#পিশাচ পুরুষ ৮ম পর্ব
দেখতে দেখতে জঙ্গলের সেই বিশাল বৃক্ষের কোটরে জমা হলো ৬১টি নারীর দেহ। শত গুলো পূরণ হলেই এমন কিছু একটা ঘটবে জঙ্গলে যা শত বর্ষ ধরে এই জঙ্গলের একটা শক্তি চাইছে ঘটুক। যে শক্তির উৎস, লক্ষ্য এখন পর্যন্ত কোনো মানুষ জানতে পারেনি। এমন কী কারো ধারণাও নেই, এখানে কী ঘটতে চলেছে।
আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগের সময়। এই জঙ্গলেরই শেষ মাথায় যে নদী রয়েছে তার পাড়ে একটি গ্রাম ছিল। যেখানে একটা গোষ্ঠীর বিশটির মতো পরিবার বসবাস করত। জঙ্গলে শিকার, বৃক্ষের ফল, উৎপাদিত সবজি দিয়ে খুব ভালো ভাবেই তাদের জীবন কেটে যাচ্ছিল। তাদের কাছ সৃষ্টিকর্তার আলাদা কোনো পরিচয় ছিল না। তাদের পূর্ব পুরুষ কারা, কবে থেকে এই নদীর তীরে তারা বসবাস করে কয়েকজন বৃদ্ধ লোক ছাড়া কেউই সে ইতিহাস জানতো, কারো মধ্যে এধরনের কৌতূহলতাও ছিল না বাইরের জগৎ সম্পর্কে। জঙ্গলকেই তারা প্রভু মানতো। নিজেদের গোষ্ঠীর লোকজন ছাড়া আর কাউকে তারা আপন ভাবতো না।
জঙ্গল খুঁজে যেসব বড়, অদ্ভুত গাছ দেখত সেসবের পুজো করতো তারা। বিপদে সহায়তা চাইতো, উৎসর্গ করতো নিজেদের খাবার। কিন্তু একটা সময় পর তারা বুঝতে পারে তাদের খারাপ সময় কিংবা বিপদে গাছগুলো কোনো সাহায্য করে না। তখনই গোষ্ঠীর মানুষেরা জঙ্গলের খুব ভেতরে একদিন শিকারে গিয়ে একটা বড় গাছের শিকড়ের পাশে সৃষ্টি হওয়া কোটরের মাঝে সন্ধান পায় কিছু বীভৎস, ভয়ঙ্কর মূর্তি। একবার ওগুলোর দিকে তাকাতেই ভয়ে তাদের বুক কেঁপে উঠে। অনুভব করে তারা এমন শক্তিশালী শক্তির উপলব্ধি তারা এর আগে কখনো করেনি।
মূর্তিগুলো এখানে কারা রেখে গিয়েছিল! তারা দল বেঁধে উপস্থিত হয় সেখানে, মূর্তিগুলো তাদের গ্রামের কাছাকাছি জঙ্গলের অংশে নিয়ে গিয়ে লুকায়িত, গুপ্ত এবং সুন্দর একটি জায়গায় মূর্তিগুলো স্থপিত করে। এক প্রকার ভয়েই নিজেদের গ্রামে নিয়ে যেতে পারেনি ওগুলোকে।
এরপর গোষ্ঠীর কেউ কেউ স্বপ্নে দেখতে লাগলো এসব মূর্তিগুলোকে। মূর্তিগুলোর পেছন থেকে এক গায়েবি কণ্ঠ তাদের নানান আদেশ, উপদেশ দিতে লাগলো। বলল, গোষ্ঠীর লোকেরা যাতে মূর্তিগুলোর পুজো করা আরম্ভ করে, তার প্রতিদানে পাবে তারা এমন কিছু যা তাদের কল্পনাতীত। মূর্তিগুলোর দিকে তাকালে এমনিতেও তাদের মনে ভয় আর ভক্তি কাজ করে। তাই দ্রুতই সবাই পিশাচ মূর্তিগুলোর উপাসনা করতে লাগলো। নিজেদের নানান চাহিদা ওগুলোর কাছে জানাতে লাগলো, রোগ বিপদের প্রতিকার চাইলো। এক অলৌকিক শক্তিতে ছেয়ে গেল গ্রাম। গোষ্ঠীর লোকেদের সব রকম সমস্যা দূর হতে লাগলো, অলৌকিক উপায়ে তাদের মনের সব ইচ্ছা পূরণ হতে লাগলো। বন্য হিংস্র জন্তুদের আক্রমনের শিকার, শিকার করতে গিয়ে কেউ না কেউ রোজই হতো। বন্য জন্তুর আদিপত্ত কমতে লাগলো।
তারা তখন এই মূর্তিগুলোর ক্ষমতায় স্তব্ধ মুগ্ধ। অবশ্য তখনো তারা পুরোপুরি পিশাচ পূজারী হয়নি। এরপরেই স্বপ্নাদেশ পেতে লাগলো তারা মূর্তিগুলোর তৃষ্ণা ও ক্ষুধা নিবারণ করতে হবে এই গোষ্ঠীর লোকগুলোকেই। কিভাবে করতে হবে সেই নির্দেশও পেল তারা। প্রথমে বিভিন্ন জন্তু এনে উৎসর্গ করতে লাগলো মূর্তিগুলোর কাছে। এরপরেই জানতে পারলো ওগুলোর উপাসনার জন্য মানুষের রক্ত প্রয়োজন। তারা আতঙ্কিত হয়ে উঠল নিজেদের কথা ভেবে। এরপরেই তারা প্রথম গ্রাম ছেড়ে বের হতে লাগলো। জঙ্গলের আশেপাশের অন্যান্য গ্রামের মানুষদের ফাঁদে ফেলে এখানে ধরে নিয়ে আসতো।
পিশাচ গুলো এরমধ্যেই গ্রামের লোকদের নানান অলৌকিক শক্তি দান করেছিল। শক্তির লোভ আর দাপটে পিশাচ গুলোকে সন্তুষ্ট রাখতে তারা পুরো দমে মানুষ শিকারে বের হয়। এবং উৎসর্গ করতে থাকে ওদের মূর্তির পায়ে। এক সময় এগুলো উপভোগ করতে থাকে তারা। বর্বর হিংস্র হয়ে ওঠে।দিন দিন গোষ্ঠীর লোকেরা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে। প্রায় প্রতি মাসেই এখানে নরবলি হতে লাগলো। কখনো বাচ্চা, কখনো বৃদ্ধা, কিশোরী , যুবক যুবতী।
দেখতে দেখতে ভয়ানক পিশাচ সাধকের গ্রাম হয়ে উঠে এটা। স্বপ্নাদেশ পেয়ে আরো অনেক শক্তিশালী পিশাচ শক্তির সাধনা করে তারা। নিজেরাই কাঠ, মাটি দিয়ে ওগুলোর মূর্তি তৈরি করে , মানুষের রক্তে ভিজিয়ে পূর্ণতা দান করে বাকি পিশাচ মূর্তিগুলোর পাশে স্থাপিত করে। জঙ্গলের এপাশে একটি গ্রামের অস্তিত্ব আছে, কেউ কেউ জানলেও এখানে আসলে কী ঘটে কেউই জানতো না আশেপাশের গ্রামের। তাদের কিছু মানুষ নিখোঁজ হওয়ার পেছনে ওদের হাত থাকতে পারে এটা কল্পনাও আনতে পারেনি কেউ। জঙ্গলটা দুর্গম আর হিংস্র জন্তুতে ভরা ছিল বলে কোনো সাধারণ মানুষও এইদিকে আসতো না।
প্রায় দীর্ঘ একটি সময় কেটে যায়। জঙ্গলের ও মাথার এক কৃষক একদিন জঙ্গলে প্রবেশ করে পথ হারিয়ে ফেলে। হাটতে হাটতে অনেক রাতে চলে আসে জঙ্গলের যেই জায়গাটিতে পিশাচ মূর্তিগুলোর উপাসনা করে গ্রামের লোকেরা সেখানে। দূর থেকে সে আলো দেখে আর মানুষজনের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে সেদিকে এগিয়ে যায়। ভাবে জঙ্গলের এত ভেতরে রাতে কারা কী করছে!
লুকিয়ে লুকিয়ে সেখানে গিয়ে যা দেখল তা তাকে স্তব্ধ করে দিল। বিশাল আকৃতি কয়েকটা ভয়ঙ্কর মূর্তি। ওগুলোর সামনে হাত পা বাধা তিনজন মানুষ হাঁটুমুরে বসে আছে। অদ্ভুত পোশাক, মুখে , শরীরে নানারকম উল্কা আঁকা কয়েকজন মানুষ তাদের ঘিরে আছে। হাতে ধারাল অস্ত্র। বসে থাকা লোকগুলো নেশার ঘোরে গোঁঙাচ্ছে। হঠাৎ করে কেঁপে উঠলো মূর্তিগুলো। উল্কা আঁকা লোকগুলো কিছু একটা বলে চেঁচিয়ে উঠলো। এরপরই অস্ত্রগুলো নামিয়ে আনলো লোকগুলোর ঘাড় বরাবর। মাথা থেকে শরীর আলাদা হয়ে গেল তিনজনেরই। আনন্দে হৈ হৈ করে উঠলো লোকগুলো। বিস্ময়ে লোকটা স্তব্ধ হয়ে গেল। উল্টো ঘুরেই ছুটতে লাগলো লোকালয়ের দিকে।
রাত পেরিয়ে পরদিন রাতে সে গ্রামে ফিরল। তার অবস্থা তখন ভয়ানক কাহিল। গ্রামের লোকেদের কাছে সে বলল, জঙ্গলে কী দেখেছে সে। সবাই আতঙ্কিত হলো এবং অবিশ্বাস্যও লাগলো ঘটনাটা। কিন্তু তার কয়েক ঘন্টা পরেই সে মারা গেল। এরপরই চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো জঙ্গল নিয়ে এই গুঞ্জনটা। কিন্তু কেউই দিনে রাতে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করে কথাটার সত্যতা নিশ্চিত করার সাহস পেল না।
পিশাচ গ্রামে তখন পুরোপুরি বর্বরতার যুগ। এক গ্রাম থেকে বেশি মানুষ তারা ধরে আনে না, জানে একবার আতংক সৃষ্টি হলে অন্য সব গ্রামের মানুষেরা মিলিত হবে একটি দলে। তখন তাদেরই বিপদ। তাই দূরের গ্রাম গুলো থেকে তারা মানুষ শিকার করে। আজ তেমনি তিনজন মানুষ ধরে আনা হয়েছে। দুই জন পুরুষ এবং একজন যুবতী। গোত্রপ্রধান আমন এলেন লোকগুলোকে দেখতে। যুবতী মেয়েটিকে দেখে একেবারেই স্তব্দ হয়ে গেলেন। এত রূপবতী মেয়ে সে এই প্রথম দেখল। মেয়েটার পরনেও ঠিকঠাক মতো পোশাক নেই। প্রবল আকর্ষণ বোধ করলো মেয়েটার প্রতি আমন। সে বলল, উৎসর্গের আগে মেয়েটাকে কিছুক্ষণের জন্য নিয়ে যাবে সে।
কেউ খুশি না হলেও গোত্রপ্রধানের সাথে ঝামেলা করলো না। আমন যুবক বয়সী, নতুন গোত্রপ্রধান। তার বড় ভাই গত এক মাস আগে ঘুমের ভেতর মারা গিয়েছে। আমন সবাইকে বলে, পিশাচ দেবতাদের সাথে বেঈমানি করতে চেয়েছিল তার বড় ভাই তাই তাকে অলৌকিক শক্তি হত্যা করেছে এবং এখন থেকে সেই গোষ্ঠী প্রধান। তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী অবশ্য অভিযোগ করেছিল আমনই নাকি কী এক শক্তি বলে ক্ষমতার লোভে তার বড় ভাইকে খুন করেছে। এরপর থেকে তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী এবং একমাত্র কন্যাকে আর কেউ খুঁজে পায়নি। হাজার হোক গোত্রপ্রধানের বিরোধিতা করা চলে না।
মেয়েটাকে তার ঘরে জোর করে টেনে নিয়ে যায় আমন। স্ত্রীকে ঘর থেকে বের করে দেয়, গভীর রাত পর্যন্ত আবদ্ধ থাকে সে মেয়েটিকে নিয়ে ঘরটিতে। আজ উৎসর্গের রাত। গোষ্ঠীর বাকি লোকেরা উৎসর্গের জন্য মেয়েটিকে নিতে আসলে এমন জানায় সে এই মেয়েটিকে বিয়ে করবে। ওকে কিছুতেই বলি দেয়া যাবে না। আমন নিজেও জানে আজ রাতে তিনজন লোককে বলি না দিলে পিশাচদের পক্ষ থেকে কঠিন বিপদ নেমে আসবে। সে নিজেই ক্ষমতার লোভে একাকী নিজের বড় ভাইয়ের স্ত্রী, কন্যা এবং এই গ্রামেরই তার বিরোধী এক লোককে কিছুদিন আগে গোপনে বলি দিয়েছে।
সে ঘোষণা করলো, উৎসর্গতে কোনো বাধা নেই। এই মেয়েটার বদলে সে তার আগের স্ত্রীকে উৎসর্গ করলো পিশাচের উদ্দেশ্যে। সকলেই হতভম্ব হয়ে গেল আমনের এমন নিষ্ঠুরতা দেখে। নিজেদের লোককে তারা এর আগে প্রকাশ্যে বলি দেয়নি। আমনের বড় ভাইয়ের সময়ে তা গুরুতর অন্যায় ছিল। আমনের স্ত্রী হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। সে রাতে এভাবেই উৎসর্গ সমাপ্ত হলো। যুবতী মেয়েটা নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়ে বিহ্বল হয়ে উঠল এবং আমনের মনোরঞ্জনে ব্যাস্ত হয়ে উঠলো।
আমন সেই মেয়েটিকে বিয়ে করলো। একই ভাবে কয়েক মাস অতিবাহিত হয়ে গেল। মেয়েটাও এরমধ্যে গোষ্ঠীর লোকদের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে। সে খুব দরিদ্র পরিবারে আশ্রিতের মতো ছিল এতদিন গ্রামে। এখানে প্রায় মহারানীর মতো সম্মান আর মর্যাদা তার। সকলেই তাকে ভয় পায়। এই লোভে বশীভূত হলো সে।
আমন সম্প্রতি সময়ে বেশ হতাশায় ভুগতে লাগলো। তার মনে হতে লাগলো তারা শুধু শুধু কষ্ট করে মানুষ শিকার করে পিশাচগুলোকে উৎসর্গ করে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে। সেই তুলনায় পিশাচ গুলো তাদের খুব কম উপকার করে। অলৌকিক শক্তিগুলোও এখন তার কাছে একঘেয়ে লাগে। সে ভাবে এরচেয়ে ক্ষমতাবান কোনো পিশাচ কী আছে! যার শক্তি তাকে আরো ক্ষমতাবান করবে। শুধু এই জঙ্গল নয়। আশেপাশের সব জায়গায় তার প্রভাব থাকবে। তার ভক্তি পিশাচ গুলো থেকে কমতে থাকে, প্রায়ই গোপনে অনুসন্ধান করে জঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে থাকা কোনো মহান শক্তির। ………………………….
.
.
. . . . চলবে . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana