#অবন্তিকা_তৃপ্তি
ধীরে ধীরে পথ পেরুচ্ছে অদিতি-ধ্রুবর বাস! অদিতির পাশে ধ্রুব বসে; মোবাইল দেখছে! মোবাইল দেখছে কথাটা ভুল অবশ্য; ওর স্থির দৃষ্টি ঘুরেফিরে বারবার আটকে যাচ্ছিল অদিতির দিকে। অদিতি চুপ করে অস্বস্তি নিয়ে জানালার বাইরে চেয়ে আছে, ভুলেও ধ্রুবর দিকে তাকাচ্ছে না। ওর খোলা চুল উড়ে ধ্রুবর মুখের উপর ছড়িয়ে পড়ছিল বারবার। ধ্রুব হাত বাড়িয়ে অদিতির উড়ে আসা চুল মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিয়ে কিছু বলবে ভাবলো।অথচ হঠাৎ অদিতির মলিন—বিমুগ্ধ মুখের দিকে চেয়ে ও যেন থমকে গেল! অদিতির চুল উড়ছে; বাতাসের ঝাপটায় ওড়নাও উড়ছে; অথচ ওর মধ্যে নিজেকে গোছানোর কোনো তাড়া নেই; অস্থিরতা নেই। ও জানালার দিকে অপলক চেয়ে আছে; মাঝেমধ্যে কি যেন চিন্তায় ডুবে যাচ্ছে। ধ্রুবর হঠাৎ কী হলো; সে ফোনটা নিয়ে আলগোছে-বড্ড নিঃশব্দে অদিতির একটা ছবি ক্যামেরা দিয়ে তুলে নিল। তারপর আবার ক্যামেরা কোলের উপর রেখে; দেখে যেতে লাগলো সামনে বসে থাকা মলিন অথচ সুন্দর মেয়েটির দিকে।
বাস স্টেশনে পৌঁছাতে আরো দু-ঘণ্টা। বাসের ঝাকুনিতে দুজনের অবস্থায় করুন। অদিতির এসব রাস্তায় চলাফেরা করার অভ্যাস থাকলেও; ধ্রুব এসবে নতুন। অদিতি কষ্ট পাবে দেখে ও এতক্ষণ চুপ করে সব সইছিলো। একপর্যায়ে বাস এমন জোরে ব্রেক কষলো; অদিতি ছিটকে পরলো সামনের সিটে! মাথাটায় ব্যথা পাবে; তার আগেই ধ্রুব দ্রুত হাত দিয়ে ধরে ফেলল ওকে। অদিতি নিজেকে ঠিক করে উঠে ভালোভাবে বসলো; ধ্রুব ওর মাথা থেকে হাত সরিয়ে বললো——-‘ঠিক আছো?’
অদিতি নিচু গলায় জবাব দিল——‘হু!’
ধ্রুবর পিঠ ব্যথা করছিল! ও সিটে হেলান দিতেই সিট পেছনের সিকে ঝুঁকে গেল। সঙ্গেসঙ্গে পেছনের লোকটা খেঁকিয়ে উঠল; ——‘এই মিয়া; সিট ঠিক করেন আপনের।’
আচমকা চেঁচিয়ে উঠায় ধ্রুব ভারি বিরক্ত হয়ে পেছনের দিকে উকি দিল; একটা মাঝবয়সী লোক বসে আছে।নিজে নিজের সিট পেছনে অনেকটাই হেলিয়ে রেখেছে; অথচ ধ্রুবর বেলায় চেঁচালো। ধ্রুবর দিকে এমনভাবে চেয়ে আছে- যেন ধ্রুবকে এখানেই মাইর লাগাবে। ধ্রুব ওই চাউনি দেখে একটা রাগান্নিত দৃষ্টি ছুঁড়লো; হাতের শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে লোকটাকে দেখে দাঁত খিঁচিয়ে বলল ——‘কি বলছিলেন আপনি যেন?’
ধ্রুবর হাতের ম্যাসাল; আর ওর চোখের রাগ দেখে হয়তোবা লোকটা ভয় পেয়েছে। ওমনি মিনমিন করে অন্যদিকে চেয়ে বিড়বিড় করলো——‘মাইয়া নিয়ে বাসে উঠে মস্তানি দেখাইতেসে।’
ধ্রুবর কানে কথাটা গেল; ওর রাগ এবার চিরিক দিয়ে মাথায় উঠে গেল। ও উঠে দাঁড়াতে চাইল ——-‘মাইয়া মানে? কি বোঝাতে—-‘
লোকটা আচমকা ধ্রুবর এমন রূপে এবার ভয় পেয়ে সেটিয়ে গেল একপ্রকার। ধ্রুব তেড়ে উঠতে চাইলে; ওর হাত দ্রুততার সঙ্গে চেপে ধরে অদিতি। ধ্রুব ওর হাতের দিকে একবার তাকিয়ে আবার অদিতির দিকে চায়। অদিতি চোখের ইশারায় ওকে থামতে বলছে। ধ্রুব ওই করুন দৃষ্টি দেখে চোখ বুজে জোরে শ্বাস ছেড়ে আবার জায়গায় বসে গেল।
অদিতি ধ্রুবর হাত ছেড়ে দিলো। ওর মাথাটা নিচু করে;আস্তে করে বললো——-‘আমাদের গ্রামের লোক একটু অন্যরকম। ওরা এভাবে বলে; এটা নিয়ে মারামারি করে লাভ নেই।’
ধ্রুব রাগে কাপছিলো! অদিতির সম্পর্কে বাজে বলাটা ও একদমই নিতে পারেনি।নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হয়ে: ধ্রুব অদিতির দিকে একটু ফিরে; শাসিয়ে বললো——-‘লোকটার বাড়ি তুমি আমায় চেনাবে; পরে দেখবো এটারে।’
অদিতির ঘুম পাচ্ছিলো! ও বাসের সিটে মাথা হেলিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল; একপর্যায়ে ঘুমিয়েও গেল। ধ্রুব দেখে সেসব! অদিতির মাথা বারবার সিট থেকে হেলে পরে যাচ্ছিল। ধ্রুবর কী হচ্ছে আজ কে জানে! বারবার অদিতির দিকে চেয়ে থাকছে; ছুঁতে ইচ্ছে করছে; মেয়েটার এলোমেলো চুল গুছিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। অদিতি আজ প্রথমবার; এতটা পাশে আছে বলেই কি আজ ওর চাওয়াগুলো বেপরোয়া হচ্ছে?
ধ্রুব নিজেকে আশকারা দিল। ধীরে হাত বাড়িয়ে অদিতির মাথাটা নিজের কাঁধে হেলিয়ে দিলো! ঘুমের ঘোরে অদিতি ধ্রুবর কাঁধে নাক গুঁজে দিলো। এমনটা করার সাথেসাথে ধ্রুবর শ্বাস যেন আটকে এলো! ও ঢোক গিলে, ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের কাঁধের উপর পরে থাকা অদিতির দিকে তাকালো! অদিতি হুশে নেই। ধ্রুব ঢোক গিলে আবার সোজা হয়ে বসলো; ওর লোম দাড়িয়ে যাচ্ছে।
তারপর যখন অদিতি ঘুমের ঘোরে ওর বাহু জড়িয়ে ধরলো। ধ্রুবর বুকের ধুকপুকানি যেন এবার লাগাম ছাড়লো।কোনো মেয়ে আজ-অব্দি ওর এতটা কাছে কোনোদিন আসেনি। ধ্রুবর কাছে এই ছোঁয়া নতুন! ধ্রুব এবার ঢোক গিলে, ওর কেমন একটা লাগছে। ও ধীরে ধীরে মাথাটা ঘুরিয়ে অদিতির ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকাল! অদিতি যেন আজ বড্ড নিশ্চিন্ত; ভীষণ আরাম করে ঘুমুচ্ছে। ধ্রুব মুগ্ধ হয়ে দেখে গেল পুরোটাক্ষণ! তারপর আলগোছে অদিতির মাথা সেভাবেই রেখে দিল নিজের কাঁধে পুরোটা রাস্তা!
–
বাস লক্ষ্মীপুর পৌঁছেছে! ধ্রুবও ঘুমিয়ে পরেছিলো অদিতির মাথায় নিজের মাথা হেলিয়ে।বাসের মধ্যে শোরগোল শুনে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ-মুখ কুঁচকে দেখলো আশেপাশটা। অদিতি ওর কাঁধে তখনও মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে। ধ্রুব সোজা হলো: ওকে ডাকল——‘অদিতি, গেট আপ! আমরা পৌঁছে গেছি।’
অদিতি একটা পুরুষ কণ্ঠের আওয়াজ ডাক শুনে নিভুনিভু চোখে তাকালো।! ওর মুখ প্রায় ছুঁইছুঁই ধ্রুবর মুখের সঙ্গে! ঘুমের রেশ কেটে, পুরো ব্যাপারটা মাথায় আসতেই ছিটকে সরে গেল ও। দ্রুত ওড়না ঠিক করে অপ্রস্তুত গলায় বলতে চাইল——-‘আমি- আমি কখন আপনার..’
ধ্রুব কি উত্তর দিবে? ও অদিতিকে টেনে এনেছে নিজের কাঁধে বললে উল্টোপাল্টা ভাবতে পারে। ধ্রুব কিছুটা দোনামোনা করে বললো——-‘তুমি ঘুমের ঘোরে এসেছিলে; আমি আনিনি।’
অদিতি শুনলো। উঁকি দিয়ে আশেপাশটা দেখলো। সবাই ব্যাগ নিয়ে নেমে যাচ্ছে। ধ্রুব নিজের ব্যাগ গুছিয়ে, শার্ট টেনেটুনে উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে; মাথায় ক্যাপ পরে নিলো। তারপর অদিতির ধ্রুব হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো ——‘দাও।’
অদিতি কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে তাকাল! ধ্রুব কি ওকে হাত ধরার জন্যে বলছে? অদিতি অস্বস্তি নিয়ে আশেপাশে তাকালো ; এই বাসে অনেকেই হয়তো ওকে চিনতে পারে। অদিতি এবার কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললো——-‘এসব কি করছেন? আমি হাত ধরতে পারবনা।’
‘গিভ মি ইয়োর ব্যাগ।’———অদিতির কথা শেষ হওয়ার আগেই ধ্রুব বিরক্ত হয়ে বললো!
অদিতি এবার ভীষণ লজ্জায় পরে গেল। ও এসব কি ভাবছিল? অথচ ধ্রুবর মনে সেসব কিছুই ছিল না। অদিতি ওর ব্যাগ নিজেই হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো; বললো ——‘আমি নিতে পারব। আপনি আগে আগে যান প্লিজ, কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’
ধ্রুব অদিতির কথা শুনে আশেপাশে তাকাল! মানুষজনের ভিড় দেখে ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো——‘চলো।’
বলে অদিতির বিপদের কথা ভেবে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। অদিতি ধ্রুবর থেকে দূরত্ব রেখে বাস থেকে নামলো। ধ্রুব বাস থেকে নেমে হাত মুচড়ে স্ট্রেচিং করছিল। অদিতি সেটা দেখে নিচু গলায় বললো——-‘রাস্তাটা ভালো না এদিকের। অনেকবার চেয়ারম্যানকে বলা হয়েছিলো, লাভ হয়নি।’
ওর কথা শুনে ধ্রুব স্ট্রেচিং থামিয়ে সঙ্গেসঙ্গে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল; বললো——‘ডোন্ট ওরি; আ’ম ফাইন।’
অদিতি বোঝে: ধ্রুব কখনোই ওর অসুবিধা প্রকাশ করবে না অদিতির সামনে।ওরা দাড়িয়ে থাকে। ধ্রুব একটুপর বললো——‘তোমাকে নিতে কেউ আসেনি?’
অদিতি খুঁজছে আশেপাশে কাউকে; বললো ——-‘আব্বা আসবেন।’
ধ্রুব নিজেও তাকালো আশেপাশে। অদিতির বাবা দেখতে কেমন; সেটা ওরও জানা দরকার। লোকটার কিসের এত অহংকার; গৌরবের বাহাদুরি; জানা লাগবে। হঠাৎ অদূরে নিজের বাবাকে দেখতে পেয়েই আটকে গেল অদিতি।ভয়ে ধ্রুবকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে সরিয়ে দিয়ে বললো —‘সরে দাঁড়ান; আব্বা আসছেন।’
ধ্রুব আচমকা ধাক্কায় কয়েক পা পিছিয়ে অবাক চোখে অদিতির দিকে তাকাল! অদিতির চোখ-মুখ ভয়ে আতঙ্ক। একবার বাবাকে দেখছে তো আরেকবার ধ্রুবর দিকে তাকাচ্ছে।
পাঞ্জাবি গায়ে তোফাজ্জল মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। ধ্রুব তোফাজ্জলের সঙ্গে অদিতিকে দেখে বুঝতে পারল—এই সেই বিখ্যাত প্রেমের বিচারক। ও ভ্রু কুঁচকে চাইল; আগাগোড়া লক্ষ্য করতে থাকলো তোফাজ্জলকে। দেখেই মনে হচ্ছে ভীষণ রাগী এক মানুষ! ধ্রুব কিছুটা দূর থেকেই দেখছিল বাপ-মেয়েকে। তোফাজ্জল মেয়ের ব্যাগ নিজের হাতে নিয়ে বললেন——‘পথে অসুবিধা হয়েছে?’
অদিতি আড়চোখে ধ্রুবর দিকে চেয়ে, সঙ্গে সঙ্গেই চোখ ঘুরিয়ে তোফাজ্জলের দিকে চেয়ে জবাব দিল——‘না।’
তোফাজ্জল মেয়ের ব্যাগ নিয়ে নিলেন কাঁধে; গমগমে স্বরে বললেন——‘বাড়ি চলো।’
অদিতি বাবার পেছনে পেছনে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। স্টেশন ছাড়ার আগে একবার পেছন ঘুরে মলিন চোখে ধ্রুবকে দেখলো। ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে চেয়ে ছিলো! দুজনের চোখে চোখ মিললো। একজনের চোখে ছিলো— প্রেমের ব্যর্থতা তো অন্যজনের চোখে চাপা রাগ। অদিতি মলিন চোখে চেয়ে, আবার বাবার দিকে ফিরে হেঁটে গেল।
___________
অদিতি যেতেই ধ্রুব ক্যাপ খুলে ফেলল! ওর মাথায় চড়ে গেভে কিছু একটা। তোফাজ্জল অদিতির বাবা না হলে এতক্ষণে….
ধ্রুব নিজের রাগ কন্ট্রোল করলো।ও পরিকল্পনামাফিক এগুচ্ছে। স্টেশন ছেড়ে ও হাতে ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে তুলতে চলে গেছে সোজা অদিতির বাড়ির সামনে। ছোটখাটো একটা ইটের তৈরি বাড়ি। বাড়ির সামনে ছোট একটা উঠোন; উঠোনে হরেক রকম শাকসবজি লাগানো হয়েছে। উঠোনের একপাশে একটা ছোট্ট পুকুর। ধ্রুব বাড়ির বাইরে থেকেই সেসবের ছবি তুলল একটা। তখন তোফাজ্জল উঠোনে বসে পেপার পড়ছিলেন। একটা অচেনা ছেলেকে উনার বাড়ির সামনে ঘুরঘুর করতে দেখে তিনি ভ্রু কুঁচকে উঠে দাঁড়ালেন। বাড়ির ভেতর থেকে ডাকলেন——-‘অ্যাই ছেলে, এদিকে আসো!’
ধ্রুব ক্যামেরা বন্ধ করে এগিয়ে গেলো। তোফাজ্জলের সামনে দাঁড়াতেই তিনি ধ্রুবকে আগাগোড়া ভালোভাবে দেখে নিলেন। যুবক ছেলে; চোখে সানগ্লাস; পিঠে ঝুলানো বাদামি রঙের ব্যাগ। দেখে তো শহুরে ছেলে মনে হচ্ছে। তোফাজ্জল বললেন——‘কোথা থেকে আসছো তুমি? গ্রামে নতুন লাগছে।’
ধ্রুব সানগ্লাস খুলে শার্টে ঝুলিয়ে; শান্ত স্বরে জবাব দিল—‘বরিশাল থেকে এসেছি; এই গ্রামে প্রজেক্টের কাজে।”
‘প্রজেক্ট? গ্রামে কিসের প্রজেক্ট?’— তোফাজ্জল নিজের স্বভাবতই সন্দেহ করলেন।
ধ্রুবর কাছে মিথ্যা তৈরি করাই ছিলো। ও নিজের ক্যামেরা দেখিয়ে বলল——‘আমি ফটোগ্রাফি করি! এই গ্রামে আমাকে আমার কোম্পানি থেকে পাঠিয়েছে; শুটের জন্য।’
তোফাজ্জল ভ্রু বাঁকিয়ে; হাত এগিয়ে বললেন——‘দেখি তোমার ক্যামেরা দাও তো, কী ছবি তুলো দেখি।’
ধ্রুব এবার কিছুটা থমকালো। ক্যামেরার প্রথম ছবিটাতেই অদিতি! বাসে তুলেছিল ও। ধ্রুব তোফাজ্জলের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো; বোঝার চেষ্টা করল উনার মনের মতিগতি। বোঝা গেল; তোফাজ্জল ক্যামেরা নিয়েই ছাড়বেন। অন্যকেউ হলে; হয়তবা ধ্রুব সোজা মুখের উপর মানা করে দিতো। কিন্তু এখানে তোফাজ্জল দাঁড়িয়ে আছেন। উনার সঙ্গে ধ্রুবর প্রতিটা কথা; আচরণ সবকিছুর উপর নির্ভর করছে ধ্রুবর সঙ্গে অদিতির সম্পর্ক! ধ্রুব চুপচাপ ক্যামেরা এগিয়ে দিল।
তোফাজ্জল মাত্র দুটো ছবি দেখলেন; বাকি আর ঘাঁটালেন না। ক্যামেরা ফিরিয়ে দিলেন। ধ্রুব যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। তোফাজ্জল বললেন——‘গ্রামে কার বাড়িতে থাকবে?’
ধ্রুবর কাছে জবাব তৈরি ছিলো——‘এখনো ডিসাইড করিনি। কাজ সবে শুরু হয়েছে। এখানে কোনো হোটেল পাওয়া যাবে?’
ওদের কথা বলার ফাঁকে অদিতি চুলে গামছা পেঁচিয়ে উঠানে এসেছে কাপড় মেলে দিতে। ধ্রুবকে ওর বাবার সঙ্গে কথা বলতে দেখে অদিতি সেখানেই থমকে গেল। ধ্রুবরও তখন চোখ গেল অদিতির দিকে। ভেজা মুখ; গামছা পেঁচানো চুল; ওই মুখের উপর লেপ্টে থাকা ভিজে বেবি হেয়ারগুলো; আর হাতে বালতি। অদিতিকে লাগছিল পাক্কা গৃহিণী; শুধু শাড়িটাই মিসিং।ধ্রুব মুগ্ধ হয়ে দেখে যেতেই লাগল ওই গোলগাল মুখের সৌন্দর্য্যটুকু।
তোফাজ্জল ধ্রুবর দিকে চেয়ে বললেন——‘গ্রামে হোটেল খুঁজতে এসেছো? জীবনে গ্রাম দেখোনি?’
ধ্রুব তাৎক্ষণিক ধ্যান ভেঙ্গে গেল। ও দ্রুত চোখ সরিয়ে ফেললো অদিতির থেকে; গলা কেশে তাকাল তোফাজ্জলের দিকে। অদিতিও দ্রুত কাপড়ের বালতি উঠোনে রেখেই দৌঁড়ে আবার ভেতরে চলে গেল।
অথচ ভেতরে গেলেও, পর্দার ফাঁক গলিয়ে দেখতে লাগল ধ্রুবকে। ধ্রুবকে এভাবে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর হাত-পা কাঁপছে রীতিমত।ওখানে কী হচ্ছে কে জানে? বলা যায় না; এই ছেলে আদৌ কী বুঝতে পারবে অদিতির সমস্যাগুলো; ওর ভয়গুলো? যা গোঁয়ার ছেলে।যে কখনও কারো ধার ধারেনি; সে আজ তোফাজ্জলের কাটছাঁট কথা আদৌ সহ্য করবে কিনা কে জানে। অদিতি পর্দার আড়ালে মুখ লুকিয়ে দেখতে থাকলো শুধু।
ধ্রুব তোফাজ্জলের কথা জবাব দিল——‘শহরে বড় হয়েছি আমি! গ্রাম সম্পর্কে এক্সাক্টলি তেমন ধারণা নেই। যদি থাকার জায়গা না থাকে তবে রাতটা আজকে স্টেশনেই কাটিয়ে দিতে হবে মেবি।’
তোফাজ্জল ভাবলেন- একটা শহরের ছেলে স্টেশনে রাত কাটালে এটা গ্রামেরই বদনাম; উনার মেহমানদারির বদনাম। তাই তিনি পরে বললেন———‘স্টেশন কোনো থাকার জায়গা না। আমার বাংলো বাড়িতে থাকতে পারো কদিন; যদি আমার প্রস্তাব ভালো না লাগে, তবে রাতের বাস ধরে বাড়ি চলে যাও।’
ধ্রুবর চোখ-মুখ শান্ত! অথচ ভেতরে ভেতরে সে এসবই আশা করেছিল; সবকিছু প্ল্যানমাফিক চলছে। ও কাঁধের ব্যাগের ফিতে ধরে বলল—-‘আমার প্রবলেম নেই। খাবার আমি এখানেই কোনো রেস্টুরেন্টে খেয়ে নেব।”
‘রেস্টুরেন্ট?’— তোফাজ্জল ভ্রু কুঁচকালেন।
ধ্রুব এবার কিছুটা হতাশ হয়ে বলল——‘গ্রামে হোটেল থাকে না; কিন্তু ছোট ধাবা থাকে শুনেছি। এখানে কি সেটাও নেই?’
তোফাজ্জল ধ্রুবর কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলেন- এই ছেলে জীবনেও গ্রাম দেখেনি। উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন——‘এখানে ধাবা নেই। ছোট ছোট দোকান আছে, যেখানে শুধু চা পাওয়া যায়। চা খেয়ে জীবন চললে, চা-ই খেতে পারো, নাহলে আমার এখানে খাবার খাওয়া যাবে।’
ধ্রুব মনেমনে হাসে! এই লোক ভারি অদ্ভুত! হেল্প করছেন; অথচ কথার মধ্যে কোনো নরম ভাব নেই। সবকিছুর মধ্যে একটা রাগি-ঘাড়ত্যাড়া ভাব। ভালো হয়েছে। জামাই-শ্বশুর ভালো জমবে—-দুজনের রাগ-ই তুঙ্গে থাকে সবসময়ই; এবং দুজনেই ঘাড়-ত্যাড়া। ওদের দুজনের জিন ধ্রুব-অদিতির বাচ্চাও পেয়ে গেলেও পেয়ে যেতে পারে।
ধ্রুব বললো——‘থ্যাংকস! আপনি চাইলে এসবের জন্যে আমি পে করতে পারি আপনাকে।’
তোফাজ্জল এবার মহা বিরক্ত হলেন; বললেন——‘ টাকা পয়সার হিসেব দেখানোর দরকার নেই। যাও গোসল করে খেতে আসো। পুকুর ওপাশে আছে; ঘরে গোসলের জন্য আলাদা ব্যবস্থা নেই।”
ধ্রুব পুকুরটার দিকে একবার চেয়ে তারপর তোফাজ্জলের দিকে তাকালো। জবাব দিল——‘ওকে।’
তোফাজ্জল আর কথা বাড়ালেন না। পরপর চেয়ার থেকে পেপার নিয়ে হেঁটে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। তাকে ঘরের দিকে আসতে দেখে অদিতি দ্রুত পর্দার আড়াল থেকে সরে গেল। তোফাজ্জল দেখার আগেই দ্রুত নিজের ঘরে ঢুকে গেল। ধ্রুব ওর বাড়িতেই থাকবে—অদিতির মন কু ডাকছে। ধ্রুবর ব্যাপারে বাবা জানলে সবার সামনে ওকে অপমান করবেন; ও এসব সহ্য করতে পারবে না একদমই। কেলেঙ্কারী ঘটবে দুজনের মধ্যেই; দুজনেরই যা অসম্ভব রাগ।
ধ্রুব হাতে টাওয়াল নিয়ে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবল। শহুরে জীবন থেকে এতটা দূরে এসে গ্রামের পুকুরে গোসল— ব্যাপারটা তার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। গায়ে শুধুমাত্র প্যান্ট রেখে পুকুরে নেমে পরলো। সাঁতার কেটে; ডুব দিয়ে উঠল।গোসল শেষে ভিজে গায়ে শার্ট-প্যান্ট পরে নিল। বাড়িতে থাকলে হয়তো খালি গায়েই প্যান্ট পরেই বের হয়ে যেত বাথরুম থেকে। কিন্তু এটা আরেকজনের বাড়ি! অনেকেই হাঁটচলা করে উঠোনে। তাছাড়া অদিতি আছে; ধ্রুব ওকে অপ্রস্তুত করতে চায়না।
ধ্রুব টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বাড়ির দিকে যেতে গিয়ে হঠাৎ ও থমকে দাঁড়াল। অদিতি উঠানে দাঁড়িয়ে কাপড় মেলে দিচ্ছে; ধ্রুবকে দেখেই অদিতির হাত কাঁপা শুরু হয়ে গেছে। ও আশেপাশে তাকাল; কেউ কি দেখে নিচ্ছে?
ধ্রুব ভেজা গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ওর কাছে এগিয়ে গেল। অদিতি তাকে দেখে চোখ নামিয়ে নিলো; বললো——‘কেউ দেখবে; ভেতরে যান প্লিজ।’
ধ্রুব আশেপাশে তাকাল; কেউ নেই আশেপাশে। তোফাজ্জল বাইরে গেছেন। ধ্রুব অদিতির দিকে ঝুঁকে এসে আশপাশটা সতর্ক চোখে চেয়ে দেখতে দেখতে বলল ——‘তোমার বাবা আসলেই বড্ড কড়া। তুমি সত্যি তোমার বাবার মেয়ে তো?’
ধ্রুব এবার অদিতির দিকে মাথাটা নিচু করে তাকালো; ফিসফিস করে বললো——-‘ডাউট হচ্ছে আমার।’
অদিতি ভ্রু কুঁচকে ধ্রুবর দিকে মাথা তুলে তাকাল! ধ্রুব ওর দিকে আর একবারেও তাকাল না; যা বলার বলা শেষে টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে সেভাবেই বাড়ির সোজা সামনের বাংলোতে ঢুকে গেলো। অদিতি কিছুক্ষণ সেভাবেই চেয়ে; হঠাৎ করে হেসে ফেলল! ধ্রুব ওর আশেপাশে থাকছে; ব্যাপারটা ওকে হয়তো আনন্দই দিচ্ছে।
#চলবে
মনখুলে সবাই রিয়েক্ট-কমেন্ট করবেন প্লিজ!
পর্ব ভালো লাগলে বা না লাগলে, আপনারা গ্রুপে এটা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।
অবন্তিকা তৃপ্তির পার্সোনাল গ্রুপ লিংক- https://www.facebook.com/share/g/5XQheuegTGqc2anJ/?mibextid=K35XfP