাকাছি খুব। নিষ্পলক মেয়েটাকে চেয়ে দেখবে তীব্র। সব চাওয়া-পাওয়া মিটে যাবে সাথে।
ঘোর ভাঙল নূহার স্বতঃস্ফূর্ত আওয়াজে।
“ স্যার, দেখুন, এটাকে আমি এখন হাত দিয়ে ঘোরাব। ঘুরতে ঘুরতে বোতলের মাথাটা যার দিকে থামবে? তাকে দুটো অপশন দেয়া হবে। ট্রুথ আর ডেয়ার। ট্রুথ নিলে যা প্রশ্ন করা হবে? উত্তরে সত্যি বলা চাই। আর ডেয়ার নিলে..
নাহিদ আগ বাড়িয়ে বলল,
“ যা করতে বলা হবে, তাই করতে হবে এইত? স্কুল লাইফে অনেক খেলেছি জানেন। আজকে আবার খেলব। উফ পুরো নস্টালজিক ব্যাপার-স্যাপার।”
তীব্রর তাও পছন্দ হলো না। সে ট্রুথ নিলে প্রশ্ন করবে ঠিক আছে,কিন্তু যদি ভুল উত্তর দেয়? বা মিথ্যে বলে? এরা বুঝবে কীভাবে? বোকা বোকা জেনারেশানের বোকা বোকা খেলা। ছোটো করে ঘাড় নাড়ল তাও।
নূহার মধ্যে উৎফুল্লতার কমতি নেই। সেকেন্ডে বোতল ঘুরিয়ে দিলো মেয়েটা। মনে মনে প্রার্থনা করল যেন পুষ্পিতার কাছে এসেই থামে। কাকতালীয় হলেও,প্রার্থনা ফলে যায়। ঘুরতে ঘুরতে বোতলের সরু মাথা ঠিক পুষ্পিতার সামনে এসেই জিরোলো।
খুশিতে হাত তালি দিয়ে উঠল নূহা। পুষ্পিতা মিইয়ে গিয়ে বলল,
“ যা বাবা,প্রথমেই আমি?”
নূহা লাফিয়ে-চড়িয়ে শুধায়,
“ ট্রুথ না ডেয়ার? বল বল তাড়াতাড়ি বল!”
পুষ্পিতা ভুলেও ডেয়ার নেবে না। এই নূহাকে ও হাড়েহাড়ে চেনে। উল্টোপাল্টা কিছু একটা দিয়ে বসলে?
বলল,
“ ট্রুথ।”
নূহা তীব্রকে শুধাল,
“ স্যার প্রশ্ন করবেন?”
তীব্রর ভেতরটা উশখুশে। প্রশ্ন তো একশবার করতে চায় । আর ভয়টা এখানেই। জ্বিভের যে ভরসা নেই। দেখা যাবে বলে বসল,
“ আমাকে ভালোবাসো?”
থাক। চুপচাপ মাথা নাড়ল দুপাশে। নূহা হতাশ হলো একটু। সে চাইছিল তীব্র এই সুযোগে মনের কথা শুনে নিক ওর থেকে।
নাহিদকে জিজ্ঞেস করল,
“ আপনি করবেন?”
একইরকম মাথা নাড়ে সেও।
নূহা কাঁধ উঁচিয়ে বলল,
“ ঠিক আছে। আমিই করছি।”
তারপর একটু ভেবে বলল,
“ আচ্ছা বল তো,এমন কী জিনিস যেটা পেলে তোর মনে হবে তুই পৃথিবীর সবচাইতে সুখী?”
সবাই যখন উত্তরের আশায় চেয়ে,পুষ্পিতা মাথা নোয়াল। ছোট্টো ঢোক গিলে বলল,
“ একটা বাড়ি।”
তীব্রর ভ্রু বেঁকে যায়। সাগ্রহে শুধায়,
“ বাড়ি?”
নূহা নিজেও বেশ অবাক হলো। এরকম কিছু পুষ্পিতার মুখে ও কোনওদিন শোনেনি।
পুষ্পিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাতাসের তাণ্ডবের কাছে, হার মানা বদ্ধ জানলার দিক চেয়ে বলল,
“ আমার নিজের নামে একটা বাড়ি চাই আমি। রাজপ্রাসাদ নয়,একটা ছোট্টো বাড়ি। খড়কুটোর চাল,কিংবা মাটির বেড়া ? কিছু একটা হলেই চলবে। কিন্তু বাড়িটা হবে আমার নামে। একদম আমার নিজের। যেখান থেকে কেউ আমাকে ইচ্ছে হলেই চলে যেতে বলবে না। যখন-তখন ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করার ভয় দেখাবে না। যেখানে তিন বেলা খেয়ে-পরে বাঁচার খোটা শুনতে হবে না । উঠতে-বসতে শুনতে হবে না,আমি এখানকার আশ্রিতা। যে বাড়িতে কারো বোঝা হয়ে নয়, আমি আমার মতো করে থাকব । না খেয়ে থাকলেও,যেখানে দিন শেষে একটু নিশ্চিন্তে শ্বাস নিতে পারব। রাতের বেলা মেঝেতে মাথা রেখে ঘুমোলেও মনে হবে, আমি তো আমার বাড়িতেই আছি। এই বাড়ি থেকে কেউ আমাকে কোনওদিন তাড়িয়ে দিতে পারবে না। কেউ না।”
বলতে বলতে পুষ্পিতার কণ্ঠ ভিজে এলো। কথার শেষে এক ফোঁটা উষ্ণ জল টুপ করে গড়িয়ে পড়ল গালে। সাথে প্রচন্ড কান্নারা বাধ ভেঙে ছুটে গেল গলায়। সবার সামনে মেয়েটা আর বসে থাকতে পারে না। অন্ধকারেই দৌড়ে চলে যায় ঘরে। নূহার নিজেরই কান্না পেয়ে যাচ্ছে।
নাহিদের হাসিটাও বিলীন। দুজনেই একসাথে ফিরে চাইল থম ধরে থাকা তীব্রর দিকে। যার সুতনু আদল ভাবনায় ডুবেছে। অথচ কী ভাবছে, কে জানে!
চলবে,