দুপুর ২ টা। মামুদের বাসায় ঢুকতেই শুভ্র ভাইয়ার হাসির শব্দ কানে এলো। ধীর পায়ে উনার রুমের পাশে উঁকি দিতেই চোখে পড়লেন উনি। খুব মনোযোগ দিয়ে বিছানা গুছাচ্ছেন আর ফোন লাউডে রেখে কারো সাথে কথা বলছেন উনি। আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করতেই শুভ্র ভাইয়ার কথা কানে এলো।
– দেখ শালা। রাগ উঠাবি না বলে দিলাম।
– আরেহ্ কি যে বলো মামু। তোরে রাগানোর তো এটাই বেস্ট টাইম। ক্যাম্পাসে থাকলে তো কিছু বললেই মাইরা ভর্তা বানাস। বাট এখন তো মারতে পারবি না আর তুই তো আবার গালি দেস না। সো, তোরে শান্তিতে জ্বালানো যেতে পারে। তবে দোস্ত! বিশ্বাস কর। আজ আমি তোরে জ্বালাইতে ফোন দিই নি।
– তো এতক্ষণ ধরে কি আমার সাথে প্রেম করছিস? ডাফার!
– দোস্ত! লাবনির লগে ঝগড়া লাগছে। ফেসবুক,ইন্সটাগ্রাম,নাম্বার সব ব্লক মারছে। দোস্ত তুই একটু ফোন দিয়া ক না। এই লকডাউনে কি সিংগেল জীবন ভাল্লাগে ক? একটু হেল্প কর না মামা প্লিজ।
– আস্তাগফিরুল্লাহ! জীবন থাকতে না। তোর ওই গার্লফ্রেন্ডের নাম আমার সামনে নিবি না একদম। শালা..এটা মাইয়া নাকি অন্য কিছু? আমি “হ্যালো” বললে সে “আই লাভ ইউ ” ভেবে গলায় ঝুলে পড়বে।
– দোস্ত ওমন করছ কেন? তুই ওর ক্রাশ হের লাইগা এমন করে। আর ক্যাম্পাসের মাইয়ার লগে প্রেম করলে একটু আধটু সহ্য করতে হয় বুঝলি? তুমি তো মামা…মাইয়া গোর পাত্তায় দেও না। ওই আবৃত্তি না কি জানি নাম…. মাইয়াটা কি চিজ ছিলো মামা। তোমারে আইসা প্রোপোজ করলো আর তুমি বোন ডাইকা দিলা? কেমনে পারিস তুই? তোর সব ঠিক আছে তো?
– রোজার দিন লুচ্চামি থামা। সামনে থাকলে থাপড়াইয়া দাঁত ফালাই দিতাম। একটা গার্লফ্রেন্ড সামলাইতে পারিস না আবার সং ঢং করিস। শালা আবুল।
– আবুল তোর শশুড়। আমার গার্লফ্রেন্ড তো আর তোমারটার মতো বাচ্চা না। তুমি তো চড় মাইরা চুপ করাইয়া বসায় রাখো আর আমি? আমি চড় মারলে হেতি আমারে উল্টো লাত্থি মাইরা দিবো।
– আসলে কি জিসান? তুই না এক্চুয়েলি লাত্থি খাওয়ারই যোগ্য। আর কি বললি?আমার শশুড় আবুল? এক্চুয়েলি বন্ধু,, ভালো বলছিস। আবুল হতেও পারে…. তবে হ্যা,শশুড় নিয়ে বলছিস ভালা কথা বউ নিয়া কিছু বললে খবর আছে।
– দেখাইছিস কখনো বলবো? ফোনে তো পিকও রাখস না। তোর ফোনটা একদম ভাজা ফ্রাই বানাই ফেলছি তাও কোনো পিক খুঁজে পাই নাই। তবে একটা হাফ পিক পাইছিলাম। খালি দাঁত বের করা হাসি।তবে দোস্ত হাসিটা কিন্তু জোস ছিলো। ওইটা দেইখাই বুঝা যায় ভাবি আমাগো সেই হিট।
– হারামি কোথাকার। তোরা আমার ফোন চেক করিস? আর কিসের ভাবি হ্যা? আমার বউরে তোরা বোন ডাকবি বুঝছিস? তোগোর ভাবি ডাকের মাঝেই গলদ। সব কটা একেকটা লুইচ্চা।
– তোর মতো সবাই আদর্শ পুরুষ হইলে ভার্সিটির মাইয়ারা প্রেমিকহীনতায় ভুগবো বুঝছিস? এখন এগ্লা বাদ দিয়া লাবনি রে একটা কল দে..
– পারবো না। মেয়েদের ধারে কাছেই নাই আমি। আর ওইসব চিপকু মাইয়াদের ধারে কাছে তো আরো না। ম্যাসেঞ্জারেই কথা বলি না আবার ফোনে? মেয়ে মানে এক্সট্রা ঝামেলা।।আসিফরে বল যা…
– আরে বা*, আসিফের কথা শুনবে না। তোর কথা শুনবে। প্লিজ মামা,প্লিজ।
– দেখ দোস্ত। আমার ফুলের মতো পবিত্র চরিত্রটাকে এভাবে নির্যাতনের মধ্যে ফেলিস না। আমি আমার পিচ্চিকে নিয়েই ভালো আছি। তোর লাবনি টাবনির মধ্যে ফেলিস না আমায়।প্লিজ।
– আরে মামা। তুই বন্ধুর জন্য এইটুকু করতে পারবি না? তোরে কি প্রেম করতে বলছি? তুই জাস্ট বোঝাবি….প্লিজ দোস্ত প্লিজ। আর শোন? আমার ফোন কাটিস না। এমনি ফোন দে…শুনি কি বলে।
– শালা বাটপার। আচ্ছা লাইনে থাক…
আমি এবার দরজায় হেলান দিয়ে বেশ আরাম করে দাঁড়ালাম। উনি ফোনটা হাতে নিয়ে আবারও টেবিলের উপর রেখে দিলেন। বিছানার উপর রাখা শার্টগুলো গুছাতে গুছাতে শান্ত এবং ধীর কন্ঠে বলে উঠলেন,
– আসসালামু আলাইকুম, লাবনী বলছো?
– জি আপনি কে?
– আমি শুভ্র। জিসানের ফ্রেন্ড।
– ওহ্ মাই গড্। শুভ্র ভাইয়া? আপনি আমাকে ফোন দিয়েছেন? আমি জাস্ট বিশ্বাস করতে পারছি না। আপনি আর আমাকে? ওহ মাই গড।
শুভ্র ভাইকে দেখে মনে হচ্ছে উনি বেশ আনইজি ফিল করছেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে উঠলেন,
– আসলে লাবনি ফোনটা জিসানের জন্য করেছিলাম। ছেলেটা তোমাকে খুব ভালোবাসে। তুমি ওকে ইগনোর করছো তাই বেচারা মনমরা হয়ে বসে আছে। হয়তো বা কান্নাকাটিও করেছে। কি একটা অবস্থা বলো। আজকালকার যুগে কি এমন ছেলে পাওয়া যায় বলো? আর তাছাড়া মান অভিমান তো হবেই তার জন্য এতো রাগ করলে চলে? ও তো একটু ভবঘুরেই বাট তুমি তো বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে। অল্পতে রাগ করা বুদ্ধিমতীদের মানায় না। তুমি প্লিজ ওকে আনব্লক করে ওর সাথে একটু কথা বলো।।
– ভাইয়া আপনি যখন বলেছেন অবশ্যই করবো। দেখেছেন আপনি কতো সুইট করে স্মোথলি কথা বলেন। আর জিসান? অলওয়েজ ধমকা ধমকি করে। ভাইয়া প্লিজ ওকে একটু আপনার মতো কথা বলতে শিখাবেন?
– সবাই একরকম হয় না। ও ওর মতো পার্ফেক্ট লাবনী।
– তবু ভাইয়া প্লিজ। আপনার সবকিছুই কতো কুল। ওকে একটু আপনার মতো শিখিয়ে দিয়েন প্লিজ প্লিজ।
– আচ্ছা শেখাবো। এখন রাখছি তুমি প্লিজ ওকে আনব্লক করে দিও।
– আনব্লক না করলে কি আবার ফোন দিবেন?
শুভ্র ভাইয়া যেন এবার বিষম খেলেন । কোনো মতে বলে উঠলেন,
– নাহ্। আমি কাউকে বারবার রিকুয়েষ্ট করি না। তোমাকে বললাম এবার বাকিটা তোমার উপর নির্ভর করছে। রাখছি।
– একমিনিট। ভাইয়া? আপনার কি গার্লফ্রেন্ড আছে? না মানে, ক্যাম্পাসে তো কখনো দেখি না তাই বললাম। আপনাদের ফ্রেন্ড সার্কেলে তো আনিকা আপু আর মিলি আপুকেই দেখি বাট আপনার সাথে আলাদা কাউকে কখনো দেখি নি। আছে কি?
– নাহ। গার্লফ্রেন্ড নাই তবে বউ আছে। প্রেগনেন্ট বউ।
– আপনি মজা করছেন ভাইয়া?
– জি না। মজা করছি না। তুমি চাইলে জিসানকে জিগ্যেস করতে পারো। নাম্বারটা আনব্লক কর তাড়াতাড়ি জিগ্যেস করে নাও কেমন?রাখছি..আল্লাহ হাফেজ।
ফোনটা তাড়াহুড়ো করে কেটেই জোরে একটা শ্বাস ফেললেন উনি। রাগী কন্ঠে বলে উঠলেন,
– শালা হারামি। তোর গার্লফ্রেন্ডের কানের নিচে মারা উচিত।
– দোস্ত! পাইলে আমিই মারতাম। শালী বলে কি? দেখছিস? তোর লগে কতো লাফায় লাফায় কথা বললো আর আমি ফোন দিলে মনে হয় কেউ ওরে ইন্দুরের ফ্রাই খাওয়াই দিছে।
কথাটা শুনেই ভুবন কাঁপানো হাসিতে ফেটে পড়লাম আমি। এতোক্ষণ কতো কষ্টে যে হাসি চেপে রেখেছিলাম, আল্লাহ মালুম। আমার হাসির শব্দে পেছন ফিরে তাকালেন শুভ্র ভাই। মুহূর্তেই ভ্রু কুঁচকে এলো উনার। ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
– মামু, কে রে? ভাবি? তোর ফোনে যে হাসির রেকর্ডিং আছে তার লগে তো মিলে যায়তাছে।
– শালা ফোন রাখ।
কথাটা বলেই ফোন কেটে দিলেন উনি। টাওজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠলেন,
– কি? এই বিকেল বেলা আমার বাড়িতে রোদেলা দুপুর এসে হাজির। কাহিনী কি? আর এভাবে বেক্কলের মতো হাসছিস কেন? তোকে না বলছি এভাবে হাসবি না। হাসি থামিয়ে বল,এখানে কি?
– আম্মু পাঠিয়েছে তাই এসেছি। মামানি নাকি অসুস্থ? মামু বাড়ি নেই। তাই আম্মু বললো আমি যেনো আজ মামানির সাথে থাকি।
– ওহ! রোজা রেখেছিস?
– হু।
– গুড। রোজা আর নামাজ মিস গেলে মাইর খাবি। আচ্ছা বল তো কি রান্না করা যায়? আজ ইফতারি আমি বানাবো।
– আমি থাকতে আপনি কেন বানাবেন? তাছাড়া,আম্মু আমাকে রান্নার জন্যই পাঠিয়েছে।
– পাঠাক। পিচ্চি পিচ্চির মতো থাক। রান্না ঘরে ঢুকে গরম তেল ছিটিয়ে মরতে চাস? এবার চুপচাপ আমার সাথে রান্নাঘরে চল। দূরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখবি সব ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা। বিরিয়ানি, বেগুনী, বুট দিয়ে চলবে না? আমি এগুলোই পারি। যদিও বেগুনীর রেসেপিটা ইউটিউবে একবার দেখতে হবে।
আমি আর শুভ্র ভাই রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে আছি। পেঁয়াজ -মরিচ -মাংস- বেগুন সব কেটে দিয়েছি আমি। উনি ইউটিউব দেখে বিরিয়ানিও রান্না করে ফেলেছেন ইতোমধ্যে। বেশ ভালোই ঘ্রান আসছে মনে হয়। কালারটাও মোটামুটি খারাপ না। এখন বেগুনী বাজছেন আর ইউটিউবের মহিলাটাকে বকা দিচ্ছেন। উনার ধারনা মহিলা নির্ঘাত কিছু কারচুপি করেছেন যার কারণে তার বেগুনীগুলো মহিলাদের মতো ফুলছে না। কেন ফুলছে না? ফুলবে না কেন? ফুলতে হবে!! আমি উনার কান্ড দেখে হাসিতে কুটিকুটি। এমন সময় গুটি গুটি পায়ে মামনি এলে দাঁড়ালেন পাশে। দুর্বল হাসি দিয়ে বললেন,
– কি করছিস তোরা?
আমি লাফিয়ে তাকের উপর থেকে নেমে মামানির কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। মামনিকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলাম,
– আমি কিছু করছি না মামানি। সব তোমার গুণোধর ছেলে করছে। তোমার ছেলের তো বহুত গুণ, সবই পারে। তাহলে মা শুধু শুধু আমায় কেন পাঠালো বলো তো ?
– তোকে আমার ছেলের গুণ দেখতে পাঠিয়েছে। দেখে নে, আমার ছেলের অনেক গুণ। (মুচকি হেসে)
মামানির কথার উত্তরে কিছু একটা বলতে যাবো ঠিক তখনই শুভ্র ভাইয়া বলে উঠলেন,
– ফুপি জানে তার ভাতিজার কি চায়। তাই তোকে পাঠিয়েছে। আই মিন, রান্নাটা নাহয় আমিই করলাম থালা-বাসন ধোয়া, আমার কাপড় ধোয়া, ঘর গুছিয়ে দেওয়া, খাবার সার্ভ করা এসব আমার কর্ম নয়। তাই তোকে পাঠানো হয়েছে। যাহ্ কাজে লেগে যা। (একটু ভেবে) নাহ এখনই না। ইফতারের পর শুরু করবি। ননস্টপ ওয়ার্কিং। আমি সেটা দিয়ে নাটক বানাবো “কাজের মেয়ে রোদেলা” আহা! হিট হিট হিট।
– মামানি! দেখছো কেমন করছে। আমি নাকি কাজের মেয়ে। থাকবোই না আমি।
– শুভ্র! একটা চড় দিবো। তুই সবসময় ওর পেছনে লাগিস কেন শুনি?
– আজব! আমি কি করলাম? ওকে আমি যা বলি তাতেই সে ফেচফেচ করে কাঁদে নয়তো চিৎকার করে। এই দেখো আমি কাজের মেয়ের জায়গায় যদি বলি “ঘরের বউ রোদেলা” তবু চোখ পাকিয়ে তাকাবো। বিশ্বাস করলা না? ওই দেখো…ওই যে!
আমি দাঁতে দাঁত চেপে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মামানি এবার মিষ্টি হেসে আমার হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
– রাগ করে না। দ্বিতীয় কথাটা তো খারাপ বলে নি,রাগ করছিস কেন? যায় হোক ইফতার টাইম তো হয়ে এলো। তোদের কাজ কতদূর?
শুভ্র ভাই গ্যাসটা বন্ধ করে দিয়ে কিচেন থেকে বের হতে হতে বলে উঠলেন,
– আমার রান্না তো শেষ। এবার সার্ফ করার দায়িত্ব বাড়ির বউয়ের। তাহাকে বলো… আমি আর নাই।
কথাটা বলেই রুমে ঢুকে গেলেন উনি। মামানিও মুচকি হেসে নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিলেন। আমি একা এক অবলা নারী দাঁড়িয়ে আছি রান্না ঘরে। উনি কি বুঝিয়েছেন তা যে বুঝি নি তা নয়। বুঝেছি কিন্তু এমনটা কেনো বললেন সেটা বুঝতে পারছি না। সবসময় অদ্ভুত কথা বলেন কেন উনি?
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
#রোদবালিকা