রাত ১০ টা। সব কাজিনরা মিলে বসেছি ছাদে। উদ্দেশ্য আজকের রাতটা গল্পের আড্ডায় কাটিয়ে দিবো। সেহেরী খেয়ে তারপর ঘুমাতে যাবো সবাই, এর আগে নয়,,কিছুতেই নয়। আমাদের সাথে পুচকো দুটোও বসেছে আড্ডার আসরে। গল্পের টপিক হলো “বিয়ে”।
গল্প করতে করতে গল্পের মোড়টা এলো আমার বাবা-মায়ের বিয়ের দিকে। সবচেয়ে রোমান্টিক এন্ড কিউট প্রেমের কাহিনী ছিলো আমার বাবা-মার। মামাতো ভাইয়ের সাথে বেশ ভালোই প্রেমে মেতেছিলো মা।।পরবর্তীতে পরিবারের সিদ্ধান্তে বিয়ের কাজটা শেষ হয় তাদের। আমার এক বড় ভাইয়া এই গল্পটুকু বলা শেষ করতেই সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো।। আমি অস্বস্তি নিয়ে বলে উঠলাম-
.
কি হলো?আমার দিকে তাকাচ্ছো কেন?
.
আলিফ ভাইয়া সরু চোখে তাকিয়ে বলে উঠলেন –
.
তোকে বেশ সন্দেহ সন্দেহ লাগছে রে রোদু।। রুহির তো বয়ফ্রেন্ড আছে।। ও বিয়ে ওই বয়লার মুরগীকেই করবে। কিন্তু তুই??কাকিমনিও কিন্তু বাড়ির ছোট মেয়েই ছিলো।।
.
উনার কথায় সবার সন্দেহ যেনো প্রখর থেকে প্রখরতর হলো। আমার দিকে এমন ভাবে তাকালো যেনো আমি কোনো ভিনগ্রহী প্রাণী।। আমি মুখ কাঁচুমাচু করে বলে উঠলাম –
.
আলিফ ভাইয়া?তুমি কিন্তু বেশি বলছো।। ঘটনার পুনর্বৃত্তি বারবার হয় না।। সো চুপ থাকো।আজগুবি পেঁচাল পারবা না।
.
আমার কথা শেষ হতেই পাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠলো রাফিয়া ।।আমরা সবাই চমকে ওর দিকে তাকাতেই বলে উঠলো সে-
.
রোদু রে…বিশ্বাস কর! এখন আমারও কেমন সন্দেহ সন্দেহ হচ্ছে। নয়তো তোর মতো মাইয়ার এখনও বিএফ নাই কেন??
.
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠলো সে-
.
তারমানে শুভ্র ভাই!!শুভ্র ভাই ছাড়া তো তোর আর কোনো মামাতো ভাই নাই।।হে মাবুদ!!শেষমেষ শুভ্র ভাই আমার দুলাভাই??
.
রাফিয়ার কথায় চারপাশে যেনো বজ্রপাত হলো।।চারপাশে পিনপতন নীরবতা।।রাফিয়া অলওয়েজ রং জায়গায় রং কথা বলে এটা তার অভ্যাস।।এতোক্ষণ সবাই মজা করলেও ওভাবে নেয় নি ব্যাপারটা কিন্তু রাফিয়া যেন ঢোল ফাঁটালো।সবাই একবার আমার দিকে তো একবার শুভ্র ভাইয়ার দিকে তাকাচ্ছে।।লজ্জায় আর রাগে মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। শুভ্র ভাই এতক্ষন রেলিং এ ঠেস দিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে গেইম খেলছিলেন।।কিছুক্ষন পর চুয়িংগাম চিবুতে চিবুতে বলে উঠলেন উনি-
.
এই? তোরা কি আমার দিকে তাকিয়ে আছিস??
.
আদিবা ফটাফট জবাব দিয়ে দিলে-
.
হু দাদাভাই।ছব্বাই ১, ২,৩,৪…… পনেলো জন।
.
জারিফ সাথে সাথেই আদিবার মাথায় চাটি মেরে বলে উঠলো –
.
চুপপ…গাধী!! এখানে ১৫ জন নয় ১০ জন।
.
শুভ্র ভাইয়া ঠোঁট কামড়ে ভ্রু দুটো কুঁচকে গেইমে আরেকটু মনোযোগী হয়ে উঠলেন। কয়েকসেকেন্ড পড়ে হঠাৎই বলে উঠলেন -“ওহ্ শীট!!ড্যাম ম্যান” তারপর ফোনটা পাশে রেখে সিল্কিচুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে পেছনে ধাক্কা দিয়ে শার্টের ওপরের দুটো বোতম খোলে কলার ঝাঁকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন –
.
প্রচুর গরম পড়েছে আজ।হয়তো বৃষ্টি হবে। (আমাদের দিকে তাকিয়ে) কি রে?তোরা এখনও এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? অদ্ভুত!! তোদের চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে তোদের সবার বউ ভাগিয়ে নিয়ে চলে গেছি আমি….আর তোদের জামাইদের হাটে বেঁচে এসেছি।।এভাবে তাকাবি না…অন্যদিকে তাকা।।বিয়ে করবো বলে যাকে সন্দেহ করছিস তাকালে সে তাকাবে,, তোরা তাকাস কেন?অন্যের জামাইয়ের দিকে এমন আবুলের মতো তাকিয়ে থাকিস, লজ্জা করে না??
.
উনার কথায় ফিক করে হেসে উঠলো সবাই।।আমি চুপচাপ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছি।।এতোক্ষণে হালকা-মৃদু বাতাস বইছে চারপাশে।।হঠাৎ করেই তনিমা আপু বলে উঠলেন…
.
দাদাভাই?সত্যি রোদকে বিয়ে করবা তুমি??
.
তনিমা আপুর কথায় বিষম খেলাম আমি।।উফফ…বারবার আমার টপিকই কেনো টানছে ওরা??এই মাটিটা ফাঁক হচ্ছে না কেন??তাহলেই তো তার মাঝে ঢুকে গিয়ে কিছুটা নিস্তার মিলতো আমার।।শুভ্র ভাইয়া উদাসী গলায় বলে উঠলেন –
.
তোর ননদীনিকে বিয়ে করবো তনিমা।
.
সাথে সাথেই পাশ থেকে অদুত ভাই বলে উঠলেন –
.
আমার তো কোনো বোন নাই শুভ্র।কারে বিয়া করবি তুই?(অদুত ভাই আমার জেঠাতো ভাই।তনিমা আপুর সাথে তার প্রেম প্রায় দু’বছরের)
.
শুভ্র ভাই এবার ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলেন –
.
নাই নাকি?খুঁজে দেখ…আছে নিশ্চয়।বিয়ে তো আমি তোর বোনকেই করবো তা যেভাবেই হোক।
.
অদুত ভাইও ভ্রু কুঁচকালো।।তারপর কি ভেবে হেঁসে উঠলেন।।তনিমা আপু,,আপু,, রাফিয়া সহ আরো কয়েকজন গেলো আম ভর্তা করতে।।আলিফ ভাই আর ভাইয়া গেলো বাগানের গাছ থেকে আম পাড়তে….আর অদুত ভাই আর তুষার ভাইয়া গেলো সিগারেট টানতে।।বলতে গেলে একে একে সবাই পাঁচ দশমিনিটের ব্রেকে চলে গেলো।।জারিফ আদিবা উঠে দৌঁড় দিতেই আমিও উঠতে গেলাম।।তার আগেই হাত টেনে বসিয়ে দেওয়া হলো আমায়।।কাজটা শুভ্র ভাই ছাড়া কেউ করেনি বুঝতে পেড়েই রাগী চোখে তাকালাম। উনি কিছুই হয় নি এমন ভাব নিয়ে বলে উঠলো –
.
কই যাস?
.
নিচে যাবো হাত ছাড়ুন।
.
হাত ধরেছি নাকি?ওহ শীট!!সরি রে। তবে ধরেই যখন ফেলেছি তখন আর ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।।এখন মুড নেই বুঝলি?কিছুক্ষণ পর মনে করিয়ে দিস।।মুড থাকলে ছেড়ে দিবো।।
.
আমি রাগ নিয়ে হাত ছাড়াতে গেলেই আরো শক্ত করে চেপে ধরলেন উনি।।চুয়িংগাম চিবুতে চিবুতে বলে উঠলেন –
.
এক্টু বেশি বেশি করে হরলিক্স খা বুঝলি?তোর হাইট তো মাত্র ৫।আর আমি ৬ ফুট ২। তোর থেকে পুরো ১ ফিট ২ ইঞ্চি লম্বা।। আমার গলা পর্যন্ত পৌঁছাতেই তো তোর তিনদিন লাগবে রে।।
.
উনার কথায় রাগটা চরম আকার ধারন করলো আমার।।একটু লম্বা বলে এতো বড়াই??আমি দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলাম-
.
আপনার গলা পর্যন্ত পৌঁছানোর কোন ইচ্ছে আমার নেই।।হাত ছাড়ুন বলছি নয়তো কামড়ে দিবো।
.
ওহ মাই গড্। তুই তো ওদের বিয়ের ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছিস।এখনই কামড়াকামড়ি??
.
আমি রাগে লাল হয়ে বসে আছি৷ উনি যে ইচ্ছে করেই ফাঁদে ফেলছেন আমায় তা বেশ বুঝতে পারছি।।তাই এই নীরবতা… কোনো ভাবেই উনার ফাঁদে পা দেওয়া চলবে না।।কিছুতেই না।।আমাকে এভাবে চুপ করে বসে থাকতে দেখে মুচকি হেসে ফু দিয়ে সামনের চুলগুলো উড়িয়ে দিয়ে বললেন-“পাগলী!” তারপর শার্টের পকেট থেকে বের করলেন হিজল ফুল।।হাত ভর্তি লাল টকটকে হিজল ফুল এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। আমার ধরে রাখা হাতটি টেনে কোলে নিয়ে হিজলফুলের মালা জড়াতে লাগলেন হাতে….তার সাথে সাথে গলা কাঁপিয়ে আবৃত্তি করে উঠলেন-
.
তোমায় দিলাম অযুত জারুল ফুল,
তোমায় দিলাম হিজল ফুলের বন,
রোজ নিশীথে একলা থাকার কালে,
আমায় দিও খানিক তোমার মন।
আমায় দিও একটুখানি ছায়া,
একটু দিও শান্ত শীতল জল,
তোমার জন্যে বুকের ভেতর তবু,
সাত সাগরের অশ্রু টলমল।
আমার ভোরের আলোকজুড়ে দ্বিধা,
আমার সকাল বিষণ্নতায় ঠাসা,
একজনমের রাত্রি-দিবসজুড়ে,
তোমার নামেই নিত্য যাওয়া আসা।
আমায় দিও একটুখানি ছুঁয়ে,
আমায় দিও একটুখানি মন,
এই জনমের জন্ম-মৃত্যু জানে,
তুমি মানেই আমার সমর্পণ।
___ সাদাত হোসাইন
.
আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি।উনার কন্ঠটা এমনিতেই সুন্দর তারমাঝে এই কবিতা!!কবিতার প্রতিটি লাইনে যেন নিজের সবটা আবেগই ঢেলে দিয়েছেন উনি।। আমাকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে উঠলেন উনি-
.
বাসার পাশে যে হিজল গাছটা আছে…আজ প্রথম ফুল ফুটেছে তাতে।।জানিস?কতো কষ্ট হয়েছে মালা গাঁথতে?ইশশ আঙ্গুলগুলো সুঁচের গুঁতোই কাহিল!!এই এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন??প্রেমে পড়ে যাবি তো….পরে বিয়ে করতে মন চাইবে…..আমি আবার খুব আবেগী মানুষ বুঝলি…রাজী হয়েও যেতে পারি।।তখন আমাকে সারাজীবন তোর মতো পুতুল টাইপ মেয়ের জামাই হয়ে থাকতে হবে।।তাই বলছি, প্রেমে পড়ে আমার এতোবড় সর্বনাশ করিস না।
.
আমি হাতটা টেনে নিয়ে বলে উঠলাম –
.
প্রেম আর আপনার? কোনো কালেই না।।আমি বরং এক কাজ করি রাফিয়াকে কনগ্রাচুলেশনটা জানিয়েই দিই….সে তো আপনার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেই….বিয়ের শখটাও জেগে গেছে নিশ্চয়….আর আপনি তো খুব আবেগী মানুষ নিশ্চয় রাজি হয়ে যাবেন?রাফিয়া একদমই পুতুল টাইপ না…কপালটা এবার খুলে গেলো আপনার।
.
আমার কথায় মুচকি হাসলেন উনি।।চুলগুলো ঝাঁকিয়ে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলে উঠলেন –
.
আহারে…রাজি হতে পারলে বেশ হতো বুঝলি।।বাট জ্বলন্তী কন্যা, রাজি হওয়ার সিস্টেমটা খারাপ হয়ে গেছে বুঝলি?ইচ্ছে থাকলেও উপায় নাই।।মন, মেজাজ, শরীর সবকিছুই অন্যদিকে ডাইবার্ট হয়ে গেছে।।তাছাড়া আমার মা জননীর আবার পুতুল টাইপ বউমা চায়,,যেনো তার নাতিপুতি সব পুতুলের মতো গুলুমুলু হয়….এজ ইউজাল “” মায়ের হুকুম শিরধার্য “” টাইপ ছেলে আমি।।তো পুতুল টাইপ ছাড়া বিয়ে করি কেমনে বল?(চোখ টিপে)
.
আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলাম।নিচ থেকে কথার আওয়াজ আসছে…সবাই নিশ্চয় ছাদে ফিরছে??উনি হুট করেই একটানে মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে দুইগালে হাত রেখে কপালে হাল্কা ঠোঁটে চুমু একে দিলেন।ধীর কন্ঠে বললেন-“চুলটা বেঁধে নে” কথাটা বলেই উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের এক কোণায় কার্নিশ ঘেষে দাঁড়ালেন উনি।কানে হেডফোন গুঁজে উল্টোদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।এমন ভাব যেন কিছুই হয় নি…কিচ্ছুটি না।।আমি স্তব্ধ হয়ে বসে আছি…এরমধ্যে সবাই এসে গেছে।।আমি মালা জড়ানো হাতটা ওড়নার নিচে লুকিয়ে বসে আছি চুপচাপ। গলা শুকিয়ে কাঠ!! সবার হৈ-হুল্লোড়ে কেনো জানি সঙ্গ দিতে পারছি না একদম।।চোখে জমে চলেছে বিন্দু বিন্দু জল।।কিসের জল কে জানে??
.
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
.
#রোদবালিকা