রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৩৪
#লেখিকা- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
____________________
শরৎ-এর মাঝামাঝি। আকাশে পেঁজা তুলোর মতো শুভ্র মেঘের উড়ো উড়ি চোখে পড়ছে না। আকাশটা ছেয়ে আছে ছাই রঙা মেঘে। ব্যালকনির ডানপাশের দেয়ালটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। গায়ের গোলাপী-সাদা শাড়ির আঁচলটা অল্প অল্প উড়ছে।
খোলা চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিতেই হাতের চুড়িগুলো রিনিঝিনি বাজছে। আজকাল বেশ উদাসীন হয়ে পড়েছি আমি। হুটহাট মন খারাপ হয়। আবার হুটহাটই অন্যায় হাসিতে মত্ত হই। ‘অন্যায় হাসি’ শব্দটা মনের মাঝে ছোট্ট বলের মতো ঢপ খেতে খেতে ঘুরে বেড়ায়। আচ্ছা? হাসির মাঝেও কি ন্যায়- অন্যায় হয়? হয়তো হয়! নয়তো নয়। আমার এসব অদ্ভুত চিন্তাগুলোর মাঝেই ধমকা হাওয়ার মতো পেছন থেকে ডেকে উঠলেন মামানি,
—” রোদু মা?”
আমি ছাই রঙা আকাশে দৃষ্টি রেখেই উত্তর দিলাম,
—” হু।”
মামানি আগ্রহ নিয়ে বললেন,
—” দারোয়ানকে দিয়ে লুডু কিনে আনিয়েছি। চল লুডু খেলি। অনেকদিন যাবৎ খেলি না।”
মামানির কন্ঠে হঠাৎই যেন কিশোরী মেয়ের চঞ্চলতা খুঁজে পেলাম আমি। ঘাড় ঘুরিয়ে মামানির দিকে তাকাতেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন মামানি। সোফায় বসে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন,
—” শুভ্র জন্মাবার আগে তোর মামু আর আমি রোজ লুডু খেলতাম। তোর মামু অফিস থেকে আসার পর কত রাত জেগে জেগে কাটাতাম আমরা।”
কথাগুলো বলতে গিয়ে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো মামানির ঠোঁটে। মনে হলো, উনি হয়তো সেই দিনগুলোকে দেখছেন। প্রথম যৌবনের শিহরণময় রাতগুলো যেন চোখের সামনে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। আমি হাসিমুখে মামানির পাশে গিয়ে বসলাম। কৌতূহল নিয়ে বললাম,
—” তারপর?”
আমার কথায় অন্যমনস্কতা কেটে গেলো মামানির। আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। হেসে বললেন,
—” তারপর একটা মাইর। খুব দুষ্টু হচ্ছিস দিন দিন। চল লুডু খেলবো। লুডুতে সবসময় জিতি আমি।”
আমি হেসে বললাম,
—” আর আমি সবসময়ই হারি!”
ড্রয়িংরুমের ফ্লোরে পা গুটিয়ে বসে লুডুর ওপর ঝুঁকে আছি। বিরবির করে বলছি, “একটা ছয়! আল্লাহ.. একটা ছয়।” এমন সময় পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন শুভ্র ভাই। উরুতে দু’হাত রেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। আমার হাত থেকে লুডুর কৌটোটা একরকম ছিনিয়ে নিয়ে বললেন,
—” ধুর! তুই পারিস নাকি কিছু? সর…আমিও খেলবো।”
আমি বিরক্ত চোখে তাকালাম। কৌটোটা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
—” উফ্ ওটা দেন বলছি। বিরক্ত করবেন না একদম, এখন আমার চাল।”
উনি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললেন,
—” আমি বিরক্ত করছি? ঠাডায় লাগাবো একটা চড়, বেয়াদব। বড়দের রেসপেক্ট করতে শিখ। আমি গুণে গুণে তোর থেকে ছয় বছরের বড়।”
—” আশ্চর্য! আমি আপনাকে ডিসরেসপেক্ট কখন করলাম? মামানি? তোমার ছেলেকে এখান থেকে যেতে বলো নয়তো আমি উনার মাথা ফাটিয়ে দেবো।”
শুভ্র ভাই বিস্ময় নিয়ে বললেন,
—” কি সাংঘাতিক মেয়ে তুই! মুখের উপর মাথা ফাটিয়ে দিতে চাইছিস তবু বলছিস অসম্মান করছিস না? একদম বাপের মতো হয়েছে….”
আমি ঠোঁট উল্টিয়ে ধারালো দৃষ্টিতে তাকালাম। অনুযোগের সুরে বললাম,
—” আপনি আবার বাবাকে নিয়ে বাজে কথা বলছেন। খেলবো না আমি। এক্ষুনি বাসায় চলে যাবো।”
মামানি শুভ্র ভাইয়ের পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন,
—” একটা চড় দিবো। দিন দিন ফাজিল হচ্ছিস। ওর বাবা তোর কি হয়,হ্যাঁ? খবরদার এসব কথা যেন আর না শুনি। এবার এখান থেকে ভাগ।”
মামানির কথায় শুভ্র ভাইয়ের মধ্যে তেমন কোনো ভাবাবেগ হলো না। ফ্লোরে বেশ আয়েশ করে বসলেন। নাছোড়বান্দা গলায় বললেন,
—” আমিও খেলবো।”
আমি রাগ নিয়ে বললাম,
—” আপনাকে নেওয়া হবে না। আপনি না তুষার ভাইয়াদের সাথে বের হচ্ছিলেন? তাহলে সেখানে যান না….এখানে কি?”
উনি আমার মাথায় চাটি মেরে বললেন,
—” তুই বললেই আমায় যেতে হবে? আমার এখন যেতে ইচ্ছে করছে না, যাবো না। খেলতে ইচ্ছে করছে … খেলবো, ব্যস।”
আমি কিছুক্ষণ মুখ ফুলিয়ে বসে রইলাম। মামানি আর আমি দু’জনেই জানি, এই মানুষটার মতো নাছোড়বান্দা ব্যক্তি পৃথিবীতে আর দুটো নেই। একবার যখন বলেছেন ‘খেলবো’ তারমানে পৃথিবী উল্টেপাল্টে গেলেও উনি খেলবেন। মামানি ছেলের যন্ত্রণায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আবারও নতুন করে গুটি সাজানো হলো। খেলা শুরু করার আধাঘন্টার মাঝেই লুডুর ছক উল্টে দিলেন শুভ্র ভাই। আমি আর মামানি দু’জনেই চোখ গরম করে তাকালাম। আমাদের তপ্ত দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে বলে উঠলেন উনি,
—” এটা কোনো খেলা হলো? ফালতু। লুডুর ছকও মেয়েদের সাইড নিচ্ছে। এই অসম অধিকার তো মানা যায় না। তোমাদের দু’জনেরই ছয় উঠছে আমার উঠছে না…… এটা তো রীতিমতো দুর্নীতি।”
উনার কথা শুনে রাগে শরীরটা জ্বলে উঠলো আমার। ইচ্ছে হচ্ছিলো উনার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো টেনেটুনে ছিড়ে ফেলি। একটা মানুষ এতোটা বিরক্তিকর কি করে হতে পারে? কি করে? মামানি রাগ নিয়ে বললেন,
—” বাপ ছেলে একরকম হইছে। চাপা দিয়েই পৃথিবী উদ্ধার করে ফেলে। খেলাটা এতো ভালোভাবে এগুচ্ছিলো নষ্ট করলি কেন?”
—” ভালো কই এগুচ্ছিলো? একদম বিশ্রীভাবে এগুচ্ছিলো। আমি হলাম যুবসমাজ…চোখের সামনে তো আর দুর্নীতি সহ্য করতে পারি না।”
—” এগুলো কথা তোর বাপের থেকে শিখছিস না? তোর বাপ যুবসমাজ থেকে বুড়োসমাজে পৌঁছেছে এখন ছেলে যুবসমাজ বলে হল্লা করছে। তোরা ময়মনসিংহের ছেলেরাই এমন….চাপাবাজ।”
শুভ্র ভাই যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বিস্ময় নিয়ে বললেন,
—” ময়মনসিংহের ছেলেরা চাপাবাজ? ওকে ফাইন…বাবাকে ডাক। গার্লস Vs বয়েজ খেলা হবে। দেখি কে জিতে। শেরপুরের মেয়েরা নাকি ময়মনসিংহের ছেলেরা। ডাক… ডাক…”
মামানি কনফিডেন্স নিয়ে বললেন,
—” তোরা হারবি। তোর বাপও সারাজীবন হেরেছে, তুইও হারবি।”
—” দেখা যাবে। দেখা যাবে। হু…”
শুভ্র ভাইয়ের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করেই মামুকে ডাকলেন মামানি। চারবারের মাথায় বই হাতে বেরিয়ে এলেন মামু। নাকে পড়ে থাকা মোটা চশমার উপর দিয়ে মামানির দিকে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
—” কি সমস্যা? এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন?”
মামানি এমনিতেই রেগে ছিলেন। মামুর কথায় রাগটা তার দ্বিগুণ হলো। ফুঁসে ওঠে বললেন,
—” একবার ডাকার পর চলে এলেই তো চেঁচাতে হতো না।”
মামু একবার আমার দিকে তাকালেন। ভাগ্নীর সামনে বউয়ের তেজ সহ্য করতে একদমই রাজি নয় সে। আমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলেন মামু,
—” ডাকছিলে কেন?”
মামানি ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি ঝুলিয়ে নিয়ে বললেন,
—” লুডু খেলবো, আসো।”
মামানির কথায় কিছুক্ষণ বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন মামু। ডানহাত দিয়ে চশমাটা ঠেলে দিয়ে বললেন,
—” তোমরা খেলো।”
আমি আদুরে গলায় বললাম,
—” মামু? চলো না খেলি। মজা হবে অনেক।”
মামু মৃদু হেসে বললেন,
—” তোরা খেল মা। আমি বই পড়ছি।”
—” প্লিজ মামু। প্লিজ…প্লিজ…।”
মামু কিছু বলার আগেই পাশ থেকে বলে উঠলেন শুভ্র ভাই,
—” আব্বু? আম্মু কিন্তু তোমায় ব্যাপক পঁচাচ্ছে। বলছে, তুমি নাকি সারাজীবন হেরে হেরে বুড়ো হয়েছো। আমি বলি নি, আম্মু বলেছে। আমিও নাকি তোমার মতো হেরে হেরেই বুড়ো হবো। আব্বু? এর প্রতিবাদ না করলে কিন্তু হচ্ছে না। গার্লস Vs বয়েজ খেলা হবে, মানসম্মানের ব্যাপার। চলে আসো….”
মামু খানিক ভাবলেন। মামানির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন। হাতের বইটা টি-টেবিলে রেখে মামানির পাশে ফ্লোরে এসে বসলেন। আবারও নতুন উদ্দ্যমে খেলা শুরু হলো। কিছুক্ষণের মাথায় শুভ্র ভাই আমার পর পর দুটো গুটি খেয়ে দিলেন। রাগে-দুঃখে লোকটাকে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করলো আমার। আমাকে রাগী চোখে তাকাতে দেখেই হেসে ফেললেন উনি। ঠোঁট কামড়ে হেসে ডান চোখটা টিপে দিয়ে আবারও খেলায় মনোযোগী হলেন। সাথে সাথেই মামানির একটা গুটি গিয়ে পড়লো মামুর হাতে। মামনী রাগে ফুঁসে ওঠে বললেন,
—” এটা চিটিং ছিলো। তুমি ভুল চাল দিয়েছো।”
মামু গম্ভীর গলায় বললেন,
—” একদম না।”
লেগে গেলো দু’জনের মাঝে যুদ্ধ। এই বয়সে এসেও মামু-মামানিকে বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করতে দেখে রাগ ভুলে হেসে ফেললাম আমি। শুভ্র ভাই আমার দিকে একটু চেপে এসে ফিসফিস করে বললেন,
—” আল্লাহ বাঁচিয়েছে….এদিক থেকে আব্বুর চেয়ে আমি লাকি।”
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। উনি আবারও হাসলেন। শেষমেশ মামানিই জয়ী হলেন, গুটিটা আগের জায়গায় রেখে আবারও চাল দিতে হলো মামুকে। কিন্তু শেষ রক্ষাটা আর হলো না। ঘুরেফিরে একটা ‘কানা’ কে পুঁজি করেই জিতে গেলেন শুভ্র ভাই আর মামু। মামানি রাগে কটমট করে মামুর দিকে তাকালেন। মামু ব্যাপারটাকে এড়িয়ে চলার জন্য বই নিয়ে বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলেন। শুভ্র ভাই হাসি চেপে বললেন,
—” ইট’স ওকে আম্মু। এরপরের বার তোমরা জিতবে, সিউর।”
মামানি ফুঁসে ওঠে বললেন,
—” একদম আম্মু ডাকবি না। বাপের চামচা কোথাকার।”
শুভ্র ভাই অবাক হয়ে বললেন,
—” আরে, আমি কি করলাম?”
—” কি করলি মানে? তুই আমার দুটো গুটি খাইছিস।”
আমি ঠোঁট উল্টিয়ে বললাম,
—” আমারটা ছয়বার খেয়েছে।”
শুভ্র ভাই হেসে ফেললেন। ঠোঁট চেপে হাসি কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে বললেন,
—” আম্মু? তুমি বাচ্চাদের মতো করছো কেন? খেলায় এক-দুটো গুটি খাওয়া কোনো ব্যাপার না।”
পাশ থেকে মামু বলে উঠলেন,
—” তোর মা এমনই করে। আগে হারলে রাতের রান্না বন্ধ করে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকতো।”
মামানি চেতে উঠে বললেন,
—” একদম চুপ। বাপ-ছেলে মিলে আমায় হেনস্তা করছো। আল্লাহ কেন আমাকে একটা মেয়ে দিলো না। তাহলে নিশ্চয় সে আমার সাইড হয়ে কথা বলতো। তুমিই সব নষ্টের গোড়া।”
মামু অবাক হয়ে বললো,
—” আরে… আমি কি করলাম?”
আমি একহাতে মামানিকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
—” ওদের ছাড়ো তো মামানি। ওরা সব চিট করেছে। নয়তো তোমার সাথে পাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। এইযে মামুর ছেলে? নিজের দোষটা স্বীকার করতে শিখুন। বুঝেছেন?”
মামানি আমার কথায় খুশি হয়ে বললেন,
—” একদম। নিজেদের দোষ স্বীকার করা শিখ নয়তো বিয়ে টিয়ের নাম ভুলে যা। ঘুরে-ফিরে তো আমার কাছেই আসবি। তখন বুঝাবো মজা, আমি নিজে ভাঞ্জি দিয়ে বিয়ে ভেঙে দিবো। হুহ… ”
শুভ্র ভাই হেসে ফেললেন। মামুর ঠোঁটেও মৃদু হাসি। শুভ্র ভাই হাত জোড় করে বললেন,
—” আদেশ শিরধার্য মাতা। সব দোষ আপনার স্বামীর…আমি স্বীকার করলাম।”
শুভ্র ভাইয়ের কথায় খিলখিল করে হেসে উঠলাম আমি। মামু অবাক চোখে শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালেন। মামানি হেসে ফেলে বললেন,
—” দিন দিন ফাজিল হচ্ছিস তুই।”
শুভ্র ভাই তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
—” চলো একটা ফ্যামিলি পিক তুলি আম্মু। অনেকদিন যাবৎ একসাথে বসা হয় না আমাদের। এটা একটা মেমোরি…. এই দিনে শেরপুরের মাইয়াদের হারিয়ে দিয়েছি আমরা। আহা! স্বর্ণালী ইতিহাস। এই জিতটাকে বাঁধায় করে রাখতেই হবে।”
কথাটা বলে নিজেই হেসে ফেললেন উনি। মামানি, মামু হাসিমুখে সোফায় গিয়ে বসলেন। শুভ্র ভাইয়ের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম,
—” আপনি থ্রী কোয়াটার প্যান্ট পড়ে ফ্যামিলি ফটো তুলবেন?”
—” তো?”
আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
—” কিছু না। আপনিও গিয়ে বসুন, আমি ছবি তুলে দিচ্ছি।”
উনি ফোনটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বললেন,
—“তুই কেনো তুলে দিবি?সর!”
উনার এমন কথায় বেশ অবাক হলাম আমি। মুখ ভার করে খানিকটা সরে দাঁড়ালাম। উনি ফোনে টাইমার সেট করে আমাকে টেনে নিয়ে মামানিদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠেলো। শুভ্র ভাই ফোনের কাছে গিয়ে বললেন,
—” পার্ফেক্ট ফ্যামিলি ফটো আম্মু। ওয়ান মোর…”
উনি আবারও টাইম সেট করে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। পাশে দাঁড়িয়েই আমার খোলে রাখা লম্বা চুলগুলো হালকা হাতে টানলেন। আমি চুলে হাত দিয়ে বিস্মিত চোখে উনার দিকে তাকালাম। উনি আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। আমি তাকাতেই চমৎকার একটা হাসি দিলেন। সাথে সাথেই জ্বলে উঠলো ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। আমি চুলগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
—” শুধু শুধু ছবিটা নষ্ট করলেন। বিরক্তিকর।”
—” নষ্ট হয় নি বরং দারুন এসেছে। দেখিস… ”
আমি মুখ বাঁকিয়ে মামানির পাশে গিয়ে বসলাম। শুভ্র ভাই আবারও ছুটলেন টাইমার সেট করতে।
___________________
হঠাৎ করেই ঘুম ছুটে গেলো আমার। চোখ পিটপিট করে চারপাশে তাকালাম। ঘরটা ঝাপসা অন্ধকার। শান্ত, শীতল পরিবেশ। বিছানা থেকে একটু দূরে ছোট্ট আলো জ্বলছে। সেই আলোতেই ফুটে উঠেছে অস্ফুট এক অবয়ব। ঘুম ভেঙেই এমন একটা দৃশ্য দেখে চমকে উঠলাম আমি। চোখ দুটো বোজে নিয়ে আবারও চোখ মেলে তাকালাম। ওই আলোমাখা অবয়বটা যে শুভ্র ভাই সেটাও বেশ বুঝতে পারলাম। আমি আর কিছু ভাবার আগেই মামনির কন্ঠ কানে এলো। তারস্বরে আমার নাম ধরে ডাকছেন উনি। দরজার কাছাকাছি এসে লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে আবারও ডেকে উঠলেন উনি। আমি কি ভেবে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলাম। শুভ্র ভাই তাড়াহুড়ো করে বললেন,
—” আস্তে আম্মু। ঘুমের মাঝে কেউ এতো জোরে ডাকে? চমকে উঠবে তো।”
—” ওহ্ খেয়াল ছিলো না। রোদু? এই রোদু?”
—” থাক না আম্মু। ঘুমোচ্ছে ঘুমোক। ডেকো না। আমি দাদুর রুমে চলে যাচ্ছি।”
—” ডাকবো না মানে? খায় নি তো রাতে। সেই সন্ধ্যায় ঘুমিয়ে পড়েছে। খেতে হবে না?”
—” খায় নি তো ঘুমুতে দিয়েছো কেন?”
—” আমি কি ঘুমুতে দিয়েছি নাকি? তোর ল্যাপটপে নাটক দেখছিলাম। ও বিছানায় শুয়ে ছিলো। কখন ঘুমিয়ে গিয়েছি বুঝতেই পারি নি। তখন ডাকি নি ভাবলাম খাওয়ার সময় ডাকবো।”
—” ঘুমিয়ে যখন পড়েছেই তখন থাক। একরাত না খেলে কিছু হবে না। এখন ডাকলে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকবে। সকালে এক প্লেটের জায়গায় দু’প্লেট খাইয়ে দিও। তাতেই হবে।”
মামানি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। উনার নিঃশ্বাসের শব্দ নিস্তব্ধ রুমের বাতাসে আঘাত হেনে খনিকের মাঝেই মিলিয়ে গেলো। ছোট্ট করে বললেন,
—” ঠিক আছে। তুই তাহলে তোর দাদুর রুমেই শুয়ে পড়িস…এবার খেতে আয়।”
—” হুম। যাচ্ছি। আব..শুনো আম্মু? মশারীটা কোথায়?”
মামানি বিস্মিত কন্ঠে বললেন,
—” মশারী দিয়ে কি হবে? তোকে তো মেরে কেটেও মাশারী টানাতে রাজি করানো যায় না, আজ হঠাৎ।”
—” আমাকে মশা কামড়ায় না কিন্তু….”
—” কিন্তু?”
—” না.. আসলে…এতো প্রশ্ন কেনো করছো মা? উত্তরটা দিয়ে দিলেই তো হয়। মশারি কোথায়?”
—” আলমারির কোন চিপাই আছে কে জানে? অনেক খুঁজতে হবে। কয়েল জ্বালিয়ে দে……তাহলে যাকে নিয়ে চিন্তা করছিস তাকেও মশা কামড়াবে না।”
শুভ্র ভাই কেশে উঠলেন। মামানি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
—” খেতে আয় জলদি।”
মামানী হয়তো রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। পায়ের শব্দগুলো ধীরে ধীরে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এলো। শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বিছানার দিকে এগিয়ে এলেন। আমি কোনোরকম দম আটকে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। বারবার মনে হচ্ছিল এই বুঝি ধরা পড়ে যাচ্ছি আমি। এই বুঝি কাপড় সরে গেলো শরীর থেকে। এই বুঝি ধরে ফেললেন সব চুরি। এতোসব চিন্তা নিয়ে ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকা ধীরে ধীরে দুষ্কর হয়ে উঠলো আমার জন্য। উনি জোড়ে একটা শ্বাস টেনে নিয়ে আমার মাথার পাশে বসলেন।
ঠিক সেই সময়েই আমার খোলা চুলগুলো নাকে-মুখে সুড়সুড়ি দিতে লাগলো আমায়। ইশ! কি একটা ঝামেলা। আচ্ছা? ঘুমের ভান ধরে চুল ঠিক করলে কি উনি বুঝে যাবেন? অনেক চিন্তা ভাবনা শেষে, চুলের সুড়সুড়িতে অতিষ্ঠ হয়ে ডানহাতে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুলাম আমি। আমি পাশ ফিরে শুয়ার দুই মিনিটের মাথায় চুলে টান অনুভব করলাম।
কি সাংঘাতিক ব্যাপার! শুভ্র ভাই কি আমার চুল ধরে টানছেন? কিন্তু কেনো? উনি কি বুঝে গেছেন আমি জেগে আছি? নাকি অন্য ব্যাপার? আমার ছোট্ট মাথায় এতো এতো টেনশন নিয়ে ছটফট করতে লাগলাম আমি। যতটুকু পারি চোখ খিঁচে পড়ে রইলাম। পাঁচ মিনিটের মাথায় চুলের টান কমে এলো। একটা গরম নিঃশ্বাস ক্রমান্বয়ে গাঢ় থেকে গাঢ় হয়ে পড়তে লাগলো আমার ঘাড়ে,গলায়। আরো একদফা চমকে উঠলাম আমি। এটা কি সত্যিই শুভ্র ভাই? নাকি কোনো ভূত,টূত কিছু একটা। নয়তো, শুভ্র ভাই এমন অদ্ভুত বিহেভ কেন করবেন?
আমার চিন্তার মাঝেই দূরে সরে গেলো সেই নিঃশ্বাস। গায়ে চাদরের মতো কিছু একটা অনুভব করলাম। অল্প একটু চোখ খুলে গায়ে জড়ানো বস্তুটির দিকে তাকালাম — কাঁথা। এই কাঁথাটা নেওয়ার জন্যই কি এতোটা কাছাকাছি এসেছিলো মানুষটা? মুহূর্তেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস খেলে গেলো মনে। মাথায় আর কপালে কারো ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে আবারও নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো আমার। চোখ মেলে খুব করে দেখতে ইচ্ছে করলো শুভ্র ভাইয়ের মুখ।
কিন্তু সে সুযোগ হলো না। প্রায় সাথে সাথেই রুমের আলো নিভিয়ে বেরিয়ে গেলেন উনি। ‘উনি চলে গেছেন!’ ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই লাফিয়ে উঠে বসলাম আমি। কাঁধে পড়ে থাকা লম্বা বিনুনিটা দেখেই অবাক হলাম। বিনুনির শেষ প্রান্তে ছেলেদের হাতে পড়ার ব্যান্ডগুলো বাঁধা দেখে প্রচন্ড হাসিও পেলো। বুকে একরাশ প্রশান্তি নিয়ে আবারও গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়। শরীর-মন চঞ্চল হয়ে উঠছে হঠাৎ। অসম্ভব ভালো লাগায় ছেয়ে যাচ্ছে চারপাশের আকাশ, বাতাস, গুমোট অন্ধকার….
#রোদবালিকা
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
[ পাঠকরা আমায় এতো এতো ভালোবাসে যে মনে হয় নিজের ভালোবাসার ঘটটাই উপুড় করে দিই তাদের উপর। তাদের ভালোবাসার টানে লিখলাম। আমার সময় হলে আমি নিজেই দিবো গল্প। আপনারা কেউ অপেক্ষা করে থাকবেন না প্লিজ।]