ফ্রিজ পর্ব ১৩
হালকা শীত পড়তে শুরু করেছে। যদিও ঢাকায় খুব একটা শীত নেই। ভোরবেলা কুয়াশাচ্ছান্ন রাস্তা দেখতে বেশ লাগে! মানুষজন নেই ফাঁকা রাস্তা। দুয়েকজন পত্রিকাওয়ালা ছুটছে ব্যস্ত ভঙ্গিতে। বাড়ি বাড়ি কাগজ পৌঁছে দিতে হবে সময়মতো।
ইদের পর পরেই আমরা ফ্রিজটা কিনতে পারতাম। মা বলল, শীতে দামটা আরেকটু পড়বে তখনই না হয় কিনব।
স্কুল থেকে ফেরার সময় দূর থেকে দেখেছি। ফ্রিজের দোকানে বেশ ভালো ছাড় দিয়েছে। অবশ্য ভিতরে গিয়ে দেখতে পারিনি!
স্কুল ছুটির পর দাঁড়িয়েছিলাম আপার অপেক্ষায়। আপার কলেজটা একটু পরেই ছুটি হয়। এই ঘন্টা ধেরেক সময় পরে৷ এতটা সময় অপেক্ষা করতে হয় আপার সাথে আসার জন্য। এমনিতে আমি একা একা চলে আসি। আজ আপার অপেক্ষায় ছিলাম।
হুট করে জুটে গেল টুম্পা। স্কুলের সামনে বড়ো রাস্তাটার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। পেছন থেকে টুম্পার হাঁক। ” রুনু এই রুনু।”
ঘুরে তাকিয়ে দেখলাম ছুটে আসছে টুম্পা। ওর সাথে আমার বেশ খাতির হয়েছে। আজ অবশ্য ওকে দেখে ভালো লাগছিল না! ও সাথে থাকলে ফ্রিজের দোকানগুলো ঘুরে দেখা যাবে না। আজ কী চলে যাব? না আপার জন্য অপেক্ষা করব। ঠিক বুঝতে পারছি না। টুম্পা কাছাকাছি চলে এসেছে।
“কী রে এখনে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
“এমনি। আপার সাথে বাড়ি যাব।”
“খুব ভালো হবে! আমিও আজ তোদের সাথে যাব।”
টুম্পার কথায় মনটা খারাপ হয়ে গেল। আজ আর ফ্রিজের দোকানে যাওয়া হলো না। দূর থেকেই খেয়াল করতে হবে। কয়দিন পর পর ফ্রিজের খবর মাকে পৌঁছে দিতে হয়।
টুম্পা পাশে এসে দাঁড়াল। রাস্তার পাশে একটা গাছ আছে। গাছের নীচে একটা বেঞ্চ পাতা। বেঞ্চে আমরা দুইজন বসলাম। কী গাছ ঠিক বলতে পারছি না। আপা কে জিজ্ঞেস করতে হবে। আপা গাছ ভালো চিনে।
একটু সময় পরে টুম্পা উঠে গেল। রাস্তার ওপারে একটা দোকান আছে। দোকান থেকে আইসক্রিম নিয়ে এসেছে। এ মেয়েটা খালি খাবার নিয়ে হাজির হয়। ওদের বাড়িতে গেলেও একটু পর ছুট দিয়ে এটা সেটা নিয়ে আসে।
আমি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,” এই শীতের মধ্যে কেউ আইসক্রিম খায়!”
“তুই খেয়ে দ্যাখ কেমন লাগে? শোন ঠান্ডার মধ্যে আইসক্রিম খেতে বেশি ভালো লাগে! সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আইসক্রিম খেতে।”
আমি কিছু বললাম না। এ মেয়ের মনে হয় মাথায় একটু সমস্যা হয়েছে! এর সাথে খুব বেশি কথা বলা যাবে না।
আমি আইসক্রিমটা নিয়ে খেতে শুরু করলাম। না, খেতে আসলেই ভালো লাগছে! এখন মনে হচ্ছে ওর মাথায় কোনো সমস্যা নাই। ওর সাথে কথা বলা যায়।
টুম্পার দিকে তাকালাম। গাঢ় নেভি ব্লু রংয়ের স্কুল ড্রেসে পরেছে। গায়ের রংটা আপার মতো দুধে আলতা। গোল গোল চেহারার টুম্পা কে দেখতে বেশ ভালো লাগে! আমার গা ঘেঁষে বসল টুম্পা। কেমন আহ্লাদী গলায় বলল, “আপা কখন আসবে রে রুনু?”
“এসে পড়বে। তুই না হলে চলেই যায়।”
“না আমি আপার সাথেই যাব।”
এ মেয়েটা দেখি আপার ভক্ত হয়ে গেছে! একদিন কিছুটা সময় আপার সাথে কাটিয়েই এ অবস্থা! অবশ্য আপা কেমন করে যেন মানুষ কে আয়ত্ত্ব করে ফেলে। সবাই আপা কে খুব ভালোবাসে।
“রুনু এই রুনু।”
আমি টুম্পার দিকে তাকালাম। বল, কী বলবি?”
“শুক্রবার আমাদের বাড়িতে আসতে পারবি?”
“কেন রে?”
“আমরা একসাথে একটা মুভি দেখব। আপাকেও বলব আসতে, কী বলিস?”
“জানি না রে। মা আসতে দিবে কি-না, কে জানে?”
আমার যাওয়ার খুব একটা ইচ্ছে নাই। শুক্রবারের আগেই আমাদের ফ্রিজটা কিনা হয়ে যাবে। শুক্রবার আমি আর আপা বাসায় আইসক্রিম বানাব। কী করে আইসক্রিম বানাতে হয় আপা সব শিখেছে। টুম্পা কে এ সব কথা বলা যাবে না।
দূর থেকে আপা কে দেখা যাচ্ছে। সাদা কলেজ ড্রেস পরেছে আছে আপা। মনে হচ্ছে একটা সাদা পরী হেঁটে হেঁটে আসছে!
কী সুন্দর করে একটা হাসি দিলো আমাদের দেখে। কাছে এসে বলল, “আরে টুম্পা তুই এখানে?”
“আজ তোমাদের সাথে বাড়িতে যাব বলে বসে আছি।”
“চল, চল।”
আমরা তিনজন পাশাপাশি হাঁটছি। টুম্পা আপার সাথে কী সব গল্প করছে। আমি একটু পেছনে পেছনে হাঁটছি। আমার একটু খারাপ লাগছে, না, অনেকটা খারাপ লাগছে! আপা শুধু টুম্পার সাথেই কথা বলছে।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা ফ্রিজের দোকানগুলোর সামনে আসলাম। আপুর হাঁটার গতি একটু কমে গেল। আমি ফ্রিজের দোকানের ছাড়ের বিজ্ঞানের দিকে তাকালাম। আপুও টুম্পার সাথে কথা বলার ফাঁকে চোরাচোখে একবার তাকাল!
আপু পিছনে আমার তাকিয়ে একটু আলগা করে হাসল। আমি আর আপা বুঝলাম। আমাদের সাথে থাকে টুম্পা কিছুই বুঝল না!
মা কে ফ্রিজের নতুন বিজ্ঞাপনের কথাটা আপুই বলল। আপু খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারে। কী করে যে পারে?
মা শুনে খুব খুশি হলো। মায়ের হাসি হাসি মুখ দেখতে বেশ ভালো লাগছে! কতদিন ধরে অপেক্ষা করছে মা। আজ মনে হয় সেই অপেক্ষার অবসান হলো।
মা বলল,” তাহলে ফ্রিজটা এখন কিনাই যায় কী বলিস তোরা?”
আমি মায়ের সামনে বসে আছি। আপু মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে আছে। আমাদের কী ভালো লাগছে! আপু বলল,” হ্যাঁ, মা এখন কিনেই ফেলো।”
রাতে মা বাবা আসার পর আবার আমাদের ঘরে একটা বৈঠক বসল। এমন করে প্রায়ই আমরা বসি। মা বাবা কথা বলে আমরা দুইবোন শুনি। মা বাবা কে বুঝায় এভাবে করো। বাবা সমস্যা দেখায়। আবার কখনো কখনো মা সমস্যা দেখায়।
আমার মায়ের অনেক বুদ্ধি! বাবাও এ কথা বলে। সব শুনে বাবার মুখেও হাসি ফুটেছে। “তুমি শেষপর্যন্ত ফ্রিজের টাকা জমিয়ে ফেললা!”
মা কিছু বলল না। একটু হালকা হাসি দিলো। এটা মায়ের আত্মতৃপ্তির হাসি।
“তা মোট কতটাকা জমিয়েছ?”
“ত্রিশ হাজার। এতে তো ভালো একটা ফ্রিজ পাওয়া যাবে।”
বাবা বিস্মিত হয়ে বলল, “কী করে যে তুমি এত টাকা জমালে!”
“তুমি আগামীকাল আনোয়ার ভাই কে নিয়ে ফ্রিজটা কিনে আনো।”
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এতদিন ধরে ভাবছি ফ্রিজ কিনতে যাব। আর মা কি-না বলে আমরা যাব না!
“তোমরাও চলো সাথে। “
“না, না, আমি গিয়ে কী করব? ফ্রিজ ঘরে আসলেই হলো।”
“সে তুমি না যাও। মেয়ে দুটি কে সাথে নিয়ে যাবোই।”
“মা একটু গম্ভীর হয়ে বলল, সব কিছু তে ওদের কেন যেতে হবে! মেয়ে মানুষের এত পাড়া বেড়াতে নেই।”
“আঃ! তুমি কী যে বলো না! মনে হয় প্রতিদিন আমরা ফ্রিজ কিনি আর ওরা সাথে যায়। ওদেরও তো সখ টখ আছে নাকি?”
“ঠিক আছে, ঠিক আছে তুমি তোমার মেয়েদের সাথে নিয়ে যেয়ো। “
আপা আর আমি এসেছি আনোয়ার চাচা কে বলতে। আনোয়ার চাচা একটা পাতলা কম্বলের মতো কী যেন গায়ে দিয়ে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে। আমাদের দেখে বই থেকে চোখ তুলে চাচা বললেন, “কী রে খবর তোদের?”
আপার মুখ কেমন হাসি হাসি। চাচা বইটা পাশে রেখে উঠে বসলেন।” আজ তোদের কে খুব খুশি খুশি লাগছে! ঘটনা কী বলত?”
আমি কিছু বললাম না। আপা বলল, “আমরা আগামীকাল ফ্রিজ কিনব চাচা।”
চাচার মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেল! সেটা একমুহূর্তেই আবার পরিবর্তন হয়ে গেল। হাসিমুখে বললেন, ” দারুণ খবর রে! এক কাজ কর। ফ্রিজে মিষ্টি আছে বের কর। তোদের এই খুশিতে মিষ্টি খাই।”
আমি বললাম, ” ডাক্তার না তোমাকে মিষ্টি খেতে বারন করেছেন! মিষ্টি এনোছ কেন?”
“তোদের জন্য এনেছিলাম রে মা। আজ না নিষেধ ফিসেধ বাদ দিই। তোদের সাথে একটু আনন্দ করি। কী বলিস তোরা?”
“আপা বলল, সে না হলো। কিন্তু সামান্য খাবে। আবাট গপাগপ খাওয়া শুরু করো না।”
আপার কথা শুনে আনোয়ার চাচা হেসে ওঠলেন।” না রে সামান্যই খাব।”
আপা ফ্রিজটা খুলে মিষ্টির প্যাকেটা বের করল। একটা পিরিচে কয়েকটা মিষ্টি রেখে চাচার সামনে রাখল। চাচা আধখানা মিষ্টি মুখে দিয়ে বললেন, “নে তোরা খা।”
আমরা মিষ্টি নিলাম। মিষ্টিটা খুব নরম। খেতে কী যে ভালো লাগছে! মুখে দেয়ার সাথে সাথে গলে যাচ্ছে।
চাচা বললেন,” মিলি একটু কফি বানত মা। তোদের দেখে কেমন কফি খেতে ইচ্ছে করছে। “
আপা কফি বানাতে গেল। আমি সোফায় বসে টিভিটা ছাড়লাম। টিভির রিমোট হাতে পেলে শুধু টিপতে ইচ্ছে করে। কোনো চ্যানেল দেখতেই ভালো লাগে না!
আপা কফি নিয়ে হাজির হলো। তিন কাপ কফি বানিয়েছে।
আনোয়ার চাচা কফির কাপটা আলত চুমুখ দিয়ে বললেন, ” তোরা তো ভালো কফি বানান শিখে গেছিস রে! এবার একটা কফিশপ খুললে ভালোই চলবে মানে হয়। “
আপা মিষ্টি করে হাসল। আপার হাসি দেখলে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে! কী সুন্দর করে আপা হাসে!
বের হওয়ার সময় আপা বলল, “চাচা কাল তোমাকে যেতে হবে কিন্তু। “
“যাবো না মানে! অবশ্যই যাব।”
রাতে শুয়ে আছি আপুর পাশে। ঘুম আসছে না! মনে হচ্ছে কখন রাতটা শেষ হবে। কখনো কখনো সময় মনে হয় থেমে থাকে! আজকের রাতটা এত বড়ো লাগছে!
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ