রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ২০
#নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৮.
“বিরক্তি”—শব্দটাই আস্ত এক বিরক্তির ডিব্বা। সারাদিনে লক্ষবার বিরক্ত হই আমি। আমি এমন একটা মেয়ে যে কিনা নিজের রুম থেকে বের হয়ে ব্যালকণিতে যেতেও বিরক্ত হই। আর ভাগ্যক্রমে এইসব বিরক্তিজনিত বিষয়গুলো কেবলমাত্র আমার সাথেই ঘটে। আজও ঠিক তাই হলো। কয়েকদিন যাবৎ মনটা বেশ খারাপ। সেই সাথে রাতের ঘুমও হারাম। সারারাত জেগে উপন্যাস পড়ে সকালের দিকে ঘুমোতে যাই। যার ফলাফল হিসেবে ঘুম থেকে উঠতে উঠতে দশটা।
ফ্রেশ হওয়ার পর খাওয়া নামক যে বিষয়টি আছে তাতেও আমি চরম বিরক্ত ! সেই সাথে আতঙ্কিত। তাই খাবারটাকে অপশনাল সাবজেক্টের ভীরে ফেলে রেখেছি সেই অনেকদিন থেকে । অর্থাৎ,আম্মু বাসায় থাকলে আমার খাওয়া হয় নয়তো নয়। খাবার দেখলেই কিছুদিন যাবৎ কান্না কান্না পায় কিন্তু মা-জননীর জন্য কাঁদতে কাঁদতেই খাবার গিলতে হয়। আপু একটু শুকনো বলেই হয়তো আমাকে গুলুমুলু গোল আলু বানানোর এতো পরিকল্পনা আম্মুর। সে যায় হোক, প্রতিদিনের মতো আজও পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিলাম। ঘড়িতে তখন —– ১০ঃ১৫ কি ১০ঃ১৬ । ঘুমের মাঝেই কেউ একজন টেনে হিঁচড়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো আমায়। ভাত মাখিয়ে মুখের সামনে ধরে বললো,
— হা কর।
আমি চোখ পিটপিট করে তাকালাম, আম্মু! সাথে সাথেই রাজ্যের বিরক্তি হানা দিলো আমার গায়ে। কোনোরকম বললাম,
— ফ্রেশ তো হতে দাও। দাঁতও তো ব্রাশ করি নি।
আম্মু আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে বললেন,
— তোর ফ্রেশ হতে দু’ঘন্টা লাগবে ততক্ষনে খাওয়ার কথা ভুলে যাবি। এখন আমি সময় পেয়েছি সো আগে ভাত খা, ঔষধ খা তারপর দাঁত ব্রাশ করবি না গোসল করবি সেটা আমার দেখার বিষয় না। কি হলো? বলদের মতো বসে আছিস কেন? হা কর!
আমি কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে “হা” করলাম। আমার আম্মু শুধু কথায় নয় কাজেও আমার আম্মু। একবার যে কথা বলবে সেই কথার কোনো নড়চড় হবে না। অর্থাৎ, এখন যেহেতু উনি ভেবে নিয়েছেন আমাকে খাওয়াবেন তারমানে খাওয়াবেন। ধম ফোঁটা হয়ে মরে গেলেও খাওয়াবেন, ব্যস! এইদিক থেকে শুভ্র ভাই আর আম্মুর ব্যাপক মিল। দু’জনেই ঘাড়ত্যাড়া। আমার ধারনা, এই ত্যাড়ামো নামক গুণের জন্যই আম্মু শুভ্র বলতে পাগল। আমি দু-তিনবার খাবার মুখে নিতেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো আপু। কাঁচা হলুদের মধ্যে সবুজ সুতোয় কাজ করা জামা পড়েছে সে। ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। এমনিতেই সাদা ফর্সা গায়ের রঙ গোসল করে ফর্সা ভাবটা যেন বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। আমি অবাক চোখে তাকালাম। মুখের খাবারটা গিলে নিয়ে বললাম,
— এতো সকালে গোসল! কোথাও যাচ্ছো আপু?
আপু দায়সারা উত্তর দিলো,
— হুম, যাচ্ছি। তবে একা নয় সাথে তুইও যাচ্ছিস।
আপুর কথায় মন খারাপ ভাবটা স্পষ্ট। তবে,এই মুহূর্তে আপুর মন খারাপ ভাবটা তেমন একটা ভাবালো না আমায়। আমি বিস্মিত গলায় বললাম,
— কি? আমি যাচ্ছি মানে কি? কোথায় যাচ্ছি?ইম্পসিবল! আমি কোথাও যাচ্ছি না।
আম্মু শান্ত গলায় বললো,
— তোর মামানি তৃষাল যাচ্ছে। ওইযে, শুভ্রর নূরজাহান খালামনির নাম শুনিস নি? হাইস্কুলের টিচার যে…উনাদের বাসায়। তোদের দু’জনকেও সাথে নিবে। খাওয়া শেষ করে ঝটপট রেডি হয়ে যা।
আমি অসহায় মুখে আপুর দিকে তাকালাম। আপুর মুখটাও ইতোমধ্যে বাংলার পাঁচের আকার ধারন করেছে। আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম,
— চরপাড়া থেকে তৃষাল!! অনেক সময় লাগবে আম্মু। আমি যাবো না। অনেক কাজ আছে আম…
আম্মু ঝাঁঝাঁলো গলায় বললো,
— তোর কাজ তো ওই এক ফোনেই।এদিকে দুনিয়া ভেসে যাক, পারেলে কিয়ামত হয়ে যাক সেইদিকে কোনো মাথা ব্যাথা নেই তোর? কি লাভ এই ফোন নিয়ে বসে থেকে? কি লাভ? ইচ্ছে তো করে ফোন নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে আসি। বাপের আদরে সবকটা দিন দিন অসামাজিক জীব হয়ে যাচ্ছে। আমি একটা কথাও শুনতে চাই না। তোদের মামানি নিয়ে যেতে চাইছে তো যাবি, ব্যস।
কথাটা বলে খাবারগুলো মুখে ঠুসে দিয়ে প্ল্যাট হাতে বেরিয়ে গেলেন আম্মু। আপু মুখ কালো করে পাশে বসেই বলে উঠলো,
— শেষ রক্ষা আর হলো না, বুঝলি?
আমি অবাক হয়ে বললাম,
— কেনো?
আপু কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
— কেন মানে? শুভ্র ভাইয়ের আংকেলের কথা জানিস না তুই?ব্যাটার কাজই হলো ঘটকালি করা। একজন গভমেন্ট অফিসারের এমন স্বভাব মানায়, বল? আমাদের মতো প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য মূর্তমান আতঙ্ক উনি। দেখিস, যাওয়ার সাথে সাথেই ঘটকালী শুরু করে দিবেন। উনাকে দেখে মনে হয়, বাংলাদেশের সব ইয়াং ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেওয়ার মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন উনি। যত্তসব!
আমি কিছু বললাম না। রেডি হয়ে এতোটুকু রাস্তা যেতে হবে কথাটা মনে হতেই মনটা বিরক্তিতে তেতো হয়ে যাচ্ছে আমার। আপুর মতো ঘটকালি জাতীয় টেনশনটা আপাতত নেই। বিরক্তির নিচে চাপা পড়ে জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত তারা। আর যদি ঘটকালি করেই বসেন তাতেই বা ক্ষতি কি? বিয়ে করা তো আহামরি কোনো বিষয় নয়। জাস্ট তিনবার কবুল বলে জ্বালানোর জন্য আস্ত একটা মানুষ পেয়ে যাওয়াটা তো দুঃখে বুক ফাঁটানোর মতো কিছু নয় বরং পরম আনন্দের। এমন হাজারও কথা মাথায় নিয়ে ওয়াশরুমে দরজা দিলাম আমি। ফ্রেশ হয়ে কালো আর লালের মিশ্রণে একটা গাউন পড়ে নিয়ে ধীরে স্থিরে তৈরি হয়ে আপুর দিকে তাকালাম। আপুর মুখটাতে কাঁদো কাঁদো ভাব। ওকে দেখে মনে হচ্ছে, এখনই ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাকে আর সেই দুঃখে ভয়ানক রকম দুঃখী সে। কিছুক্ষণ পরই মামানি এলেন। শুভ্র ভাই গাড়ি আনতে গেছেন। শেষ মুহূর্তে আদিবাকেও সাথে নেওয়া হলো। গাড়িতে উঠার সময় একবার শুধু আড়চোখে তাকালেন শুভ্র ভাই। আর আমি? উনাকে প্রথমদিন দেখে যেমন ৮০ ভোল্টেজের ক্রাশ খেয়েছিলাম আজও তাই খেলাম। উনি কালো শার্ট পড়েছেন। চোখে-মুখে অসম্ভব রকম স্নিগ্ধতা। চোখ সরিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাটাই যেন হারিয়ে ফেলেছি আমি। মনে মনে আয়তুল কুরসি পড়তে লাগলাম, এতে যদি রক্ষা হয়! কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। মাথার ভেতর প্রেমভোমরাটা ভনভন করে ছুটতে লাগলো তার নিজস্ব গতিতে। আমি ঢোক গিলে চোখ বন্ধ করে সিটে গা এলিয়ে দিলাম। আচ্ছা? এই লোকটি কি জানে না? গায়ে কালো রঙ জড়ানোটা তারজন্য মারাত্মক এক অপরাধ! মামানির বোনের বাসায় ঢুকতেই দেখা হলো নূরজাহান আন্টির সাথে। এই মহিলাকে এর আগেও দু-একবার দেখেছিলাম আমি। আমাদের দেখে যে উনি সীমাহীন খুশি হয়েছেন তা তার চোখে-মুখে স্পষ্ট। আমরা সোফায় বসতেই আমাদেরকে কিভাবে আপ্যায়ন করবেন তা নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েন উনি। কিছুক্ষণ পরই রুম থেকে বেরিয়ে এলেন মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক। মুখে অমায়িক হাসি। লোকটি যে যৌবনে হাজারও মেয়ের দীর্ঘশ্বাসের কারণ ছিলেন তা তার চেহারার শক্ত ভাজে অনেকটাই স্পষ্ট। গালের চাপা দাঁড়ি আর ছোট করে কাঁটা মাথার চুলগুলোতে পাক ধরেছে মাত্র। উনি আমাদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে সোফায় বসতে বসতে বলেন,
— আসসালামু আলাইকুম, শরিফা। কেমন আছো? অনেকদিন পর দেখা…
মামানিও হাসিমুখে বলেন,
— ওয়ালাইকুম সালাম, দুলাভাই। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
— আছি ভালো। এটা তোমার ছেলে বুঝি? এত্তোবড় হয়ে গেছে? বাপরে…আমার থেকেও উঁচু হবে মনে হয়। কোথায় পড়াশোনা করছো বাবা?
শুভ্র ভাই হাসিমুখে বলেন,
— চুয়েট-এ পড়ছি। মাস্টার্স লাস্ট টার্ম। এই বছরই শেষ হতো কিন্তু এই মহামারীর জন্য আটকে গেলাম।
— বাহ, গুড গুড। আমি তো চিটাগাং পড়তাম। তবে চুয়েট এ নয় চিটাগং ইউনিভার্সিটিতে। ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে। তোমাদের মতো ইঞ্জিনিয়ারিং টিঞ্জিনিয়ারিং আমার মাথায় ঢুকতো না। তো লাস্ট সেমিস্টারে রেজাল্ট কেমন?
শুভ্র ভাইয়া ইতস্তত করে বলেন,
— ৩.৯৪ আঙ্কেল।
লোকটি সরু চোখে তাকান। মুগ্ধ গলায় বলেন,
— ব্রিলিয়ান্ট! এনিওয়ে, ওরা কারা? তোমাদের নাম কি মা?
আমরা নাম বলতেই, কে কোথায় পড়াশোনা করি তার খুঁটিনাটি জিগ্যেস করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন উনি। আপু ইঞ্জিনিয়ারিং করছে শুনে চোখমুখ চকচক করে উঠে উনার। বিস্ময় নিয়ে বলেন,
— তুমিও ইঞ্জিনিয়ারিং করছো? বাহ্! দেখতেও তো মাশাআল্লাহ।
শুভ্র ভাইয়া বাঁকা হেসে বলেন,
— দেখতে হবে না কার বোন? শুভ্রর বোন বলে কথা ,সবকিছুতেই মাশাআল্লাহ!
লোকটি হাসেন। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলেন,
— তা যা বলেছো। সুদর্শন পুরুষের সুন্দরী বোন বলে কথা! কিন্তু ও তোমার কেমন বোন হয়? চিনতে পারলাম না ঠিক।
শুভ্র ভাই স্বাভাবিক গলায় বলেন,
— আমার একমাত্র ফুফাতো বোন।
লোকটি অবাক হয়ে বলেন,
— সে কি! রুহি তোমার ফুপ্পির মেয়ে? চেহারায় মিল নেই একদম। তবে, রোদলাকে দেখে বুঝা যায় ও অরিয়ানার মেয়ে। চেহারায় বেশ মিল। কিন্তু, রুহিকে একমাত্র ফুফাতো বোন বললে কেন? রোদ-রুহি যে বললো ওরা দুইবোন!
মামানি হেসে উঠেন। শুভ্র ভাই সোজা হয়ে বসে খুব স্বাভাবিক গলায় বলেন,
— রোদকে তো নদীর পাড় থেকে কুড়িয়ে এনেছে আংকেল। তাই ওর প্রতি বোন বোন ফিলটা আসে না। মাঝে মাঝে তো এটাও ভুলে যাই যে ওকে সবাই ফুপ্পির মেয়ে বলে চেনে।
শুভ্র ভাইয়ের কথায় চোখ-মুখ লাল করে তাকাই। সাথে সাথেই ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠেন শুভ্র ভাইয়ার আংকেল। কিছুক্ষন একটানা হেসে নিয়ে হাসি থামিয়ে মামানিকে উদ্দেশ্য করে বলেন,
— তোমার ছেলে তো দেখি ভারি রসিক। পড়াশোনাও তো শেষ। তা বাবা? বয়স কত তোমার?
শুভ্র ভাই অদ্ভুত চোখে তাকান। মৃদু হেসে ভদ্রতার খাতিরে বলেন,
— ২৪।
— তাহলে তো বিয়ের বয়স হয়েই গেছে। এই বয়সে তো আমি দু’বার হানিমুনও কমপ্লিট করে ফেলেছি, হা হা হা।
শুভ্র ভাই হাসেন। উনার হাসিতেও একরাশ বিরক্তি। বিরক্তি চেপে মৃদু গলায় বলেন,
— সবই কপাল।
শুভ্র ভাইয়ের কথা উনার কান পর্যন্ত পৌঁছলো কিনা বুঝা গেলো না। লোকটি আগের থেকেও আমোদিত কন্ঠে বলেন,
— তা শরিফা? ছেলেকে বিয়ে দিবে না? বলো তো পাত্রী দেখি। ছেলের রেজাল্ট ভালো ভবিষ্যৎ উজ্জল। বিয়েটা নাহয় দিয়েই দাও।
শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে মামানির দিকে তাকান। যার অর্থ, মা আমি বিরক্ত হচ্ছি। মামানি শুভ্র ভাইয়ার মুখটা একবার দেখে নিয়ে মৃদু হেসে বলেন,
— আগে চাকরি করুক। স্যাটেল হোক তাছাড়া এখনকার ছেলেমেয়েদের তো নিজস্ব পছন্দ থাকে। সেদিক থেকে ধরতে গেলে পাত্রী খুঁজতে হবে না দুলাভাই।
মামানীর কথায় লোকটি আশাহত হন। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন। কিন্তু দমে যান না, নতুন উদ্যোগে রুহি আপুকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। শুভ্র ভাই ঠোঁট চেপে হাসেন। আপুর কানের কাছে ফিসফিস করে বলেন,
— রুহি রে…বোন আমার, তোর ফার্মের মুরগীর কি হবে বল তো? বলিস তো, কয়েকটা মদের বোতল কিনে দিয়ে আসি। একদিকে তোর বিয়ে হবে অন্যদিকে তোর ফার্মের মুরগী ক্যাক ক্যাক করে গাইবে, ” বন্ধু যখন বর নিয়া হাইটা যায়, বুকটা ফাইটা যায়।” কি রে? কিনে আনবো?
শুভ্র ভাইয়ের কথায় মুখ কালো করে বসে থাকে আপু। তখনই ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে দু’জন ছেলে। একজন হলদে ফর্সা, অন্যজন উজ্জল শ্যামা। আঙ্কেল উৎসাহ ভরা দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকান। হাসিমুখে বলেন,
— আমার দুই ছেলে। চিনতে পারছো, শরিফা?
মামানি ধাঁধা লাগানো চোখে বলেন,
— ওমা! কতো বড় হয়ে গেছে। সেই ক্লাস নাইনে থাকতে দেখেছিলাম। নাহিদ কে? আর নাঈম কে?
ছেলেরা হেসে আন্টিকে সালাম দেয়। শ্যামলা করে ছেলেটা বলে,
— আমি নাহিদ আন্টি। আর ও নাঈম।
মামনী হাসিমুখে বলে,
— কোন ক্লাসে পড়ছো এখন?
এবার ফর্সা ছেলেটা বলে,
— দু’জনেই মাস্টার্স করছি আন্টি। আমি জাহাঙ্গীর নগরে ইকোনমিকসে আর নাহিদ রাজশাহীতে ইংলিশে।
— মাশাআল্লাহ। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম শুভ্র আর তোমরা ইয়ারমেট। ক্লাস ফাইভে একসাথেই কোচিং করতে মনে নেই? তখন তো চড়পাড়ায় থাকতে।
ছেলেদুটো হালকা হেসে মাথা দোলায়। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
— এখানে বড়দের সাথে বসে থেকে বোর না হয়ে আমাদের সাথে ছাদে চলো। সবাই মিলে আড্ডা দেওয়া যাবে।
কথাটা কানে যেতেই ঝটপট ওঠে দাঁড়ায় আপু। এখান থেকে পালানোর এটাই তার সুবর্ণ সুযোগ। আপুর সাথে আমি আর শুভ্র ভাইও উঠে দাঁড়াই। নাহিদ ভাইয়া আদিবাকে কোলে নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসতেই শুভ্র ভাইকে ঝাঁপটে ধরে আদিবা। অপরিচিত কারো কাছে যেতে একদমই অভ্যস্ত নয় সে। শুভ্র ভাই হেসে আদিবাকে কোলে তুলে নিয়ে বলেন,
— নাহিদ, ও আমার কাছেই থাকুক। তোমাকে চিনতে একটু সময় লাগবে ওর।
নাহিদ ভাইয়া হেসে সম্মতি জানান। ছাদের সিঁড়ি ধরে হাঁটতে হাঁটতে জানতে পারি উনারা দু’জন জমজ ভাই। নাঈম ভাইয়া দু’মিনিটের ছোট আর নাহিদ ভাইয়া বড়। নাঈম ভাইয়া ফর্সা হলেও নাহিদ ভাইয়াকেই বেশ লাগলো আমার। ছেলেদের শ্যামলা বর্ণেই বেশি মানায়। তাছাড়া, হাসিমুখে কথা বলেন আর মোষ্ট ইম্পোর্টেন্ট, শুভ্র ভাইয়ের মতো উনার গালেও টোল পড়ে। উনাদের ছাদটা বেশ বড়।
ছাঁদের একপাশে বিভিন্ন ফুলের গাছ আর আরেকপাশে ছোট ছোট আম, লিচু আর লেবু গাছের টব। সবকটা গাছেই ঝুঁকে ধরে আছে ফল। তারমধ্যে সবচেয়ে সুন্দর গাছটি হলো কালো গোলাপের গাছ। এর আগে কখনো কালো গোলাপ দেখি নি আমি। কালো রঙটাও যে ভয়ঙ্কর সুন্দর তা কালো গোলাপ দেখে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। ফুলের প্রতি আমার মুগ্ধতা দেখে এগিয়ে এলেন নাহিদ ভাইয়া। কালো গোলাপ নিয়ে হাজারও গল্প জুড়ে দিলেন উনি।
উনার কথাগুলো সুন্দর বলে শুনতেও বেশ লাগছিলো আমার। কখনো হুট করেই গলা ছেড়ে হাসছিলাম তো কখনো একটু আধটু উত্তর দিচ্ছিলাম। শুভ্র ভাই ছাঁদের অন্যকোণায় দাঁড়িয়ে আদিবাকে কিছু একটা দেখাচ্ছিলেন। আপু আর নাঈম ভাইয়াও শুভ্র ভাইয়ার পাশে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়েই শুভ্র ভাইয়ার সাথে কিছু নিয়ে গল্প করছিলেন। আধাঘন্টার মাথায় নাহিদ ভাইয়া আর নাঈম ভাইয়ার সাথে বেশ মিলে গেলো আমাদের। হাসি মজায় মেতে উঠলাম সবাই। এক পর্যায়ে নাহিদ ভাইয়াদের রুমে গিয়ে বসলাম। আড্ডা যখন চরমে ঠিক তখনই শুভ্র ভাইয়ার ফোনটা হাতে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো আপু। আমরা অবাক চোখে তাকালাম। শুভ্র ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে বললেন,
— আমার ফোনে তোর কি? ফোন দে।
রুহি আপু হাত উঁচিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় পড়তে লাগলো,
— ” শুভ্র ভাইয়া? আপনি বিশ্বাস করবেন না আমি কতোটা পাগল আপনার জন্য…”
এটুকু পড়ে সরু চোখে তাকালো আপু। সন্দেহী কন্ঠে বললেন,
— পাসওয়ার্ড বলেন শুভ্র ভাই। আমরাও দেখতে চাই কে সে রমনী। বলুন বলুন।
শুভ্র ভাই রাগী গলায় বললেন,
— একটা থাপ্পড় লাগাবো। ফোন দে বলছি। তোর সাহস দেখে আমি হতবাক। দে বলছি ফোন।
রুহি আপু এবার গো ধরে দাঁড়ালো। ম্যাসেজের সম্পূর্ণটা সে পড়বেই পড়বে। আমরাও আগ্রহ নিয়ে তাকালাম। শুভ্র ভাইয়া উঠে দাঁড়াতেই দৌড় লাগালো আপু। শুভ্র ভাইও কম না ফোন তো উনি নিবেনই।পাঁচ মিনিট এদিক সেদিক দৌঁড়াদৌঁড়ি করে হাঁপিয়ে উঠলো আপু। আমার হাতে ফোনটা দিয়ে বললো,” এবার তুই দৌড়া!” আমি ফোনটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। স্কিনের উপরে অর্ধেক ভেসে থাকা ম্যাসেজটাই চোখ বুলালাম। “আফসানা ইয়াসমিন…..” আইডিটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে ফেইক আইডি। আমি মাথা তুলে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকাতেই বিছানায় গিয়ে বসে পড়লেন উনি। আমি মৃদু গলায় বললাম,
— পাসওয়ার্ড কি?
উনি আমার চোখের দিকে তাকালেন। শান্ত গলায় বললেন,
— ভেবে দেখ, পেয়ে যাবি।
আমি ভাবলাম। দু’তিনবার ট্রাই করার পর খুলেও গেলো। সাথে সাথেই ফোনের উপর হামলে পড়লো সবাই। আপু ফোনটা ছিনিয়ে নিতে গেলেই রাগী চোখে তাকালেন শুভ্র ভাই। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
— ওই? খবরদার ফোন ধরবি না। “ফোন” মানেই পার্সোনাল বিষয়। ছাড় বলছি। নয়তো চড় মেরে দাঁত ফেলে দিবো।
আপু ফোনটা ছেঁড়ে দিয়ে ফুসফুস করে বললো,
— রোদের হাতে থাকলে মনে হয় পার্সোনাল বিষয়ে ব্যাঘাত ঘটবে না। আজাইরা।
শুভ্র ভাই আপুর কথায় পাত্তা না দিয়ে বালিশে গা এলিয়ে বসলেন। আমি ম্যাসেঞ্জার অপশনে গিয়ে ম্যাসেজটা অন করলাম। তাতে হেনতেন অনেক কিছু লেখা। মেয়েটা শুভ্র ভাইয়ের জন্য কতো পাগল, না দেখেই কত্তো ভালোবাসে ব্লা ব্লা। আপু ম্যাসেজগুলো পড়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। গম্ভীর গলায় বললো,
— ভার্চুয়াল লাভ। কাহিনী কি শুভ্র ভাই? মাইয়াটা কেডা?
শুভ্র ভাই কিছু না বলে আগের মতোই বসে রইলেন। নাহিদ ভাইয়া আর নাঈম ভাইয়া নিঃশব্দে হাসছেন। আপু আবারও জিগ্যেস করলো,
— কি ব্যাপার? নীরবতা সম্মতির লক্ষ্মণ। আপনি কিছু বলছেন না কেন শুভ্র ভাই?
শুভ্র ভাই বিরক্ত গলায় বললেন,
— তোরে কেন বলবো?
আমি গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম,
— নিউ জিএফ নাকি শুভ্র ভাই?
উনি শীতল গলায় বললেন,
— চিনি না। এমন ম্যাসেজ অনেক আসে। আমাকে কিভাবে চিনে জানি না। আন্সার দিই না। সীনও করি না। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে দু একটা ম্যাসেজের আন্সার দিয়ে জিগ্যেস করেছিলাম আসল কাহিনীটা কি। এটুকুই! চেইক করে দেখ।
আমি ফোনটা উনার দিকে এগিয়ে দিয়ে আরাম করে বসলাম। আমি জানি উনি মিথ্যে বলছেন না। তাছাড়া, ম্যাসেজের স্পষ্ট কারণ থাকা সত্যেও উনাকে অবিশ্বাস করার কোন কারণই নেই। তবে, আপু ব্যাপারটাই অসন্তুষ্ট। তার আরো কিছু ম্যাসেজ পড়ার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু আমার জন্য হয়ে উঠলো না। সবাই যখন নীরবতা আর অস্বস্তিতে বিরক্ত ঠিক তখনই নূরজাহান আন্টি রুমে এলেন। কিছু হালকা খাবার টেবিলে রাখতে রাখতে নাহিদ ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
— বাবু? ছাদ থেকে কয়েকটা আম আর লেবু নিয়ে আয়। পাকা-কাঁচা মিলিয়েই আনিস।
নূরজাহান আন্টি বেরিয়ে যেতেই উঠে দাঁড়ালেন নাহিদ ভাইয়া। আদিবার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— পিচ্চি আপু? আমার সাথে আম পাড়তে যাবে?
আদিবা কিছু না বলে শুভ্র ভাইয়ার গলা জড়িয়ে ধরলো। নাহিদ ভাইয়া হাসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— তুমি যাবে রোদেলা? শুনেছি ছোটরা গাছ থেকে ফল ছিঁড়তে খুব পছন্দ করে। আদিবার পর তো তুমিই পিচ্চি। তো, পুচকি মেয়ে কি ছাঁদে যাবেন?
আমি হালকা হেসে উঠে দাঁড়ালাম। আমার এই স্বচ্ছ হৃদয়ের হাসিটা যে একজনের একদমই সহ্য হলো না তা তখন বুঝতে পারি নি আমি। ছাঁদ থেকে ফিরে এসেই খাবার টেবিলে বসতে হলো। পরে আসায় আমাকে আর নাহিদ ভাইয়াকে পাশাপাশিই বসতে হলো। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মজার মজার গল্পও শুনালেন নাহিদ ভাইয়া। খাওয়ার মাঝেই হঠাৎই বলে উঠলেন মামানি,
— বাহ। রোদুমনি আজ অনেক খাবার খেয়ে ফেলেছে। এটা কি নূরজাহান আপার হাতের জাদু না তার ছেলের কথার জাদু? তবে যায় হোক না কেন, কাজে লেগেছে খুব।
মামানীর কথায় হাসলেন সবাই। আপু খেতে খেতে বললো,
— আম্মু দেখলে নাহিদ ভাইয়া আর নূরজাহান আন্টি দু’জনকেই বাসায় নিয়ে পার্মানেন্টলি আটকে রাখতো।
আপুর কথায় আবারও হাসির ঢল নামলো। কিন্তু একজনের মুখে হাসি ফুটলো না। চুপচাপ মাথা নিচু করে খাবার খাওয়াতে ব্যস্ত সে। বিকেলের দিকে সবাইকে বিদায় জানিয়ে বাসার দিকে রওনা দিলাম আমরা। তখনও জানি না কতোটা ঝড় অপেক্ষা করছে আমার জন্য। ভয়ঙ্কর ঝড়!
#রোদবালিকা
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/