রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৫০
#লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
গ্রাম বাংলায় মেয়ের বাড়িতে শীতের পিঠা। গ্রীষ্মের আম, কাঁঠাল পাঠানোর একটা রীতি ছিল। রীতিটা এখন বিলুপ্তির পথে হলেও আমার বৃহৎ গোষ্ঠী তা আকঁড়ে ধরে আছেন খুব নিয়ম করে। বাবা ছোট থেকেই ছোট ভাই-বোনদের মাথায় বটগাছের মতো ছায়া দিয়ে আসছেন। ভাই-বোনের জীবনে বাবার ভূমিকা পালন করে আসছেন। ফুপ্পি-চাচ্চুরা সন্তান-সন্ততির বাবা-মা হয়ে যাওয়ার পরও বাবার এই সংযম, এই বটগাছের মতো আগলে রাখাটা হারিয়ে যায়নি। তাই এখনও মাকে হাঁড়ি হাঁড়ি পিঠা বানাতে দেখি।
আর সেই পিঠা ব্যাগ ভর্তি করে তিন ফুপ্পি আর দুই চাচ্চুর বাড়িতে চালান হতেও দেখি। সাথে থাকে বছরের যত ফলমূল, চিড়ামুড়ি। রীতি অনুযায়ী এবারও তাই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হলো না। হঠাৎ আম্মু অসুস্থ হয়ে পড়ায় এতো পিঠা বানানোর মতো ধৈর্য্য আর সাহস কোনোটাই আম্মুর জুটলো না। অভিমানী ফুপ্পিরা ছেলে-মেয়ে-স্বামী নিয়ে উঠলেন বাসায়।
দুই চাচ্চুকেও ফোন দিয়ে ঢেকে আনালেন ময়মনসিংহ। চরপাড়ায় আমাদের ছোট্ট বাসাটা এক দিনেই হয়ে উঠলো উৎসবমূখর আর জনাকীর্ণ। বাবা ফোন দিয়ে মামানিদেরও ডেকে পাঠালেন। ময়মনসিংহে থাকা কয়েকজন আত্মীয়র মাঝে নিমন্ত্রিত হলেন নাহিদ ভাইয়াদের পরিবার আর মিথি আপুর শশুর বাড়ির লোক। প্রত্যেক পরিবারেই হয়ত ননদ-ভাবির মধ্যে চাপা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বাড়ির বড় বউয়ের প্রতি সেই ক্ষোভ থাকে আরো জোড়াল।
আর নিরীহ বড় বউও থাকে ননদদের প্রতি খানিকটা ত্যক্ত, বিরক্ত। আর সেই বিরক্তির ভারটা খুব স্বাভাবিকভাবেই এসে গড়ায় বড় বউয়ের মেয়েদের চোখে-মুখে। এই সহজাত ধর্মটা ধরে রাখতেই হয়তো বাবা পাগল আমরা দুই বোনও খানিকটা বিরক্ত হলাম। বিক্ষিপ্ত মনটা ফুঁসফুঁস করে বলতে লাগল, আম্মুর অসুস্থতার খবরটা জানার পরও জাতি-গোষ্ঠী নিয়ে ঘুরতে আসার মানে কী? আম্মুকে শুধু শুধু হেনস্তা করা ছাড়া কী আর কোন কাজ নেই এদের? বাড়ির বড় বউ বলে কী মাথা ছিঁড়ে খেতে হবে? আশ্চর্য!’
তবে ফুপ্পিরা এবার আর কোনো ঝামেলা করলেন না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ফুপ্পি আর চাচিরা মিলে রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। মাকে খানিকটা নিস্তার দিয়ে নিজেরাই পিঠা বানাতে উদ্যোগী হলেন। বাসায় ছোট-বড় সবার মাঝে হৈ-হৈ শুরু হলো, আজ রাতে পিঠা উৎসব হবে। সব কাজিনরা একসাথে হতে পেরে এমনিতেই আমরা মহাখুশি। তারওপর পিঠা উৎসব? আহা! বেঁচে থাকতে আর কি চাই? বিকেল দিকে বাবা আর চাচ্চুরা মিলে ব্যাগ ভরে মাছ নিয়ে ফিরলেন। মা-চাচিদের টিটকারি আর ঠাট্টাকে কেন্দ্র করে বাবা আর চাচ্চু বসলেন মাছ কাটতে। আর আমার মতো ‘বেগুণ’ মানুষটিকে হতে হলো তাদের বিশেষ সহকারী।
বাবা-মেয়ে কোমর বেঁধে লেগে গেলাম ‘অসহ্য বস্ত’ অর্থাৎ মাছ কাটতে। আট-দশ মিনিট সময় নিয়ে একেকটা মাছ কেটেও চলছিল। কিন্তু বিপত্তি বাঁধল আধঘন্টা পর। বাসার মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে এসে দাঁড়াল দীর্ঘকায় এক পুরুষ। রান্না ঘরের কিনারা থেকে তাকে দেখতে পেয়েই বুকের ভেতর রক্ত ছলকে উঠল আমার। ছাই রঙের পুলওভার আর কালো টাওজার পরে দাঁড়িয়ে আছেন শুভ্র ভাই। দু’হাত টাওজারের পকেটে গুজা । চুলগুলো নিয়ম মেনে পড়ে আছে কপালে। খানিকটা শীর্ণ হয়ে আসা গাল ভর্তি ছোট ছোট মিষ্টি দাঁড়ির বাহার।
ঠোঁটের নিচের কালো তিলটা স্বাভাবিকের থেকে বেশি ঝলঝলে। আমার হৃদপিণ্ড হাজার স্পিডে ছুটতে লাগল। শুভ্র ভাই ফিরে এসেছেন। তারমানে উনার মাস্টার্সের পরীক্ষা শেষ? কি সর্বনাশ! কবে শেষ হলো? ইয়া মা’বুদ এখন কি হবে? শুভ্র ভাই কি মাছের মতো বটি দিয়ে কেটে-কুটে ব্রহ্মপুত্র নদে ভাসিয়ে দিবেন আমায়? আমার গলা শুকিয়ে এলো। শুভ্র ভাই উদ্বেগহীন পায়ে রান্না ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন। সবাই আমাদের ঘিরে মাছ কাটা দেখছিল। শুভ্র ভাই আমাদের দিকে একবার তাকিয়েই মামানিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘ আম্মু? বাসার চাবি তোমার কাছে রাখো। পরে আমায় খুঁজে পাবে না।’
‘ কেন? কোথায় যাবি? আজ অনেক ঠান্ডা পড়েছে। খবরদার জ্বর শরীর নিয়ে সন্ধ্যায় বেরুবি না।’
‘ কোথাও যাব না। আবার যেতেও পারি, ঠিক নেই। তুমি চাবিটা রাখো তো।’
মামানি গো ধরে বললেন,
‘ নিব না। চাবি নিলেই তুই এই ভর সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে চলে যাবি। বাইক নিয়ে টু টু করে ঘুরবি। আজ বাসার বাইরে যাওয়া বারণ।’
শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকালেন। বিরক্ত কন্ঠে বললেন,
‘ আচ্ছা, তাহলে থাকো। এখন আমাকে আরও খুঁজে পাবে না। কাল সকালের আগে বাসাতেই ফিরব না। তুমি আর তোমার বর ননদের বাসাতেই ঘুমাও। গুড নাইট।’
আমি শুভ্র ভাইয়ের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। উনি রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াতেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে কাঁপন ধরেছিল। সেই কাঁপন এখন চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছে। শুভ্র ভাইয়ের কথা-বার্তা শুনেই বুঝা যাচ্ছে তিনি ভয়ানক রেগে আছেন কিন্তু প্রকাশ করছেন না। মামানিও অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ছেলের জেদ সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা আছে তার। ভালোর সময় মহাভালো আর মেজাজ খারাপ হলেই বিশ্ব বেয়াদব। শুভ্র ভাইয়ের চিন্তায় বেখেয়ালি হয়ে পড়তেই আবারও এক সর্বনাশ ঘটে গেল। বটি দিয়ে ডান হাতের আঙ্গুল কেটে বলি হলো। ছাই আর মাছের আঁশ দিয়ে মাখামাখি হাত দিয়েই চেপে ধরলাম কাঁটা স্থান। মুহূর্তেই ভয়ানক রক্তপাত শুরু হলো। আমার রক্তে সমস্যা থাকায় রক্ত জমাট বাঁধতে সময় নেয়।
রক্তপাত অপেক্ষাকৃত বেশি হয়। এবারও হলো তাই। সবাই আমার হাত নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও শুভ্র ভাইয়ের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা দিল না। মামানির হাতে জোরপূর্বক চাবিটা ধরিয়ে দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। হাতের ব্যথা নাকি অভিমানের চাপে জানি না, তবে এতক্ষণে চোখ উপচে জল গড়াল। প্রচন্ড অভিমানে কিশোরী মনটা ফুঁসে উঠল। শুভ্র ভাই মামানির সাথে চোটপাট করে বেরিয়ে যাওয়ার ভয় দেখালেও কোথাও গেলেন না। বাসার এখানে সেখানে অদুদ-মিলাদ ভাইয়াদের সাথে আড্ডারত অবস্থাতেই দেখা গেল তাকে। সারাটা সময় এমন একটা ভাব নিয়ে থাকলেন যেন আমাকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। আমার উপস্থিতি তিনি বুঝতে পারছেন না।
আমার পরিকল্পনায় জল ঢেলে নিরুদ্ধেগ ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। আমার পরিবর্তে সে নিজেই আমাকে পুরোদস্তুর এড়িয়ে চলতে লাগলেন। অভিমানী মন বেশ কয়েকবার ফুঁসে উঠে বলল,’ এর থেকে ভয়ানক রাগ আর দু-একটা চড় থাপড়া কি বেশি ভালো ছিল না?’ বিক্ষিপ্ত মন পরমুহূর্তেই চিন্তা করে, ‘ যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে। চলুক না এড়িয়ে। আমিও এড়িয়ে চলব। কি দরকার শুধু শুধু ঝামেলায় জড়ানোর? ঝামেলা কেটে গেছে, বেশ হয়েছে।’ এভাবেই দুটানা আর মান-অভিমানে কেটে গেল পুরো সন্ধ্যা।
রাত আটটার দিকে যথারীতি ছাঁদে আড্ডা বসল। নাহিদ ভাইয়াদের সাথে সাথে মিথি আপু আর চয়ন ভাইয়াও আড্ডায় যোগ দিলেন। পিঠা সাপ্লাই করতে করতে ক্লান্ত আমি আর রাফিয়া আড্ডায় যুক্ত হলাম সবার পরে। দুই হাতে ভাঁপা আর পুলি পিঠার বাঁটি নিয়ে যখন ছাঁদে পৌঁছালাম তখন সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ছে টাইপ অবস্থা। আমরা পাটির ওপর বসতেই রাতুল ভাইয়া বললেন,
‘ আরে ধুর, চয়ন ভাই। আমারটা বাদ দিয়ে আলিফের কাহিনী শুনেন। আলিফ সেদিন নিব্বি গার্লফ্রেন্ড নিয়ে নদীর ওপারে গিয়েছিল। পার্কের ছাতা তো এখন আর নাই তাই বাধ্য হয়েই ঝোপঝাড়ের নিচে। সব ঠিকঠাক। প্রেম একদম জমে ঘি টাইপ অবস্থা। কিন্তু ঝামেলা হইলো অন্য জায়গায়। বাচ্চা মাইয়া। তোতাপাখির জীবন নিয়ে প্রেম করতে গিয়েছে। আমাদের আলিফ বোধহয় ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারেনি। গিয়েছে চুমু খেতে। চুমু খাওয়া তো দূর, মাইয়া চুমু খাওয়ার কথা শুনেই ভয়ে অজ্ঞান। আলিফ তো ভ্যাবাচ্যাকা। আমারে ফোন দিয়ে বলে, ভাই? কাহিনী তো একটা ঘটে গিয়েছে। এখন কি করি?’
রাতুল ভাইয়ার কথায় বিস্ময়ে মুখ চেপে ধরলাম আমি। শুভ্র ভাই আর চয়ন ভাইয়া হুহা করে হেসে উঠলেন। আপু মুখ চোখ কুঁচকে বলল,
‘ ছিঃ অশ্লীল। তোমরা এতো খারাপ? বোনদের সামনে এসব বলছ! লজ্জা করে না?’
আলিফ ভাইয়া রাতুল ভাইয়ের পিঠে ধুম করে একটা চড় বসিয়ে চোখ রাঙালেন। নিচু কন্ঠে বললেন, ‘ শালা! কথা সামলায় বলতে পারিস না? যেখানে সেখানে ছেড়ে দেস।’ রাতুল ভাই দাঁত কেলিয়ে বললেন, ‘ আমার আর তোর বোন সেইম। শালা বলে লাভ নেই।’ আলিফ ভাই দাঁতে দাঁতে চেপে বললেন, ‘হারামি! খাড়াও, তোমারটা লাইভ টেলিকাস্ট করব।’ অদুত ভাই জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব নিয়ে বললেন,
‘ এই রুহি? তোরে না বলছি? ভাইয়েরা যখন কথা বলবে তখন চোখ-কান-নাক-মুখ সব বন্ধ করে রাখবি? এতো ফাজিল তোরা? ভাইদের ফুঁসফাস কথা শুনে ফেলিস।’
‘ তোমরা বলো কেন? না বললেই তো শুনি না। আমি ফুপ্পিকে বলব দাঁড়াও।’
‘ আমিও বলব।’
‘ কি বলবা? কি বলবা শুনি?’
শুভ্র ভাই এবার ধমকে উঠে বললেন,
‘ তোরা দুইটা চুপ করবি নাকি ঠাডায় দুইটা লাগাব? এই ঠান্ডায় কি তোদের ঝগড়া শোনার জন্য বসে আছি?’
শুভ্র ভাইয়ের ধমকে কেউ আর কথা বাড়াল না। এতোক্ষণ চুপ থাকা নাহিদ ভাইয়া প্রসঙ্গ পাল্টালেন। উচ্ছল কন্ঠে বললেন,
‘ পিচ্চি? তোমাকে আজ বড় বড় লাগছে। পিচ্চি নামটা বেশিদিন টিকবে বলে মনে হচ্ছে না।’
নাহিদ ভাইয়ার কথায় দপ করে জ্বলে উঠলেন শুভ্র ভাই। সামনে রাখা পিঠার প্লেটটা সম্পূর্ণ নিজের কোলে তুলে নিয়ে চুপ করে বসে রইলেন। ভাবসাব এমন, আরেকটা কথা বললেই পিঠা ছুঁড়ে মারব তোর মাথায়। আমি নাহিদ ভাইয়ার কথায় মৃদু হাসলাম। বললাম,
‘ আর কত পিচ্চি থাকব? বড় হয়ে গিয়েছি না? কয়েকদিন পর অর্নাস স্টুডেন্ট হবো।’
নাঈম ভাইয়া উৎসাহ নিয়ে বললেন,
‘ তোমাকে দেখতে অনেকটা আমার ফ্রেন্ড তিন্নির মতো লাগে। প্রথম দিন দেখে ভেবেছিলাম তুমি তিন্নির ছোট বোন।’
নাঈম ভাইয়ের কথায় সহজ হয়ে গেলেন শুভ্র ভাই। বুঝলাম, শুভ্র ভাইয়ের নির্দিষ্ট নাহিদ ভাইয়া ব্যতিত অন্য কাউকে নিয়ে তেমন সমস্যা নেই। শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘ তোমার ফ্রেন্ড তিন্নিকে হয়ত আমি চিনি। চট্টগ্রাম গিয়েছিলে না একবার? তিন্নিও ছিল সাথে।’
নাঈম ভাইয়া হেসে বললেন,
‘ ও তোমার অ্যাডমায়ারার। ভীষণ রকম ক্রাশড ছিলো। এই লকডাউনে বিয়ে হয়ে গেল বাচারীর। দাওয়াতও পেলাম না। তোমার সাথে বিয়ে হলে এটলিস্ট দাওয়াতটা পেতাম। ধুর!’
শুভ্র ভাই হেসে ফেললেন। আলিফ ভাইয়া উচ্ছ্বাসিত কন্ঠে বললেন,
‘ নাঈম ভাই? তোমাদের ক্যাম্পাসের মাইয়াগুলোরে সামলাও কেমনে? জাহাঙ্গীরনগরের মেয়েদের এতো তেজ। বাপরে বাপ! আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড ছিল ওখানের। দুই বছর সিনিয়র গার্লফ্রেন্ড। জীবনটা ত্যানাত্যানা করে দিয়ে লাস্ট ইয়ার ব্রেকআপ করে দিয়েছে। সিনিয়র গার্লফ্রেন্ডগুলো মাস্টার্নী টাইপ হয় তবু সিনিয়রই ভাল্লাগে।’
নাঈম ভাই হেসে বললেন,
‘ নাম কি? কততম ব্যাচ? কোন ডিপার্টমেন্ট?’
আলিফ ভাইয়া বিরস কন্ঠে বললেন,
‘ তোমাদের ইকোনমিক্স ডিপার্মেন্টেরই। এবার অর্নাস শেষ করল।’
‘ ওহ্।’
‘ জুনিয়র বয়ফ্রেন্ডগুলো একটু আলাভোলা হয়। আমাকে এক জুনিয়র প্রপোজ করেছিল। দেখতে হেব্বি কিউট। ভেবেছিলাম কয়েকদিন ভাব নিয়ে একসেপ্টটা করেই নেব। এমন টাইমে তোদের ভাইয়া কোথা থেকে টপকে এসে বিয়ে করে ফেলল। আমার আর জুনিয়রের সাথে প্রেম করা হলো না। কষ্ট!’
মিথি আপুর কথায় চোখ বড় বড় করে তাকালেন চয়ন ভাইয়া। শুভ্র ভাইয়া ফোঁড়ন কেটে বললেন,
‘ চয়ন ভাই তোরে বিয়ে করে উদ্ধার করেছে বইন। এখন এইসব আজাইরা কথা বললেও জাতি বিশ্বাস করবে না।’
রাফিয়া লাফিয়ে উঠে বলল,
‘ আহ! আমিও তাহলে জুনিয়রের সাথে প্রেম করব। এক্সপিরিয়েন্স থাকা ভালো।’
রাতুল ভাই মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন,
‘ একটা থাপড়া দিয়ে শশুর বাড়ি ফালাই দিয়ে আসব। বেদ্দপের আছাড়ি। বড় ভাইয়ের সামনে প্রেমের কথা কস। আম্মারে কইতাছি খাঁড়া। তোরে বিদেয় না করে শান্তি নাই।’
আমি ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,
‘ আমিই বোধহয় একমাত্র বালিকা যে প্রেম করলে সিনিয়র সিটিজেনের সাথেই প্রেম করতে ইচ্ছুক। জুনিয়রকে বিয়ে করলে দেখা যাবে, বিয়ের পর পোলা “আপু আপু”ডেকে মুখের ফ্যানা তুলে ফেলছে। বাচ্চারা বাপের দেখাদেখি আন্টি ডাকছে। কি সাংঘাতিক!’
আমার কথায় হেসে ফেলল সবাই। শুভ্র ভাই বাঁকা হেসে বললেন,
‘ হু। তাই তো করবি। সিনিয়র বিয়ে করে বিয়ের পর বরকে ভাইয়া ডেকে নিহত করে দেওয়ার পরিকল্পনা তোর। বুঝি, সবই বুঝি। ভয়ানক মহিলা।’
আমি কন্ঠে ঝাঁঝ নিয়ে বললাম,
‘ ডাকলে ডাকব, তাতে আপনার কি? আমার বর। আমি যা ইচ্ছে তাই ডাকব। আপনার কোনো সমস্যা?’
‘ অনেক সমস্যা। নিউ জেনারেশন মানেই হলো দেশের ভবিষ্যৎ। তুই ভাই ডেকে দেশের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে ফেলবি আর আমি চুপ করে বসে থাকব তা তো হয় না। হাজার হলেও আমি একজন সচেতন নাগরিক। তোর মতো পুচকিকে ভাই ভাই করে চেঁচিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করতে দিতে পারি না।’
আমি হতভম্ব চোখে তাকালাম। বিস্ময় নিয়ে বললাম,
‘ আমি ভাই ডাকলে দেশের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে যাবে? আপনি আমার ভাই ডাকার সাথে দেশের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে ফেলছেন?’
শুভ্র ভাই অত্যন্ত স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
‘ হ্যাঁ ফেলছি। তোর বাপ তো বহুত ধুরন্ধর ব্যক্তি। মাইয়াকে তো বিশিষ্ট পন্ডিত ছাড়া বিয়ে-শাদি দিবেন না। তুই তো তোর বাপের থেকেও ধুরন্ধর। দেখা গেল বিয়ের রাতে তুই তোর বিশিষ্ট পন্ডিত বরকে বারবার ‘ভাইয়া’ ডেকে নিহত করে ফেললি। তখন কি হবে জানিস? তখন এই দেশ একজন বিশিষ্ট পন্ডিত হারাবে। দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। পৃথিবী থেকে একজন বিশুদ্ধ মানুষের প্রাণ নাশ হয়ে যাবে। আহা! আমি কী এই ভয়ানক অন্যায় আদৌ মেনে নিতে পারি?’
শুভ্র ভাইয়ের যুক্তিতে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম আমি। একটা মানুষ কতটা ফালতু হলে এমন অদ্ভুত যুক্তি দিতে পারে তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। চারপাশে সবাই হাসতে হাসতে পাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। আমি নাক-মুখ ফুলিয়ে বললাম,
‘ আপনি না মানতে পারলে সেটা আপনার নিজস্ব সমস্যা। আমি তো ভাই-ই ডাকব। শুধু বরকে নয়। অতি শীঘ্রই একটা প্রেম করব। প্রেমিক পুরুষকেও ভাইয়া ডেকে নিহত করে ফেলব। দেশের ভবিষ্যৎ-এ অমাবস্যা লাগলে লাগুক।’
আমার কথাটুকু শেষ হতেই লাফিয়ে উঠলেন আলিফ ভাইয়া। খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন,
‘ এই না হলে বোনের মতো কথা। রোদু? আমার না বহুত দিনের শখ তোর প্রেম করা দেখব। তুই শুধু একবার হ্যাঁ বল। দরকার পড়লে বাড়ির সামনে ছেলেদের লাইন লাগিয়ে দেব। তা না-হলে টাকা দিয়ে বয়ফ্রেন্ড ভাড়া করে আনব, কোনো সমস্যা নেই। তবুও তুই প্রেম কর। আমি আশেপাশের আবহাওয়াটা একটু দেখতে চাই। নিউটনের তৃতীয় সূত্র মোতাবেক, প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে। আমি তোর প্রেমের বিপরীত প্রতিক্রিয়াটা দেখতে চাই। ‘
কথাটা বলেই শুভ্র ভাইয়ের দিকে আড়চোখে তাকালেন আলিফ ভাইয়া। দাঁত বের করে বললেন,
‘ শুভ্র ভাইও হেল্প করবে। তাই না ভাই?’
শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
‘ হু। অবশ্যই। ফুপি যখন জানবে তার বাচ্চা মেয়েটাকে প্রেম নামক অশ্লীল পথে হাঁটার প্ররোচনা দিয়েছিস তুই তখন তাঁর বিপরীত প্রতিক্রিয়া কি হবে সেটা দেখারই মারাত্মক শখ জাগছে আমার। ক্যারি অন। আমি আমার একমাত্র ফুপ্পিকে এক ডজন ঝুড়ি গিফ্ট করে সাহায্য করব।’
আলিফ ভাইয়া অসহায় মুখে তাকালেন। মৃদু কন্ঠে বললেন,
‘ কল্পনায় প্রতিক্রিয়া দেখা হয়ে গিয়েছে। বোন তুই প্রেমটেম করিস না। প্রেম করা মহাপাপ।’
কথাটা বলে থামলেন। তারপর আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন,
‘ তবে লুকিয়ে করতে পারিস। লুকিয়ে করলে পাপ হয় না।’
আলিফ ভাইয়ের কথায় আবারও হেসে উঠল সবাই। আড্ডা শেষ হলো দশটায়। নিচ থেকে খাবারের ডাক পড়েছে। খাবারের ডাক পেয়েই হুরমুর করে নিচে নেমে গেলেন সবাই। শুভ্র ভাই চুপচাপ পাটির ওপর বসে রইলেন। বিন্দুমাত্র নড়লেন না। কেউ জিগ্যেস করতেই বললেন, ‘একটু দরকার আছে। তোমরা যাও। আমি আসছি।’ সবাই বিদায় নিলেও থেকে গেলাম আমি আর নাহিদ ভাইয়া। আমার এক পাটি জুতো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেল? এখানেই তো ছিল! নাহিদ ভাইয়া বললেন,
‘ কী খুঁজছ পিচ্চি? নিচে যাবে না?’
‘ জুতো খুঁজে পাচ্ছি না।’
‘ আচ্ছা। আমি হেল্প করছি। এখানেই থাকার কথা।’
শুভ্র ভাই এবার উঠে দাঁড়ালেন। পকেটে হাত ঢুকিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ালেন। কৃত্রিম হাসি নিয়ে বললেন,
‘ তুমি যাও নাহিদ। সবাই হয়তো খুঁজছে তোমায়। আমি জুতো খুঁজে দিচ্ছি। আমাদের দেরী হলেও সমস্যা নেই।’
শুভ্র ভাইয়ের কথায় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সতর্ক হয়ে উঠল আমার। এই জুতো হারানোর ব্যাপারটা নির্ঘাত শুভ্র ভাইয়ের ইচ্ছেকৃত কাজ। এখন আমায় একা পেয়ে ইচ্ছেমতো পিটাবে নিশ্চয়? আমার গলা শুকিয়ে গেল। তাড়াহুড়ো করে বললাম,
‘ কি দরকার? আপনি নিচে যান শুভ্র ভাই। আমি আর নাহিদ ভাইয়া জুতো নিয়ে আসছি।’
শুভ্র ভাই ধমক দিয়ে বললেন,
‘ মেহমানকে দিয়ে জুতো খুঁজাবি তুই? দেব এক চড়। নাহিদ তুমি যাও।’
নাহিদ ভাইয়া হাসার চেষ্টা করে বললেন,
‘ ইট’স ওকে। আমার সমস্যা নেই।’
শুভ্র ভাই থমথমে কন্ঠে বললেন,
‘ তোমার না থাকলেও আমার আছে। আই মিন, ফুপ্পি মেহমানদের বিষয়ে একটু বেশি সেনসেটিভ। তোমাকে নিচে না দেখলে হয়ত উল্টো রোদকে বকাঝকা করবে। তারথেকে বরং নিচে যাও। আমরা খুঁজে নেব।’
নাহিদ ভাইয়া সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালেন। একবার আমার তো আরেকবার শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন,
‘ আর ইউ শিওর?’
শুভ্র ভাইয়া ভারি বিরক্ত কন্ঠে বললেন,
‘ হান্ড্রেড পার্সেন্ট!’
নাহিদ ভাইয়া অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিচে নেমে গেলেন। আমি অসহায় চোখে তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। নাহিদ ভাই চলে যেতেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল ছাঁদের পরিবেশ। সেই নিস্তব্ধ, ছমছমে পরিবেশে আমি একা এক অভাগা কিশোরী আর সামনে দাঁড়ানো সুঠাম, সুপুরুষ দৈত্য। শুভ্র ভাই একপর্যায়ে হালকা শিষ দিয়ে সরে দাঁড়ালেন। আমি শিষের সুরে চমকে তাকালাম। সাথে সাথেই লেবু গাছের টব থেকে উঁকি দিল আমার হারিয়ে যাওয়া দূর্ভাগা স্যান্ডেল। স্যান্ডেলটা দেখে আমার কেঁদে দেওয়ার অবস্থা। শুভ্র ভাই তাহলে কাজটা ইচ্ছে করেই করেছেন। লেবু গাছের মাথায় তখন জমাট বাঁধা অন্ধকার। চারপাশে সাদা সাদা কুয়াশার কুন্ডলীতে ফিকে হয়ে এসেছে বৈদ্যুতিক বাল্বের লালচে আলো। আমি ভয়ে ভয়ে লেবু গাছের কাছে গিয়ে জুতোটা উদ্ধার করতেই পেছনে এসে দাঁড়ালেন শুভ্র ভাই।
আমি লেবু গাছের পাশে রেলিং-এ পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার সামনে, কিছুটা তফাৎ-এ পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শুভ্র ভাই। মুখভঙ্গি থমথমে। চোখদুটো ঈষৎ লাল। কঠিন দৃষ্টি আমার মুখের উপর স্থির। উনার কঠিন দৃষ্টি দেখেই ঘাম ছুটে গেল আমার। ঢোক গিলে রেলিং-এর ওপাশে নিচের দিকে তাকালাম। অস্থির মন গননা করতে লাগল, ‘আচ্ছা? দুই তলার ছাঁদ থেকে পড়ে গেলে কি মানুষ মরে যায়? মরে না বোধহয়। আবার মরতেও পারে। কাউকে দুইতলা থেকে পড়ে গিয়ে দৌঁড়াতে তো দেখিনি। চোখের দেখায় বড় দেখা। প্রমাণহীন গননা চলে না। নৈব নৈব চ।’ মনের যুক্তিতর্কে পারদর্শী অংশ বলল, ‘ তাহলে কি দুই তলা থেকে পড়ে গিয়ে তৎক্ষনাৎ মরতে দেখেছিস কখনও?’ তাও ঠিক।
এমনও কাউকে দেখা হয়নি। দুই পাশেই যুক্তি জবরদস্ত। সুতরাং গননা বা জরিপ সম্ভব নয়। এইসব আজগুবি চিন্তা করতে করতেই আবারও আড়চোখে তাকালাম আমি। শুভ্র ভাই আগের থেকেও কুটিল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। ফর্সা চেহারায় রক্তবর্ণ চোখদুটো ভয়ানক দেখাচ্ছে। শুভ্র ভাই এক পা এগিয়ে এলেন। সাথে সাথেই হাত পায়ে কাঁপন ছুঁটে গেল আমার। শুভ্র ভাই আমাকে আগাগোড়া নিরক্ষণ করে মাত্রাতিরিক্ত শীতল কণ্ঠে বললেন,
‘ ভয় লাগে?’
আমি জবাব দিলাম না। শুভ্র ভাই আরেকটু এগিয়ে এলেন। ভয়ে আমার হাত-পা অবশ হওয়ার উপক্রম। মুখে অসংখ্যবার চড়-থাপ্পড় মারলেও বাস্তবে খুব একটা চড়-থাপ্পড় মারেননি তিনি। এক বা দুইবারের বেশি তো নয়ই। কিন্তু এবার বোধহয় রেকর্ড ভঙ্গ হবেই হবে। একবারে দশ বারোটা থাপ্পড় মেরে তবেই থামবে। শুভ্র ভাই থাপ্পড় মারলেন না৷ ঝুঁকে এসে আমার দুই পাশে রেলিং-এ হাত রাখলেন। আমি অস্থির হয়ে বললাম,
‘ আল্লাহ! দেখুন। সরুন জলদি। কেউ এভাবে দেখে ফেললে কেলেংকারী হয়ে যাবে। আম্মু খুন করে ফেলবে আমায়। প্লিজ সরুন।’
শুভ্র ভাইয়ের মধ্যে কোনো ভাবাবেগ দেখা গেল না। শান্ত চোখ মেলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি আবারও অনুরোধ করলাম,
‘ প্লিজ। হাত জোর করছি, যেতে দিন। বাড়ি ভরা মানুষ। কেউ দেখলে তিল থেকে তাল বানিয়ে ফেলবে।’
‘ আর যদি তালই দেখে?’
উনার শান্ত কন্ঠে কেঁপে উঠলাম আমি। হৃদপিণ্ডের গতি ধীর হয়ে গেল। সারা শরীর অবশ লাগছে। মাথা ঝিমঝিম করছে। কান্নায় গলা আটকে আসছে। এসব দেখলে আম্মু নির্ঘাত কেটে কুঁচিকুঁচি করে ফেলবে আমায়। ফুপ্পি, চাচিমণিরা কত কথা শোনাবে আল্লাহ মালুম। আমি দুর্বল কন্ঠে বললাম,
‘ আমি কিন্তু আম্মুকে বলে দেব। যার জিনিস তার কাছেই পৌঁছেছে। এতে এতো রিয়েক্ট করার কি হলো?’
শুভ্র ভাইয়ের চোয়াল শক্ত হলো। রাগে ফর্সা গালে গোলাপি আভা ফুটলো। পরমুহূর্তেই বাঁকা হেসে সুর তুলে বললেন,
‘ রোদ মানেই সুন্দর কিছু! তারপর কি যেন? ওহ হ্যাঁ।
“বালিকা তুই ভুল করিয়া
খুলিসনে তোর চুল
না হয় আমি নয়ন জুড়িয়ে
করতে পারি ভুল
নয়ন জুড়ানো রেশমি চুলে
হৃদয় ছুঁয়ে যায়
আদর করে দিবো তোকে
আমার স্বপ্নে আয়।” ‘
আমি আবারও ঢোক গিললাম। যতদূর মনে পড়ছে, এই লাইনগুলো নাহিদ ভাইয়া তার কমেন্টে লিখেছিলেন। একটা আমার কভার ফটোতে। অন্যটি প্রোফাইল পিকচারে। প্রোফাইল পিকচারের কমেন্টে কবিতাটা লিখে নিচে লিখেছিলেন,’ তোমার ছবিটা দেখে এই কবিতাটা মাথায় এলো। কিছু মনে করো না। ভীষণ মিষ্টি লাগছে।’ আর যতদূর মনে পড়ছে আমার প্রোফাইল আমি সাথে সাথেই অনলি মি করেছি এবং কমেন্টটাও প্রায় সাথে সাথেই ডিলিট করেছি। তাহলে এই কবিতাটা শুভ্র ভাই দেখলেন কিভাবে? আশ্চর্য! আমি চোখ খিঁচে বন্ধ করে দোয়া আওড়াতে লাগলাম। বিপদের দোয়া,’ ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন, আল্লাহুম্মা আজিরনি ফি মুসিবাতি ওয়া আখলিফ-লি খাইরাম মিনহা।’ শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে অদ্ভুত কন্ঠে বললেন,
‘ অন্যকারো স্বপ্নে ঢুকার আকাঙ্খা জেগে গেলে পুরোনো জিনিস, পুরোনো মানুষ কিছুই ভালো লাগার কথা নয়। আর না তার মান-অপমানের খেয়াল থাকার কথা। তাই না?’
আমি চট করে চোখ মেলে তাকালাম। টেনশনে সারা শরীর ঝিমঝিম করছে আমার। ছাঁদের দরজাটা সটান খোলা। যে কেউ, যেকোনো মুহূর্তে ছাঁদে আসতে পারে। আর আমাদের এই অবস্থায় দেখলে….। আমি আর ভাবতে পারছি না। মৃদু কন্ঠে বললাম,
‘ সরুন। কেউ আসলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।’
শুভ্র ভাই শক্ত কন্ঠে বললেন,
‘ আই ডোন্ট কেয়ার।’
ঠিক তখনই সিঁড়িতে কারো পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। আমি আর্তনাদ করে উঠে বললাম,
‘ প্লিজ সরুন। কেউ আসছে। আম্মু খুন করে ফেলবে আমায়।’
শুভ্র ভাই সরলেন না। আমি চোখ খিঁচে বন্ধ করলাম। রুদ্ধ কন্ঠে দোয়া আওড়াতে লাগলাম। সিঁড়ি ঘরের দরজা থেকে বিস্মিত মেজো চাচিমণির কন্ঠ ভেসে এলো,
‘ রোদ-শুভ্র? এখানে কি করছ? নিচে সবাই খাচ্ছে।’
আমি চোখ মেলে তাকালাম। শুভ্র ভাই আমার থেকে অনেক তফাৎ-এ দাঁড়িয়ে আছেন। দুইহাতে তিনটা লেবু। শুভ্র ভাই চাচিমণির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। বললেন,
‘ লেবু গাছে ব্যাপক লেবু ধরেছে এবার। আমার ফুপ্পি লাগিয়েছে বলে কথা! আপনি নিশ্চয় আমাদের ডাকতে এসেছেন আন্টি?’
চাচিমণি কিছু বলার আগেই শুভ্র ভাই আমাকে ইশারা করে অত্যন্ত বিরক্ত কন্ঠে বললেন,
‘ আম্মু এই বলদকে লেবু নিতে পাঠিয়েছিল। এসেছে আর খোঁজ নেই। তাই বাধ্য হয়ে আমাকেও পাঠাল। এসে দেখি কাটা হাত নিয়ে লেবু টানাটানি করছে মাত্র। একটাও ছিঁড়তে পারেনি। আপনাদের এই বলদ মেয়ের শশুরঘর জুটবে না আন্টি।’
শুভ্র ভাইয়ের কথায় হেসে ফেললেন চাচিমণি। হাসিমুখেই বললেন,
‘ তোমাদের ডাকতে আসিনি। ছাঁদে বিকালে একটা চাঁদর শুকোতে দিয়েছিলাম। রাফিয়াকে নিতে বলেছিলাম, সে নাকি ভুলে গিয়েছে। যেটুকু শুকিয়েছিল এই অকর্মা মেয়ের জন্য সেটুকুও কুয়াশায় ভিজল বোধহয়।’
শুভ্র ভাই তাড়াহুড়ো করে বললেন,
‘ ওহ্। আপনি দাঁড়ান। আমি এনে দিচ্ছি। আপনার এত্তোবড় ছেলে থাকতে আপনাকে কেন আনতে হবে?’
চাচিমণিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ছাঁদের অন্য কিনারায় গিয়ে চাঁদর এনে দিলেন শুভ্র ভাই। শুভ্র ভাইয়ের ভদ্রতায় চাচিমণির চোখ-মুখ চিকচিক করছে। চাঁদরটা হাতে নিয়ে খুশিতে ঝলমল কন্ঠে বললেন,
‘ কি লক্ষ্মী ছেলে! তোমার মা লাখে একটা ছেলে জন্ম দিয়েছে। এই রোদু? ভাই থেকে কিছু শিখতে পারো না তোমরা? সারাদিন খালি ঢিং ঢিং করে ঘুরো।’
আমি জবাব দিলাম না। চাচিমণির মুখে ‘ভাই’ শব্দটা শুনেই কেশে উঠলেন শুভ্র ভাই। তারপর মৃদু হেসে চাচিমণিকে বিদায় দিলেন। আর আমরা যে খুব শীঘ্রই নিচে আসছি সেটাও জানালেন। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। শুভ্র ভাই মুহূর্তেই আগের রূপে ফিরে এলেন। আগের মতোই চোখ-মুখ শক্ত, লাল। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
‘ নয়ন জুড়ানো রেশমি চুল আর আদর আদর খেলার হায়াৎ ফুরিয়ে এসেছে রোদপাখি। এই কয় বছরে আমাকে ঠিকঠাক চিনে উঠতে পারোনি তুমি। এবার চিনবে।’
কথাটা বলেই দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেলেন। আমি মোহাচ্ছন্নের মতো ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। কি থেকে কি হয়ে গেল! আগেই রাগের পাল্লা ভারী ছিল তারপর যুক্ত হলো নাহিদ ভাইয়া নিয়ে ভুল বোঝাবোঝির বহর। আমি দুই হাতে মুখ চেপে নিচে বসে পড়লাম। শুভ্র ভাইয়ের এই শান্ত ধমকির ফলশ্রুতি যে কি হতে পারে, জানি নেই। অতো ভাবতেও পারছি না। শরীর-মাথা কিচ্ছু চলছে না। সবকিছু অসহ্য থেকে অসহ্য লাগছে। কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থাকার পর ফোনে কথা বলতে বলতে ছাঁদে এলেন নাহিদ ভাইয়া। আমাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে ফোন কেটে জিগ্যেস করলেন,
‘ তুমি এভাবে বসে আছ কেন? ঠান্ডা লাগছে না?’
আমি চট করে উঠে দাঁড়ালাম। একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম,
‘ না। আপনি থাকুন। আমি নিচে যাচ্ছি।’
নাহিদ ভাইয়া হাসলেন। ‘আচ্ছা’ বলেও ফট করে প্রশ্ন করলেন,
‘ শুভ্রর সাথে ঝামেলা হয়েছে নাকি?’
আমি চমকে তাকালাম। বললাম,
‘ জি? উনার সাথে ঝামেলা কেন হবে?’
‘ আমার মনে হয়েছিল শুভ্র তোমার প্রতি কিছুটা হিংস্র অনুভূতি পোষণ করে।’
আমি থতমত খেয়ে বললাম,
‘ হিংস্র অনুভূতি মানে? তেমন কিছু নয়। উনার কাজিনের মাঝে আমি সবার ছোট তো। আর চঞ্চলও বেশি। তাই একটু বকাঝকা বেশি করে। এছাড়া কিছু নয়।’
‘ বকল নাকি?’
আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম,
‘ না তো। আপনি নিচে যাবেন? আম্মু বোধহয় আমায় খুঁজছে। আমি নিচে যাব।’
নাহিদ ভাইয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘ আমিও যাব। চলো।
আমরা একসাথেই নিচে নেমে এলাম। নাহিদ ভাইয়া বিনাবাক্যে ডাইনিং স্পেসের দিকে চলে গেলেন আর আমাকে বসার ঘরে আটকে দিলেন আম্মু। আমি তখনও জানতাম না এরপরের গল্পটুকু ঠিক সুখকর হবে না। বসার ঘরে তখন কেউই নেই। আম্মু শীতল কন্ঠে জিগ্যেস করলেন,
‘ কোথায় ছিলি?’
আমি হাসিমুখেই বললাম,
‘ ছাঁদে।’
‘ কার সাথে?’
এবার আমার একটু খটকা লাগল। আমি আম্মুর চোখের দিকে তাকিয়ে ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করলাম। আম্মু একপা এগিয়ে এসে রাগ থমথমে অথচ নিচু স্বরে বললেন,
‘ নাহিদই কি সেই ছেলে? ওর সাথেই সম্পর্কে জড়িয়েছিস তুই?’
আম্মুর প্রশ্নে হতবাক হয়ে গেলাম আমি। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থেকে বললাম,
‘ কি বলছ মা? ছাঁদে আমি একা ছিলাম। নাহিদ ভাইয়া তো…’
এটুকু বলতেই দানবীয় এক চড় এসে পড়ল আমার গালে। আমি হতভম্ব হয়ে পড়লাম। আকস্মিক এই আক্রমণ, এই অপমানে কাঁদতেও ভুলে গেলাম। চড়ের শব্দ সবার দৃষ্টি তখন আমার উপর। ঘরভর্তি মানুষের সামনে এতোবড় মেয়ের গায়ে হাত তোলার মতো মানুষ আম্মু নন। তাহলে আজ হঠাৎ এই রণচণ্ডী রূপ কেন? অপমান আর লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারছি না আমি। এই মুহূর্তে দুনিয়াদারি ছেড়ে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে বহুদূরে। এর থেকে মরণটাই কি ভালো ছিল না? আমি আড়চোখে একবার শুধু শুভ্র ভাইয়ের মুখের দিকে তাকালাম। উনার ফর্সা মুখটা খানিক ফ্যাকাশে লাগল কি? সবসময় সবরকম পরিস্থিতিতে আগলে রাখা সেই মানুষটি আজ এগিয়ে এলো না। ছুটে এলো মামানি। আমাকে শক্ত করে জাপটে ধরে আম্মুর দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
‘ খবরদার গায়ে হাত দিবে না। এতোবড় মেয়ের গায়ে হাত তুলো কি করে তুমি, অরি? হাত কাঁপলো না।’
আম্মু জবাব না দিয়ে রক্তিম চোখে তাকিয়ে থাকেন আমার মুখে। রাগ, লজ্জা, অপমান আর ক্ষোভে শরীর তখন মৃদুমন্দ কাঁপছে। শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। মামানি তপ্ত কন্ঠে বললেন,
‘ পেটে ধরলেই শুধু মা হয়ে যায় না অরি। রোদ আমারও মেয়ে। তোমার থেকে কম ভালোবাসি না আমি। আমার মেয়ের গায়ে যখন তখন, এক ঘরভর্তি মানুষের মাঝে হাত তুলবে না। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি। ও আজ আমার সাথেই থাকবে।’
আম্মু এবারও জবাব দিলেন না। মামানি আমাকে এক হাতে বুকে আগলে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে এলেন। যেতে যেতে মামুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘ বোনকে ঠিকঠাক শাসন করলে আজ এতোবড় মেয়ের গায়ে হাত তুলতে পারত না। বোনকে তো কোনোদিন শাসন করতে দেখলাম না।’
মামু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মৃদু গলায় ধমক দিলেন আম্মুকে। আমার গায়ে হাত তোলার কারণটা সবার মনে আস্ত একটা রহস্য হিসেবে থেকে গেল। মামুদের বাসায় এসে, নিজের রুমে ঢোকার পর, কান্নায় ভেঙে পড়লাম আমি। মামানি কিছুক্ষণ আমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাশে বসে রইলেন। আমি কাঁথায় চোখ-মুখ ঢেকে নিরবে চোখের জল ফেলতে লাগলাম। প্রায় ঘন্টাখানেক পর শুভ্র ভাই ফিরলেন বাসায়। তখন বোধহয় বারোটা কি সাড়ে বারোটা বাজে। মামানিকে ডেকে চাপাস্বরে জিগ্যেস করলেন,
‘ রোদু ঘুমিয়ে পড়েছে?’
মামানি ক্ষোভ নিয়ে বললেন,
‘ কেন? রাগ পোষানো এখনও বাকি আছে?’
শুভ্র ভাই অসহায় কন্ঠে বললেন,
‘ আমি কি করলাম?’
‘ জানো না কি করেছ? অরিকে কি বলেছ তুমি? আমি খুব ভালো করে জানি সবকিছুর পেছনে তোমার হাত আছে।’
‘ আমি তেমন কিছুই বলিনি আম্মু। আর যতটুকু বলেছি তাতে ফুপ্পির এতোটা রিয়েক্ট করারও কথা ছিল না। বেশি হলে একটু বকাঝকা করত, ব্যস।’
‘ আমি তোমাকে পেটে ধরেছি। খুব ভালো করে চিনি তোমায়। তোমার এসব জেদ আর রাগের জন্য একদিন অনেক বেশি সাফার করতে হবে। এখনও সময় আছে শুধরে যাও।’
শুভ্র ভাই ক্লান্ত কন্ঠে বললেন,
‘ আম্মু প্লিজ! তোমার সাথে তর্ক করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে এখন নেই। শরীরটা ভালো লাগছে না। মিথ্যা আশা রেখো না, আমি শুধরাতে পারব বলেও মনে হয় না। তবে আজ আমি শান্ত আছি। রাগ,জেদ সবই কন্ট্রোল করেছি। নয়তো তোমার আদরের রাজকন্যার কপালে শনি ছিল।’
‘ ছোটবেলা থেকে তো তাই করছিস। মেয়েটাকে এতো জ্বালাস কেন তুই? ছোট থেকে জ্বালাচ্ছিস।’
‘ তোমার শুধু আমার দোষ চোখে পড়ে। ওর দোষ চোখে পড়ে না? তুমি এই মেয়েকে যতটা পবিত্র আর অবুঝ ভাবছ সে ততটা নয়। ফাজিলের হাড্ডি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে থাপড়াইয়া ঠিক করে ফেলি।’
‘ কি বললি?’
‘ কিছুই বলিনি। বাবা রুমে একা। নিশ্চয় তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। গো টু ইউর রুম এন্ড এট্যান্ড ইউর হাজবেন্ড। এখানের থেকে ওখানে তোমার প্রয়োজন বেশি।’
মামানি হয়ত শুভ্র ভাইয়ের বাহুতে থাপ্পড় লাগালেন ‘চটাস’ এক শব্দ হলো। তারপর মিষ্টি শাসনের কন্ঠে বললেন,
‘ অসভ্য! মায়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?’
শুভ্র ভাই হেসে বললেন,
‘ ধুর! কিসের মা? তুমি তো আমার বান্ধবী। তোমাকে আজ থেকে রেনু আপা বলে ডাকব।’
‘ ফাজিল! একটা থাপ্পড় দেব। দিন দিন ফাজিল হচ্ছিস। সবসময় ফাজলামো। বের হ রুম থেকে। আমি আজ রোদের সাথেই থাকব। তোকে আমি বিশ্বাস করি না।’
‘ এইতো মায়েদের মতো ব্যবহার করা শুরু করলে। তুমি নিজেও খুব ভালো করে জানো যে, তোমার এই ‘উরে এসে জুড়ে বসা’ মেয়ের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হবে এমন কিছুই করব না আমি।’
‘ সারাদিনই তো ক্ষতি করছিস।’
‘ উফ! আম্মু যাও তো।’
মামানি চলে যেতেই ধীর পায়ে বিছানায় এসে বসলেন শুভ্র ভাই। এতকিছুর পর আমার উচিত প্রচন্ড রাগে ফেটে পড়া। কিন্তু অদ্ভুতভাবে আমার রাগ লাগছে না। শুভ্র ভাই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আলতো হাতে আমার মুখ থেকে কাঁথা সরিয়ে কপালের ওপর হাত রাখলেন। সাথে সাথেই সারা শরীর শিউরে উঠল আমার। শুভ্র ভাইয়ের শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। এতো জ্বর নিয়ে বিছানায় শুয়ে আবোল তাবোল বকার কথা কিন্তু সে একদম ফিট। শুভ্র ভাই খুব সাবধানে আমার চোখের সামনে হাত নাড়লেন। আমি ঘুমের ভাব ধরে পড়ে থাকার যথেষ্ট চেষ্টা চালালাম। আমি ঘুমিয়ে গিয়েছি বিষয়টি স্পষ্ট হতেই শুভ্র ভাইয়ের ঠোঁট দুটো নেমে এলো আমার গালে, কপালে। কেঁটে যাওয়া ডানহাতটায় আলতো আদর করে মৃদুস্বরে বললেন,
‘ সরি!’
আমি এবার নড়েচড়ে উঠে চোখ মেলে তাকালাম। শুভ্র ভাই বেশ অপ্রস্তুত হলেন কিন্তু হাত ছেড়ে দিলেন না। হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
‘ না খেয়ে পাবদা মাছের মতো শুয়ে আছিস কেন? না খেয়ে থেকে প্রমাণ করতে চাইছিস, আমাদের বাসায় তোকে যত্ন-আত্তি করা হয় না?’
আমি জবাব নিয়ে দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে রইলাম। শুভ্র ভাই ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘ আশ্চর্য! আমি এদিকে বসে আছি, তুই ওদিকে কাকে দেখছিস? এদিকে তাকা।’
আমি আগের মতোই চুপচাপ শুয়ে রইলাম। শুভ্র ভাই আমার জবাবের ধার ধারলেন না। হুট করেই আমাকে পাঁজা কোলে নিয়ে দরজার দিকে হাঁটা দিলেন। আমি আৎকে উঠলাম। চিৎকার করতে গিয়েও থেমে গেলাম। চাপা কন্ঠে বললাম,
‘ হচ্ছেটা কি? নামান বলছি। আমি কিন্তু মামানিকে ডাকব।’
শুভ্র ভাইয়ের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। দরজার বাইরে উঁকি দিয়ে চারপাশটা দেখে নিয়ে সোজা বসার রুমে গিয়ে থামলেন। আমাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ বাসায় রান্নাবান্না হয়নি আজ। বল, কি খাবি?’
আমার বিস্মিত চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,
‘ কম সময়ে একটা খাবারই রান্না সম্ভব, নুডুলস। নুডুলসই চলবে? নুডুলসই খা। পেট ভরলেই হলো।’
আমি মৃদুস্বরে বললাম,
‘ আপনার শরীরে অনেক জ্বর।’
শুভ্র ভাই যেন শুনেও শুনলেন না। আমাকে বসিয়ে দিয়ে সোজা রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। আমি সোফার উপর চুপচাপ বসে রইলাম। ব্যালকণির দরজা লাগানো। জানালাগুলোতেও পর্দা টানা। বাইরের কোন শব্দই ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে পারছে না৷ চারদিকে ঝিম ধরা নীরবতা। বসার ঘরে টিমটিম করে অল্প আলো জ্বলছে। নীল রঙের আলো। সেই আলোতেই সামনের দেয়ালটা চোখে পড়ল।
দেয়ালে বেশকিছু ছবি লাগানো হয়েছে। যতটুকু মনে পড়ে এর আগেরবার যখন এসেছিলাম তখন দেয়ালটাতে কিছু প্যাইনটিং ছিল, ছবি ছিল না। আমি উঠে গিয়ে দেয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেয়ালের মাঝ বরাবর মামানি আর মামুর বাঁধাই করা হাস্যোজ্জল ছবি। সেই ছবিকে কেন্দ্র করে চারদিকে ফ্রেমেবন্দী আরও কিছু মুহূর্তে। একটি ছবিতে স্বাস্থ্যবান একটি বাচ্চা দন্তহীন হাসছে। হাতে তার লাল বল। কপালে কাজলে আঁকা নজর ফোঁটা। বাচ্চাটাকে দেখেই কোলে তুলে নিতে ইচ্ছে করছে আমার। তার মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে হাত বাড়িয়ে দিলেই ঝাঁপিয়ে কোলে উঠে আসবে সে। ইশ! কি মিস্টি। তার ওপরের ছবিটি কিশোর বয়সী এক ছেলের। স্নিগ্ধ মুখ জুড়ে দুষ্ট হাসি।
ঠোঁটের নিচে, থুতনিতে কালো কুচকুচে একটি তিল। গায়ে সাদা টি-শার্টের ওপর চেইক শার্ট। তারউপরে যুবক শুভ্র ভাইয়ের টি-শার্ট পরা একটা ছবি। গম্ভীর, সুন্দর চোখদুটোতে কালো সানগ্লাস। চারপাশে সবুজ গাছপালার বহর। সেই গাছপালার মাঝে দুই হাত কোমরে রেখে দাঁত বের করে হাসছেন উনি। আশ্চর্য সুন্দর সেই হাসি। তারপাশের ছবিটিতে নীল পাঞ্জাবি পরা শুভ্র ভাই। এই ছবিটাতে গম্ভীর, পরিপূর্ণ পুরুষ লাগছে তাকে। সুঠাম শরীর।
ফর্সা মুখে ছোট ছোট দাঁড়ির আভাস। গভীর চোখদুটো ডানহাতের ওপর নিবদ্ধ। ভীষণ মনোযোগে হাতের ঘড়ি ঠিক করছেন তিনি। তারপাশে শুভ্র ভাইয়ের গত জন্মদিনে তোলা মামানি আর শুভ্র ভাইয়ের ছবি। তারপাশে সেইদিনের তোলা ছবিটা। যেখানে শুভ্র ভাইয়ের হাতে বন্ধী আমার একগোছা চুল। আর আমার চোখে বন্ধী শুভ্র ভাইয়ের হাস্যোজ্জল মুখ। আমি বিস্মিত চোখে ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। শুভ্র ভাইয়ের কথাটা সত্যি। ছবিটি আসলেই অসম্ভব সুন্দর।
‘ এভাবে দেখার মত কি আছে এতে? যাকে দেখার তাকে তো দেখিস না।’
শুভ্র ভাইয়ের কথায় চমকে তাকালাম আমি। ছবি দেখতে মগ্ন হয়ে পড়ায় শুভ্র ভাইয়ের উপস্থিতি টের পাইনি এতক্ষণ। শুভ্র ভাইয়ের দিকে একবার তাকিয়েই বাচ্চা শুভ্রর দিকে তাকালাম। ছবিটিকে ইশারা করে বললাম,
‘ এই মিষ্টি বাচ্চাটাকে কোলে নিতে ইচ্ছে করছে আমার। এতো কিউট কেন হবে একটা বাচ্চা! এই পুচকুকে ছবি থেকে বের করে আনা যায় না কোনোভাবে?’
শুভ্র ভাই হেসে ফেলে বললেন,
‘ আনা যায়। তবে এভাবে নয় অন্যভাবে।’
আমি বুঝতে না পেরে বললাম,
‘ জি?’
‘ কিছু না।’
আমি আরেকটা ছবি দেখিয়ে বললাম,
‘ এই দুষ্টু ছেলেটার প্রেমে পড়ে গিয়েছি আমি। ড্রেস আপ সেন্স কি চমৎকার। তারওপর ওই হাসিটা!’
শুভ্র ভাই ঠিক ওভাবেই হাসলেন। ঘাড়ে হাত ঘষতে ঘষতে বললেন,
‘ খাবি চল। অলমোস্ট একটা বাজে। ঘুম পাচ্ছে আমার। জলদি খেয়ে উদ্ধার কর। তোর বাপ যে হিটলার। দেখা যাবে, তোকে না খাইয়ে রাখার অপরাধে আমার নামে মামলা টামলা ঠুকে দিয়েছে।’
আমি সোফার দিকে এগিয়ে যেতেই শুভ্র ভাই বললেন,
‘ আমি এখন রুমে যাব। হালকা পাতলা কাজ আছে রুমে। তুই এখানে একা বসে খেতে পারবি? নয়ত আমার রুমে বসে খেতে পারিস। শর্ত একটায়, খাওয়া শেষ করেই উত্তর দক্ষিণ না দেখে বেরিয়ে যাবি। আমার ঘরে রাতের বেলা মহিলা মানুষ এলাউড নয়। চরিত্র খারাপ হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।’
আমি একবার ভাবলাম এখানেই থাকি কিন্তু পরমুহূর্তেই চারপাশের থমথমে পরিবেশে খানিকটা ভয় করতে লাগল। আবার ভাবলাম, খাব না। খাবারটা রেখেই ঘুমিয়ে পড়ব। খেতে ইচ্ছে করছে না। তারপর আবার মনে হলো, শীতের রাতে এই ঘুমন্ত শহরটাতে, একলা জেগে একশো তিন ডিগ্রি জ্বর নিয়ে যে মানুষটি আমার জন্য রান্না করলেন। তার খাবারটা ফেলে রাখা বড্ড নির্দয়ের মতো কাজ হবে। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার পিছু পিছু তার রুমের দিকে হাঁটা দিলাম। শুভ্র ভাই রুমে ঢুকেই আলো জ্বালালেন। উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠল চারপাশ। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানার ওপর বসলেন। ল্যাপটপটা কোলে নিয়ে ক্লান্ত কন্ঠে বললেন,
‘ খেয়ে নে দ্রুত।’
আমি টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটাতে বসলাম। শুভ্র ভাইয়ের রুমটা নতুন লাগছে। কোথায় যেন কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে। আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে পরিবর্তনটা ধরতে চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণ পরই বুঝতে পারলাম আসবাবপত্রগুলো এদিক-সেদিক করা হয়েছে। বিছানার ওপর আর বুক সেল্ফের পাশে বেশকিছু ছবি লাগানো হয়েছে। আমি অবাক হয়ে খেয়াল করলাম ছবিগুলোতে আমার আর মামানির ছবির প্রাধান্যই বেশি। আমাকে ছবির দিকে ‘হা’ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধমকে উঠলেন শুভ্র ভাই,
‘ ওই বেআক্কল মাইয়া? তুই কি কোনোভাবে আমার রুমে থেকে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছিস নাকি? এমন কিছু ভেবে থাকলে ভুলে যা। আমি আমার রুমে কাউকে এলাউ করব না।’
‘ আপনার রুমে কেন থাকব? আমার কি থাকার জায়গার অভাব হয়েছে?’
কথাটা বলে আবারও আড়চোখে ছবিগুলোর দিকে তাকালাম। শুভ্র ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন। ছবিগুলোকে ইশারা করে বললেন,
‘ বারবার এদিক-ওদিক তাকাবি না। ওসব আমার ব্যক্তিগত জিনিস। তুই বোধহয় আমার রুম থেকে যেতে চাইছিস না। তাই না-খেয়ে তব্দা মেরে বসে আছিস। দে আমি খাইয়ে দিই।’
শুভ্র ভাই আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমার সামনে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসলেন। হাতের প্লেটটা নিজের হাতে টেনে নিয়ে বললেন, ‘হা কর।’ আমি অন্যদিকে তাকিয়ে খাবার মুখে নিলাম। শুভ্র ভাই তার তপ্ত হাত দিয়ে আমার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন,
‘ যতক্ষণ খাবি ততক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকবি। চোখ অন্যদিকে সরিয়েছিস তো কেটে বস্তা ভরে বহ্মপুত্রে ফেলে আসব। এবার আমি সিরিয়াস।’
শুভ্র ভাইয়ের শক্তপোক্ত কথায় অন্যদিকে তাকানোর সাহস আর হয়ে উঠল না আমার। অস্বস্তি নিয়েই শুভ্র ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে হলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরই বুকের ভেতর থাকা অনুভূতিগুলো উথাল-পাতাল ঢেউ তুলতে লাগল। হঠাৎ-ই আমি বাম হাতটা তার কপালে রেখে জ্বর পরীক্ষা করতে উদ্যত হলাম। শুভ্র ভাই চোখ বোজলেন। আমি আৎকে উঠে বললাম,
‘ আপনার গায়ে অনেক বেশি জ্বর। তবুও এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন? আমাকে খাইয়ে দিতে হবে না। আমি…’
আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েই শুভ্র ভাই মৃদু হেসে আবৃত্তি করলেন,
‘ প্রিয় জ্বর আর কিছুদিন থাকো
অন্তত এই বাহানায় আর কিছুদিন সে আসুক।
আমার কপাল হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে
সে যদি আমার ভিতরের অসুখ বুঝতে পারে!
যদি সে বুঝতে পারে আমার চোখে কতটা অসুখ
তাকে চোখের দেখা দেখতে চেয়ে।
যদি সে বুঝতে পারে আমার হাতে কতটা অসুখ,
তার হাতের আঙ্গুল ধরতে চেয়ে।
প্রিয় জ্বর আর কিছুদিন থাকো,
অন্তত এই বাহানায় আর কিছুদিন তাকে দেখি।
তার দু’চোখ হাতের আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে,
আমার না বলা অসুখ যদি তাকে বলতে পারি।
—-রুদ্র গোস্বামী ‘
আমি মুগ্ধ চোখে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। অনুভূতির উথাল পাতাল যন্ত্রণায় হঠাৎ অদ্ভুত এক কাজ করে বসলাম। জীবনের প্রথম নিজে থেকে উনার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম। উনি চমকে উঠলেন। হতভম্ব চোখে চেয়ে রইলেন। চমকালাম আমিও। লজ্জা, সংকোচ আর অস্বস্তিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম। শুভ্র ভাই আগের মতোই বজ্রাহতের মত বসে রইলেন। আমি দরজার দিকে দৌঁড় লাগাতেই ডানহাত ধরে আটকে ফেললেন তিনি। ততক্ষণে লজ্জা আর ভয়ে মরে যাওয়ার দশা আমার।
শুভ্র ভাই কোন কথা বললেন না। আমিও ফিরে তাকালাম না। তিনি আমার হাতে ঠান্ডা, শক্ত কিছু একটা ধরিয়ে দিয়ে হাত ছেড়ে দিলেন। আমি এক দৌড়ে নিজের ঘরে এসে দরজা দিলাম। হৃদপিণ্ড তখন ভয়ানক গতিতে ছুটছে। ছি! কি করে ফেললাম আমি? কেন করলাম? কিভাবে যাব এবার উনার সামনে? দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই হাতের মুঠো খুলে দেখলাম একটা চাবি। চাবি? এই চাবি দিয়ে কি হবে? তাছাড়া এর তালায় বা কোথায়? আমি আকাশ-পাতাল চিন্তা করতে করতে চাবিটা উল্টেপাল্টে দেখলাম। আচ্ছা? এই ঘরে থাকা আসবাবগুলোতে এই চাবি খাটে কিনা তা খুঁজে দেখলে কেমন হয়? এই ঘরটাতে চাবি সংক্রান্ত দুটো আসবাব আছে।
একটি কাঠের শোকেস। আরেকটা মাঝারি আকারের আলমারি। আমি শোকেসের তালায় বেশ কয়েকবার চাবি ঘুরালাম, কাজ হলো না। তবে আলমারির তালায় চাবি দিতেই খুলে গেল তার পাল্লা। পাল্লাটা খুলে ভেতরে তাকিয়েই অবাক হলাম আমি। শুভ্র ভাইকে ফিরিয়ে দেওয়া জিনিসগুলো খুব যত্ন করে গুছানো। সুপ্ত মনটা খুশিতে নেচে উঠল। প্রত্যেকটা জিনিস উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতেই চুড়ির বাক্সটা চোখে পড়ল। বাক্সর ঢালা ভাঙা। ভেতরের সব চুরি ভেঙে টুকরো। সেখানে হলুদে রঙের ছোট্ট এক চিরকুট,
‘ রাগ করে ভেঙে ফেলেছি তোমার শখের চুড়ি। নতুন কিনেও এনেছি আবার। তবে, সেগুলো সেদিনই পাবে যেদিন আমার বুকের কালো মেঘটা সরিয়ে রোদ ছড়াতে পারবে। এবার একটু রোদ হয়ে নামো প্লিজ। তোমার উষ্ণতার অপেক্ষায় আমি ক্লান্ত।’
প্রিয় জিনিসগুলোর নিচে সেই নতুন চুড়ির বক্সটাও পাওয়া গেল। সেইসাথে পাওয়া গেল নতুন নীল শাড়ি। মিষ্টি দেখতে লাল টুকটুকে একটি পুতুল। তারপাশেই যত্নে রাখা একটি ডায়েরি। ডায়েরির গায়ে লাল সুতো দিয়ে বাঁধা এক চিঠি। আমি চিঠিটা নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলাম। সেখানে চিরপরিচিত অক্ষরে লেখা,
‘ শ্যামলতা,
তুমি ঠিক কবে এবং কখন চিঠিটা পড়বে জানি না। তবে সেই সময়টা নিশ্চয় বিশেষ কোনো সময় হবে। কেননা, কোনো বিশেষ সময় ব্যতিত এই গুপ্ত অনুভূতির চাবির সন্ধান তুমি পাবে না। পাওয়ার কথাও নয়। আমি পেতে দেব না। আমি যেদিন অনেক বেশি খুশি হবো। কষ্ট, অবহেলা, রাগ, অভিমানকে ছাপিয়ে দিয়ে তোমার দেওয়া সুখে ভাসব ঠিক সেদিনই এই চাবি হাতে পাবে তুমি। নয়তো না।
আমাকে এই বিশেষ অনুভূতিটা দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ রোদপাখি। তোমার তৃষ্ণায় আকন্ঠ ডুবিয়ে এই মহমান্বিত পানীয় খুবই প্রয়োজন ছিল। তুমি নাহয় চিরকালই এমন নিষ্ঠুর, উদাস থেকো। আমাকে প্রচন্ড তৃষ্ণায় ছটফট করিয়ে হঠাৎ একটু তৃষ্ণা মিটিও। এই এক ফোঁটা পানীয়ের জন্য লক্ষ বছরের তৃষ্ণা, ক্লান্তি আমি মাথা পেতে নেব।
ইতি..
আমি ‘
চিঠিটা হাতে নিয়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম আমি। বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। চোখে ভর করল এক রাজ্য ঘুম। মনের কোথাও বয়ে বেড়াতে লাগল অকল্পনীয় সুখ। অতৃপ্ত তৃষ্ণা!
#রোদবালিকা
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/