#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ২০
শাশুড়ি থেকে এমন অপমান সহ্য করতে পারলো না।নিজ রুমের দরজা বন্ধ করে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলল সে। বিবাহিত জীবনের এতগুলো বছরে তাকে কেউ কোনো দিন এতোটা অপমান করেনি। নিজ ঘরে বসে দেয়ালের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো টাঙানো ছবিটা।হাস্যজ্জ্বল চোখ মুখে তাকিয়ে আছে জাফরিন।তার দুই গালে চুমু দিচ্ছে নিজ দুই সন্তান।ছেলের জন্মদিনে তোলা ছবিটা।জাফরিনের মুখটা দেখে তাত ভিতরে কষ্টগুলো আর দুমড়ে মুচড়ে উঠেছে।এই মেয়েটা নিজ সন্তানের থেকে কোনো অংশে ভালো কম বাসে না সে। তবে কীভাবে মেয়েটা তার কথা মানলো না?পর মুহুর্তে মনে হলো,
“আদৌও কি মেয়েটা সুখী হতো এই সংসারে?লোকে তাকে যত কথাই বলুক না কেন সে তো জানে তার এই সংসার কতোটা সুখের।সূচনা কেন মারা গেল? না কি তাকে মরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে? কি দোষ করেছিল মেয়েটা?মানুষ হিসেবে সবার কিছু চাহিদা রয়েছে, ভালোবেসে নিজ স্বামীর কাছাকাছি যেতে চাওয়াটা কী খুব ভুল ছিল?যে পুরুষ তার এবং স্ত্রীর মাঝের এই গোপন সময়ের কথা মাকে বলে মেয়েটাকে নিয়ে তামাশা করতে পারে, সেই পুরুষ কি পারতো তার বোনকে সুখী করতে?তাকে কি আদৌও ভালোবাসতো?”
হৃদয়ের অন্তঃসত্ত্বা বলে উঠে “না”, কখনোই না। তার কাছে ছোট্ট ফুলটা কোনো ভাবেই মানসিক শান্তি পেত না।সে যে নরপিশাচ, যে স্বীয় স্ত্রীর সম্মান নিজ ঘরের দোরগোড়ায় এনে তামাশার বস্তু বানিয়েছে।তার কাছে প্রতিটি মেয়েই সমান থাকতো।এবার তার নিজের প্রতি নিজের ঘৃণা হতে লাগলো।শাশুড়ির কথায় কত বড় ভুল আবদার করে বসেছিল সে?
ভাগ্যিস তার এই আবদার নয় ভুল আবদার কেউ মেনে নেয়নি।জাফরিন এক বুক মন খারাপ নিয়ে চলে গেছে।এখন সে আর কাঁদতে কাঁদতে তার বুকে এসে মাথা রেখে বলবে না,
বড় আপা, আব্বা কই গেল?আব্বা আমাদের এতিম করে ক্যান গেল?” মেয়েটা হয়তো এই সময় এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে।আগলে ধরে তাকে কাছা টানা হবে না।কে জানে ভাগ্যে আছে কি না মেয়েটার সাথে দেখা। জাফরিনের হাতের পোড়াটা নিয়েও বেশ চিন্তিত হলো সে। ইউভান বলেছিল তার সার্জারীর প্রয়োজন। কে জানে এখন কোন অবস্থায় আছে।
বাইরের থেকে আসা কান্নার শব্দে ধ্যানভঙ্গ হয় তার।কন্ঠ শুনে মনে হচ্ছে তার ছোটো মেয়েটা কাঁদছে। দ্রুত পায়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দেখলো রক্তারক্তি অবস্থা।মেয়েটার দাঁতে লেগে ঠোঁট কেটে গেছে অনেকটা।মেয়েকে কাছে টেনে নিবে এমন সময় তার হাত থেকে ছোঁ মেরে নাতনীকে নিয়ে গেলেন তার শাশুড়ি। কোলে তুলে নিতে নিতে বললেন,
“আমাকে ওয়াদা করছিলা তোমার বইনের সাথে আমার বাপের বিয়া দিবা।কিন্তু তুমি রাখো নাই।এখন তার শাস্তি তোমার পোলাইপান পাইতাছে।কেমন মা তুমি?বোনের স্বার্থ দেখতে গিয়া নিজের সন্তানের উপর মৃত্যুর অভিশাপ ডেকে আনতেছো?”
“আম্মা আপনি অতিরিক্ত কিছুই বলিয়েন না।আপনি যেমন আপনার সন্তানের কথা ভাবতেছেন আমার আম্মাও তার সন্তানের কথা ভাবছে। সে না চাইলে আমার বোন রাজি না থাকলে, আমার মুখের কথাতেই আপনার বেয়াদব ছেলের কাছে তারে বিয়ে দিবে?”
“কী বললা তুমি?”
বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ভদ্রমহিলা। কিছুটা কাঁপানো গলায় বড় আপা উত্তর দিলেন,
“ছোটো যদি ওর বউয়ের কথা আপনার কাছে না বলতো আর আপনি যদি এতোটা বাজে ভাষায় সূচনাকে কথা না শোনাতেন, ওর মা-বাবারে ডেকে এনে অপমান না করতেন তাহলে ও আত্মহত্যা করতো না।কেমন পুরুষ আপনার ছেলে যে নিজের বৌয়ের চাহিদাই মেটাতে পারতো না, আর সেটা ডাক ঢোল পিটিয়ে বলে বেড়াতো বৌয়ের চাহিদা বেশি?”
স্ব জোরে থাপ্পর বসিয়ে দিলো পুত্র বধূর গালে।রাগে ফোঁসফোঁস করে বললেন,
“বেয়াদব, এই মুহুর্তে আমার বাসা থেকে বেরিয়ে যাবি তুই। কিসে তোর এত অহমিকা?”
“বেশ আম্মা,আজ আসুক আপনার ছেলে।আমি চলে যাবো।আমার কিছুতেই কম নেই।কিন্তু আজকের এই কাজের জন্য আপনি ভবিষ্যৎে আপনাকে কাঁদাবে।মনে রাখবেন।অন্তত সেই মরা মেয়েটার রুহের হায় লাগবে আপনার।”
(৪৭)
এনাউন্সমেন্ট শুনে উঠে দাঁড়ালো জাফরিন।উত্তেজনা না কি ভয় বুঝা গেল না তবে তার পুরো শরীর মৃদু কাঁপছে।জাফরিন ইউভানের হাত শক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ভয় লাগছে দাদা ভাই।আমি যাবো না।মায়ের কথা মনে হচ্ছে।”
“না যেতে চাইলে বিলক্ষণ যাবি না।কিন্তু ভয় পাওয়ার কিছুই নেই।”
“আমার কান্না পাচ্ছে যে। আমি কি করবো?”
“কাঁদবি,সব কষ্টকে চাপা থাকতে দিতে হয় না।কিছু কষ্টকে চোখের পানির সাথে বইতে দিতে হয়।”
“মাকে দেখে রেখো।আর বড় আপার খোঁজ নিও।কথায় আছে ঝোঁকে বাঙালি, আপা ওরকম।তাকে আলাদা করে দিও না।আর মেঝ আপা যতই নিজেকে শক্ত মনের মানুষ বলুক না কেন,ঘরে দরজা দিয়ে নিরবে কাঁদতে জানে সে।”
“তোকে এতো কথা চিন্তা করতে হবে না।তুই আমার কথা শোন,ওখানে আমার একজন কলিগ সম্প্রতি গিয়েছেন।তোর ব্যাপার সব জানে। পৌঁছে তোর কাজ হবে সময় সুযোগ বুঝে হাতের ট্রিটমেন্ট করানো।আমি সময় হলেই তোকে দেখতে যাবোরে বোন।”
জাফরিন দুহাতে জড়িয়ে ধরে তার ভাইকে।আপন ভাই হলেও হয়তো তাকে এতোটা আদর-যত্ন করতো না যতোটা তার মামাতো ভাই তথা ইউভান করেছে। বোনের মাথায় হাত রেখে তার মাথায় চুমু দিয়ে ইউভান বলল,
“আমার যদি একটা বোন থাকতো আমি তাকেও তোর মতোন আদর করতাম।কিন্তু কি করবো বল, দেখলাম যে ছোট্ট কোনো বোন নেই তখন ফুপুকে বললাম আর ফুপু তোকে ড্রেন থেকে তুলে এনেছিল।”
“আজকে তো এসব বলো না।আমি চলে যাচ্ছি।”
“এবার সত্যি যা, ওই যে তোর জন্য অপেক্ষা করে আছে সবাই।যা দেরি করিস না।”
ইউভানের পাশে দাঁড়িয়ে এমিলি বলল,
“মিস শিকদার, এবার আমাদের যেতে হবে। এনাউন্সমেন্ট হয়েছে অনেক সময় হয়ে এলো।দেরি করা যাবে না।”
জাফরিন এগিয়ে যেতেই ইউভান পিছন ফিরলো।চোখ দুটো মুছে রোদ চশমা চোখে হাসি মুখে বিদায় দিলো বোনকে। সবটাই দূর থেকে দেখলো মাশহুদ।নিজের রাগটাকে দমন করে এগিয়ে গেল সে। এমিলি হাঁটছিল মেয়েটার পাশে পাশে।
তার গায়ে এক ধরনের গন্ধ ভেসে আসছে৷ মাশহুদ মাঝেমধ্যে এই গন্ধটার কথা বলেছে ফোনে কুঞ্জকে। এই গন্ধটায় না কি মাদকতা রয়েছে।গত দুদিন পূর্বে সে এটাও এমিলিকে বলেছে যেন দেশে ফিরেই কোনো একটা কোম্পানি সাথে কোলাবোরেশান করার প্রজেক্ট হাতে নেয়, তারা নতুন একটা পারফিউম আনবে বাজারে। যেটা থাকবে প্রেয়সীকে উৎসর্গ করা যায়।ফার্স্ট ক্লাসে টিকিট বুক করা হয়েছিল তাদের জন্য।জাফরিন প্রবেশ করে দেখতে পেল সেখানে আরো কয়েকজন বাঙালি রয়েছেন বাকী সিট গুলো।
পুরোপুরি ভাবে ফাঁকা পড়ে আছে। এমিলিকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানালো তাদের বস এভাবে নিয়ে যেতে বলেছেন।জাফরিন যেন তার পছন্দসই সিটে বসে পড়ে এবং যে কোনো সমস্যা হলে তাকে জানানোর জন্য। এটা ছিল জাফরিনের প্রথম প্লেনে উঠা।সে খেয়াল করলো তার শরীর ধীরে ধীরে খারাপ হচ্ছে। ভয় আতঙ্কে মাথাটা বেশ ঝিম ধরে এলো।সে আস্তে-ধীরে গা এলিয়ে দিলো সিটটাতে।দু চোখ বন্ধ করে মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলো।তার ভয় কেটে গেল যখন একটা হাতের স্পর্শ পেলো নিজের হাতে।চোখ মিলিয়ে তাকিয়ে দেখলো একটা ভরসার হাত ধরে আছে তার দুটো হাত। উষ্ণ স্পর্শ, ভরসার দৃষ্টিতে তার ভয়টা উবে গেল মুহুর্তেই।
চলবে..