#ক্যামেলিয়া পর্ব ৯
#সাদিয়া_খান (সুবাসিনী)
#পর্ব ৯
(২৪)
কাজী অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে জাফরিন শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে ইউভানের হাত।দীর্ঘ পাঁচ বছর যাবত এই দিনটার অপেক্ষা করেছে সে। যেদিন সে প্রথমে বুঝতে শিখেছে মা-বাবা কিংবা আপন জনের ভালোবাসা ছাড়াও অন্য আরো একটি ভালোবাসার সম্পর্ক হয় সেদিন থেকেই সে এই দিনটির অপেক্ষায় ছিল।
কাজী অফিসের ভিতরে প্রবেশ করেই দেখতে পেলো সেখানে কনে বেশে বসে আছে মোনালী।তার দু হাত ভর্তি রয়েছে মেহেদীর আলপনা। প্রথমেই মোনালী যেদিকে তাকালো সেটা হলো ইউভানের হাতের দিকে। হুট করেই মনে হলো শরৎের আকাশে মেঘ জমেছে। যে কোনো সময় হবে বৃষ্টি। তার নিজের মন খারাপ কে লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে সে তাকালো ইউভানের হাতের দিকে।
যে হাত আবদ্ধ রয়েছে জাফরিনের হাতে। হাত ছাড়িয়ে নিয়ে জাফরিন তার দিকে গিয়ে বলল,
“আমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে এবার তবে তোমরা বিয়ে করে নিচ্ছো।”
অনিচ্ছাকৃত ভাবে হেসে মোনালী হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো। জাফরিন খুশিতে তাকে জড়িয়ে ধরে রইল।বেশ সময়। এর ফাকে ইউভান প্রয়োজনীয় কাজ সেরে এসে তাদের পাশে বসে বলল,
“এবার তবে কাজ শেষ করা যাক?”
মোনালী হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো। ঠিক সেই মুহুর্তে তার ফোন বেজে উঠেছে। কল রিসিভ করে নিঃশব্দে কিছু সময় পার করলো সে। নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে যেতে যেতে সে বলল,
“আমার পক্ষে এই বিয়ে করা সম্ভব নয় ইউভান।আমি জানি আজকের পর থেকে হয়তো তুমি কখনো আমার মুখ দেখতে চাইবে না কিন্তু আমার কোনো উপায় নেই।আমি তোমার জন্য কনে বেশে এখানে বসে ছিলাম পুরো পরিবার এবং বাবার মতের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমি পারলাম না আমার পঁচিশ বছরের পিছুটান রেখে তোমার হাত ধরতে। আমার বাবার কান্না যে আমি সহ্য করতে পারছি না। পারলে আমায় মাফ করো তুমি।”
ইউভান নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল।সে যেন জানতো যে এমন কিছুই হতে চলেছে৷ কিন্তু জাফরিন নিজেকে স্থির রাখতে পারলো না।সে মোনালীর হাত ধরে বলল,
“আপু আমরা সবাই মিলে একটা ব্যবস্থা ঠিক করে ফেলবো।এই ভাবে সব কিছু শেষ করে দেওয়া ঠিক নয়।”
মোনালী কিছু না বলে জাফরিনের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে।পিছনে ফেলে গেল তার দীর্ঘ পাঁচ বছরের প্রতিশ্রুতি, ভালোবাসা এবং এক জীবনের স্বপ্ন।
গাড়িতে বসে জাফরিন ইউভানের দিকে তাকিয়ে রইল।ইউভান আপন মনে ড্রাইভিং করতে ব্যস্ত। শহরের ভিতরে ইতিমধ্যে প্রবেশ করেছে তারা। রাস্তায় সিগন্যালে গাড়ি দাঁড়াতেই জাফরিনকে পানি কিনে দিলো সে।এক বাচ্চার থেকে হাওয়াই মিঠাই ও নিলো।সেসব হাতে নিয়ে জাফরিন ইউভানের উদ্দেশ্যে বলল,
“ভাইয়া তোমার কান্না পেলে তুমি কাঁদতে পারো।”
“কেন?”
” আপুর চলে যাওয়াতে তোমার কষ্ট হচ্ছে আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু কী বলবো?”
জাফরিনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ইউভান।মেয়েটার হাতে থাকা হাওয়াই মিঠাইয়ের প্যাকেট খুলে দিয়ে বলল,
“আমাদের সমাজ বড্ড খারাপ সমাজ। জানিস তো?এখানে প্রেমিক ব্যতীত অন্য কেউ একজন মেয়ের জন্য ফুল কিনতে পারে, এটা এই সমাজ মেনেই নেয় না।একজন মানুষ যখন ফুলের দোকানে, কিংবা রাস্তায় কোনো ফুল কিনে তখন ফুল বিক্রেতা থেকে শুরু করে আশেপাশের সবাই মনে করতে থাকে যে ব্যক্তিটা তার প্রেমিকার জন্যই কিনেছে। অথচ ফুলগুলো তার বোন কিংবা মায়ের জন্যও তো কিনতে পারে।
কিংবা ধরে নে এই হাওয়াই মিঠাই। এর গায়ে কোথাও কি লেখা আছে যে এই হাওয়াই মিঠাই শুধু মাত্র প্রেমিকাকেই দেওয়া যাবে?
যে মানুষটা সাধারণ সম্পর্ক গুলোকে জটিল করে ফেলে, শুধু জটিল নয় একটা সম্পর্ক নিয়ে সব সময় বাজে চিন্তাভাবনা রাখে সে মানুষ নিয়ে কী সারা জীবন কাটানো যেত?”
ইউভানের কথার স্পষ্ট মানেটা আজ বুঝতে পারলো জাফরিন।তবে এটাই ছিল ইউভান- মোনালীর সম্পর্কের ফাটল ধরার এক মাত্র কারণ?
“আমার জন্য তোমাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে গেল?”
“না, এখানে তোর কোনো দোষ নেই।কারণ তুই আমার কাছে আমার বোনের মতো না,আমার ছোটো বোন।
তোর জন্য আমি তোর বড় ভাই। যার কাছে তুই সব থেকে বেশি নিরাপদ। অথচ দেখ এই সমাজ কিংবা আমার প্রাক্তন? সে কিন্তু এমন ভাবছে না।
আমি মাইরি তাকে এটা বুঝাতে অক্ষম হয়েছি যে
তোকে নিয়ে আমার মনে সামান্যতম অন্য অনুভূতি হলে কি ঈশানের পরিবার তোর বাড়িতে আসতে পারতো? না আজ যা হলো এসব হতে পারতো?”
এই সমাজ কি মানে জানিস? এই সমাজ মানে মেয়েদের জন্ম হয়েছে মাত্রই পুরুষদের সেবা করার জন্য এবং সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য।তাছাড়া তাদের আর কি কাজ এই সমাজের?
অথচ নারীরাই এই সমাজের ভিত্তি এটা কেউ মানতেই চায় না।
জাফরিন নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল ইউভানের দিকে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে, বাইরের দিকে তাকিয়ে সে আপন মনেই ভাবতে লাগলো,
“মোনালী নামক মেয়েটা জীবনে চরম পর্যায়ে বোকামী করে বসলো আজ।ইউভান নামক মানুষটাকে সে পেয়েও হারিয়ে ফেলল মাত্র তার সন্দেহ এর কারণে।”
(২৫)
আজমল সাহেবের লাশ কে আজ শেষ বারের মতোন দেখতে গিয়েছে মাশহুদ। সেখানে থেকেই কাফন পড়িয়ে পাঠানো হবে তাকে। বাংলাদেশে ফেরার পর তার যত দ্রুত দাফন করা যাবে ততই ভালো।ময়নাতদন্তের কারণে তার দেহে রয়েছে অসংখ্য সেলাই।সেসব দেখে মনে মনে শিউরে উঠেছে মাশহুদ। দ্রুত বেরিয়ে এলো লাশ ফ্রিজিং রুম থেকে।
আর যাই হোক এই লাশ তাদের পরিবারকে এই ভাবে দেখানো যাবে না।আপন জনের মৃত্যু কিংবা এমন লাশ তারা দেখে সইতে পারবে না।
এমিলি এগিয়ে এসে মাশহুদের পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“স্যার, সব কাগজ পত্র তৈরী হয়েছে। আপনি কী সত্যি যাচ্ছেন?”
” নিশ্চিত না হওয়ার তো কোনো কারণ নেই।”
“তবে কী একা যাবেন?”
“জি না। সাত জনের টিম গঠন করুন।আমাকে যারা লিড করবে।”
“জি স্যার।আগামীকাল তবে আপনারা যেতে পারবেন।”
মাশহুদ কিছু না বলেই নিজের গাড়িতে উঠে বসলো।উঠে বসে অফিশিয়াল মেইলের মাধ্যমে জাফরিনকে জানিয়ে দেওয়া হলো আগামী কাল তার বাবার লাশ দেশে যাচ্ছে।
তাদের কে উক্ত সময়ে এয়ারপোর্টে উপস্থির থাকার জন্য।
মেইল পাঠিয়ে দিয়েও মাশহুদ উশখুশ করতে লাগলো। তিন ঘন্টা পার হয়ে যাওয়ার পরেও কোনো রিপ্লাই আসেনি জাফরিনের থেকে। অতঃপর সে নিজে কল দিয়ে বসলো জাফরিন কে।
অপর দিকে পুরো একটা ক্লান্তিকর দিন কাটিয়ে জাফরিন সবে মাত্র গোসল সেরে বেরিয়ে এসেছে। মায়ের ফোন বাজতে দেখে সে হাতে নিয়ে দেখলো বাইরের দেশ থেকে কল এসেছে।
কল রিসিভ করে সে খুবই শান্ত ভাবে মাশহুদের সাথে কথা বলল।কল কেটে দেওয়ার পর সে দুই চোখ বুজে রইল। হয়তো বৃষ্টি নামবে এজন্যই এমন গরম হাওয়া বইছে।
নিজের কান্নাকে সামলে নিলো সে। তার বাবার রেখে যাওয়া স্মৃতি হিসেবে তার কাছে কি আছে? হয়তো অনেক কিছু, অথবা কিছুই নেই।কয়েক ঘন্টা পর যে দেশে ফিরে আসবে তার বাবা এরপর শুরু হবে তাকে দাফন করার তোড়জোড়। যত দ্রুত তাকে দাফন করা যাবে ততই ভালো।
এত দিন তবুও সে আশায় থাকতো কবে তার বাবার লাশ দেশে আসবে, কবে এক নজর দেখবে?
কিন্তু আগামীর পর সেই আশাটাও থাকবে না।তার বাবার জন্য অপেক্ষা ফুরিয়ে যাবে। তার বাবা হারিয়ে যাবে তাদের থেকে।
অপর দিকে মাশহুদ অপেক্ষা করছে এই রমনীর থেকে নিজের উদ্দেশ্যটা যে করেই হোক উদ্ধার করতেই হবে। একটা তথ্য যে তথ্য কে সে হারিয়ে যেতে দিতে পারে না আজমল সাহেবের মৃত্যুর সাথে।
জাফরিন তার পরিবারকে জানানোর পর সবার মাঝেই এক উত্তেজনা বা অস্থিরতা কাজ করছিল।কিন্তু এয়ারপোর্টে যাওয়ার পর বাজলো আরেক বিপত্তি।জাফরিনের চাচারা গতকালকেই অভিযোগ করেছে মন্ত্রণালয়ে।তাদের ভাইয়ের লাশ মাত্র তারাই নিবে।জাফরিনদের কোনো অধিকার নেই।জাফরিন অবাক চোখে তাকিয়ে রইল তার রক্তের মানুষের দিকে।আজকের দিনেও কী তারা পারে? তার মৃত বাবার লাশ নিয়ে তাদের হয়রানি করতে?
চলবে -এডিট ছাড়া
(যারা গল্প পড়ছেন, তারা অনুগ্রহ করে রেসপন্স করবেন।কেনো না আপনারা শেয়ার করলেই অনেকের কাছে পৌঁছে যাবে এবং সবাই পড়তে পারবে। তাই অনুগ্রহ করে রেসপন্স করবেন। কারণ লিখছিই আপনাদের জন্য।”)