ভাবীর সংসার ১৮ তম পর্ব
আজ তিন দিন ধরে টাইপিং শিখতে যাচ্ছে পলি ও কলি। রিতা খালা নিজে গিয়ে ওদের কে সরকারি ভাবে ভর্তি করে দিয়েছেন, তেমন কোন টাকা লাগেনি। যেহেতু যুবায়ের সাহেব নিজে এখানে বড় পদে চাকরি করেন, তাই খুব সহজেই দুজন ভর্তি হয়ে গেল।
পলি খুব কৃতজ্ঞ খালার প্রতি! কারণ তিনি না থাকলে ভর্তি হওয়া সম্ভব হতো না। একদম কলেজের কাছে তাই হেঁটে দুইবোন চলে যায় ক্লাসে।
আগামীকাল থেকে রমযান শুরু হবে, পনেরো দিন ক্লাস শেষ করে তারা দুই বোন বাড়ী যাবে। যদিও কলেজের অনেকেই রমযানে হলে থাকেনা। কিন্তু তারা থাকছে, তাদের টাইপিং ক্লাসের জন্য। তাছাড়া মাস দুয়েক পরে, তাদের পরীক্ষা শুরু হবে। বাড়ীতে গেলে পড়া হয়না!
কলির সেহরীতে উঠেই মুখ ভার করে বসে আছে। কারণ আজকেও হলে মূলা দিয়ে মাছের তরকারি আর পাতলা ডাল রান্না হয়েছে। এই প্রথম বার সে রমযান মাসে বাইরের বাইরে, এজন্য ও তার মন খারাপ।
পলি বললো শোন, কৌটায় সামান গুড়ো দুধ আছে, দিব? মাখিয়ে খেতে পারবি।
– না, আমি খাবো না।
– এখন অভিমান করলে কি হবে? রোযা থাকতে হবে তো!
— আমি রোযা রাখবো, তুই খেয়ে নে, আমার একদম ভালো লাগছেনা।
– শেষবারের মতো বলছি, খেয়ে নে। নয়তো কষ্ট হবে।
কলি উঠে বারান্দায় চলে গেল। এটা তার অভ্যাস, কখনও কিচ্ছু ঝামেলা হলে রুমে থেকে বেড়িয়ে যাবে।
পলি জানে, কলি শেষ রাতে তেমন কিছু খেতে পারেনা। কিন্তু কি করবে তার কাছে তেমন কোন টাকা নেই যে, ভালো কিছু এনে খাওয়াবে।
পলি অনেক জোড় করে, বোন কে ভাত খাওয়ালো। কি করবে, পরিস্থিতি। এমন বাজে। তাছাড়া হলে রমযান মাসের প্রথম সেহরিতে সব সময় মাংস থাকে। কিন্তু ডাইনিং এর দায়িত্ব যে লোক আছে, সে হঠাৎ ছুটিতে যাওয়ায় বাজার হয়নি ঠিকমতো, তাছাড়া অল্প কয়েকজনই হলে আছে এজন্য মেনু ভালো হয়নি।
পরের দিন বিকাল বেলা, পলি ডাইনিং এ গিয়ে বললো মামা আজকে ইফতারিতে কি আছে?
– কি আর থাকবো ভাগ্নী খিচুড়ি আর ছোলা ভুনা! আর কিছু নাইক্কা, আপনার মন যদি কিছু ছায় মন্টু মিয়ারে কইলে হেয় আইন্না দিবার পারে।
– আচ্ছা।
– আর হুনেন ভাগ্নী এই রমযান মাসে এখানে পইড়া আছেন ক্যালা। এহানে কি আর ভালো খাওন দিব নাকি!
– ক্লাস করছি তো এজন্য থাকতে হচ্ছে।
– বুঝবার পারছি।
ইফতারের আগে আগে পলি দশ টাকার পিঁয়াজু আর দশ টাকার জিলাপি নিয়ে এলো। কারণ রাতেও মেয়েটি ঠিকমতো খায়নি!
আসরের আযানের কিছুক্ষণ আগে, একজন এসে বললো আপনাদের গেস্ট আসছে নিচে আসেন।
পলি বললো নিশ্চয়ই ভাইজান এসেছেন। আমাদের নিতে!
– আজ কি শুক্রবার যে ভাইজান আসবেন?
– আর কে আসবে?
– দেখ গিয়ে।
– তুই ও চল!
– না, আমার আসরের নামায পড়ার পর একদম শরীর দূর্বল লাগছে, প্রথম রোযা তো তাই।
– শুয়ে থাক, আমি লেবু নিয়ে এসেছি কাল, শরবত করে দিব।
– তুই আগে যা, পরে কথা বলিস।
– হ্যা হ্যা।
পলি গেস্ট রুমে এসে দেখলো, এক টিফিন হাতে দাঁড়িয়ে যুবায়ের সাহেব।
আসসালামু আলাইকুম খালু।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছ তোমরা?
– ভালো আছি খালু।
– তোমাদের খালা, ইফতার আর সেহরীর জন্য খাবার দিয়েছেন, খেয়ে নিও।
– খালু, এখানে খাবার অনেক ভালো। কেন কষ্ট করলেন?
– মা, আমি ও হলে থেকেই পড়েছি।
– রমযানের জন্য আলাদা খাবার আছে, আর নিয়ে আসবেন না খালু। আমরা খেতে পারবো।
– আচ্ছা সে দেখা যাবে, আর ক্লাসে রেগুলার যাবে। কেমন?
– জি খালু।
– খাবে, আর পড়বে। আর সমস্যা হলে জানাবে।
– খালু, অনেক ধন্যবাদ। খালাকেও জানাবেন। তবে, আর রমযানে খাবার লাগবেনা, এখানে ভালো ব্যবস্থা আছে।
– আচ্ছা, দেখা যাক।
পলি টিফিন হাতে দাঁড়িয়ে দেখছে যুবায়ের সাহেব উনার গাড়ী নিয়ে চলে যাচ্ছেন।
পলি সিঁড়ি দিয়ে উঠছে আর বলছে জীবনে কখনো ফেরেশতার সাথে দেখা হয়নি, উনি হয়তো ফেরেশতা হয়ে জীবনে এসেছেন। আল্লাহ খালুকে হাজার বছর হায়াত দিন।
কলি টিফিন দেখে বললো কি রে কে এসেছিল।
– খালু। রিতা খালাম্মা টিফিট দিয়ে পাঠিয়েছেন।
– এতো ব্যস্ত একজন মানুষ আমাদের জন্য টিফিন নিয়ে এসেছেন! আল্লাহ খালুকে খালাকে ভালো রাখুন।
অথচ আমাদের ভাইজানের খবর নাই।
– কলি, একটু পরে আযান দিবে, এই সময় কারো জন্য কষ্ট পাবিনা, আল্লাহ শুনে ফেলবেন। আল্লাহ আমাদের ভাইজান কে ও ভালো রাখুন।
– ভাইজানের জন্য বদ দোয়া আসেনি, খারাপ লেগেছে বলছি। ভাইজান কে আল্লাহ সব সময় ভালো রাখুন, সে দোয়া করি।
পলি টিফিন খুলে দেখলো, প্রথম বাটিতে পিঁয়াজু, ডিম চপ, কাবাব, বেগুনি,জিলাপি। পরের বাটিতে অর্ধেক বাটিতে ছোলা, আর বাকি অর্ধেকে সবজি ভাজি। তিন নম্বর বাটিতে গরুর মাংসের তরকারি, আর একদম নিচের বাটিতে গরুর মাংসের তেহারি।
পলির চোখে পানি চিক চিক করছে, এতো যত্ন করে মা ছাড়া, কোন দিন তাদের কেউ খাওয়ায় নি, অথচ খালা কত সুন্দর করে পাঠিয়েছেন।
ইফতার করে দুই বোন নামায পড়ে তাদের মা-বাবার সাথে সাথে খালা-খালুর জন্য অনেক দোয়া করলো।
অনেক না করার পর ও দুই দিন পর পর ঠিকই খালু উপস্থিত হতেন সেহরী সহ টিফিন নিয়ে। উনার একই কথা, তোমরা তো আমার বড় কুটুম, ভাগ্নীর ননদ, মানে আরেক ভাগ্নী।
আগামী কাল পলি-কলি বাড়ী চলে যাবে, আজ টাইপিং ক্লাস বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দুই বোন ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছে। সকাল বেলা জাহিদ এসে পৌছে যাবে। তাদের আজ মনে অনেক আনন্দ কারণ তারা বাড়ী যাবে।
দুপুরের দিকে আবার খবর এলো যে, তাদের গেস্ট এসেছেন। পলি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো কিরে খালু আজ এতো সকালে চলে এলেন! কাল বলে দিয়েছিলাম আজ খাবার লাগবেনা, কারণ কাল সকালেই চলে যাবো।
– আচ্ছা আমি যাচ্ছি।
– যা।
কলি গিয়ে দেখলো সাঈদ দাঁড়িয়ে, বললো কলি, পলিকে নিয়ে আয়, আমরা ঈদের শপিং করবো, জিহান কে ওর নানুর কাছে রেখে আসছি। তাড়াতাড়ি আয়।
– জি ভাইজান। ভাবী কোথায়?
– বাইরে গাড়ীতে আছে।
– আসছি ভাইজান।
কলি-পলি তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে নিচে আসলো।
শারমিন দেখেই বললেন তাড়াতাড়ি গাড়ীতে উঠো, আমার ছেলে রেখে আসছি।
– কেমন আছে জিহান?
– ভালো আছে। তোমার ভাই, বোনেদের জন্য তার যে ভালবাসা, বোন ছাড়া শপিং করতে চায়না।
সাঈদ বললো জাহান আমি চার হাজার টাকা বোনাস পেয়েছি, এর মধ্যে আম্মা আর মায়ের জন্য শাড়ি কিনবে, তোমাদের কাপড় কিনবে।
– আম্মার টা আমি কিনে নিব।
– না একই রকম নিও।
– দেখছি।
– আর শাহিদ নাহিদ এর জন্য শার্ট নিও।
– না না, আমাদের বাজেটে হাত দিওনা আর। কি বলো কলি।
কলি হাসছে।
পলি ভাবছে ভাবী আজ হঠাৎ এতো ভালো হয়ে গেল কি করে!
দোকানে গিয়েই ভাবী বলছেন জামদানী দেখান।
দোকানদার বললো, আপা, নব্বই সালের সেরা জামদানী হলো মেরুন কালারের এই শাড়ি।
– আগে দেখান।
– দেখলে চোখ ফেরাতে পারবেন না।
সাঈদ আস্তে করে বললেন আগে দাম জিজ্ঞেস করে নাও।
– পছন্দ করার আগে, এমন করছো কেন?
– আচ্ছা দেখো।
শারমিন শাড়ীর প্রেমে পড়ে গেলেন, তিন হাজার টাকা দিয়ে শাড়ি কিনলেন, সাঈদ কে বার বার বলছেন, এই শাড়ি না নিয়ে আমি যাবোই না। কি সুন্দর শাড়ি!
পলি-কলি দুই বোন একজন আরেকজন কে দেখছে।
পলি আর কলির জন্য আটশো টাকা দিয়ে দুটি জামার কাপড় কেনা হলো। কারণ রেডি জামার বাজেট আর নাই।
শারমিন বললেন তোমরা বাড়ীতে ঈদ করবে, দামী ড্রেস দিয়ে কি করবে? বলো? আমরা শহরে থাকি কত ধরণের মানুষ। আর মায়ের শাড়ি আমি কাল কিনে দিব। সমস্যা নেই, এই দুইশো দিয়ে স্যান্ডেল কিনতে হবে। আর আমার বাবুর কাপড় কিনতে আরেকদিন আসতেই হবে।
পলি বললো কেমন লাগছে বাবুর জন্য কিছু নিলেনা!
– ওর যে কত্ত জামা তুমি গুনে শেষ করতে পারবে?
– ওহ।
– আর ওর জন্য আগামী সপ্তাহে নিব। ওর জন্য আর আমার মায়ের জন্য।
সাঈদের মন কিছুটা ভার হয়ে আছে এতো দাম দিয়ে শাড়ি কেনায়। তার আর কত শপিং রয়ে গেল।
সাঈদ গাড়ীতে উঠে বললো আজ আমাদের সাথে চল, তোরা।
শারমিন সাথে সাথে বললো কি যে বলো, কাল বাড়ী যাবে। কত গোছানো আছে, আজ কিভাবে আমাদের সাথে যাবে।
– ঠিকই বলেছেন, কলি বইখাতা এখনো ঠিক করে গুছানো শেষ করেনি।
– আর কাল যাওয়ার আগে একবার বাসা হয়ে যেও, মায়ের শাড়িটা দিয়ে দিব।
– জি ভাবী।
দুই বোন হলের সামনে নেমে গিয়েছে। রুমে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে বসে আছে দুজন।
পলি বললো ভাবী আমাদের কেন আদর করেনা কলি, একবার যাওয়ার জন্য বলতে পারতো!
– থাক আপা, এসব মানুষ নিয়ে ভাবতেও আমার ভালো লাগেনা।
– হুম, ঠিক।
– কাল বাড়ী যাবো, এই আনন্দেই থাকি, নতুন কাপড় পেয়েছি তাইতো শুকুর আলহামদুলিল্লাহ!
– সত্যি বলেছিস।
পলি কাল ভাইয়ের আসার অপেক্ষা করছে, কত্ত দিন পর বাড়ী যাচ্ছে, এটাই এখন সবচেয়ে আনন্দের বিষয়….
চলবে….
আন্নামা চৌধুরী
১৯/১২/২০২১