#ক্যামেলিয়া পর্ব ১৭
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ১৭
(৪০)
“আম্মা আপনি চাইছেন আপনার ছোটো মেয়ের জন্য আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাক?আমার স্বামী সন্তানদের নিয়ে আমি সারা দিন অশান্তিতে থাকি?”
বড় মেয়ের কথা শুনে জাফরিনের মা জিজ্ঞেস করলেন,
“জাফরিনের জন্য তুমি কেন অশান্তিতে থাকবে?ও তো আর তোমার সংসারে গিয়ে বসে রয়নি।”
“কিছুক্ষণ আগে মা এসে সরাসরি বলে গেছেন জাফরিন যদি বিয়েতে রাজি না হয় তাহলে সে আমার হাতে এক গ্লাস পানিও খাবে না।”
“বেশ তো, না খেলে দিবে না তুমি।এখানে জাফরিনকে টানার কোনো কারণ দেখছি না।তুমি কী এসব বলার জন্য আমাকে কল দিয়েছো?”
“আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন না।আপনার কথা সে শুনবে।”
“ঠিক কি বলতে বলছো তুমি?তোমার দেবরের সাথে বিয়ের কথা?”
“আম্মা, জাফরিনের বিয়ে ভেঙ্গেছে একবার না দুই বার। আর ওর একটা ভবিষ্যৎ আছে। কী হবে বিদেশ পাঠিয়ে লেখাপড়া করিয়ে? সেই তো শেষ অবধি রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আগুনের তাপে রাঁধতেই হবে। এর চেয়ে এটা কী ভালো হয় না?সারা জীবন সে আমার সাথে থাকবে আমি নিজে ওকে সবটা দিয়ে আগলে রাখবো।আখেরে কিন্তু লাভটা জাফরিনের হবে। কে জেনে শুনে বিয়ে ভাঙা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবে?”
“আমার মেয়েকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না।নিজের সংসার মনোযোগ দিয়ে করো।তুমি স্বীয় স্বার্থ দেখতে দেখতে নিজের বোনের ক্ষতি চেয়ে বসছো।তোমাকে বিয়ে দিয়ে যে ভুল আমি করেছিলাম সেটার খেসারত আমার ছোটো মেয়ে দিবে না।এটা মনে রেখো। এসব বলার জন্য এখানে আর কল দিবে না।অন্য কথা বলার হলে বলবে।”
মায়ের পাশেই বসেছিল জাফরিন।বড় বোনের কথা শুনে কিছুটা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল সে। কীভাবে বড় আপা এটা চিন্তা করতে পারে? সে ভেবে পাচ্ছে না।অথচ দুলাভাই তাকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে এটা কোনো দিন সম্ভব নয়। জাফরিনদের শহরের বাসায় কাজ ধরেছে। কিছুটা পরিবর্তন আনার পর এখানে একটা এতিম খানা বা বৃদ্ধশ্রম করার চিন্তা ভাবনা করছে জাফরিনের মা।খুব দ্রুত দেশের বাহিরে চলে যাবে ছোটো মেয়ে। বড় দুই মেয়ে নিজ সংসারে আগে থেকেই ব্যস্ত৷ তার দিন কীভাবে কাটবে। তার স্বামী এত কিছু রেখে গেছেন তার জন্য অথচ এই সম্পত্তি এখন তার কোনো কাজের নয়। আত্মীয় স্বজনদের দিয়ে কী হবে তাদের যথেষ্ট আছে। এমন কাউকে এসব দান করতে চান বা তাদের পিছনে খরচ করতে চায় যাদের সত্যিই নেই।অন্তত তারা যেন ভালো একটা জীবন পেতে পারে।
এই শহরের ফুটপাতে অনেক জীবন রয়েছে যাদের থাকার স্থান কোনো অভার ব্রিজের নিচে। মাথা গোঁজার মতোন একটা ঠাঁই, দু বেলা দুটো ভাত এবং বাচ্চাদের একটু একটু করে আরবি পড়া শেখাতে চান তিনি।জাফরিন জানে তার মা মৃত্যুর পরবর্তী সময়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইদানীং খুব সামলে সিদ্ধান্ত নেন কিংবা কারোর সাথে কথা বলেন।মায়ের এমন পরিবর্তন জাফরিনকে বেশ টানে।সৃষ্টি কর্তার নিকট কাঁদতে কাঁদতে তার দুচোখের নিচে কালো দাগ বসেছে। রাতভর সে নফল নামাজে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু নিজের সন্তানের প্রতি আরো শক্ত হয়েছেন।তার মেয়েদের নিয়ে অধিক চিন্তা করলেও কারোর নিকট প্রকাশ করেন না।
যেমন আজ জাফরিনের চেকাপ আছে। প্লাস্টিক সার্জন জানিয়েছে তার হাতে সার্জারির প্রয়োজন রয়েছে। ক্ষত বিক্ষত হাত জাফরিন লুকিয়ে রাখে ওড়নার আড়ালে। সে হাতে মেহেদী পড়তে বেশ পছন্দ করতো অথচ এখন চেষ্টা করে যতোটা কম হাত দেখানো যায়। ইউভান তাকে নিয়ে এসেছিল।গাড়িতে উঠার পর বলল,
“তোর এই দাগটা দেখে জানিস কী মনে হয়?”
“কী?যেন চাঁদের গায়ে কেউ আঘাত করেছে?”
“কীভাবে বুঝলি?”
“এটাই সবাই বলে। ডায়লগটা পুরোনো হয়েছে। নতুন কিছু ট্রাই করতে হবে।”
“আর মাত্র সাত দিন আছিস এখানে। আমাদের কথা মনে হলে খারাপ লাগবে না?”
“লাগবে, না বললে মিথ্যে বলা হবে। কিন্তু কী বলতো ভাইয়া। এভাবে তো কারোর জন্য কেউ থেমে থাকে না।আজ সব ঠিক থাকলে এই সময় আমি আমার লাইফের বেস্ট সময় কাটাতাম।তাই নয় কী?অথচ দেখো এখন এই ডাক্তার ওই ডাক্তার করতে হচ্ছে। ভাগ্যিস বাবার কোম্পানির লোক ভিসা সংক্রান্ত সব কিছুর ভার নিয়েছে। এজন্য আমাদের একটু স্বস্তি।”
ইউভান তাকিয়ে দেখলো জাফরিন কান্না আটকে রাখার চেষ্টা করে চলেছে। অপর দিকে ইউভান তাকে সামলে বলল,
“ফ্রুটস নিবো?”
“আছিই তো কয়েক দিন। আবার দেখা পাই না পাই। চলো আজ কিছু রিচ ফুড খাবো।”
“অসুস্থ শরীরে?”
“শরীরের অসুখ কিছুই না যদি মন ভালো থাকে। মনের অসুখ মহামারী যা শরীরকে পুড়িয়ে ফেলে।”
(৪১)
Hey, ladies drop it down
Just want to see you touch the ground
Don’t be shy girl go bananza
Shake ya body like a belly dancer…
লাউড মিউজিকের কারণে কুঞ্জ ঠিক মতোন মাশহুদের কথা গুলো শুনতে পারছে না।ক্লাব থেকে বেরিয়ে নিজের গাড়িতে বসে বলল,
“এবার বল কী বলছিস?”
“এখন তুই ক্লাবে?”
“আজ উইকেন্ড তো ক্লাবে থাকবো না?”
“তোর সাথে কে?”
“আপাতত কেউই নেই।”
“তবে নিজে ড্রাইভ করিস না। কেস খেয়ে যাবি ট্রাফিক ভাঙ্গার কারণে এখন আমি নেই যে ছাড়িয়ে আনবো।”
“বাদ দে এসব। তোর ওদিকের খবর কী?আজ সতেরো দিন হয়ে এলো। কবে ফিরবি?”
“এইতো দিন সাত পর। আচ্ছা তুই আমাদের শহরের বেস্ট প্লাস্টিক সার্জন এর এপোয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখবি।”
“কেন?”
“আমার চেহারা সার্জারি করে তোর চাঁদ মুখ খানা বসাবো আমার মুখে। তুই প্রেমিক পুরুষ না?যেটা বলেছি সেটা কর।”
“তাদের নিয়ে আসছিস? দাদার প্রথম স্ত্রী।”
“এখনো জানি না।তবে চেষ্টা করবো।না হলেও একজন নিয়ে ফিরছি।তোকে যা বলেছি সেটা কর।”
ফোন রেখে দিয়ে মাশহুদ বারান্দায় পা মেলে বসলো।এই পরিবারের প্রতি তার আলাদা মায়া জন্মেছে।গ্র্যানি বা বাবা কী তাকে ভুল বুঝবে? সে যে সতীন এবং সৎ ছেলে সমেত পুরো পরিবার নিয়ে যাচ্ছে তাদের জন্য সারপ্রাইজ হিসেবে।
হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে পাশ ফিরতেই সে কারোর সাথে আঘাত প্রাপ্ত হলো।ষাট ওয়াটের মৃদু আলোয় দেখলো হাত দুই দূরে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যার চোখ মুখে তীব্র ব্যথা। ব্যথায় কুঁকিয়ে সে বসে পড়েছে। ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বলতেই মাশহুদ দেখলো শাড়ি পরিহিতা একজন বসে আছে মাটিতে। পায়ের বৃদ্ধা আংগুল ধরে। বুঝতে বাকী রইল না মেয়েটার পায়ে আঘাত করেছে সে। তার কাছে যেতেই সে বলল,
“প্রয়োজন নেই। আমি সামলে নিতে জানি।”
অদূরে দাঁড়িয়ে মেয়েটির বাবা সবটা দেখে মনে মনে ভাবলেন,
“এক সময় ওই বিদেশী নারী আমার থেকে আমার বাবাকে নিয়েছিল আজ যদি আমি তার থেকে তার এক মাত্র বংশধরকে নিয়ে যাই?তবে কী হিসেব বরাবর হবে না?”
(৪২)
আগামী তিন দিন পর জাফরিনের ফ্লাইট। এই সময়টা সে একান্ত ভাবে তার পরিবারের সাথে কাটাচ্ছে। মায়ের সাথে থাকছে অধিক সময়। ঠিক যেমন ছোটো বেলায় থাকতো।ভাগ্নে-ভাগ্নী সবাই এসে ভিড় জমিয়েছে তার কাছেই। মেঝ আপা ছুটি নিয়েছেন। বড় দুলাভাইও এসেছে,আসেনি শুধু বড় আপা।সে শুধু জাফরিন নয় প্রতিটি মানুষের সাথে রাগ করেছে। ভাগ্নীর গালে লাল দাগ দেখে তাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে আসতে চেয়েছে বলে তার মা তাকে মেরেছে।কিন্তু বাবা তাদের নিয়ে এসেছে। এটাও জানতে পারে যে তার দাদী প্রতিদিন তার মাকে অনেক কথা শোনায়, মায়ের সাথে কথা বলে না।খাবার দিতে খাবার খায় না।সে চায় যেন জাফরিন বিদেশ না যায়, বিয়েটা হয়। এজন্য দাদী তাদেরকেও বেশ করে কথা শুনিয়েছে।
কথাগুলো শুনে বাড়ির প্রতিটি মানুষের মন খারাপ হয়ে গেল।জাফরিন ভেবেছিল যাই হোক তার চলে যাওয়ার খবর শুনে বড় আপা আসবেন।ছোটো থেকে তার কাছেই বেশি সময় থেকেছে। মায়ের কাছে কোনো কথা বলতে না পারলে বড় আপাকে বলেছে। অথচ আজ সে নেই। সামান্য অভিমানে কত দূরের মানুষ হয়ে গেল।মান অভিমান ভুলে জাফরিন নিজেই তাকে কল দিলো। কল রিসিভ করে সে বলল,
“কী জানতে কল দিয়েছিস? আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি?এটা দেখার জন্য?”
“আপা আমি আগামী পরশু চলে যাবো।”
“যাবি তো আমাকে মরার জন্য রেখে যাবি।সূচনার মতোন আমার মরা ছাড়া উপায় থাকবে না।কী হবে বিদেশ গিয়ে? নোংরামি করার খুব দরকার।”
নিমিষেই জাফরিনের মন বিক্ষিপ্ত হয়ে গেল।সে দ্বিগুণ রাগের সাথে জবাব দিলো,
“বেশ তবে মরেই যান।কথা দিচ্ছি সূচনার পরিবার যে সকল আইনী পদক্ষেপ নেয়নি আমি সব নিবো আপনার জন্য।আর এমন সামাজিক কীট গুলোকে শাস্তির ব্যবস্থা করবো।”
চলবে….