#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ১৮
(৪৩)
জাফরিন চলে যাওয়ার আগের দিন সকালে চূড়ান্ত ঝামেলাটা হলো। সূচনার খুনের ব্যাপারে পুলিশ এসে চার্জ করলো জাফরিনকে। থানায় করা মামলায় প্রধান আসামী হিসেবে দায়ী করা হয়েছে তাকে। অফিসার এসে জাফরিন কে জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনি সূচনাকে চিনেন?”
“জি।”
“কত বছর যাবত তার স্বামীর সাথে আপনার সম্পর্ক?”
“ঠিক কেমন সম্পর্কের কথা বলছেন?আমি কি একটু জানতে পারি?”
“যেমন সম্পর্ক থাকলে একজন মেয়ে অন্য মেয়েকে আত্মহত্যা করতে মোটিভেট করতে পারে।”
“আত্মহত্যা নিশ্চয়ই কোনো সুখকর কাজ নয় যে করতে মোটিভেট করলাম।আর সে করে ফেলল।আর তাছাড়া আপনার কাছে কোনো ওয়ারেন্ট আছে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার?”
“এমনি এমনি তো আপনার সাথে তামাশা করতে আসিনি ম্যাডাম।আপনি প্রশ্ন না ঘুরিয়ে সরাসরি জবাব দিন।”
“আপনিও না ঘুরিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করুন।”
“আপনার সাথে ভিক্টিমের স্বামীর কেমন সম্পর্ক? “
“সে আমার বড় দুলাভাই আসলাম সাহেবের ছোটো ভাই।তার সাথে আমার আর পাঁচ টা মানুষের মতন সম্পর্ক।”
” আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে আপনি এবং তার স্বামী, দুজনে মিলে বাধ্য করেছেন ভিক্টিমকে আত্মহত্যা করতে। কারণ আপনাদের প্রেমের সম্পর্ক চলছে চার বছর যাবত।”
এবার জাফরিন না হেসে পারলো না।ফিক করে হেসে বলল,
” একটু খোঁজ নিয়ে দেখলে জানতে পারবেন সম্প্রতি আমার বিয়ে ভেঙেছে এবং সেটাও আমার প্রেমের বিয়েই ছিল।এরপর গুঞ্জন উঠেছে আমার চাচাতো ভাইয়ের সাথেও আমার প্রেমের সম্পর্ক।আচ্ছা বাদ দিন এটাও, সব থেকে বড় কথা, ওই যে দেয়ালে যার ছবি দেখছেন আমার সাথে,সে আমার মামাতো ভাই। তার সাথেও আমার প্রেমের গুঞ্জন রয়েছে। আজ আবার এটা, আসলে আমি কনফিউজড। আমার প্রেমটা হয়েছিল কার সাথে?”
“আপনি আমার সাথে মশকরা করছেন?”
“জি না।আমি এটা বুঝাতে চাচ্ছি যে শোনা কথায় সব হয় না।আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ তো লাগবে।”
” ভিক্টিমের মা আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। কারণ দুর্ঘটনার পর পরেই আপনাদের বিয়ের কথা চলছে।”
“এক পাক্ষিক কিছুই হয়নি। আর তাছাড়া আমার এই বিষয় নিয়ে কিছুই বলার নেই।যদি করতেই হয় তবে সূচনার স্বামী এবং শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করুন।”
ঠিক সেই মুহুর্তে জাফরিনের বড় মামা চলে আসেন। তিনি অফিসারের সাথে কথা বললেন।পরিচয় দেওয়ার পূর্বেই তাকে চিনতে পারেন।তিনি নিশ্চিয়তা দেন এসবের সঠিক ভাবে তদন্ত করার। কিন্তু জাফরিন এই মুহুর্তে দেশ ছেড়ে যেতে পারবে না বলেও জানান।আগামী সপ্তাহে কেস কোর্টে উঠবে এরপর দেখা যাবে কী হয়।
পুলিশ চলে যাওয়ার পর চিন্তার ভাঁজ পড়লো সবার কপালে।বিশেষ করে জাফরিনের মায়ের। আসলাম সাহেব সবটা জানতে পেরে দ্রুত ছুটে আসলেন তাদের কাছে।মামা সাহেব উপরস্থ কর্মকর্তা তার বন্ধুকে কল দিলে তিনি বললেন,
যদি ভিক্টিমের পরিবার থেকে কেউ একজন তাকে নির্দোষ বলে লিখিত দেয় তবে বাকীটা উনি দেখবেন। না হলে আগামী সপ্তাহ অবধি অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
এবার আসলাম সাহেব সরাসরি কথা বললেন সূচনার পরিবারের সাথে।
“জাফরিনের কোনো দোষ নেই এতে তালোই সাহেব।আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি এটা।”
“আপনি সেদিন কোথায় ছিলেন যেদিন আমার মেয়ে মারা গেল?সেদিন তো আপনার শালী সেখানে ছিল।”
“কারণ নিশ্চয়ই আপনি জানেন।আমার শশুর ইন্তেকাল করেছেন আর মেয়েটার জীবনে অনেক সমস্যা লেগেই আছে। এই তো সে আগামীকাল স্পেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে কিন্তু পুলিশ বিধিনিষেধ দিয়ে গেল।এভাবে মেয়েটার ভবিষ্যৎ নষ্ট করবেন না।”
“আর আমার মেয়েটা যে মরে গেল?”
জাফরিনের মেঝ আপা এই কথাতে ভীষণ রেগে গেলেন।সে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু মামা নিষেধ করলেন।এই মুহুর্তে তাদের মাথা ঠান্ডা রাখতেই হবে।প্রয়োজন পড়লে নিচু হয়ে কথা বলতে হবে। তাদের নিজেদের ভালোর জন্য।
“আপনারা যা ভাবছেন এমন নয়।জাফরিনের সাথে আমার কুলাঙ্গার ভাইয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। আপনারা যা শুনেছেন সবটা ভুল।হ্যাঁ, আমার মা বলেছিল বিয়ের কথা কিন্তু জাফরিন রাজি হয়নি।তাই তো সে চলে যাচ্ছে দেশ থেকে।”
অপর পাশে থেকে কেউ একজন বলল,
“হ্যাঁ, ওই মেয়েটা তখনি রাগারাগি করে বাড়ি থেকে চলে যায়।ওর দোষ নাই।অযথা ওর যাওয়াটা আটকালে এতিম মেয়েটার সাথে খারাপ হবে।ওর সাহায্য করলে হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমাদের মেয়ের প্রতি রহম করবে৷”
“আচ্ছা বেশ, আমাদের কী করতে হবে?”
“বেশি কিছু নয়, আপনাদের লিখিত দিলেই হবে যে জাফরিনের প্রতি কোনো অভিযোগ নেই।বাকীটা হয়ে যাবে।”
(৪৪)
মাশহুদ যখন এই বিষয় সম্পর্কে জানতে পারলো তখন মনে মনে বলল,
“এই মেয়ে কী চলন্ত সমস্যার মেট্রোরেল? এত সমস্যা কেন তাকে ঘিরেই?”
মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকী আছে, এরপর তাদের বেরুতে হবে। আর এখন কী না এই মেয়ে কেসে ফেসেছে৷ রাগে তার কপালের দুটো শিরা ফুলে উঠেছে। ভুল হয়েছে একটাই।সেদিন রাতেই তাকে এখানে নিয়ে আসা উচিৎ ছিল।তার কাজ শেষ হলে ছেড়ে দিতো অথচ তার প্রতি অমোঘ মায়ার শেষ হবে কী করে?
এমিলিকে সে বলল বিষয়টা মিটিয়ে নিতে প্রয়োজন হলে টাকা দিয়েও মিটিয়ে নিতে।
তখন এমিলি জানালো তার পরিবার থেকেই সব মিটিয়ে নিয়েছে।
“যাক তবে, মেয়েটার পরিবার এতোটাও তবে ফেলনা নয়। সাপোর্ট করার ক্ষমতা তাদের আছে তবে।বিপদ মোকাবিলা করতে জানে ঠান্ডা মাথায়।”
“কিন্তু স্যার, আমার মনে হয় মিস. জাফরিন নিজেই সমস্যা গুলো ক্রিয়েট করে।”
“মিস এমিলি,আপনি কী নিজের সমস্যা ক্রিয়েট করে আপনার নিজের শরীরের অংশ পুড়িয়ে ফেলবেন?না কী এমন একটা মার্ডার কেসে জড়াবেন?”
“দুঃখিত স্যার।আমি পরবর্তী সময়ে আমার শব্দ চয়নে কেয়ারফুল হবো।”
মাশহুদ কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালো। এমিলি তার পিছনে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো,
“জাফরিন নামের মেয়েটার পিছনে ছায়ার মতোন লেগে থাকা এই মাশহুদ যে তাকে আগলে রাখছে। যে তার জীবনে জমিয়ে রাখা সব স্নেহ,ভালোবাসা,ইচ্ছে কিংবা অভিমান ঢেলে দিবে
মেয়েটার মাঝে। সে কী মেনে নিতে পারবে?
কারণ প্রেমিক পুরুষ হিসেবে মাশহুদ যে বড্ড অভিমানী প্রজাতির প্রেমিক। জাফরিন বুঝবে তো তাকে?”
চাপা গুঞ্জনে চারপাশে মানুষ কথা বলছে। এই মাষ্টার বাড়িতে কয়েক দিন যাবত কারা যেন থাকছে। তাও আবার বিদেশি,আসার পর মাষ্টারের সব ঋণ শোধ করেছে, নিত্যদিন বাজার থেকে ব্যাগ ভরে বাজার নিয়ে আসে। বাড়ির বাইরে দাঁড়ানো থাকে সারি করে দামী গাড়ি। সব বিদেশি লোকজনের মতোন লাগে। আবার সেদিন বারান্দায় মাষ্টারের বড় মেয়ের সাথে এক ছেলেকে দেখছে পাশের বাড়ির লোক।পুরো যেন সিনেমার নায়ক- নায়িকা। এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল তারা। মাষ্টার কী বড় মেয়ের জন্য বিদেশি পাত্র ঠিক করেছে?
মাষ্টার এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন।তিনি চায়ের দোকানে বসে ছিলেন অনেকের সাথে। দীর্ঘ কয়েক বছর পর এখানে বসা। তার জন্ম হয়েছে যুদ্ধের বছর। এই এলাকার সবার কাছে সে মাষ্টার নামেই বেশি পরিচিত। অন্যের সন্তান মানুষ করলেও করতে পারেনি নিজের সন্তান। কারণ ছেলেটা অল্প বয়সে জুয়াড়িদের খাতায় নাম লেখায়।বার বার জেলে যেতো আর তাকে ছাড়াতে মাষ্টার ধার-দেনা কিংবা সুদে টাকা নিতো।এভাবেই যখন ঋণের বোঝা বাড়লো তখন আর বসা হতো না চায়ের দোকানে। পাঁচটা টাকাও যে অনেক ছিল তখন। কিন্তু এখন ঋণ নেই। তাই বসেছে এখানে।সবাই যখন জিজ্ঞেস করলো তখন সে বলল
“ছেলেটা না কী তার ভাতিজা লাগে। তার বাবা বিদেশে বিয়ে করেছে সেই ঘরের।দেশে এসেছে তাদের নিতে। কিন্তু সে বিশ্বাস পাচ্ছে না।অপর দিকে সে তার ঋণ শোধ করেছে তাও বিশ্বাস পায় না।ঘরে জোয়ান -যুবতী মেয়ে নিয়ে থাকে। তাই তারা যদি সাহায্য করে ওই ছেলের সাথে বিয়ে দিতে তাহলে বেশ উপকার হইতো তার।”
“তোমাদের তো নিয়ে যেতে চায়, আর জোড় করলেই কী রাজি হবে?”
“তোমরা ভাইয়েরা আমারে এইটুক সাহায্য করবা না? এই ছেলে যাওয়ার পর কেউ আমার মেয়েরে বিয়ে করবে?কোনো সম্বন্ধ আসবে?এমনিতেই আমার পোড়া কপাল।আর তাছাড়া এক বার ভাবো, বিদেশে এত ধনী লোক,শুনলাম কোম্পানি আছে, আমার মেয়ে যদি এর বৌ হয় তাহলে গ্রামবাসীর জন্য কিছু করবো না?অবশ্যই করবে।আমি বলতেছি করবে।”
“তাহলে এখন কী করা যায়?”
“এই ছেলে বাংলা এত বুঝে না।আর আজ রাতেই তোমরা সবাই আমার বাড়ি আসো। জোড় করে ধরো তারে, বিয়ে না করতে চাইলে জোড় করবা।সব তোমাদের হাতে। কিন্তু আমি কিছুই জানি না।মনে থাকবে?”
“আচ্ছা, তবে রাতে আমরা আসতেছি।তুমি পারলে মিষ্টির ব্যবস্থা করিয়ো।বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের।”
চলবে …..