#ইশরাত_জাহান_জেরিন
পর্ব ৫৯
#প্রথমাংশ
আসছে বিশ অক্টোবর ফারাজ এলাহীর জন্মদিন। এই বছর একত্রিশে পা দেবে। চিত্রা নিজের জন্মদিনে কখনো গিফট পায়নি। পাবে কেমন করে? তার তেমন বন্ধু ছিল না। যাও জানুয়ারির দিকে কয়েকটা জুটত। ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ আসার আগেই সব সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেত। একবার চিত্রার মুনমুন নামক একটা বান্ধবী হয়েছিল। তার সাথে ছিল গলায় গলায় খাতির। মেয়েটার জন্মদিন মার্চে ছিল। এপ্রিলেই বন্ধুত্ব হলো। সেইবার সোহাগের থেকে টাকা নিয়ে মেয়েটিকে চেরি হিজাব গিফট করেছিল চিত্রা। খুব আশায় ছিল ডিসেম্বরে এবার কেউ তো তাকে গিফট দেবে। ওমা জুন আসতে না আসতে বিরাট একটা ঝগড়া বেধে দু’জনে আলাদা হয়ে গেল। শেষে ডিসেম্বরে আর কিছুই পাওয়া হলো না। সেই হিজাবের টাকাটা জলে চলে গেছে ভাবলেই মনটা চায় নিজের গালে দু’টো চড় কষাতে। চিত্রাকে যদি কেউ কোটি টাকাও দিয়ে দেয় তবুও ওই হিজাবের আড়াইশ টাকার কথা কভু ভুলতে পারবে না।
বাড়িতে এসে চিত্রা সরাসরি রুমে চলে যায়। ফারাজের বিদেশে একটু ঝামেলা হচ্ছে। তার কিছুদিনের মাঝেই ইতালি যাওয়াটা জরুরী। কিন্তু এখানে সে চিত্রাকে একা ফেলে কি করে যাবে? সোহান পালোয়ান এখন আর কোনো ঝামেলা করছে না কিংবা বাকিরাও৷ এখন যে যার কাজে। চিত্রাও স্বাভাবিক। তবে এত স্বাভাবিকের মধ্যেই ভেজাল লুকিয়ে থাকে। ফারাজ অভ্রকে এতগুলো কল করার পরেও ধরল। এই ব্যাটা হচ্ছে তার বউয়ের পরে দুনিয়ার সবচেয়ে ছোটলোক। ফারাজ অভ্রের নাম্বারটায় নাম এডিট করে দুই নাম্বার ছোটলোক দিয়ে সেইভ করল। আহ্ একটু শান্তি শান্তি লাগছে এখন। সে পাঞ্জাবিটা গায়ে জড়িয়েই অভ্রর রুমের দিকে যায়। নক করবে কি করবে না ভেবেই ঢুক পড়ল। নক করার মতো সময়ও ফারাজ এলাহীর নেই। ভেতরে ঢুকতেই তার চোখ ছানাবড়া। চেয়ারের সঙ্গে অভ্র হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বসে আছে। হাফপ্যান্ট পড়া। গায়ে কোনো জামা নেই। আয়েশার হাতে একটা লাঠি। অদ্ভুত দেখতে। সে দাঁড়িয়ে আছে অভ্রর ঠিক সামনেই। এসব দেখে ফারাজ নিজেই দ্বিধায় পড়ে যায় কি বলবে৷ ফারাজের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল সে হয়ত নক করে না আসায় লজ্জাবোধ করছে। কিন্তু পরক্ষণেই ফোনটা বের করে একটা ছবি তুলে বলল, ‘কালকের পত্রিকার ব্রেকিং নিউজ কি হবে জানো? কুদ্দুসের বাপ দরজা খুলে হাফপ্যান্ট পরে কালা মাইর খাচ্ছে বউয়ের কাছে।’ বলেই ফারাজ নিজের রুমের দিকে বাক নেয়। অভ্র যে উঠে গিয়ে ফারাজকে আটকাবে তার উপায় কই? মুখে তার টেপ মারা। হাত-পা তার বাঁধা। এটা তার বউ নাকি নেংটি ইঁদুর?
–
ফারাজ রুমে গিয়ে দেখল চিত্রা বিছানায় শুয়ে আছে। এই মেয়েটা এত নোংরা কেন ফারাজ জানে না। হঠাৎ ফারাজ কি একটা ভেবে বলল, ‘আসো তোমাকে বায়োলজি ক্লাস করাই। কোন চাপ্টারে সমস্যা?’
চিত্রা চোখ না খুলেই গম্ভীর গলায় বলল, ‘আপনি কি ভুলে গেছেন আমি কমার্সের ছাত্রী? আর নিজেও তো অ্যাকাউন্টিং নিয়ে পড়েছেন?’
‘ সুইটহার্ট পুরুষমানুষ জন্ম থেকেই বায়োলজির বিদ্যা অর্জন করে আসে। শিখতে তো হয় মেয়ে মানুষের। দেখো ভয়ের কিছু নেই। আমি আস্তে আস্তে সহজ ভাষায়, সহজ কৌশলে তোমায় শিখাবো।’
চিত্রা মুখ ভেংচি কেটে বলল, ‘আর আমি জোরে জোরে কঠিন ভাষায় আপনাকে পিটুনি দিয়ে এই ঘর থেকে তাড়াব। যান গিয়ে গোসল করে এসে ঘুমান। বেশি ঢং করেন। ছোটলোক কোথাকার।’
ফারাজ টেনে চিত্রাকে বিছানা থেকে উঠিয়ে সাওয়ার নিতে গেল। বউ তার ডিগ্রি অর্জন করা বজ্জাত হয়ে যাচ্ছে। না না একে একটা বাচ্চা ধরিয়ে এবার থামাতে হবে। বাচ্চা থাকলে এমন ভণ্ডামি করার সময় পাবে না।
কিছুক্ষণ পর চিত্রা ভেজা চুলে বেরিয়ে আসে। ফারাজ রুমে এসে সবেমাত্র ট্রাউজারটা পড়েছে।
ঘরে তখন শুধু বিছানার পাশে ছোট্ট টেবিল ল্যাম্পের আলো জ্বলছে। চিত্রা ধীরে ধীরে বিছানায় এসে বসে। তোয়ালে দিয়ে চুল মোছার চেষ্টা করে। ফারাজ পেছন থেকে এসে তার কাঁধে হাত রাখে।
“দাও, আমি দিই।”
চিত্রা কিছু না বলে তোয়ালেটা এগিয়ে দেয়।
ফারাজ আস্তে আস্তে তার ভেজা চুল মুছতে থাকে। সেই মুহূর্তটা এতটাই নরম যে, সময় যেন একফোঁটা হয়ে কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।
” আপনি কীভাবে পারেন এতোটা ভালোবাসতে? আমি তো কখনো নিখুঁত ছিলাম না!”
“তোমার খুঁতগুলোর মধ্যেই আমার ভালোবাসা লুকিয়ে আছে, আর ত্রুটির ভেতরেই আমার পূর্ণতা। ভালো না বেসে থাকি কি করে বিবিজান?”
চুল মুছা শেষ হলে ফারাজ তার কপালে আলতো চুমু দিয়ে বলে, “জানো তোমায় কাছে পেলে আমার সব পাওয়া হয়ে যায়। এমনকি পৃথিবীও আমার কাছে ছোট লাগে তখন।”
“তাহলে আমায় হারালে আপনার পৃথিবীটা কি ফাঁকা হয়ে যাবে?”
“হারানোর কথা বলো না, আমি তো হারানোর আগে হারিয়ে যাই তোমায় ভাবতে ভাবতেই।”
চিত্রা চোখ নামিয়ে বলে, “আপনি সব সময় এমন বলেন। কিন্তু একদিন যদি আমিই হারিয়ে যাই?”
ফারাজ থেমে যায়। তার চোখের গভীরতা কেমন যেন ভারী হয়ে ওঠে। “তুমি হারিয়ে গেলে, আমি খুঁজে খুঁজে বাঁচবো। আর না পেলে? হয়তো নিজেই হারিয়ে যাব।”
” আচ্ছা আপনি বাকি প্রেমিকদের মতো আমায় নিয়ে গান লিখেন না কেন? প্রেমিকরা তো প্রেমিকার জন্য গান উৎসর্গ করে।”
“তোমায় নিয়ে আমি গান লিখি না, কারণ আমার হৃদপিন্ডটাই তো একটা চলন্ত কবিতা। যার প্রতিটা ছন্দে শুধু তুমিই আছো। তাই আমার উৎসর্গের প্রয়োজন নেই।”
“আপনি যদি কখনো আমাকে ছেড়ে কাউকে ভালোবাসেন এত কথা বলেও?”
ফারাজ চিত্রার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার নামের নিচে অন্য কারও নাম আসে না, আসবেও না, এমনকি ভুলেও না। এই হৃদয়টা জুড়ে একটা খাতা, যেখানে একটাই নাম লেখা – মিসেস চিত্রাঙ্গনা।”
চিত্রা এবার চুপ করে তার দিকে তাকায়। মুখের দিকে নয়, চোখে। সেই চাহনি অনেক কিছু বলে দেয়—যা ভাষা দিয়ে বলাও যায় না। ঘরের আলো নিভে গেল। সেই নিভে যাওয়া আলোতে রয়ে গেল কেবল চিত্ররাজের ভালোবাসা।
–
সকালে ঘুম থেকে উঠে অভ্র’র ফারাজের কাছে যেতে ইচ্ছে করল না। কাল কি না কি ভাবল সে! অভ্রর কালকের কথা মনে পড়ে যায়। সন্ধ্যায় সে একটু ঘুমিয়েছিল। স্বপ্নে দেখল চারটা বউ তার। তাদের সঙ্গে সেই রকম ঝাকানাকা একটা নাচ দিচ্ছে অভ্র। ওমা আচমকা দেখল আয়েশা ঝাড়ু নিয়ে চেঁচিয়ে তেড়ে আসছে তার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নটা ভেঙে গেল। তাও আবার আয়েশার চেঁচানি শুনে। অভ্র এক লাফে উঠে বসতেই আয়েশা জিজ্ঞেস করল, ‘ঘুমের মধ্যে হাসছিলা কেন সরকার ভাই?’
অভ্র এত করে কথা লুকানোর চেষ্টা করল। কিন্তু এই ঘরনী তার পেটের থেকে কথা বের করেই ছাড়ল। তারপর আর কী? কতক্ষণ নিজের গালির বিদ্যা অভ্র’র ওপর ঢেলে শুরু করল বিশেষ পানিশমেন্ট দেওয়া। গুন্ডি মহিলা লজ্জাশীল অভ্রর জামা-কাপড় খুলে নিয়ে চেয়ারে বসিয়ে হাত-পা বেঁধে চুল ধরে টেনে দিল। লাঠি দিয়ে খোঁচা মারার আগেই তো ফারাজ চলে এলো। যদিও এসে ভালোই করেছে। ভালোই হয়েছে শাঁকচুন্নি ঘরনীটা দরজার ছিটকিনি লাগাতে ভুলে গিয়েছিল। আল্লাহ উচিত বিচার করছে। তবে এখন সে নিজে তো ফারাজের সামনে দাঁড়াতেই পারবে না আর অভ্রর তো কচু গাছের সঙ্গে ফাঁসি দিয়ে মরার অবস্থা।
অভ্র তাই ঠিক করল আজ সকাল সকালই সে কেটে পড়বে। আগে এমন সকাল সকালে এই বাড়ির চৌদ্দ গোষ্ঠীরা জেগে উঠত, রান্নাবান্না করত। এখন সবার ঢং বেড়েছে। রান্নাঘরের সামনে দিয়ে অভ্রর যাওয়ার সময় একটা শব্দ কানে এসে ধাক্কা খেলো। ওমা ভূত নাকি? যদিও এই ভূত তার বউয়ের মতো বজ্জাত হতে পারবে না। অভ্র চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে কিচিরমিচির শব্দ হয়। কিংবা ওইযে কেউ কিছু খাচ্ছে কেউ এমন। ভয় ভয় করে অভ্র’র। তবে মনকে শক্ত করে এবার ঠিক করল একবার দেখেই আসবে রান্নাঘরে কে? অভ্র ফোনের ফ্লাশ অন কর রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। এক পা দুই পা করে ভেতরে প্রবশ করতেই মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো অবস্থা। কিচেন টপে চিত্রা বসে আছে। তার কোমর আঁকড়ে ধরে আছে ফারাজ। এত কাছাকাছি? ওমা এরা এমন সময় এত কাছাকাছি এখানে কি করছে? অভ্রকে দেখে চিত্রা ফারাজকে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দেয়। ফারাজ বোকাসোকা মুখ নিয়ে অভ্রকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই অভ্র বলল, ‘নিউজ পেপারে আজকে একটা চরম খবর ছাপবে। চিত্ররাজ সকাল সকাল কিচেনে উহুম উহুম কট।’ বলেই অভ্র বাইরের দিকে দেয় এক দৌড়। আর ফারাজ? সে তো অভ্রর পেছনে ছুটে।
–
বিকেলে মোহনার শরীর অসুস্থ হয়ে যায়। রোশান তাকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। গিয়ে মোহনার বিষয়ে যখন জানতে পারল তখন ভেতরটা চিরে যাচ্ছিল। এ কি করে হলো? মোহনা সহ নিজের জীবনটাও শেষ করে দিল। এই মুখ নিয়ে এখন সে কি করে মোহনার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে? হাসপাতালের করিডোরে বসে ছিল রোশান। ডাক্তার ভেতর থেকে বেড়িয়ে এসে যখন বলল, ‘এবার আপনি ভেতরে যেতে পারেন স্যার।’
রোশান কথা না বলে এক পা দুই পা করে ভেতরে চলেই গেল। ডাক্তার তার হাতে রিপোর্ট দিল। মোহনা দ্বিধায় রোশানের দিকে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছে। ভয় হচ্ছে তার। কারণ সে জানে, রোশান এখন নিজেকে দোষারোপ করবে। অথচ ভুল তো তারই। রিপোর্টটা দেখার পর রোশান কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যায়। তারপর মোহনার পাশেই রিপোর্ট রেখে বলল, ‘তোমার এত কষ্ট হচ্ছিল এতগুলো দিন একবার বললে না কেন?’
‘একটুই তো। তোমাকে যেই যন্ত্রণা দিয়েছি তার চেয়ে কমই ছিল।’
‘এভাবে কেন বলতাছো? আমারে একটা বার বলতা। আমার জন্য তোমাকে না জানি আরো কত কি সহ্য করতে হয়েছে।’
মোহনা চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘তুমি আরেকটা বিয়ে করতে পারবে? আমার তো বাচ্চা হবে না। তুমি তো বাচ্চার বাবা হওয়া ডিজার্ব করো।’
‘পাগল হইছ মোহনা? তোমার গায়ের গন্ধ ছাড়া এই রোশানের সকাল শুরু হইতে চায় না আর তুমি বলতাছো আরেকটা বিয়ে করতাম? পৃথিবীর অসম্ভবতম কাজ।’
‘অসম্ভবকে আমার জন্য সম্ভব কি রোশান এলাহী করতে পারবে না?’
‘তা করার প্রয়োজন নাই।’
‘কেন?’
রোশান রিপোর্টটা মোহনাকে দেখায়। যেখানে স্পষ্ট লেখা আছে মোহনা মা হতে পারবে। আগের ডাক্তার ভুল চিকিৎসা দিয়েছে। আসলে শেষবার বাচ্চা নষ্ট হওয়ায় একটু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তাছাড়া প্রস্রাবে ইনফেকশন থেকেই মূলত পেট ব্যথা। অথচ একটা ভুল চিকিৎসা তো তাদের সব সিদ্ধান্তই শেষ করে দিতে বসেছিল। ডাক্তারের চেম্বার খুললেই হয় না, আগে যোগ্য ডাক্তার হওয়া লাগে। মোহনার চোখে জল চলে আসে। তাহলে তাদের আর কোনো কষ্ট নেই? তারাও সম্পূর্ণ একটা পরিবার হতে পারবে? রোশান হাত এগিয়ে দিতেই মোহনা তার হাত দু’টো শক্ত করে ধরে। দু’জনের চোখেই জল। তবে এই জল সুখের। রোশান মোহনার গালে,কপালে চুমু খায়। হাতে চুমু খায়। হঠাৎ তার ফোনে একটা কল আসে। স্ত্রিনে রাজনের নামটা দেখা মাত্রই মুখটা কালো হয়ে যায়। রোশান একবার মোহনার দিকে তাকায়। তারপর আস্তে করে ফোনটা তুলে কানে ধরল। সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে রাজনের কর্কশ কণ্ঠ ভেসে আসল, ‘কিরে জানোয়ার? তুই কী রসের ভালোবাসা রাইখা কাজে আসবি? নাকি আমার অন্য পদ্ধতি দেখতে হইব?’
চলবে?
#চিত্রাঙ্গনা
#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৫৯
#বর্ধিতাংশ
নদীর জীবনটা নদীর মতোই গতিশীল। এই যে কতদিন ধরে সে বাইরে যাচ্ছে। না নামে চিঠি আসছে, সে কাউকে চিঠি দিচ্ছে এই চিঠির বিশেষ মানুষগুলো তার বাড়ির লোক। হ্যাঁ দেখা করেছে সে তার বাবা-মায়ের সঙ্গে এখন রাজন সেই শাস্তি হিসেবে তাকে মারলেও সমস্যা নেই। তবে নদীকে এখন হয়তো আর মারবে না রাজন। সে তার গতি বদলে ফেলেছে। রাজন আর নদীর হয়েও হলো না। এই যে রাতে নেশা করে এসে যখন চলতে পারে না, যখন খাইয়ে দিতে হয়, এই যে মন কে শান্ত করার জন্য যখন গায়ে গাত তুলতে হয়। অসুখের রাতে যখন কাতরায় তখন তো ঘুরেফিরে এই নদীকেই রাজনের প্রয়োজন হয়। এত প্রয়োজনের পরেও যে মানুষ কেন প্রিয়জন হয়ে উঠতে পারেনা। হয়তো এটাই সৃষ্টির নিয়ম। তবে রাজন এখন অনেক দূরে যে হারিয়ে গেছে তা নদীর জানতে বাকি নেই। সেখান থেকে ফেরা মুশকিল। নদী কোথায় হারাবে? নুড়ি তার মেয়ে না তবুও তো নুড়িকে ঘিরেই তার সব। নদীর তো নুড়ির জন্য হলেও এখানেই ধুঁকে মরতে হবে। হারালে চলবে না। আর যদি কখনো হারিয়ে যায়, তখন না হয় মা মেয়ে একসঙ্গে হারাবে। নদী কখনো চিঠি কিংবা অনুভূতি লিখেনি। আজ লিখতে ইচ্ছে করছে। শরীরের গা কাঁপানো ১০৩ ডিগ্রি জ্বর নিয়েই লিখতে ভীষণ হচ্ছে করছে। সে লিখতে বসল।
আমার হয়েও না হওয়া ভালোবাসা,
২.২০.২২
তীব্র জ্বর আমার গায়ে, কিন্তু তার থেকেও বেশি জ্বর তোমাকে দেখার। থার্মোমিটার বলছে ১০৩, কিন্তু মন বলছে, তুমি-হীন সুস্থতা আমার কাম্য নেই। ডাক্তারের কাছে গেলে সে কেবল ঘুমের ওষুধ দেয়, অথচ রোগ যে আমার একটাই—”তুমি”। তুমি চোখের আড়ালে, এইটুকুই আমার অসুখের কারণ। সারাদিনের দুর্বলতা, বমি, কাঁপুনি সবই যে তোমার অনুপস্থিতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। তুমি কখনও জানবেও না যে,তুমি ভালোবাসোনি বিধায় একটা মানুষ রোজ কতখানি চাপা অসুস্থতা কুড়িয়েছে। শুধুই কোনো একদিন তুমি এসে চোখে চোখ রেখে মনের জানালায় হাত রেখে সুস্থ করে তুলবে বলে। তুমি আমার গা কাঁপানো সেই মনের জ্বর ছিলে যাকে আমি ভালোবেসে হেমলক হিসেবে পান করেছি প্রতি মুহূর্তে। এখন মৃত্যু তো আমার নিশ্চিত তাই না বলো?
ইতি ভালোবাসায় দগ্ধ হওয়া এক মৃত,
চাতক পাখি
নদীর শরীর কাঁপছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। সে আর লিখতে পারছে না। ইতি টানল। কেন চিঠিটা ভালোবাসায় সিক্ত হলো না? কেন এত আক্ষেপ জমা হলো নদীর লেখা প্রথম চিঠিতে। নদী চিঠি জড়িয়ে ধরে কাঁদল। শব্দহীন আর্তনাদে হাহাকার করল।
–
সোহান কাজে আসে না আজ অনেকদিন হলো। নেশা করে। ভয়ানক সব ডোজ নিয়ে কাত হয়ে পড়ে থাকে। কারণ একটাই তা কেবল চিত্রা। ইদানীং চিত্রা কলেজে গেলেও লুকিয়ে লুকিয়ে চিত্রাকে অনুসরণ করে সোহান পালোয়ান। ভালোবাসায় তার জীবন মজে গেছে। তাও ভালো সিফাত সোহানকে আগলে রেখেছে। তা না হলে যে কি হতো? তবে সিফাত ইদানীং বিরক্ত। বিরক্তের কারণ খালি যে সোহান পালোয়ানের অদ্ভুত কাজকর্ম তা নয় বরং চিত্রা। ওই মেয়ে থাকলে কি আর তার ভাই ঠিক হবে? ধ্বংস করবে ওই মেয়েসব। তাছাড়া তালুকদার বাড়ির মেয়ে। তালুকদার বাড়ির ইতিহাস কেউ ভুলেনি। ওই বাড়ির রক্ত ভালো তো হওয়ার নয়। কিছু একটা করা লাগবেই।
সকাল সকাল নাহিয়ান গোসল করে তৈরি হয়। ফারিয়া বিছানা ঘুছিয়ে নাহিয়ানের সামনে এসে দাঁড়ায়। নাহিয়ান যে গোয়েন্দা অফিসার সেটা ফারিয়া অনেক আগেই জানে। এই লোকটা নিজ থেকেই তাকে সব কিছু বলেছে। আর বলেছে দেখেই তো ফারিয়ার প্রতি মুহূর্তে একটা ভয় কাজ করত। যদি তার ভাইয়েদের কানে সব পৌঁছে যায়? তখন তো তারা তার স্বামীকে ছাড়বে না।
ফারিয়ার বিয়ের আগের একটা অতীত আছে। কলেজে থাকাকালীন সময় একটা ছেলে তাকে প্রায় বিরক্ত করত রাস্তায়। তারপর একদিন সেই ছেলে ফারিয়ার ছবি কিছু খারাপ নোংরা ছবির মধ্যে লাগিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে। এত নিখুঁত ভাবে ছবিগুলো বসানো যে কেউ ধরতেই পারবে না। কেবল ফারিয়া জানে এসব মিথ্যা। ছেলেটি তাকে একরাতের জন্য বিছানায় আহ্বান করে। তা না হলে নাকি ছবি সে ভাইরাল করে দিবে। ফারিয়া তার পরিবারের মানুষদের জানে। ওদের চোখে নারী এমনিতেই নিচুজাত। তার ওপর এসব দেখলে ভুল বুঝে ফারিয়াকে খুন করতে এক মুহূর্তে সময় নিবে না। ভয়ে ফারিয়া রাজি হয়ে যায় ওই ছেলের প্রস্তাবে। কিন্তু তবুও কোনো লাভ হয় না। ওই ছেলের দাবি,চাহিদা বাড়ে। টাকা চাওয়া শুরু হয়। একসময় ঘটনা এলাহী বাড়ির ছেলেদের কানে চলেই যায়। তারা তো ফারিয়াকে মেরেই ফেলত কিন্তু ওইসময় ফারাজ ভাই একটা কাজে বাংলাদেশ এসেছিল। সব জানার পর ফারিয়াকে সেই রক্ষা করে। তবে ওই ছেলের লাশ পাওয়া যায়। রাজন ভাইদের দলে তখন নাহিয়ান নতুন যুক্ত হয়েছিল। ফারিয়া পরে জেনেছে সে উদ্দেশ্য পূরণ করতে দলে যুক্ত হয়েছে। তবে সে সত্যি ফারিয়াকে ভালোবাসেই ফেলে প্রথম দেখায়। ভালোবাসে বলেই তো ফারিয়ার মুখের দিকে চেয়ে এই বাড়ির কারোর সত্য সামনে আনেনি। ফারিয়া ঝামেলা যায় না। এসব আইন তাদের ভাইয়েদের কিছুই করতে পারবে না। তার চেয়ে বরং পাপের শাস্তি খোদার হাতে তুলে দেওয়া হোক। এই নাহিয়ান ছেলেটা আসলেই ভালো। ফারিয়াকে শর্তমতে ওই ছেলের সঙ্গেই বিয়ে বসতে হয়। ছেলেটা সব জানার পরেও ফারিয়াকে মেনে নিয়েছিল। কেবল এই কথা জানার পরই ফারিয়া হু হু করে কেঁদেছিল। নাহিয়ান এত যত্নশীল পুরুষ। তাকে আপন করে নিতে ফারিয়ার একটু কষ্ট হয়নি। কোনো জনমে হয়তো ভালো কিছু করেছিল তাইতো তার জীবনে নাহিয়ান এসেছে। তবে এখন সব ছেড়ে ফারিয়া আর নাহিয়ান বিদেশ চলে যাবে। খুব জলদিই। আর কখনোই দেশে ফিরবে না। পৃথিবী জানবে না এলাহী বাড়ির সঙ্গে কোনো এক কালে এই দুজন মানুষেরও গভীর সম্পর্ক ছিল।
–
ছাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে নিরুপমা। বজ্র ঠিক তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। এখানে এসেছিল অন্য এক উদ্দেশ্য নিয়ে। খোদা এক উদ্দেশ্য পূরণ করতে পাঠিয়ে অন্য উদ্দেশ্যে জড়িয়ে ফেলেছে। খোদার পরিকল্পনার কোনো তুলনা হয়না। যাকে মন চায়নি তাকে বজ্রর আপন করতে হয়নি আর যাকে চেয়েছে সে তো আপাতত পাশেই আছে। তবে বাবাকে যে করেই হোক এবার বিষয়টা বুঝিয়ে বলতে হবে। যেটা হওয়ার সেটা তো হয়েছেই। আর কায়সার বাড়িটা তো হাতছাড়া হয়েছে নিজেদের ভুলের কারণেই। কায়সারটা ডাকাত বংশের লোক ছিল। পূর্ব শত্রুর অভাব ছিল না। ভালো মানুষদেরই তো শত্রুর অভাব থাকে না আর তো খারাপ লোকেদের। বিদেশে সবাই ভালোই আছে। ওই ভাঙ্গা কায়সার বাড়ির প্রয়োজন নেই তার। আর ওই বাড়ির মেয়ে এখন ভালোই আছে। তারও বাড়ি ফেরার দরকার নেই। বজ্র নিরুকেই ভালোবাসে। বউ হয়ে নিরুই বজ্রর সঙ্গে যাবে। তবে এখন সময়ের অপেক্ষা। একবার সব ঝামেলা মিটুক। সব ক্লিয়ার হয়ে যাক তখন শান্তি। বজ্র নিরুকে কি বলবে না বলবে করতে করতে হঠাৎ পকেট থেকে আংটি বের করে। সেটা নিরুর সামনে ধরে বলে, “উইল ইউ ম্যারি মি?”
–
সুলেমান এলাহীর মৃত্যুর বিষয়ে বাড়ির কে জানে কিংবা জানে না এই বিষয়ে বাড়ির বাকিদের খবর তো রুমানা জানে না তবে এটা জানে খুনি আসলে কে? কথা হচ্ছে সবাই কপাল। পাপ করলে তার শাস্তি সবাইকেই পেতে হবে। অতীতের পাপের শাস্তি সব। রুমানা পাপ করার সময়ও জানত শাস্তি পেতেই হবে কিন্তু এমন ভাবে পেতে হবে তা জানত না। রুমানার হঠাৎ করেই চোখের সামনে তালুকদার বাড়ির একটা প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল। রুমানা অনেক করে চেয়েছিল মোহনা আর নদী ঘরে যেন ছেলে হয়। বংশ তো সামনে এগিয়ে নিতে হবে। তার জন্য ছেলেই দরকার। আর এই বাড়িতে মেয়েদের তো কদর নেই তা সে জানেই। এসব জানার পরেও কখনো ইচ্ছে হয়নি নাতনিদের মুখ দেখার। তবে চিত্রার বিষয়ে আপাতত কিছুই বলতে পারছে না। সে যে চিত্রার সঙ্গে অন্যায় করেছে। অনেক বড় অন্যায় করেছে। এই বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর রুমানা প্রায় রাতেই তো চিত্রাকে রুমে ডাকতেন। গল্প করতেন। বাড়ির জন্য মিষ্টি বানালে চিত্রাকে রাতে একটা বেশি দিতেন। কেন দিতেন সে জানে ভালো। আসলে রুমানা কখনো চায়নি চিত্রার কোল আলো করে সন্তান আসুক। তাই তো খাবারের সঙ্গে মাসে একটা করে ঔষধ খাইয়েছে। যাতে আস্তে ধীরে মেয়েটা বাচ্চা নষ্ট করে ফেলতে পারে। তাই তো সারা মাসই চিত্রা একটু ভালো থাকলে বাকিটা অসুস্থ থাকে। সুলেমানও সব জানত। তবে আজকাল কিছুই ভালো লাগে না। এই যে এত এত পাপ? এসবের কথা ভাবলেই ভয় করে। মৃত্যুটা তার কেমন করে হবে? সুলেমানের মতো ভয়ানক ভাবে? নাকি তার চেয়েও ভয়ানক ভাবে?
–
সোহাগ সব ভুলে নতুন করে মায়ের জন্য বাঁচতে শুরু করেছে। মা এখন আগের থেকে সুস্থ। ফারাজ সোহাগকে একটা কাজ জুটিয়ে দিয়েছে। বিকেলে কাজ শেষ করে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যায়। অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে বাড়ি ফেরে। নিজের রাঁধে, মায়ের সেবা করে, নিজের কাজ শেষ করে। এভাবে ভালোই চলে যাচ্ছে তার দিনকাল।
ফারাজ এখন বাসায় নেই। চিত্রার বই পড়তে ভালো লাগছে না। কিছুক্ষণ ফোনে একটা গান শুনে কত কী ভাবল। ফারাজকে সে বিশ্বাস করে। তবে নাহিয়ান খানের কথাগুলো যে এখন পর্যন্ত শান্তি দিচ্ছে না তাকে। আর দিবেও না। এই বাড়ির কেউ সাধু না। মিতালি, নিলু সবাইকে ধ্বংস করেছে। তবুও চিত্রা চুপ করে আছে। কেবল ফারাজকে হারাতে চায় না বলেই। সে প্রতিবাদ করলে যদি ফারাজ আবার দূরত্বে উপহার দেয় তাকে? কিন্তু চিত্রার এই পরিবারে থাকতে এখন কষ্ট হয়। খুনিদের সঙ্গে একসাথে উঠছে, বসছে একই ছাদের নিচে। এর চেয়ে কষ্টের জীবনে কি আছে? তবুও মুখ বন্ধ করে বাঁচতে হচ্ছে। চিত্রা জলদি এখান থেকে চলে যেতে চায়৷ এই রক্তপাত, খুন তার বোধগম্য নয়। সে এবার এসব থেকে মুক্তি চায়। কেবল মুক্তি। চিত্রা কি ভেবে বজ্রকে কল করল। বজ্র প্রথম কলটা ধরল না। তবে ২য়টা ধরল। ধরেই ঘুমভাঙা কণ্ঠে বলল, ‘এই সময় চিত্রা?’
‘ভাবী হই।’
‘হ্যাঁ সেটাই। বলুন ভাবী কি জন্য কল করেছেন?’
‘আমার পাসপোর্টের ঝামেলা শেষ হয়নি কেন? আমি ইতালি যাব কেমন করে?’
‘আপনার স্বামী যাবে ডেনমার্ক আপনি ইতালি কেন?’
‘আরে ধ্যাৎ! একটু আগে একটা গল্পের বই পড়ছিলাম। সেখানে এতবার ইতালির নাম দেওয়া। তাই মুখ দিয়ে বের হয়ে গেল। যাইহোক ঝামেলা কি ঠিক হবে না?’
‘হবে আমি ব্যবস্থা করেই তো রাখলাম। বিদেশ চলে যান আরামে সংসার করুন। বাকিদের কেউ ভালো থাকতে দেন।’
‘খারাপ আছেন বুঝি বজ্র কায়সার?’
‘ ভালো আর থাকলাম কই চিত্রা….. চিত্রা তালুকদার।’
‘সাবধানে। পাসপোর্টের বিষয়টা সুন্দর ভাবে দেখুন। আমি জলদি সব ছেড়ে ফারাজের সঙ্গে ডেনমার্ক চলে যাবো। আর ঘুমাচ্ছিলেন মনে হয়? আমি একটু দিলাম বলে আপনি পুরোটা নিয়ে নেবেন?’
‘কেন আপনি জানেন না কায়সারের রক্তে নেওয়া-দেওয়ার হিসাবটা কেমন?’
‘রক্তের বিষয়ে জানি বলেই সাবধান করছি। না হলে কবেই তো রক্তের হিসাবে সব ধ্বংস হতো তাই না বলুন মিস্টার বজ্র কায়সার?’
চলমান।
চিত্রাঙ্গনা বইটি অর্ডার করুন নয়া উদ্যোগ প্রকাশনী পেইজ থেকে।