নীলার শাশুড়ী পর্ব ১
নীলার শাশুড়ী নিয়ে নীলার পরিবার এবং আত্মীয়মহলে বিপুল আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়েছিল নীলার বিয়ের পর থেকেই । আজ সাত সাতটি বছর পর হয়ে গেলেও আজও তা উত্তরোত্তর বাড়ছে বৈকি কি কমছে না। আর হবেই না বা কেন কেউ কি শুনেছে ,কোন মা নিজের ছেলের জন্য তার চেয়ে বয়সে এক নয় দুই নয় তিন তিনটি বছরের বড় মেয়েকে নিজে পছন্দ করে বৌ করে আনে! নীলার বিয়ের পর পরই এটা পরিচিত মহলে মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে ছিল বহুকাল ।
কেবল বিয়েই নয় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ও আরও কিছু বিষয় যা এই সমাজের কাছে কেবল আনকোড়াই নয় অভাবনীয় ,অবিশ্বাসেও বটে এমন কিছু ঘটনারও জন্ম দিয়েছেন হাফসা বেগম মানে নীলার শাশুড়ী। নিশ্চয়ই আপনাদের এখন একটু হলেও জানতে ইচ্ছে করছে কেনই বা হাফসা বেগম নিজের ছেলের চেয়ে তিন বছরের বড় মেয়েকে নিজের বড় ছেলের বউ করে আনলেন আর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতাতেই কি এমন নতুনত্ব আনলেন যে সমাজের সকলের তাক লেগে গেল।
এ কথা জানতে হলে নীলার বিয়ের দু এক বছর আগের ঘটনাও জানতে হবে আপনাদের ।
নীলা তখন ঢাকা মেডিকেলের শেষবর্ষের ছাত্রী। ঈদের ছুটির শেষে নীলা ঢাকা ফিরছিল বরিশাল থেকে আর হাফসা বেগম বরিশালে তার বোনের মেয়ের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ঢাকায় নিজ বাসায় ফিরছিলেন সুন্দরবন -৮ লঞ্চ এ ।
নীলা লঞ্চ এর কেবিন আগেই বুকিং দিয়ে রাখায় ঈদ পরবর্তী ভীড়ের সময়েও কেবিন পেয়েছিল কিন্তু হাফসা বেগমের বোনের স্বামী আর বোনপো অনেক চেষ্টা করেও কোনভাবেই কেবিনের ব্যবস্থা তো করতে পারলেন না অনেক কষ্টে একটি টিকিটের ব্যবস্থা করেছিলেন , যেহেতু হাফসা বেগমের তাড়া ছিল তাই তার পক্ষে আর দেরী করা সম্ভব ছিল না ।
তাই তার বোন তাকে বেশ মোটা একটা কাঁথা দিয়ে দিয়েছিলেন একান্তই যদি কিছু না পান তবে যেন অন্তত লঞ্চের মেঝেতে পেতে একটু বসতে পারেন এ ভেবে । নীলা লঞ্চে উঠেই কেবিন বুঝে নিয়ে বাসা থেকে নিয়ে আসা চাদর বিছিয়ে আরাম করে শুয়ে গল্পের বই পড়তে লাগল ।
এই লঞ্চ ভ্রমনটা নীলার বেশ লাগে ।
গত পাঁচ বছরে ঢাকা -বরিশাল কতবার যে করতে হয়েছে তবুও একদিনের জন্যও ভ্রমণজনিত ক্লান্তি অনুভব করে নি কেবল এই রাতের আমারদায়ক লঞ্চ ভ্রমনের জন্য । এমনো হয়েছে ছুটি শেষ করে যেদিন লঞ্চে উঠেছে তার পরদিনই ক্লাস । রাতে লঞ্চের কেবিনে দারুন একটা ঘুম দিয়ে সকালে হস্টেলে ব্যাগ রেখে ক্লাস করতে চলে গেছে নীলা । আজও ছুটির একেবারে শেষদিনটি বাবামার সাথে কাটিয়ে তবেই ঢাকায় রওনা করেছে ।
ওদিকে হাফসা বেগম কোন ভাবেই কেবিন তো দূরে থাক একটু বসবার জায়গাও না পেয়ে প্রথম শ্রেনীর কেবিনের সামনে পেতে রাখা চেয়ারে বসে পড়লেন , ঠিক করলেন কোন ভাবে রাতটা এখানে পার করে দিবেন না ঘুমিয়ে আর ফজরের সময়ই ড্রাইভারকে সদরঘাটে চলে আসতে বলেছেন তাই লঞ্চ ঘাটে ভীড়লেই নেমে পড়বেন । হাফসা বেগম যে চেয়ারটাতে বসেছিলেন তা নীলার কেবিনের সামনের চেয়ারটাই। তাই দু একবার বাথরুমে যাওয়া আসার সময় নীলার নজরে এসেছিল হাফসা বেগমকে। নীলা দেখল বোরকা পরা একজন বছর ষাটেকের সম্ভ্রান্ত মহিলা তার কেবিনের সামনের চেয়ারটিতে বসে আছেন , নীলা বুঝল ঈদের সময়ে মহামূল্যবান টিকেটের ব্যবস্থা না করতে পেরেই তাঁর এই করুন দশা।
লঞ্চ যখন চলতে শুরু করেছে কীর্তনখোলার বুক চিরে তখন নীলা বই পড়া বাদ দিয়ে বাইরে রেলিং এর ধারে এসে দাঁড়াল , যতবারই ও লঞ্চে যাওয়া আসা করে ততবারই এই সময়টা ও কেবিনের বাইরে এসে রাতের নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করে । নীলার বাবার খুব ইচ্ছে ছিল মেয়ে যেন বরিশাল শেরে-ই -বাংলা মেডিকেল কলেজেই চান্স পায় , তাহলে মেয়ে ঘরের ভাত খেয়ে পড়াশোনা করতে পারবে । কিন্তু নীলা যখন ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেলো তখন বাবা চিন্তায় পরে গিয়েছিল যে ঢাকায় মেয়ে কিভাবে একা একা পড়াশুনা করবে , লোকাল গার্জিয়ান হবার মতও ওদের তেমন কোন আত্মীয়ও ঢাকায় নেই এই ভেবে । পরে নীলার কলেজের রাবেয়া ম্যাডাম তার বোন কে ওর লোকাল গারজিয়ান হবার জন্য অনুরোধ করেন আর বাবাকে ও বুঝাতে সক্ষম হন ওকে ঢাকায় পড়তে পাঠাতে ।
এরপর তো পাঁচ পাঁচটি বছর চোখের নিমেষেই কেটে গেল আর একবছর ইনটার্নি শেষ করলে ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে আসবে। নদীর দিকে চেয়ে চেয়ে নীলা এসব ভাবছিল । ওর ইদানিং মনে হয় এই যে একবার ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে আর কি সেই ভাবে ঠিক আগের মত করে ঘরে ফেরা হবে!?
নাকি আর যায় ফেরা!
ওর চির পরিচিত নিজের রুমের নিজের খাটে এখন হস্টেলের খাটটার চেয়ে কম ঘুমোনো হয় । নিজের বাসায় এখন কেমন যেন অতিথীর মত আসা হয় বছরে কয়েকবার । একবার ছাত্ররাজনীতির কারনে হল বন্ধ করে দেয়াতে টানা তিনমাস বাড়িতে গিয়ে ছিল নীলা তখন সে প্রথম উপলব্ধি করেছিল আর ফেরা যায় না সেই পুরোনো দিনে , সেই আগের মত করে এমনকি আগের আমিতেও না!
হঠাৎ ফোনের রিংটোনের শব্দে ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে চলে এলো । দেখলো চেয়ারে বসে থাকা মহিলার ফোন বাজছে । হাফসা বেগম সম্ভবত তার স্বামীর সাথে কথা বললেন কেবিন না পাওয়া বিষয়ে , সারা রাত কিভাবে এখানে বসে থাকবেন এ নিয়েও কিছুটা চিন্তিত দেখা গেল তাকে। এশার নামাজ কোথায় পড়বেন এটা নিয়ে উনি বেশী চিন্তিত মনে হল । নীলা ওযু করে ওর রুমে গিয়ে নামাজের প্রস্তুতি নিতে গিয়ে কি মনে করে আবার বাইরে এসে সরাসরি হাফসা বেগমকে বললেন ,তার যদি কোন সমস্যা বা আপত্তি না থাকে তবে তিনি নীলার কেবিনে নামাজ পড়তে পারবেন ।
হাফসা বেগম দেখলেন একটা কেবিনে মেয়েটা একাই তাই আর আপত্তি করলেন না । তার ব্যাগটা নীলার কেবিনে রেখে ওযু করতে চলে গেলেন । নীলা প্রায় পাঁচবছর এই পথে অসংখ্যবার চলাচল করবার জন্যই লঞ্চের প্রায় সব কর্মচারীই ওর পরিচিত হয়ে গেছে । নীলা দেখল সাইফুল চাবির গোছা নিয়ে অন্য কেবিনের দিকে যাচ্ছে , তাই ওকে ডেকে আধঘন্টা পর রুমে টেবিল আর কি মনে করে দুটো প্লেট আর গ্লাস দিতে বলল। সাইফুল ঠিক সময়ে দিয়ে যাবে আর যদি আরও কিছু দরকার হয় জানাতে বলে চলে গেল । নীলা হাফসা বেগমের ফেরার অপেক্ষায় বসে রইল , তিনি এলে দরোজা লাগিয়ে নামাজ পড়তে বসবে এজন্য । হাফসা বেগম এসে গেলে নীলা এক বিছানায় আর হাফসা বেগম অন্য বিছানায় নামাজ পড়তে বসলেন ।
নামাজ শেষ হবার পর নীলা বলল হাফসা বেগমের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে এখানে থাকতে পারে ,কারন কেবিনে দুটো বিছানা থাকেই আর ও তো একা তাই অন্যটাতে হাফসা বেগম অনায়াসেই থাকতে পারেন । হাফসা বেগম এমন অভাবনীয় প্রস্তাব পেয়ে কৃতজ্ঞতায় একেবারে অভিভূত হয়ে গেলেন আর বার বার ধন্যবাদ দিতে লাগলেন নীলাকে। নীলা স্মিত হেসে বলল, “খালাম্মা আপনি আমায় তুমি করি বলুন আর এত কৃতজ্ঞতা দেবার কি আছে যেখানে ওর কেবিনে একটা বিছানা খালিই পরে থাকত” ! কিছুক্ষন পর সাইফুল খাবার টেবিল আর অন্যান্য জিনিস দিয়ে গেল কেবিনে। নীলা বলল , “চলুন খালাম্মা রাতের খাবারটা খেয়ে নেই “।
হাফসা বেগম তার টিফিন ক্যারিয়ার বের করে টেবিলের উপর রাখলেন আর নীলাও। নীলা বলল ওর সন্ধ্যা নদীর ইলিশমাছ পছন্দ বলে মা ওর মামাকে দিয়ে আনিয়ে ভেজে দিয়েছেন রাতে খাবার জন্য আর কিছু হস্টেলে নিয়ে যাবার জন্য । হাফসা বেগমও সায় দিলেন এ ইলিশ স্বাদে অনন্য ।তারা দুজনে দুজনের আনা খাবার ভাগাভাগি করে খেলেন । খাওয়া শেষে নীলা জানতে চাইল হাফসা বেগম কি কোন নাটক বা সিনেমা দেখতে চান কিনা , তাহলে ও রুমের টিভিটা অন করে দিবে।
হাফসা বেগম জানাল নীলার যদি এখনি ঘুম না আসে তবে তিনি একটু কিছুক্ষন বই পড়বেন, লাইটে যদি নীলার সমস্যা হয় তা হলে আর পড়বেন না । নীলা বলল সে নিজেও কিছুক্ষন বই পড়বে তাই কোন সমস্যা নেই। ওর নিজেরও টিভি দেখার অতটা নেশা নেই। নীলা ওর মায়ের দেয়া নকশীকাঁথাটা পায়ের উপর দিয়ে গতবারের বইমেলা থেকে কেনা” যাযাবরের দৃষ্টিপাত” বইটা পড়তে লাগল।
ওর বাবার কাছে এই বইটার কথা অনেক শুনেছে সেই ছোটবেলা থেকে । তাই বেশ আগ্রহ নিয়েই পড়তে লাগল । “বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ , কেড়ে নিয়েছে আবেগ ‘” এই প্রসিদ্ধ লাইনটি তাহলে এই লেখকেরই! নীলা এতদিন জানত না । হঠাৎ ও বই থেকে চোখ তুলে দেখে হাফসা বেগম কি যেন লিখছেন বই থেকে, আবার পড়ছেন । নীলা কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারছিল না। জানতে চাইবে কি , চাইবেনা ভাবতে ভাবতে প্রশ্ন করেই ফেলল অবশেষে।
চলবে……
সম্পূর্ণ গল্পের লিংক