#এক কাপ চা
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ৪৭
(২১৭)
লাশ বাহী ফ্রিজিং গাড়ির সাথেই বেরিয়ে পড়লো বাড়ির সবাই। তাশদীদের বাবাকে নিয়ে যেতে না চাইলেও নিতে হলো কারণ পরিবারের প্রতিটি মানুষ ভীষণ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আছে।
স্নেহাকে বুকের মাঝে লুকিয়ে রেখেছে সাগরিকার মা। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে।শুভ্র ড্রাইভিং করছিল। সাগরিকা তার মায়ের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করেছে।
তাদের সাথে তাশদীদ আসেনি, সে তার বাবা-মায়ের সাথে অন্য গাড়িতে। আরো একটা গাড়িতে মৌসুমির মা সমেত রাশেদ ইখুমরা।
সাগরিকার বাবা পিছন ফিরে বার বার তার মেয়েকে দেখছে। মেয়েটার মুখ একদম শুকিয়ে গেছে। সামিনার লাশ দেখে অসহায়ের মতোন চিৎকার করে কাঁদছিল সে। তার জানা মনে সাগরিকা এতটাও ঘনিষ্ঠ ছিল না সামিনার সাথে তবুও মেয়েটার কান্নায় তার দুচোখ বুজে এসেছিল।
আজ তাদের পরিবারের অনেক কিছুই সবার সামনে এসেছে। তার থেকে কায়সার বয়সে খুব একটা বড় ছিল না।বছর খানেকের ব্যবধান ছিল।কায়সার বড় হওয়া স্বত্বেও তাকে ভাই বলে ডাকেনি সে। অথচ সামিনার প্রতি যথেষ্ট সম্মান দেখিয়েছে। বিদেশ তো তার যাওয়ার কথা ছিল।দুই ভাই এক সাথেই পাসপোর্ট করলো। অথচ তার যাওয়া হয়নি।বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসায় তখন লসের হিসেবটাই বেশি।বড় ভাই একা এসব সামাল দিতে পারবে না বলেই তাকে থেকে যেতে হলো।সাগরিকার মা কে যে মাসে বিয়ে করে ঘরে তুলল,সে মাস ছিল আষাঢ় মাস। বৃষ্টির এক বিকেলে পিয়ন এসে চিঠি দিয়ে গেল তার হাতে। সেই চিঠিতে ছিল শুধু তামাশার কথা।
সাগরিকার বয়স যখন বারো তখন কায়সার বিয়ে করছিল।কায়সার এরপর তার স্ত্রী, মেয়েটাকে কার কাছে আমানত রেখে গেল সে?
নিশ্চুপে কেঁদেই চলল সে।
দীর্ঘ উনিশ বছর পর আজ তার সিগারেট এর তেষ্টা পাচ্ছে। সাগরিকা জন্মানোর পর থেকে সে একটা সিগারেটও খায়নি, মেয়ের মুখ দেখলেই তার সব কষ্ট দূর হয়ে যায় তবুও আজ তার বড্ড কষ্ট হচ্ছে।
পেট্রোল পাম্পের পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে শুভ্র ছুটলো পানির উদ্দেশ্যে। তাকে দৌঁড়ে যেতে দেখে গাড়ি থামালো তাশদীদ। কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেল সাগরিকা বমি করছে আর তার বাবা তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটার চুল গুলো খুলে পুরো পিঠে ছড়িয়ে পড়েছে। তাশদীদ এগিয়ে এসে এক হাতে সাগরিকাকে শক্ত হাতে আবদ্ধ করলো। অন্য হাতে শুভ্রর থেকে পানির বোতল নিয়ে সাগরিকাকে বলল,
” কুলকুচা করে ফেলে দাও।”
কিন্তু তাশদীদকে অগ্রাহ্য করে সেই পানি খেয়ে ফেলল সাগরিকা।এমনটা হবে আগে থেকেই জানতো সে। মুখে চোখে পানি দিয়ে এনে সাগরিকাকে বসালো গাড়িতে। নিজ হাতে চুল বেধে দিয়ে বলল,
“দুপুরে কিছু খাওনি তো। কিছু খাবে?”
দু পাশে মাথা নাড়িয়ে সাগরিকা না বলল।পুনরায় তাশদীদ জিজ্ঞেস করলো,
“আমার সাথে যাবে?”
“আপনি যান। ওই গাড়িতে বাবা আর দাদু রয়েছে। দুই জন অসুস্থ মানুষ নিয়ে যাচ্ছেন।”
তাশদীদ কোনো জবাব দিলো না। সাগরিকার মাথায় হাত রেখে শুভ্রের উদ্দেশ্যে বলল,
“এসি চালানোর দরকার নেই। গ্লাস খুলে দিস। আর হ্যাঁ একটু সাবধানে আসিস। গ্রামের পথ তো।ঝাঁকুনি যেন কম লাগে।”
পাশ ফিরেই সাগরিকার বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
“কাকা আপনি কিছু টক ফল কিংবা খাবার কিনে নিয়ে আসুন।স্নেহাও কিছু খায়নি।আমরা এগিয়ে যাচ্ছ আপনারা ধীরে ধীরে আসুন।”
সামিনার লাশের সাথে এসেছিল মুনির এবং তাজবীদ। তারা পৌঁছে অপেক্ষা করতে লাগলো।বাকী সবাই পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে। সেদিন দাফন করা সম্ভব নয়, কারণ সামিনার এখনো কাফন হয়নি। বিস্তৃত খোলা উঠানের মাঝে রাখা হয়েছে গাড়িটা। গাড়ির ভিতরেই এক রাত রাখা যাবে এমন ব্যবস্থা করে নিয়ে এসেছে।পুরো উঠানে আলোর খেলা চলছে।গ্রামের মানুষ আসছে, কথা বলছে। কেউ বা নিজ থেকেই কোর-আন শরীফ পাঠ করছে।
লাশ পাহাড়া দেওয়াটা গ্রামের মানুষের কাছে নতুন নয়। বাড়ির বান্ধা কাজের লোকগুলো লেগে আছে খেদমতে। রাত গড়িয়ে ভোর হতে চলল ঠিক সেই সময় নিজ রুমে ফিরলো তাশদীদ।সাগরিকা নিজ বিছানায় উবু হয়ে শুয়ে আছে। ফ্রেশ হয়ে এসে তার পাশে আস্তে-ধীরে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সে।
দরজায় ঠকঠক শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল তার।
মুনির, শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চেহারায় বিরক্ত ফুটে উঠেছে।
মুনির কিছু বলার পূর্বেই তাশদীদ ইশারা করে বলল বাইরে যাবে তারা। মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। তাদের অপেক্ষা করতে বলে ফিরে এলো বিছানার কাছে। ঘুমন্ত মেয়েটার গায়ে চাদর টেনে দিয়ে বেরিয়ে গেল সে।
(২১৮)
এত রাতে কোনো আসামীর সাথে দেখা করার অনুমতি কারা কর্তৃপক্ষ কাউকে দিতে চান না।কিন্তু এই অনুমতি এসেছে উপর মহল থেকে।আজ বিকেলে গ্রেফতার কৃত মহিলা আসামীর সাথে দেখা করতে এসেছে কেউ।
চোখ মুখে ঘুম নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জুলি।সামনে রয়েছে তার ছোটো বোন।আজ দীর্ঘ পনেরো বছর পর তাদের দেখা।
বোনের দুই হাত ধরে জুলি বলল,
“এখানে কেন এসেছো? জানো না, কোনো আসামীকে অপরাধে সাহায্য করাটাও অপরাধ। তুমি কেন এসেছো?”
“তুমি আর বাবা ছাড়া আমার আর কে আছে?”
” তোমার নিজের সন্তান আছে, স্বামী আছে।”
“আমি তাদের ছাড়তে চাচ্ছি এটাও তুমি জানো।”
“না তুমি তাদের ছাড়বে না।তুমি কী ভুলে গেছো?একটা পরিবার মানে একটা রহমত।পরিবার ভাঙ্গা মানে অনেক কিছু।সামান্য ভুল বুঝাবুঝি জন্য এসব করো না।পরিবার মানেই আপনজন।”
“তাহলে তুমি কী করেছো আপু?তুমি একটা পরিবারকে ভেঙ্গে চূর্ণ করে দাওনি?স্নেহার কী হবে?”
বোনের কথায় জুলির চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।সে কাঠ কাঠ গলায় জবাব দিলো,
“আমি যা করেছি আমার নিজের জন্য করেছি।নিজ শান্তির জন্য।”
“যেদিন কায়সার ভাই বিয়ে করলো সেদিন তোমার ফিরে আসা উচিৎ ছিল।অথবা তাকে তোমার উপস্থিতি জানান দেওয়া।”
“সে বলেছিল হাজার মাইল দূরে থেকেও আমাকে বুঝতে পারে সে। তাই আমি কখনো তার সামনে যাইনি। তাকে পরিচয় দেইনি।”
“প্রেমে পড়ে আবেগের কথাগুলো বিশ্বাস করে নিজের সব শেষ করে দিলে?”
“তুমি চলে যাও। এখন থেকে আমার কাছে আর আসবে না।বাবাকে দেখে রেখো।”
জুলির সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে এটা জেল সুপার কল দিয়ে জানিয়েছে শুভ্রকে। আর জুলির জামিনের চেষ্টা করা হচ্ছে এটা মুনিরের বন্ধু জানালো।সবটা শোনার পর তাশদীদ বলল,
“আগে কাকীর দাফন হোক তারপর বাকীটা দেখা যাবে।অন্তত এটুক নিশ্চিত করবো যেন ফাঁসি ব্যতীত অন্য কোনো শাস্তি না হয়।”
(২১৯)
সামিনাকে শেষ গোসল করানোর জন্য নেওয়া হয়েছে। কবর স্থানে কবর খোড়া সম্পন্ন করেছে। কেউ বা বাঁশ কাটছে কেউ বা খাটিয়া আনতে যাচ্ছে।বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব দেখছিল সাগরিকা।বড়ই,নিম পাতা দিয়ে গরম পানি করা হচ্ছে। তার মা করছে সেসব।মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“মা আমি কাকী কে গোসল করাবো।”
মেয়ের এহেন কথায় চমকে উঠেছে সাগরিকার মা।ধমক দিয়ে বললেন
“এসব পাগলামো করো না।যাও ঘরে যাও। বিশ্রাম নাও।”
“আমি করাবো মা।”
“অনেক নিয়ম-কানুন মানতে হয় মা।এসব তুমি পারবে না।”
“যারা থাকবে তারা দেখিয়ে দিবে না হয়।”
মেয়ের এমন জেদ শুনে সাগরিকার বাবা, তাশদীদ এগিয়ে এলো।শুভ্র কড়া চোখে নিষেধ করলো।সবার কড়া আদেশ সাগরিকা পাত্তা দিলো না। সে নিজের মতামত জানিয়ে দিয়েছে। উপায়ন্তর না দেখে তাশদীদ সাগরিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“তুমি কি জানো এমন পাগলামো করাটা বোকামী হচ্ছে।কাকীর ময়নাতদন্ত হয়েছে। তার শরীরে অনেক কাটা দাগ।”
“আপনি কী ভাবছেন আমি ভয় পাবো?”
“তুমি অনেক দিন এসব ভুলতে পারবে না।”
“আমাদের নারী জীবনটাই এমন।আজ মৃত তার শরীরের কাটা দাগ আছে এটা সবাই জানেন অথচ জীবিত থাকতে যে তার দেহে অসংখ্য অদৃশ্য কাটা দাগ ছিল?সে সব আপনাদের চোখে লাগেনি কেন?”
চলবে…..