রাত ৮ টা কি ৯ টা বাজে, ছাঁদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পাশে রাফিয়া।রাফিয়া হলো আমার চাচাতো বোন।যেমন সুন্দরী তেমন ঢঙ্গী একটা মেয়ে।তবে আমার সাথে তেমন ঢং দেখায় না বলে তাকে নিয়ে আমার তেমন কোনো আপত্তি নেই।।ছাঁদের লাইট অন…রাফিয়া অন্ধকারে ভয় পায় তাই এমন ব্যবস্থা।নয়তো আমি কখনো লাইট অন করে ছাঁদে দাঁড়াই না। দুজনের গল্পের টপিকস হলো “কলেজের ইংরেজি স্যার”।
ব্যাটাকে দেখে সব মেয়েই ক্রাশ। আমার ধারনা দেশের সব কলেজেই একজন করে ক্রাশ টিচার থাকেন যার দিকে মেয়েরা ” হা” করে তাকিয়ে থাকে আর হা-হুতাশ করে।আমাদের আড্ডা যখন জমে এসেছে ঠিক তখনই ছাদে এলেন শুভ্র ভাই।।গায়ে কচুপাতা রঙের পাঞ্জাবি,, হাতা দুটো গুটিয়ে কনুই পর্যন্ত উঠিয়ে রেখেছেন। একহাতে একটা বই আর কিছু গোলাপ,হাসনাহেনা আর কি কি জানি ফুল আর অন্যহাতে মাথার টুপিটা বাজ করে ধরে রেখেছেন।আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েই ঝটপট বলে উঠলেন –
.
ওই রোদু?মা একটা বই চেয়েছে…কি জানি নাম?(কপাল কুঁচকে)ওহ হ্যা…”বার চান্দের ফজিলত” অর সামথিং। যা দৌড়ে গিয়ে বইটা নিয়ে আয় …ফাস্ট।
.
আম্মুকে বলেন।আমাকে বলছেন কেন?আমি হাদিসের বই পড়ি নাকি?
.
তুই না পড়লেই এনে দেওয়া যাবে না?আমিও তো পড়ি না তবু তো নিয়ে যাচ্ছি নাকি? ফুপি নামায পড়ছে…তুই আয়..
.
আমি এখন পারবো না। রাফিয়ার সাথে গল্প করছি আপনি দেখে নিয়ে যান।
.
শুভ্র ভাই এবার রাফিয়ার দিকে তাকালেন।মুচকি হেসে বললেন-
.
আরে রাফিয়া নাকি?কেমন আছো?খেয়ালই করি নি।
.
শুভ্র ভাইয়ার কথায় রাফিয়া যেনো আকাশের চাঁদ পেয়ে গেলো।।খুশিতে গদগদ হয়ে বলে উঠলো –
.
জি ভাইয়া ভালো আছি।আপনি কেমন আছেন?
.
ভালো আর থাকি কি করে?যে পৃথিবীতে তোমার বোনের মত কেউ (আমাকে ইশারা করে)আছে সে পৃথিবীতে ভালো থাকার কোনো উপায় নেই।একদম ফাজিল মহিলা।
.
রাফিয়ার গদগদ ভাব দেখেই রাগ উঠে গিয়েছিলো আমার। এবার উনার কথায় যেনো রাগের উপর এক বালতি ঘি এসে পড়লো।।ইচ্ছে হচ্ছে চিবিয়ে খেয়ে ফেলি উনাকে।উনার কথা শুনে রাফিয়া খুশিখুশি মুখ নিয়ে বলে উঠলো –
.
ও একটু ওরকমই ভাইয়া।সবাই তো আর একরকম হয় না।।ওর কথা ছাড়ুন তো।।আপনি কিন্তু আগের থেকে আরো বেশি হ্যান্ডসাম হয়ে গেছেন ভাইয়া।(মুচকি হেসে)
.
রাফিয়ার কথায় রাগে মাথা ভনভন করতে লাগলো আমার।শুভ্র ভাই কথাটা শুনে একবার আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়েই কেশে উঠলেন।কোনমতে নিজেকে ঠিক করে জোড়পূর্বক হাসি দিয়ে বললেন-
.
তুমি তো দেখি অনেক বড় হয়ে গেছো বোন।লাস্টবার যখন দেখেছিলাম তখন অনেক ছোট ছিলে।হয়তো সেভেন এইটে পড়তে।
.
হ্যা ভাইয়া।(লাজুক হেসে)সবাই একই কথা বলে।আমি নাকি আগের থেকে সুন্দর হয়ে গেছি।
.
শুভ্র ভাইয়া হাসলেন।আমার দিকে তাকিয়ে বললেন-
.
এই রোদু চল না প্লিজ।।দেরি হয়ে যাচ্ছে তো…
.
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে হাত ভাঁজ করে রেলিং এ ঠেস দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম।ভ্রু হালকা কুঁচকে আছে আমার।কেনো জানে প্রচন্ড রাগ লাগছে….আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই পাশ থেকে রাফিয়া প্রশ্ন করে বসলো-
.
ভাইয়া?আপনার হাতে এতো ফুল কেন?
.
ওহ… এগুলো তিথি আপু দিয়েছেন।তীর্থর কাছে আমার একটা বই ছিলো ওটা আনতে গিয়েই তিথি আপুর সাথে দেখা।ছাঁদে নাকি ফুলের বাগান করেছেন ওখান থেকেই জোড় করে ফুল দিয়ে দিলো।
.
ওয়াও…ফুলগুলো অনেক সুন্দর তো।।গোলাপের রংগুলো কিন্তু বেশ হয়েছে…..আমি নিই?
.
নিবা?ওকে নাও।
.
কথাটা বলে দুটো ফুল ওর হাতে দিলেন শুভ্র ভাই।হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়েই হুট করে রাফিয়ার হাত থেকে ফুলগুলো কেঁড়ে নিলেন উনি।রাফিয়া অবাক হয়ে বলে উঠলো –
.
কি হলো?
.
না মানে।ফুলগুলো বাইরে থেকে আনলাম তো.. করোনা ভাইরাস থাকতে পারে।এগুলো নেওয়ার দরকার নেই তোমার।ভাই হয়ে তো বোনের এতো বড় সর্বনাশ করতে পারি না…তাই না??এগুলো আমার কাছেই থাকুক….(জোড়পূর্বক হাসি দিয়ে)
.
আমি একটা রাগী লুক নিয়ে উনার দিকে তাকিয়েই হাঁটা দিলাম।উদ্দেশ্য নিচে যাবো।।দু’পা এগিয়েই বুঝতে পারলাম পা থেকে পায়েলটা খুলে পড়েছে…তবু দাঁড়ালাম না আমি…যার পায়েল সেই ই নিয়ে যাক…চাই না আমার।পেছন থেকে রাফিয়া ডেকে বলে উঠলো -‘”এই রোদু?তোর খুলে পড়লো তো!'” আমি কোনো কথা না বলে চুপচাপ নিচে নেমে এলাম।রুমে উঁকি দিয়ে দেখলাম আম্মু এখনও নামায পড়ছে…আপু বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ফোন ঘাটছে….ভাইয়া আর আব্বুও নিশ্চয় যার যার রুমে।
কেন জানি রুমে যেতে ইচ্ছে করছে না আমার…রুমের বাতাসটা বিষাক্ত লাগছে খুব।গুটি গুটি পাশে গেস্টরুমের ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখান থেকে আকাশটা বেশ পরিষ্কার দেখায়।।হঠাৎ করেই পেছন থেকে কেউ একজন হাত টেনে ধরলো।আমি আঁতকে উঠে পেছনে তাকাতেই দেখি শুভ্র ভাই।আমাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে নিচে হাঁটু ভেঙে বসলেন উনি।বাম পায়ে হাত দিতেই ছিটকে সরে গেলাম আমি।উনি রাগী চোখে একবার তাকিয়েই শক্ত করে পা’টা ধরে নিজের হাঁটুর উপর রেখে খুব যত্নে পায়েলটা পড়িয়ে দিলেন।আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি।কোনো কথা নেই মুখে।উনি উঠে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলে উঠলেন –
.
এতো রাগ কেন তোর?কথায় কথায় রেগে যাস…..।
.
আমি উনার কথার জবাব না দিয়ে উনাকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিতেই আমার হাত ধরে আবারও রেলিং এর গা ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে দিলেন।রেলিং এর উপর দুইহাত রেখে খানিকটা ঝুঁকে বলে উঠলেন –
.
যেতে বলেছি আমি?চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক।দুটো ফুলের জন্য এতো জেলাস হওয়ার কি আছে?জেলাসি ভাবটা একটু কমা বুঝলি…নয়তো জ্বলে পুড়েই মরে যাবি।
.
কথাটা বলে একটা ফুল আমার কানে গুঁজে দিয়ে বাকিগুলো আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন -“নে,সব তোর।” আমি কোনো কথা না বলে ফুলগুলো নিচে ফেলে দিলাম।উনি এবার শীতল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডানহাতটা শক্ত করে চেপে ধরলেন।মনে হচ্ছিল এই বুঝি মট শব্দ করে ভেঙে যাবে হাত।।ব্যাথায় আত্মা কেঁপে উঠছে বারবার।তবু আমি চুপ।একটা টু শব্দও বের হলো না মুখ থেকে।কেন কে জানে??উনি এবার একহাতে গাল দুটো চেপে ধরে বললেন-
.
কথা বল!কথা বলিস না কেন?এখানে কি বোবার মতো দাঁড়িয়ে থাকার জন্য দাঁড় করিয়ে রেখেছি তোকে?এতো তেজ ভালো লাগে না রোদু।আমার রাগ উঠাবি না বলে দিলাম….
.
আমি এবারও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম…গালের চোয়াল যেনো ভেঙে চুরমার হয়ে খুলে পড়ে যাবে এখনই…উনি আবারও কিছু বলতে যাবেন তখনই ডায়নিং থেকে আম্মুর কন্ঠ কানে এলো।।আমি উনাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ডায়নিং এর দিকে হাঁটা দিলাম।পেছন থেকে উনার কন্ঠ ভেসে আসছে কানে-“রোদু?এই রোদু?আরে বাবা শোন না!!আমি কি করেছি? এমন করছিস কেন?রোদু?”
.
.
ডায়নিং এ বসে আছি।টেবিলের এক কোনায় আমি আমার ঠিক সামনে রুহি আপু।টেবিলের আরেককোনায় শুভ্র ভাই।শুভ্র ভাইয়ার সামনের চেয়ারে ভাইয়া। রাফিয়া হেলে দুলে হেঁটে শুভ্র ভাইয়ের পাশের চেয়ারটাতে বসে পড়লো।গা জ্বলানো হাসি দিয়ে শুভ্র ভাইয়ার সাথে গল্প জমাতে লেগে গেলো।।শুভ্র ভাই হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়ালো…. আম্মু অবাক হয়ে বললেন-“কি রে?কি হলো?উঠলি কেন?খাবারই তো দিলাম না এখনও..!” উনি মুচকি হেসে বললেন-” একটা কল আসছে ফুপ্পি… কথা বলে আসছি” প্রায় পাঁচমিনিট পর ফিরে এসে আমার আর ভাইয়ার মাঝে যে চেয়ারটা ফাঁকা ছিলো তাতে বসে পড়লেন শুভ্র ভাই।রাফিয়া ব্যস্ত হয়ে বললো-“আরে ভাইয়া?আপনি তো এখানে বসে ছিলেন” শুভ্র ভাই মুচকি হেসে বললেন-
.
” ওহ, তাই নাকি?ভুলে গিয়েছিলাম বোন।ব্যাপার না একজায়গায় বসলেই হলো…খাওয়াটা ইম্পোর্টেন্ট…বসাটা নয়…তুমি খাওয়াতে কনসেন্ট্রেট করো বনু”
.
কথাটা বলে খেতে শুরু করতেই রুহি আপু হেসে বলে উঠলো-
.
আহা! রাফিয়া?তুই খেয়াল করেছিস?শুভ্র ভাই তোকে কতো আদর করে…এক সেন্টেন্সে দু’বার করে বোন ডাকছেন।কি ভাগ্য তোর।এদিকে আমাদের রোদুকে দেখ….বেচারীকে কিন্তু বছরেও বোন ডাকেন না উনি…ভুলেও না।।আহারে…শুভ্র ভাইয়ের আদরটা তুই পেলি না রোদু…কষ্ট!!
.
শুভ্র ভাই আবারও বিষম খেলেন।রাগী চোখে আপুর দিকে তাকিয়ে বললেন-
.
রুহি রে…বোন আমার চুপ হয়ে যা।এমনি তো কথা বলিস না যখন বলিস তখন একদম ছুঁড়ি ঢুকিয়ে দিস।একটু চুপ যা,, নয়তো ওই ফার্মের মুরগীর সাথে বিয়েতে আমি ভাঞ্জী দিবো কনফার্ম।
.
আপু দাঁত কেলিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলে উঠলো –
.
আমি ছুঁড়ি ঢুকাতে যাবো কেন?আমি তো জাস্ট বলছিলাম রোদুর কপাল খারাপ…. একমাত্র মামাতো ভাইয়ের আদর পেলো না….আমাদের কতো আদর করেন অথচ ওকে!!আহারে…কষ্ট।
.
এবার যদি চুপ না করিস তো গ্লাস ছুঁড়ে মারবো বলে দিলাম।সবার আদর একরকম হয় না…..আদরের ক্লাসিফিকেশন আছে বুঝলি?
.
ওওওও….তো রোদ কোন কেটাগরিতে পড়লো??(দাঁত কেলিয়ে)
.
আমি চুপচাপ খাচ্ছিলাম…আপুর এসব কথায় প্লেটটা নিয়ে চুপচাপ উঠে চলে এলাম।পেছন থেকে শুভ্র ভাইয়ার কন্ঠ ভেসে উঠলো। ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলছেন উনি-
.
ভাই?এই জঞ্জাটটাকে বিয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি বিদেয় করো তো।।হারামিটা অলওয়েজ বেশি কথা বলে….ওর বিয়ে হলে সব ঝামেলা শেষ…রাস্তা একদম পরিষ্কার…
.
আমি সোফায় পা গুটিয়ে বসে বসে খাচ্ছি আর ভাবছি,,কি বললেন উনি?আদরের ক্লাসিফিকেশন?? আদরের ক্যাটাগরি থাকে নাকি?অদ্ভুত!!
.
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
#রোদবালিকা