রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৩৯
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
__________________
ঘড়িতে চারটা বাজে। সারা ঘরময় পায়চারি করছি আমি। ঘুম, উপন্যাসের বই, ফেসবুক কোনো কিছুতেই মন বসানো যাচ্ছে না। কখনও চাপা রাগ তো কখনও চাপা কান্নায় নিজেকে অসহায় অসহায় লাগছে। কিছুক্ষণ ফ্লোরে পা ছড়িয়ে বসে থেকেই ভয়ানক সিদ্ধান্ত নিলাম আমি। নিজের রুম থেকে বেরিয়ে শুভ্র ভাইয়ের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে ফিসফিস করে ডাকলাম,
—–” শুভ্র ভাই? শুভ্র ভাই?”
শুভ্র ভাই একটু নড়ে চড়ে চোখ মেলতেই আৎকে উঠলেন। মোবাইলের ফ্ল্যাশে চোখ-মুখ কুঁচকে নিয়ে নিজের অবস্থান বুঝার চেষ্টা করলেন। হাত বাড়িয়ে আলো জ্বালিয়ে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালেন। উনি ধমক দেওয়ার আগেই থমথমে গলায় বলে উঠলাম আমি,
—–” তাসনিম ছাড়া আর ক’জন গার্লফ্রেন্ড ছিল বা আছে বলুন তো।”
উনি বিস্মিত চোখে তাকালেন। হঠাৎ করেই কোনো কথা খুঁজে পেলেন না। ডানহাতে নিজের চুলগুলো পেছন দিকে ঠেলে দিয়ে টি-শার্টের কলার ঠিক করলেন। আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলেন। বললেন,
—–” ইশ! ভীষণ জ্বলে না?”
উনার ত্যাড়াব্যাকা কথা শুনেই মেজাজ বিগড়ে গেল আমার। রাগী চোখে তাকিয়ে বললাম,
—–” যা বলেছি তার উত্তর দিন।”
উনি ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
—–” তোর জেনে লাভ?”
আমি রাগী চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। কটমটে গলায় বললাম,
—–” নাহ্ এক্চুয়েলি আপনি তো প্রেমিক পুরুষ তাই অনেক মেয়েই চান্স টান্স খুঁজে। আমি আবার খুবই দয়ামহ নারী….. নাহিদ ভাইয়া ম্যাসেজে বলছিল যে… “
এটুকু বলতেই জ্বলে উঠলেন শুভ্র ভাই। বিছানা থেকে নেমে খপ করে আমার হাত চেপে ধরে বললেন,
—–” নাহিদ তোর নাম্বার কই পেল?”
আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,
—–” তা জেনে আপনার লাভ?”
উনি আমর দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
—–” অনেক লাভ। এখন বল।”
আমি শক্ত গলায় বললাম,
—–” আপনার লাভ আপনার কাছে। আমার তো কোনো লাভ নেই। সো বলব না। হাত ছাড়ুন….. মামানি জেগে আছেন এখনও।”
উনি হাতটা সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরে বললেন,
—–” বাড়াবাড়ি করলে খুন করে দেব বলে দিলাম। স্পষ্ট এবং সহজ ভাষায় বলছি নাহিদকে আমার ভালো লাগে না। আমার ভালো লাগে না মানেই তোর জন্য নিষিদ্ধ। এটাকে স্বাধীনতা হরণ ভাবলে তাই। আমার ঘুম, জীবন সবকিছুই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিলি তুই। কিন্তু অন্যকারো নিদ্রাভঙ্গের কারণ হয়েছিস তো খবর আছে…..”
কথাটা বলে ধীরে সুস্থে আমাকে রুম থেকে বের করে দরজা লাগালেন উনি। রাগ আর অপমানে টলমলে চোখে রুমে ফিরে এলাম আমি। মনে মনে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। যায় হয়ে যাক না কেন, ‘এই লোকের সাথে কথা বলা চলবে না। কিছুতেই না।’
_______________________
মামুর বাসায় কাজের মেয়ের রুল প্লে করার আজ দ্বিতীয় দিন চলছে। সেই সাথে শুভ্র ভাইয়ের প্রতি বিরক্তিটাও হুহু করে বাড়ছে। আজাইরা হুকুম কাকে বলে? কত প্রকার? এবং কি কি? তা খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছেন শুভ্র ভাই। শুভ্র ভাইয়ের শোবার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। বারান্দার পাশ ঘেঁষে কয়েকটি ক্যাকটাস গাছ লাগানো। তার মধ্যে ‘রোজ ক্যাকটাস’ গাছে রক্তলাল ফুল ফুটেছে। ফুলটাকে দেখতে ভীষণ আদর আদর লাগছে। আমি দু’পা এগিয়ে ফুলটাকে ছুঁতে যাব ঠিক তখনই রুম থেকে তীক্ষ্ণ রিংটোনের শব্দ কানে এলো। রিংটোনের শব্দকে অনুসরণ করে রুমের ভেতরে উঁকি দিতেই বিছানায় শুভ্র ভাইয়ের ফোনটা পড়ে থাকতে দেখা গেল। আমি ভ্রু কুঁচকে এদিক ওদিক তাকালাম। ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার আওয়াজ আসছে। আমি উঁকিঝুঁকি দিতে দিতেই ফোনটা কেটে গেল। প্রায় সাথে সাথেই নতুন উদ্যমে আবারও বাজতে লাগল মুঠোফোন। আমি কৌতূহল নিয়ে এক-দু পা এগিয়ে গেলাম। ভ্রু কুঁচকে স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই আননোন একটা নাম্বার জ্বলজ্বল করে উঠল। ফোনটা আবার কেটে আবারও বাজতে লাগল। ডায়ালকারীর উদ্যম দেখে মনে হচ্ছে রিসিভ করার আগপর্যন্ত সে থামবে না। কিছুতেই না। আমি হাজারো দ্বিধা আর অস্বস্তি নিয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিলাম। রিসিভ করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে রিনরিনে কন্ঠে সালাম দিল একটি মেয়ে। আমি নার্ভাস গলায় সালামের জবাব দিয়ে জিগ্যেস করলাম,
—–” কে বলছেন?”
—–” আমি তাসনিম সিদ্দিকী। এটা আবরার আহমেদ শুভ্রর নাম্বার না?”
আমার কপাল কুঁচকে এলো। শক্ত গলায় বললাম,
—–” জ্বি। এটা উনারই নাম্বার।”
—–” তাহলে আপনি কে? শুভ্র কোথায়?”
——” আমাকে আপনি চিনবেন না। উনি একটু ব্যস্ত আছেন। আপনার কিছু বলার থাকলে আমায় বলতে পারেন। আমি উনাকে বলে দিব।”
—–” না। ঠিক আছে। ওর সাথে আমার নিতান্তই ব্যক্তিগত কথা ছিল। কিন্তু আপনি ওর কি হোন? বোন?”
মেয়েটা বেশ নম্রভাবে কথা বললেও রাগে মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল আমার। মেয়েটা ভুক্তভোগী, তার সাথে সহানুভূতির দৃষ্টিতে কথা বলা উচিত এসব মহান বাণী তখন নিতান্তই বিরক্তকর এবং অবান্তর বলে বোধ হতে লাগল। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললাম,
—–” আপনার তাই মনে হচ্ছে? “
—–” উহু। আমার অন্য কিছু মনে হচ্ছে। কিন্তু সেই মনে হওয়াটাকে পাত্তা দিতে চাইছি না। এই না চাওয়ার পেছনে কোনো কারণ নেই তবুও চাইছি না। আমার ধারণা আপনি বিশেষ কেউ।”
আমি হালকা হেসে বললাম,
—–” আপনার এমন কেন মনে হচ্ছে?”
—–” এইযে প্রথম থেকেই ‘উনি’ ‘উনি’ করে বলছেন। নিজের ভাইকে কেউ আপনি করে বলে না। আর আমি শুভ্রকে যতটুকু চিনি ওর পার্সোনাল জিনিসে হাত দেওয়ার সাহস সবার হয় না। কিন্তু আপনার মাঝে ভয় বা অস্বস্তির ছিটেফোঁটা নেই। তারমানে আপনি অবশ্যই এমন কেউ যাকে শুভ্র এসব বিষয়ে কোনো বাধা নিষেধ দেয় না।”
আমি কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বললাম,
—–” আপনি কিন্তু ভীষণ সুন্দরী। আপনি এতো সুন্দরী বলেই হয়ত আপনাকে আমার খুব একটা পছন্দ হয় না।”
মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসিমুখে বলল,
—–” কেন? সুন্দরী মেয়েরা বুঝি অপছন্দনীয় হয়?”
—–” না। তা হয় না। কিন্তু কিছু মানুষকে চাইলেও মন থেকে পছন্দ করা যায় না। আমার মনে হয় আপনি ওই ক্যাটাগরির মানুষ।”
তাসনিম জবাব না দিয়ে বলল,
—–” আপনিও ঠিক শুভ্রর মতোই মুখের ওপর বলে দেন সব। আচ্ছা? আমি যে সুন্দরী কিভাবে জানলেন? দেখেছেন কখন? শুভ্র দেখিয়েছে?”
—–” উহু। হসপিটালে দেখেছিলাম। উনি বলেছিলেন আপনি তার প্রাক্তন।”
তাসনিম কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বিস্ময় নিয়ে বলল,
—–” শুভ্রর পাশে বসে থাকা ওই পিচ্চিটা তুমি?”
আমি কিছু বললাম না। শুভ্র ভাই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। কপাল কুঁচকে বললেন,
—–” কার সাথে কথা বলিস?”
আমি ফোনটা এগিয়ে দিয়ে থমথমে গলায় বললাম,
—–” আপনার বাচ্চা কালের প্রেমিকা।”
আমার কথায় বেশ অবাক হলেন উনি। ফোনটা কানে নিয়ে ভরাট গলায় বললেন,
—–” হ্যালো? কে বলছেন?”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে হেসে উঠলেন উনি। ফোনটা সরিয়ে ঠোঁটের ইশারায় আমায় খাবার দিতে বলে আবারও ফোন কানে নিলেন। উনার এই গদগদে হাসি দেখেই রাগে উনার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলার অদম্য ইচ্ছে জাগতে লাগল আমার। পুরাতন প্রেমিকার সাথে এতো আনন্দে মত্ত হয়ে কে কথা বলে শুনি? সবক’টা একরকম। সুন্দরী মেয়ে দেখলে এরা দুনিয়া ভুলে যায়। নির্ঘাত এখন পুরনো প্রেম জেগে উঠবে তাদের। তারপর শুরু হবে আদিক্ষেতার দ্বিতীয় পর্যায়। কথাগুলো ভাবতেই নিজেকে ভীষণ অসহায় অনুভূতি হতে লাগল আমার। জীবনের কোনো একটা অংশ ধসে পড়ার সতর্কবার্তা যেন খিলখিল করে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে লাগল। আমি বিছানা থেকে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। ভঙ্গ মন নিয়ে শুনতে লাগলাম উনার প্রাণোচ্ছল কন্ঠস্বর,
—–” ওর অনেকগুলো নাম আছে। ওসবে কিছু মনে করো না। তোমাকে হয়ত তার ঠিক পছন্দ হয় নি। দেখা হলে ঠিক মিশবে….”
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/
[ বিঃদ্রঃ বিশাল বড় করে লিখতে চেয়েছিলাম কিন্তু সময়ের অভাবে লেখা হয়ে উঠল না। কাল দিলে হয়ত সম্পূর্ণ হত কিন্তু আপনাদের কথা দিয়েছিলাম বলে অর্ধেকই দিতে হলো।]