#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব ৫৮
ফারাজের সন্ধ্যায় একটা ইভেন্ট আছে। চিত্রাকেও সঙ্গে নিয়ে যাবে। অনেক হয়েছে এবার মণির সঙ্গে দেখা করানোর পালা। সামান্য একটুখানি মণির সঙ্গে দেখা করলে বুঝি চিত্রা সব জেনে যাবে? চিত্রা বাসায় আসার পর থেকে কেমন যেন দূরে দূরে থাকছে। এই মেয়েটাকে আল্লাহ যে কোন মাটি দিয়ে তৈরি করেছে। সেকেন্ডে সেকেন্ডে রূপ বদলায়। যদি রূপ বদলানোর বিষয়ে মেয়ে মানুষ আর গিরগিটির মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো তবে ফারাজ ১০০% নিশ্চিত প্রথম প্রাইজটা নারীজাতিই পেত। সন্ধ্যায় ফারাজ নিজেই চিত্রাকে শাড়ি বের করে পরতে বলল। চিত্রা মুখ কুঁচকে বলল, ‘কিছু পড়ব না। এমনিতেই চলে যাব।’
ফারাজ চোখ বড় করে বলল, ‘পড়বা না মানে? নেংটু যাবা? হাউ ছোটোলোক। যাহ শাড়ি পড় আবুলের নাতনি।’
চিত্রা নির্বিকার মুখে জবাব দিল, ‘পড়তাম না তুই পড়।’
‘এই বউ, এই দেখি দেখি গুলিস্তানে বউ এক্সচেঞ্জ হয়ে গেল নাকি?’ফারাজ হতবাক ভঙ্গিতে বলল।
ফারাজ এসে আচমকা চিত্রার ঠোঁটে চুমু খায়। অতঃপর জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, ‘না তো বউ তো আগেরটাই। ঠিকঠাকই আছে।’
চিত্রা হতভম্ব হয়ে তাকায়। ‘ আপনি চুমু খেলেন কেন?’
‘খাইনি তো। পরীক্ষা করে দেখছিলাম তুমি আসলেই আমার বউ কিনা।’
‘তাই বলে চুমু খেতে হবে?’
‘আরে ওইটা চুমু হলো? ওইটা আমার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পদ্ধতি।’
‘ওহ আচ্ছা।’
‘হুম।’
চিত্রাও কম যায় না। কটাক্ষের ভঙ্গিতে বলে, ‘তাহলে জমেলা দাদিকে ডেকে আনি? মানুষটাকে আজকাল চিনতে পারছি না। একটু পরীক্ষা করে দেখবেন আসলেই কি সে আমাদের জমেলা দাদি নাকি?’
ফারাজ বউকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই পর্দার আড়াল থেকে জমেলা বের হয়ে বলল, ‘আই অ্যাম কামিং হেন্ডু বয়। পিলিজ পরীক্ষা মি।’
ফারাজ একটা ঢোক গিলল। একবার বউ অন্যবার জমেলার দিকে তাকালো। তারপর বলল, ‘তোর মতো বউ থাকলে রে আমার আর শত্রুর দরকার নাই। ঘরের শত্রু এখন আর বিভীষণ নয় রে বরং বউষণ হয়ে গেছে।’
–
সুলেমান এলাহীর কবরের সামনে বসে আছে জুনায়েদ। সঙ্গে এতগুলো মদের বোতল আর সিগারেটের প্যাকেট। নিজেও নেশা করেছে। সেই কখন থেকে কবরের সামনে বসে আছে। কত কথা বলছে। ফারহাদের পাশেই সুলেমান এলাহীর কবর। তার পাশে রুমানার জন্য জায়গা রাখা। ওই তো পাশে আরেকটা কবর আছে। জুনায়েদের স্ত্রী মমতাজের কবর। তার পাশেই জায়গা খালি। জুনায়েদের নিজের জন্য রাখা নির্ধারিত মৃত্যু। আচ্ছা মানুষ মরার আগেই তার জন্য কবর খুঁড়ে রাখাটা কেমন অদ্ভুত নয় কি? মৃত্যু না আসতেই তখন ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে থাকতে হয়। জুনায়েদ উঠে গিয়ে সুলেমান আর ফারহাদের কবরের ওপর মদের বোতল রেখে বলল,
‘নে নে মদ গিল সব। কবরে নিচে মদ ছাড়া তোদের থাকতে অনেক কষ্ট হয় তাই না? পরের বার আসার সময় একটা মাইয়া নিয়া আসমু। কতদিন হইল ফারহাদ আর সুলেমান এলাহী মাইয়াগো সঙ্গে শোয় না। এত কষ্ট নিতে পারতাছি না।’
জুনায়েদ, এলাহী সুলেমানের কবর পেরিয়ে মমতাজের কবরের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর কবরের সামনে ঢলে পড়ে কান্না করে। হাহাকার করে। মমতাজকে গালাগাল করে। এই স্বার্থপর মহিলা তাকে রেখে চলে গেছে বলেই তো জুনায়েদের এত কষ্ট। ছেলে মেয়েগুলোকে একা মানুষ করতে পারল না। মেয়েটা হারিয়ে গেল। জুনায়েদের এখন মরার কথা ভাবলে কষ্ট হয়। বউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে এতসব জবাব দেওয়ার ভয়ে তার কষ্ট হয়।
“তুই থাকলে, আমি বদলাতে পারতাম, জানিস? কেউ থামায় নাই…আমারে। তুই থামানোর আগেই চইলা গেলি” জুনায়েদ কাঁদতে কাঁদতে মমতাজের কবরের পাশেই শুয়ে পড়েন। সে বকবক করতে করতে হুঁশ হারানোর আগেই জোহান সেখানে উপস্থিত হয়। হুঁশ হারানো জুনায়েদ কে তার বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। তবে যাওয়ার সময় মায়ের কবরের মাটি গুলো সে হাত বুলিয়ে দেখল। বলল, ‘মা আমি কি ভালো হতে পারতাম না বলো? ওরা আমায় ভালো হতে দেয়নি কেন?’
জোহান -জুনায়েদের একই বুলি। তবে কারো বুলি স্ত্রীর জন্য, কারোরটা মায়ের জন্য।
–
সন্ধ্যায় চিত্রাকে নিয়ে একটা আশ্রমে যায় ফারাজ। সেখানে বছরে একবার একবার এমন বড় করে অনুষ্ঠান করা হয়। ফারাজ সবার সাথে সময় কাটায়। চিত্রা একটা কাতান শাড়ি পরেছে আজ। গাঢ় সবুজ রঙের। ফারাজের গায়েও আজ একই রঙের একটি পাঞ্জাবি। এখানেই চিত্রার সঙ্গে ফারাজ মণি নামক এক বৃদ্ধার পরিচয় করিয়ে দেন। ফারাজদের বাসায় অনেক আগে এই মহিলা কাজ করত। তারপর বৃদ্ধাকে তার নিজের ছেলে-মেয়ে ঘর থেকে বের করে দেয়। সেই থেকে এখানেই থাকেন। এই আশ্রমটা আগে সাফিয়ে নামক নারী নাকি চালাতো। এখন ফারাজের আন্ডারে চলে। চিত্রা বৃদ্ধার সঙ্গে বসে গল্প করে। ঠিক করে তো উনি কথা বলতে পারেন না। তবুও বললেন। তার নাম লতামণি। লতামণি মায়া করে ভাজ পড়ে যাওয়া হাত দিয়ে চিত্রার গালে হাত দিয়ে আঙুল বুলিয়ে দিলেন। ফারাজকে বললেন, ‘তোমার বউ কিন্তু ভারী সুন্দরী। ঠিক যেন আরেক সাফিয়েকে দেখছি।’
চিত্রা কথায় কথায় বুঝলেন এই সাফিয়ে মহিলা আসলেই অনেক সুন্দরী। চিত্রার তাকে দেখতে ইচ্ছে করল। তবে ফারাজ জানাল সে কোথায় আছে তা কেউ জানে না। তবে যেখানে আছে হয়তে ভালোই আছে। চিত্রার খুব কষ্ট লাগল। সে ফারাজকে নিয়ে কত নোংরা চিন্তাই না করল। মনে করেছিল ফারাজের বুঝি অবৈধ সম্পর্ক আছে। আজকাল তো দুনিয়ায় লায়লা-মামুন ভরে যাচ্ছে। সন্দেহ না করলেও এখন সন্দেহ জন্মে যায়। তবে ফারাজ যে এত ভালো একটা কাজ করছে, আশ্রম চালাচ্ছে সেটা একবার অন্তত বললেই হতো। বিয়ের পর কোনোদিন তো বলল না।
রাতে খাওয়াদাওয়া করে চিত্রার নড়চড় করতে মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। ফারাজকে বলতেই ফারাজ বলল, ‘তাহলে একটু হাঁটাহাটি করি? খাবার হজম হয়ে যাবে বউ।’
চিত্রা রাজি হয়ে গেল। রাতের শহর নিস্তব্ধ হয়ে এসেছে। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো হালকা হলুদ আলো ছড়িয়ে দিয়েছে, দূরে কোথাও একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠছে। চিত্রা আর ফারাজ পাশাপাশি হাঁটছে। হেঁটে চলার শব্দটাই তাদের মধ্যকার একমাত্র উচ্চারণ এ নীরবতায়। হঠাৎ হালকা বাতাসে চিত্রার শাড়ির আঁচল উড়ে এসে বারবার ফারাজের মুখে লাগতে থাকে। সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, “তোমার এই আচলটা আমার সাথে ঝগড়া করতে চায় নাকি?”
চিত্রা হেসে চোখ ফেরায়, “অচেনা বাতাসের দোষ। আমি কিছু করিনি।”
ফারাজ কিছু না বলে এগিয়ে গিয়ে খুব যত্ন করে তার আঁচলটা গুছিয়ে দেয় কাঁধে। চিত্রা তাকিয়ে থাকে স্থির হয়ে। ততক্ষণে বাতাস থেমে গেছে, শুধু দু’জনের চোখ দুজনাতে থমকে গেছে। “সবসময় এমন যত্ন করে গুছিয়ে দেবেন?” চিত্রা নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল।
ফারাজ মৃদু হেসে বলল, “যতদিন তোমার আচল আমার গায়ে এসে পড়বে, ততদিন গুছিয়ে দেবই।”
চিত্রা কিছু না বলে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে।
একটু পরে সে বোঝে, পাশে ফারাজ নেই। সে পেছনে তাকায়। ফারাজ হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
চোখে অদ্ভুত গম্ভীরতা। “কী হলো? থেমে গেলেন কেন?”
ফারাজ ধীরে এগিয়ে এসে চিত্রাকে নিজের দিকে টেনে নেয়। হালকা করে জড়িয়ে ধরে বলে, “তোমার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, একদিন তুমি হারিয়ে যাবে। তাই মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে নিজেকে মনে করিয়ে দিই, তুমি এখনও আছো, পাশেই আছো,থাকবে।”
চিত্রা তার বুকের কাছে মাথা রেখে বলল, “আমি হারাব না। যতক্ষণ আপনি আছেন, ততক্ষণ আমি থেকে যাব।”
ফারাজ চিত্রার ওষ্ঠে চুমু বুলিয়ে বলল, ❝তুমি আঁচল ফেলে হাঁটো, আমি বিছিয়ে দেব বুক, তোমার ঠোঁটের পরশেই লুকায়িত আমার না বলা সকল সুখ।❞
সময় আরো গড়িয়ে যায়। চিত্রা হাঁটছে। কিন্তু গতি কমে গেছে। ফারাজ চিত্রার জুতার দিকে তাকায়। উঁচু জুতা পরলে তার পা ছিলে যায়, তাও পরেছে। ফারাজ চিত্রাকে থামিয়ে নিচু হয়ে বসে বলল, ‘জুতা খুলো দেখি।’
‘কেন?’
‘পা দাও, চুপচাপ। আর শাড়িটা একটু তোলো।’
চিত্রা পা এগিয়ে দিয়ে শাড়ি একটুখানি উপরে তুলে। ফারাজ পায়ের থেকে জুতা খুলে হাতে দিয়ে বলে, ‘ এবার হাঁটো। আর পায়ে ব্যথা করলে বলবে কিন্তু। আমি কোলে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত।’
চিত্রা লজ্জাভরা চোখে মুচকি হেসে তাকাল ফারাজের দিকে। ফারাজ হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘আচ্ছা তোমার কাছে তোমার স্বামী ফারাজ এলাহী কেমন?’
‘ওই যে গুটি আমের সাথে লবণ,মরিচ, আর সরিষার তেল মাখিয়ে খেতে লাগে যেমন।’
ফারাজ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর মৃদু হেসে বলে, “তাহলে সাবধানে খেয়ো, বেশি খেলে আবার আসক্ত হয়ে পড়বে।”
চিত্রা এক চিলতে হেসে বলল, “হয়েই তো গেছি। এখন ওষুধ নয়, আপনার ঠোঁটই একমাত্র প্রতিকার।”
‘পাকা মেয়ে! যেটা বাংলায় বললে, তার ইংরেজিটা বলতে পারবে?’
‘পাকিয়েছেন তো আপনিই।’
‘ ছিঃ বউ। আমার নামে এমন অপবাদ দিতে পারলে তুমি? শাস্তি হিসেবে কিন্তু আগুন সুন্দরীর আগুন নিভিয়ে দেব।’
‘কি দিয়ে?’
‘শুনতে চাও?’
‘বলুন।’
ফারাজ হিসহিসিয়ে বলল, ‘জল দিয়ে। জলের মধ্যে কিন্তু বহু তফাৎ আছে। সব জল দিয়ে তো আমার আগুন সুন্দরীর আগুন নেভানো সম্ভব নয়।’
‘অসভ্য একটা।’
‘তোমার প্রেমেই তো। তোমার প্রেমে আমি বেহায়া, নির্লজ্জ, দুনিয়ার সবচেয়ে অসভ্য প্রেমিক পুরুষটাই হয়ে বেঁচে থাকতে চাই।’
একটা মোড় ঘুরতেই সামনে পড়ল স্টেশন। সেখানে ছোট্ট চায়ের দোকান খোলা। মানুষজন নেই। সব শূন্য। শুধু ধোঁয়া উঠছে কাগজের কাপ থেকে। ফারাজ একটা চায়ের কাপ নেয়। তারপর চিত্রার দিকে বাড়িয়ে দেয়। “আজ ভাগ করে খাই?”
চিত্রা কাপে চুমুক বসিয়ে কাপটা ফারাজের দিকে এগিয়ে দেয়। চিত্রার ঠোঁটের গোলাপি লিপস্টিকের যেখানে আবছা দাগ লেগে আছে, ফারাজ ঠিক সেখান থেকেই চুমুক দেয়। তারপর পুনরায় এগিয়ে দেয় কাপটা চিত্রার দিকে। চিত্রা হালকা হেসে চায়ের কাপ নেয়। দুজনে বসে পড়ে স্টেশনের বেঞ্চেতে। হাত ধরে, কাঁধে কাঁধ রেখে। এক কাপ চা, দুজনের ঠোঁট।
চুমুকের মধ্যে লুকিয়ে থাকে না বলা কত অনুভব।
হঠাৎ দূর থেকে একটা ট্রেন ছুটে আসে। হুইসেলের শব্দ পুরো এলাকা কাঁপিয়ে তোলে। ফারাজ চায়ের কাপ নামিয়ে চিত্রার দিকে তাকায়। চিত্রা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফারাজ তার ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় নিজের ঠোঁটে। ট্রেনের হুইসেল চুমুর শব্দকে ঢেকে দেয়। শব্দ থেমে গেলে ফারাজের দীর্ঘপরশও ধীরে ধীরে থেমে যায়। সে লজ্জায় রাঙা হয়ে যাওয়া চিত্রার দিকে তাকিয়ে বলল, ❝তোমার ঠোঁট ছুঁয়ে বুঝলাম,
ভালোবাসা শব্দে নয়, সংবেদনে বোঝা যায়।❞
চলবে?
চিত্রাঙ্গনা গল্পের লিংক । কলমে: ইশরাত জাহান জেরিন
(ফাইনালি কালকে বইয়ের প্রি-অর্ডার আসছে। সব কিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ। নিশ্চয়ই প্রচ্ছেদ দেখার জন্য মনটা আঁতিপাঁতি করছে?)