ভাবীর সংসার ৩৩ তম পর্ব
রাহেলা বেগম সকালে উঠে ভাত তরকারী রান্না করে, গোসল করে ছাদে বসে আছেন। ঘড়িতে তখন নয়টার সামন্য বেশি বাজে।
হাতে একটা মোড়া নিয়ে পলি মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। রাহেলা বেগম দেখে বললেন আরাম করে ঘুমাচ্ছিস দেখে ডাকিনি।
– হ্যা, ঘুম ভালো হয়েছে।
– রান্নাঘরে সব রেডি করা আছে খেয়ে নে।
– তুমি খেয়েছো?
– কলি বিছানা-পত্র গুছিয়ে গোসল করছে, বের হলে খাবো।
– এতো সকালে? ব্যাপার কি?
– সাঈদ মালামাল নিয়ে আসছে, নাহিদ সাত টায় ওই বাসায় চলে গিয়েছে। শাহিদ দোকানে গিয়েছে, বারো টার দিকে আসবে। কাজের চাপ বেশি, তাই যেতেই হয়েছে।
– মা,
– কি?
– এখানে অনেক আরামে আছ, থাকো। কষ্ট পাবে কেন শুধু শুধু ভাইজানের বাসার কথা চিন্তা করছো?
– নাতিটা বড় হয়ে যাচ্ছে আদর করলাম না! বউ কি একা একা এই সংসার করতে পারবে?
– মেয়েরা সব পারে।
– নাহিদ-শাহিদ কে অর্ধেক বাসা ভাড়া দিতে বলবো। এখানে তো ভাড়া আছে, ওখানেও শরিক হবে। কিছু বাজার সদাই ও করবে, তবুও এক সাথে থাকলাম।
– দেখো কি হয়!
– হুম।
– মা, আমি চাচ্চি চট্টগ্রাম চলে যেতে, আমার শ্বশুর বাড়ী একা, একদম ভালো লাগেনা।
– এগুলো তোর জামাই আর শ্বশুরের ইচ্ছা মা, আমি নাক গলাতে যাবো না। বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নিবি, নতুন বিয়ে হয়েছে মাত্র।
– আচ্ছা বুঝলাম, কি রান্না করেছো?
– মাছের মাথা লাউ দিয়ে রান্না করেছি, করলা ভাজি, আর মাষকলাইয়ের ডাল। আর এখন খাওয়ার জন্য বেগুন ভর্তা, আর শিম ভাজি করেছি। আর কাল শাহিদ ডিম এনেছে, ডিম ভাজি করে দিব?
– না। ওই বাড়ীতে প্রতিদিন আলু ভর্তা আর ডাল খেতে খেতে মুখে কড়া পরেছে। এখানে অন্য রকম খাবার আছে, শান্তি।
– আমি রুটি করি সকালে, আজ সময় কম, তাই ভাত রান্না করলাম।
– ভালো করেছো। এখন একটু মাথায় তেল দিয়ে দাও, আমি রোদে বসি।
– বসো।
মা-মেয়ে তিন জন খাওয়া শেষ করে হাত ধুইছে তখন নাহিদ এসে রুমে বসেছে।
কলি আড় দৃষ্টিতে ভাইয়ের রাগী চেহারা দেখছে, ফর্সা মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। কলি এক গ্লাস পানি নিয়ে বললো কি হয়েছে নাহিদ।
– আমি না খেয়ে দৌড়ে সকাল সাতটায় গেলাম, বলে এখন এসে কি করবি? আমি তো ছয়টায় এসেছি। যা,চলে যা বাসায়। তুই বল, আমি কি স্বপ্নে দেখবো যে, এতো সকালে চলে এসেছে। তার মধ্যে আইরিন কে নিয়ে এসেছে। সে যে, পন্ডিতি করছে।
-খেয়েছিস?
– কিচ্ছু থাকলে দে, নাশতা হয়েছে?
– মা, ছেলের বাসায় যাবেন, দুপুরের রান্না শেষ করে ফেলেছেন।
– ভালো। ভাত থাকলে, ভাত দে।
নাহিদ বললো, মা তোমার ছেলের তিন বেডের বাসা। এক রুমে সে থাকবে, এক রুমে শালী মাঝে মধ্যে থাকবে, আর আরেক রুম নাকি গেস্ট রুম। ড্রয়িং- ডাইনিং সেট আপ করা শেষ।
– তুই চলে এসেছিস কেন?
– আইরিনের কি কাগজ জমা দিবে, তাই মেডিকেলে যাবে। ঘর তালা দিচ্ছে, মিস্ত্রি রা সব মালামাল জায়গায় রেখে চলে গিয়েছে। দুপুরের পরে এসে, বাড়ীওয়ালা চাচার নাম্বারে কল দিবে, তখন যেতে বলেছে।
– ওহ। আমি ভাত দিচ্ছি খেয়ে নে।
নাহিদ মাকে দেখছে, কিভাবে চুপ করে সব হজম করছেন, এতো কাছাকাছি এসেও ছেলে আলাদা বাসা নিচ্ছে, এতো কোন দুঃখ বোধ নেই। অথচ তিন দিন ধরে আশায় আছেন, নাতি আদর করবেন, সবাইকে নিয়ে থাকবেন। অথচ একটা ওহ বলেই চুপ করেই আছেন তিনি। সবসময় দুঃখ কাউকে বুঝতে দেন না।
পলি এসে নাহিদ কে বললো প্লিজ তুই মাকে কিচ্ছু বলিস না, এমনি ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছে। মায়ের কি ছেলের বাসায়, ছেলের টাকায় থাকবেন, সে আশায় থাকতে চান নি, ভেবেছিলেন নাতি নিয়ে আদর করবেন, এক সাথে থাকবেন, তিন ছেলে নিয়ে কিন্তু!
– পলিপা আমি সব বুঝি। কিন্তু ভাইজানের এই সব বুঝেন না, এটাই কষ্ট লাগে।
রাহেলা বেগম বিকালে ছেলের বাসা দেখতে গেলেন, কি সুন্দর সুন্দর ফার্নিচার কিনেছে সাঈদ। নতুন দুটি খাট ও কিনেছে। তারা সুখে থাকলেই ভালো।
সাঈদ বললো মা, পছন্দ হয়েছে বাসা?
– হ্যা বাবা। পছন্দ হয়েছে।
– জিহান বড় হচ্ছে, একটু বড় বাসা লাগবেই।
– হ্যা। আমি কি কিছু সাহায্য করবো?
– কাজ শেষ। আর নাহিদ দেরী করে এসেছে, কাজ আর থাকে? আমি ছয়টায় এসে সব লেবার দের নিয়ে কাজ করেছি।
– ভালো করেছিস। রাতে আজ আমার এইখানে থাক।
– না, মা। আমি একটু পরেই রওনা হবো। থাকা যাবেনা। কাছাকাছি এলাম, এখন তোমাদের দেখতে যাবো।
– হ্যা, খুব ভালো হয়েছে।
রাহেলা বেগম সেদিন সারারাত ঘুমাতে পারেন নি, কেন যেন খুব কষ্ট লেগেছিল। এই ছেলে এক সময় বলতো, মাকে ছাড়া আমার এক ঘন্টা বাইরে কেমন অশান্তি লাগে, এখন মায়ের সাথে এক ঘন্টা কথা বলার সময় নেই, কত কাছে থেকেও কত দূরে!! চোখ থেকে এক ফোটা পানি বালিশে গিয়ে পরেছে, সাথে সাথে আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন রাহেলা।
দুই, তিন মাসের মধ্যে এই দুই রুমের বাসা একটা মিনি হোটেল হয়ে গেল। কাছের দূরের সকল আত্নীয়ের ডাক্তার দেখানো, ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া, ঢাকার সকল কাজ হয়, এই বাসায় থেকে।
আজ বাসায় চারজন মেহমান, রাহেলা বেগমের ছোট বোন , তার দুই মেয়ে, তার জামাই। মোট চার জন মানুষ। ছোট বোনের ডাক্তার দেখানোর জন্য ঢাকায় এতো জন এসেছেন। গত রাতে নাহিদ-শাহিদ মাথায় পিঁড়ি রেখে ঘুমিয়েছে। কারণ বাসায় নতুন দুটি বালিশ কিনেও মেহমান দের বালিশ দিয়ে তাদের জন্য আর বালিশ অবশিষ্ট নেই।
রাহেলার ছোট বোনের জামাইয়ের আর্থিক অবস্থা ভালো। আসার সময় বেশ বাজার সদাই করে এনেছেন। রাহেলার বাজার ছাড়াও মেহমান দের খাওয়াতে খুব ভালো লাগে। হোক ডাল-ভাত তাই দিয়ে আপ্যায়ন হবে।
রাহেলা তরকারি বসাচ্ছেন, তার বোন শরিফা পাশে এসে বসে বললেন আপারে, আমি তোকে কষ্টে ফেলে দিলাম।
– কি যে বলিস তুই!
– আমি ভেবেছি সাঈদের বাসা কাছে দুই মেয়ে কে সেখানে পাঠিয়ে দিব। এখন, বউ যে পছন্দ করেনা যাওয়া, সেটা বুঝিনি।
– কষ্ট একটু তোদের হচ্ছে শুইতে। নজরুল ভাই নেহাৎ ভালো মানুষ তাই কিছু বলছেন না।
– না, সে তোমাকে তার আপন বোনের মতো সম্মান করে। মেয়ে দুটিকে কার কাছে রেখে আসবো! এজন্য নিয়ে এসেছি। আজ রিপোর্ট দেখিয়ে, কালই চলে যাবো।
– মেয়ে গুলিকে নিয়ে ভালো করে ঘুরাঘুরি করে যা।
– না, এবার নয়, পরে আরেকবার আসবো। এখন ডাক্তার দেখিয়ে যাই।
– কি ভর্তা মর্তা দিয়ে খাওয়াচ্ছি, জাহিদ বেতন পায়নি, এখনো। নয়তো হাতে টাকা থাকতো!
–আপারে তুই তো ভর্তা দিয়ে খেতে দিচ্ছিস আনন্দ নিয়ে, এই ঢাকা শহরে কেউ খাওয়া ছাড়াও থাকার জায়গা দেয় না।
প্রতি শুক্রবারে জুম্মার নামায পড়ে কিছু সবজি আর দুই হালি ডিম নিয়ে মাকে দেখতে আসেন সাঈদ। আজ ঘরে ঢুকেই বলছে মা, বড় টাটকা লাল শাক, আর মিষ্টি কুমড়া পেলাম নিয়ে আসলাম।
– বাসায় সবজি আছে।
– আমি কি খালি হাতে আসবো নাকি? মা বাসায় ফ্রিজ নাই, একটা ফ্রিজ থাকা জরুরি।
– ফ্রিজ কোথায় পাবো বাবা? আর ফ্রিজের দরকার নাই।
– আছে। আমি দেখি আগামী সপ্তাহে একটা ফ্রিজ কিনে আনতে পারি কিনা!
– না, লাগবেনা৷ বাবা, ভাত খেয়ে যাও।
– শারমিন অপেক্ষা করছে৷ একা খাবে। আমি যাই। আসবো, সুযোগ পেলে।
কলি, ভাই যাওয়ার সাথে সাথে বললো, কেন একটা মাছ/ মুরগী নিয়ে আসতে পারেনা। খালি শাক-সবজী আনে। সস্তায় পায়, তাই আনে।
– এখানে কি মাছের বাজার আছে? যে আনবে?
– নিজের বাসায় মাছ কিনেনা?
– কিনুক। যার যা ইচ্ছা করুক, আমি মাথা ঘামাইনা।
– আবার বলে, ফ্রিজ নাই, ফ্রিজ কিনে দিবে।
– আমি কি বলেছে দিতে? আমার ফ্রিজের দরকার নাই।
– তুমি আশাও করনা, করলে কষ্ট পাবে।
– চুপ কর তুই। যা, ভাত রেডি কর। শুধু বেশি বেশি কথা….
কলি ভাত নিয়ে ভাবছে কি কথা, ফ্রিজ কিনে দিবে। কি ফ্রিজ কিনে দিবে তা আল্লাহ শুধু জানেন। একটা মাছ কিনে দিলেন না, এখন ফ্রিজ…..
চলবে….
আন্নামা চৌধুরী
০২.০২.২০২২