রোদ-শুভ্র ও তাদের খুচরো কথা
লেখানীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কৃষ্ণচূড়ার পসরা বসেছে। শ্যামলী সুন্দরের মাথায় দোলছে চোখ ঝলসে যাওয়া অগ্নিনৃত্য। চনমনে রোদ গায়ে মেখে থেকে থেকেই ডাকছে পাখি। কী পাখি, বুঝা যাচ্ছে না। ছেলেবেলা হলে বাবাকে ফট করে প্রশ্ন করতো শুভ্র, ‘বাবা? বলো এটা কী পাখি? তুমি বাবা, তোমার তো জানার কথা। বাবারা সব জানে।’ শুভ্র নিজের মনে হাসে। সে দিন এখন অতীত হয়েছে। এখন শুভ্রতা তার কোলে চেপে চোখ-মুখ গম্ভীর করে বলে,
‘ বাবা?পাকি।’
শুভ্র মাথা দোলায়। মেয়ের গম্ভীর মুখভঙ্গি লক্ষ্য করে গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দেয়,
‘ হ্যাঁ, মা। পাখি।’
শুভ্রতা বড়ো বড়ো চোখদুটোতে টলটলে মন খারাপ নিয়ে পাখি দেখে। নিচের ঠোঁটটা উল্টে রাখে অভিমানে। অভিমানটা ঠিক কার উপর, বুঝা যাচ্ছে না। বোধহয় মায়ের উপর। সেই কোন সকালবেলায় সুন্দর জামা-জুতো পরিয়ে মা তাকে নানুর কাছে রেখে এলো, তারপর থেকে আর মাকে দেখা যাচ্ছে না। মামু বলেছে, মা হারিয়ে গিয়েছে; আর আসবে না। মা হারিয়ে গেলে তো খুবই বিপদের কথা। শুভ্রতা মাকে ছাড়া থাকবে কী করে? মা একা একা হারিয়ে গেলো; শুভ্রতা আর তার বাবাকে নিলো না কেন? বাবা অবশ্য বলেছে, ‘মা হারিয়ে যায়নি। মায়ের পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা শেষ হলেই ছুটে চলে আসবে।’ শুভ্রতা বাবা-মার কথা বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত। বাবার কথা তার বিশ্বাস হয়েছে। বিশ্বাস হলেও কান্না পাচ্ছে। শুভ্রতা পাখির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই কেঁদে ফেললো। চোখ থেকে বৃষ্টি ফোঁটার মতো জল গড়াচ্ছে। ছোট্ট কোমল ঠোঁটদুটো অভিমানে ফুলে ফুলে উঠছে। শুভ্র অসহায় মুখে মেয়ের অশ্রুসজল চোখের দিকে চেয়ে রইলো। মেয়ে বাবার করুণ চাহনিকে দু’আনা পাত্তা না দিয়ে বললো,
‘ আম্মু যাবো।’
ব্যস! কথাটা কণ্ঠনালি থেকে নিঃসৃত হওয়ার সাথে সাথেই কান্নার বেগ উসাইন বোল্টের পায়ের থেকেও দ্রুত গতিতে ছুটে গেলো চূড়ান্তের পথে। কেঁদেকেটে হেঁচকি উঠার মতো অবস্থা। শুভ্র মেয়েকে বুকে জড়িয়ে পাখির কথা বললো। ফুলের কথা বললো। কিন্তু মেয়ে অপারগ। তার ফুল চায় না, পাখি চায় না; আম্মু চায়। মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে নিজের উপরই বিরক্ত হলো শুভ্র। এতো জেদ! নিজে একটু কম জেদি হলেই মেয়ের জেদের পারদ খানিক কম হতো। সামলানো সহজ হতো। বিয়েও করেছে বেছে বেছে জেদি টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি ধরনের রমণী। এবার হলো তো? হলো তো, জিনে জিনে ঠুকাঠুকি? দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুভ্র। এদিকে তার ক্লাসের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। সেকেন্ড ইয়ার সেকেন্ড সেমিস্টারের সিটির ডেটটা পোস্টপোন হচ্ছে গত এক সপ্তাহ যাবৎ। আজও পোস্টপোন করতে হলে, ব্যাপারটা কেমন দেখাবে? শুভ্র মেয়ের কপালে উষ্ণ চুমু দিয়ে বললো,
‘ আম্মু, এভাবে কাঁদলে কিন্তু বাবা খুব রাগ করবে। প্রিন্সেসরা কখনও কাঁদে? তোমার আম্মু তোমাকে প্রিন্সেসদের গল্প শুনিয়েছে না?’
শুভ্রতা মাথা নাড়ে। অর্থাৎ মা তাকে গল্প শুনিয়েছে। শুভ্র মেয়ের চোখ-মুখ মুছে দিয়ে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় তুলতুলে গাল, কপাল, মুখের সর্বত্র। বুকের সাথে চেপে ধরে বলে,
‘ তুমি বাবাকে গল্পটা শুনাবে না, মা?’
বাবার থেকে আচমকা এতো আদর পেয়ে জলের মতো সরল চোখে বাবার মুখের দিকে চেয়ে থাকে শুভ্রতা। একদম মায়ের মতো দৃষ্টি! মুগ্ধ হয় শুভ্র। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিগুণের প্রশংসায় ভরে উঠে মন। অবিকল তার মতো চেহারার এই কোমল, ফুটফুটে শিশুটি তারই ঔরসজাত সন্তান। তার থেকেই সৃষ্ট, বিশ্বাস হয়? সৃষ্টিকর্তার কী আশ্চর্য মহিমা! হাসিতে তার কী আশ্চর্য নূর! ভক্তিতে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে শুভ্রর। মেয়েকে আদরে আদরে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে হয়। মেয়ের মুখের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলে,
‘ আম্মু? চলো আমরা তোমার আম্মুর জন্য চকলেট কিনে নিয়ে আসি। শী ইজ আ কুইন। বাবাকে তোমার মতো মিষ্টি একটা প্রিন্সেস উপহার দিয়েছে। শী ডিজার্ভস্ আ গিফ্ট, না?’
শুভ্রতা বাবার কোলে চড়ে মায়ের জন্য উপহার কিনতে যায়। পথে যেতে যেতে বাবা তাকে মায়ের গল্প শুনায়। কীভাবে মা একসময় শুভ্রতার মতোই সুইট প্রিন্সেস ছিলো। তারপর হুট করে কুইন হয়ে গেলো, সেই গল্প। মায়ের গল্প শুনতে শুনতে কান্নার কথা ভুলে যায় শুভ্রতা। চোখ-মুখ গম্ভীর করে মতামত দেয়,
‘ আম্মু কুইন।’
শুভ্র তার গালে চুমু দিয়ে নিচু কণ্ঠে শুধায়,
‘ কুইন অর্থ জানো আম্মু? কুইন অর্থ রাণী।’
শুভ্রতা অর্থের গভীরতা বুঝতে পেরেছে এমন মুখভঙ্গি করে মাথা ঝাঁকায়,
‘ হু, কুইন অত্ত লানি।’
হেসে ফেলে শুভ্র। হঠাৎ করেই বসন্তকালকে আরও বেশি ফুলেল বলে বোধহয়। জীবনটাকে মনে হয় পরিপূর্ণ। কোলে চেপে বসে থাকা শিশু কন্যাটি তার নিজের, কী চমৎকার ব্যাপার! বেঁচে থাকাটা এতো মধুর!
___________
দুপুরের ভ্যাপসা গরমে থেকে থেকেই উশখুশ করছে চিত্রা। লেখালেখি ভালো লাগছে না; দেশি মুরগীর ঝোল দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। মনের ইচ্ছেটাকে কিছুক্ষণ মনের মধ্যেই নাড়াচাড়া করে রোদের পিঠে কলমের গুঁতো দিলো সে। কণ্ঠ নামিয়ে ফিসফিস করে বললো,
‘ এই রোদ? রোদ? শোন না!’
রোদ লেখায় অব্যাহতি দিয়ে সোজা হয়ে বসলো। ভাবনায় লেখার রেশটা ধরে রেখেই শুধালো,
‘ কী হয়েছে?’
‘ ভার্সিটির আশেপাশে কোথায় দেশি মুরগীর ঝোল পাওয়া যায়, বল তো?’
রোদ চকিতে চাইলো। ভ্রু কুঁচকে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে শুধালো,
‘ কীহ? মুরগীর ঝোল! সিরিয়াসলি?’
‘ হু, ভীষণ খেতে ইচ্ছে করছে। পাওয়া যায়?’
বিরক্তিতে কটমট করে চাইলো রোদ। লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করলো। দাঁতে দাঁত চেপে মধুর কণ্ঠে বললো,
‘ থাপ্পড় খেয়ে দাঁত ভাঙতে না চাইলে চুপচাপ লেখ। পরীক্ষার হলে বসে মুরগীর ঝোল খেতে মন চায়! এই? আন্টি তোকে কোন হা-ভাতের বংশ থেকে তুলে এনেছে বল তো? সব সময় খালি খাই খাই।’
চিত্রা মুখ কালো করে বললো,
‘ একদম আমায় বকাবকি করবি না। একজন অন্তঃসত্ত্বা রমণীর এমন হুটহাট ক্ষুধা পায়। তোর তো একটা বাচ্চা আছে। ইউ শ্যুড নো। তোর উচিত আমাকে এপ্রিশিয়েট করা। তা না করে চড়-থাপ্পড় মারতে চাইছিস? নিষ্ঠুর! পাষণ্ড!’
রোদ অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে চাইলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘ এপ্রিশিয়েশন? সিরিয়াসলি! পরীক্ষার হলে বসে দেশি মুরগীর ঝোল খেতে চাওয়ার মধ্যে আমি কোনো এপ্রিশিয়েশনের ব্যাপার দেখতে পাচ্ছি না। এমন তো নয়, পরীক্ষার হলে দেশি মুরগীর ঝোল খেতে চেয়ে তুই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছিস? আরও মানুষের বাচ্চা হয়; অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পরীক্ষা দেয়। তোর মতো আকাইম্মা ইচ্ছা আর কারো হয় না। দয়া করে চুপ থাক আর লিখতে দে। প্লিজ!’
চিত্রা মুখ কালো করে বসে রইলো। আবার কিছু বলে ধমক খাবে কিনা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই সম্মুখ থেকে গমগমে এক পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে এলো,
‘ এইযে, আপনারা দুইজন। কী সমস্যা? মাস্টার্স করছেন অথচ আচরণ টিনএজারদের মতো। পরীক্ষার হল যে পিকনিক স্পট নয় এতোদিনে এতোটুকু ম্যানার তো শেখা উচিত!’
অপমানে থমথমে হয়ে গেলো রোদের মুখ অথচ চিত্রা নির্বিকার। একবার চিত্রার দিকে গরম চোখে চেয়ে ততোধিক থমথমে কণ্ঠে ক্ষমা চাইলো রোদ,
‘ সরি, স্যার।’
প্রফেসর কথা না বাড়িয়ে বসতে বলতেই হৃদয় ভেঙে গেলো চিত্রার। অত্যন্ত দুঃখী কণ্ঠে বললো,
‘ কী দরকার ছিলো সাবধান করার? সরাসরি খাতাটা নিয়ে বের করে দিলেই তো হতো। বাসায় চলে যেতাম। সিরাজ-উদ-দ্দৌলাও তো মীরজাফরকে সাবধান করেছিলো। লাভ কি হয়েছিলো? সিরাজ-উদ-দ্দৌলার পতন। স্যার কী নিজেকে সিরাজ-উদ-দ্দৌলা ভাবছে? আমরা কী এখন দেশি মুরগীর ঝোল রেখে ষড়যন্ত্রের ছক কষতে বসবো? আশ্চর্য!’
বিরক্তিতে দমবন্ধ হয়ে যাওয়া চেহারা নিয়ে চিত্রার দিকে চাইলো রোদ। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘ তুই কী চুপ করবি? নাকি ঠাটিয়ে একটা চড় খাবি? তোর কোনো মান-অপমান জ্ঞান নেই, না? আজ পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে তোকে যদি আমি দেশি মুরগীর ঝোলে না ডুবিয়েছি তবে আমার নাম রোদ না।’
চিত্রা খুশি মনে বললো,
‘ তুই তো রোদ না’ই। তুই হলি দ্য গ্রেট শুভ্র ভাইয়ার একমাত্র বধূয়া। কন্যার পিতা-মাতা হয়ে যাওয়ার পরও তোদের প্রেম দেখলে মনে হয় দুই মিনিট আগে বিয়ের আসর থেকে উঠে আসা লাজুকপাতা আর লাজুকলতা। শোন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি শিশিরকে শুভ্র ভাইয়ার কাছে টিউশন নিতে পাঠাবো। কোর্সের বিষয় হবে, হাও টু মেইক টেরেবল লাভ উইদ দ্য ওল্ডেস্ট ওয়াইফ।’
রোদ কোনোরকম প্রত্যুত্তর না করে লেখায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো। চিত্রার এহেন আচরণে সে বিস্মিত। কোনো মানুষ যে পরীক্ষার হলে বসেও রোমান্টিসিজম কপচাতে পারে, বর-সংসার নিয়ে গল্প জুড়তে পারে তা চিত্রাকে না দেখলে বিশ্বাস হতো না। রোদের মনোযোগ না পেয়ে আবারও উশখুশ করে উঠলো চিত্রা। পেছন থেকে ঘ্যানঘ্যান করে বললো,
‘এই রোদ? রোদ রে? চল না বেরিয়ে যাই। আর লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না।’
‘ এখনও পাশ মার্কস্ উঠেনি। শিশির স্যার তোর রেজাল্ট দেখলে খুন করে ফেলবে।’
চিত্রাকে পরীক্ষা পাশ নিয়ে খুব একটা চিন্তিত দেখালো না। সে ফুরফুরে মেজাজে বললো,
‘ ধুর! কিছুই বলবে না। তার বাচ্চাকে এতোগুলো মাস ধরে পেটে নিয়ে ঘুরছি তারপরও চোটপাট? পরীক্ষা যে দিচ্ছি এই তার সাত পুরুষের ভাগ্য। এখন আমার সাতখুন মাফ।’
রোদকে হতাশ দেখালো৷ কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললো,
‘ তোর সাত খুন মাফ হলেও আমার মাফ না ভাই৷ যার বাচ্চা তার কাছে সাকসেসফুলি হ্যান্ডওভার করা হয়ে গিয়েছে আরও দুই বছর আগে। বাচ্চা নিয়ে নাটক-সিনেমা করার সুযোগ আমার নেই। রেজাল্টের করুণ অবস্থা দেখলে কন্যার পিতা আমাকে মাথায় তুলে আছাড় মারবে। মরে মরে হলেও আই নিড টু মেইক আ হ্যান্ডসাম সিজি দোস্ত। প্লিজ জ্বালাইছ না, প্লিজ!’
চিত্রা জ্বালানোতে অব্যাহতি দিবে নাকি দিবে না সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই হল রুমের সম্মুখ থেকে গম্ভীর এক আদেশ ভেসে এলো,
‘ এইযে, আপনারা দু’জন; দাঁড়ান। অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছি। স্ট্যান্ড আপ!’
চিত্রা খুশিতে ঝুমঝুম করে বললো,
‘ এইবার কী আমাদের বের করে দেবে রে রোদু?’
___________
ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের সিঁড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে বিভিন্ন বয়সী ছেলেমেয়েরা। তাদের প্রত্যেকেই তরুণ, প্রাণোচ্ছল। চোখে-মুখে ঝিলিক দিচ্ছে বাঁচার আনন্দ। তাদের মধ্য থেকে নব যৌবনা এক যুবতী কয়েক হাত দূর দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক যুবককে দেখিয়ে শুধালো,
‘ উনি কোন ডিপার্টমেন্টের স্যার রে? সবাই সালাম দিচ্ছে।’
‘ সিএসই।’
‘ কী সুন্দর দেখতে! কোলের বাচ্চাটা কে? ছোট বোন? আহারে আমার ননদটা! ভাই-বোনের চেহারায় কী আশ্চর্য মিল!’
তরুণমহলে হাসির রোল পড়ে গেলো। একজন বললো,
‘ এতোবড়ো ছেলের এতো ছোট বোন হয়? এটা স্যারের মেয়ে। স্যারের ওয়াইফ বোধহয় আমাদের ভার্সিটিরই এক আপু। মাস্টার্স করছে, আমাদের সিনিয়র।’
মেয়েটা কৃত্রিম দুঃখ নিয়ে বললো,
‘ ইশস্ রে! এমন সুন্দর ছেলেদের প্রেম করতে শেখায় কে বল তো? এদের প্রেমের কার্ড তো বাজেয়াপ্ত করে দেওয়া উচিত। এদের প্রেম হবে পৃথিবী বিস্তৃত। উনার ওয়াইফও ছাত্রী, আমরাও ছাত্রী৷ ইকুয়াল ইকুয়াল। তাহলে প্রেম শুধু সেই ছাত্রীর সাথেই কেন? আমরা কী দোষ করলাম? উনার উচিত প্রত্যেক ছাত্রীকে সমানভাবে ভালোবাসা। এই অসম নীতি তো মানা যাচ্ছে না! স্যাড!’
এক যুবক প্রতিবাদ করলো,
‘ শুধু ছাত্রীদের কেন? আমরা, ছাত্ররা কী দোষ করেছি? আমাদেরও ভালোবাসা, প্রেম সেই সাথে পাশ মার্কস্ ফ্রী দেওয়া উচিত।’
আবারও হৈহৈ পড়ে গেলো। একেকজন হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়লো অপরজনের গায়ে। বললো,
‘ বিয়েশাদি করে এক বাচ্চার বাবা হয়ে যাওয়া স্যার আর যায়হোক সমকামী হতে চাইবে না। সবাই তো তোর মতোন না।’
বন্ধুমহলের সবথেকে গম্ভীর শ্রোতা এবার বক্তা হলো। বিরক্ত হয়ে বললো,
‘ অযথা ফাজলামো করিস না তো। স্যার আর আপুর প্রেমকাহিনী টিচার-স্টুডেন্ট টাইপ না। সিনিয়র জুনিয়র রিলেশনশিপ। ছাত্র অবস্থায় প্রেম করেছেন। স্যার আমাদের ভার্সিটিরই বড়ো ভাই। খুব ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিলেন। ফোর আউট অব ফোর।’
‘ বাপরে! এতো পড়াশোনা করেও প্রেম করার সময় পায় কখন মানুষ? আমি তো ভাই চির সিঙ্গেল জীবন নিয়েও তিন তুলতে গিয়ে পাতিলের তলার মতো কালো হয়ে যাচ্ছি।’
নুপুরের রিনিঝিনির মতো উঠে এলো সমস্বর হাসির সুর। একজন সমঝোতার ভঙ্গি করে বললো,
‘ যায় বলিস, স্যারের মেয়েটা কিন্তু ভীষণ মিষ্টি। আমি তার সাথে প্রেম করতে ইচ্ছুক। স্নাতক, স্নাতকোত্তর শেষ করে বিসিএসের জন্য চার-পাঁচ বছর ধ্বংস করে দিলে স্যারের কন্যার বিবাহের বয়স হবে না?’
হেসে ফেললো সবাই,
‘ তখন সে দশ/বারো বছরের নিব্বি হবে। আর তুই ত্রিশ বছরের দামড়া।’
ছেলেটা কৃত্রিম গাম্ভীর্য নিয়ে বললো,
‘ বারো বছর যথেষ্ট। বারো বছরের নিব্বির জন্য ত্রিশ বছরের দামড়া যে কত সুবিধার সেই সম্পর্কে তোদের কোনো ধারণাই নাই। যদিও আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি তবু চল, হবু বউকে কোলে নিয়ে একটু আদর করে দিয়ে আসি। তাকে আমার এক্ষুনি চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।’
বন্ধুদল থেকে কয়েকজন উঠে গেলো তড়িৎ পায়ে। বাকিরা কণ্ঠ ভর্তি ঠাট্টা নিয়ে সমস্বরে গান ধরলো। চেঁচিয়ে গাইলো,
‘ অল্পনা বয়সের ছকিনা ছেরি
আমার মনটা করলি চুরি
সত্যি করে বলা না ছেরি গো?’
যেতে যেতেই পেছন ফিরে হেসে ফেললো সবাই। বললো,
‘ চুপ, শালা!’
____________
শুভ্র দু’তলার সিঁড়ি ডিঙিয়ে করিডোরে এসে দাঁড়িয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর উদ্বিগ্ন চোখে বুকের সাথে লেপ্টে থাকা মেয়ের দিকে তাকাচ্ছে। মেয়ের কান্না থামায় কিছুটা স্বস্তি পাওয়া গেলেও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে না। ছোট্ট মুখখানা কেমন মলিন হয়ে আছে। বাবার কাঁধে মাথা রেখে নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে অনেকক্ষণ থেকে। কথা বলছে না। কিছুক্ষণ আগে একদল ছেলেমেয়ে এসে খুব হৈ-হুল্লোড় করলো। এন্টারটেইন করার চেষ্টা করলো। কিন্তু লাভ হয়নি। শুভ্র দু’তলা পেরিয়ে তিন তলায় উঠতে নিতেই শান্ত মেয়ে হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠলো। কিছুতেই তিন তলায় যাবে না। শুভ্র অবাক হয়ে বললো,
‘ কী হয়েছে বাবা?’
শুভ্রতা ডানদিকে দেখিয়ে বললো ওখানে যাবে। শুভ্র মেয়ের মতিগতি ধরতে না পেরে বিভ্রান্ত হয়ে সেদিকে এগুলো। এগিয়েই এক ঝটকা খেলো। ক্লাসরুমে রোদকে দেখা যাচ্ছে। এই বিচ্ছু মেয়ে আবার সেটা দেখেও ফেলেছে। শুভ্র মেয়ের দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা দেখে অভিভূত।আহা, দেখতে হবে না কার মেয়ে? অবজারভেশন পাওয়ার কী দূর্দান্ত! যদিও মায়ের মতো খুঁজে খুঁজে শুধু আকামের জিনিসই দেখে তারপরও তো দেখে? শুভ্র মেয়েকে বুঝাতে চেষ্টা করলো, সেদিকে যাওয়া যাবে না। সমস্যা আছে। শুভ্রতা কোনো সমস্যা বুঝতে রাজি না। শুভ্র হতাশ নিঃশ্বাস ফেললো। মেয়েটা জেদের দিক থেকে সত্যিই তার মতো হয়েছে। শুভ্রও তো ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন রোদকে কম জ্বালাতন করেনি। এইসবই রোদের অভিশাপ। এই মহিলার অভিশাপে নিজের জিন নিজের উপরই ভারী পড়ে গিয়েছে। বাবা-মেয়ের বাকবিতন্ডার মধ্যেই পাশে এসে দাঁড়ালেন এক ভদ্রলোক। শুভ্রকে দেখে অবাক হয়ে বললেন,
‘ আরে, শুভ্র স্যার! কেমন আছেন? সিএসই ডিপার্টমেন্ট আজ স্বয়ং আমাদের আঙিনায় নেমে এসেছে দেখে অবাক হচ্ছি। কী সৌভাগ্য আমাদের!’
শুভ্র হাসলো। ভদ্রলোক শুভ্রর সাথে হাত মিলিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকালেন,
‘ আপনার মেয়ে না? আগেও কয়েকবার দেখেছি। বাবার মতোই দেখতে হয়েছে। তবে কিছুটা আমাদের ছাত্রীর মতোও হয়েছে।’
শুভ্র হাসলো। মেয়ের কানের কাছে মুখ নামিয়ে আদুরে কণ্ঠে মনে করিয়ে দিলো,
‘ আম্মু, আঙ্কেলকে সালাম দাও।’
শুভ্রতা এতোক্ষণ বাবার কাঁধে মাথা রেখে শান্ত চোখে ভদ্রলোকের দিকেই চেয়েছিলো। বাবার কথাতেও সে মুখ তুলে চাইলো না। সালামের পরিবর্তে টলমলে চোখে চেয়ে প্রায় রুদ্ধ কণ্ঠে বললো,
‘ আম্মু যাবো।’
শুভ্রর বুক কেঁপে উঠলো। মেয়েকে বুকের সাথে চেপে ধরলো গভীর আবেগে। আহারে, মেয়েটার এতো মন খারাপ! শুভ্রতার টলমলে চোখের দিকে চেয়ে ধাক্কা খেলেন স্যারও। বুকের ভেতরে হাওয়া দিয়ে গেলো অদ্ভুত এক মায়া। শুভ্রর দিকে চেয়ে শুধালেন,
‘ ওর মা কোথায়?’
শুভ্র বিব্রত কণ্ঠে বললো,
‘ আজকে ওর পরীক্ষা। পাশের রুমে পরীক্ষা দিচ্ছে।’
ভদ্রলোক মাথা ঝাঁকালেন,
‘ ও হ্যাঁ, হ্যাঁ। মাস্টার্সের পরীক্ষা তো চলছে। রোদেলা যে এবার মাস্টার্সে খেয়ালই ছিলো না।’
তারপর চোখ ফিরিয়ে শুভ্রতার দিকে চাইলেন। রোদকে তিনি বিশেষ স্নেহ করেন। অতএব, সেই স্নেহ তার মেয়ের উপরও গড়ালো। চোখ-মুখে বিস্তৃত হাসি নিয়ে শুধালেন,
‘ আচ্ছা! তো আমাদের মামণি আম্মুর কাছে যেতে চায়? আমি নিয়ে যাই আম্মুর কাছে? আসবে আমার কোলে?’
শুভ্রতাকে বিভ্রান্ত দেখালো। সে মায়ের কাছে যেতে চায় ঠিক কিন্তু বাবার লোভনীয় কোল ছাড়তেও তার বিশেষ আপত্তি। সে মায়ের কাছে যাবে বাবার কোলে চড়ে। কিন্তু তা যেহেতু সম্ভব নয় তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও লক্ষ্মী মেয়ের মতো ভদ্রলোকের কোলে চাপলো। সেই সাথে শক্ত করে ধরে রাখলো বাবার হাতের আঙুল। মায়ের মতো বাবাও হারিয়ে গেলে তো সমূহ বিপদ! শুভ্র মেয়ের থেকে হাত ছাড়াতে না পেরে নিজেও এসে দাঁড়ালো দরজার কাছে। রোদ তখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডিউটি স্যারের লাঞ্ছনা সহ্য করছে। এমন অস্বস্তিকর ; একইসাথে অপমানজনক সময়ে ডিপার্টমেন্টের সবথেকে প্রিয় স্যারের কোলে স্বীয় মেয়েকে দেখে সে যতটা না চমকালো, তার থেকেও বেশি চমকালো মেয়ের পেছনে মেয়ের বাবাকে দেখে। দু’দিন যাবৎ শুভ্রতার খুব জ্বর। মামানি-রুহি কেউ বাড়িতে ছিলো না বিধায় অসুস্থ মেয়েকে বাবার বাড়ি রেখে এসেছিলো রোদ। সেই মেয়ে কী করে নানু বাড়ি থেকে বাবার কাছে পৌঁছালো এবং দিনক্ষণ দেখে ঠিক এই অপমানজনক সময়েই বাবাকে নিয়ে প্রকট হলো, তা আর ভাবতে ইচ্ছে হলো না। সৃষ্টিকর্তার প্রতি বড়ো অভিমান হলো, কেন তিনি এই এক্ষুনি শুভ্রকে পাঠালেন? এই পৃথিবীতে কী সময় কম পড়েছিলো? পৃথিবীতে এতো সাবজেক্ট থাকতে তার মানসম্মানেরই এমন নিষ্ঠুর বিসর্জন দিতে হলো কেন? নিজের ওভার ট্যালেন্টেড বরকে এই কলঙ্কিত মুখ সে কী করে দেখাবে? হায় বিধাতা, পৃথিবীটা এখনও দু’ভাগ হয়ে যাচ্ছে না কেন? একটা ঘূর্ণিঝড় এসে ক্লাসরুমটা উড়িয়ে নিলেও তো পারে? কী নিষ্ঠুর এই পৃথিবী, ছেহ্!
রোদ অপমান- অস্বস্তি- আতঙ্কে মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে থাকলেও মেয়ে তাকে দেখে উচ্ছ্বসিত। ডিউটি স্যারও ক্লাসরুমে নতুন অতিথি দেখে আগ্রহী হলেন। রোদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে শুভ্রতার দিকে চেয়ে শুধালেন,
‘ এটা কে স্যার? আমি তো শুনেছিলাম আপনার বাচ্চারা বড়ো হয়ে গিয়েছে।’
স্যার হাসলেন,
‘ এই মিষ্টি মেয়েটা আমার মেয়ে হলে মন্দ হতো না। কিন্তু দুর্ভাগ্য; এটা শুভ্র স্যারের মেয়ে, জাফর।’
জাফর এবার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা শুভ্রকে লক্ষ্য করলেন। তাদের কুশলাদি বিনিময়ের মাঝেই স্যার রহস্য করে বললেন,
‘ বুঝলে জাফর? শুভ্র স্যার কিন্তু একদিক দিয়ে আমাদের ডিপার্টমেন্টের জামাই। উনাকে কীভাবে আপ্যায়ন করা যায় বলো তো?’
জাফর রহস্য বুঝতে না পেরে বললেন,
‘ জামাই মানে?’
স্যার এবার রোদের দিকে চেয়ে ভ্রু নাচালেন৷ ঠাট্টা করে বললেন,
‘ কী রোদেলা? চিনো নাকি স্যারকে?’
রোদ বিষম খেলো। অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
‘ জি? হ্যাঁ.. মানে.. জি স্যার, চিনি। উনি সিএসই ডিপার্টমেন্টের ফ্যাকাল্টি৷ এর আগেও দেখেছি উনাকে।’
রোদের জবাবে পরীক্ষা ফেলে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো সবাই। পেছন থেকে একজন শুধালো,
‘ কয়বার দেখেছিস রে রোদ? গুণে গুণে বল।’
রোদ বন্ধুদের দিকে চেয়ে চোখ রাঙালো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘ হবে দুই-একবার। তোর এতো পরিসংখ্যান দরকার কেন?’
বন্ধুটি সে কথার জবাব না দিয়ে বললো,
‘ দুই-একবার দেখেই আমরা মামা হয়ে গেলাম, সর্বনাশ!’
আবারও চারদিকে হাসির রোল পড়লো। রোদ ক্রুদ্ধ চোখে বন্ধুদের দিকে চাইলো। চাপা কণ্ঠে বললো,
‘ এই নাজমুলকে জুতো খুলে মার তো চিত্রা। বাকিটা আমি দেখবো পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে। বেত্তমিজ!’
চিত্রা নির্বিকার কণ্ঠে বললো,
‘ দুঃখিত বন্ধু। জুতো খোলার মতো এনার্জি আমার শরীরে নাই। আমার মনটা খুবই খারাপ। দেশি মুরগীর ঝোল পেলে….’
চিত্রার কথার মাঝপথেই তার পায়ে শক্ত এক লাথি কষালো রোদ৷ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘ তুই আর তোর মুরগীর ঝোল! আজ শুধু তুই হল থেকে বের হ চিতাবাঘ। তারপর তোর একদিন কী আমার একদিন। মুরগীর জায়গায় তোর ঝোল বানিয়ে রেস্টুরেন্ট খুলবো আমি, স্টুপিড।’
চিত্রা মুখ ভার করে বসে রইলো। স্যার শুভ্রতাকে কোলে নিয়ে রোদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। রোদকে দেখিয়ে শুধালেন,
‘ মামণি, এই মেয়েটাকে তুমি চিনো? কে এটা?’
শুভ্রতা মায়ের দিকে দুই হাত মেলে দিয়ে রুদ্ধ কণ্ঠে ঘোষণা দিলো,
‘ আম্মু। আম্মু যাবো।’
রোদ হাত বাড়িয়ে মেয়েকে কোলে নিলো। স্যার মুচকি হেসে বললেন,
‘ যাক! মেয়ের বাবাকে দুই-একবার দেখলেও মেয়েকে ভালোভাবেই চিনতে পেরেছে আমাদের ছাত্রী।’
চারদিকে হাসির হিড়িক পড়লো। কী লজ্জাজনক অবস্থা, উফ! শুভ্র দরজা থেকেই মেয়েকে ডাকলো,
‘ আম্মু? আমরা এখন চলে যাই, চলো?’
শুভ্রতা বাবার ডাকে বাবার দিকে তাকালো ঠিক কিন্তু কোনো হেলদোল দেখালো না। শুভ্র এবার বাধ্য হয়েই ভেতরে ঢুকলো। মেয়ের কাছে গিয়ে মেয়ের আগে তাকালো মেয়ের মায়ের দিকে। শুভ্রর সেই চাহনিতে গলে গেলো রোদের হৃদয়। আহা, বরটা তার কী সুন্দর! গলে যাওয়া হৃদয় সামলে একেবারে মিহি কণ্ঠে অভিযোগ করলো রোদ,
‘ ক্যাম্পাসে এতো সেজেগুজে আসার মানে কী? শুধু কচি মেয়ে পটানোর ধান্ধা। ‘
‘ আর আপনার বুঝি শুধু দেখে লিখে পাশ করার ধান্ধা? এজন্যই তো মহারাণীকে পড়তে বসতে দেখি না।’
বরের রূপে মুগ্ধ মুখটা আষাঢ়িয়া মেঘের মতো কালো হয়ে গেলো এবার। বিজলির মতো ঝলকে উঠলো দৃষ্টি। শুভ্র স্ত্রীর তপ্ত দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে ঠোঁটের কোণে হাসি চাপলো। শুভ্রতার মুখের কাছে ঝুঁকে নিচু কণ্ঠে বললো,
‘ বাবা? চলো আমরা যাই? আম্মু পরীক্ষা শেষ করে এক্ষুনি চলে আসবে। এতোক্ষণ আমরা বাবার অফিসে বসি? এখানে তো থাকা যাবে না, সোনা।’
শুভ্রতা প্রত্যুত্তরে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেললো। অর্থাৎ, সে প্রস্তাবে রাজি না। শুভ্র জানতে চাইলো,
‘ তাহলে বাবা চলে যাবে?’
শুভ্রতা তৎক্ষনাৎ মায়ের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকালো। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
‘ বাবা যাবে না।’
‘ যেতে হবে তো মা।’
শুভ্রতা মুখ ভার করে জানালো,
‘ বাবা যাবে না।’
শুভ্র মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। নিজে যাবে না, বাবাও যাবে না। দুইজনেই মায়ের সাথে বসে থেকে পরীক্ষা দিবে, কী সুন্দর বুদ্ধি! এই মেয়ে ভবিষ্যতে শিক্ষামন্ত্রী হলে তো দেখি ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে যাবে। পরীক্ষার হলে বাবা-মা-ভাই-বোন-স্বামী-সন্তান সকলের বসে থাকার লাইসেন্স দিয়ে বসে থাকবে। অবাধ চলাচল! শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অদূরে দাঁড়িয়ে তাদের ব্যক্তিগত আলাপন শুনতে না পেলেও শুভ্রতার মর্জি ধরতে পারলেন স্যার। শুভ্রতার প্রতি আচমকা উদিত হওয়া মায়ায় খুশি হয়ে বললেন,
‘ না যেতে চাইলে থাকুক না, স্যার? আপনি যান। কাজ সেরে আসুন। প্রয়োজন হলে আমি না হয় কল করবো আপনাকে।’
শুভ্র চিন্তিত কণ্ঠে বললো,
‘ না স্যার। ও থাকলে এক্সাম হলের প্রোটোকল ভাঙবে। তাছাড়া, রোদের লিখতেও সমস্যা হবে। তার থেকে নিয়ে যাই।’
স্যার হেসে বললেন,
‘ ইমার্জেন্সি হলে প্রোটোকল ভাঙা যায়। আপনার মেয়েটার প্রতি এতো মায়া পড়ে গিয়েছে! মনে হচ্ছে, জোর করলেই কাঁদবে। কাঁদানোর দরকার কী?’
দ্বিধান্বিত শুভ্র মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে রাজি হলো। বাবাকে ছাড়তে নারাজ মেয়ের টলটলে মন খারাপটা নিজের বুকে নিয়ে নীরবে বেরিয়ে গেলো। শুভ্রতাকে পেয়ে সবথেকে আরাম হলো চিত্রার। সে হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো খুশি হয়ে গেলো। মেয়ের মাকে জ্বালানো ক্ষ্যান্ত দিয়ে এবার মেয়েকে জ্বালানো আরম্ভ করলো। শুভ্রতা রোদের গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা এলিয়ে চিত্রার দিকেই চেয়েছিলো। মহাখুশি চিত্রা তার হাতের আঙুল নিয়ে খেলতে খেলতে তার সাথে গল্প জুড়ে দিলো। মাথা এগিয়ে এনে ফিসফিস করে বললো,
‘ তুমি বাবার প্রিন্সেস শুভ্রতা আহমেদ?’
শুভ্রতা মাথা নাড়ে। চিত্রা আবার শুধায়,
‘এই পঁচা মেয়েটা তোমার মা?’
শুভ্রতা জবাব দেয় না।
‘ ইউনিভার্সিটিতে থাকতে তোমার বাবা কিন্তু আমার ক্রাশ ছিলো। ক্রাশ কী বুঝো? বুঝো না? আচ্ছা, অতো বুঝতে হবে না। শুধু এটুকু জানো, ক্রাশকে পটাতে পারলে এই পঁচা মহিলার জায়গায় আমি হতাম তোমার মা। আমি কত সুইট না? তোমার আম্মু পঁচা।’
শুভ্রতা এতোক্ষণ চুপ থাকলেও এবার গম্ভীর মুখে মতামত দিলো,
‘ আম্মু বায়ো।’
‘ তোমাকে কে বলেছে?’
রোদ বিরক্ত হয়ে বললো,
‘ থামবি, চিত্রা? অযথা ওকে ডিস্টার্ব করছিস কেন?’
চিত্রা ততোধিক বিরক্ত হয়ে বললো,
‘ তোকে কে বলেছে, ও বিরক্ত হচ্ছে? ও হলো শুভ্র ভাইয়ার মেয়ে। তোর মতো কথায় কথায় বিরক্ত হওয়ার চিজ না।’
পরমুহূর্তেই কণ্ঠটাকে আহ্লাদে ডুবিয়ে বললো,
‘ দোস্ত? তোর মেয়েটা কি লক্ষ্মী রে? আমার মেয়ে হলে আমরা অদল-বদল করে ফেলবো কেমন?’
রোদ প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না। বিরক্তিতে তার মাথা ফেঁটে যাচ্ছে। এভাবে বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে লেখা যায়? তারওপর চিত্রার এই আহ্লাদ! রোদ অতিষ্ঠ হয়ে খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে এলো। সাথে সাথেই খাতা জমা দিয়ে দিলো চিত্রা। রোদের চেতে থাকা মেজাজ আরও চেতে গেলো যখন দেখলো মেয়ে বাড়ি ফিরতে নারাজ। বাড়ি যাওয়া হচ্ছে বুঝতে পেরেই বারবার শুধাচ্ছে,
‘ বাবা কোতায়?’
রোদ মুখ গম্ভীর করে বললো,
‘ বাবা কাজ করছে।’
‘ বাবা যাবো।’
রোদ মেজাজ খারাপ করে মেয়ের দিকে তাকালো। এই মেয়ের তো ডিমান্ড তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে। একবার মা যাবো, একবার বাবা যাবো। কান বরাবর একটা চড় লাগালেই বাবা যাওয়া বেরিয়ে যাবে। কিন্তু এই মুহূর্তে চড় মারা যাবে না। মেয়ের গালে চড় পড়ার খবর শুভ্র পর্যন্ত পৌঁছানো মাত্র সে তাকে খুন করে ফেলবে। নিজের তো মেয়ে সামলাতে হয় না। এজন্য রাজা-মহারাজার মতো হুকুম জারি করা যায়, ‘মেয়ের গায়ে হাত তুলবে না।’ দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা মেয়ের পেছনে ছুটতে হতো তখন বুঝতো কেন চড় লাগাতে হয়! মেয়ের উদ্বেগ কমাতে শুভ্রকে ফোন করলো রোদ। গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললো,
‘ আমরা বাড়ি ফিরছি। আপনি আসবেন?’
শুভ্র অবাক হয়ে শুধালো,
‘ এতো তাড়াতাড়ি পরীক্ষা শেষ?’
রোদ গম্ভীর হয়ে বললো,
‘ পরীক্ষা দেবো না।’
শুভ্রর বিস্মিত প্রশ্ন,
‘ কেন?’
‘ সেটা তো এখন আপনাকে বিশ্লেষণ করতে পারবো না। আপনি আসবেন কিনা সেটা বলুন।’
‘ না, এখন তো আসতে পারছি না। ডিপার্টমেন্টে কিছু কাজ আছে আমার। সেখান থেকে অফিস যাবো, ভাইয়া অপেক্ষা করছে। আমার বাড়ি ফিরতে রাত হবে। আমি ড্রাইভারকে বলে রেখেছি। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে আসছে, তোমাদের পৌঁছে দেবে।’
রোদ থমথমে কণ্ঠে বললো,
‘ আমি নাহয় গেলাম। আপনার আদরের মেয়ে তো বাবাকে ছেড়ে যেতে নারাজ। মুখ দেখে মনে হচ্ছে এখনি কান্নাকাটি জু্ড়ে দিবে।’
শুভ্র ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
‘ তুমি ওকে একটু বুঝিয়ে নিয়ে যাও৷ আমি জলদি ফিরতে চেষ্টা করবো। আর দয়া করে, ওকে বকাবকি করো না। ও অসুস্থ।’
রোদ মেজাজ খারাপ করে বললো,
‘ আমি এতো বুঝাতে-টুঝাতে পারবো না। আপনার মেয়ে আপনি বুঝান। এমনিই আমার মেজাজ খারাপ। এখন কান্নাকাটি করলে আমি কিন্তু ওকে এখানে ফেলে রেখেই চলে যাবো।’
শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রোদের মেজাজ গরম দেখে আর কথা বাড়ালো না। বললো,
‘ তোমরা তাহলে ক্যান্টিনে অপেক্ষা করো। আমি ঘন্টাখানেক পর আসছি।’
শুভ্রতা আর চিত্রাকে নিয়ে ক্যান্টিনের দিকে যেতেই বেঁকে বসলো শুভ্রতা। সে ওই বিল্ডিং-এ বাবাকে ছেড়ে এসেছে। ওখানেই যাবে। আর কোথাও যাবে না। অচিরেই শুরু হলো কান্না। কিছুতেই তার কান্না থামানো যাচ্ছে না। মেয়েকে রোদ ভালো করে জানে। বাবার মতো জেদ থাকলেও খুবই বুঝদার। ছোট্ট একটা বিষয়ে এভাবে কান্নাকাটি করার কথা না। রোদকে চিন্তিত দেখালো। ক্যান্টিনে গিয়ে বসার কিছুক্ষণের মাঝেই কাঁদতে কাঁদতে নেতিয়ে পড়লো শুভ্রতা। বমি হলো। মুখে ভাসলো লাল লাল ছোপ। জ্বরের দাপটে পুড়ে যাচ্ছে ত্বক। মেয়ের এমন অবস্থায় ঘাবড়ে গেলো রোদ। হাহাকার করে উঠলো বুক। দমবন্ধ হয়ে এলো। চোখ দিয়ে টপাটপ জল গড়াতে লাগলো ভয়ে। শুভ্র ফোন রিসিভ করতেই আটকে রাখা কান্না যেন একটা রাস্তা পেলো। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেলো তার। কিছুক্ষণ আগেও যে মেয়ে রেগে বোম হয়ে ছিলো তাকে আচমকা এভাবে কাঁদতে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলো শুভ্র। হতভম্ব কণ্ঠে বললো,
‘ কী হয়েছে!’
রোদ রুদ্ধ কণ্ঠে পরিস্থিতি জানালো। মায়ের কান্না দেখে মেয়ের কান্না আরও চড়া হলো৷ শুভ্র ফোনের ওপাশে মা-মেয়ের সমস্বর কান্নাকাটিতে স্তব্ধ হয়ে গেলো। ক্লাস, পরীক্ষা ফেলে শুভ্র যখন ক্যান্টিনে পৌঁছালো ততক্ষণে মা-মেয়ে দুজনের অবস্থায় নাজেহাল। মেয়ের থেকে মেয়ের মায়ের অবস্থা আরও খারাপ। শুভ্রতা বাবাকে দেখেই হাত বাড়িয়ে দিলো। বাবা কোলে নিয়ে আদর করতেই তার কান্না থেমে গেলো। কিন্তু মেয়ের মায়ের কান্না থামায় তার সাধ্য কার? ভার্সিটি থেকে পরিচিত ডাক্তারের চেম্বারে পৌঁছানো পর্যন্ত রোদের কান্নাকাটি চললো। ডাক্তার শুভ্রতাকে দেখার আগে রোদের দিকে চেয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বললেন,
‘ আপনার চেহারার এই অবস্থা কেন ভাবি? চোখ-টোখ ফুলিয়ে ফেলেছেন দেখি।’
শুভ্র টিপ্পনী কেটে বললো,
‘ তাই তো! আপনার মেয়ে, আপনার মেয়ে যে করেন সবসময়? তা আমার মেয়ের জন্য আপনার এতো কান্নাকাটির কারণ কী? একটু আগেই না বললেন, ফেলে রেখে চলে যাবেন? হঠাৎ এতো মায়া?’
রোদ প্রত্যুত্তরে গম্ভীর হয়ে রইলো। তার এখনও কান্না পাচ্ছে। এই মেয়েটার জন্য জীবনের সবথেকে বড়ো লড়াই লড়েছে রোদ। মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনা মেয়েটার হঠাৎ কী হলো? মেয়েটার এতো কষ্ট হচ্ছে কেন, ভাবতেই অবশ লাগছে। হাত-পা হয়ে পড়েছে অচলিষ্ণু। সে হাত বাড়িয়ে শুভ্রর শার্টের আস্তিন টেনে ধরে রাখলো। তার মনে হচ্ছে সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। শুভ্র মেয়ের থেকে মনোযোগ হটিয়ে রোদের দিকে তাকালো। এক হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে কণ্ঠ নামিয়ে কোমল স্বরে বললো,
‘ কিচ্ছু হয়নি রোদপাখি। কিচ্ছু হয়নি৷ দেখো, এভ্রিথিং ইজ ওকে। তুমি এতো দুশ্চিন্তা করছো কেন, বলো তো? তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার পাগল পাগল লাগে। কিচ্ছু ম্যানেজ করতে পারি না। প্লিজ, বি স্ট্রং। আমি আছি তো, ভয় কী? ইশ, আর কাঁদে না তো!’
শুভ্রতা বাবার কোলে বসেছিলো। মলিন চোখে চেয়ে বাবার কথা শুনছিলো। বাবার কথা শেষ হতেই মায়ের গালে হাত দিয়ে নিজের দিকে ফিরিয়ে বাবার মতো করে বলার চেষ্টা করলো,
‘ আম্মু? আম্মু, তাক, আল কাঁদে না তো।’
রোদ মেয়ের দিকে চেয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো এবার। মেয়েকে বুকে নিয়ে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো সারা গা। এতো মিষ্টি তার মেয়েটা! শুভ্র বসে থেকে এই মায়াময় দৃশ্য দেখলো। তারপর ঝুঁকে এসে রোদের গালে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে বললো,
‘ আমিও একটা চুমু খাই?’
রোদ লাজুক চোখে তাকালো। শুভ্র এবার ঝুঁকে এসে চুমু খেলো মেয়েকে। মনে মনে প্রার্থনা করলো, হে বিধাতা! এই দুটো মানবীকে কী কোনোভাবে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলা যায় না?
বেশ কিছু টেস্ট করানোর পর ডাক্তার জানালেন, ভয় পাওয়ার কোনো ব্যাপার নেই। এলার্জিক কিছু খাওয়ার জন্য এরকম হয়েছে। কিছুদিন খাবার-দাবারের দিকে খেয়াল রাখলেই ঠিক হয়ে যাবে। রোদ-শুভ্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ডাক্তার দেখিয়ে বাইরে বেরুতেই পার্কিংয়ের সামনে রুহিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। তার পাশ দাঁড়িয়ে মোচড়া-মোচড়ি করছে আদ্র-রোদ্র। দু’জনের গায়েই স্কুলের পোশাক। তাদের নতুন নতুন স্কুলে দেওয়া হয়েছে। বোনকে দেখেই মায়ের হাত ছুটিয়ে দৌঁড়ে এলো তারা। শুভ্র অবাক হয়ে বললো,
‘ বউমণি, তোমরা এখানে কেন? খবর পেলে কী করে?’
রুহি বললো,
‘ চিত্রা বললো শুভ্রতাকে হাসপাতালে এনেছে। এতো টেনশন হচ্ছিলো! তাই স্কুল থেকেই চলে এসেছি। তোমার ভাইয়াও এসেছে।’
সত্যি সত্যিই কিছুদূরে দাঁড়িয়ে অভ্রকে ফোনে কথা বলতে দেখা গেলো। তার থেকেও বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটলো সাহেলদের গাড়িটা হাসপাতালের সামনে থামার পর। সাহেল গাড়ি থেকে মাথা বের করতেই শুভ্র অবাক হয়ে বললো,
‘ তোদের কী কাজ?’
সাহেল নির্বিকারমুখে বললো,
‘ খবর পেলাম শুভ্রতা হাসপাতালে। সিরিয়াস অবস্থা। তুই আমাকে একটা খবর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলি না? তোর প্রিন্সেস আমার হলেও হতে পারে পুত্রবধূ। আমাদের একটা দায়িত্ব আছে না? তুই তো দেখি এখন থেকেই শত্রুতা করছিস!’
ততক্ষণে গাড়ি থেকে নেমে এসেছে সাদাফ আর নাবিলা। সাহেল সাদাফের মাথায় চাটি মেরে বললো,
‘ এই যে পুত্র মহোদয়? মুখখানাকে গম্ভীর করে বুড়ো বুড়ো ভাব নিয়ে বসে থাকলে তো হবে না বাপ। ট্রাই টু ইম্প্রেস হার। নয়তো সারাজীবন চিরকুমার থাকতে হবে। শুভ্রতা ছাড়া অন্যকারো সাথে প্রেম করলে তোর কপালে দুঃখ আছে বলে রাখলাম।’
সাদাফের কপাল কুঁচকে গেলো। বাবার অধিকাংশ কথায় তার বোধগম্য হয়নি। সে মায়ের দিকে চেয়ে জানতে চাইলো,
‘ আম্মু, চিরকুমার কী?’
নাবিলা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
‘ যারা কখনো বিয়ে করে না তাদেরকে চিরকুমার বলে, বাবা।’
সাদাফের মুখ আরও গম্ভীর হয়ে গেলো। সে এখন চিরকুমার ব্যাপারটা নিয়ে ভাববে। সাহেল ছেলের গম্ভীর মুখ লক্ষ্য করে বললো,
‘ দেখ! আমার পুত্রের মুখটা একবার দেখ! বলেছি প্রেম করতে কিন্তু সাহেবের মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোনো বৈজ্ঞানিক সূত্র নিয়ে গবেষণা করছে। একে দিয়ে কিচ্ছু হবে না রে। কই, আমার শুভ্রতা মামণি কই? কোলে দে তো। ওর কানে কানে একটা পরামর্শ করতে হবে।’
সাহেলের ভাব-ভঙ্গিতে হেসে ফেললো সবাই। এর মাঝেই মুখ কাচুমাচু করে এসে উপস্থিত হলো, সাকিব আর রাতুল। শুভ্র তৃতীয় বারের মতো বিস্মিত হয়ে বললো,
‘ কী রে, তোদের খবর দিলো কে?’
রাতুল আর সাকিব দ্বিধান্বিত চোখে শুভ্রর পেছনে তাকালো। এবার সকলের নজর ঘুরে গেলো হাসপাতালের করিডোরে বেঢপ পেট নিয়ে হাত-পা মেলে বসে থাকা চিত্রার দিকে। সাহেল চিত্রাকে দেখেই ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
‘ কী ব্যাপার বলো তো চিত্রারাণী? যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি তুমি। নিশ্চয় খাবারের ঘ্রাণ পেয়ে চলে এসেছো? জানো, সবাই একসাথে হলেই লাঞ্চের প্রোগ্রাম থাকবে। এই সময় এতো খাই খাই স্বভাব কিন্তু ভালো না।’
চিত্রা মুখ ফুলিয়ে অভিযোগ করলো,
‘ আমি কিন্তু তোমার বরের মাথা ফাটিয়ে দিবো নাবিলা আপু? সবসময় আমার সাথে এমন করে! আমি ভালো বুঝে সবাইকে খবরটা দিলাম। ধন্যবাদ না দিয়ে এমন অপমান?’
তারপর আকাশের দিকে দুই হাত তুলে কাতর কণ্ঠে বললো,
‘ আল্লাহ দয়া করো, আমার একটা ছেলে হোক। প্রয়োজনে সিনিয়র বউমা নিয়ে যাবো ছেলের জন্য। তারপরও আপনার সাধের পুত্রবধূ ভাগিয়ে ছাড়বো সাহেল ভাই। তখন কেঁদে কূল পাবেন না।’
সাহেল আঁতকে উঠার অভিনয় করে বললো,
‘ দেখেছো? মেয়ে মানুষের নাড়ে নাড়ে প্যাঁচ!’
সাকিব ফোঁড়ন কাটলো,
‘ কিন্তু আপনার মেয়ে হোক এটাই আমরা চাই শ্বাশুড়ি মা। আপনার মেয়ের জন্য আমি এখনও বিবাহ করি নাই।’
চিত্রা ফুঁসে উঠলে,
‘ খবরদার, সাকিব ভাই! আপনি আমাকে একদম শ্বাশুড়ি মা ডাকবেন না। এই রোদু? তুই কিছু বলবি না? আমি কিন্তু এই ব্যাটার মাথা ফাটিয়ে দিবো।’
রোদ তখনও মেয়ের চিন্তায় বিভ্রান্ত। চিত্রার কথায় খুব একটা সরব হতে পারলো না। পরিশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, আজকের মধ্যাহ্নভোজ হবে আহমেদ ভিলায়। খাবার কিনে নেওয়া হবে সাকিবের রেস্তোরাঁ থেকে। ছেলেটা নতুন রেস্তোরাঁ দিয়েছে। নানা ব্যস্ততায় এখনও সেখানে খেতে যাওয়া হয়ে উঠেনি। রেঁস্তোরার সামনে গাড়ি থামিয়ে সকলেই হৈ-হৈ করে নামলো রেঁস্তোরার ভেতরটা দেখতে। শুভ্রতা ভাইদের দেখেই সজীব হয়ে উঠেছে। বাবার কোল থেকে আছড়ে পাছড়ে নেমে পড়েছে ভাইদের সাথে দাঁড়াবে বলে। বাচ্চারা রেঁস্তোরার বারান্দার ফটো জোনে খেলছে। আদ্র-রোদ্র একটা ফুলে সাজানো দোলনা ধরে টানা হিঁচড়া করছে। শুভ্র রাতুলকে পাশে দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরে ঢুকলো। কিছুক্ষণ পর একদল ছেলে-মেয়ে হৈ-চৈ করে বেরুলো রেস্তোরাঁ থেকে। শুভ্রতাকে বারান্দায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই শুধালো,
‘ এই? এটা ওই স্যারের মেয়েটা না?’
অন্যজন মাথা নাড়লো। ছেলেটা এগিয়ে গিয়ে শুভ্রতার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো। শুধালো,
‘ তোমার নাম কী বাবু?’
শুভ্রতা হকচকিয়ে গিয়ে বললো,
‘ শুব্বতা আমেদ।’
ছেলেটা চমৎকার হাসলো,
‘ আমার নাম নিহান। আমাকে বিয়ে করবে?’
নিহানের এই প্রশ্ন হো-হো করে হেসে উঠলো পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুরা। শুভ্রতা চোখ বড়ো বড়ো করে ছেলেটার দিকে চেয়ে রইলো। বিয়ে ব্যাপারটা তার বোধগম্যের মধ্যে পড়ছে না। বাবা তাকে বিয়ে ব্যাপারটা বুঝায়নি। ছেলেটা এবার শুধালো,
‘ আমি তোমাকে একটু কোলে নিই?’
শুভ্রতা উত্তর দিলো না। ছেলেটা অবশ্য অনুমতির অপেক্ষাও করলো না। খপ করে কোলে তুলে নিলো তাকে। আদ্র-রোদ্র এতোক্ষণ দোলনা ঠেলে খেলছিলো। বোনকে অপরিচিত কারো কোলে দেখেই ছুটে এলো। বললো,
‘ এই তুমি নামাও বোনকে। নামাও!’
ছেলেটি সরু চোখে আদ্রর দিকে তাকালো,
‘ তোমার বোন নাকি?’
আদ্র জবাব দিলো না। তীব্র রোষ নিয়ে চেয়ে রইলো ছেলেটির দিকে। ছেলেটি হেসে ফেলে বললো,
‘ আরে, রেগে গিয়েছো নাকি? আমি কী তোমার বোনকে মেরেছি? আদর করছি তো।’
রোদ্র প্রতিবাদ করলো,
‘ আদরও করবে না। আমাদের বোন আমরা আদর করবো। নামাও তুমি ওকে। তুমি ওকে নিয়ে বেঁচে দিবে।’
তারপর আচমকা ছেলেটির প্যান্ট ধরে ঝুলে পড়ে তীব্র রোষ নিয়ে বললো,
‘ নামাও! নামাও ওকে! নামাও!’
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেলো উপস্থিত যুবকদল। নিহান চোখ সরিয়ে পাশে ভ্রু ট্রু কুঁচকে গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাদাফের দিকে তাকালো। সাদা ফতুয়া আর হাফপ্যান্ট পরে চমৎকার ভদ্রলোক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। নিহান তাকে শুধালো,
‘ ও তোমারও বোন নাকি? তোমরা কী তিন ভাই চম্পা নাকি?’
রোদ্র বরাবরই মারকুটে। সে ক্ষেপে গিয়ে বললো,
‘ ওর বোন কেন হবে? শুভি শুধু আমাদের দুইজনের বোন। ও বোধহয় বোনকে বিয়ে করবে৷ তুমি নামাও ওকে। নামাওওও!’
পেছন থেকে হো-হো হাসির রোল পড়লো। একজন মন্তব্য ছুঁড়লো,
‘ সর্বনাশ নিহান! তোর হবু বউ তো আগে থেকেই বর ঠিক করে রেখেছে রে? সর্বনাশ!’
তার কথায় আবারও রেঁস্তোরা কাঁপিয়ে হাসির ঢেউ উঠলো। নিহান শুভ্রতাকে নামিয়ে দিয়ে সাদাফের দিকে ঝুঁকে শুধালো,
‘ কী ছোট মিয়া? তোমার সাথে আমার প্রতিযোগিতা নাকি? বিয়ে করবে এই মেয়েকে?’
সাদাফ তার কথার কোনো উত্তরই দিলো না। নিহান হেসে বন্ধুদের নিয়ে রেঁস্তোরা থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে একবার পেছনে ফিরে তাকালো। দেখলো আদ্র-রোদ্র বোনকে সুরক্ষিত করে আবার দোলনায় ফিরে গিয়েছে। শুভ্রতা দেওয়ালে লাগানো একটা প্লাস্টিকের ফুল টেনে খোলার চেষ্টা করছে। সাদাফ চট করে তার হাত টেনে সরিয়ে আনলো দূরে। অর্থাৎ, ফুল ধরে টানাটানি করা যাবে না। শুভ্রতাও সরল চোখে চেয়ে মেনে নিলো সেই নিষেধ। নিহান হাসলো। তার হঠাৎ করেই খুব কৌতূহল হলো। জানতে ইচ্ছে হলো, তাদের কী সত্যিই বিয়ে হবে? কেমন হবে তাদের গল্প? বড়ো হলে কী এসব কাণ্ড তাদের মনে থাকবে? কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য!
সমাপ্ত
( Late night Breaks)