#অবন্তিকা_তৃপ্তি
রাতের আঁধার ধীরে ধীরে বাড়ছে। আমন্ত্রিত অতিথিদের অনেকেই তখন অনুষ্ঠান ছেড়ে বাড়ি ফিরেছেন। সবেমাত্রই অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে। কজন ছাত্র-ছাত্রী মিলে স্যারের আদেশে ক্যাম্পাস পরিষ্কার করছিলো। ধ্রুব তখন একপ্রকার হাওয়া বলা চলে। কোথায় গেছে কে জানে? অদিতি তখন ভাগে পরা কাজগুলো শেষ করে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে যাবে-যাবে অবস্থা। হঠাৎ ওর পেছনে এসে দাঁড়ালেন ধ্রুবর বাবা; সৌরভ ইয়ামিন। অদিতির সঙ্গে আলাদা করে দুটো কথা বলবেন ভেবেই, সবাই চলে গেলেও এতক্ষণ ধরে বসে ছিলেন।
ধ্রুবর বাবা ডাকলেন পেছন থেকে—‘শুনো মেয়ে!’
অদিতি ব্যাগ গোছাতে গোছাতে পেছন ফিরে তাকাল। সৌরভকে দেখেই ও রীতিমত চমকে উঠে, ব্যাগ-ট্যাগ ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো। প্রধান অতিথি স্বয়ং তাকে ডাকছে; অদিতি কিছুটা গুটিয়ে গেল যেন এ কথা চিন্তা করে।!ও তখনও ধ্রুবর বাবাকে চিনে না। ও শুধু চিনে সৌরভ ইয়ামিন,যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছেন।
সৌরভের ডাকে অদিতি সাতপাঁচ চিন্তা করে এগিয়ে গেল; গলার স্বর নিচু রেখে বলল —‘আসসালামুয়ালাইকুম, স্যার।’
ধ্রুবর বাবা অদিতিকে জহুরিচোখে আগাগোড়া দেখলেন। বাবা হিসেবে উনার ছেলেকে তো উনি চিনেন। চুড়ান্ত বেয়াদব; উগ্র, বখাটে একটা ছেলে কেমন মেয়েকে ভালোবেসেছে সেটা উনি একবার পরীক্ষা করে দেখে নিচ্ছেন। নীল রঙ্গা শাড়ি পড়া মোটামোটি ছিমছাম গড়নের একটা মেয়ে। মুখে আজকাল যুগের মেয়েছেলেদের মতো একগাদা মেকআপ নেই, সামান্য কাজল চোখে। মুখের আদল ভারি মিষ্টি; সরল ভীষণ!
এই অনুষ্ঠানে অনেক মেয়েছেলে শাড়ি টাইট-ফিট করে পরে এসেছিলো আজ, কজন কোমর দেখিয়ে নেচেছেও সবার সামনে। অথচ এই মেয়ের এতটা মার্জিতভাবে শাড়ি পরা উনাকে উনার মরহুম স্ত্রীর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে আজ। কারিশমা এভাবেই গাঁ ঢেকে: কোমরের দিকের শাড়িতে ডজন সেফটিপিন লাগিয়ে মার্জিত ভাবে শাড়ি পড়তো, আজ অব্দি কেউ বলতে পারেনি- কারিশমার গায়ের বাঁক কেমন ছিলো; এতটাই মার্জিত ছিলো সে। এই মেয়েটাও তেমনি; অত্যন্ত মার্জিত! আজকাল ঢাকা শহরের কিছু বখে যাওয়া মেয়ের ন্যায় নয়।
ব্যাস! সৌরভের বাবা-বাবা মনটা অদিতিকে দেখে ভীষণ তুষ্ট হলো! সম্ভবত ছেলের বৌ হিসেবে অদিতির মধ্যে নিজের স্ত্রীর গুণগুলো উনি দেখেছেন। সৌরভ কণ্ঠে মায়া ঢেলে বললেন—-‘কেমন আছো তুমি, মা?’
অদিতি অবাক; উনি অদিতির ভালো-মন্দ কেন জিজ্ঞেস করছেন? তবুও সম্মান রক্ষার্থে অদিতি জবাব দিল —‘জ্বী, ভালো, স্যার। আপনি?’
সৌরভ যারপরনাই খুশি হলেন অদিতির আলাপে। হাসিহাসি মুখে জবাব দিলেন —‘ভালো আছি, মা। তোমার বাড়ি কোথায়?’
অদিতি তখনও অবাক, ও জবাব দিল—‘‘লক্ষ্মীপুর।’
সৌরভ চমকে উঠলেন; জিজ্ঞাস করলেন —‘লক্ষ্মীপুরের কোথায়?’
অদিতি জবাব দিল —‘ইসলামপুর, স্যার।’
সৌরভ হুট করে কিছু যেন মনে পরে গেল। উনি বিস্মিত হয়ে বললেন—-‘ আরে? ওখানে তো আমি গেছিলাম একদিন; আমার জোয়ান বয়সে; বন্ধু-বান্ধব নিয়ে। আমার একটা প্রজেক্টের কাজ ছিলো তোমাদের গ্রামে। গ্রামটা অনেক সুন্দর ছিলো, আমরা ভীষণ এনজয় করেছিলাম।’
অদিতি অবাক হয়েছে বটে। দুনিয়াটা আসলেই গোল! ও ভদ্রতার খাতিরে বললো ——‘আরেকবার ওদিকে গেলে আমাদের বাড়িতে যাবেন, স্যার।’
সৌরভ যেন হাতে চাঁদ পেলেন, খুশিতে গমগম করে উঠে বললেন —‘হ্যাঁ, অবশ্যই। তোমার বাবার নাম; বাড়ির ঠিকানাটা দিয়ো। আমি ওদিকে বেড়াতে গেলে তোমাদের বাড়িতে ঘুরে আসতে চাই। পুরনো দিনটা আবার ফিরে পেতে কার না ভালো লাগবে।’
অদিতি এবার কিছুটা হীনমন্যতায় ভুগতে লাগলো। ওদের ওই ওতো ছোট বাড়িতে এতবড় গনমান্য মানুষ যাবেন? ওদের বাড়িতে গেলে; ওরা তো সেইভাবে উনার খেয়ালই রাখতে পারবে না। অদিতি কিছুটা দোনামনা করতে পাগল। হঠাৎ কোথা থেকে ধ্রুব বড়বড় পা ফেলে এগিয়ে এলো ওদের দিকে।
সৌরভ আগ বাড়িয়ে অদিতিকে কিছু বলতে যাবেন; ধ্রুব তখন ওদের সামনে দাঁড়ালো এসে। ওর শ্বাস-প্রশ্বাস অশান্ত! চোখ-দুটো মারাত্মক লাল! অদিতি-সৌরভের দিকে চেয়ে যেন ফুঁসছে।
ওদের কাছে এই শুরুতেই অদিতিকে দিলো এক রাম ধমক—-‘অদিতি, জাস্ট লিভ।’
হঠাৎ ধ্রুবর এতবড় ধমক খেয়ে অদিতি রীতিমত চমকে উঠে তাকালো ওই গুরুগম্বীর-একরোখা, রাগান্বিত ধ্রুবর মুখের দিকে। সৌরভ নিজেই অবাক! ধ্রুব পারে না এক্ষুনি অদিতিকে কাচা চিবিয়ে খেতে ফেলতে। অদিতি অবাক হয়ে সৌরভের দিকে একবার চেয়ে আবার ধ্রুবর দিকে তাকালো; বলতে চাইল যেন কিছু —‘ আপনি— উনি এসেছেন..’
অদিতিকে কিছুই বলতে দেওয়া হলোনা। ধ্রুব চোখ বুজে রেখে বড়বড় নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে নিজেকে শান্ত করার খুব চেষ্টা চালালো। পরপর চাপা স্বরে রাগী কণ্ঠে এটুকু বললো—‘অ্যাই সেইড, লিভ রাইট নাও।’
ধ্রুবর এমন অদ্ভুদ ব্যবহারগুলো অদিতির কাছে সম্পূর্ণ নতুন। ধ্রুব ওর মতো স্বল্প পরিচিত এক মেয়ের সঙ্গে এভাবে কথা বলছে; ভাবতেই অবাক হচ্ছে অদিতি। অদিতি অপমানিত ভঙ্গিতে সৌরভের দিকে তাকাল। ভদ্রলোকের মুখটা শুকনো লাগছে, ভয়ঙ্কর অপমানিত বোধ করছেন যেন। অদিতি বুঝলো না; ধ্রুব হঠাৎ এমন করে রেগে গেল কেন? তাও একজন গণমান্য অতিথিকে অপমান করছে। অদিতি ধ্রুবর র/ক্তচক্ষু দেখে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেল না। সৌরভকে আস্তে করে সালাম করে চলে এলো সেখানে থেকে।
ও যেতেই ধ্রুব এবার লাল চোখ নিয়ে দৃষ্টি ফেলল সৌরভের দিকে। ধ্রুব যেন নিজের মাঝেই নেই। কিছু একটা হারিয়ে ফেলার ভয়ে ও নিদারুণ ভাবে জর্জরিত।
সৌরভ ছেলের কাজে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন —-‘আমরা কথা বলছিলাম।’
ধ্রুব হাসলো অতিষ্ট ভঙ্গিতে। কোমরে এক হাত রেখে, আরেকহাতে বাম চোখ ডলে আবার সৌরভের দিকে তাকাল। তারপর তাচ্ছিল্য নিয়ে বলল —‘কথা বলছিলেন? অদিতির সঙ্গে? কেন? হঠাৎ ওর সঙ্গে কি আপনার? পছন্দ হয়েছে? ওকেও বিয়ে করতে চাইছেন?’
সৌরভ নিজের ঔরসজাত সন্তানের মুখে এমন সস্তা-ছোটলোকি কথা শুনে ভয়ঙ্কর লজ্জায় পরে গেলেন। ছেলের মুখে ছেলের বউ নিয়ে এমন কথায় তার কান থেকে ধোঁয়া বের হতে লাগলো। উনি এতবড় কথা সহ্য করতে পারলেন না। আঙুল উঁচিয়ে শাসিয়ে উঠলেন ছেলেকে—‘ভদ্রভাবে কথা বলো ধ্রুব। ও আমার মেয়ের বয়সী।’
ধ্রুব হাসে; ভ্রু বাকিয়ে নিজস্ব ভঙ্গিমায় বলে ——‘মিস তৃণাও তো আমার জানামতে তোমার মেয়ের বয়সী ছিলো? রাইট? ওকে বিয়ে করতে পারলে; অদিতি কেন নয়?’
সৌরভ চোখ রাঙালেন; বললেন —-‘তৃণা মোটেও মেয়ের বয়সী ছিলো না; ওর-আমার এইজ গ্যাপ সবে ১৩ বছরের। যেখানে তোমার আপন মায়ের সঙ্গে আমার বয়সের গ্যাপ ছিলো ১০ বছর। রাগে বিবেক হারিয়ে ফেলো না ধ্রুব।
‘ওহো, অপস! ভুল হয়ে গেল।’ —— ধ্রুব হাসে; যেন মশকরা করেছেন সৌরভ ওর সঙ্গে।
সৌরভ নিজের রাগ সামলালেন; ছেলের এমন উশৃঙ্খল আচরণের জন্যে যদি কেউ সবচেয়ে বেশি দায়ী হয় তবে সেটা উনি নিজে; কথাটা আর কেউ না জানুক উনি তো জানেন।
তাই উনি ধীর গলায় ছেলের ভুল বোঝাটা শুধরে দিতে চাইলেন; বললেন —‘তোমার জন্যে অদিতির বাড়িতে আমি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে চাইছিলাম ধ্রুব।’
ধ্রুব হতভম্ব হয়ে তাকাল সৌরভের দিকে। চুড়ান্ত অবাক হয়ে বললো—‘তোমাকে কোন ব্লা/ডি রা/স্কেল বলেছে আমি অদিতিকে বিয়ে করতে চাই?’
সৌরভ বললেন —‘ বাবা হই আমি তোমার। তোমার চোখ-দুটো আমার চেনা আছে।’
—‘ বাবা হই? ও গড।’—- ধ্রুব আবারও কপাল চুলকে অতিষ্ট ভাবে হাসে।
তারপর বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে বলে বসলো—-‘ বাবা যদি হতেই; তাহলে আমার মা অসুস্থ থাকা অবস্থায় পরকীয়া করে বেড়াতে না। আমার মা ক্যানসারে বিছানায় শুয়ে কাতরে যাচ্ছিল; আর তুমি তার ওই নাজুক অবস্থাত ঘরের বাইরে মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছিলে।’
সৌরুভ হতভম্ব। ছেলের এহেন বিশ্বাসে তিনি বিস্ময় নিয়ে বললেন —‘আমি পরকীয়া করিনি। তৃণার সঙ্গে আমার দেখা হওয়া অনেক আগে হলেই, আমি তোমার মায়ের মারা যাওয়ার পর ওকে ভালোবেসেছি। ও কখনোই তোমার মা জীবিত থাকা অবস্থায় আমাদের দুজনের মাঝে আসেনি।’
ধ্রুব হাসল; টিটকারি করে বললো—‘ওও! তাইতো মা মারা যাবার দু-মাস পরেই আমার ঘরে সৎ মা এমনি এমনি এসে গেছিল। রাইট?’
সৌরভের রাগ লাগছে। তবুও আজ সব বলা দরকার এই ভেবে বললেন——‘বিয়েটা আমি তোমার ভালোর জন্যেই করেছি ধ্রুব, তুমিও সেটা জানো। আমাদের ঘরটা নারীবিহীন উচ্ছন্নে চলে যাচ্ছিল। তুমি বিপথে চলে যাচ্ছিলে; তাই আমি আমাদের সবার কথা ভেবেই—‘
ধ্রুব সৌরভের দিকে চেয়ে: চেঁচিয়ে উঠে এবার —‘না, তুমি শুধু স্বার্থপরের মতো নিজের চিন্তা করেই বিয়ে করেছিলে। আমাকে এখানে খবরদার টানবে না। আমার ভালো তুমি কোনোদিনই চাওনি।’
সবার মধ্যে এভাবে চিৎকার করে বলা কথায় সৌরভ লজ্জায় আশেপাশে তাকালেন। কেউ নেই এদিকে।তবুও তিনি আর ভরা মজলিসে অপমানিত হতে চাইলেন না। এখন ধ্রুব অন্ধ ভাবে উনার প্রতি রেগে আছে। যেই রাগ শুরু হয়েছিল ধ্রুব যখন ১০ বছর বয়স। আজ ধ্রুব ২৫ বছরের ছেলে; এতটা বছর সে অনেক যত্ন নিয়ে বাবার প্রতি এই রাগ-অভিযোগগুলো পুষেছে। এতো সহজে এগুলো মিটবে না। ওকে এখন কিছু বোঝানো মানে শুধুশুধু সময় নষ্ট করা।
পাশ খেকে স্যারকে চুপ দেখে সেক্রেটারি রাহুল নিচু গলায় ধ্রুবকে বলল —‘তোমার বাবা চাইছেন: তুমি তোমার পছন্দের মানুষকে বিয়ে করে সুখে থাক। তাই তিনি বলছিলেন-‘
ধ্রুব বাকিটা আর শুনলোই না। চেঁচিয়ে উঠলো আবার —-‘ওহ গড, প্লিজ! দয়া করে আমার লাইফে দখল দেওয়া বন্ধ করো সবাই। আমি কাকে বিয়ে করবো এটা আমি জানি। আমি চেয়েছি তোমার ফালতু ওই সাহায্যগুলো? তোমরা আবার আমার লাইফ এলোমেলো করে দিতে উঠেপড়ে লেগেছো,যেখানে আমি মাত্র মাথাটা উঁচু করা শিখেছি।’
ধ্রুবর সামনে সৌরভ ইয়ামিন হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছেন। ছেলের এই চুড়ান্ত বে/য়াদ/বিগুলো তার হজম হচ্ছে না আর। সৌরভ বহু কষ্টে নিচু আওয়াজে বললেন-‘আমি ভেবেছি যদি আরেকবার তোমার লাইফটা গুছিয়ে-‘
‘আমি বলেছি?’ – ধ্রুব আবারও চেঁচালো।
সৌরভ কথার খেই হারিয়ে ফেললেন; পাশ থেকে রাহুল নম্র কণ্ঠে; ভয় নিয়ে ধ্রুবর কাঁধে হাত রাখল, বললো—-‘ধ্রুব আস্তে কথা বলো প্লিজ, তোমার বাবার হাই প্রেশার আছে।’
ধ্রুব শুনে চোখ বুজে জোরেজোরে শ্বাস ফেলতে লাগলো; নিজেকে রাগ কন্ট্রোল করে,একটাসময় নিজেকে শান্ত করে চাপা স্বরে লাল চোখ নিয়ে বলল -‘আমি আমার বিয়েতে তোমায় বলবোই না, চিন্তা নেই। বিয়ে যেদিন করতে ইচ্ছে হবে না? জাস্ট কাজী অফিসে গিয়ে কাজ সেরে বউ নিয়ে চলে আসব, তোমার লোক দেখানো দায়িত্বগুলোর আমার দরকার কখনো ছিলোই না; ভবিষ্যতেও হবে না।’
সৌরভ মাথা তুলে ছেলের দিকে তাকালেন: বুকটা আবার ভারি হচ্ছে তার। বুকের ব্যথা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। ধ্রুব হয়তো চিন্তাও করেনি- এই কথাগুলো একটা বাবার জন্যে কতটা পীড়াদায়ক। বাবা হিসেবে একজন পুরুষকে ব্যর্থ অনুভব করিয়ে ফেলতে পারে মুহূর্তেই।
ধ্রুব কথাটা বলে আর একমুহূর্ত অপেক্ষা করল না। বড়বড় পা ফেলে বাইকের দিকে এগিয়ে গেল। সৌরভ বুকে হাত দিয়ে পাশে থাকা চেয়ারে ধপ করে বসে পরলেন। রাহুল দ্রুত ব্যাগ থেকে ইনহেলার; আর প্রেশারি ঔষুধ বের করে দিল উনাকে। সৌরভ সেগুলো ধরলেনই না। ছেলের যাওয়ার দিকে টলমলে চোখে চেয়ে থাকলেন!
______
ধ্রুব মারাত্মক স্পিডে বাইক চালাচ্ছিলো। ওর হাত আজ কাঁপছে রীতিমত। শরীর হেলে পরতে চাইছে। তবুও স্পিড কমাচ্ছে না; আজ এই রাস্তায় মরে পরে থাকলেও ধ্রুবর আফসোস হবে না। শালা জিন্দেগির প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে রীতিমত। একটা তামাশা চলছে ওর লাইফে। ধ্রুব বারবার গাড়িগুলো ওভারটেক করছিল। যেন আজ কোনোরকমে মরে যেতে পারলেই ওর তৃপ্তি।
ধ্রুবর ফোন পকেটে বারবার বাজছে। কয়েকবার বেজে ফোন কাটল; ধ্রুব ফোন রিসিভ করল না। ওর চোখ-দুটো ঢুলছে.. যেন লুটিয়ে পরবি এক্ষুনি। হয়তো পুরনো মেন্টাল ট্রমাটা আবার হানা দিতে চাইছে।
বারবার ফোন বাজছিল; তাই একসময় অতিষ্ট হয়ে বাইকের স্পিড কমিয়ে ফোন রিসিভ করলো: ওপাশ থেকে তানিয়ার গলার আওয়াজ শুনতে পেল। কাঁদতে কাঁদতে বলছে—‘ধ্রুব ভাই; অ-অদিতি!’
গাড়ির শা-শা আওয়াজে ধ্রুব কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। তানিয়ার কাছে ওর নম্বর দেওয়া ছিলো: যেন অদিতির খোঁজ নিতে পারে। তানিয়ার সাহস হবে না বিনা কারণে ধ্রুবকে কল দেওয়ার। অদিতির হয়তো কিছু প্রয়োজন, তাই ধ্রুব বাইক এক পাশে সাইড করল। কানে ফোন চেপে জিজ্ঞেস করলো —‘শুনতে পাইনি আমি। এখন বলো—‘
তানিয়া হাঁপাচ্ছে; ও কান্না আটকে অশান্ত শ্বাস ফেলতে ফেলতে বললো—-‘ ভাইয়া, অদিতিকে পাওয়া যাচ্ছে না দু ঘণ্টা ধরে।’
হঠাৎ ধ্রুবর বুক কেঁপে উঠলো যেন। এমনিতেই অ্যানযাইটি অ্যাটাকের মতো হচ্ছিল, তারউপর এই খবর।ধ্রুব মনের মধ্যে নেগেটিভ কিছু ভাবতে চাইছে না। শান্ত থাকার চেষ্টা করে বললো—‘ হোস্টেলে ফিরে নি ও?’
—-‘ না ভাইয়া। ও হোস্টেলে নেই। আশেপাশের জায়গাগুলো খোজা হয়েছে। কোথাও নেই। কেউ কেউ বলছে—অদিতিকে লাস্ট বার কতগুলো ছেলের সঙ্গে নাকি দেখেছে কজন।’
ধ্রুব অবিশ্বাস নিয়ে বললো—-‘ অদিতি ছেলেদের সঙ্গে? কে দেখেছে ওটা?’
—‘ ভাইয়া আমাদের ক্লাসমেট কজন। আমরাও বিশ্বাস করতে পারছি না এটা।’ — তানিয়া থামল এবার।
ধ্রুব চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করলো। ওর মন এবার কু ডাকতে শুরু করেছে। আবারও মনের মধ্যে- কিছু একটা হারিয়ে ফেলার শূন্যতা অনুভব করছে; যেমনটা অনুভব করত ওর মা মারা যাবার পরে।ধ্রুবর বুক ধুকপুক করছে; ও অতিষ্ট ভঙ্গিতে নিজের বুকের বা পাশটা কুর্তার উপর খামচে ধরলো।
ধ্রুবর অস্থিরতা বাড়ছে, ও বহু কষ্টে উচ্চারণ করলো কটা কথা—‘হ-হো- হোস্টেলের সিসি টিভি ফুটেজ চেক করো তানিয়া। আ- আমি আসছি।’
ধ্রুব বাকি কথা শোনার আগেই; এক মুহূর্তের মধ্যেই বাইক এক টানেই ঘুরিয়ে ফেলল ভার্সিটির দিকে। তারপর বাড়িয়ে দিলো বাইকের স্পিড। আশপাশের গাড়ি-বাইক-সিএনজি চলছে; একটা বাইকের এত স্পিড দেখে সবাই বারবার তাকাচ্ছিল ধ্রুবর দিকে। ধ্রুবর এসবে পরোয়া নেই। ওর ঘাম হচ্ছে ভীষণ; ও এক হাতের পিঠে কপালের ঘাম মুছে, স্পিড বাড়াচ্ছে ক্রমশ! ওর বুক ধুকপুক করছে ভীষণ। যেন অদিতির কাছে উড়ে পৌঁছে গেলেই ওর শান্তি।
মায়ের পর আর কাউকে হারিয়ে ফেলার শক্তি সম্ভবত ওর আর নেই। ধ্রুবর বুক ব্যথা করছে; ক্রমশ অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে ও। মাথা ফেটে যাচ্ছে; আগের রোগের সিমটম দেখা যাচ্ছে। ধ্রুব ঢোক গিললো। বিড়বিড় করে নিজের বুকের বা-পাশে চাপড় দিতে দিতে বললো—‘ও ঠিক আছে; সেইফ আছে। অল ইজ ওয়েল, অল ইজ ওয়েল!’
এসবের মধ্যে হঠাৎ করে ধ্রুব উপলব্দি করলো; ওর নিজের জীবনের থেকেও এখন ইম্পোরট্যান্ট কেউ আছে ওর জীবনে। যে হারিয়ে গেলে; যার গায়ে সামান্য আঁচড় লাগলে: ধ্রুব ইয়ামিন পাগল পাগল হয়ে যায়।সেই মেয়েটা এখন নিখোঁজ। তাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না; হারিয়ে গেছে ও।
#চলবে