#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব ৫৬
কাছে কোথাও বজ্রপাত হয়েছে। এত প্রকট শব্দ। ঘুমের পাতালে চিত্রা হুড়মুড়িয়ে ফারাজ বলে গুঙিয়ে উঠে ফারাজকে জড়িয়ে ধরে। ফারাজ নিজের মাথায় ট্রিগারটা চালিয়েও থমকে গেল। পারল না। পারল না সে নিজেকে শেষ করতে আর না চিত্রাকে। অন্ধকারে ফারাজ পিস্তল তোষকের নিচে তাড়াহুড়ো করে লুকায়। চিত্রা ততক্ষণে ফারাজের নগ্ন বুকে শরীর মিশিয়ে দিয়েছে। ফারাজ একটা মুহূর্তের জন্য পাথর হয়ে যায় তারপর চিত্রাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ফারাজের এমন আহাজারি কান্না দেখে চিত্রা অবাক। ফারাজ নিজেও জানে এই কান্না তাকে প্রশ্নের মুখোমুখিও নিয়ে আসতে পারে। তবুও সব কিছু ভুলে সে চিত্রাকে ঝাপটে ধরল। কেমন যেন বাচ্চাদের মতো ছটফট শুরু করল। আচ্ছা নিষ্পাপ একটা মানুষকে তার বংশের করা পাপের দায়ে হত্যা করে কী ওপারে চলে যাওয়া মানুষের আত্মাকে মুক্তি দেওয়া যায়? চিত্রার বংশের করা পাপের শাস্তি সে কেন পাবে? ফারাজ তার ভালোবাসার শপথ কেটে বলতে পারবে তার এই হাতে যতগুলো খুন হয়েছে তারা কেউ নিষ্পাপ ছিল না। তাদের মৃত্যু ওই ভাবেই কাম্য ছিল। কিন্তু আজ ফারাজ কী করে তার নীতিভুলে গিয়ে চিত্রাকে মারার কথা মাথায় আনল? গুরুত্বপূর্ণ একজনকে তো ফারাজ রক্ষা করতে পারেনি তবে আর নয় এবার চিত্রাকে রক্ষা করার পালা। ফারাজ নিজের পাপের শাস্তি চিত্রাকে পেতে দিবেনা কখনো। হ্যাঁ একটা সময় পর্যন্ত ফারাজ বেশ কিছুবার চিত্রাকে মারার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনোবার মারেনি। মারতে পারেনি। আজকের মতো প্রতিবার থেমে গিয়েছে কেবল ভালোবাসার টানে। চিত্রাকে কষ্ট দেওয়ার চিন্তা করে ফারাজ কতরাত ঘুমহীন কাটিয়েছে তা কেবল সে যানে। যতবার সে চিত্রাকে মারার চেষ্টা করেও মারেনি ততবার সে নিজের গায়ে ড্রাগস দিয়েছে, নিজেকে কষ্ট দিয়ে চিত্রাকে মারার অপরাধের শাস্তি হিসেবে। তবুও ফারাজ সবার চোখে খারাপ। ওইযে কেউ তার ভেতরটা দেখেনি যে তাই। ভেতরে কথা চাপা রেখে হাসি মুখে ভালো আছি বলতে সবাই পারে না। তার জন্য অনেক সাহস লাগে,যন্ত্রণা সহ্যের ক্ষমতা লাগে। ফারাজের ভেতর ফাটে। এই নশ্বর দুনিয়ায় সে চিত্রাকে ছাড়া কিছুই চায় না। তার কখনই পাপে জড়ানোর কথা ছিল না। তবে যার বড় হওয়া যেমন ভাবে হয় আরকি। জন্মের পর থেকে চোখের সামনে রক্তারক্তি, খুনখারাপি দেখে বড় হওয়া মানুষ কতখানি ভালো হতে পারে? তবুও তো ফারাজ ভালো হতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রতিটি কাজের পেছনে একটা লক্ষের প্রয়োজন হয়। ফারাজের জীবনে তেমন কিছু ছিলই না। তার ভালো হওয়ার কোনো কারণই ছিল না। তাকে ভালোবাসার মতো কেউ ছিলই না। তবে আর নয়।
“আপনি কী কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন ফারাজ?”
“হ্যাঁ।”
“কী দেখলেন?”
“দেখলাম একটা বিচ্ছেদ হচ্ছে।”
“তাহলে তো অনেক ভয়ানক স্বপ্ন।” ফারাজের চোখে জল দেখে কখন যে চিত্রার চোখটা ভিজে একাকার। সে অশ্রুসিক্ত লোচনে বলল,” আমাকে আরও শক্ত করে জরিয়ে ধরুন। ভয় করবে না।”
ফারাজ তাই করে। মনে মনে সিদ্ধান্তের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। আজ থেকে,এই মুহূর্ত থেকে কালো দুনিয়ায় রাজ করা একজন পাপিষ্ঠ পুরুষ চিরজীবনের জন্য হারিয়ে যাবে। রাতের ইতালিতে যার নাম শুনলে মানুষ কাঁপে সেই ব্যক্তি অজান্তেই মুছে যাবে। দুনিয়া জানবে কেবল সেই পুরুষের কথা যে স্ত্রীর জন্য সব ছেড়েছে। নিজের গড়া দুনিয়া ছেড়েছে, পাপ ছেড়েছে। খোদা ক্ষমাশীল। যদিও তার পাপের ক্ষমা হয়না তবুও সে খোদার দরবারে ক্ষমাপ্রার্থী। ফারাজ চিত্রাকে নিয়ে ডেনমার্ক চলে যাবে। ব্যবসা করবে। তার তো আর ঠুনকো ব্যবসা নয়। বিরাটকারবার। কতোগুলো ফ্যাক্টরী আছে। ইতালি আর ডেনমার্কে। সেই ফ্যাক্টরীর মাল সারা বিশ্বে যায়। ফারাজ চিত্রাকে নিয়ে সেখানে চলে যাবে যেখানে তাদের মাঝে দূরত্বের জন্ম হতে পারবে না। তাদের সংসার হবে। ছেলো-মেয়ে হবে। আচ্ছা মেয়ের নাম কী হবে? ফিজা এলাহী?চিত্রাকে জিজ্ঞেস করতে হবে নামটা তার পছন্দ হয়েছে কিনা। ফারাজের তো ভীষণ পছন্দ হয়েছে। সব ছাড়লেও ফারাজের ভিতরে হয়তো একটা চাপা দীর্ঘ শ্বাস আটকা পড়েই রইবে। ওই যে বলতে পারবে না চিত্রাককে, “জানো চিত্রা তুমি যেই মানুষটিকে এত ভালোবাসো সে এত ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়। সে তোমায় বহুবার মারতে চেষ্টা করেছিল। সে সাধারণ কোনো মানুষ নয়। সে ইতালির কালো জগতের একজন স্মাগলার। যে মাদক কেবল সেবনই করে নি , অস্ত্র কেবলই ব্যবহারই করে নি বরং অবৈধ পাচারও করেছে। যে অগণিত রক্তে নিজের হাত ভিজিয়েছে। কলিজা ছিনিয়ে এনেছে। আর সবচেয়ে বড় কথা বিয়ে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে এক রাতেই সাতাশজনকে খুন করা। তাও আবার তাদেরকে যাদের কবরের দিকে চেয়ে অসহায় চিত্রা এখনও চিন্তায় নিমগ্ন হয়।” ইশরে যদি সব খুলে বলা যেত তবে এই মুহূর্তে ফারাজই হতো দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মানুষ। বুকের ভেতর জমা দুঃখ গুলো ফারাজকে তীব্র দুঃখ দিচ্ছে। কিন্তু সব বললে চিত্রা ফারাজকে যেই ঘৃণার চোখে দেখবে তা তো ফারাজ সহ্য করতে পারবে না। প্রিয়তমার চোখের ঘৃণা মনকে জবাই করার ক্ষমতা রাখে। ওই ভয়ানক মৃত্যু সে চিত্রার থেকে চায় না। সে কেবল চিত্রাকে চায়,তার সঙ্গে সুখী হতে চায়। ফারাজ যা ভাবার ভেবে নিয়েছে। এখন আর সম্ভব নয় চিত্রাকে ছাড়া বাঁচা। না পারবে সে চিত্রাকে ছাড়া বাঁচতে না তাকে ছেড়ে কোথাও যেতে। অসম্ভব। ঘৃণার দেয়াল টপকে ভালোবাসার ছোঁয়া চায় সে। কেবলই চিত্রাকেই শতবার,বহুবার চায়। ফারাজের বিরহে সেদিন হয়ত দূর থেকে মেঘের গর্জনে গান হয়ে ফিরে আসছিল বার বার তার মনের অব্যক্ত কথাগুলো,
❝ও .. পারবো না আমি ছাড়তে তোকে
পারবো না আমি হারতে তোকে,
ছেড়ে যেতে আর আমি পারবো না।
তোর বায়না সব, রেখে দেব সাজিয়ে
তুই চাইলে বল, হয়ে আছি রাজি রে,
পালাতে আমি পারবো না ..❞
–
সোহান তার মায়ের চুলে তেল দিয়ে বেণী করে দিয়েছে। তার এখনও মনে আছে সেই ছোট থেকেই সে নানা প্রতিকূলতা দেখেছে। সব থাকতেও না থাকা যাকে বলে। তার বাবা সুন্দর মানুষ। চকচকা ফর্সা গায়ের রং। পালোয়ান বংশে কোনো কালো মানুষ ছিল না। তবুও সোহানের দাদা একটা কথার কারণে সোহানের বাবার বিয়ে তার মায়ের সঙ্গে করিয়ে দেন। সোহানের দাদা আবার এক কথার মানুষ। সেই কথা রাখতে গিয়েই ছেলের বিয়ে দিতে হয় নূরবানুর সঙ্গে। নুরবানুর মা-বাবা ইটের ভাটায় দেন মজুর হিসেবে কাজ করতেন। পালোয়ানদেরই ইটের ভাটা। সোহানের দাদার সেইরাতে ইটভাটায় এক জমির মালিকের সঙ্গে ঝামেলা হয়। এক পর্যায়ে ইট হাত তুলে মাথায় দেন এক বাড়ি। লোকটা তাৎক্ষণিক মারা যান। সেই দিন নূরবানুর পিতা-মাতা সেই দৃশ্য দেখে ফেলেন। কিছুদিন পর তাদের লাশ পাওয়া যায়। সবাই হাহাকার করছিল নূরবানুকে নিয়ে। মাত্র পনেরো বছর এই মেয়ের। কে পালবে? কোথায় যাবে? দুনিয়া তো জালেম। সেইদিন সোহানের দাদা নূরবানুর সঙ্গে নিজের একমাত্র ছেলের বিয়ে দিবেন বলে ঠিক করেন। আসলে ভিতরে ভিতরে তার শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। কারণ ওইদিন রাতে নূরবানুর বাবা-মা খুনের সত্য পুলিশকে জানাবে বলে ঠিক করে। থানার দিকে রওনা হয়। তবে এত বছরের কামানো সম্মান এভাবেই হাতছাড়া করা সম্ভব নয়। তাই সোহানের দাদা একসময় লোক ভাড়া করে নূরবানুর বাবা-মাকে হত্যা করায়। তারপর জমির মালিকের হত্যার দায় মৃত মানুষ দুটোর ওপরে চাপায়। কিন্তু ভেতর ভেতর সে কেমন জানি শাস্তি পাচ্ছিল। সেই শাস্তি থেকে রক্ষা করতেই সে নিজের ছেলের সঙ্গে কালোরঙা নূরবানুর বিয়ে ঠিক করেন। সোহানের বাবা তখন ঢাকায় পড়ালেখা করছিলেন। সেখানে মৌমিতা নামক একটা হিন্দু মেয়ের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক। মেয়েটি বড়লোক হিন্দু পরিবারের। জমিদার রায় বংশের মেয়ে। কলকাতায় তাদের কত কারবার আছে। দেখতে শুনতে খাঁটি সোনা। মেয়েটি তার জন্য মুসলিম হবে, তারা বিয়ে করবে এমন সময় কিশোরগঞ্জ থেকে বাবার চিঠি আসে সোহানের পিতার কাছে। চিঠিতে বিয়ে সম্পর্কে কিছুই লেখা ছিল না। তবে জরুরি তলবের বিষয় স্পষ্ট ছিল। মৌমিতার যেদিন সব ছেড়ে পালিয়ে সোহানের বাবার হাত ধরে মুসলিম হওয়ার কথা ছিল,বিয়ে করার কথা ছিল তার আগের দিন রাতেই সোহানের বাবাকে কিশোরগঞ্জ ফিরতে হয়। সেখানে এসে তাড়াহুড়োয় তার অনিচ্ছায় কছম দিয়ে নূরবানুর সঙ্গে তার পিতা তার বিয়ে দেন। মৌমিতার কথা জানালেও তার বাবা তার ওপর চোরাও হয়ে যান। শেষে কিনা হিন্দু বাড়ির মেয়ে আমাদের বাড়ির বউ হবে? অন্তত আমি বেঁচে থাকতে নয়। তোমাকে আজীবন আমার পছন্দ করা এই মেয়ের সঙ্গেই থাকতে হবে। তারপর আর কী! বছর খানেক কেটে যায়। সোহানের জন্ম হয়। তবুও সোহানের বাবার মন থেকে মৌমিতার স্মৃতি মুছে না। সোহানের দাদার মৃত্যুর একমাস পড়ে সোহানের পিতা ঢাকায় গিয়েছিল মৌমিতার খোঁজ করতে। তবে সেখানে গিয়ে জানতে পায় মৌমিতার বিয়ে কলকাতার চৌধুরী বাড়িতে হয়েছে। ছেলের নাম বিনোদ চৌধুরী। বনেদি বাড়ির ছেলে। সে কী তাদের নাম-ডাক। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফিরতে হয় তাকে কিশোরগঞ্জ। তবে ওই যে পরেনো বছর বয়সী কালো রঙা নূরবানু ওর সঙ্গে কিন্তু বিয়ের পর থেকে অত্যাচার হয়েছিল। বিয়ের রাতেই সোহানের বাবা চাবুকের আঘাতে গায়েল করেছে তাকে। প্রতিরাতে কালো রং নিয়ে বিশ্রী কথাবার্তা,নির্যাতন সয়েও নূরবানু চুপ করে গিয়েছেন। শশুর তার ভালো মন্দের খোঁজ নিলে কখনও বেদনার কথা বলতে পারতেন না। কী করে বলবে? ঘরের কথা বাইরে গেলে তো স্বামীর অসম্মান হবে। ওই বাড়িতে কেবল সোহানের দাদাই তাঁর খোঁজ নিতেন। সে ছিল বলেই নূরবানু ওই বাড়িতে টিকতে পেরেছেন। তা না হলে তো সবার তাচ্ছিল্য ছাড়া অভাগীর কপালে কিছুই জুটে নি। সোহানের যখন এগারো বছর তখন তার দাদা মারা যান। ছোট থেকেই সোহান বাবার অবহেলায়, প্রতি রাতে বাবার মদ খেয়ে এসে মাকে করা অত্যাচার,অনাহার এসব দেখেই বড় হয়েছে। কালো বলে তাকেও আপন করেনি পিতা। জন্মের পর থেকে মায়ের অশ্রু দেখেই তা কেটেছে। খুব রাগ হতো কিন্তু মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া তার কোনো উপায় ছিল না। এমনও দিন গেছে ঘরে বাবা বাজার করেনি। খেতে দেয়নি। বাড়িতে কাজ করা বুয়া তখন নিজের বাড়ি থেকে আনা ভাত তাদের খাইয়েছে। তারপর একদিন দাদার মৃত্যুর পর নূরবানু আর সোহানকে বাড়ি থেকে বাহির করে দেওয়া হলো। রাস্তায় রাস্তায় ঠোকর খেতে হলো। মা অন্যের বাসায় বাসায় কাজ করেছে। কারো বাসার কোনো বাসি খাবার পেলোও ক্ষুধা নিয়ে তা নিজে না খেয়ে ছেলেকে এনে খাইয়েছে। কাজের বুুয়া মাইমুনা ছিলেন বেদে সম্প্রদায়ের মানুষ। নিজেদের থাকার নেই আশ্রয় তবুও সোহানদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সোহান সেই সময় এত অভাব মেনে নিতে পারছিল না। চোখের সামনে এত কষ্ট, মায়ের এত দুঃখ আর নেওয়া যাচ্ছিল না। অভাবের তাড়নায় সেই ছোট্ট সোহান পাপের সঙ্গে জড়ায়। তবে তার মা ছিল তার দুনিয়া। তার সব কিছু। মা চায় সে অন্তত যেন ভালো মানুষ হয়ে গড়ে উঠুক। পড়ালেখা তো করাতে পারেনি তবুও চায় ভালো মানুষ হোক। তবে মাকে কে বুঝাবে দুনিয়া ভালোমানুষ খায় না। ধীরে ধীরে সোহানের খারাপ কাজ শুরু হয়। সে অন্যজনের আন্ডারে কাজ করত। বাচ্চা বলে তাকে দিয়ে সহজেই সব বাজে কাজ করিয়ে ফেলা যেত। ধীরে ধীরে সোহান বড় হয়,তারপর বুঝতে পারে এভাবে চললে হবে না। আরোও টাকা চাই তার,অন্যের আন্ডারে নয় বরং অন্যরা তার হয়ে কাজ করবে সেই ক্ষমতা চাই। তাই সোহান সেই লোককে প্রথমে হত্যা করল যে তাকে খারাপ কাজ শিখিয়েছিল। ক্ষমতা পায় সোহান। যত বড় হয়, তত ক্ষমতা বাড়ে। এলাহীদের সঙ্গে পার্টনার শিপ হয় তার। সোহান মাকে নিয়ে বাড়িতে উঠে। জানতে পায় বাবা আবার বিয়ে করেছে। সেই ঘরে ছেলে আছে। নাম সুমন। সোহানের তাতে কিছু আসে যায় না। সে মাকে সম্মানের সহিত বাড়িতে ফিরিয়ে আনে। সোহানের বাবা ততদিনে ভয়ে আর সোহানের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস পায়নি। তবে ছোটবউকে সে বেজায় ভালোবাসত। মা মাঝে মাঝে আড়াল থেকে সেইসব দেখে কাঁদত। আসলে ওমন ভালোবাসা তো স্বামীর থেকে সেও চেয়েছিল। পাইনি তো। একদিন-দুইদিন যায় সোহান বিষয়টি লক্ষ করে। তারপর বাবার থেকে কেড়ে নেয় তার আদরের ছোট বউকে। মায়ের থেকে মাসির দরদ সোহানের সহ্য হয় না। যেই ভালোবাসা তার মা পায়নি সেই ভালোবাসা অন্য কারো পাওয়ার অধিকার নেই। তবে সোহান কত-শত মানুষকে মারলেও বেদে মানুষকে কখনই মারেনি কেবল মাইমুনার কারণে। তাদের কষ্টের জীবনের একমাত্র আশ্রয় ছিলেন মাইমুনা। তাই তো দুঃখের দিনে আজও সোহান স্মৃতিচারণ করতে বেদে পাড়ায় যায়। মাইমুনা নেই তো কী হয়েছে? তার ছেলে,ছেলের বউ তাদের একটা মেয়ে তো আছে। সেই মেয়ে সোহানকে ভাই বলে ডাকে। এটাই শান্তি। তবে সোহান তার সেই বাবাকে এখনও মারেনি কেন? মারেনি তিলে তিলে শেষ করার জন্য। বাড়ি আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত তিলে তিলে প্রতিদিন একটু করে কষ্ট দিচ্ছে। তবে এখন অনেক হয়েছে। এবার ওই লোকের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে। পঁচা শরীরটাকে মাটির নিজেও আশ্রয় পেতে দিবে না সোহান। কিছুতেই না। সোহান মায়ের কপালে চুমু খায়। বলে,
“আম্মা আপনার কী চাই? কী খাইতে মন চায়?”
“তুই একটা বিয়া কর বাপ। আমার আর কিচ্ছু চাই না।”
সোহান মুচকি হাসে। মনে মনে ঠিক করে ফেলে বউ সে এবার আনবেই। বউয়ের জায়গায় একটা সুন্দরীর চেহারা ভেসে উঠে।
–
মোহনার ধবধবে ফর্সা পা নিজের উরুর ওপর নিয়ে আলতা লাগিয়ে দিচ্ছে রোশান। মোহনা তাকে চেয়ে চেয়ে দেখছে। হাতে রবীন্দ্রনাথের প্রেমের কাব্য। সে রোশানের দিকে চেয়ে সেই কবিতা পাঠ শুরু করল,
“তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি
শত রূপে শত বার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।
চিরকাল ধরে মুগ্ধ হৃদয়
গাঁথিয়াছে গীতহার,
কত রূপ ধরে পরেছ গলায়,
নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে, যুগে যুগে অনিবার।”
রোশান মুগ্ধতা নিয়ে সেই কবিতা শুনে। সে রাজন সোহানদের কাল রাতেই জানিয়ে দিয়েছে আর ওইসব খারাপ কাজ সে করবে না। ভালোমতো একটা ঝগড়া হয়েছে সবার সঙ্গে। কারন নতুন ডিলটা রোশান সামলাচ্ছিল। সব ছেড়ে চলে এসেছে। ওই ডিল রোশান ছাড়া আর কেউ সামলানোর মতো নেই। ডিল ক্যান্সেল হলে কোটি টাকা মাইর খাবে। কিন্তু তাও রোশানের কিছু যায় আসে না। সে সুখ-শান্তি চায়। মোহনাকে নিয়ে একটা শান্তিময় জীবন কাটাতে চায়। একটা বাচ্চা হবে তাদের, তারা ঘুরবে ফিরবে এইতো ছোট্ট এই জীবনে আর কি চাই? মোহনা আজকে আর কোনো স্লিভলেস ব্লাউজ পড়ে নি,পাতলা শাড়ি পড়ে নি। একটা সুতির লাল শাড়ি পড়েছে। নববধূর মতো লাগছে।
“শুনছো।”
“নিশির সঙ্গে একবার দেখা করিয়ে নিয়ে আসবে? “
“তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড?”
“হুম”
“ঠিক আছে। আর আশ্রমে যাবে না?”
“হ্যাঁ যাবো।”
“চলো ঘুরতে যাই আজ কোথাও। তোমায় নতুন শাড়ি, চুরি কিনে দিব।”
“তাই নাকি?”
“হুম।” বলেই রোশান মোহনার কপালে চুমু খায়। এই মানুষটার এত ভালোবাসা আগে কেন মোহনার নজরে পড়ল না? তবে মোহনা এখনও রোশানকে বলতে পারেনি তার যে বাচ্চা হবে না আর। মা হওয়ার পথ নেই। মোহনার পেটে ব্যথা করছে। একটু পর পর থেকে পেটটা কামড়ে উঠে। সহ্য করছে, বলতে পারছে না। বললে তো সামনে বসে থাকা মানুষটার মুখ থেকে সব হাসি নিমিষেই গায়েব হয়ে যাবে। নিজেকে দোষারোপ করে হয়তো বিধ্বস্ত হবে। রোশান মোহনার হাতটা নিজের কাছে নিয়ে চুমু খায়। বলে,”এই হাত মরার আগ পর্যন্ত আর ছাড়ছি না,ছাড়া সম্ভব নয়।”
–
এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে রোজ। ফারাজের থেকে বিদায় নিচ্ছে। ফারাজ হাসি মুখে তাকে বিদায় দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। অভ্র পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। রোজ যাওয়ার আগে বলল, “বস আপনার মতো একটা পুরুষ আমার জীবনেও আসুক। সে জাত কূল সব ভুলে, ভালোবাসার জন্য সব ছাড়তেও দ্বিধাবোধ করবে না। আপনার নতুন জীবনের জন্য আপনাকে স্বাগতম। তবে পাপের দুনিয়ার একটা নিয়ম হচ্ছে কেউ হারিয়ে গেলে কেউ তার জায়গায় ফিরে আসে। কিন্তু মনে হয় না ফারাজ এলাহীর মতো দক্ষ কেউ কখনও ওই দুনিয়া ফিরতে পারবে। ফারাজ এলাহী একজনই। ফারাজদের জন্ম দ্বিতীয়বার হয় না। আপনি আমার চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমার ভুল ভাঙিয়ে দিয়েছেন। আপনার বিবাহিত জীবন দীর্ঘায়ু হোক। অপেক্ষায় থাকব আপনাদের।”
যাওয়ার আগে রোজ অভ্রর থেকেও বিদায় নেয়। রোজের চোখে জল। বাহ কত বিস্ময়কর! অভ্র বলে,” আর কাঁদিস না দেশে তো ফিরছি। আয়েশা আর ভাবির পাসপোর্ট এই সপ্তাহেই চলে আসবে। তারপর তো আসছি।”
রোজ চলে যাওয়ার পর ফারাজ অভ্রকে বলে,”স্টাডি রুম থেকে সব মদ,নেশা জাতীয় জিনিস সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করিস। আর অস্ত্রও আমার লাগবে না। ইতালি আর ডেনমার্কের বাড়ি-ঘরের বিষয় রোজ সামলে নিবে।”
“কিন্তু নিরাপত্তার তো একটা বিষয় আছে।”
ফারাজ আকাশের দিকে ইঙ্গিত করে বলে,”খোদা আছে না?ভয় কিসের?”
–
আজকাল নদী চুপিসারে বাড়ির বাইরে যায়। সুলেমান এলাহীর মৃত্যুর পর থেকে তাকে কেমন যেন অন্য মনস্ক দেখাচ্ছে। কেমন যেন ভীতি স্বরে কথা বলে। ঘর থেকে দরকার ছাড়া বের হয় না। চিত্রা এখন স্বাভাবিক। সময়কে পেছনে ফেলে, পড়ালেখায় মন দিয়েছে সে। আগের থেকে পড়ার মান ভালোই হচ্ছে। ফারাজের ভালোবাসা সেই রাতের পর থেকে আরও দ্বিগুন বেড়ে গিয়েছে। তবে ভয় তো তারই হয়। দু’টো সত্য মুখোমুখি হওয়ার ভয়। চিত্রা নিঃশ্বাস ছেড়ে ভাবল, একটা পুরুষ মানুষ এত ভালোবাসতে পারে? এত সুখ খোদা তার জীবনে যে লিখে রেখেছে তা জানা ছিল না। টিফিন আওয়ারে চিত্রা বান্ধবীদের সঙ্গে গোল হয়ে বসে গল্পতে মসগুল। যেদিন থেকে সবাই জানতে পেরেছে ফারাজ এলাহীর স্ত্রী চিত্রা। ওমা সে কি খাতির। কথায় কথায় নীলা নামক মেয়েটা বলে উঠে,”জানিস আমি না একটা খবর জানি।”
সবাই উত্তর জানার জন্য নিলার দিকে তাকাতেই নিলা বলল, “পুরানঘাটে খারাপ মানুষের আড্ডা। ওইখানে রাতের বেলা মেয়ে মানুষ ধরে আনা হয়।”
সবাই চোখ হা করে রইল। চিত্রা এবার জিজ্ঞেস করল, “এসব আসলে সত্য তো? নাকি মনগড়া গল্প?”
“নারে, আমার মেজো ভাই বদ একটা। ওইসব খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িত। ফোনে সেদিন কথা বলছিল আমি আড়ালে শুনে ফেলি। কাউকে বলার মতো সাহস পাইনি। ভাইয়ের কানে এসব গেলে সে মেরেই ফেলবে। তোরা কাউকে বলিস না বুঝলি?”
কারো সেইসবে পাত্তা নেই। নীলা একটা মিথ্যাবাদী মেয়ে। বানোয়াট গল্প বানায়। একবার বলেছিল ওদের বাড়িতে নাকি সিঁড়ি আছে। দোতালা বাথরুম।বড় বাড়ি। তারপর সব বান্ধবীরা সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে সারপ্রাইজ হয়ে যায়। গিয়ে দেখে বাড়ি টিনের৷ বাইরে বাথরুম। উঁচু জায়গা দেখে দু’টো সিঁড়ি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে বাথরুমের সামনে। এই তার দোতলা বাথরুমের নমুনা। আর যেই সিঁড়ির কথা বলেছিল? সেটা মূলত বাথরুমের সাথে পাশে লাগানো ছোট্ট একটা লোহার সিঁড়ি। ওর ওপরে উঠে টাঙ্গি পরিষ্কার করা হয়।
তবে চিত্রা কিছুক্ষণ এই নিয়ে ভাবল। তার মাথায় হুট করে মারিয়া ভাবি আর জান্নাতের কথা এলো। আচ্ছা ওই নারীদের জিম্মি করার সঙ্গে কী কোনোভাবে এদের দুজনের সম্পর্ক জড়িয়ে?
হুট করে চিত্রার সামনে থেকে দু’টো মেয়ে উঠে ওয়াশরুমে যায়। কিছুক্ষণ পর ফেরত এসে বলে, “চলো চিত্রা ছুটির পর আমরা সেই জায়গায় যাই। আসল ঘটনা কি, নীলা মিথ্যা বলল কিনা জানা যাবে।”
পাশ থেকে আবার অন্য একজন বলল, আরে না এখন দিনের বেলা। এমন সময় ওই জায়গা এমনিতেও খারাপ মানুষ থাকে না। ওরা আসে সন্ধ্যায়। সন্ধ্যায় আমাদের আইসিটি প্রাইভেট আছে না? ওইটা ফাঁকি দিয়ে যাবোনি।”
চিত্রা আজকেই আইসিটি প্রাইভেটে প্রথম যাবে। প্রথম দিনেই ফাঁকি? আচ্ছা থাক একদিন ফাঁকি দিলে কিছু হয় না। খালি যাবে আর দেখে চলে আসবে। যেখানে প্রাইভেট পড়ে সেখান থেকে বেশি দূরের তো পথ না। আর ফারাজ আজকে বাইরে। বজ্রও নেই। ড্রাইভার এসে নামিয়ে দিয়ে যাবে। পালালেও কেউ ধরতে পারবে না। ঠিক সময়মতো আবার চলে আসবে না হয়। চিত্রার কলেজের নাম গুরুদয়াল সরকারি কলেজ। ফারাজও এখান থেকেই উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে গিয়েছে। চিত্রা কলেজ গেট থেকে বাহিরে বের হয়েই দেখে রাস্তার ওপাশে ফারাজের গাড়ি পার্কিং করা। কী! এই লোক কখন ফিরে এলো? চিত্রা গেটের থেকে বের হতেই ফারাজ একটা বুকে নিয়ে তার কাছে এগিয়ে আসে। তবে ফারাজ পৌঁছানোর আগেই ক্লাস ওয়ানের পেট মোটা স্কুল ড্রেস পড়া ছেলেটা চিত্রার জন্য গাছ থেকে একটা ভৃঙ্গরাজ ফুল ছিঁড়ে তা দিয়ে আংটি বানিয়ে বলে, “তুমি আমাকে বিয়ে কলবে? আমি তুমাকে টকলেট কিনে দেব।”
চিত্রা হাত এগিয়ে দেয় ফুল নেওয়ার জন্য। তবে ছেলেটা ফুলের আংটি টি না দিয়ে বলে,”আন্ডুল দাও। পলিয়ে দেই।”
চিত্রা হেসে আঙুল বাড়াতে যাবে তার আগেই ফারাজ এসে ছেলেটার গাল টেনে বলে, “এই পেট মোটা গোপাল চোখে দেখো না মেয়ের হাতে আগ থেকেই ম্যারেড রিং আছে? বিবাহিত মহিলাকে বিয়ে করা যে ইলিগ্যাল ডু ইউ নো? তোমার মা-বাবা কোথায়? ফোন নাম্বার দাও। তোমার নামে মামলা করব।”
চিত্রা ফারাজের দিকে তাকাতেই ফারাজ ছেলেটির গাল ছেড়ে দেয়। ছেলেটি নিজের গালে হাত দিয়ে ব্যথা দূর করার চেষ্টা করে রাগে ফারাজের দিকে তাকায়। ফারাজ চুইঙ্গাম চিবুচ্ছিল। তা দিয়ে একটা বেলুন ফুলিয়ে ঠাস করে তা ফুটিয়ে আবার চিবোনো শুরু করে। তারপর ছেলেটিকে বলে, “গোপাল বিদায়। আমার বউকে নিয়ে আমি গেলাম।”
“এ্যাহ ছালো আংকেল এটা আমার বউ।”
“এরে গেডা তোর নাক টিপলে দুধ পড়ে আবার বউ বউ মারাচ্ছো।”
“ছিহ্ আংকেল আপনি ভুল বলেতেন। আমাল নাক টিকলে দুধ না সড্ডি পলে।”
চিত্রা বাচ্চাটার কথায় হ্যাঁ মিলাতেই ফারাজ চিত্রার দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে বলল,”ওরে আমার মিরজাফরের নানাতো বোন তুমি চুপ যাও।”
চিত্রা চুপ করে যায়। ছেলেটা আবার বলে উঠল, “আমায় কবে বিয়ে কলবা?”
“এই বিয়ে করে বউকে কি খাওয়াবা কালুয়া?” ফারাজ বলল।
“চিনি ছালা হালুয়া।”
ফারাজ রিতীমত অবাক। কত পাকা ছেলে! এর নামে হাইকোর্টে গিয়ে কেইস করতে হবে। ফারাজ আবার বলল, “হালুয়া যে খাওয়াবা, হালুয়া কেনার টাকা কি তোমার নানা এসে দিয়ে যাবে?”
“কেন আপনি আতেন না?”
চিত্রা হেসে উঠল। ফারাজ স্তব্ধ। চিত্রা প্রায় ছুটির সময় বের হলে ছেলেটি তার সঙ্গে কথা বলে। সে নাকি চিত্রাকে বিয়ে করবে। বউ বানাবে। রোজ চকলেট নিয়ে আসে। তবে ওয়ানে পড়া এই ছেলে গলায় মামপটের বদলে ফিডার জুলিয়ে আনে। একদিন তো চিত্রাকে ফিডার দিয়ে বলে, “তুমি আমাল দুধ থাবে? আমি নাগ কলব না।”
চিত্রা ছেলেটির গালে হাত রাখে। রেখে বলে, “তুমি বড় হও তখন তোমাকে আমি বিয়ে করব যদি এই পঁচা আংকেলটা অনুমতি দেয়।”
ছেলেটা ফারাজের দিকে তাকাতেই ফারাজ অন্যদিকে মুখ ঘুড়িয়ে বলে,”অনুমতি ডিসমিস।”
যাওয়ার সময় চিত্রা ফারাজের থেকে বুকে নেওয়ার আগে ছেলেটির থেকে ওই ফুলের আংটি নেয়। তা দেখে ফারাজ কি আর চুপ করে বসে থাকার মানুষ? সে ছেলেটির পশ্চাৎপদে চিমটি মেরে কাঁদিয়ে ছাড়ে। তার জন্য আবার চিত্রার কাছে বকাঝকাও শুনতে হয়। শেষে গোপালকে একটা আইসক্রিম কিনে দিতে হয়।
–
সন্ধ্যায় ফারাজ চিত্রাকে প্রাইভেটে দিয়ে কাজে চলে যায়। ফ্যাক্টরীর কিছু রিপোর্ট এসেছে বাংলাদেশে। ওইসব দেখতে হবে। ছুটির সময় ফারাজ আসতে পারবে না সেই নিয়ে আজকে চিত্রা কি খুশী। প্রাইভেটের সামনেই বাকি মেয়ে তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। নিলাও তাদের সঙ্গে যোগ হয়েছে। এখন চারজন মিলে অটোতে উঠে। চিত্রা বাকিদের ভাড়াও দিয়ে দেয়। কারন তার স্বামীর অনেক টাকা। সে ইনভেস্ট করার মতো কোনো জায়গা পাচ্ছিল না।
সন্ধ্যা চুপিসারে নেমেছে। একটা পুরোনো শাড়ির মতোন, রঙচটা আভা নিয়ে। আকাশে তখন শেষ রোদের আগুন নিভে আসছে। একটা হালকা কমলা থেকে ধূসর ছায়ার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। নদীর জল ঝিম মেরে গেছে। শুধু নৌকার সঙ্গে ধাক্কা লাগা শব্দে বোঝা যায় যে সময় এখনো থেমে যায়নি। পাখির দল উড়ে চলে গেছে গাছের গভীরে। ঘাটের একপাশে কয়েকটা ভাঙাচোরা চৌকি আর পাথরের ওপর আধময়লা গামছা ছুঁড়ে রেখে কেউ একজন বসে আছে। সামনে ধোঁয়া-ধোঁয়া একটা আগুন জ্বলছে। কোনো পুরনো চাটাই, কাঠের বাক্স আর কাগজ পুড়িয়ে তৈরি সেই আগুন। নেশাদ্রব্যের বাজে গন্ধ আর বাজে গানের আসর বসেছে। নিলা চিত্রাকে আড়াল থেকে উঁকি মারতে বললে চিত্রা তাই করার চেষ্টা করে। তবে উঁকি মেরে কিছু দেখার আগেই বাকি দু’জন মেয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে হেসে উঠে। এক মুহূর্তে কড়া গলা ভেসে আসে, “কেরে ওইখানে?” চিত্রা উঠে পেছন ফিরতেই দেখে নিলা সহ বাকিরা হাসতে হাসতে দৌড়ে বেশখানিক দূরে চলে গিয়েছে। চিত্রা একটা ঢোক গিলে। কারা জানি এগিয়ে আসছে। ওই বাজে লোকগুলো। সে ভালো করে দেখতে পারে নি তাদের চেহেরা। তবে একজনকে তো কোথায় যেন দেখেছে মনে হলো। কিন্তু এটা ভাবার নয়, পালানোর সময়। সে দৌড়ানোর জন্য পেছন ফেরার আগেই কেউ একজন রুমাল দিয়ে তার মুখ চেপে ধরে। চিত্রা তাকানোর আগেই জ্ঞান হারিয়ে ঢলে পড়ে তার গায়ে।
মুখে পানি ছিটানোর পর হুঁশে এলো চিত্রা। একটা বদ্ধ ঘরে বন্দী সে। হুট করে একটা লোক তার সামনে এগিয়ে আসে। আঁধারকে উপেক্ষা করে এগিয়ে আসতেই চিত্রা বলে উঠে, “নিহান ভাই?”
“উঁহু। নাহিয়ান খান। স্পেশাল ফোর্সের ইনটেলিজেন্স অফিসার নাহিয়ান খান।”
চলবে?
চিত্রাঙ্গনা গল্পের লিংক । কলমে: ইশরাত জাহান জেরিন
.