ইলমা বেহরোজ
বসন্ত শেষের দিকে। গ্রীষ্মের আগমন চলছে। প্রকৃতি নিঃশ্বাস ফেলে বলছে, “এবার আমার বিদায়ের পালা।” গাছের পাতাগুলো ইতিমধ্যে হলদেটে হয়ে উঠেছে। বার্ধক্যের ছোঁয়া লেগেছে তাদের গায়ে। আকাশে মেঘের আনাগোনা বেড়েছে, তবে বৃষ্টি নেই। বাতাসে একটা অস্থিরতা। জমিদার বাড়ির বাগানে সেই পরিবর্তনের ছাপ স্পষ্ট। ফুলগাছগুলো ক্লান্ত, তবু তাদের সেবায় মনোনিবেশ করেছেন সুফিয়ান। বিকেলের নরম রোদে তিনি আর তার কর্মচারী সিদ্দিক মিলে গাছপালায় পানি দিচ্ছিলেন। সুফিয়ানের চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। সেই ক্লান্তিকেও হার মানিয়েছে তার কর্তব্যবোধ। এই কর্তব্যের জন্যই দুইদিনের মাথায় কবিরাজের বাড়ি থেকে চলে এসেছেন।
হঠাৎ করে তার নজর পড়ল বাড়ির দরজার দিকে। জাওয়াদ, তার ছেলে, বেরিয়ে যাচ্ছিল। সুফিয়ানের গম্ভীর কণ্ঠে ডাকলেন, “জাওয়াদ!”
জাওয়াদ থমকে দাঁড়াল। তার শরীরের ভাষায় অনিচ্ছা। ধীরে ধীরে সে ঘুরে দাঁড়াল, প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে। তার চোখে মুখে একটা চাপা বিদ্রোহের ভাব।
সুফিয়ান ছেলের দিকে তাকালেন। তার চোখে একসাথে রাগ আর হতাশা। তিনি বললেন, “শুনলাম, দুদিন নাকি খামারবাড়িতে লুকিয়ে ছিলে?”
জাওয়াদ মাথা উঁচিয়ে, প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুরে বলল, “লুকোব কেন? আমি এমনি গিয়েছিলাম। এতে লুকোনোর কী আছে?”
“এসব ছাড়ো। তোমার মা কত চিন্তা করেছে জানো? আমি কবিরাজের কাছে গিয়েছিলাম, কিন্তু চিকিৎসা শেষ না করেই ফিরতে হলো। ব্যবসার চাপ। নাভেদ পাটোয়ারী গম নিয়ে চলে…”
জাওয়াদ বাবার কথার মাঝেই বাধা দিয়ে বলল, “বাবা, আমার একটু জরুরি কাজ আছে। পরে কথা হবে।” সে পা বাড়াতে যাচ্ছিল।
সুফিয়া গর্জে উঠলেন, “দাঁড়াও! আমার কথা শেষ হয়নি।” তার কণ্ঠস্বরে এমন একটা শক্তি ছিল যে জাওয়াদ অনিচ্ছা সত্ত্বেও থেমে গেল।
সুফিয়ান এবার ধমকের সুরে বললেন, “আমার অনুমতি ছাড়া কোথায় যাচ্ছো? তোমাকে কতবার বলেছি, ব্যবসায় মন দাও। এই জমিদারি একদিন তোমাকেই দেখতে হবে। কিন্তু তুমি কী করছো? শুধু উড়ে বেড়াচ্ছো।”
জাওয়াদের চোখে মুখে এবার একটা দৃঢ়তা ফুটে উঠল। সে বলল, “আমি অনেক আগেই বলেছি বাবা, ওসব আমি পারব না। জমিদারি, ব্যবসা এসব আমার জন্য নয়। আমার নিজের স্বপ্ন আছে।”
সুফিয়ানের চোখে বিস্ময় ও ক্রোধের মিশ্রণ। তিনি ব্যঙ্গাত্মক সুরে জিজ্ঞেস করলেন, “স্বপ্ন? কী স্বপ্ন? তাহলে কী পারবে তুমি? ছোটবেলা থেকে শুধু আকাশে বিমান উড়াতে চেয়েছো। তোমার মা আর চাচার অনুরোধে শহরে রেখে পড়াশোনা করিয়েছি। আর তুমি কী করেছো? সব কিছু ফেলে নিখোঁজ হয়ে গেছো। টাকা আর সময় দুটোই নষ্ট করেছো।”
জাওয়াদের চোখে এবার একটা আগুন জ্বলে উঠল। সে গর্বের সাথে বলল, “বাবা, আমি প্রাইভেট পাইলট লাইসেন্স পেয়েছিলাম। আর কিছুদিন গেলে কমার্শিয়াল লাইসেন্সও পেয়ে যেতাম। আমি কিছু নষ্ট করিনি। আমি আমার স্বপ্নের পিছনে ছুটেছি।”
সুফিয়ান বিরক্তিতে মাথা নাড়লেন। তার চোখে মুখে একসঙ্গে রাগ আর হতাশা ফুটে উঠল। তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “কিন্তু সেই কিছুদিন তো গেল না, তার আগেই তুমি নিখোঁজ হয়ে গেলে। এখনো বলোনি কোথায় গিয়েছিলে।” তিনি একটু থামলেন। নিজের ভেতরের উদ্বেগটাকে সামলাতে চেষ্টা করছেন। তারপর আবার বললেন, “তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে কি ভেবেছো? সময় থাকতে ব্যবসায় মন দাও। ওসব বিমান উড়িয়ে কি হবে?”
সুফিয়ানের কণ্ঠে এবার একটা অসহায়তা ফুটে উঠল। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “তুমি ছাড়া আমাদের কোনো উত্তরাধিকারী নেই, জাওয়াদ। এটা শুধু ব্যবসা নয়, এটা আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য।”
জাওয়াদের চোখে মুখে একটা অদ্ভুত মিশ্রণ ফুটে উঠল। বিদ্রূপ, রাগ, আর একটুখানি দুঃখ। সে পরিষ্কার গলায় বলল, “চাচা তো সবে বিয়ে করেছে। উনাকে বলুন একটা ছোট্ট উত্তরাধিকারী নিয়ে আসতে। সেই উত্তরাধিকারী নিশ্চয়ই আপনার মতো হবে। না হলেও আমি তাকে শিখিয়ে দেব কীভাবে আপনার মতো গম্ভীর মুখ করে বসে থাকতে হয়। আর ঐতিহ্যের কথা বলতে হয়।”
সুফিয়ান হকচকিয়ে গেলেন। তার মুখ লাল হয়ে উঠল রাগে। তিনি গর্জন করে উঠলেন, “কী বললে? এই বেয়াদব ছেলে! তোমার এত বড় সাহস?”
জাওয়াদ আর দাঁড়াল না। সে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে হনহনিয়ে চলে গেল।
দৃশ্যটি দেখে সিদ্দিকের ঠোঁটের কোণে একটা চাপা হাসি খেলে যায়। সে যতই চেষ্টা করুক, তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠা কৌতুকের ভাবটা লুকোতে পারল না।
সুফিয়ান ঝাঁঝালো চোখে তাকালেন সিদ্দিকের দিকে। তার চোখে জ্বলছে রাগের আগুন। গর্জন করে উঠলেন, “কী রে হারামজাদা? হাসছিস কেন?”
সিদ্দিক তড়িঘড়ি নিজেকে সামলে নেয়। তার মুখের হাসি মুহূর্তেই মিলিয়ে যায়।
সুফিয়ান আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন, “আমার ছেলে আমাকে বেইজ্জতি করল, আর তুই দাঁড়িয়ে হাসছিস?”
সিদ্দিকের মুখ ভয়ে সাদা হয়ে যায়। সে কাঁপা গলায় বলল, “মাফ করেন হুজুর। আমি… আমি ভুল করে ফেলছি। আমার উচিত হয়নি…”
সুফিয়ান গভীর শ্বাস নিলেন। নিজের রাগটাকে দমন করার চেষ্টা করছেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে, ধীরে ধীরে বললেন, “দেখ সিদ্দিক, তুই আমার মায়ের বাড়ির লোক। তার মানে এই না যে, যা খুশি তাই করবি। এমন কাণ্ড করবি না যাতে তোকে এ বাড়ি থেকে তাড়াতে হয়।”
সিদ্দিক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, কথা বলার সাহস পাচ্ছে না।
সুফিয়ান আবার বললেন, এবার একটু নরম সুরে, “যা, গিয়ে দেখ জাওয়াদ কোথায় যাচ্ছে। ওর পিছু নে। আর মনে রাখবি, এ বাড়িতে যা হয়, তা এই বাড়িতেই থাকবে। বুঝেছিস?”
সিদ্দিক মাথা নেড়ে সায় দিল। তার চোখে-মুখে তখন শুধু অনুশোচনা আর ভয়। সে আর কিছু না বলে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে জাওয়াদের পথ ধরে।
জুলফার ঘরের দরজা বন্ধ। বাইরে থেকে শঙ্খিনীর উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, “বেগম সাহেবা, একটু দরজা খুলুন। কিছু মুখে দিন। কী হয়েছে আপনার?” তার কথায় উৎকণ্ঠা ও মমতা।
ঘরের অন্ধকারে, চার পোস্টার বিশাল পালঙ্কে পড়ে আছে জুলফা। তার চোখ লাল, অশ্রুর নদী বয়ে গেছে সেখানে। চুল এলোমেলো। গতকাল বিকেল থেকে শুধু পানি ছাড়া কিছুই স্পর্শ করেনি তার ঠোঁট। খাবারের কথা হারিয়ে গেছে স্মৃতির অতল গহ্বরে। মনের ভেতর যে ঝড় বইছে, তা থামানোর ক্ষমতা নেই কোনো মানবিক শক্তির। জুলফা চোখ বোজে। পলকের মাঝেই আবার সেই দৃশ্য ভেসে ওঠে। নাভেদ আর রাইহা একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরেছে। রাইহার চোখে অশ্রুর ঝরনা, নাভেদের দৃষ্টিতে গভীর উদ্বেগ। জুলফার বুকের ভেতর একটা তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে।।আবার তার চোখ দুটি সজল হয়ে ওঠে, অশ্রু গড়িয়ে পড়ে গালের ওপর দিয়ে।
“কেন?” জুলফা নিজের মনেই প্রশ্ন করে, তার কণ্ঠে বেদনার সুর। “কেন রাইহা? তুমি তো ছোট জমিদারের বউ হবে। সমাজের চোখে উঁচুতে উঠবে। তবে কেন নাভেদকে জড়িয়ে ধরলে?”
বাইরে শঙ্খিনী এখনো ডাকছে। জুলফার কানে তা পৌঁছায় না। সন্ধ্যা নামছে। ঘরের ভেতরে জুলফার মনেও নেমে এসেছে এক গভীর অন্ধকার। সে এক অতল সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে। তার চিন্তাগুলো উত্তাল তরঙ্গের মতো এসে আছড়ে পড়ছে মনের তীরে। সে ভাবতে থাকে, হয়তো জাওয়াদের অজান্তেই রাইহা আর নাভেদ প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। এখন জাওয়াদের কী হবে? আর তার নিজের কষ্ট? সে জানে নাভেদকে সে কখনো পাবে না। তারা দুটি সমান্তরাল রেখা যা কখনোই মিলবে না। অবিবাহিত থাকাকালীনই নাভেদের নজরে পড়েনি, সেখানে এখন সে বিবাহিত। তবুও কষ্ট হচ্ছে। বুকের মধ্যে একটা তীক্ষ্ণ ছুরি বিঁধে আছে। কিছুতেই এই যন্ত্রণা আটকানো যাচ্ছে না, প্রতিটি মুহূর্তে তা আরও গভীর হচ্ছে।
হয়তো তাদের মধ্যে প্রেম হয়নি। কিন্তু দুই বছর ধরে যে পুরুষ তার স্বপ্নের রাজপুত্র ছিল, সেই পুরুষকে অন্য মেয়ে জড়িয়ে ধরেছে – এই দৃশ্য কীভাবে মেনে নেবে সে? তার হৃদয় বিদ্রোহ করে ওঠে এই চিন্তায়। রাইহাই বা কীভাবে জাওয়াদকে প্রতারিত করে নাভেদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ল? আর নাভেদ, সে কি একবারও ভাবল না যে জমিদার বাড়ির হবু বউয়ের সঙ্গে সম্পর্কে যাওয়া কত বড় অপরাধ?
রাত গভীর হয়। জুলফার ঘরের বাইরে এখন আর কোনো শব্দ নেই। শঙ্খিনী হয়তো ক্লান্তিতে ঢলে পড়েছে, তার উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর নীরবতায় মিলিয়ে গেছে।
জুলফা ধীরে ধীরে উঠে বসে পালঙ্কে। তার শরীর দুর্বল, অনাহারে ক্লান্ত। মাথা ঘুরছে। সে টলতে টলতে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে গভীর অন্ধকার, কালো কালিতে ডুবে গেছে সারা প্রকৃতি।
জুলফার মন যখন বিষাদে ভারাক্রান্ত হয়, তখন সে রাতের অন্ধকারে একাকী ঘুরে বেড়ায়। এই অভ্যাস তার কাছে এক নির্বাক সান্ত্বনা। আজও সেই অদম্য টান অনুভব করে। তার মনের গহনে কী একটা অজানা শক্তি তাকে আহ্বান করছে। বিনা দ্বিধায়, কোনো চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই, সে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ে বাড়ি থেকে। একটা অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা পুতুলের মতো, সে পা চালায় বনের দিকে। সেখানে গাছপালার নিবিড় ছায়া আরও গভীর অন্ধকার সৃষ্টি করেছে।
রাতের বাতাস শীতল স্পর্শে জুলফার এলোমেলো চুলে খেলা করছে। তার পায়ের নিচে শুকনো পাতার মৃদু মর্মর ধ্বনি, দূর থেকে ভেসে আসা শেয়ালের করুণ আর্তনাদ রাতের নিস্তব্ধতাকে আরও গাঢ় করে তুলছে। জুলফার মনে কোনো ভীতি নেই। তার অন্তরের গভীর যন্ত্রণার কাছে এসব ভয় তুচ্ছ, নগণ্য।
সে এগিয়ে চলে, নিজের থেকে দূরে পালিয়ে যেতে চায়। এই নিরুদ্দেশ যাত্রাই এখন তার একমাত্র সান্ত্বনা। বনের নিঃশব্দতা জুলফার মনের সাথে একাত্ম হয়ে যায়। এখানে তার মনে হয়, তার অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবন আর এই বিশাল পৃথিবীর অন্ধকার একাকার হয়ে গেছে। সে অনুভব করে, অন্ধকার তার সঙ্গে আছে!
জুলফা থমকে দাঁড়ায় একটা বিশাল বটগাছের নিচে। গাছের খসখসে বাকলে হাত বোলায়। এই গাছও তার মতো একা, নিঃসঙ্গ। তবুও দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, যুগ যুগ ধরে। হঠাৎ একটা পেঁচার ডাক শোনা যায়। জুলফা চমকে ওঠে না। সে আকাশের দিকে তাকায়। মেঘের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা তারা। জুলফা আবার হাঁটতে শুরু করে। এবার তার পদক্ষেপ একটু দৃঢ়। এই অন্ধকার চিরস্থায়ী নয়। যেমন রাতের পর আসে দিন, তেমনি তার জীবনেও একদিন আলো ফুটবে। হয়তো সেই আলো এখনও দূরে, কিন্তু তা আসবেই।
হঠাৎ কানে আসে ঘোড়ার ক্ষুরের ছন্দোবদ্ধ শব্দ – খটাং খটাং, খটাং খটাং। সেই অপ্রত্যাশিত শব্দে জুলফা থমকে দাঁড়ায়। তার বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড পাখির ডানার মতো ফড়ফড় করে উঠল। নিঃশ্বাস থেমে যাবার উপক্রম। বিস্ফারিত চোখে সে তাকিয়ে রইল সামনের অন্ধকারের দিকে।
গভীর রাতের আবরণ ভেদ করে ধীরে ধীরে প্রকট হতে লাগল একটি অস্পষ্ট মূর্তি। মুহূর্তের মধ্যেই সেই আবছা আকৃতি রূপ নিল এক দৃপ্ত অশ্বারোহীর। রাতের আলোয় ঝলমল করছে সাদা ঘোড়া। আর তার পিঠে বসে আছে নাভেদ।
জুলফার চোখ দুটি আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। নাভেদ যেন রূপকথার পাতা থেকে সাক্ষাৎ জীবন্ত হয়ে এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। নাভেদের দৃষ্টিতেও ফুটে উঠল অপরিসীম বিস্ময়। সে সটান লাফিয়ে নামল ঘোড়ার পিঠ থেকে। ঘোড়ার লাগাম হাতে নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এল জুলফার দিকে। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে তার সুগঠিত দেহ। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে অবাক বিস্ময় আর কৌতূহল। জুলফার দিকে তাকিয়ে সে মৃদু কণ্ঠে বলল, “আপনি এই নির্জন বনে?”
জুলফার হৃদয় তখন দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে। তার চোখে মুখে বিস্ময়। সে কিছুটা সংকুচিত হয়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, আমি… আমি এখানে একটু হাঁটতে এসেছিলাম।”
নাভেদ এক পা এগিয়ে এল। তার চোখে মুখে ফুটে উঠল উদ্বেগ, “কিন্তু এই গভীর রাতে? একা? এটা তো বিপজ্জনক হতে পারে!”
জুলফা অস্বস্তি নিয়ে বলল, “এখানে প্রায়ই আসি, আমার অভ্যাস আছে।”
নাভেদের চোখ-মুখের উদ্বেগ গভীর হয়, “এই বন আর আগের মতো নিরাপদ নেই। শুনেছি, দস্যুরা নাকি এদিকে তাদের আস্তানা গেড়েছে। আপনার মতো একজন রূপবতী নারীর পক্ষে এখানে একা থাকা মোটেও নিরাপদ নয়।”
জুলফার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। সে একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু আপনিও তো একা একা ঘোড়া নিয়ে এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।”
নাভেদের চোখে তখন এক অপার্থিব দৃষ্টি ঝিলিক দিয়ে উঠল। তার কণ্ঠস্বরে ফুটে উঠল বেদনার সুর, “জীবনে এমন কিছু মুহূর্ত আসে যখন মনের গহীনে এক অজানা শোকের ঢেউ উথলে ওঠে। তখন এই ঘোড়াই হয়ে ওঠে আমার একমাত্র সঙ্গী। আমরা দুজনে মিলে বেরিয়ে পড়ি, খুঁজতে থাকি মনের শান্তি, জীবনের অর্থ।”
জুলফার মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে এল, “আপনারও দুঃখ আছে!”
নাভেদের ঠোঁটে হাসির রেখা দেখা দিল। সে ধীরে ধীরে বলল, “দুঃখ? দুঃখ তো জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর অস্তিত্ব প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে লুকিয়ে থাকে। আচ্ছা, আপনি কি কখনো ভেবে দেখেছেন, এই বিশাল জমিদারির একজন অধিকারিণী হয়েও আপনার মনে অতৃপ্তির জন্ম?”
জুলফা হঠাৎ করেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল। নাভেদ কীভাবে তার অন্তরের গোপন কথাটি জানতে পারল? সে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আমার? আমার আবার কীসের অতৃপ্তি? আমি তো সবই পেয়েছি জীবনে।”
জুলফার বুকের ভেতর তখন প্রচণ্ড ঝড় বইছে। নাভেদ কি সত্যিই তার মনের গভীরে লুকানো সেই অপূর্ণতার কথা জেনে ফেলেছে?
নাভেদ তখন গভীর দৃষ্টিতে জুলফার দিকে তাকিয়ে বলল, “মনে অশান্তি কিংবা অতৃপ্তি না থাকলে কি কেউ এভাবে রাতের অন্ধকারে নির্জন বনে ঘুরে বেড়ায়? মানুষ তখনই প্রকৃতির নির্মল কোলে আশ্রয় খোঁজে যখন সে মানুষের সান্নিধ্যে কিংবা বস্তুগত সুখ-সমৃদ্ধির মাঝে তার মনের শান্তি খুঁজে পায় না।”
জুলফা নির্বাক। তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে অব্যক্ত বেদনার ছায়া। সে নীরবে তাকিয়ে রইল নাভেদের দিকে।
নাভেদ নরম সুরে বলল, “রাত গভীর হয়ে আসছে। আপনার এবার বাড়ি ফেরা উচিত। এই বনের নিস্তব্ধতা যতই মনোরম হোক, এর বিপদও কম নয়।”
জুলফা মৃদু মাথা নাড়ল। নাভেদ ঘোড়ার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে হঠাৎ করেই, আবার জুলফার দিকে ফিরে তাকাল। তার চোখে একটা অদ্ভুত চাঞ্চল্য।
নাভেদ একটু ইতস্তত করে বলল, “আপনি যখন দেখেছেনই, তাই বলে ফেলি। রাইহা আর আমার মধ্যে… সেটা শুধুই বন্ধুত্বের সম্পর্ক। জানেন তো, মেয়েটা একটু আধুনিক মনের। তাই ওভাবে…”
নাভেদের কথা অসমাপ্ত থেকে গেল। সে আর কিছু না বলে দ্রুত ঘোড়ায় চেপে বসে। তারপর, নিজের সাথেই কথা বলার মতো করে বলল, “আসি তাহলে।”
নিস্তব্ধ বনভূমির মাঝে, জুলফা দাঁড়িয়ে রইল নিশ্চল মূর্তির মতো। নাভেদের শেষ কথাগুলো তার কানে বাজছে, “রাইহা আর আমার মধ্যে… সেটা শুধুই বন্ধুত্বের সম্পর্ক।” কথাগুলো জাদুর মন্ত্রের মতো কাজ করে তার মনে। তার মনের আকাশ থেকে কালো মেঘের আস্তরণ সরে গিয়ে সেখানে ফুটে উঠে মনোরম রামধনু। ঠোঁটের কোণে দেখা দেয় মৃদু হাসির রেখা, যা সে কোনোমতেই চেপে রাখতে পারছে না। গতকাল থেকে বুকের মধ্যে যে ভারী পাথরটা চেপে বসেছে, সেটা হঠাৎ করেই পালকের মতো হালকা হয়ে গেছে।
কানে বেজে উঠে নাভেদের আরেকটি কথা, যা সে কিছুক্ষণ আগে বলেছিল, “আপনার মতো একজন রূপবতী নারীর পক্ষে এখানে একা থাকা মোটেও নিরাপদ নয়।” তখন এই কথাটা তার মনে তেমন দাগ কাটেনি, কিন্তু এখন সেই কথাটি নতুন অর্থ নিয়ে ফিরে এসেছে।
“রূপবতী…” শব্দটা জুলফার মনে বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। নাভেদ তাকে রূপবতী বলেছে! এই ভাবনাটা তার মনে এক অদ্ভুত শিহরণ জাগায়। সে এক হাতে নিজের গাল স্পর্শ করে, যেন নিজের রূপের অস্তিত্ব খুঁজছে।
আবার ঘোড়ার ক্ষুরের মৃদু শব্দ ভেসে এল। জুলফা চমকে উঠে মুখ তুলল। চাঁদের আলোয় দেখা গেল নাভেদের চিরপরিচিত মূর্তি। তার হৃদয়ের স্পন্দন দ্রুততর হয়ে উঠল। নাভেদ ঘোড়া থেকে নেমে আসে। তার চোখে-মুখে একটা উদ্বেগ আর সংকোচ। সে কিছুক্ষণ নীরব থেকে, নিজের সাহস সঞ্চয় করে, ধীরে ধীরে বলল, “আপনাকে একা এই নির্জন বনপথ দিয়ে একা যেতে দেওয়া উচিত হবে না।” সে একটু থেমে আবার বলল, “যদি আপত্তি না থাকে, আমি আপনাকে আমার ঘোড়ায় চড়িয়ে বনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে দিতে পারি।”
নাভেদের এই অপ্রত্যাশিত প্রস্তাবে জুলফার মন বিস্ময়ে, আনন্দে নেচে ওঠে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে একটা সূক্ষ্ম উদ্বেগও তার মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সে কিছুক্ষণ নীরব থেকে, নিজের ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে নিয়ে, মৃদু স্বরে বলল, “নাভেদ সাহেব, আপনার এই উদারতায় আমি অভিভূত। কিন্তু…” সে একটু থেমে গেল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, “আপনি জানেন, আমার অবস্থান… সমাজের চোখে… যদি কেউ দেখে ফেলে…”
নাভেদ জুলফার অসমাপ্ত কথার অর্থ বুঝতে পেরে জুলফার চোখের দিকে তাকিয়ে, গভীর মমতায় বলল, “আমি আপনার উদ্বেগ বুঝতে পারছি। কিন্তু এই মুহূর্তে আপনার নিরাপত্তাই সবচেয়ে জরুরি। লোকে কী ভাববে, সেটা নিয়ে এখন ভাবার সময় নয়।” তারপর একটু থেমে, একটু নরম সুরে যোগ করল, “আর তাছাড়া, আমরা তো কিছু অন্যায় করছি না। শুধুমাত্র একজন বন্ধু হিসেবে আপনাকে সাহায্য করছি।”
জুলফার মনের মধ্যে তখন এক তুমুল দ্বন্দ্ব চলছে। একদিকে সামাজিক মর্যাদা রক্ষার দায়, অন্যদিকে নাভেদের প্রতি তার অব্যক্ত অনুরাগ। এই মানুষটার সান্নিধ্য, উপস্থিতির জন্য সে সর্বক্ষণ উন্মুখ হয়ে থাকে। আর এখন, যখন সেই সুযোগ এসেছে, তখন কি সে তা হারাতে পারে?
অবশেষে, জুলফা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মাথা নিচু করে মৃদু স্বরে বলল, “ঠিক আছে।” তারপর একটু ইতস্তত করে যোগ করল, “তবে… আমি কখনো ঘোড়ায় চড়িনি। একটু ভয় লাগছে।”
নাভেদের মুখে হাসি ফুটে। সে ঘোড়ার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, তারপর জুলফার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “আমি আছি। আপনার কিছু হতে দেব না। এবার আসুন।”
জুলফা ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল। যখন সে নাভেদের হাতে হাত রাখল, তখন তার সারা শরীরে একটা শিহরণ খেলে যায়। নাভেদ তাকে যত্ন করে ঘোড়ার পিঠে তুলে দেয়। সেই মুহূর্তে, চাঁদের আলোয় দুজনের চোখাচোখি হলো। সেখানে ছিল একটা অব্যক্ত বোঝাপড়া, একটা নীরব স্বীকৃতি।
নাভেদ পিছনে বসতেই জুলফা অনুভব করে তার পিঠের সঙ্গে নাভেদের বুকের স্পর্শ। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা ফাঁকা হয়ে যায়। হৃদয় উধাও হয়ে যাচ্ছে, মাথা ঘুরছে অবিরাম। শরীরের প্রতিটি স্নায়ু টানটান, কিন্তু গায়ে এক ফোঁটাও শক্তি পাচ্ছে না।
ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দে বনের নিস্তব্ধতা ভেঙে পড়েছে। চাঁদের আলো পাতার ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ে নাচছে তাদের গায়ে। জুলফার নিশ্বাস ক্রমশ দ্রুত হচ্ছে। সে চেষ্টা করছে নিজেকে সামলাতে, কিন্তু নাভেদের উষ্ণ শ্বাস তার ঘাড়ে লাগছে, আর সে অনুভূতির বেড়াজালে আরও অসহায় হয়ে পড়ছে।
হঠাৎ করেই জুলফার চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে এল। শরীর ঝিমঝিম করতে লাগল, মনে হলো যেন সে ভেসে যাচ্ছে অতল গহ্বরে। তার জ্ঞান হারানোর মুহূর্তটা একটা স্বপ্নের মতো – বনের গাছপালা, চাঁদের আলো, ঘোড়ার দৌড় সব মিলেমিশে একাকার।
নাভেদ অনুভব করে জুলফার শরীর ঢলে পড়ছে। তৎক্ষণাৎ সে তাকে জড়িয়ে ধরল। ঘোড়ার গতি কমিয়ে, সে জুলফাকে নিজের বুকের কাছে টেনে নিল। তার নরম চুলে হাত বুলিয়ে, কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “জুলফা, আমি আছি। ভয় নেই তোমার।”
চলবে…