ভাবীর সংসার ৩৮ তম পর্ব
পলি সকাল থেকে মন খারাপ করে বসে আছে। কারণ আবিদ এক কথাই বার বার বলছে, এভাবে এখানে থাকা ঠিক হবেনা। আমি এভাবে, আব্বা-আম্মাকে কষ্ট দিতে পারবো না।
পলি কান্নাকাটি করে, হালকা হতে ইচ্ছে করছে। আবিদ চুপচাপ ভদ্র ছেলে, মাঝারি ধরণের চাকরি। সামন্য টাকা বেতন আর চার/পাঁচ টা টিউশনি করে, চলে যাবে সংসার। কিন্তু সে একদম দায়িত্ব ছাড়া কিছুই বুঝেনা, আবেগ নেই বললেই চলে। সে আজ একমাস হয়েছে এখানে, শখ করে একদিন এক কাপ চা খেতে পর্যন্ত নিয়ে যায়নি! সে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে। তবুও সারাদিন অপেক্ষা করেই থাকতে ইচ্ছে হয়। এই ছোট্ট রুমের মায়ায় সারাক্ষণ বন্দি থাকতে ইচ্ছে হয়।
আবিদ স্কুলে যাওয়ার সময়, মুখ বেশ কালো করে বললো, পলি গুছিয়ে রাখবে সব, কাল সকালেই রওনা হবো।
পলি আর কিছুই বলেনি, বলতে ইচ্ছে হয়নি। মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। তার স্বপ্ন ছিল একজন মানুষ থাকে পাগলের মতো ভালবাসবে, খুব সকালে দুজন মিলে হাত ধরাধরি করে রাস্তায় হাঁটবে। ইচ্ছে হলে ছুটির দিনের বিকালে শাড়ী পরে রিকশা করে ঘুরবে! এক গুচ্ছ বেলী ফুল নিয়ে হয়তো সারপ্রাইজ দিবে। কিন্তু আবিদ সম্পূর্ণ বিপরীত, চুপচাপ একজন মানুষ। ঘুরতে যাওয়ার বিন্দু মাত্র আগ্রহ তার নেই। তবুও সে আবিদ কে প্রান ভরে ভালবাসে। আজ খুব রাগ লাগছে, শ্বশুরের বাসায় যেতে মন একদম মানছেনা। একদম না।
দুপুরের খাওয়ার পর জলির পাশে বসে আছে রনি। বললো আমার মামাতো ভাই কে কি পছন্দ হয়নি কলির?
– কলিকে, কিছুই জানানো হয়নি। আজ মেজ ভাই আসবে, আসলে বুঝে জানাবেন।
– এতো বোঝার কি আছে জলি? ব্যবসা করে, নিজেদের ফ্ল্যাট কিনেছে। বড় মামার বাড়ীতে বিশাল সম্পদ। একটাই ছেলে।
– আমার তো ওকে অনেক পছন্দ কিন্তু, ভাইদের মতামত এখানে অনেক বেশি জরুরি।
– ওর, কলিকে পছন্দ হয়েছে।
– ভালো সংবাদ
জাহিদ এসেই ভাগ্নেকে কোলে নিয়ে আদর করছে। আহা! আমাদের বড় ভাগ্নে, তাই না মা?
– হ্যা। ভাগ্নের মুখ দেখ তোর মতো।
– তাই নাকি?
– ভাগ্নের জন্য কি এনেছিস?
– অনেক কিছু….. মা, প্রচন্ড ক্ষুদার্ত দুই ভাই, খাবার দাও।
বড় খাটে, জলি তার ছেলে, আর রাহেলা বেগমের জন্য জায়গা করা হয়েছে। পলি নিচে কাঁথা বিছিয়ে জায়গা করছে। ছোট রুমের খাটে, রনিকে একাই দেওয়া হয়েছে। সে বার বার নাহিদ কে ডাকছে। কিন্তু নাহিদের বেশ লজ্জা লাগছে, এভাবে গাদাগাদি করে থাকবে, তার চেয়ে নিচেই ভালো।
জাহিদ ১৮০ টাকা দিয়ে একটা মশারি কিনে এনেছে। এনে, মাকে দিল।
– এটা কি জন্য?
– আমরা তিন ভাই ছাদে, শুয়ে পরবো। নিচে থাকবে পাটি, আর দুইটা পিড়ি দিবে, তার উপর কাপড় বিছিয়ে শুয়ে যাবো।
– কি বলিস এসব?
– মা, এখন হালকা শীত পরছে, সমস্যা নাই। মশার সমস্যা সমাধান। আর পিঁড়ি পেতে ঘুমানো আমার পুরনো অভ্যাস।
– সাঈদের বাসায় রুম গুলি খালি পরে আছে।
– আমাদের এই বিশাল ছাদ খালি পরে আছে। জামাই মানুষ এসেছে, সে বেশি কথা শুনলে, কষ্ট পাবে।
– ছোট রএর নিচে জায়গা কর।
– এখানে একজনের জায়গা হবে, আর নাহিদ ও এখানে থাকতে চায়, থাক। দুলাভাই আরাম করে ঘুম দিক।
– আর তুই?
– যে জার্নি আজ হয়েছে, শুধু চোখ বন্ধ করলেই শেষ।
রাহেলা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,একে বুঝানো একে বারেই সম্ভব না। কেমন করে এই খোলা আকাশের নিচে রাতে থাকবে তিন ছেলে।
রাতে তিন ভাই মিলে কুটকুট করে গল্প করছে। নাহিদ বলছে মেজ ভাই, কলিপার বিয়ের আলাপক আসছে?
– এখন কিসের বিয়ে। এম.এ পাশ করা বেশি জরুরি।
– দুলাভাইয়ের মামাতো ভাই, বিশাল বড় লোক।
– বিশাল বড় লোক কলিকে বিয়ে করতে চায়, এখানে ঘাপলা আছে।
– না, কোন ঝামেলা নাই।
– ভাই, অনেক বেশি ক্লান্ত আজ, শাহিদ সাহেব এখনই নাক ডাকছেন৷ আমাকেও নাক ডাকতে দে।
– ভাইজানের মন উদার থাকলে আজ এভাবে থাকতে হতো না।
– সব সময় মাথায় রাখবি, সব কাজের পিছনে ভালো কোন কিছু আছে। এখন ঘুমাই, সকালে কথা বলবো। মশারীর ফাঁক দিয়ে মশা বাবু গুন গুন করছেন। কি যে বিশ্রি সে সুর।
– হুম। অত্যন্ত বেসুরা। ঘুমাও মেজ ভাই।.
ফযরের নামায পরে, একটা মোড়া নিয়ে ছেলেদের পাশে এসে বসেছেন রাহেলা। তিন পুত্র আরাম করে ঘুমাচ্ছে। নাহিদ পিঁড়ি থেকে মাথা নামিয়ে নিজের হাতের উপর শুয়ে আছে। রাহেলা রুমে গিয়ে, এবার নিজের বালিশ টা নাহিদের মাথায় দিলেন। আরও দুটি বালিশ কেনা দরকার।
ভোর ছয়টার দিকে চোখে রোদ লাগতেই জাহিদ উঠে বসে পরলো, বেশ গরম লাগছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, রাহেলা বেগম মাথার কাছে বসে ছিলেন। হাতে পাখা, বাতাস করছেন।
তুমি কখন এসেছো?
— একটু আগে। তুমি ঘুমাও মা! তোমার হাই প্রেশার।
– আমার সূর্য উঠলে কখনো ঘুম লাগেনা আর। বাবা, কলির জন্য জামাই বিয়ের আলাপ নিয়ে আসছে। কিন্তু এখন বিয়ে দেওয়ার দরকার নাই।
– তাইতো। দুলাভাইয়ের কি হয়?
– মামাতো ভাই। ঢাকায় নাকি অনেক বড় ব্যবসা। সমস্যা একটাই ছেলে ম্যাট্রিক পাশ।
– আমার বোন দুই দিন পর মাস্টার্স পাশ করবে।
– আমি তো বিয়েই এখন দিব না। তাই আর আগ্রহ দেখাই নাই। মেয়েদের কপাল কার কোথায় কে জানে! শিক্ষা কম বলার দরকার কি? উত্তর একটাই এখন বিয়ে দিব না।
– হ্যা।
– আমি খিচুড়ি বসাই। জামাই এসেছে।
জলি ছেলেকে নিয়ে রোদে বসে আছে। যাতে চগেলের জন্ডিজ না হয়। দুই মামা দুই দিকে বসে আছে।
রাহেলা বেগম বললেন দেখেছিস মেজ মামাজি কত জামা নিয়ে এসেছে?
– হ্যা মা। আর জাম লাগবেই না।
– এখন আর কি লাগবে, বল? আমি তো কিছু দিলাম না।
– না, তুমি কি দিবা, তোমার দোয়াই আসল। তার দাদী নাকি রুপার চেইন, আংটি কিনেছেন। অবস্থা গরীব কিন্তু মন অনেক বড়।
– হুম।
– আমার বড় ননদের ছেলে চার আনার চেইন দিয়েছেন। আমার শ্বাশুরির নাতি-পুতির প্রতি স্নেহ বেশি।
– থাক, তুই। আমি জাহিদের সাথে কিছু আলাপ করি।
– মা, কলির বিয়ের টাও।
– হুম।
রাহেলা বেগম আসতে আসতে চিন্তা করছেন তিনি সোনার চেইন কোথায় পাবেন? কে দিবে তাকে টাকা।
জাহিদ মায়ের পাশে বসে বললো মা, জলিপার পছন্দ হয়েছে কাপড়?
– হ্যা।
– আমার হাত একদম খালি। বেতন পেয়ে নেসের ভাড়া, খাবার খরচ দিয়ে, সব নিয়ে এসেছি। এসব কিনে টাকা মাত্র ছয় হাজার রয়েছে। এই মাস চলবে কেমন করে। এই মাসেই শাহিদের ফরন ফিলাপ।
– চিন্তা কর না, আল্লাহ ব্যবস্থা করবেন।
রাহেলা বেগম ছেলেকে স্বর্ণ চেইনের কথা বলার সাহস পেলেন না। জাহিদের হাত টাকা নাই, মানে বল নাই। কেমনে করে কি করবেন, কিছুই বুঝতে পারছেন না, তিনি। তার সহজ সরল জলি কি মাতের এই পরিস্থিতি বুঝবে!
পলি শেষ পর্যন্ত যাওয়া তিন দিন পিছিয়েছে। কিন্তু থাকা হবেনা আর, এটা বেশ জোরালো ভাবে বলেছে আবিদ। পলি আজ চিন্তা করছে, আবিদ যাওয়ার পর, শ্বাশুরিকে কল দিবে। যদি ল্যান্ডলাইন ঠিক হয়, তিনি কথা বলবেন। তবে, সব শুনে কি তিনি রাজী হবেন না কষ্ট পাবেন! আনিদ বেড়িয়ে যাচ্ছে, পলি ফোনে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পরবর্তী কি হবে, সেটা সে জানেনা, তবে৷ সে শেষ চেষ্টা করবেই, এবং এতে কিনহবে সেটা জানেনা….
চলবে…
আন্নামা চৌধুরী।
১৬/০২/২০২২
বি.দ্র’ একুশে বইমেলায় আসছে আমার প্রথম উপন্যাস “সময় ঘড়” পেন্সিলে পাবলিকেশন্স থেকে। ২০,২১ সারাদিন বইমেলায় থাকবো, ইনশাআল্লাহ, দেখা হবে
।